বাংলাদেশিদের ইমিউনিটির মিথ প্রশ্নবিদ্ধ হলো গবেষণায়
বে-নজীর আহমেদ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বে-নজীর আহমেদের জন্ম ১৯৫৯ সালে গাইবান্ধায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যে মাস্টার্স এবং চিকিৎসা অণুজীববিজ্ঞানে এমফিল করেন। সংক্রামক রোগ বিষয়ে শিক্ষকতা, গবেষণা ও কর্মসূচি পরিচালনায় দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। বিশেষত কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ, জলাতঙ্ক ও ডেঙ্গুরোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকার জন্য সুবিদিত অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ। ২০১১ থেকে ’১৫ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক ও সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের লাইন ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক বে-নজীর। এ সময় কালাজ্বর, গোদরোগ এবং চৌষট্টি জেলায় বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা প্রদান কর্মসূচি পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) যৌথ গবেষণা সম্পর্কে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় করোনার সংক্রমণ নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) একটি যৌথ গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। এই গবেষণার ফল কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
বে-নজীর আহমেদ : করোনার সংক্রমণ নিয়ে যে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে প্রথমেই এটাকে সাধুবাদ জানাই। এ ধরনের গবেষণা খুব জরুরি হলেও সেটা হচ্ছিল না। মহামারীর গতি-প্রকৃতি এবং অঞ্চলভিত্তিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এ ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা খুবই সহায়ক। কিন্তু এটা ঠিক যে, এই গবেষণায় যে চিত্র ফুটে উঠেছে সেটা নিঃসন্দেহে খুবই অস্বাভাবিক। ফল প্রকাশের পর আমি বিষয়টা জানার চেষ্টা করেছি। আইসিডিডিআর,বি থেকে এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি।
যেকোনো গবেষণার ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার ডিজাইন যথার্থ কি না, গবেষণার স্যাম্পলিং কীভাবে হয়েছে, স্যাম্পলিং সাইজ ঠিক আছে কি না এবং গবেষণার মেথডটা কী এসবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর যারা নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা কাজটা যথার্থভাবে করেছেন কি না এবং যে পরীক্ষা করা হয়েছে সেটা মানসম্পন্ন কি না। একটা গবেষণার মান যাচাইয়ের জন্য এসব বিবেচনা করতে হয়। এখন যেহেতু এখানে আইসিডিডিআর,বির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইইডিসিআরের মতো আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান যুক্ত, যারা দীর্ঘদিন ধরে এমন গবেষণা করছে। আর ইউএসএআইডি ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো দাতারা এই গবেষণায় ফান্ড দিয়েছে, তারাও এসব ক্ষেত্রে মানের ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করে। সব মিলিয়ে আমি এই গবেষণার মানের ওপর আস্থা রাখতে চাই।
দেশ রূপান্তর : মধ্য এপ্রিল থেকে আগস্টের শেষভাগে পরিচালিত এই গবেষণায় অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ফল বলছে প্রায় তিন মাস আগেই রাজধানীর ৪৫ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অথচ সরকারি তথ্যানুসারে করোনায় সংক্রমিতের যে হিসাব আমরা জানি তাতে এই গবেষণার ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার ২ লাখের মতো মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কথা। এই গবেষণার ফল বিবেচনায় নিলে যা প্রায় এক কোটি মানুষের কাছাকাছি হয়ে যায়। এদিকে গবেষণায় বলা হচ্ছে, আক্রান্তদের ৮২ শতাংশের কোনো উপসর্গ নেই। আপনার কী মনে হয়?
