বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাস বোঝা যাবে না
আফসান চৌধুরী
আফসান চৌধুরী একাধারে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক। তিনি ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় তার। পেশাদার সাংবাদিকতায় ইংরেজি সাময়িকী ঢাকা কুরিয়ার, ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ টু ডে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কাজ করেছেন জাতিসংঘে। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। শিক্ষকতা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। বর্তমানে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (বিআইজিডি) গবেষণা ও গবেষণা তত্ত্ব পড়াচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আফসান চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ (১-৪ খণ্ড) প্রকাশ : ২০০৭, মওলা ব্রাদার্স। মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে তার সম্পাদনায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্রামের একাত্তর’, ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’, ‘১৯৭১ : অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ’, ‘১৯৭১ : গণনির্যাতন-গণহত্যা’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ এবং প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘আফসান চৌধুরীর গল্প’। ইংরেজিতে প্রকাশিত তার একমাত্র কবিতার বইয়ের নাম ‘কনভার্সেশন্স উইথ সোলেমান’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা ও সাহিত্যের জন্য আফসান চৌধুরী ২০১৮ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। আফসান চৌধুরী মনে করেন বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তার মৌলিক কাজ ‘শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড বাংলাদেশ : দ্য কোয়েস্ট ফর অ্যা স্টেট (১৯৩৭-১৯৭১)’। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ও ইতিহাস চর্চা নিয়ে আফসান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : আপনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন কেন? অনুপ্রেরণা পেলেন কার কাছে, কীভাবে?
আফসান চৌধুরী : আমি মুক্তিযোদ্ধা এটা কোনো ব্যাপারই না। সারা দেশের অগুনতি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমার কাজ শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। হাসান হাফিজুর রহমান তখন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প’-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার তখন চাকরি দরকার ছিল। আর আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ভালো ছাত্র ছিলাম প্রথম হয়েছিলাম। আমার বন্ধু মোরশেদ ফখরুল হাসানের কাছ থেকে খবর পেলাম। সাংবাদিক মাসুদুল্লাহ ভাইয়ের অনুরোধে সেখানে আমার চাকরি হয়ে গেল। এটা ছিল আমার কপালের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। তখন আমি হাসান ভাইয়ের সঙ্গে প্রকল্পটা তৈরি করছি। কিন্তু আমি তখন হাসান ভাইকে বলেছিলাম আপনি ইতিহাস লেখেন না। একটা দেশের সরকার কখনো ইতিহাস লিখতে পারে না। আমি বললাম আমরা দলিলপত্র সম্পাদনা করে ১৬ খ- বের করি। হাসান ভাই রাজি হলেন। কিন্তু বললেন, তোমাকে তাহলে প্রত্যেক খ-ের শুরুতে কিছুটা করে লিখে দিতে হবে। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ। হাসান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কাজটা করি। আমি পরিচিত আরও তিনজনকে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। একজন ছিলেন, শাহ আহমেদ রেজা, ইতিহাস বিভাগের, মওলানা ভাসানীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একজন ওয়াহিদুল হক খুব গোছানো মানুষ ছিলেন। আরেকজন ছিলেন ইমামুর রশীদ, রাজনীতি করতেন, জামালপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। এই প্রকল্পের কাজ পরে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ নামে ১৫ খন্ডে প্রকাশিত হয়।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এরপর আপনার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে চার খ-ের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’সহ একে একে আরও বেশ কয়েকটি বই। এ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণা কবে কীভাবে শুরু করলেন?
