রাজনৈতিক সচেতনতাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল
এ কাইয়ূম খান
বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা এ কাইয়ূম খান ১৯৫১ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এএমএম খান ছিলেন পেশাদার কেমিস্ট; ষাটের দশকে ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের প্রথম ওষুধ কোম্পানি ‘ফার্মাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। তার মায়ের নাম রওশন আরা খান। ১৯৬৮ সালে ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন এবং প্রথম বর্ষে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি বিদেশে উচ্চতর অধ্যয়ন করেন এবং ফিন্যান্সে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের Bittersweet victory a freedom fighters tale (UPL), যা পরে বাংলায় ‘তিক্ত মধুর বিজয় : একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প’ নামে ‘বেঙ্গল বই’ থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮১ সালে এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও পূর্বাপর নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : আপনার স্কুলজীবন কেটেছে ষাটের দশকে। স্কুলে পড়ার সময় কি রাজনীতি কিংবা দেশ নিয়ে ভাবতেন? মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণা কীভাবে তৈরি হলো?
এ কাইয়ূম খান : প্রথমত আমাদের শিক্ষকদের কথা বলব। আমাদের স্কুল-কলেজে দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া সব শিক্ষকই বাঙালি ছিলেন, তারা খুবই মেধাবী শিক্ষক ছিলেন। তাদের অনেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কেউ কেউ ছাত্র অবস্থাতেই রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কাজ করেছেন। আমরা বোর্ডিং স্কুলে থাকায় ক্লাসের বাইরেও ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের অনেকটা সময় পেতাম। তারা বঙ্গভঙ্গ, পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস এবং বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের কথা বলতেন। একটা কথা খুব জোর দিয়েই তারা বলতেন যে বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় বলা প্রয়োজন। ষাট দশকের শেষদিকের সাংস্কৃতিক জাগরণও আমাদের প্রভাবিত করেছিল। স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই আমরা রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনে পাকিস্তানের বাধাপ্রদানের কথা জানতে পারি। ১৯৬৭ সালে তো ছায়ানট রমনার বটমূলে প্রভাতি অনুষ্ঠানে বর্ষবরণ শুরু করল। ছায়ানটের পৃষ্ঠপোষকদের অনেকে আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। সে সুবাদে পারিবারিকভাবেও এসবের প্রভাব ছিল। এছাড়া ঢাকায় তখন আরও অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিল, সেসবে আমরা যেতাম। আর সত্যি কথা কি, এসব থেকেই তো মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। এ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতাই আমাকে, আমার মতো অনেককেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
দেশ রূপান্তর : এ তো গেল স্কুলের কথা। ষাটের দশকের শেষভাগ তো ঢাকায় রাজনীতির এক উত্তাল জাগরণের সময়। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সময়। কলেজে পড়ার সময় কি রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন?
এ কাইয়ূম খান : আমি নটর ডেম কলেজে পড়তাম। সেটা মিশনারি ফাদাররা পরিচালনা করতেন। সেখানে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা ছিল। ফলে ছাত্ররা কখনই রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের আর আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। তখন ছাত্ররা কলেজ থেকেই মিছিল নিয়ে ঢাকার বড় বড় মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করল। তখন তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ডাকসুর ভিপি। আমরা তখন মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিতাম। ঊনসত্তরের এই ছাত্র অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করার আন্দোলনে রূপ নিল। আর এর পরিসমাপ্তিও ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে।
দেশ রূপান্তর : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার শুরুর কথা শুনতে চাই। কবে কীভাবে যুদ্ধে গেলেন?