বে-নজীর আহমেদ : আমি আগেই বলেছি যে, গবেষণার মানের ওপর আস্থা রাখলেও এটা বলতেই হবে যে, গবেষণার ফাইন্ডিংস আসলেই ‘অস্বাভাবিক’। ঢাকা বিপুল জনঘনত্বের অত্যন্ত জনবহুল মহানগর। এখন ঢাকার ৪৫ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হলে প্রায় এক কোটি মানুষের সংক্রামিত হওয়ার কথা। এখন আমাদের চোখের সামনে, মানে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের চোখের সামনে এত মানুষ আক্রান্ত হলেন, কিন্তু তারা এটা রোধ করতে পারলেন না, এমনকি এটা টেরও পেলেন না এটা তো আসলেই হতাশাজনক। ফলে গবেষণায় উঠে আসা এই তথ্য মেনে নেওয়াটা আসলেই কঠিন। তেমনি এটা আবার উড়িয়েও দেওয়া যায় না। কারণ প্রথম দিক থেকেই ঢাকাতেই সংক্রমণটা বেশি হয়েছে। এক. যে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে ফিরেছেন, গেইটওয়ে যেহেতু ঢাকা, তারা ঢাকায় কিছুদিন হলেও থেকেছেন বা ঢাকা হয়ে গ্রামে গিয়েছেন। দুই. ঢাকায় ২৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত যে লকডাউন ছিল তাতে ঢাকা থেকে বাইরে বা বাইরে থেকে ঢাকায় যাতায়াত খুব একটা না হলেও শহরের মধ্যে চলাচল যাতায়াত, পাড়া-মহল্লা আর বাজারঘাট সবই কিন্তু চলেছে। জুন থেকে লকডাউন উঠিয়ে নেওয়া এবং মসজিদে তারাবির নামাজ ও জামাত চালু করাসহ দোকানপাট আরও স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঈদের আগে কেনাকাটা এবং ঈদের সময় বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত অনেকটাই হয়েছে। সব মিলিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ কার্যকর রাখার কথা ছিল প্রশাসন থেকে সেটা যেমন পুরোপুরি করা হয়নি, তেমনি যতটা সচেতনতা মেনে চলার কথা ছিল মানুষও সেটা মেনে চলেনি। আবার সংক্রমণ শনাক্তে পরীক্ষার হার অপর্যাপ্ত ছিল। একইভাবে আমাদের বড় দুর্বলতা ছিল ‘ট্রেসিং’-এর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ যিনি সংক্রামিত তার সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে, কতজন এসেছে সেটা কিন্তু আমরা প্রায় এড়িয়ে গেছি। এসব কারণে ঢাকায় মারাত্মক সংক্রমণ কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত আমরা যদি এটা আমলে নিই যে, সংক্রামিতদের ৮২ শতাংশেরই যদি কোনো উপসর্গ না থাকে তাহলে কিন্তু গবেষণার এই ফল আর অস্বাভাবিক মনে হয় না।
দেশ রূপান্তর : আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, গবেষণাটির ফল থেকে দেখা যাচ্ছে রাজধানীতে সামগ্রিকভাবে সংক্রামিতের হার ৪৫ শতাংশ হলেও বস্তিবাসীদের মধ্যে সংক্রমণের হার আরও অনেক বেশি। বলা হচ্ছে ঢাকার বস্তিবাসীদের মধ্যে ৭৪ শতাংশেরই অ্যান্টিবডি শনাক্ত হয়েছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন বা এমন হওয়ার কারণ কী বলে মনে করছেন?
