আত্মসমর্পণ প্রবণতায় নিমজ্জিত সমাজেই আবরাররা খুন হয়
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের জন্ম ১৯৫৯ সালে ঢাকায়। একসময় ছাত্ররাজনীতি ও শ্রমিকরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা। এছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গণহত্যা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সক্রিয় কর্মী তিনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড এবং দেশের সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : স্বাধীন মতামত প্রকাশের কারণে দেশে মানুষ খুন হচ্ছে। একসময় উগ্রবাদী মতাদর্শে দীক্ষিত গোষ্ঠীর হামলায় এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মতপ্রকাশের মতো মৌলিক মানবাধিকারের এমন লঙ্ঘন হচ্ছে কেন?
নূর খান লিটন : আমরা যদি এ বিষয়ে গত দশ বছরের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করি তাহলে দেখব, একসময় উগ্র মতবাদে বিশ্বাসীরা উগ্রপন্থায় মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশকে স্তব্ধ করে দেওয়ার, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমরা যেমন ব্লগারদের হত্যা করতে দেখেছি তেমনি রাষ্ট্রের তরফ থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে, লেখালেখির কারণে মতপ্রকাশের কারণে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করতে দেখেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নানা আইনকানুন দেখিয়ে মানুষকে হয়রানি করেছে, গ্রেপ্তার ও মামলা করে মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে এমনকি রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও এই বিষয়গুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নানাভাবে গণমাধ্যমসহ নানা জায়গায় নিয়ে এসেছেন। ফলে কেবল হামলা, হত্যাচেষ্টা বা হত্যাকাণ্ডই নয় নানাভাবেই সমাজে ও রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে, মতপ্রকাশের পরিসরকে সংকুচিত করা হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : একটা রাষ্ট্রে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিসরেও স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য কাউকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় সেখানে সাধারণ মানবাধিকার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন আপনি?
নূর খান লিটন : বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির বিষয়ে নিজের মতপ্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত মানুষ বিশ্বাস করে যে এই স্ট্যাটাসের কারণেই তাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বুয়েটের কিছু নেতাকর্মী নির্মমভাবে নির্যাতন করে, পিটিয়ে হত্যা করেছে। যে কক্ষে নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয় সেখান থেকে লাশটিকে তারা বাইরে নিয়ে সিঁড়ির কাছে ফেলে রাখে। আমরা সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি সেখানে পুলিশ এলেও প্রথমে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি এমনকি শিক্ষকদের সঙ্গেও তারা ভালো আচরণ করেনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের এমন নির্মমতার কারণ কী? আসলে রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারা যখন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যান বা জবাবদিহি হতে চান না; এবং যে দেশে নির্বাচন নির্বাচন নাটকের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করা হয় এবং যখন জনগণ আর ভাগ্য নির্ধারক থাকে না, সেখানে কর্র্তৃত্ববাদী শাসন বা ফ্যাসিজম তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বা এমন ঘটনা ঘটলেও সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। যদিও প্রবল জনমতের চাপে এক্ষেত্রে হয়তো তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টা আমরা লক্ষ করছি, কিন্তু সাধারণ মানুষ সে বিষয়ে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
দেশ রূপান্তর : রাষ্ট্রীয় আইনে স্বাধীন মতপ্রকাশে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। বিতর্কিত ৫৭ ধারার পর এখন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বা ৩২ ধারা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কি তাহলে উল্টোপথে হাঁটছে বলে মনে করেন?