এ কাইয়ূম খান : আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। পঁচিশে মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরুর মধ্য দিয়ে একটা ভয়াবহ ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। ২৭ মার্চ যেদিন প্রথম কারফিউ ভাঙল সেদিন আমি শেখ কামালের সন্ধানে ধানম-িতে গিয়েছিলাম। শেখ কামাল আমার বন্ধু ছিল। পাকিস্তানি আর্মি তখন আমাকে আটকায়। সম্ভবত আমি ভালো উর্দু বলতে পারতাম বলে সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যায়। কিছুদিনে সেরে উঠলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা শহরের অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পারলাম আমাদের সামনে মাত্র দুটি পথই খোলা হয় বাড়িতে বা অন্য কোথাও পাকিস্তানি হানাদারদের গুলি খেয়ে মরতে হবে; নয়তো যুদ্ধে গিয়ে লড়াই করে মরতে হবে। অন্য অনেকের মতো আমিও যুদ্ধে গিয়ে মরার জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করলাম।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা মতিনগর গেলাম। ঢাকা থেকে কুমিল্লার পথে গেলাম, চান্দিনা বাজার থেকে পূর্বদিকে ভারতের আগরতলার মতিনগরে একটা প্রশিক্ষণ শিবির ছিল, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাওয়া ভলান্টিয়ারদের রিক্রুট করার জন্য। আমি প্রথম সেখানে যুক্ত হলাম। মতিনগরে প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরই আমাকে আবার ঢাকায় আসতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বাঙালি অফিসারদের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুজিবনগর সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছিল। আমাদের ছোট একটা দল ঢাকায় পাঠানো হলো মেজর শাফায়েত জামিল, মেজর নূরুল ইসলাম আর মেজর খালেদ মোশাররফের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যেতে। খালেদ মোশাররফের পরিবারে সঙ্গে আমরা সংযোগ স্থাপন করতে পারিনি। বাকি দুই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। কিন্তু নূরুল ইসলামের পরিবার মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত থাকায় তাদের কাউকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা মেজর শাফায়েত জামিলের স্ত্রী এবং দুই শিশু সন্তানকে নিরাপদে আগরতলায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম।
দেশ রূপান্তর : এরপর কী হলো? মুক্তিবাহিনীতে আপনি কোথায় কেমন সামরিক প্রশিক্ষণ পেলেন? আপনি তো মুক্তিবাহিনীর ‘ফার্স্ট ওয়ার কোর্স’-এর সদস্য ছিলেন। একাত্তরে যাদের ‘মুক্তি’ বলে ডাকা হতো?
এ কাইয়ূম খান : মতিনগর থেকে আমি চলে যাই মেজর শাফায়েত জামিলের সঙ্গে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মেজর শাফায়েত জামিলকে অধিনায়ক নিয়োগ দিয়ে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। এই পুনর্গঠনের কাজ হচ্ছিল পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটের রাইগঞ্জে। সেখানে একটা বিশাল ‘যুব শিবির’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাওয়া তরুণ-যুবকদের শারীরিক-মানসিকভাবে প্রস্তুত করে প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্য। সে সময় মুজিবনগর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিবাহিনীকে আরও গোছানোর জন্য প্রশিক্ষিত নেতৃত্ব বা প্রশিক্ষিত সেনা অফিসার সৃষ্টি করতে হবে যাতে একসময় গেরিলা যুদ্ধের ধরন থেকে নিয়মিত বাহিনীর যুদ্ধে উত্তরণ ঘটানো যায়। তখন বালুরঘাট যুবশিবির থেকে মাত্র দুজন নির্বাচিত হয়েছিল। একজন ছিলেন কায়সার হক (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক), আরেকজন আমি। সারা দেশ থেকে তখন এরকম ৬০ জন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হলো প্রশিক্ষণের জন্য। ফার্স্ট ওয়ার কোর্সের এই ৬০ জনকে তখন পাঠানো হলো জলপাইগুড়ির ‘মূর্তি’ নামের একটা জায়গায়। হিমালয়ের পাদদেশে চা বাগানঘেরা পাহাড়ি এলাকা মূর্তি; এটা জলঢাকা রিজার্ভ ফরেস্টসংলগ্ন। সেখানে আমাদের ১৫ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ হলো। এরপর আমাদের এই ওয়ার কোর্সের ৬০ জনকে বাংলাদেশের ১১টা সেক্টর এবং ৩টা ব্রিগেড কে-ফোর্স, এস-ফোর্স ও জেড-ফোর্সে নিয়োগ দেওয়া হলো।
দেশ রূপান্তর : আপনার নিয়োগ কোথায় হলো, কোন সেক্টরে?