বে-নজীর আহমেদ : বস্তিবাসীদের মধ্যে সংক্রমণ হারের যে তথ্য সেটা আমাদের জন্য হুইসেল ব্লোয়ার হতে পারে। এখানে আগে বিবেচনা করতে হবে আমাদের দেশে নানাভাবে কিছু মিথ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে নিম্নবিত্তরা, শ্রমজীবীরা করোনায় আক্রান্ত হন না, বস্তিবাসীরা এতে আক্রান্ত হন না, আমাদের গ্রামের মানুষরা এতে আক্রান্ত হন না, বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনা প্রতিরোধের ইনবিল্ট ইমিউনিটি আছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। এটা যেমন সরকারের মন্ত্রীরা করেছেন, তেমনি স্বাস্থ্য বিভাগকেও এসব নিয়ে এক ধরনের আহ্লাদ অনুভব করতে দেখা গেছে। এমনটি টেলিভিশন টক-শোতেও এসব কথা বলতে শুনেছি। আমি নিজে এমন কিছু অনুষ্ঠানে বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম যে, বস্তিবাসীর হবে না কেন সেটা ব্যাখ্যা করেন।
আমি বিষয়টা নানাভাবে বোঝার এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এক. সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য কয়েকটি বিষয় মুখ্য, তার মধ্যে একটা হলো পুষ্টিকর খাবার। তাহলে কি আমরা বলব যে বস্তিবাসীরা অন্য নগরবাসী বা নাগরিকদের তুলনায় বেশি পুষ্টিকর খাবার খান। নিশ্চয়ই না। দুই. তারা বলছিলেন বস্তিবাসীরা দিনের লম্বা সময় রোদে থাকে, খোলা আলো-বাতাসে থাকে ফলে ভিটামিন-ডি তারা বেশি পায়। আমি এটা সমর্থন করি, কারণ ভিটামিন-ডি এক্ষেত্রে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর। তিন. বস্তিবাসীরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে বলে তারা নানা ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত থাকতে পারে। ফলে তারা হয়তো করোনার ভাইরাসের দ্বারা কিছুটা কম আক্রান্ত হতে পারে। এটা খানিকটা হতেও পারে। চার. আমার একটা বড় যুক্তি হলো আমাদের বস্তিবাসীরা আসলে আক্রান্ত কি না সেটার তো পরীক্ষা হচ্ছে না। কিন্তু ভারতের মুম্বাইয়ের বিশাল বস্তিতে যেভাবে করোনা পরীক্ষা হয়েছে এবং বিপুল হারে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে সেটা আমলে নিন। কারণ আমাদের বস্তিগুলোও তারচেয়ে খুব ভিন্ন নয়। পাঁচ. একদিকে বস্তিবাসীর পরীক্ষা হচ্ছে না, আরেকদিকে তারা অসুখ হলেও লুকিয়ে রাখবে, সেটা স্বাভাবিক। কারণ জ¦রটর হয়েছে বললে সে কাজ হারাবে। তাই প্যারাসিটামল বা এমনসব ওষুধ খেয়েই তারা সেটা পার করার চেষ্টা করবে। ছয়. বস্তিতে জনঘনত্ব নগরের অন্যসব এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের গোসল, রান্নাবান্না, থাকা-খাওয়া সবই গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে। ফলে একজন সংক্রমিত হলেই তার মাধ্যমে সেটা অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি। ছয়. আবার বস্তিবাসীদের মধ্যে মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া বা সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার হারও ছিল খুব কম। এসব মিলিয়ে বস্তিবাসীদের প্রায় ৭৪ ভাগই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে গবেষণায় যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তাতে আমি মোটেই অবাক হইনি।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা এটাই যে বাংলাদেশিদের করোনায় ইমিউনিটি বেশি বা বস্তিবাসী, শ্রমজীবী বা গ্রামবাসীর করোনা হয় না এসব মিথ এই গবেষণায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল। ফলে আমি বলতে চাই, এসব মিথ এখন ভেঙে ফেলতে হবে। একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে করোনা মোকাবিলায় আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর আরও অনেক বেশি জোর দেওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর : আমরা দেখলাম গবেষণার ফল প্রকাশের এক দিন পরই রাত ১১টায় সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর বলেছে, ঢাকা মহানগরে কভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে গবেষণার অন্তর্বর্তীকালীন যে ফল তারা জানিয়েছিলেন, সেটা পুরো ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করে না বা সেটা তারা দাবিও করেননি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
