সমস্ত অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী আমাদের জনগণ
আবু ওসমান চৌধুরী (১ জানুয়ারি ১৯৩৬ - ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০)
একাত্তরের মার্চে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি তখন চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর ৪ নম্বর উইংয়ের অধিনায়ক। ২৫ মার্চ রাতে তিনি কুষ্টিয়ায় অবস্থান করছিলেন। অপারেশন সার্চলাইটের নামে রাজধানী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর খবর পেয়ে তিনি চুয়াডাঙ্গার ঘাঁটিতে ফিরে আসেন এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে সৈন্যদলসহ স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তার নেতৃত্বাধীন ইপিআর উইংয়ের নিরাপত্তা প্রহরাতেই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। মে মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন দুই ভাগ করা হলে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হন। একাত্তরে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করা সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সংগঠক এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সহ-সভাপতি ছিলেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। একাত্তরের রণাঙ্গনে তার যুদ্ধ শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে গত বছরের ১৮ মার্চ রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আবু ওসমান চৌধুরীর বাসভবনে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন দেশ রূপান্তরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক ওমর শাহেদ। দেশ রূপান্তরের পাঠকদের জন্য অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হলো বি.স.
ওমর শাহেদ : একাত্তরের মার্চে আপনার সেনাবিদ্রোহ আর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে চাই।
আবু ওসমান চৌধুরী : ২৬ মার্চ সকালে খবরে শুনছি। আগেই তারা ‘মার্শাল ল’ করে দিল। সিভিল এভিয়েশনের সব লোক ঘরে। সার্কিট হাউজ থেকে আমরা সব দেখলাম। পেছনের জানালা দিয়ে দেখি, কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে তারা আরও সৈন্য জড়ো করেছে। আমরা সবাই ইউনিফর্মে। জানি দেখলেই মেরে ফেলবে। দেখলাম এখানে থাকলে অসুবিধা। হাবিলদারকে বললাম, আমার নষ্ট গাড়ি রেডি করে, তোমাদের পেছনে আবার বাঁধো। রিপেয়ার করার সময়ও পাইনি; প্রত্যেকে নিজের জায়গায় বসো। যখন ইশারা করব রওনা করবে। ঠিক করেছি, সেক্টর হাউজের সামনে দিয়ে গিয়ে উল্টোপথে ঝিনাইদহ দিয়ে যাব। কুষ্টিয়া শহরের দুই তিনটি বাড়ি পেরিয়ে, তারপর সব গ্রাম। অন্যভাবে গ্রামের ভেতর দিয়ে যাব, অসুবিধা হবে না, তারা টেরও পাবে না। দেখলাম, যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তারা এক খোলা জিপে কাগজের বোম্বায় হুকুম করছে কারফিউ, কারফিউ, কারফিউ; কেউ বেরুতে পারবে না। সার্কিট হাউজ পর্যন্ত আসে, ওদিকে চলে যায়, আবার আসে। যখনই ওদিকে কিছুদূর গেল; আমার