এ কাইয়ূম খান : আমি কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে ৭ নম্বর সেক্টরে জয়েন করলাম। উত্তরে ঠাকুরগাঁও, দক্ষিণে পাবনা, পশ্চিমে পদ্মা নদী, পূর্বে যমুনা নদী নিয়ে রাজশাহী-বগুড়াসহ এই পুরো এলাকা ছিল সেক্টর-৭। সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হলো ৩ নম্বর সাব-সেক্টরে। সেখানকার অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, যিনি ১৪ ডিসেম্বরের সম্মুখ সমরে শহীদ হন এবং পরবর্তীকালে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি পান। তিনি আমার কমান্ডার ছিলেন। সেখানে এসে দেখলাম মুক্তিবাহিনীতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদের অভাবসহ প্রশিক্ষণের সমস্যাসহ আরও অনেক সমস্যা। ভীষণ প্রতিকূল অবস্থাতেই আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জয়েন করে ডিসেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্বে আমরা অনেকগুলো অপারেশনে অংশগ্রহণ করি।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধে আপনার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে এমন একটা সম্মুখ সমর বা স্মরণীয় অপারেশনের কথা আমাদের বলুন।
এ কাইয়ূম খান : আমি যুদ্ধে আমাদের শেষ অপারেশনের কথাটাই আপনাকে বলি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এতে ভারতীয় বিএসএফের আর্টিলারি ছাড়া সম্পূর্ণ যুদ্ধটাই মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করেছে। এখানে আমাদের মোট পাঁচ কোম্পানি মুক্তিবাহিনী তিনটা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আক্রমণ চালায়। অফিসারদের মধ্যে একটা গ্রুপে ছিলাম ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আর আমি, আরেকটা গ্রুপে ছিলেন লেফটেন্যান্ট বজলুর রশীদ ও লেফটেন্যান্ট রফিক, আরেকটা গ্রুপে একা ছিলেন লেফটেন্যান্ট আওয়াল চৌধুরী। আমরা কানসাট, শিবগঞ্জ দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে মহানন্দা নদীর উত্তরপাড় আসলাম, দক্ষিণপাড়েই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর। শহর এলাকায় অপারেশন চালানোর রণকৌশল সাধারণ গেরিলা অপারেশনের চেয়ে অনেক ভিন্ন। কিন্তু আমাদের কাছে এ ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্রের প্রায় কিছুই আমাদের ছিল না। আমরা রাইফেল, সাবমেশিনগান, লাইট-মেশিনগান, মর্টার আর গ্রেনেড নিয়েই এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এর মধ্যে গ্রেনেড ছিল সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
১৪ ডিসেম্বর সকালে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণ শুরু করি। প্রথম দুই-তিন ঘণ্টা আমরা খুব ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি আর আমার কমান্ডার জাহাঙ্গীর দেখলাম শহরের কিছু কিছু দালানের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী মেশিনগানসহ অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিয়েছে। ওরা প্রচুর গুলি ছুড়ছিল। আমাদের আর এগোনো সম্ভব হচ্ছে না দেখে জাহাঙ্গীর এগিয়ে গিয়ে শত্রুদের তাক করা এলএমজির ওপর একটা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সেটা বিকল করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিক্ষেপও করেছিলেন। এ সময় পাশের কোনো একটা বিল্ডিংয়ের পজিশন থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটা গুলি এসে সরাসরি তার বাম চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেখানেই শহীদ হন। কিন্তু আমরা পিছু হটিনি। এই যুদ্ধ ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত চালিয়ে গেছি। ওই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
দেশ রূপান্তর : যুদ্ধ শেষে আপনি বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করলেন। স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীতে আপনার কী অভিজ্ঞতা হলো?