বে-নজীর আহমেদ : আমি তীব্রভাবে আইইডিসিআরের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করি। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক পরিচালক দুজনেই বলছেন এটা পুরো ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু কোনো গবেষণাতেই একটা শহর বা দেশের সব লোককে যুক্ত করা হয় না। তারা এখন বলছে স্যাম্পল সাইজটা ছোট। কিন্তু আইসিডিডিআর,বির অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানের কাছে আমি শুনেছি, তারা প্রথমে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ঢাকা শহরের ২৩টা ওয়ার্ডকে সিলেক্ট করেছেন। ২৩টা ওয়ার্ড কম কথা নয়। তারপর প্রতিটি ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে স্যাম্পল সাইজ কত হলে চলে হিসাবনিকাশ করে সেটা ঠিক করেছেন। সে অনুযায়ীই তারা গবেষণাটা করেছেন। এখন যদি তারা বলেন যে, এটা সীমিত পরিসরে করা হয়েছেসেটা একটা অবৈজ্ঞানিক কথা।
দেশ রূপান্তর : আপনি যেমন বলছিলেন যে, করোনায় বাংলাদেশিদের ইমিউনিটি বেশি বলে একটা মিথ প্রচার করা হয়েছিল। তেমনি আমরা একটা সময় শুনেছি যে, রাজধানী ঢাকায় বা সারা দেশে একসময় হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যাবে। এই গবেষণা সংশ্লিষ্টরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, মধ্য জুলাইয়ে ঢাকায় সংক্রমণের হার ৪৫ শতাংশ হয়ে থাকলে ওই ধারাবাহিকতায় আরও তিন মাসে এখন সেটা প্রায় ৬০-৬৫ ভাগ। সেক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে, তাহলে কি আমরা হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু গবেষণার ফল প্রকাশ করতে গিয়ে আইসিডিডিআর,বির সংক্রামক রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরি বলেছেন, হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠার কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না আর সংক্রমিত ব্যক্তিদের শরীরে কতদিন অ্যান্টিবডি থাকবে, তা-ও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করুন।
বে-নজীর আহমেদ : হার্ড ইমিউনিটির অনেকগুলো শর্ত আছে। প্রথম শর্ত হলো, কত ভাগ লোকের আক্রান্ত হতে হবে বা কত ভাগ লোককে ভ্যাকসিন দিতে হবে। সেটা ৮০ বা ৮৫ ভাগ হতে পারে। এটা নির্ভর করে একটা রোগের ইনকিউবিশন পিরিয়ড কত, রোগটির সংক্রমণের ক্ষমতা কতটা তার ওপর। এখন বস্তিবাসীর ৭৪ ভাগ বা ঢাকাবাসীর ৪৫ ভাগ থেকে বেড়ে আরও বেশি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও সেটা হার্ড ইমিউনিটির শর্ত পূরণ করে না। দ্বিতীয় শর্ত হলো, ইমিউনিটি পেতে হলে দেখতে হবে অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু কভিডের বেলায় বিশ্বব্যাপী এখনো প্রমাণিত হয়নি যে, এর অ্যান্টিবডি দীর্ঘস্থায়ী। তাহলে দ্বিতীয় শর্তও পূরণ হচ্ছে না। আর তৃতীয়ত, দেখা গেছে যে যাদের উপসর্গহীন সংক্রমণ হয় এবং সেটা যদি দীর্ঘস্থায়ী অ্যান্টিবডি না দেয় তাহলে কী ঘটবে। এখন এই গবেষণায় বলা হচ্ছে, ৮২ ভাগ বা সিংহভাগই উপসর্গহীন আর এতে অ্যান্টিবডিও খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাহলে সত্যিই কার্যকর ভ্যাকসিন ছাড়া এভাবে আমাদের হার্ড ইমিউনিটির কোনো সুযোগ নেই।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বে-নজীর আহমেদের জন্ম ১৯৫৯ সালে গাইবান্ধায়। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যে মাস্টার্স এবং চিকিৎসা অণুজীববিজ্ঞানে এমফিল করেন। সংক্রামক রোগ বিষয়ে শিক্ষকতা, গবেষণা ও কর্মসূচি পরিচালনায় দেশ-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। বিশেষত কালাজ্বর, ফাইলেরিয়া বা গোদরোগ, জলাতঙ্ক ও ডেঙ্গুরোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকার জন্য সুবিদিত অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ। ২০১১ থেকে ’১৫ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের পরিচালক ও সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের লাইন ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক বে-নজীর। এ সময় কালাজ্বর, গোদরোগ এবং চৌষট্টি জেলায় বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা প্রদান কর্মসূচি পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় করোনা সংক্রমণ নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) যৌথ গবেষণা সম্পর্কে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক বে-নজীর আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় করোনার সংক্রমণ নিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) একটি যৌথ গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে। এই গবেষণার ফল কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
বে-নজীর আহমেদ : করোনার সংক্রমণ নিয়ে যে একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে প্রথমেই এটাকে সাধুবাদ জানাই। এ ধরনের গবেষণা খুব জরুরি হলেও সেটা হচ্ছিল না। মহামারীর গতি-প্রকৃতি এবং অঞ্চলভিত্তিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এ ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা খুবই সহায়ক। কিন্তু এটা ঠিক যে, এই গবেষণায় যে চিত্র ফুটে উঠেছে সেটা নিঃসন্দেহে খুবই অস্বাভাবিক। ফল প্রকাশের পর আমি বিষয়টা জানার চেষ্টা করেছি। আইসিডিডিআর,বি থেকে এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি।
যেকোনো গবেষণার ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণার ডিজাইন যথার্থ কি না, গবেষণার স্যাম্পলিং কীভাবে হয়েছে, স্যাম্পলিং সাইজ ঠিক আছে কি না এবং গবেষণার মেথডটা কী এসবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপর যারা নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা কাজটা যথার্থভাবে করেছেন কি না এবং যে পরীক্ষা করা হয়েছে সেটা মানসম্পন্ন কি না। একটা গবেষণার মান যাচাইয়ের জন্য এসব বিবেচনা করতে হয়। এখন যেহেতু এখানে আইসিডিডিআর,বির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আইইডিসিআরের মতো আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান যুক্ত, যারা দীর্ঘদিন ধরে এমন গবেষণা করছে। আর ইউএসএআইডি ও বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো দাতারা এই গবেষণায় ফান্ড দিয়েছে, তারাও এসব ক্ষেত্রে মানের ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করে। সব মিলিয়ে আমি এই গবেষণার মানের ওপর আস্থা রাখতে চাই।
দেশ রূপান্তর : মধ্য এপ্রিল থেকে আগস্টের শেষভাগে পরিচালিত এই গবেষণায় অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ফল বলছে প্রায় তিন মাস আগেই রাজধানীর ৪৫ শতাংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অথচ সরকারি তথ্যানুসারে করোনায় সংক্রমিতের যে হিসাব আমরা জানি তাতে এই গবেষণার ফল প্রকাশের আগ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার ২ লাখের মতো মানুষের আক্রান্ত হওয়ার কথা। এই গবেষণার ফল বিবেচনায় নিলে যা প্রায় এক কোটি মানুষের কাছাকাছি হয়ে যায়। এদিকে গবেষণায় বলা হচ্ছে, আক্রান্তদের ৮২ শতাংশের কোনো উপসর্গ নেই। আপনার কী মনে হয়?