নূর খান লিটন : দেখুন, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতি যখন দুর্বৃত্তদের দখলে চলে যায়, দুর্বৃত্তায়িত হয়ে যায়, রাজনীতিতে তখন আর নীতি-আদর্শের চর্চা থাকে না। আদর্শহীন রাজনীতি যখন সমাজ-রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে থাকে তখন এক ধরনের অন্ধ-কানা জন্ম দেয়; যারা দলদাসে রূপান্তরিত হয়। সেটি বুদ্ধিজীবী শ্রেণিই হোক বা বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মানুষই হোক। সারা দেশে এমন দলদাস দেখা যাচ্ছে আমরা যারা সত্য কথা বলতে ভয় পাই; যদি ‘নেতা’ কিছু মনে করেন। যদি ‘নেতা’ কিছু মনে করেন, তাহলে আমার ব্যক্তিজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে, বা আমার আকাক্সক্ষা পূরণে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, কিংবা আমি হয়তো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পরি। এসব কারণে সমাজের সব ক্ষেত্রেই একটা আত্মসমর্পণ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আত্মসমর্পণ প্রবণতায় নিমজ্জিত সমাজেই আবরাররা খুন হয়। এ প্রসঙ্গে আমি একটা ঘটনার উদাহরণ দিতে চাই। কিছুদিন আগে সিলেটে খাদিজা নামের একটি মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আক্ষেপ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি ‘এত মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে, ছবি তুলেছে কেউ একজনও এগিয়ে গিয়ে প্রতিরোধ করেনি!’ এই পরিস্থিতি আসলেই সমাজের এক ভয়াবহ সংকট। এই বিষয়ে আমি বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে- সমাজ কেন আজ এমন ভয়ের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতির দিকে চলে গেছে যে, যেখানে মানুষ এখন স্বাভাবিকভাবে প্রতিবাদ করতেও সাহস পায় না, পালিয়ে বেড়ায়, আত্মসমর্পণ প্রবণতায় নিমজ্জিত হয়।
দেশ রূপান্তর : স্বাধীন মতপ্রকাশের দায়ে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মতোই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মতপ্রকাশের কারণে আবরার ফাহাদকে হত্যা করে তখন ছাত্রলীগকে কি আর গণতান্ত্রিক সংগঠন বলা যাবে? তাহলে উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে ছাত্রলীগের কী পার্থক্য থাকল?
নূর খান লিটন : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কি এই সমাজের বিচ্ছিন্ন কোনো অংশ? এই রাজনীতির বিচ্ছিন্ন কোনো অংশ? যে রাজনীতি নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে, যে রাজনীতি নৈতিকতা বর্জিত হয়ে মানুষকে আর মানুষ হিসেবেই মর্যাদা দেয় না ছাত্রলীগ কি তা থেকে বিচ্ছিন্ন? মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিলে তো তারা জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনোরকম বাধা প্রদানের সুযোগ দিত না। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে এই ছাত্ররাই তো দেখেছে, কীভাবে রাতের আঁধারে ভোটের ক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যায়, এরাই তো দেখেছে কীভাবে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকা যায়, এরাই তো দেখেছে কীভাবে রাজনীতির নামে দুর্নীতি-লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়া যায়। সেক্ষেত্রে শুধু বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্রলীগকে বা রাজনীতির কতিপয় মানুষকে আমি চিহ্নিত করতে রাজি না। আমি মনে করি এখন সময় এসেছে সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলোকে বিবেচনা করার, এমন দুর্বৃত্তদের যারা রাজনীতিতে আশ্রয় দিয়েছে, বেড়ে উঠতে দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করার। সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে দেখে সংকটাপন্ন এই ব্যবস্থাটাকে পাল্টে ফেলার।
দেশ রূপান্তর : আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের আলোচনায় উঠে এসেছে ২০১২ সালে পুরান ঢাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের কথা, ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত আবু বকর সিদ্দিকের কথা। সবাই বলছেন, নৃশংস এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে আজ বুয়েটে আবরারকে প্রাণ দিতে হতো না।
নূর খান লিটন : এ ধরনের আরও বেশ কিছু ঘটনা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের নামে শীতের ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখার পর ওই নির্মম নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে একটি ছেলে মারা যায়। বিভিন্ন স্থানে এরকম আরও অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন-হত্যাকাণ্ডের কথা বলা যাবে। কিন্তু আমি এই বিষয়ে শুধু একটি কথা বলতে চাই। ছাত্রলীগের তো অভিভাবক রয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে ছাত্রলীগ যে মতাদর্শের অনুসারী তার নেতানেত্রীরা রয়েছেন। ছাত্রলীগের অভিভাবক চাইলে কি পারেন না এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে?
দেশ রূপান্তর : আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বিশেষত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী বা সমর্থক নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে আবরার ইসলামী ছাত্রশিবির করতেন, তিনি ফেইসবুকে নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠীর পেইজে লাইক দিতেন। আবার যারা এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত তাদের সম্পর্কেও বলা হচ্ছে যে এরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ছদ্মবেশী শিবির। প্রশ্ন হলো একজন শিক্ষার্থী বা যে কেউ এমনকি কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন করলেও কি তাকে এভাবে হত্যা করাটা বৈধ হয়ে যায়?