এ কাইয়ূম খান : স্বাধীনতার পর ৭ নম্বর সেক্টর হয়ে গেল ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। প্রথমে সেখানকার অ্যাডজুট্যান্ট ছিলাম। এরপর তো সেনাবাহিনীর চাকরি যা হয়। বিভিন্ন জায়গায় বদলি হলাম। থার্ড ইস্ট বেঙ্গলে ছিলাম। আমি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও যাই। একসময় আমি জেনারেল জিয়াউর রহমানের এডিসি ছিলাম। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যাকা-ের মামলায় আমাকে অভিযুক্ত করা হলো। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ না পেয়ে আমাকে খালাস করা হলো। আমি সেনাবাহিনী ছেড়ে বিদেশে চলে গেলাম এবং দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলাম।
দেশ রূপান্তর : আপনি চাকরি ছাড়লেন নাকি আপনাকে অবসর দেওয়া হলো?
এ কাইয়ূম খান : বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হলো।
দেশ রূপান্তর : আমরা বর্তমানে চলে আসি। আমরা এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আছি। আপনারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। আজকের বাংলাদেশকে কীভাবে দেখেন?
এ কাইয়ূম খান : একটা বিষয় হলো, যখন আমরা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক অবস্থান দেখি আর তার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করি, তখন দেখি বাংলাদেশ অবশ্যই পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ভারতের থেকেও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ভালো। এগুলো সবই তো স্বাধীনতার অর্জন। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই এসব সম্ভব হয়েছে। উন্নতি হয়েছে, উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেটা সমাজের সবক্ষেত্রে নয়, সবার জন্যও নয়।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার যে বাংলাদেশ সে বাংলাদেশ আমরা কতটা নির্মাণ করতে পেরেছি বলে মনে করেন? মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা সেটা আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেটা কতটা ধারণ করে?
এ কাইয়ূম খান : শোনেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে একদম লিখিত আছে। ওই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশ সংবিধানে যুক্তও আছে। তিনটা মূল নীতি। সেটা হলো সোশ্যাল জাস্টিস বা সামাজিক ন্যায়বিচার, হিউম্যানিটি বা মানবতা এবং হিউম্যান ডিগনিটি বা সব মানুষের মর্যাদা। আমরা কি রাষ্ট্রীয়ভাবে, সামাজিকভাবে বা সার্বিকভাবে এসব চেতনা ধারণ করি? আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন, আমাদের দেশে এখন সামাজিক ন্যায়বিচার কিংবা সব মানুষের মর্যাদা আছে? তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হলো কই?
দেশ রূপান্তর : দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা নিয়েও নানা বিতর্ক হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসব কীভাবে দেখেন আপনি?
এ কাইয়ূম খান : আমি এসব নিয়ে কথাই বলতে চাই না। কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়। আমি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেই না। নেই না কারণ যে দেশ এখনো শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি দায়িত্ব পালন করে না, সেই দেশে থেকে আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা নিতে পারি না। সেটা প্রতীকী সম্মানের জন্য হলেও নেই না। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত শহীদ পরিবারগুলোকে সাহায্য করার চেষ্টা করি কারণ সেটা কেউ করছে না। সাহায্য তো করেই না উল্টো এই দেশে শহীদ পরিবারের সম্পত্তি লুটপাট হয়।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা এ কাইয়ূম খান ১৯৫১ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এএমএম খান ছিলেন পেশাদার কেমিস্ট; ষাটের দশকে ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তা হিসেবে দেশের প্রথম ওষুধ কোম্পানি ‘ফার্মাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। তার মায়ের নাম রওশন আরা খান। ১৯৬৮ সালে ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭০ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন এবং প্রথম বর্ষে পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি বিদেশে উচ্চতর অধ্যয়ন করেন এবং ফিন্যান্সে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের Bittersweet victory a freedom fighters tale (UPL), যা পরে বাংলায় ‘তিক্ত মধুর বিজয় : একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প’ নামে ‘বেঙ্গল বই’ থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮১ সালে এই মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও পূর্বাপর নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : আপনার স্কুলজীবন কেটেছে ষাটের দশকে। স্কুলে পড়ার সময় কি রাজনীতি কিংবা দেশ নিয়ে ভাবতেন? মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণা কীভাবে তৈরি হলো?
