‘এই আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নেই’
রিপন দে | ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২১:২৫
সাবেক ছাত্রনেতা, সাবেক সংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহাদ ১৯৬৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সুলতান মোহাম্মদ মনসুর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন।
এ কারণে জীবনের বড় একটা সময় কাটাতে হয়েছে ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে আত্মগোপনে। ১৯৭৫’র পট পরিবর্তনের কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক যে জয় আসে তা ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের আহমদের হাত ধরে।
সেই জয়ের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে ’৭৫-এর পর প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি স্থান পায় ডাকসু ভবনে। সৎ, পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি সুলতান মনসুর মেধাবী, আদর্শবান ও পরীক্ষিত ছাত্রনেতা হিসেবে ৮০’র দশকে সাড়া জাগিয়েছিলেন।
মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে পরপর ৩ বার নির্বাচন করেছেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে তার সক্রিয় রাজনীতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আলোচিত ১/১১-এর পর সংস্কারপন্থী হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা হয়। ২০০৮ সালে তৃণমূল থেকে একক প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েও দলের মনোনয়ন পাননি। ১২ বছর ছিলেন রাজনীতির বাইরে।
সেই সুলতান মনসুর বর্তমানে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে সাংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ধানের শীষ প্রতীকে। মুজিব কোট গায়ে ধানের শীষে ভোট চাইতে চষে বেড়াচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় প্রয়াত জাতীয় নেতাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণের পাশাপাশি শোনাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিএনপির নেতাকর্মীদের সামনে স্লোগান দিচ্ছেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।
এর সঙ্গে তিনি বলছেন ‘জয় ধানের শীষ’। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে পোস্টার, ব্যানারও ব্যবহৃত হচ্ছে তার নির্বাচনী প্রচারে। সম্প্রতি কুলাউড়ায় নিজ বাসভবনে তিনি কথা বলেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে-
দেশ রূপান্তর: নৌকার সুলতান কেন আজ ধানের শীষে?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ষড়যন্ত্র করে আমাকে যখন রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হলো, তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি হলো, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া, অন্যটি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা। রাজনীতি না করে মানুষ থেকে দূরে সরে থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। এ কারণে দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছি। আমি আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসিনি বরং আওয়ামী লীগ আমাকে ছেড়েছে। দীর্ঘ কয়েকটি বছর আমার রাজনৈতিক জীবন বন্দী করে রাখা হয়েছিল।
৭৫-পরবর্তী রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভূমিকা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমার অবস্থান, দল ও তৃণমূলে জনপ্রিয়তা, আমার সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি আমি। আমার পদ কেড়ে নেয়া হয়, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
দেশ রূপান্তর: ঠিক কী ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে একমাত্র মৌলভীবাজার-২ আসনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা একক প্রার্থী হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আমাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। কেন দেওয়া হয়নি তা আমি জানি না। সে সময় আমি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে প্রথম এক সপ্তাহ আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। সাত দিন চেষ্টার পর নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়।
তখন আমি দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে বললাম, ‘আপা, প্রস্তাবে আমার নাম তো একা এসেছিল, অন্য কারো নাম আসেনি। কেন আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয় নাই?’
তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘একবার এমপি না হয়ে দেখ কেমন লাগে!’ আমি জানি না তিনি কেন এমন উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু এমপি হওয়া তো কোনো চাকরি না যে আমি চাকরি করব।
রাজনীতি একটি আদর্শ, আমি ১৯৬৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করি। কোনো হুমকি বা বাধা-বিপত্তি বা কোনো লোভ-লালসা আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারবে না, আজীবন মুজিব কোট গায়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে মানুষের সেবা করে যাব।
দেশ রূপান্তর: তারপর আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন কেন?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ’৭৫ এ যখন অনেকে লোভে বা কেউ ভয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান, তখন আমি সুলতান রাজপথে ছিলাম। মৃত্যুকে পরোয়া না করে স্বাধীনতাবিরোধী এবং তাদের দোসরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সারা জীবন রাজপথে লড়াই করে মুজিব আদর্শের জানান দিয়েছি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি, প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। সেই প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ কয়েক বছর পাহাড়ে কাটিয়েছি। এরপর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশব্যাপী ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছি।
আমার রাজনীতির জীবন কেটেছে রাজপথের উত্তাল পিচঢালা পথে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে। মাত্র পাঁচ বছর, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকারি দলে ছিলাম।
তখন সারা দেশ ঘুরে দলকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে তুলতে তৎপর থেকেছি। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করা সেই রাজনীতি ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমি ফের সক্রিয় রাজনীতি শুরু করি।
দেশ রূপান্তর: ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ কীভাবে করেছিলেন?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে সিলেট থেকে প্রথম সশস্ত্র প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম আমি।
সারাদেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টুঁ-শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে কাঁপিয়েছি। সেই সময়ে দেশব্যাপী ১০৪ জন শহীদ হয়েছিলেন।
আমিও মারা যেতে পারতাম, কিন্তু মৃত্যুকে পরোয়া না করে সারা দেশ ও বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর বাংলার সব সন্তান বেইমান হয়ে যায়নি।
সেদিন জীবনবাজি রেখে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর মান উজ্জ্বল হয়। বিশ্ববাসীর টনক নড়ে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশের ভেতরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হচ্ছে। সেই প্রতিরোধের কারণে শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে জীবন বাঁচাতে এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে দীর্ঘ চারটি বছর না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, নির্ঘুম অনেক রাত কাটিয়েছি ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে পাদদেশে ঘন বনাঞ্চল ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়।
সবশেষে ধানের শীষকে কেন বেছে নিলেন?
সেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করেও পরে দলে থাকতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা বর্তমান সরকারে। বঙ্গবন্ধুকে বলে গালি দিত যে নেতা সে এখন মন্ত্রী হিসেবে এই সরকারে আছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যিনি উল্লাস করেছিলেন, তিনি এখন মন্ত্রিসভায়।
এই সরকার লুটেরার সরকার। কিছু সুবিধাবাদী, কালোবাজারি, টাকাওয়ালা, এই সরকারে আছে। এই আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নেই। এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ নয়।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি সারা জীবন করে যাব। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সংগ্রাম ছিল মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য। সেই অধিকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ঐক্যফ্রন্টের পতাকাতলে সমবেত হয়ে প্রতিটি বাঙালি জেগে উঠবে। জনগণের অধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
রিপন দে | ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ২১:২৫

সাবেক ছাত্রনেতা, সাবেক সংসদ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহাদ ১৯৬৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সুলতান মোহাম্মদ মনসুর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন।
এ কারণে জীবনের বড় একটা সময় কাটাতে হয়েছে ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে আত্মগোপনে। ১৯৭৫’র পট পরিবর্তনের কঠিন সময় পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রথম আনুষ্ঠানিক যে জয় আসে তা ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের আহমদের হাত ধরে।
সেই জয়ের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে ’৭৫-এর পর প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি স্থান পায় ডাকসু ভবনে। সৎ, পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি সুলতান মনসুর মেধাবী, আদর্শবান ও পরীক্ষিত ছাত্রনেতা হিসেবে ৮০’র দশকে সাড়া জাগিয়েছিলেন।
মৌলভীবাজার-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে পরপর ৩ বার নির্বাচন করেছেন, ১৯৯৬ সালে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলনে তার সক্রিয় রাজনীতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আলোচিত ১/১১-এর পর সংস্কারপন্থী হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করা হয়। ২০০৮ সালে তৃণমূল থেকে একক প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েও দলের মনোনয়ন পাননি। ১২ বছর ছিলেন রাজনীতির বাইরে।
সেই সুলতান মনসুর বর্তমানে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে মৌলভীবাজার-২ আসনে সাংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন ধানের শীষ প্রতীকে। মুজিব কোট গায়ে ধানের শীষে ভোট চাইতে চষে বেড়াচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রতিটি নির্বাচনী জনসভায় প্রয়াত জাতীয় নেতাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণের পাশাপাশি শোনাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিএনপির নেতাকর্মীদের সামনে স্লোগান দিচ্ছেন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’।
এর সঙ্গে তিনি বলছেন ‘জয় ধানের শীষ’। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে পোস্টার, ব্যানারও ব্যবহৃত হচ্ছে তার নির্বাচনী প্রচারে। সম্প্রতি কুলাউড়ায় নিজ বাসভবনে তিনি কথা বলেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে-
দেশ রূপান্তর: নৌকার সুলতান কেন আজ ধানের শীষে?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ষড়যন্ত্র করে আমাকে যখন রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হলো, তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। একটি হলো, রাজনীতি ছেড়ে দেওয়া, অন্যটি রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা। রাজনীতি না করে মানুষ থেকে দূরে সরে থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। এ কারণে দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছি। আমি আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসিনি বরং আওয়ামী লীগ আমাকে ছেড়েছে। দীর্ঘ কয়েকটি বছর আমার রাজনৈতিক জীবন বন্দী করে রাখা হয়েছিল।
৭৫-পরবর্তী রাজনীতিতে আমার সক্রিয় ভূমিকা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমার অবস্থান, দল ও তৃণমূলে জনপ্রিয়তা, আমার সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি আমি। আমার পদ কেড়ে নেয়া হয়, রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
দেশ রূপান্তর: ঠিক কী ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনের মধ্যে একমাত্র মৌলভীবাজার-২ আসনের তৃণমূল নেতাকর্মীরা একক প্রার্থী হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আমাকে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। কেন দেওয়া হয়নি তা আমি জানি না। সে সময় আমি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে প্রথম এক সপ্তাহ আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। সাত দিন চেষ্টার পর নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়।
তখন আমি দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে বললাম, ‘আপা, প্রস্তাবে আমার নাম তো একা এসেছিল, অন্য কারো নাম আসেনি। কেন আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয় নাই?’
তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘একবার এমপি না হয়ে দেখ কেমন লাগে!’ আমি জানি না তিনি কেন এমন উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু এমপি হওয়া তো কোনো চাকরি না যে আমি চাকরি করব।
রাজনীতি একটি আদর্শ, আমি ১৯৬৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করি। কোনো হুমকি বা বাধা-বিপত্তি বা কোনো লোভ-লালসা আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারবে না, আজীবন মুজিব কোট গায়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে মানুষের সেবা করে যাব।
দেশ রূপান্তর: তারপর আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হলেন কেন?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ’৭৫ এ যখন অনেকে লোভে বা কেউ ভয়ে বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান, তখন আমি সুলতান রাজপথে ছিলাম। মৃত্যুকে পরোয়া না করে স্বাধীনতাবিরোধী এবং তাদের দোসরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সারা জীবন রাজপথে লড়াই করে মুজিব আদর্শের জানান দিয়েছি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছি, প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। সেই প্রতিবাদের কারণে দীর্ঘ কয়েক বছর পাহাড়ে কাটিয়েছি। এরপর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশব্যাপী ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছি।
আমার রাজনীতির জীবন কেটেছে রাজপথের উত্তাল পিচঢালা পথে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে। মাত্র পাঁচ বছর, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকারি দলে ছিলাম।
তখন সারা দেশ ঘুরে দলকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে গড়ে তুলতে তৎপর থেকেছি। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করা সেই রাজনীতি ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমি ফের সক্রিয় রাজনীতি শুরু করি।
দেশ রূপান্তর: ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ কীভাবে করেছিলেন?
সুলতান মোহাম্মদ মনসুর: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে সিলেট থেকে প্রথম সশস্ত্র প্রতিবাদ মিছিল করেছিলাম আমি।
সারাদেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টুঁ-শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে কাঁপিয়েছি। সেই সময়ে দেশব্যাপী ১০৪ জন শহীদ হয়েছিলেন।
আমিও মারা যেতে পারতাম, কিন্তু মৃত্যুকে পরোয়া না করে সারা দেশ ও বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলাম যে, বঙ্গবন্ধুর বাংলার সব সন্তান বেইমান হয়ে যায়নি।
সেদিন জীবনবাজি রেখে যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর মান উজ্জ্বল হয়। বিশ্ববাসীর টনক নড়ে যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দেশের ভেতরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হচ্ছে। সেই প্রতিরোধের কারণে শাসকদের চক্ষুশূলে পরিণত হয়ে জীবন বাঁচাতে এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে দীর্ঘ চারটি বছর না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, নির্ঘুম অনেক রাত কাটিয়েছি ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে পাদদেশে ঘন বনাঞ্চল ঘেরা দুর্গম পাহাড়ি এলাকায়।
সবশেষে ধানের শীষকে কেন বেছে নিলেন?
সেই আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করেও পরে দলে থাকতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা বর্তমান সরকারে। বঙ্গবন্ধুকে বলে গালি দিত যে নেতা সে এখন মন্ত্রী হিসেবে এই সরকারে আছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যিনি উল্লাস করেছিলেন, তিনি এখন মন্ত্রিসভায়।
এই সরকার লুটেরার সরকার। কিছু সুবিধাবাদী, কালোবাজারি, টাকাওয়ালা, এই সরকারে আছে। এই আওয়ামী লীগ আর সেই আওয়ামী লীগ নেই। এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ নয়।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি সারা জীবন করে যাব। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সংগ্রাম ছিল মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকারের জন্য। সেই অধিকারের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। ঐক্যফ্রন্টের পতাকাতলে সমবেত হয়ে প্রতিটি বাঙালি জেগে উঠবে। জনগণের অধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে।