মানুষ সচেতন হলে অবৈধ এমএলএম ব্যবসার মূলোৎপাটন সম্ভব: নাজমুল হক
পিরামিড আকৃতির মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ থাকার পরও এক ধরনের অসাধু লোক নানা কৌশলে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা মেরে এক সময় উধাও হয়ে যাচ্ছে এসব প্রতারকেরা। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আসায় অনেক মানুষ না বুঝেই পা দিচ্ছে এই প্রতারকদের ফাঁদে।
এমনই এক প্রতিষ্ঠান এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেড, গত ১০ মাসে ২৩ লাখ সদস্য সংগ্রহ করে তাদের থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের এমডি ও সিইও আলামিন প্রধানসহ (৩২) সহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) বিভাগের (ডিবি) অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।
অভিযানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ডিবি (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. নাজমুল হক।
তিনি এর আগেও একাধিক অবৈধ এমএলএম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন। এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন দৈনিক দেশ রূপান্তরকে।
তার সঙ্গে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক ইমন রহমান।
এমএলএম ব্যবসা নিয়ে একটি সাধারণ ধারণা দেবেন?
নাজমুল হক: এটি মূলত এক ধরনের কমিশনভিত্তিক ব্যবসা। ব্যবসায় কমিশন দিলেই যে সেটি এমএলএম হবে তা কিন্তু নয়। যেমন ধরেন আপনি কোনো কোম্পানির সদস্য হলেন। তাদের প্রোডাক্ট বা সেবা কিনলেন। পরবর্তী প্রোডাক্ট বা সেবা কেনার সময় আপনি নিবন্ধিত হওয়ার কারণে ডিস্কাউন্ট বা কমিশন পেলেন এটি কিন্তু এমএলএম হলো না। কিন্তু শর্ত বা প্রলোভন যদি এমন হয় যে, আপনি কাউকে রেফার করে সদস্য বানালে তার থেকে আপনি কমিশন পাবেন। আবার সে কাউকে মেম্বার বানালে সেও কমিশন পাবে আবার আপনিও একটা কমিশন পাবেন। অর্থাৎ নিচের লেয়ারে সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্য কমিশন যখন ওপরের সব লেয়ারে পৌঁছায় তখন সেটি এমএলএম হয়ে যায়। এ কমিশন পিরামিড আকৃতির হয় যা আমাদের দেশের আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ব্যবসায় একটি টিমের শুরুর দিকে অর্থাৎ আপলিংকে যিনি থাকেন তিনি তার ডাউন লিংকের সদস্যদের কাজ (যেমন পণ্যের প্যাকেজ বিক্রি, নতুন সদস্য নিবন্ধন ফি ইত্যাদি) থেকে কমিশন প্রাপ্ত হতে থাকেন। এ কারণে প্রতিটি সদস্যই কমিশনের জন্য তার ডাউন লিংকে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। কেননা ডাউন লিংকে সদস্য যত বেশি হবে আপলিংক তত বেশি কমিশন পায়।
এ ব্যবসা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ কী?