এ কাইয়ূম খান : প্রথমত আমাদের শিক্ষকদের কথা বলব। আমাদের স্কুল-কলেজে দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া সব শিক্ষকই বাঙালি ছিলেন, তারা খুবই মেধাবী শিক্ষক ছিলেন। তাদের অনেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। কেউ কেউ ছাত্র অবস্থাতেই রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কাজ করেছেন। আমরা বোর্ডিং স্কুলে থাকায় ক্লাসের বাইরেও ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের অনেকটা সময় পেতাম। তারা বঙ্গভঙ্গ, পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস এবং বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের কথা বলতেন। একটা কথা খুব জোর দিয়েই তারা বলতেন যে বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানিরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় বলা প্রয়োজন। ষাট দশকের শেষদিকের সাংস্কৃতিক জাগরণও আমাদের প্রভাবিত করেছিল। স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই আমরা রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনে পাকিস্তানের বাধাপ্রদানের কথা জানতে পারি। ১৯৬৭ সালে তো ছায়ানট রমনার বটমূলে প্রভাতি অনুষ্ঠানে বর্ষবরণ শুরু করল। ছায়ানটের পৃষ্ঠপোষকদের অনেকে আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। সে সুবাদে পারিবারিকভাবেও এসবের প্রভাব ছিল। এছাড়া ঢাকায় তখন আরও অনেক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিল, সেসবে আমরা যেতাম। আর সত্যি কথা কি, এসব থেকেই তো মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। এ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতাই আমাকে, আমার মতো অনেককেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
দেশ রূপান্তর : এ তো গেল স্কুলের কথা। ষাটের দশকের শেষভাগ তো ঢাকায় রাজনীতির এক উত্তাল জাগরণের সময়। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সময়। কলেজে পড়ার সময় কি রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন?
এ কাইয়ূম খান : আমি নটর ডেম কলেজে পড়তাম। সেটা মিশনারি ফাদাররা পরিচালনা করতেন। সেখানে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা ছিল। ফলে ছাত্ররা কখনই রাজনীতিতে যুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের আর আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। তখন ছাত্ররা কলেজ থেকেই মিছিল নিয়ে ঢাকার বড় বড় মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করল। তখন তোফায়েল আহমেদ ছিলেন ডাকসুর ভিপি। আমরা তখন মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিতাম। ঊনসত্তরের এই ছাত্র অভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করার আন্দোলনে রূপ নিল। আর এর পরিসমাপ্তিও ঘটেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে।
দেশ রূপান্তর : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার শুরুর কথা শুনতে চাই। কবে কীভাবে যুদ্ধে গেলেন?