বে-নজীর আহমেদ : আমি আগেই বলেছি যে, গবেষণার মানের ওপর আস্থা রাখলেও এটা বলতেই হবে যে, গবেষণার ফাইন্ডিংস আসলেই ‘অস্বাভাবিক’। ঢাকা বিপুল জনঘনত্বের অত্যন্ত জনবহুল মহানগর। এখন ঢাকার ৪৫ ভাগ মানুষ আক্রান্ত হলে প্রায় এক কোটি মানুষের সংক্রামিত হওয়ার কথা। এখন আমাদের চোখের সামনে, মানে আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের চোখের সামনে এত মানুষ আক্রান্ত হলেন, কিন্তু তারা এটা রোধ করতে পারলেন না, এমনকি এটা টেরও পেলেন না এটা তো আসলেই হতাশাজনক। ফলে গবেষণায় উঠে আসা এই তথ্য মেনে নেওয়াটা আসলেই কঠিন। তেমনি এটা আবার উড়িয়েও দেওয়া যায় না। কারণ প্রথম দিক থেকেই ঢাকাতেই সংক্রমণটা বেশি হয়েছে। এক. যে প্রবাসীরা বিদেশ থেকে ফিরেছেন, গেইটওয়ে যেহেতু ঢাকা, তারা ঢাকায় কিছুদিন হলেও থেকেছেন বা ঢাকা হয়ে গ্রামে গিয়েছেন। দুই. ঢাকায় ২৮ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত যে লকডাউন ছিল তাতে ঢাকা থেকে বাইরে বা বাইরে থেকে ঢাকায় যাতায়াত খুব একটা না হলেও শহরের মধ্যে চলাচল যাতায়াত, পাড়া-মহল্লা আর বাজারঘাট সবই কিন্তু চলেছে। জুন থেকে লকডাউন উঠিয়ে নেওয়া এবং মসজিদে তারাবির নামাজ ও জামাত চালু করাসহ দোকানপাট আরও স্বাভাবিক হয়ে গেল। ঈদের আগে কেনাকাটা এবং ঈদের সময় বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত অনেকটাই হয়েছে। সব মিলিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে যেসব পদক্ষেপ কার্যকর রাখার কথা ছিল প্রশাসন থেকে সেটা যেমন পুরোপুরি করা হয়নি, তেমনি যতটা সচেতনতা মেনে চলার কথা ছিল মানুষও সেটা মেনে চলেনি। আবার সংক্রমণ শনাক্তে পরীক্ষার হার অপর্যাপ্ত ছিল। একইভাবে আমাদের বড় দুর্বলতা ছিল ‘ট্রেসিং’-এর ক্ষেত্রে। অর্থাৎ যিনি সংক্রামিত তার সংস্পর্শে কারা কারা এসেছে, কতজন এসেছে সেটা কিন্তু আমরা প্রায় এড়িয়ে গেছি। এসব কারণে ঢাকায় মারাত্মক সংক্রমণ কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত আমরা যদি এটা আমলে নিই যে, সংক্রামিতদের ৮২ শতাংশেরই যদি কোনো উপসর্গ না থাকে তাহলে কিন্তু গবেষণার এই ফল আর অস্বাভাবিক মনে হয় না।
দেশ রূপান্তর : আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, গবেষণাটির ফল থেকে দেখা যাচ্ছে রাজধানীতে সামগ্রিকভাবে সংক্রামিতের হার ৪৫ শতাংশ হলেও বস্তিবাসীদের মধ্যে সংক্রমণের হার আরও অনেক বেশি। বলা হচ্ছে ঢাকার বস্তিবাসীদের মধ্যে ৭৪ শতাংশেরই অ্যান্টিবডি শনাক্ত হয়েছে। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন বা এমন হওয়ার কারণ কী বলে মনে করছেন?