নাজমুল হক: ধরেন, আপনি একটি ব্যবসায় সদস্য হলেন ১৫০০ টাকা দিয়ে। অফার হলো, আপনি তিনজনকে আপনার ডাউনলিংকে জয়েন করালে প্রতিজনের জন্য ৫০০ টাকা করে পাবেন। আপনি তিনজনকে জয়েন করালেন এবং ১৫০০ টাকা কমিশনও পেলেন, আপনার বিনিয়োগ উঠে গেল। আপনার ডাউন লিংকের এই তিনজন আবার তাদের বিনিয়োগ তোলার জন্য তাদের জন্য ডাউন লিংকে ৯ জনকে আনল। আপনার নিচের তিনজনের বিনিয়োগের টাকা উঠে গেল এবং আপনার টিমে থাকার কারণে আপনি একটি নির্দিষ্ট হার কমিশন পেলেন। এখন আপনি কিন্তু বসে বসে কমিশন পেয়ে লাভের মধ্যে চলে গেলেন। তারপর ওই নয়জনের আবার ২৭ জনকে আনতে হবে। এভাবে যেতে যেতে এক সময় সারা পৃথিবীর বিনিয়োগ করার মতো সামর্থ্যবান মানুষ যদি আপনার টিমে যুক্ত হয় তাহলেও যারা সব শেষে জয়েন করল তারা কিন্তু তাদের বিনিয়োগের টাকা তোলার জন্য চাইলেও আর কাউকে জয়েন করাতে পারবে না। কারণ আর তো কোনো লোকই অবশিষ্ট নেই। তাই নিচের লেয়ায়ের সব লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। লাভবান হবেন আপনি এবং আপনার চেয়ে নিচের কয়েক স্তরের লোক।
আর অন্য দিকে কোম্পানির লাভ যদি হিসেব করেন তাহলে দেখবেন, আপনি দিলেন ১৫০০ টাকা, আপনার নিচের তিনজন দিল ৪৫০০ টাকা। কোম্পানির ফান্ডে যখন ৬০০০ টাকা তখন আপনি কমিশন পেলেন ১৫০০ টাকা। তার মানে তখন কোম্পানির লাভ ৪৫০০ টাকা। পরের নয়জন দিল ১৩,৫০০ টাকা। এবার আপনার নিচের তিনজন কমিশন পেল ৪৫০০ টাকা। আপনি পেলেন ২০০ টাকা, মোট ৪৭০০ টাকা। কোম্পানির থাকল ১৩৫০০- ৪৭০০= ৮৮০০ টাকা। আপনার টিমে এখন আপনিসহ ১+৩+৯= ১৩ জন, কোম্পানির আয়= ৪৫০০+৮৮০০= ১৩৩০০ টাকা।
এভাবে আপনাকে বা আপনাদের দিয়েই কিন্তু কোম্পানি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন নিম্নমানের প্রোডাক্ট বেশি দামে সদস্যদের কাছে বিক্রি করে আবার সেই কমিশনের টাকা কোম্পানির কাছেই চলে আসছে। আবার কোনো কোনো কোম্পানি কমিশনের টাকা শুরুর দিকে দিলেও পরে টালবাহানা করতে থাকে। এক সময় ব্যবসা গুটিয়ে পালিয়ে যায়। তাই এসব বিষয় বিবেচনায়, পিরামিড আকৃতির কমিশনভিত্তিক ব্যবসা বাংলাদেশে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ( নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রতারক চক্র প্রাথমিকভাবে কীভাবে ব্যবসা শুরু করে?
নাজমুল হক: আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, প্রথমে এরা ই-কমার্স বা অন্য কোনো বৈধ ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এই লাইসেন্স দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের মাঝে সহজেই বিশ্বাস স্থাপন করে যে এটি একটি অনুমোদিত ব্যবসা। তারপর তাদের বিভিন্ন জেনারেশনভিত্তিক কমিশনের লোভ, ফ্ল্যাট, গাড়ি ইত্যাদি অর্জনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের আকৃষ্ট করে থাকে। এই অননুমোদিত ব্যবসা আড়াল করার জন্য তারা তাদের নিবন্ধিত সদস্যদের নিকট বিভিন্ন নিম্নমানের পণ্য বিক্রয় করে থাকে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, এরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ই-কমার্সের কথা বলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে সদস্য নিবন্ধন করে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, ভিডিও দেখে ইনকাম, বিনিয়োগ করলেই অধিক কমিশন- এ রকম চমকপ্রদ লোভনীয় অফারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের টাকা বিনিয়োগ করিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে।
অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন?