আফসান চৌধুরী : ১৯৮৩ সালে হাসান ভাই চলে গেলেন (মৃত্যুবরণ করলেন) আর আমারও মন উঠে গেল। আমি খুব ওল্ড ফ্যাশন্ড সম্পর্কভিত্তিক মানুষ। ১৯৮৩ সালে আমিও চাকরি ছেড়ে দিলাম। তখন আসলে কাজও শেষ। এ সময়েই আমি ফুলটাইম সাংবাদিকতা শুরু করলাম। চুরাশিতে আমি ঢাকা কুরিয়ারে কাজ শুরু করলাম। এরপর জাতিসংঘে কাজ শুরু করলাম। তবে এটা বলা যায় যে, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আমি ইতিহাস গবেষণার কোনো মৌলিক কাজ করিনি। জাতিসংঘে কাজ করার সময় আমি নানা জায়গায় ঘুরেছি। তখনই গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে আমার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। তিরানব্বইয়ে আমি জাতিসংঘের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার ফুলটাইম সাংবাদিকতা শুরু করলাম। এবার বিবিসিতে কাজ শুরু করলাম। বিবিসি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ দিল। আমি বিবিসির জন্য পাঁচটা সিরিজ করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নারী, মুক্তিযুদ্ধে শিশু, মুক্তিযুদ্ধে বয়স্ক জনগোষ্ঠী নিয়ে আমি তখন কাজ করেছি। এসব কাজ রেডিওতেই থেকে গেল এসব হয়তো বই হতে পারত। এরপর ২০০০ সালে সাবির মোস্তফা আমাকে বলল আপনি পুরো একটা সিরিজ করেন। ২০০১ সাল থেকে আমি ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’-এর কাজটা শুরু করলাম। এটা করতে গিয়ে আমি ভারতে গেলাম এবং পাকিস্তানের অনেকের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারলাম। এভাবে আমার কাজের সুযোগ আর পরিধি বেড়ে গেল। তখন আমার ইতিহাস দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও ধীরে ধীরে অনেক বড় হতে লাগল। আমি মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। এটা অবশ্য ভিডিও ফরম্যাটে। কিন্তু এসব কাজ করতে গিয়েই ইতিহাস গবেষণা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার নিজের পরিপক্বতা এসেছিল। এর পরের যাত্রাটা তাই অনেক কাজের মধ্য দিয়ে গেছে। সে সময় আমি ডেইলি স্টার ছেড়ে দিয়ে ব্র্যাকে শিক্ষকতা শুরু করলাম। নতুন ডিপার্টমেন্ট আর অনেক ইয়ং ছেলেমেয়েরা ছিল। এদের অনেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ছিল। আমি এদের সবাইকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণায় কাজ করতে বললাম। সবার আন্তরিক পরিশ্রম আর নিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে এভাবেই ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ প্রকাশিত হলো।
দেশ রূপান্তর : আপনার গবেষণায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনছেন আপনি। ‘গ্রামের একাত্তর’ ইতিহাস প্রকল্প সম্পর্কে বলুন।
আফসান চৌধুরী : আমরা একাত্তরের প্রজন্ম। আমরা একাত্তরের সৃষ্টি। আমাদের চিন্তাভাবনা সবকিছুর সঙ্গে একাত্তরের অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে। কিন্তু গবেষণার পরিসর খুব নিষ্ঠুর। হাসান ভাইয়ের নেতৃত্বে কাজটা করার সময় সেখানে ইতিহাসের সব প্রতিষ্ঠিত প-িতরা যুক্ত ছিলেন। তখন কিন্তু আমরা দলিলপত্র-ভিত্তিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছি। আমার মনে হচ্ছিল যে আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কেবল রাজনীতি আর আমলাদের ইতিহাস না লিখে ফেলি। যতই কাজ হতে থাকল আমি দেখলাম আমরা খুবই অল্পসংখ্যক মানুষের ইতিহাস লিখছি। এভাবেই কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস ‘ইতিহাসের প্রান্তিক’ তৈরি করে। আমার মনে হয়েছে যে, সেখানে প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস কই? নারীর ইতিহাস কই? সংখ্যালঘুর ইতিহাস কই? এভাবেই ধীরে ধীরে একাত্তরের গ্রামের ইতিহাসের ধারণাটা আসে।
ইতিহাস নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আজ যেখানে পৌঁছেছে সেখানে কিন্তু এ বিষয়টাই আমি বলব যে প্রান্তিকই হলো ইতিহাসের মূল। এ কথাটা আমি শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা বইয়ে আলোচনা করেছি। গ্রামের মানুষই বাংলাদেশের সৃষ্টি কর্তা। শেখ সাহেবের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তিনি প্রান্তিকের শক্তিটা বুঝতে পেরেছিলেন। অন্যরা প্রান্তিককে প্রান্তিকই ভেবেছে। রাজনীতিকে রাজনীতিই ভেবেছে। ইতিহাসের শিক্ষা এটাই যে এ দুই শক্তি যখন এক হয় তখনই বড় কিছু মহৎ কিছুর সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে যেটা উনিশশো একাত্তরে হয়েছে। একাত্তরে দেশের মানুষ কই আশ্রয় নিয়েছে গ্রামে। এখন সেই গ্রামের ইতিহাস বাদ দিয়ে কীভাবে একাত্তরের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হবে? এসব জায়গা থেকেই ‘গ্রামের একাত্তর’-এর সৃষ্টি।