লোকদের হুকুম দিয়ে রওনা করলাম। আমি সামনে। কতক্ষণ পর দেখলাম তারা টের পায়নি। আমরা চলে এলাম। যত দ্রুত যাওয়া সম্ভব এভাবে; সকাল ১০টায় ঝিনাইদহে এলাম। দেখি, হাজার, হাজার লোক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছে। তারা দেখলেন, জিপ, আর্মি ইউনিফর্মে; সামনেও জিপ আছে আর্মির জিপের মতো; ভয়ে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। ভাবলাম, এই সুযোগ। গাড়ি থামিয়ে নামলাম। মানুষজন দেখলেন, আমার রং সাদা; ইউনিফর্মও পরা; মনে করলেন আর্মি; ফলে সরে যাচ্ছেন। বাংলায় বললাম আপনারা সব আমার কাছে আসেন। কথাটি শুনে এগিয়ে এলেন। বাঙালি কমান্ডার এসেছেন তারা আগে জেনেছেন, দেখা করার জন্য তাড়াহুড়োয় এগুতে লাগলেন। আমাকে ঘিরে ধরে সব শুনলেন। বললাম, আপনারা সবাই রেডি থাকুন; আসছি। ক্ষেতখামার দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চললাম। তারা প্রধান সব সড়ক গাছ ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায় ১টা বেজে গেল আমার হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গায় যেতে। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হাবিলদার মেজর ফয়েজ উল্লাহ বলল, আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু আসছেন তো না। গতকাল আপনাকে নেওয়ার জন্য ওদের জিপসহ এক মেজর এসেছিল। না পেয়ে আপনার বাঙালি ক্যাপ্টেন; তার ফ্যামিলি; বাসায় থাকতেন, সেখানে গিয়েছে; রাত ১২টা পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছে। সকাল ৬টায় স্ত্রী ও সন্তানসহ তাকে নিয়ে গিয়েছে। এখানে আমাদের মধ্যে ৪০ ভাগ সৈনিক রেখেছে পাকিস্তানি আর ৬০ ভাগ বাঙালি এও ঠিক নয়, তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পাকিস্তানিদের রেখেছে। আর সমস্ত অফিসার রেখেছে পাকিস্তানি। আমি সেখানে প্রথম বাঙালি অফিসার, ডেপুটেশন নিয়ে দেশে আসা ইপিআরের ৪ নম্বর উইং কমান্ডার; ফিরে আসায় তারা সবাই খুব খুশি। আমার হাবিলদার মেজর জানাল, যত অবাঙালি সবাইকে তারা একটি বড় রুমের মধ্যে বন্দি করেছে। তারা বলল, তাদের অধীনে যত অস্ত্র আছে, সব লুকিয়েছে। হঠাৎ আক্রমণ করে গুলি, সবকিছু নিয়ে গেলে তারা তো কিছু করতে পারবে না। এসব কাজ হাবিলদার মেজরের। দেখলাম, তারা আমার জন্য অপেক্ষায় আছে। হুকুম চায়, আন্দোলন, প্রতিরোধ সংগ্রামের। বললাম, ঠিক আছে, বাসায় যাচ্ছি। তোমরা রেডি থাকো, আমার জন্য অপেক্ষা করো।
স্ত্রী (জাহানারা খানম) নিজের কাজ ফেলে আমার কাজ করতে লাগল। আমরা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বক্তব্য টেপ করে রেখেছিলাম, শুনছিলাম। যেহেতু আমার কাছে হুকুম নেই যে আন্দোলন করব কী; পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব কী; তারা সব এক পায়ে এগিয়ে আছে। তখন টেপটি প্রথম থেকে আবার শুনলাম। টেপে বঙ্গবন্ধুর সব কথা, সমস্ত হুকুম এবং কীভাবে আন্দোলন, বিদ্রোহ করব সব বলা আছে। ফলে ঠিক করলাম, আমরা আন্দোলন করব। তার আগে কথাবার্তা দরকার। রাজনীতিবিদ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক; আনসার