নাজমুল হক: আইনগত যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আসলে প্রতিকূলতার ব্যাপার নেই। তবে যারা না জেনে না বুঝে এ রকম এমএলএম ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন তারা কেউ কেউ প্রাথমিকভাবে একটু নেতিবাচক আচরণ বা ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন। এটা এই কারণে যে, তারা তখনো মনে করে কোম্পানির কার্যক্রম বোধ হয় সঠিক। কেননা, কোম্পানি তো তাদের বুঝিয়েছে এটি ই-কমার্স বা অন্য কোনো অনুমোদিত ব্যবসা। তারপর যখন কোম্পানি আর থাকে না (আইন প্রয়োগ বা কোম্পানি ভেগে গেলে) তখন তারা বুঝতে পারে যে তারা আসলে প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে। এরপর প্রথম যাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করত, বোঝার পর, তাদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করে।
ডিবি সাধারণত কোনো মামলা বা কারও অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আপনারা অনুসন্ধানের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছেন। এ বিষয়টি অন্যদের জন্য অনুসরণীয়। আপনার অনুভূতি কী?
নাজমুল হক: আসলে ডিবি শুধু কারও অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতেই নয় বরং গোপন তথ্যের ভিত্তিতেও কাজ করে। তা ছাড়া ডিবি (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) বিভাগ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংঘটিত অপরাধ মনিটরিংয়ের ভিত্তিতেও কাজ করে থাকে। আমাদের এবারের কাজটিও অনলাইন অপরাধ মনিটরিং ও সিনিয়রদের দিক নির্দেশনায় করা হয়েছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আসলে কারও কাজ অনুসরণের বিষয় নেই। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য ও আইনের বিধান অনুসরণ।
তবে হাঁ, ভালো লাগছে এই ভেবে যে, এই অভিযানের ফলে দেশি-বিদেশি অসংখ্য সাধারণ মানুষ যারা এখনো বিনিয়োগ করেনি কিন্তু করতে পারত তারা এই প্রতারণার জাল থেকে মুক্তি পেল। কেননা যে হারে এর সম্প্রসারণ হচ্ছিল মাত্র ১০ মাসে প্রায় ২৩ লাখ আইডি হয়ে গিয়েছিল। এটি আর এক বছর চললে কত লোক যে না বুঝে এখানে বিনিয়োগ করত তার ইয়ত্তা নেই। সর্বশেষ যখন তাদের ডাউনলিংকে আইডি করার মতো আর কেউ থাকত না তখন কত মানুষ যে প্রতারিত হতো সেটি আমরা ডেসটিনির অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে ডেসটিনি থেকেও আরো বেশি হতে পারত কেননা ডেসটিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশভিত্তিক ছিল। কিন্তু এটি ছিল বিশ্বব্যাপী। ইতিমধ্যে এখানে প্রায় ৫ লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশি ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। সুতরাং এই অভিযানের ফলে জনগণের মাঝে যেমন সচেতনতা তৈরি হবে এবং এ সম্পর্কিত ব্যবসা আরও অধিকতর মনিটরিংয়ের আওতায় আসবে। সেই সঙ্গে যারা এসব ব্যবসা পরিচালনা করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তাদের জন্যও কাজটি কঠিন হবে।
এদের ফাঁদে পা দেওয়ার কারণ কী, কীভাবে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, এ বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
নাজমুল হক: ফাঁদে পা দেওয়ার কারণ হলো মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এবং মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (নিয়ন্ত্রণ) আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারকরা সহজেই মানুষকে প্রলোভনে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কেউ কেউ মনে করেন, মাল্টি লেভেল আইন পাস হয়েছে মানে এখন থেকে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বৈধ। কিন্তু আইন অনুসারে, এমএলএম ব্যবসা করতে হলে তার অবশ্যই মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের লাইসেন্স থাকতে হবে, অন্য কোনো ব্যবসার লাইসেন্স হলে হবে না।
এ ছাড়া এ ধরনের কোম্পানি বেশি দিন টিকতে পারবে না প্রতারকরা সেটা জানে। তাই স্বল্প মেয়াদে টাকা হাতিয়ে সটকে পড়ে তখন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেকটি ব্যাপার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যার মাধ্যমে জয়েন করেছিল তাদের মধ্যেও কিন্তু বিবাদের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় তা চরম শত্রুতায় পরিণত হয়।
পদক্ষেপের ব্যাপারে যদি বলেন, এ ধরনের ব্যবসা সম্পর্কে জনগণ সচেতন হলে এদের ব্যবসা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। তারপরও যদি এ রকম কোনো কোম্পানির অস্তিত্বের সংবাদ বা কেউ যদি এ রকম ব্যবসার অফার পায় তখন সাধারণ মানুষের উচিত হবে বিনিয়োগ না করে বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করা। আমরা তো মনিটর করছিই। সাধারণ মানুষ তথ্য দিলে কাজটা আরো সহজ হয়।
কীভাবে এ প্রতারণামূলক ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে দূর করা যায়?