নূর খান লিটন : দেখুন, যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নিই, আবরার শিবিরের সমর্থক বা এমনকি কর্মীও হয়, তাহলেই কি তাকে এভাবে হত্যা করাটা আইনসম্মত হয়ে যাবে? রাষ্ট্রীয় কোনো আইন কি এমন হত্যার অনুমতি দেয়। কোনোভাবেই দেয় না। কারোর বিরুদ্ধে যদি রাজনৈতিক বা ফৌজদারি কোনো অপরাধের অভিযোগ থাকে তাহলে সেটার সুরাহা করার জন্য দেশে আইন আদালত আছে। এমন যে কোনো হত্যাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সেটা দেশব্যাপীই চলছে। আর ছাত্রলীগের বিষয়ে কী বলব। কয়েকদিন আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে অপসারণের নির্দেশ দিলেন। আসলে প্রধানমন্ত্রী হয়তো একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কদিনের মধ্যেই তো আমরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখলাম। এই প্রশ্নের উত্তর তাদেরই খুঁজতে হবে যে কেন ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
দেশ রূপান্তর : আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে ‘ছাত্ররাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। অবশ্য এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এমন দাবির কথা শোনা গেছে। আপনি কি মনে করেন যে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এই সংকট সমাধান করতে পারবে?
নূর খান লিটন : শুধু ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে কোনো সমাধান আসবে না। সমাধান করতে হলো গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। আর সেই সংস্কারটি শুরু করতে হবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভেতর থেকে। কারণ দীর্ঘ দশ বারো বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে সবাই না হলেও অবশ্যই কিছু রাজনীতিবিদ দানবে পরিণত হয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে অপসারণ করে যে শুদ্ধি অভিযানের সূচনা করলেন তাতে অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু বুয়েটের এই হত্যাকাণ্ড তো সেটাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল। আর যুবলীগ এবং ক্যাসিনো-জুয়ার আসরে যে অভিযান চালানো হয়েছে সেটা কতটা সফল তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কেননা এমন শুদ্ধি অভিযান তখনই সফল বলা যাবে যখন তা সর্বব্যাপী হবে। অর্থাৎ যারা দুর্নীতি করেছেন, অপরাধ করেছেন সবাইকে যখন বিচারের আওতায় আনা যাবে।
শেয়ার করুন
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটনের জন্ম ১৯৫৯ সালে ঢাকায়। একসময় ছাত্ররাজনীতি ও শ্রমিকরাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা। এছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গণহত্যা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সক্রিয় কর্মী তিনি। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড এবং দেশের সাম্প্রতিক মানবাধিকার পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : স্বাধীন মতামত প্রকাশের কারণে দেশে মানুষ খুন হচ্ছে। একসময় উগ্রবাদী মতাদর্শে দীক্ষিত গোষ্ঠীর হামলায় এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। মতপ্রকাশের মতো মৌলিক মানবাধিকারের এমন লঙ্ঘন হচ্ছে কেন?
নূর খান লিটন : আমরা যদি এ বিষয়ে গত দশ বছরের ঘটনাপ্রবাহ লক্ষ করি তাহলে দেখব, একসময় উগ্র মতবাদে বিশ্বাসীরা উগ্রপন্থায় মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশকে স্তব্ধ করে দেওয়ার, নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমরা যেমন ব্লগারদের হত্যা করতে দেখেছি তেমনি রাষ্ট্রের তরফ থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে, লেখালেখির কারণে মতপ্রকাশের কারণে ব্লগারদের গ্রেপ্তার করতে দেখেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নানা আইনকানুন দেখিয়ে মানুষকে হয়রানি করেছে, গ্রেপ্তার ও মামলা করে মতপ্রকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে এমনকি রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও এই বিষয়গুলোকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নানাভাবে গণমাধ্যমসহ নানা জায়গায় নিয়ে এসেছেন। ফলে কেবল হামলা, হত্যাচেষ্টা বা হত্যাকাণ্ডই নয় নানাভাবেই সমাজে ও রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে, মতপ্রকাশের পরিসরকে সংকুচিত করা হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : একটা রাষ্ট্রে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পরিসরেও স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্য কাউকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় সেখানে সাধারণ মানবাধিকার পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে বলে মনে করেন আপনি?