দেশ রূপান্তর : প্রান্তিক মানুষ বা গ্রামের মানুষ কিংবা গরিব মানুষের মতোই দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে আপনার গবেষণায়। ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’ বইটির চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাই।
আফসান চৌধুরী : একাত্তরের মার্চে যখন গণহত্যা শুরু হলো তখন আমরা ঢাকায় দিলু রোডে থাকতাম। রাতে গোলাগুলির পর ঢাকার আকাশটাকে যেমন লাল দেখেছিলাম তেমন লাল আর কখনো কোনোদিন দেখিনি। রাতে গোলাগুলির শব্দে ছাদে উঠে আমরা দেখলাম পাশের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের যে বস্তি ছিল পালপাড়া, সেটা দাউ দাউ করে জ¦লছে। পাকিস্তানিরা বস্তিতে আগুন দিয়ে চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে বেরোতে দিচ্ছে না। নারী-শিশুর চিৎকার মানুষের অসহায় আর্তনাদ। আমার একাত্তর শুরু হয়েছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর এ ভয়াবহ নির্যাতনের দৃশ্য দিয়ে। একটা কথা বুঝতে হবে একাত্তরে কেউ শুধু ‘মুসলমান’ বলে তাকে প্রাণ দিতে হয়নি; কিন্তু হিন্দুদের কেবল ‘হিন্দু’ হওয়ার কারণেই মরতে হয়েছে। এখন অনেকে বলে যে হিন্দুরা তো যুদ্ধ করেনি। এটা খুবই অন্যায়। সারা দেশে কোটি-কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। কিন্তু সারা দেশে হিন্দুরা ভয়াবহ নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তেমনি শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বিশাল হিন্দু জনগোষ্ঠী কিন্তু ভারতের জন্য মুক্তিযুদ্ধে জড়ানোর একটা বড় যুক্তি তৈরি করেছিল। আবার ভারতের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে ভারতে হিন্দু-মুসলিম শরণার্থীদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে হিন্দু মানেই ছিল ভারত। পাকিস্তানিরা একাত্তরে হিন্দুদের ওপর নির্মম নির্যাতন করেছে। কিন্তু আমাদের একাত্তরের ইতিহাসেও হিন্দুরা প্রান্তিক হয়ে গেছে।
দেশ রূপান্তর : ‘নারীর একাত্তর’ নামে ইউপিএল থেকে আপনার সম্পাদনায় আরও একটি বই আসছে? এর আগে ‘তাহাদের কথা’ নামে একাত্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে কাজ করেছেন আপনি। ‘নারীর একাত্তর’ নিয়ে কিছু বলুন।
আফসান চৌধুরী : নারীর একাত্তর কিন্তু ‘নারীবাদী অবস্থান’ থেকে দেখা না। গ্রামের বা শহরের মানুষ, নারীর অবস্থান নারীর ভূমিকা কেমন ছিল সেসব তুলে আনার চেষ্টা। যুদ্ধ করতে অনেক কিছু লাগে। তার মধ্যে একটা হলো আশ্রয়। এখন শহরে কি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা বা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানো মানুষকে কে আশ্রয় দিয়েছে? একাত্তর জানতে হলে ‘আশ্রয়’ বুঝতে হবে। মানুষ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয় না পেলে মানুষ যুদ্ধ করবে কীভাবে? আর এই আশ্রয় দেওয়ার মূল ভূমিকায় ছিল নারী। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের অনেক মানবিক ও বীরোচিত আখ্যান আমাদের আড়ালেই রয়ে গেছে বা সেগুলোকে আমরা সামনে আনিনি। একটা গল্প বলি। একটা গ্রামে পাকিস্তানি আর্মি এসে গোলাগুলি করছে। নদী পার হওয়ার জন্য একদল মানুষ ছুটছে। সেখানে একটা মেয়ে ছিল চৌদ্দ বছরের। নৌকা না পেয়ে কচুরিপানা দিয়ে ভেলা বানিয়ে সবাই মিলে সেটাতে উঠেছে। একসময় তাতে পানি উঠছে দেখে ভয়ে আরেক নারী তার শিশুটির চিন্তায় চিৎকার করছে। সে এক হাতে শিশুকে ধরে আরেক হাতে ভেলা আঁকড়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে ওই কিশোরী ওই নারীকে বলল আপনি চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ঢাকা থেকেও যাওয়া ওই নারী বলল এত মানুষ, ডুবে যাব তো! এই কথা শুনে কিশোরীটি আস্তে করে ভেলা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তলিয়ে গেল! এখন এমন ত্যাগ কি আমরা করতে পারব? এই কিশোরী মেয়েটিকে কি আমরা ‘বীর’ বলছি? তাহলে কাকে বীর বলব?