নাজমুল হক: বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনেকগুলো এমএলএম কোম্পানির পরিণতি সম্পর্কে আমাদের জানা আছে। তারপরও মানুষ এদের ফাঁদে পা দেয়। কোথাও টাকা বিনিয়োগ করার আগে মানুষের ভাবা উচিত, যারা কমিশনে বড়লোক করার অফার যারা দেয়, তারা টিকবে না। টাকা আয় করার এত সহজ পথ থাকলে মানুষ এত পরিশ্রম করে কেন? সবাই তো এটাই করত। এই বোধ মানুষের মাঝে তৈরি হলে, মানুষ সচেতন হলে এ ধরনের ব্যবসার মূলোৎপাটন করা সম্ভব। তা ছাড়া আইন প্রয়োগ তো আছেই। আইন প্রয়োগ করলেও অনেক ক্ষেত্রে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত থেকে যায়। তাই সব চেয়ে ভালো এসব ব্যবসায় বিনিয়োগ না করা। আর সচেতনতা সৃষ্টিতে মিডিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নাজমুল হক: আপনাকে ও দেশ রূপান্তর পরিবারকেও ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

পিরামিড আকৃতির মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা বাংলাদেশে নিষিদ্ধ থাকার পরও এক ধরনের অসাধু লোক নানা কৌশলে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা মেরে এক সময় উধাও হয়ে যাচ্ছে এসব প্রতারকেরা। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আসায় অনেক মানুষ না বুঝেই পা দিচ্ছে এই প্রতারকদের ফাঁদে।
এমনই এক প্রতিষ্ঠান এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেড, গত ১০ মাসে ২৩ লাখ সদস্য সংগ্রহ করে তাদের থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের এমডি ও সিইও আলামিন প্রধানসহ (৩২) সহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) বিভাগের (ডিবি) অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।
অভিযানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন ডিবি (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. নাজমুল হক।
তিনি এর আগেও একাধিক অবৈধ এমএলএম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন। এ বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন দৈনিক দেশ রূপান্তরকে।
তার সঙ্গে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদক ইমন রহমান।
এমএলএম ব্যবসা নিয়ে একটি সাধারণ ধারণা দেবেন?
নাজমুল হক: এটি মূলত এক ধরনের কমিশনভিত্তিক ব্যবসা। ব্যবসায় কমিশন দিলেই যে সেটি এমএলএম হবে তা কিন্তু নয়। যেমন ধরেন আপনি কোনো কোম্পানির সদস্য হলেন। তাদের প্রোডাক্ট বা সেবা কিনলেন। পরবর্তী প্রোডাক্ট বা সেবা কেনার সময় আপনি নিবন্ধিত হওয়ার কারণে ডিস্কাউন্ট বা কমিশন পেলেন এটি কিন্তু এমএলএম হলো না। কিন্তু শর্ত বা প্রলোভন যদি এমন হয় যে, আপনি কাউকে রেফার করে সদস্য বানালে তার থেকে আপনি কমিশন পাবেন। আবার সে কাউকে মেম্বার বানালে সেও কমিশন পাবে আবার আপনিও একটা কমিশন পাবেন। অর্থাৎ নিচের লেয়ারে সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্য কমিশন যখন ওপরের সব লেয়ারে পৌঁছায় তখন সেটি এমএলএম হয়ে যায়। এ কমিশন পিরামিড আকৃতির হয় যা আমাদের দেশের আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ ব্যবসায় একটি টিমের শুরুর দিকে অর্থাৎ আপলিংকে যিনি থাকেন তিনি তার ডাউন লিংকের সদস্যদের কাজ (যেমন পণ্যের প্যাকেজ বিক্রি, নতুন সদস্য নিবন্ধন ফি ইত্যাদি) থেকে কমিশন প্রাপ্ত হতে থাকেন। এ কারণে প্রতিটি সদস্যই কমিশনের জন্য তার ডাউন লিংকে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির চেষ্টায় ব্যস্ত থাকেন। কেননা ডাউন লিংকে সদস্য যত বেশি হবে আপলিংক তত বেশি কমিশন পায়।
এ ব্যবসা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ কী?