সব শ্রেণির প্রথম ও দ্বিতীয় প্রধান সবাইকে ডাকো, আমি কথা বলব। আধঘণ্টায় সবাই এলেন। দুইটায় আমি এখানে মিটিং করলাম। বললাম, আপনারা এখন যেভাবে আছেন, আমার সৈন্যরাও এখন বিদ্রোহ করতে তৈরি; তার আগে আলাপ করা দরকার। আপনারা কি আমাদের সঙ্গে আছেন? জনগণ কি সঙ্গে আছে? পুলিশের সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার, আনসার কামান্ডার, আনসাররা আছেন; আপনারা কী চিন্তা করছেন, আমাদের হাতে শুধু থ্রি নট থ্রি; দুই একটি যে এলএমজি (লাইট মেশিন গান), সেগুলোতে কিছু নেই। আর সব তো লাঠি। এগুলো দিয়ে কীভাবে কাজ করব? সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে লাফাচ্ছেন, কিন্তু কী দিয়ে জয় বাংলা করবেন? তখন সব চুপচাপ।
বললাম, আপনাদের ভাবনার কারণ নেই। আমার কাছে এমন এক অস্ত্র আছে, যেটি পাকিস্তানের কাছে নেই, সেটি সমস্ত অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। বলেন, বলেন...আমার অস্ত্র হলেন আপনারা, আমাদের জনগণ। বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটির আপনারা অংশ। আপনারা যদি আমাদের সঙ্গে সবাই সবসময় থাকেন সব নিয়ে চিন্তা করেন; তাহলে কিন্তু চিন্তা নেই। আমরা আপনাদের ভরসায় বিদ্রোহ করতে পারি। সবাই লাফিয়ে, দুই হাত মাথার ওপর দিয়ে বললেন ‘হ্যাঁ’। বললাম, তাহলে চলেন জনগণের কাছে যাব। তারা বাইরেই। সবাই বেরুলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি তৈরি, সব কাজে যুক্ত থাকার চিন্তা করছেন? বিদ্রোহ করলেই তো হবে না। তারাও ‘জয় বাংলা’ করে লাফিয়ে উঠলেন। তাদের নিয়ে আমার সৈনিকদের ব্যারাক, অস্ত্রাগারে গেলাম; দেখলাম, অনেক পাহারাদার। বললাম, আপনারা সবাই আছেন, বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়নি, পতাকা নেন। আগে থেকেই তারা তৈরি করে রেখেছেন। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে আমাদের পতাকা উঠিয়ে দিলাম। আমার সৈনিকদের খাড়া করে পতাকাকে স্যালুট করলাম। আমরা পতাকাকেই গার্ড অব অনার দিলাম। কী যে হল্লা জয় বাংলা! জয় বাংলা!
ওমর শাহেদ : যুদ্ধ কীভাবে শুরু করলেন? আপনাদের প্রস্তুতি কেমন ছিল?
আবু ওসমান চৌধুরী : ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমরা বিদ্রোহ করলাম। চুয়াডাঙ্গার যেখানে সেটা আরম্ভ করলাম, জায়গাটির নাম কারাদ-। বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। যত সৈনিক আছে, হুকুম দিলাম তোমরা অমুকে ওখানে যাও ইত্যাদি। যে রাস্তা গাছপালা দিয়ে বন্ধ করেছে, থাকুক। আমরা বাইরে দিয়ে তাদের দেখব বেশি। তারা ও পথ দিয়েই আসবে। রাত ১১টার সময় আমারও কাজ শেষ হলো। অফিসে বসলাম। আমার চার কোম্পানি সৈন্য বর্ডারে; যোগাযোগ করলাম। বললাম, আমরা এই করেছি, তোমরাও এই করো এবং সমস্ত কিছু নিয়ে রেডি থাকো। এখন থেকে অন ওয়ার্ড আমি যা অয়্যারলেসে হুকুম করব; সেভাবে কাজ করবে। যদি বলি এখানে চলে আসো সব, সবাই আসবে। ওরা বলল, বর্ডার দেখবে কে? বর্ডার দেখতে হবে না। বললাম বর্ডার আল্লাহ দেখবেন।
ওমর শাহেদ : কুষ্টিয়া আক্রমণ করে জয় করলেন কীভাবে?