বে-নজীর আহমেদ : বস্তিবাসীদের মধ্যে সংক্রমণ হারের যে তথ্য সেটা আমাদের জন্য হুইসেল ব্লোয়ার হতে পারে। এখানে আগে বিবেচনা করতে হবে আমাদের দেশে নানাভাবে কিছু মিথ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে নিম্নবিত্তরা, শ্রমজীবীরা করোনায় আক্রান্ত হন না, বস্তিবাসীরা এতে আক্রান্ত হন না, আমাদের গ্রামের মানুষরা এতে আক্রান্ত হন না, বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনা প্রতিরোধের ইনবিল্ট ইমিউনিটি আছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। এটা যেমন সরকারের মন্ত্রীরা করেছেন, তেমনি স্বাস্থ্য বিভাগকেও এসব নিয়ে এক ধরনের আহ্লাদ অনুভব করতে দেখা গেছে। এমনটি টেলিভিশন টক-শোতেও এসব কথা বলতে শুনেছি। আমি নিজে এমন কিছু অনুষ্ঠানে বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলাম যে, বস্তিবাসীর হবে না কেন সেটা ব্যাখ্যা করেন।
আমি বিষয়টা নানাভাবে বোঝার এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এক. সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য কয়েকটি বিষয় মুখ্য, তার মধ্যে একটা হলো পুষ্টিকর খাবার। তাহলে কি আমরা বলব যে বস্তিবাসীরা অন্য নগরবাসী বা নাগরিকদের তুলনায় বেশি পুষ্টিকর খাবার খান। নিশ্চয়ই না। দুই. তারা বলছিলেন বস্তিবাসীরা দিনের লম্বা সময় রোদে থাকে, খোলা আলো-বাতাসে থাকে ফলে ভিটামিন-ডি তারা বেশি পায়। আমি এটা সমর্থন করি, কারণ ভিটামিন-ডি এক্ষেত্রে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর। তিন. বস্তিবাসীরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে বলে তারা নানা ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত থাকতে পারে। ফলে তারা হয়তো করোনার ভাইরাসের দ্বারা কিছুটা কম আক্রান্ত হতে পারে। এটা খানিকটা হতেও পারে। চার. আমার একটা বড় যুক্তি হলো আমাদের বস্তিবাসীরা আসলে আক্রান্ত কি না সেটার তো পরীক্ষা হচ্ছে না। কিন্তু ভারতের মুম্বাইয়ের বিশাল বস্তিতে যেভাবে করোনা পরীক্ষা হয়েছে এবং বিপুল হারে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে সেটা আমলে নিন। কারণ আমাদের বস্তিগুলোও তারচেয়ে খুব ভিন্ন নয়। পাঁচ. একদিকে বস্তিবাসীর পরীক্ষা হচ্ছে না, আরেকদিকে তারা অসুখ হলেও লুকিয়ে রাখবে, সেটা স্বাভাবিক। কারণ জ¦রটর হয়েছে বললে সে কাজ হারাবে। তাই প্যারাসিটামল বা এমনসব ওষুধ খেয়েই তারা সেটা পার করার চেষ্টা করবে। ছয়. বস্তিতে জনঘনত্ব নগরের অন্যসব এলাকার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের গোসল, রান্নাবান্না, থাকা-খাওয়া সবই গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে। ফলে একজন সংক্রমিত হলেই তার মাধ্যমে সেটা অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি। ছয়. আবার বস্তিবাসীদের মধ্যে মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া বা সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার হারও ছিল খুব কম। এসব মিলিয়ে বস্তিবাসীদের প্রায় ৭৪ ভাগই করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে গবেষণায় যে তথ্য প্রকাশ হয়েছে তাতে আমি মোটেই অবাক হইনি।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা এটাই যে বাংলাদেশিদের করোনায় ইমিউনিটি বেশি বা বস্তিবাসী, শ্রমজীবী বা গ্রামবাসীর করোনা হয় না এসব মিথ এই গবেষণায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল। ফলে আমি বলতে চাই, এসব মিথ এখন ভেঙে ফেলতে হবে। একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে করোনা মোকাবিলায় আমাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার ওপর আরও অনেক বেশি জোর দেওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর : আমরা দেখলাম গবেষণার ফল প্রকাশের এক দিন পরই রাত ১১টায় সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর বলেছে, ঢাকা মহানগরে কভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ে গবেষণার অন্তর্বর্তীকালীন যে ফল তারা জানিয়েছিলেন, সেটা পুরো ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করে না বা সেটা তারা দাবিও করেননি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