নাজমুল হক: ধরেন, আপনি একটি ব্যবসায় সদস্য হলেন ১৫০০ টাকা দিয়ে। অফার হলো, আপনি তিনজনকে আপনার ডাউনলিংকে জয়েন করালে প্রতিজনের জন্য ৫০০ টাকা করে পাবেন। আপনি তিনজনকে জয়েন করালেন এবং ১৫০০ টাকা কমিশনও পেলেন, আপনার বিনিয়োগ উঠে গেল। আপনার ডাউন লিংকের এই তিনজন আবার তাদের বিনিয়োগ তোলার জন্য তাদের জন্য ডাউন লিংকে ৯ জনকে আনল। আপনার নিচের তিনজনের বিনিয়োগের টাকা উঠে গেল এবং আপনার টিমে থাকার কারণে আপনি একটি নির্দিষ্ট হার কমিশন পেলেন। এখন আপনি কিন্তু বসে বসে কমিশন পেয়ে লাভের মধ্যে চলে গেলেন। তারপর ওই নয়জনের আবার ২৭ জনকে আনতে হবে। এভাবে যেতে যেতে এক সময় সারা পৃথিবীর বিনিয়োগ করার মতো সামর্থ্যবান মানুষ যদি আপনার টিমে যুক্ত হয় তাহলেও যারা সব শেষে জয়েন করল তারা কিন্তু তাদের বিনিয়োগের টাকা তোলার জন্য চাইলেও আর কাউকে জয়েন করাতে পারবে না। কারণ আর তো কোনো লোকই অবশিষ্ট নেই। তাই নিচের লেয়ায়ের সব লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। লাভবান হবেন আপনি এবং আপনার চেয়ে নিচের কয়েক স্তরের লোক।
আর অন্য দিকে কোম্পানির লাভ যদি হিসেব করেন তাহলে দেখবেন, আপনি দিলেন ১৫০০ টাকা, আপনার নিচের তিনজন দিল ৪৫০০ টাকা। কোম্পানির ফান্ডে যখন ৬০০০ টাকা তখন আপনি কমিশন পেলেন ১৫০০ টাকা। তার মানে তখন কোম্পানির লাভ ৪৫০০ টাকা। পরের নয়জন দিল ১৩,৫০০ টাকা। এবার আপনার নিচের তিনজন কমিশন পেল ৪৫০০ টাকা। আপনি পেলেন ২০০ টাকা, মোট ৪৭০০ টাকা। কোম্পানির থাকল ১৩৫০০- ৪৭০০= ৮৮০০ টাকা। আপনার টিমে এখন আপনিসহ ১+৩+৯= ১৩ জন, কোম্পানির আয়= ৪৫০০+৮৮০০= ১৩৩০০ টাকা।
এভাবে আপনাকে বা আপনাদের দিয়েই কিন্তু কোম্পানি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন নিম্নমানের প্রোডাক্ট বেশি দামে সদস্যদের কাছে বিক্রি করে আবার সেই কমিশনের টাকা কোম্পানির কাছেই চলে আসছে। আবার কোনো কোনো কোম্পানি কমিশনের টাকা শুরুর দিকে দিলেও পরে টালবাহানা করতে থাকে। এক সময় ব্যবসা গুটিয়ে পালিয়ে যায়। তাই এসব বিষয় বিবেচনায়, পিরামিড আকৃতির কমিশনভিত্তিক ব্যবসা বাংলাদেশে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ( নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
প্রতারক চক্র প্রাথমিকভাবে কীভাবে ব্যবসা শুরু করে?