দেশ রূপান্তর : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষে’ প্রকাশিত হলো আপনার বই ‘শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড বাংলাদেশ : দ্য কোয়েস্ট ফর অ্যা স্টেট (১৯৩৭-১৯৭১’। আপনি শেষ না করলেও এই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়েই আপনি পিএইচডি শুরু করেছিলেন। এই বই সম্পর্কে বলুন।
আফসান চৌধুরী : অনেক আগে এটা নিয়ে কাজ শুরু করলেও এ বই আমার একেবারে পরিণত বয়সের। কয়েক দশকে ইতিহাস চর্চা নিয়ে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে, আমি যে দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছি সেখান থেকে লেখা। আমার সবচেয়ে বড় যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা হলো গ্রামে যাওয়া। সেখানে বুঝেছি গ্রামের মানুষের যে ইতিহাস সেটা আমাদের শহরের মানুষের চেয়েও অনেক বেশি দীর্ঘদিনের। সেটা হলো উপনিবেশের ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত, গ্রামের মানুষগুলো কিন্তু সারাক্ষণই অন্য শ্রেণির সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করেছে। অন্য যে শ্রেণি এই গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিলতে পারে তারাই সাংঘাতিকভাবে সফল হয়। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। একাত্তরে তাই হয়েছে। গ্রাম হচ্ছে আধার। সেখান থেকেই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবকে বুঝতে গিয়ে আমার যে ধারণা ছিল সেটাও ক্রমাগত পাল্টেছে।
আমরা সবাই ‘৪৭ থেকে ৭১’ এভাবেই আলোচনা করতে অভ্যস্ত। আমি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছিলাম যে, শেখ মুজিবকে বুঝতে হলে ৪৭ থেকে শুরু করলে হবে না। তারও আগে যেতে হবে। আমার খুব বড় সুবিধা হয়েছে শেখ সাহেবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা পেয়ে। এটা খুবই মৌলিক একটা গ্রন্থ। আমাদের দেশে তো সামাজিক ইতিহাস নিয়ে কেউ লেখে না। বাংলাদেশের ইতিহাস বুঝতে গেলে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছাড়া সেটা বোঝা অসম্ভব। রাজনৈতিক ইতিহাস তো বটেই, সামাজিক ইতিহাসও। এটা নিয়ে বিশদ কথা বলা দরকার। এখন আমার কথা শুনে কেউ বলতে পারেন আমি আওয়ামী লীগ করি কি না? আমি আওয়ামী লীগ করি না, কিন্তু কিচ্ছু করার নাই। এই বই ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোচনা এগোবে না।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

আফসান চৌধুরী একাধারে মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক। তিনি ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয় তার। পেশাদার সাংবাদিকতায় ইংরেজি সাময়িকী ঢাকা কুরিয়ার, ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার, বাংলাদেশ টু ডে, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম এবং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। কাজ করেছেন জাতিসংঘে। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। শিক্ষকতা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। বর্তমানে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে (বিআইজিডি) গবেষণা ও গবেষণা তত্ত্ব পড়াচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আফসান চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ (১-৪ খণ্ড) প্রকাশ : ২০০৭, মওলা ব্রাদার্স। মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে তার সম্পাদনায় ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্রামের একাত্তর’, ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’, ‘১৯৭১ : অসহযোগ আন্দোলন ও প্রতিরোধ’, ‘১৯৭১ : গণনির্যাতন-গণহত্যা’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতকগণ’ এবং প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘আফসান চৌধুরীর গল্প’। ইংরেজিতে প্রকাশিত তার একমাত্র কবিতার বইয়ের নাম ‘কনভার্সেশন্স উইথ সোলেমান’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা ও সাহিত্যের জন্য আফসান চৌধুরী ২০১৮ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। আফসান চৌধুরী মনে করেন বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে তার মৌলিক কাজ ‘শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড বাংলাদেশ : দ্য কোয়েস্ট ফর অ্যা স্টেট (১৯৩৭-১৯৭১)’। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ও ইতিহাস চর্চা নিয়ে আফসান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : আপনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন কেন? অনুপ্রেরণা পেলেন কার কাছে, কীভাবে?