এ কাইয়ূম খান : আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। পঁচিশে মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরুর মধ্য দিয়ে একটা ভয়াবহ ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। ২৭ মার্চ যেদিন প্রথম কারফিউ ভাঙল সেদিন আমি শেখ কামালের সন্ধানে ধানম-িতে গিয়েছিলাম। শেখ কামাল আমার বন্ধু ছিল। পাকিস্তানি আর্মি তখন আমাকে আটকায়। সম্ভবত আমি ভালো উর্দু বলতে পারতাম বলে সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার তখন একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যায়। কিছুদিনে সেরে উঠলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা শহরের অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পারলাম আমাদের সামনে মাত্র দুটি পথই খোলা হয় বাড়িতে বা অন্য কোথাও পাকিস্তানি হানাদারদের গুলি খেয়ে মরতে হবে; নয়তো যুদ্ধে গিয়ে লড়াই করে মরতে হবে। অন্য অনেকের মতো আমিও যুদ্ধে গিয়ে মরার জন্যই নিজেকে প্রস্তুত করলাম।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা মতিনগর গেলাম। ঢাকা থেকে কুমিল্লার পথে গেলাম, চান্দিনা বাজার থেকে পূর্বদিকে ভারতের আগরতলার মতিনগরে একটা প্রশিক্ষণ শিবির ছিল, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাওয়া ভলান্টিয়ারদের রিক্রুট করার জন্য। আমি প্রথম সেখানে যুক্ত হলাম। মতিনগরে প্রাথমিক কিছু প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরই আমাকে আবার ঢাকায় আসতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বাঙালি অফিসারদের স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুজিবনগর সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছিল। আমাদের ছোট একটা দল ঢাকায় পাঠানো হলো মেজর শাফায়েত জামিল, মেজর নূরুল ইসলাম আর মেজর খালেদ মোশাররফের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যেতে। খালেদ মোশাররফের পরিবারে সঙ্গে আমরা সংযোগ স্থাপন করতে পারিনি। বাকি দুই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ হলো। কিন্তু নূরুল ইসলামের পরিবার মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত থাকায় তাদের কাউকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা মেজর শাফায়েত জামিলের স্ত্রী এবং দুই শিশু সন্তানকে নিরাপদে আগরতলায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলাম।
দেশ রূপান্তর : এরপর কী হলো? মুক্তিবাহিনীতে আপনি কোথায় কেমন সামরিক প্রশিক্ষণ পেলেন? আপনি তো মুক্তিবাহিনীর ‘ফার্স্ট ওয়ার কোর্স’-এর সদস্য ছিলেন। একাত্তরে যাদের ‘মুক্তি’ বলে ডাকা হতো?
এ কাইয়ূম খান : মতিনগর থেকে আমি চলে যাই মেজর শাফায়েত জামিলের সঙ্গে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। মেজর শাফায়েত জামিলকে অধিনায়ক নিয়োগ দিয়ে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। এই পুনর্গঠনের কাজ হচ্ছিল পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাটের রাইগঞ্জে। সেখানে একটা বিশাল ‘যুব শিবির’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চাওয়া তরুণ-যুবকদের শারীরিক-মানসিকভাবে প্রস্তুত করে প্রশিক্ষণে পাঠানোর জন্য। সে সময় মুজিবনগর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় মুক্তিবাহিনীকে আরও গোছানোর জন্য প্রশিক্ষিত নেতৃত্ব বা প্রশিক্ষিত সেনা অফিসার সৃষ্টি করতে হবে যাতে একসময় গেরিলা যুদ্ধের ধরন থেকে নিয়মিত বাহিনীর যুদ্ধে উত্তরণ ঘটানো যায়। তখন বালুরঘাট যুবশিবির থেকে মাত্র দুজন নির্বাচিত হয়েছিল। একজন ছিলেন কায়সার হক (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক), আরেকজন আমি। সারা দেশ থেকে তখন এরকম ৬০ জন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হলো প্রশিক্ষণের জন্য। ফার্স্ট ওয়ার কোর্সের এই ৬০ জনকে তখন পাঠানো হলো জলপাইগুড়ির ‘মূর্তি’ নামের একটা জায়গায়। হিমালয়ের পাদদেশে চা বাগানঘেরা পাহাড়ি এলাকা মূর্তি; এটা জলঢাকা রিজার্ভ ফরেস্টসংলগ্ন। সেখানে আমাদের ১৫ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ হলো। এরপর আমাদের এই ওয়ার কোর্সের ৬০ জনকে বাংলাদেশের ১১টা সেক্টর এবং ৩টা ব্রিগেড কে-ফোর্স, এস-ফোর্স ও জেড-ফোর্সে নিয়োগ দেওয়া হলো।
দেশ রূপান্তর : আপনার নিয়োগ কোথায় হলো, কোন সেক্টরে?
এ কাইয়ূম খান : আমি কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে ৭ নম্বর সেক্টরে জয়েন করলাম। উত্তরে ঠাকুরগাঁও, দক্ষিণে পাবনা, পশ্চিমে পদ্মা নদী, পূর্বে যমুনা নদী নিয়ে রাজশাহী-বগুড়াসহ এই পুরো এলাকা ছিল সেক্টর-৭। সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হলো ৩ নম্বর সাব-সেক্টরে। সেখানকার অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, যিনি ১৪ ডিসেম্বরের সম্মুখ সমরে শহীদ হন এবং পরবর্তীকালে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধি পান। তিনি আমার কমান্ডার ছিলেন। সেখানে এসে দেখলাম মুক্তিবাহিনীতে অস্ত্র, গোলাবারুদ, রসদের অভাবসহ প্রশিক্ষণের সমস্যাসহ আরও অনেক সমস্যা। ভীষণ প্রতিকূল অবস্থাতেই আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জয়েন করে ডিসেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্বে আমরা অনেকগুলো অপারেশনে অংশগ্রহণ করি।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধে আপনার মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে এমন একটা সম্মুখ সমর বা স্মরণীয় অপারেশনের কথা আমাদের বলুন।
এ কাইয়ূম খান : আমি যুদ্ধে আমাদের শেষ অপারেশনের কথাটাই আপনাকে বলি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এতে ভারতীয় বিএসএফের আর্টিলারি ছাড়া সম্পূর্ণ যুদ্ধটাই মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করেছে। এখানে আমাদের মোট পাঁচ কোম্পানি মুক্তিবাহিনী তিনটা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে আক্রমণ চালায়। অফিসারদের মধ্যে একটা গ্রুপে ছিলাম ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর আর আমি, আরেকটা গ্রুপে ছিলেন লেফটেন্যান্ট বজলুর রশীদ ও লেফটেন্যান্ট রফিক, আরেকটা গ্রুপে একা ছিলেন লেফটেন্যান্ট আওয়াল চৌধুরী। আমরা কানসাট, শিবগঞ্জ দিয়ে যুদ্ধ করতে করতে মহানন্দা নদীর উত্তরপাড় আসলাম, দক্ষিণপাড়েই চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর। শহর এলাকায় অপারেশন চালানোর রণকৌশল সাধারণ গেরিলা অপারেশনের চেয়ে অনেক ভিন্ন। কিন্তু আমাদের কাছে এ ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিশালী যুদ্ধাস্ত্রের প্রায় কিছুই আমাদের ছিল না। আমরা রাইফেল, সাবমেশিনগান, লাইট-মেশিনগান, মর্টার আর গ্রেনেড নিয়েই এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এর মধ্যে গ্রেনেড ছিল সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
১৪ ডিসেম্বর সকালে আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ আক্রমণ শুরু করি। প্রথম দুই-তিন ঘণ্টা আমরা খুব ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমি আর আমার কমান্ডার জাহাঙ্গীর দেখলাম শহরের কিছু কিছু দালানের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী মেশিনগানসহ অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে পজিশন নিয়েছে। ওরা প্রচুর গুলি ছুড়ছিল। আমাদের আর এগোনো সম্ভব হচ্ছে না দেখে জাহাঙ্গীর এগিয়ে গিয়ে শত্রুদের তাক করা এলএমজির ওপর একটা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে সেটা বিকল করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। নিক্ষেপও করেছিলেন। এ সময় পাশের কোনো একটা বিল্ডিংয়ের পজিশন থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটা গুলি এসে সরাসরি তার বাম চোখ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেখানেই শহীদ হন। কিন্তু আমরা পিছু হটিনি। এই যুদ্ধ ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত চালিয়ে গেছি। ওই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
দেশ রূপান্তর : যুদ্ধ শেষে আপনি বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করলেন। স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীতে আপনার কী অভিজ্ঞতা হলো?