নাজমুল হক: আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি, প্রথমে এরা ই-কমার্স বা অন্য কোনো বৈধ ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। এই লাইসেন্স দেখিয়ে সাধারণ মানুষদের মাঝে সহজেই বিশ্বাস স্থাপন করে যে এটি একটি অনুমোদিত ব্যবসা। তারপর তাদের বিভিন্ন জেনারেশনভিত্তিক কমিশনের লোভ, ফ্ল্যাট, গাড়ি ইত্যাদি অর্জনের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের আকৃষ্ট করে থাকে। এই অননুমোদিত ব্যবসা আড়াল করার জন্য তারা তাদের নিবন্ধিত সদস্যদের নিকট বিভিন্ন নিম্নমানের পণ্য বিক্রয় করে থাকে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, এরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ই-কমার্সের কথা বলে বিভিন্ন ওয়েবসাইট, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে সদস্য নিবন্ধন করে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, ভিডিও দেখে ইনকাম, বিনিয়োগ করলেই অধিক কমিশন- এ রকম চমকপ্রদ লোভনীয় অফারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের টাকা বিনিয়োগ করিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে।
অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন?
নাজমুল হক: আইনগত যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে আসলে প্রতিকূলতার ব্যাপার নেই। তবে যারা না জেনে না বুঝে এ রকম এমএলএম ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন তারা কেউ কেউ প্রাথমিকভাবে একটু নেতিবাচক আচরণ বা ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকেন। এটা এই কারণে যে, তারা তখনো মনে করে কোম্পানির কার্যক্রম বোধ হয় সঠিক। কেননা, কোম্পানি তো তাদের বুঝিয়েছে এটি ই-কমার্স বা অন্য কোনো অনুমোদিত ব্যবসা। তারপর যখন কোম্পানি আর থাকে না (আইন প্রয়োগ বা কোম্পানি ভেগে গেলে) তখন তারা বুঝতে পারে যে তারা আসলে প্রতারণার ফাঁদে পড়েছে। এরপর প্রথম যাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করত, বোঝার পর, তাদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করে।
ডিবি সাধারণত কোনো মামলা বা কারও অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আপনারা অনুসন্ধানের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েছেন। এ বিষয়টি অন্যদের জন্য অনুসরণীয়। আপনার অনুভূতি কী?
নাজমুল হক: আসলে ডিবি শুধু কারও অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতেই নয় বরং গোপন তথ্যের ভিত্তিতেও কাজ করে। তা ছাড়া ডিবি (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম) বিভাগ অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সংঘটিত অপরাধ মনিটরিংয়ের ভিত্তিতেও কাজ করে থাকে। আমাদের এবারের কাজটিও অনলাইন অপরাধ মনিটরিং ও সিনিয়রদের দিক নির্দেশনায় করা হয়েছে। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে আসলে কারও কাজ অনুসরণের বিষয় নেই। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন অপরাধ সম্পর্কিত তথ্য ও আইনের বিধান অনুসরণ।