আফসান চৌধুরী : আমি মুক্তিযোদ্ধা এটা কোনো ব্যাপারই না। সারা দেশের অগুনতি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমার কাজ শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। হাসান হাফিজুর রহমান তখন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্প’-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমার তখন চাকরি দরকার ছিল। আর আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ভালো ছাত্র ছিলাম প্রথম হয়েছিলাম। আমার বন্ধু মোরশেদ ফখরুল হাসানের কাছ থেকে খবর পেলাম। সাংবাদিক মাসুদুল্লাহ ভাইয়ের অনুরোধে সেখানে আমার চাকরি হয়ে গেল। এটা ছিল আমার কপালের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। তখন আমি হাসান ভাইয়ের সঙ্গে প্রকল্পটা তৈরি করছি। কিন্তু আমি তখন হাসান ভাইকে বলেছিলাম আপনি ইতিহাস লেখেন না। একটা দেশের সরকার কখনো ইতিহাস লিখতে পারে না। আমি বললাম আমরা দলিলপত্র সম্পাদনা করে ১৬ খ- বের করি। হাসান ভাই রাজি হলেন। কিন্তু বললেন, তোমাকে তাহলে প্রত্যেক খ-ের শুরুতে কিছুটা করে লিখে দিতে হবে। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ। হাসান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা কাজটা করি। আমি পরিচিত আরও তিনজনকে নিয়ে আসতে পেরেছিলাম। একজন ছিলেন, শাহ আহমেদ রেজা, ইতিহাস বিভাগের, মওলানা ভাসানীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একজন ওয়াহিদুল হক খুব গোছানো মানুষ ছিলেন। আরেকজন ছিলেন ইমামুর রশীদ, রাজনীতি করতেন, জামালপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। এই প্রকল্পের কাজ পরে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ নামে ১৫ খন্ডে প্রকাশিত হয়।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এরপর আপনার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে চার খ-ের গবেষণা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’সহ একে একে আরও বেশ কয়েকটি বই। এ পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণা কবে কীভাবে শুরু করলেন?
আফসান চৌধুরী : ১৯৮৩ সালে হাসান ভাই চলে গেলেন (মৃত্যুবরণ করলেন) আর আমারও মন উঠে গেল। আমি খুব ওল্ড ফ্যাশন্ড সম্পর্কভিত্তিক মানুষ। ১৯৮৩ সালে আমিও চাকরি ছেড়ে দিলাম। তখন আসলে কাজও শেষ। এ সময়েই আমি ফুলটাইম সাংবাদিকতা শুরু করলাম। চুরাশিতে আমি ঢাকা কুরিয়ারে কাজ শুরু করলাম। এরপর জাতিসংঘে কাজ শুরু করলাম। তবে এটা বলা যায় যে, ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আমি ইতিহাস গবেষণার কোনো মৌলিক কাজ করিনি। জাতিসংঘে কাজ করার সময় আমি নানা জায়গায় ঘুরেছি। তখনই গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে আমার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। তিরানব্বইয়ে আমি জাতিসংঘের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবার ফুলটাইম সাংবাদিকতা শুরু করলাম। এবার বিবিসিতে কাজ শুরু করলাম। বিবিসি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ দিল। আমি বিবিসির জন্য পাঁচটা সিরিজ করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নারী, মুক্তিযুদ্ধে শিশু, মুক্তিযুদ্ধে বয়স্ক জনগোষ্ঠী নিয়ে আমি তখন কাজ করেছি। এসব কাজ রেডিওতেই থেকে গেল এসব হয়তো বই হতে পারত। এরপর ২০০০ সালে সাবির মোস্তফা আমাকে বলল আপনি পুরো একটা সিরিজ করেন। ২০০১ সাল থেকে আমি ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’-এর কাজটা শুরু করলাম। এটা করতে গিয়ে আমি ভারতে গেলাম এবং পাকিস্তানের অনেকের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারলাম। এভাবে আমার কাজের সুযোগ আর পরিধি বেড়ে গেল। তখন আমার ইতিহাস দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও ধীরে ধীরে অনেক বড় হতে লাগল। আমি মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম। এটা অবশ্য ভিডিও ফরম্যাটে। কিন্তু এসব কাজ করতে গিয়েই ইতিহাস গবেষণা আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার নিজের পরিপক্বতা এসেছিল। এর পরের যাত্রাটা তাই অনেক কাজের মধ্য দিয়ে গেছে। সে সময় আমি ডেইলি স্টার ছেড়ে দিয়ে ব্র্যাকে শিক্ষকতা শুরু করলাম। নতুন ডিপার্টমেন্ট আর অনেক ইয়ং ছেলেমেয়েরা ছিল। এদের অনেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ছিল। আমি এদের সবাইকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণায় কাজ করতে বললাম। সবার আন্তরিক পরিশ্রম আর নিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে এভাবেই ২০০৭ সালে ‘বাংলাদেশ ১৯৭১’ প্রকাশিত হলো।
দেশ রূপান্তর : আপনার গবেষণায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনছেন আপনি। ‘গ্রামের একাত্তর’ ইতিহাস প্রকল্প সম্পর্কে বলুন।
আফসান চৌধুরী : আমরা একাত্তরের প্রজন্ম। আমরা একাত্তরের সৃষ্টি। আমাদের চিন্তাভাবনা সবকিছুর সঙ্গে একাত্তরের অভিজ্ঞতা জড়িয়ে আছে। কিন্তু গবেষণার পরিসর খুব নিষ্ঠুর। হাসান ভাইয়ের নেতৃত্বে কাজটা করার সময় সেখানে ইতিহাসের সব প্রতিষ্ঠিত প-িতরা যুক্ত ছিলেন। তখন কিন্তু আমরা দলিলপত্র-ভিত্তিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছি। আমার মনে হচ্ছিল যে আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কেবল রাজনীতি আর আমলাদের ইতিহাস না লিখে ফেলি। যতই কাজ হতে থাকল আমি দেখলাম আমরা খুবই অল্পসংখ্যক মানুষের ইতিহাস লিখছি। এভাবেই কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস ‘ইতিহাসের প্রান্তিক’ তৈরি করে। আমার মনে হয়েছে যে, সেখানে প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস কই? নারীর ইতিহাস কই? সংখ্যালঘুর ইতিহাস কই? এভাবেই ধীরে ধীরে একাত্তরের গ্রামের ইতিহাসের ধারণাটা আসে।
ইতিহাস নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি আজ যেখানে পৌঁছেছে সেখানে কিন্তু এ বিষয়টাই আমি বলব যে প্রান্তিকই হলো ইতিহাসের মূল। এ কথাটা আমি শেখ মুজিবকে নিয়ে লেখা বইয়ে আলোচনা করেছি। গ্রামের মানুষই বাংলাদেশের সৃষ্টি কর্তা। শেখ সাহেবের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে তিনি প্রান্তিকের শক্তিটা বুঝতে পেরেছিলেন। অন্যরা প্রান্তিককে প্রান্তিকই ভেবেছে। রাজনীতিকে রাজনীতিই ভেবেছে। ইতিহাসের শিক্ষা এটাই যে এ দুই শক্তি যখন এক হয় তখনই বড় কিছু মহৎ কিছুর সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে যেটা উনিশশো একাত্তরে হয়েছে। একাত্তরে দেশের মানুষ কই আশ্রয় নিয়েছে গ্রামে। এখন সেই গ্রামের ইতিহাস বাদ দিয়ে কীভাবে একাত্তরের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা হবে? এসব জায়গা থেকেই ‘গ্রামের একাত্তর’-এর সৃষ্টি।