আবু ওসমান চৌধুরী : যখন দেখেছি, আমার সৈনিকরা সবাই প্রস্তুত, জনগণও দেখলাম, সবাই সাহস দিচ্ছেন; তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, কুষ্টিয়া আক্রমণ করব। ঠিক করলাম কুষ্টিয়া আমাকে সাকসেসফুলি অ্যাটাক করতে হলে এমনভাবে করতে হবে যেন তিন দিক থেকে ‘জয় বাংলার’ জোশ পাই। জনগণ যারা আসবেন হাজার হোন, ৫শ হোন, ২০০০ হাজার হোন প্রত্যেকের হাতে লাঠি থাকতে হবে। একই সময়ে, ‘জয় বাংলা’ বলে সৈনিকদের রাইফেল দিয়ে চার্জ করে যেতে হবে, একইভাবে তাদের পেছনে সেভাবে চার্জ করে লাঠি, বাঁশ; যেটি দিয়েই হোক আমাদের সঙ্গে অন্য সবাইকে দৌড়াতে হবে। তখন ওরা কিচ্ছু করতে পারবে না। দুঃসাহসী ও জীবনের বিনিময়ে গড়া আক্রমণ পরিকল্পনাটি জনগণ মেনে নিলেন। ঠিক করলাম ৩০ তারিখ আক্রমণ করব। যেসব সৈনিক থাকবেন, তাদের জন্য আমার হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গার সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ যা যা দরকার, সব আনতে হবে। ওখান থেকে সব সৈনিকদের নিয়ে এলাম।
৩০ তারিখ আমরা রওনা করলাম। ভোর চারটার অন্ধকারে ‘জয় বাংলা’ বলে চার্জ সোজা কথা নয়। ঠিকই তারা ঘাবড়ে গিয়েছে। তারা সবাই তো ঘুমিয়ে। ‘জয় বাংলা’ করতে, করতে; সারা দিন গোলাগুলি হতে হতে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ চলতে লাগল। তাদের অনেকে (পাকিস্তানি সেনা) ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে, অনেকে চোখ ডলতে, ডলতে কী হয়েছে এই অবস্থায় বাইরে বেরুনো মাত্র মেরেছি। এভাবে তারা শেষ হয়েছে। সারা দিনের মধ্যে কুষ্টিয়ায় আমাদের সবকিছুই অধিকারে এসেছে একমাত্র হেডকোয়ার্টার জেলা স্কুল ছাড়া। পরদিন ৩১ মার্চ সকালে সেটাও অধিকারে এসেছে। স্কুল নিয়ে আমাদের ও তাদের গোলাগুলি হয়েছে অনেক। যুদ্ধে আমাদের তিনজন শহীদ হয়েছেন, তাদের অসংখ্য মারা গিয়েছে। গোনার সময়, সুযোগও ছিল না। কেউ কেউ আগের দিন রাতেই পালিয়েছে। ৩১ মার্চ রাতে তারা অয়্যারলেসে যশোর সেনানিবাসে খবর দিয়েছে, আমাদের জন্য প্লিজ রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাও। ক্যান্টনমেন্ট বলল, ওখানে বাধা আছে বলে পাঠাতে পারব না। সম্ভব নয়। তোমরা নিজেরাই পালাবার চেষ্টা করো।
আমরা একটি ছোট আকারের ব্রিজের গোড়ায় রাস্তা কেটে তার ওপর তারপুলিন দিয়েছি। গাড়ির জন্য করা হয়েছে। পাকিস্তানিরা পালানোর চেষ্টা করছে। তারা ৫০ জনের মতো দুটি জিপ আর দুটি ডজ গাড়ি নিয়ে রওনা করেছে। চারজন অফিসার দুটি জিপে; ২০ জন করে ৪০ জনের বেশি সৈন্য। আসছে ব্রিজের কাছে। প্রথমে তাদের কমান্ডার, আরেকজন অফিসার ওখানে মরেছে। দ্বিতীয়টাও পড়েছে। একজন মারা গিয়েছে, একজন অফিসার বেঁচেছে। সে লেফটেন্যান্ট আতা উল্লাহ শাহ এই কথা মনে থাকে এখনো। ভুলি না। আর যারা আশপাশ দিয়ে পালাতে চেষ্টা করছিল... গ্রামের লোক এত অ্যালার্ট ছিল যে এই সমস্ত সৈনিকরা ওদিক দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের হাতে মারা গিয়েছে। সেগুলো আমাদের হিসাবে নেই।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

একাত্তরের মার্চে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি তখন চুয়াডাঙ্গায় ইপিআর ৪ নম্বর উইংয়ের অধিনায়ক। ২৫ মার্চ রাতে তিনি কুষ্টিয়ায় অবস্থান করছিলেন। অপারেশন সার্চলাইটের নামে রাজধানী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর খবর পেয়ে তিনি চুয়াডাঙ্গার ঘাঁটিতে ফিরে আসেন এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করে সৈন্যদলসহ স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তার নেতৃত্বাধীন ইপিআর উইংয়ের নিরাপত্তা প্রহরাতেই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। মে মাসে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন দুই ভাগ করা হলে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হন। একাত্তরে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করা সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গঠিত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সংগঠক এবং সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সহ-সভাপতি ছিলেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। একাত্তরের রণাঙ্গনে তার যুদ্ধ শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে গত বছরের ১৮ মার্চ রাজধানীর ধানমণ্ডিতে আবু ওসমান চৌধুরীর বাসভবনে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন দেশ রূপান্তরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক ওমর শাহেদ। দেশ রূপান্তরের পাঠকদের জন্য অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশ ছাপা হলো বি.স.