তবে হাঁ, ভালো লাগছে এই ভেবে যে, এই অভিযানের ফলে দেশি-বিদেশি অসংখ্য সাধারণ মানুষ যারা এখনো বিনিয়োগ করেনি কিন্তু করতে পারত তারা এই প্রতারণার জাল থেকে মুক্তি পেল। কেননা যে হারে এর সম্প্রসারণ হচ্ছিল মাত্র ১০ মাসে প্রায় ২৩ লাখ আইডি হয়ে গিয়েছিল। এটি আর এক বছর চললে কত লোক যে না বুঝে এখানে বিনিয়োগ করত তার ইয়ত্তা নেই। সর্বশেষ যখন তাদের ডাউনলিংকে আইডি করার মতো আর কেউ থাকত না তখন কত মানুষ যে প্রতারিত হতো সেটি আমরা ডেসটিনির অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে ডেসটিনি থেকেও আরো বেশি হতে পারত কেননা ডেসটিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশভিত্তিক ছিল। কিন্তু এটি ছিল বিশ্বব্যাপী। ইতিমধ্যে এখানে প্রায় ৫ লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশি ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। সুতরাং এই অভিযানের ফলে জনগণের মাঝে যেমন সচেতনতা তৈরি হবে এবং এ সম্পর্কিত ব্যবসা আরও অধিকতর মনিটরিংয়ের আওতায় আসবে। সেই সঙ্গে যারা এসব ব্যবসা পরিচালনা করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তাদের জন্যও কাজটি কঠিন হবে।
এদের ফাঁদে পা দেওয়ার কারণ কী, কীভাবে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, এ বিষয়ে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
নাজমুল হক: ফাঁদে পা দেওয়ার কারণ হলো মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এবং মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (নিয়ন্ত্রণ) আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অনেকেরই স্বচ্ছ ধারণা না থাকা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারকরা সহজেই মানুষকে প্রলোভনে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। কেউ কেউ মনে করেন, মাল্টি লেভেল আইন পাস হয়েছে মানে এখন থেকে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বৈধ। কিন্তু আইন অনুসারে, এমএলএম ব্যবসা করতে হলে তার অবশ্যই মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের লাইসেন্স থাকতে হবে, অন্য কোনো ব্যবসার লাইসেন্স হলে হবে না।
এ ছাড়া এ ধরনের কোম্পানি বেশি দিন টিকতে পারবে না প্রতারকরা সেটা জানে। তাই স্বল্প মেয়াদে টাকা হাতিয়ে সটকে পড়ে তখন সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরেকটি ব্যাপার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যার মাধ্যমে জয়েন করেছিল তাদের মধ্যেও কিন্তু বিবাদের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় তা চরম শত্রুতায় পরিণত হয়।
পদক্ষেপের ব্যাপারে যদি বলেন, এ ধরনের ব্যবসা সম্পর্কে জনগণ সচেতন হলে এদের ব্যবসা এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। তারপরও যদি এ রকম কোনো কোম্পানির অস্তিত্বের সংবাদ বা কেউ যদি এ রকম ব্যবসার অফার পায় তখন সাধারণ মানুষের উচিত হবে বিনিয়োগ না করে বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করা। আমরা তো মনিটর করছিই। সাধারণ মানুষ তথ্য দিলে কাজটা আরো সহজ হয়।
কীভাবে এ প্রতারণামূলক ব্যবসা বাংলাদেশ থেকে দূর করা যায়?
নাজমুল হক: বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনেকগুলো এমএলএম কোম্পানির পরিণতি সম্পর্কে আমাদের জানা আছে। তারপরও মানুষ এদের ফাঁদে পা দেয়। কোথাও টাকা বিনিয়োগ করার আগে মানুষের ভাবা উচিত, যারা কমিশনে বড়লোক করার অফার যারা দেয়, তারা টিকবে না। টাকা আয় করার এত সহজ পথ থাকলে মানুষ এত পরিশ্রম করে কেন? সবাই তো এটাই করত। এই বোধ মানুষের মাঝে তৈরি হলে, মানুষ সচেতন হলে এ ধরনের ব্যবসার মূলোৎপাটন করা সম্ভব। তা ছাড়া আইন প্রয়োগ তো আছেই। আইন প্রয়োগ করলেও অনেক ক্ষেত্রে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত থেকে যায়। তাই সব চেয়ে ভালো এসব ব্যবসায় বিনিয়োগ না করা। আর সচেতনতা সৃষ্টিতে মিডিয়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
নাজমুল হক: আপনাকে ও দেশ রূপান্তর পরিবারকেও ধন্যবাদ।