এ কাইয়ূম খান : স্বাধীনতার পর ৭ নম্বর সেক্টর হয়ে গেল ১৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। প্রথমে সেখানকার অ্যাডজুট্যান্ট ছিলাম। এরপর তো সেনাবাহিনীর চাকরি যা হয়। বিভিন্ন জায়গায় বদলি হলাম। থার্ড ইস্ট বেঙ্গলে ছিলাম। আমি উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশেও যাই। একসময় আমি জেনারেল জিয়াউর রহমানের এডিসি ছিলাম। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান হত্যাকা-ের মামলায় আমাকে অভিযুক্ত করা হলো। আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ না পেয়ে আমাকে খালাস করা হলো। আমি সেনাবাহিনী ছেড়ে বিদেশে চলে গেলাম এবং দীর্ঘদিন বিদেশে থাকলাম।
দেশ রূপান্তর : আপনি চাকরি ছাড়লেন নাকি আপনাকে অবসর দেওয়া হলো?
এ কাইয়ূম খান : বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হলো।
দেশ রূপান্তর : আমরা বর্তমানে চলে আসি। আমরা এখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আছি। আপনারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। আজকের বাংলাদেশকে কীভাবে দেখেন?
এ কাইয়ূম খান : একটা বিষয় হলো, যখন আমরা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের আর্থসামাজিক অবস্থান দেখি আর তার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করি, তখন দেখি বাংলাদেশ অবশ্যই পাকিস্তানের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ভারতের থেকেও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান ভালো। এগুলো সবই তো স্বাধীনতার অর্জন। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই এসব সম্ভব হয়েছে। উন্নতি হয়েছে, উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেটা সমাজের সবক্ষেত্রে নয়, সবার জন্যও নয়।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার যে বাংলাদেশ সে বাংলাদেশ আমরা কতটা নির্মাণ করতে পেরেছি বলে মনে করেন? মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা সেটা আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেটা কতটা ধারণ করে?
এ কাইয়ূম খান : শোনেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে একদম লিখিত আছে। ওই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশ সংবিধানে যুক্তও আছে। তিনটা মূল নীতি। সেটা হলো সোশ্যাল জাস্টিস বা সামাজিক ন্যায়বিচার, হিউম্যানিটি বা মানবতা এবং হিউম্যান ডিগনিটি বা সব মানুষের মর্যাদা। আমরা কি রাষ্ট্রীয়ভাবে, সামাজিকভাবে বা সার্বিকভাবে এসব চেতনা ধারণ করি? আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করুন, আমাদের দেশে এখন সামাজিক ন্যায়বিচার কিংবা সব মানুষের মর্যাদা আছে? তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হলো কই?
দেশ রূপান্তর : দেশে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা নিয়েও নানা বিতর্ক হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এসব কীভাবে দেখেন আপনি?
এ কাইয়ূম খান : আমি এসব নিয়ে কথাই বলতে চাই না। কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়। আমি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেই না। নেই না কারণ যে দেশ এখনো শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি দায়িত্ব পালন করে না, সেই দেশে থেকে আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা নিতে পারি না। সেটা প্রতীকী সম্মানের জন্য হলেও নেই না। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত শহীদ পরিবারগুলোকে সাহায্য করার চেষ্টা করি কারণ সেটা কেউ করছে না। সাহায্য তো করেই না উল্টো এই দেশে শহীদ পরিবারের সম্পত্তি লুটপাট হয়।