নূর খান লিটন : বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদ ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির বিষয়ে নিজের মতপ্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত মানুষ বিশ্বাস করে যে এই স্ট্যাটাসের কারণেই তাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বুয়েটের কিছু নেতাকর্মী নির্মমভাবে নির্যাতন করে, পিটিয়ে হত্যা করেছে। যে কক্ষে নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয় সেখান থেকে লাশটিকে তারা বাইরে নিয়ে সিঁড়ির কাছে ফেলে রাখে। আমরা সংবাদমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি সেখানে পুলিশ এলেও প্রথমে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি এমনকি শিক্ষকদের সঙ্গেও তারা ভালো আচরণ করেনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের এমন নির্মমতার কারণ কী? আসলে রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন তারা যখন জবাবদিহির ঊর্ধ্বে চলে যান বা জবাবদিহি হতে চান না; এবং যে দেশে নির্বাচন নির্বাচন নাটকের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করা হয় এবং যখন জনগণ আর ভাগ্য নির্ধারক থাকে না, সেখানে কর্র্তৃত্ববাদী শাসন বা ফ্যাসিজম তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বা এমন ঘটনা ঘটলেও সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। যদিও প্রবল জনমতের চাপে এক্ষেত্রে হয়তো তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টা আমরা লক্ষ করছি, কিন্তু সাধারণ মানুষ সে বিষয়ে তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না।
দেশ রূপান্তর : রাষ্ট্রীয় আইনে স্বাধীন মতপ্রকাশে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। বিতর্কিত ৫৭ ধারার পর এখন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বা ৩২ ধারা নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও স্বাধীন মতপ্রকাশ করতে গিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা নানারকম হয়রানির শিকার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কি তাহলে উল্টোপথে হাঁটছে বলে মনে করেন?
নূর খান লিটন : দেখুন, সবকিছুর নিয়ন্ত্রক হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতি যখন দুর্বৃত্তদের দখলে চলে যায়, দুর্বৃত্তায়িত হয়ে যায়, রাজনীতিতে তখন আর নীতি-আদর্শের চর্চা থাকে না। আদর্শহীন রাজনীতি যখন সমাজ-রাষ্ট্রকে পরিচালিত করতে থাকে তখন এক ধরনের অন্ধ-কানা জন্ম দেয়; যারা দলদাসে রূপান্তরিত হয়। সেটি বুদ্ধিজীবী শ্রেণিই হোক বা বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণির মানুষই হোক। সারা দেশে এমন দলদাস দেখা যাচ্ছে আমরা যারা সত্য কথা বলতে ভয় পাই; যদি ‘নেতা’ কিছু মনে করেন। যদি ‘নেতা’ কিছু মনে করেন, তাহলে আমার ব্যক্তিজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসবে, বা আমার আকাক্সক্ষা পূরণে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, কিংবা আমি হয়তো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পরি। এসব কারণে সমাজের সব ক্ষেত্রেই একটা আত্মসমর্পণ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আত্মসমর্পণ প্রবণতায় নিমজ্জিত সমাজেই আবরাররা খুন হয়। এ প্রসঙ্গে আমি একটা ঘটনার উদাহরণ দিতে চাই। কিছুদিন আগে সিলেটে খাদিজা নামের একটি মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আক্ষেপ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি ‘এত মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে, ছবি তুলেছে কেউ একজনও এগিয়ে গিয়ে প্রতিরোধ করেনি!’ এই পরিস্থিতি আসলেই সমাজের এক ভয়াবহ সংকট। এই বিষয়ে আমি বলতে চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে- সমাজ কেন আজ এমন ভয়ের সংস্কৃতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতির দিকে চলে গেছে যে, যেখানে মানুষ এখন স্বাভাবিকভাবে প্রতিবাদ করতেও সাহস পায় না, পালিয়ে বেড়ায়, আত্মসমর্পণ প্রবণতায় নিমজ্জিত হয়।
দেশ রূপান্তর : স্বাধীন মতপ্রকাশের দায়ে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মতোই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মতপ্রকাশের কারণে আবরার ফাহাদকে হত্যা করে তখন ছাত্রলীগকে কি আর গণতান্ত্রিক সংগঠন বলা যাবে? তাহলে উগ্রবাদী সংগঠনের সঙ্গে ছাত্রলীগের কী পার্থক্য থাকল?