বে-নজীর আহমেদ : আমি তীব্রভাবে আইইডিসিআরের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করি। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক পরিচালক দুজনেই বলছেন এটা পুরো ঢাকাকে প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু কোনো গবেষণাতেই একটা শহর বা দেশের সব লোককে যুক্ত করা হয় না। তারা এখন বলছে স্যাম্পল সাইজটা ছোট। কিন্তু আইসিডিডিআর,বির অধ্যাপক মাহমুদুর রহমানের কাছে আমি শুনেছি, তারা প্রথমে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ঢাকা শহরের ২৩টা ওয়ার্ডকে সিলেক্ট করেছেন। ২৩টা ওয়ার্ড কম কথা নয়। তারপর প্রতিটি ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে স্যাম্পল সাইজ কত হলে চলে হিসাবনিকাশ করে সেটা ঠিক করেছেন। সে অনুযায়ীই তারা গবেষণাটা করেছেন। এখন যদি তারা বলেন যে, এটা সীমিত পরিসরে করা হয়েছেসেটা একটা অবৈজ্ঞানিক কথা।
দেশ রূপান্তর : আপনি যেমন বলছিলেন যে, করোনায় বাংলাদেশিদের ইমিউনিটি বেশি বলে একটা মিথ প্রচার করা হয়েছিল। তেমনি আমরা একটা সময় শুনেছি যে, রাজধানী ঢাকায় বা সারা দেশে একসময় হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে যাবে। এই গবেষণা সংশ্লিষ্টরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, মধ্য জুলাইয়ে ঢাকায় সংক্রমণের হার ৪৫ শতাংশ হয়ে থাকলে ওই ধারাবাহিকতায় আরও তিন মাসে এখন সেটা প্রায় ৬০-৬৫ ভাগ। সেক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে, তাহলে কি আমরা হার্ড ইমিউনিটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু গবেষণার ফল প্রকাশ করতে গিয়ে আইসিডিডিআর,বির সংক্রামক রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ফেরদৌসী কাদরি বলেছেন, হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠার কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না আর সংক্রমিত ব্যক্তিদের শরীরে কতদিন অ্যান্টিবডি থাকবে, তা-ও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করুন।
বে-নজীর আহমেদ : হার্ড ইমিউনিটির অনেকগুলো শর্ত আছে। প্রথম শর্ত হলো, কত ভাগ লোকের আক্রান্ত হতে হবে বা কত ভাগ লোককে ভ্যাকসিন দিতে হবে। সেটা ৮০ বা ৮৫ ভাগ হতে পারে। এটা নির্ভর করে একটা রোগের ইনকিউবিশন পিরিয়ড কত, রোগটির সংক্রমণের ক্ষমতা কতটা তার ওপর। এখন বস্তিবাসীর ৭৪ ভাগ বা ঢাকাবাসীর ৪৫ ভাগ থেকে বেড়ে আরও বেশি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তারপরও সেটা হার্ড ইমিউনিটির শর্ত পূরণ করে না। দ্বিতীয় শর্ত হলো, ইমিউনিটি পেতে হলে দেখতে হবে অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা দীর্ঘস্থায়ী। কিন্তু কভিডের বেলায় বিশ্বব্যাপী এখনো প্রমাণিত হয়নি যে, এর অ্যান্টিবডি দীর্ঘস্থায়ী। তাহলে দ্বিতীয় শর্তও পূরণ হচ্ছে না। আর তৃতীয়ত, দেখা গেছে যে যাদের উপসর্গহীন সংক্রমণ হয় এবং সেটা যদি দীর্ঘস্থায়ী অ্যান্টিবডি না দেয় তাহলে কী ঘটবে। এখন এই গবেষণায় বলা হচ্ছে, ৮২ ভাগ বা সিংহভাগই উপসর্গহীন আর এতে অ্যান্টিবডিও খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাহলে সত্যিই কার্যকর ভ্যাকসিন ছাড়া এভাবে আমাদের হার্ড ইমিউনিটির কোনো সুযোগ নেই।