ওমর শাহেদ : একাত্তরের মার্চে আপনার সেনাবিদ্রোহ আর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে চাই।
আবু ওসমান চৌধুরী : ২৬ মার্চ সকালে খবরে শুনছি। আগেই তারা ‘মার্শাল ল’ করে দিল। সিভিল এভিয়েশনের সব লোক ঘরে। সার্কিট হাউজ থেকে আমরা সব দেখলাম। পেছনের জানালা দিয়ে দেখি, কুষ্টিয়া জেলা স্কুলে তারা আরও সৈন্য জড়ো করেছে। আমরা সবাই ইউনিফর্মে। জানি দেখলেই মেরে ফেলবে। দেখলাম এখানে থাকলে অসুবিধা। হাবিলদারকে বললাম, আমার নষ্ট গাড়ি রেডি করে, তোমাদের পেছনে আবার বাঁধো। রিপেয়ার করার সময়ও পাইনি; প্রত্যেকে নিজের জায়গায় বসো। যখন ইশারা করব রওনা করবে। ঠিক করেছি, সেক্টর হাউজের সামনে দিয়ে গিয়ে উল্টোপথে ঝিনাইদহ দিয়ে যাব। কুষ্টিয়া শহরের দুই তিনটি বাড়ি পেরিয়ে, তারপর সব গ্রাম। অন্যভাবে গ্রামের ভেতর দিয়ে যাব, অসুবিধা হবে না, তারা টেরও পাবে না। দেখলাম, যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তারা এক খোলা জিপে কাগজের বোম্বায় হুকুম করছে কারফিউ, কারফিউ, কারফিউ; কেউ বেরুতে পারবে না। সার্কিট হাউজ পর্যন্ত আসে, ওদিকে চলে যায়, আবার আসে। যখনই ওদিকে কিছুদূর গেল; আমার লোকদের হুকুম দিয়ে রওনা করলাম। আমি সামনে। কতক্ষণ পর দেখলাম তারা টের পায়নি। আমরা চলে এলাম। যত দ্রুত যাওয়া সম্ভব এভাবে; সকাল ১০টায় ঝিনাইদহে এলাম। দেখি, হাজার, হাজার লোক ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছে। তারা দেখলেন, জিপ, আর্মি ইউনিফর্মে; সামনেও জিপ আছে আর্মির জিপের মতো; ভয়ে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। ভাবলাম, এই সুযোগ। গাড়ি থামিয়ে নামলাম। মানুষজন দেখলেন, আমার রং সাদা; ইউনিফর্মও পরা; মনে করলেন আর্মি; ফলে সরে যাচ্ছেন। বাংলায় বললাম আপনারা সব আমার কাছে আসেন। কথাটি শুনে এগিয়ে এলেন। বাঙালি কমান্ডার এসেছেন তারা আগে জেনেছেন, দেখা করার জন্য তাড়াহুড়োয় এগুতে লাগলেন। আমাকে ঘিরে ধরে সব শুনলেন। বললাম, আপনারা সবাই রেডি থাকুন; আসছি। ক্ষেতখামার দিয়ে গাড়ি চালিয়ে চললাম। তারা প্রধান সব সড়ক গাছ ফেলে বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায় ১টা বেজে গেল আমার হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গায় যেতে। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি হাবিলদার মেজর ফয়েজ উল্লাহ বলল, আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছি, কিন্তু আসছেন তো না। গতকাল আপনাকে নেওয়ার জন্য ওদের জিপসহ এক মেজর এসেছিল। না পেয়ে আপনার বাঙালি ক্যাপ্টেন; তার ফ্যামিলি; বাসায় থাকতেন, সেখানে গিয়েছে; রাত ১২টা পর্যন্ত খোঁজ নিয়েছে। সকাল ৬টায় স্ত্রী ও সন্তানসহ তাকে নিয়ে গিয়েছে। এখানে আমাদের মধ্যে ৪০ ভাগ সৈনিক রেখেছে পাকিস্তানি আর ৬০ ভাগ বাঙালি এও ঠিক নয়, তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পাকিস্তানিদের রেখেছে। আর সমস্ত অফিসার রেখেছে পাকিস্তানি। আমি সেখানে প্রথম বাঙালি অফিসার, ডেপুটেশন নিয়ে দেশে আসা ইপিআরের ৪ নম্বর উইং কমান্ডার; ফিরে আসায় তারা সবাই খুব খুশি। আমার হাবিলদার মেজর জানাল, যত অবাঙালি সবাইকে তারা একটি বড় রুমের মধ্যে বন্দি করেছে। তারা বলল, তাদের অধীনে যত অস্ত্র আছে, সব লুকিয়েছে। হঠাৎ আক্রমণ করে গুলি, সবকিছু নিয়ে গেলে তারা তো কিছু করতে পারবে না। এসব কাজ হাবিলদার মেজরের। দেখলাম, তারা আমার জন্য অপেক্ষায় আছে। হুকুম চায়, আন্দোলন, প্রতিরোধ সংগ্রামের। বললাম, ঠিক আছে, বাসায় যাচ্ছি। তোমরা রেডি থাকো, আমার জন্য অপেক্ষা করো।
স্ত্রী (জাহানারা খানম) নিজের কাজ ফেলে আমার কাজ করতে লাগল। আমরা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের বক্তব্য টেপ করে রেখেছিলাম, শুনছিলাম। যেহেতু আমার কাছে হুকুম নেই যে আন্দোলন করব কী; পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব কী; তারা সব এক পায়ে এগিয়ে আছে। তখন টেপটি প্রথম থেকে আবার শুনলাম। টেপে বঙ্গবন্ধুর সব কথা, সমস্ত হুকুম এবং কীভাবে আন্দোলন, বিদ্রোহ করব সব বলা আছে। ফলে ঠিক করলাম, আমরা আন্দোলন করব। তার আগে কথাবার্তা দরকার। রাজনীতিবিদ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক; আনসার সব শ্রেণির প্রথম ও দ্বিতীয় প্রধান সবাইকে ডাকো, আমি কথা বলব। আধঘণ্টায় সবাই এলেন। দুইটায় আমি এখানে মিটিং করলাম। বললাম, আপনারা এখন যেভাবে আছেন, আমার সৈন্যরাও এখন বিদ্রোহ করতে তৈরি; তার আগে আলাপ করা দরকার। আপনারা কি আমাদের সঙ্গে আছেন? জনগণ কি সঙ্গে আছে? পুলিশের সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার, আনসার কামান্ডার, আনসাররা আছেন; আপনারা কী চিন্তা করছেন, আমাদের হাতে শুধু থ্রি নট থ্রি; দুই একটি যে এলএমজি (লাইট মেশিন গান), সেগুলোতে কিছু নেই। আর সব তো লাঠি। এগুলো দিয়ে কীভাবে কাজ করব? সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে লাফাচ্ছেন, কিন্তু কী দিয়ে জয় বাংলা করবেন? তখন সব চুপচাপ।