নূর খান লিটন : বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কি এই সমাজের বিচ্ছিন্ন কোনো অংশ? এই রাজনীতির বিচ্ছিন্ন কোনো অংশ? যে রাজনীতি নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে, যে রাজনীতি নৈতিকতা বর্জিত হয়ে মানুষকে আর মানুষ হিসেবেই মর্যাদা দেয় না ছাত্রলীগ কি তা থেকে বিচ্ছিন্ন? মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিলে তো তারা জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনোরকম বাধা প্রদানের সুযোগ দিত না। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে এই ছাত্ররাই তো দেখেছে, কীভাবে রাতের আঁধারে ভোটের ক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যায়, এরাই তো দেখেছে কীভাবে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থাকা যায়, এরাই তো দেখেছে কীভাবে রাজনীতির নামে দুর্নীতি-লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়া যায়। সেক্ষেত্রে শুধু বিচ্ছিন্নভাবে ছাত্রলীগকে বা রাজনীতির কতিপয় মানুষকে আমি চিহ্নিত করতে রাজি না। আমি মনে করি এখন সময় এসেছে সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলোকে বিবেচনা করার, এমন দুর্বৃত্তদের যারা রাজনীতিতে আশ্রয় দিয়েছে, বেড়ে উঠতে দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করার। সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে দেখে সংকটাপন্ন এই ব্যবস্থাটাকে পাল্টে ফেলার।
দেশ রূপান্তর : আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের আলোচনায় উঠে এসেছে ২০১২ সালে পুরান ঢাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের কথা, ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত আবু বকর সিদ্দিকের কথা। সবাই বলছেন, নৃশংস এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হলে আজ বুয়েটে আবরারকে প্রাণ দিতে হতো না।
নূর খান লিটন : এ ধরনের আরও বেশ কিছু ঘটনা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের নামে শীতের ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখার পর ওই নির্মম নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে একটি ছেলে মারা যায়। বিভিন্ন স্থানে এরকম আরও অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন-হত্যাকাণ্ডের কথা বলা যাবে। কিন্তু আমি এই বিষয়ে শুধু একটি কথা বলতে চাই। ছাত্রলীগের তো অভিভাবক রয়েছেন। রাজনৈতিকভাবে ছাত্রলীগ যে মতাদর্শের অনুসারী তার নেতানেত্রীরা রয়েছেন। ছাত্রলীগের অভিভাবক চাইলে কি পারেন না এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে?
দেশ রূপান্তর : আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বিশেষত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী বা সমর্থক নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন যে আবরার ইসলামী ছাত্রশিবির করতেন, তিনি ফেইসবুকে নানা উগ্রবাদী গোষ্ঠীর পেইজে লাইক দিতেন। আবার যারা এই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত তাদের সম্পর্কেও বলা হচ্ছে যে এরা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী ছদ্মবেশী শিবির। প্রশ্ন হলো একজন শিক্ষার্থী বা যে কেউ এমনকি কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন করলেও কি তাকে এভাবে হত্যা করাটা বৈধ হয়ে যায়?
নূর খান লিটন : দেখুন, যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নিই, আবরার শিবিরের সমর্থক বা এমনকি কর্মীও হয়, তাহলেই কি তাকে এভাবে হত্যা করাটা আইনসম্মত হয়ে যাবে? রাষ্ট্রীয় কোনো আইন কি এমন হত্যার অনুমতি দেয়। কোনোভাবেই দেয় না। কারোর বিরুদ্ধে যদি রাজনৈতিক বা ফৌজদারি কোনো অপরাধের অভিযোগ থাকে তাহলে সেটার সুরাহা করার জন্য দেশে আইন আদালত আছে। এমন যে কোনো হত্যাই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সেটা দেশব্যাপীই চলছে। আর ছাত্রলীগের বিষয়ে কী বলব। কয়েকদিন আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে অপসারণের নির্দেশ দিলেন। আসলে প্রধানমন্ত্রী হয়তো একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার কদিনের মধ্যেই তো আমরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেখলাম। এই প্রশ্নের উত্তর তাদেরই খুঁজতে হবে যে কেন ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
দেশ রূপান্তর : আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে ‘ছাত্ররাজনীতি’ নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। অবশ্য এর আগেও বিভিন্ন সময়ে এমন দাবির কথা শোনা গেছে। আপনি কি মনে করেন যে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এই সংকট সমাধান করতে পারবে?
নূর খান লিটন : শুধু ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে কোনো সমাধান আসবে না। সমাধান করতে হলো গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। আর সেই সংস্কারটি শুরু করতে হবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ভেতর থেকে। কারণ দীর্ঘ দশ বারো বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে সবাই না হলেও অবশ্যই কিছু রাজনীতিবিদ দানবে পরিণত হয়েছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে অপসারণ করে যে শুদ্ধি অভিযানের সূচনা করলেন তাতে অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু বুয়েটের এই হত্যাকাণ্ড তো সেটাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসল। আর যুবলীগ এবং ক্যাসিনো-জুয়ার আসরে যে অভিযান চালানো হয়েছে সেটা কতটা সফল তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কেননা এমন শুদ্ধি অভিযান তখনই সফল বলা যাবে যখন তা সর্বব্যাপী হবে। অর্থাৎ যারা দুর্নীতি করেছেন, অপরাধ করেছেন সবাইকে যখন বিচারের আওতায় আনা যাবে।