বললাম, আপনাদের ভাবনার কারণ নেই। আমার কাছে এমন এক অস্ত্র আছে, যেটি পাকিস্তানের কাছে নেই, সেটি সমস্ত অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। বলেন, বলেন...আমার অস্ত্র হলেন আপনারা, আমাদের জনগণ। বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটির আপনারা অংশ। আপনারা যদি আমাদের সঙ্গে সবাই সবসময় থাকেন সব নিয়ে চিন্তা করেন; তাহলে কিন্তু চিন্তা নেই। আমরা আপনাদের ভরসায় বিদ্রোহ করতে পারি। সবাই লাফিয়ে, দুই হাত মাথার ওপর দিয়ে বললেন ‘হ্যাঁ’। বললাম, তাহলে চলেন জনগণের কাছে যাব। তারা বাইরেই। সবাই বেরুলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি তৈরি, সব কাজে যুক্ত থাকার চিন্তা করছেন? বিদ্রোহ করলেই তো হবে না। তারাও ‘জয় বাংলা’ করে লাফিয়ে উঠলেন। তাদের নিয়ে আমার সৈনিকদের ব্যারাক, অস্ত্রাগারে গেলাম; দেখলাম, অনেক পাহারাদার। বললাম, আপনারা সবাই আছেন, বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়নি, পতাকা নেন। আগে থেকেই তারা তৈরি করে রেখেছেন। পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে আমাদের পতাকা উঠিয়ে দিলাম। আমার সৈনিকদের খাড়া করে পতাকাকে স্যালুট করলাম। আমরা পতাকাকেই গার্ড অব অনার দিলাম। কী যে হল্লা জয় বাংলা! জয় বাংলা!
ওমর শাহেদ : যুদ্ধ কীভাবে শুরু করলেন? আপনাদের প্রস্তুতি কেমন ছিল?
আবু ওসমান চৌধুরী : ২৬ মার্চ দুপুর আড়াইটায় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমরা বিদ্রোহ করলাম। চুয়াডাঙ্গার যেখানে সেটা আরম্ভ করলাম, জায়গাটির নাম কারাদ-। বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। যত সৈনিক আছে, হুকুম দিলাম তোমরা অমুকে ওখানে যাও ইত্যাদি। যে রাস্তা গাছপালা দিয়ে বন্ধ করেছে, থাকুক। আমরা বাইরে দিয়ে তাদের দেখব বেশি। তারা ও পথ দিয়েই আসবে। রাত ১১টার সময় আমারও কাজ শেষ হলো। অফিসে বসলাম। আমার চার কোম্পানি সৈন্য বর্ডারে; যোগাযোগ করলাম। বললাম, আমরা এই করেছি, তোমরাও এই করো এবং সমস্ত কিছু নিয়ে রেডি থাকো। এখন থেকে অন ওয়ার্ড আমি যা অয়্যারলেসে হুকুম করব; সেভাবে কাজ করবে। যদি বলি এখানে চলে আসো সব, সবাই আসবে। ওরা বলল, বর্ডার দেখবে কে? বর্ডার দেখতে হবে না। বললাম বর্ডার আল্লাহ দেখবেন।
ওমর শাহেদ : কুষ্টিয়া আক্রমণ করে জয় করলেন কীভাবে?
আবু ওসমান চৌধুরী : যখন দেখেছি, আমার সৈনিকরা সবাই প্রস্তুত, জনগণও দেখলাম, সবাই সাহস দিচ্ছেন; তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, কুষ্টিয়া আক্রমণ করব। ঠিক করলাম কুষ্টিয়া আমাকে সাকসেসফুলি অ্যাটাক করতে হলে এমনভাবে করতে হবে যেন তিন দিক থেকে ‘জয় বাংলার’ জোশ পাই। জনগণ যারা আসবেন হাজার হোন, ৫শ হোন, ২০০০ হাজার হোন প্রত্যেকের হাতে লাঠি থাকতে হবে। একই সময়ে, ‘জয় বাংলা’ বলে সৈনিকদের রাইফেল দিয়ে চার্জ করে যেতে হবে, একইভাবে তাদের পেছনে সেভাবে চার্জ করে লাঠি, বাঁশ; যেটি দিয়েই হোক আমাদের সঙ্গে অন্য সবাইকে দৌড়াতে হবে। তখন ওরা কিচ্ছু করতে পারবে না। দুঃসাহসী ও জীবনের বিনিময়ে গড়া আক্রমণ পরিকল্পনাটি জনগণ মেনে নিলেন। ঠিক করলাম ৩০ তারিখ আক্রমণ করব। যেসব সৈনিক থাকবেন, তাদের জন্য আমার হেডকোয়ার্টার চুয়াডাঙ্গার সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র, গোলাবারুদ যা যা দরকার, সব আনতে হবে। ওখান থেকে সব সৈনিকদের নিয়ে এলাম।
৩০ তারিখ আমরা রওনা করলাম। ভোর চারটার অন্ধকারে ‘জয় বাংলা’ বলে চার্জ সোজা কথা নয়। ঠিকই তারা ঘাবড়ে গিয়েছে। তারা সবাই তো ঘুমিয়ে। ‘জয় বাংলা’ করতে, করতে; সারা দিন গোলাগুলি হতে হতে আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ চলতে লাগল। তাদের অনেকে (পাকিস্তানি সেনা) ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে, অনেকে চোখ ডলতে, ডলতে কী হয়েছে এই অবস্থায় বাইরে বেরুনো মাত্র মেরেছি। এভাবে তারা শেষ হয়েছে। সারা দিনের মধ্যে কুষ্টিয়ায় আমাদের সবকিছুই অধিকারে এসেছে একমাত্র হেডকোয়ার্টার জেলা স্কুল ছাড়া। পরদিন ৩১ মার্চ সকালে সেটাও অধিকারে এসেছে। স্কুল নিয়ে আমাদের ও তাদের গোলাগুলি হয়েছে অনেক। যুদ্ধে আমাদের তিনজন শহীদ হয়েছেন, তাদের অসংখ্য মারা গিয়েছে। গোনার সময়, সুযোগও ছিল না। কেউ কেউ আগের দিন রাতেই পালিয়েছে। ৩১ মার্চ রাতে তারা অয়্যারলেসে যশোর সেনানিবাসে খবর দিয়েছে, আমাদের জন্য প্লিজ রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাও। ক্যান্টনমেন্ট বলল, ওখানে বাধা আছে বলে পাঠাতে পারব না। সম্ভব নয়। তোমরা নিজেরাই পালাবার চেষ্টা করো।
আমরা একটি ছোট আকারের ব্রিজের গোড়ায় রাস্তা কেটে তার ওপর তারপুলিন দিয়েছি। গাড়ির জন্য করা হয়েছে। পাকিস্তানিরা পালানোর চেষ্টা করছে। তারা ৫০ জনের মতো দুটি জিপ আর দুটি ডজ গাড়ি নিয়ে রওনা করেছে। চারজন অফিসার দুটি জিপে; ২০ জন করে ৪০ জনের বেশি সৈন্য। আসছে ব্রিজের কাছে। প্রথমে তাদের কমান্ডার, আরেকজন অফিসার ওখানে মরেছে। দ্বিতীয়টাও পড়েছে। একজন মারা গিয়েছে, একজন অফিসার বেঁচেছে। সে লেফটেন্যান্ট আতা উল্লাহ শাহ এই কথা মনে থাকে এখনো। ভুলি না। আর যারা আশপাশ দিয়ে পালাতে চেষ্টা করছিল... গ্রামের লোক এত অ্যালার্ট ছিল যে এই সমস্ত সৈনিকরা ওদিক দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, তাদের হাতে মারা গিয়েছে। সেগুলো আমাদের হিসাবে নেই।