দেশ রূপান্তর : প্রান্তিক মানুষ বা গ্রামের মানুষ কিংবা গরিব মানুষের মতোই দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে আপনার গবেষণায়। ‘হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাত্তর’ বইটির চিন্তা সম্পর্কে জানতে চাই।
আফসান চৌধুরী : একাত্তরের মার্চে যখন গণহত্যা শুরু হলো তখন আমরা ঢাকায় দিলু রোডে থাকতাম। রাতে গোলাগুলির পর ঢাকার আকাশটাকে যেমন লাল দেখেছিলাম তেমন লাল আর কখনো কোনোদিন দেখিনি। রাতে গোলাগুলির শব্দে ছাদে উঠে আমরা দেখলাম পাশের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের যে বস্তি ছিল পালপাড়া, সেটা দাউ দাউ করে জ¦লছে। পাকিস্তানিরা বস্তিতে আগুন দিয়ে চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কাউকে বেরোতে দিচ্ছে না। নারী-শিশুর চিৎকার মানুষের অসহায় আর্তনাদ। আমার একাত্তর শুরু হয়েছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর এ ভয়াবহ নির্যাতনের দৃশ্য দিয়ে। একটা কথা বুঝতে হবে একাত্তরে কেউ শুধু ‘মুসলমান’ বলে তাকে প্রাণ দিতে হয়নি; কিন্তু হিন্দুদের কেবল ‘হিন্দু’ হওয়ার কারণেই মরতে হয়েছে। এখন অনেকে বলে যে হিন্দুরা তো যুদ্ধ করেনি। এটা খুবই অন্যায়। সারা দেশে কোটি-কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। কিন্তু সারা দেশে হিন্দুরা ভয়াবহ নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তেমনি শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বিশাল হিন্দু জনগোষ্ঠী কিন্তু ভারতের জন্য মুক্তিযুদ্ধে জড়ানোর একটা বড় যুক্তি তৈরি করেছিল। আবার ভারতের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে ভারতে হিন্দু-মুসলিম শরণার্থীদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে হিন্দু মানেই ছিল ভারত। পাকিস্তানিরা একাত্তরে হিন্দুদের ওপর নির্মম নির্যাতন করেছে। কিন্তু আমাদের একাত্তরের ইতিহাসেও হিন্দুরা প্রান্তিক হয়ে গেছে।
দেশ রূপান্তর : ‘নারীর একাত্তর’ নামে ইউপিএল থেকে আপনার সম্পাদনায় আরও একটি বই আসছে? এর আগে ‘তাহাদের কথা’ নামে একাত্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও ভূমিকা নিয়ে কাজ করেছেন আপনি। ‘নারীর একাত্তর’ নিয়ে কিছু বলুন।
আফসান চৌধুরী : নারীর একাত্তর কিন্তু ‘নারীবাদী অবস্থান’ থেকে দেখা না। গ্রামের বা শহরের মানুষ, নারীর অবস্থান নারীর ভূমিকা কেমন ছিল সেসব তুলে আনার চেষ্টা। যুদ্ধ করতে অনেক কিছু লাগে। তার মধ্যে একটা হলো আশ্রয়। এখন শহরে কি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা বা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালানো মানুষকে কে আশ্রয় দিয়েছে? একাত্তর জানতে হলে ‘আশ্রয়’ বুঝতে হবে। মানুষ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয় না পেলে মানুষ যুদ্ধ করবে কীভাবে? আর এই আশ্রয় দেওয়ার মূল ভূমিকায় ছিল নারী। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণের অনেক মানবিক ও বীরোচিত আখ্যান আমাদের আড়ালেই রয়ে গেছে বা সেগুলোকে আমরা সামনে আনিনি। একটা গল্প বলি। একটা গ্রামে পাকিস্তানি আর্মি এসে গোলাগুলি করছে। নদী পার হওয়ার জন্য একদল মানুষ ছুটছে। সেখানে একটা মেয়ে ছিল চৌদ্দ বছরের। নৌকা না পেয়ে কচুরিপানা দিয়ে ভেলা বানিয়ে সবাই মিলে সেটাতে উঠেছে। একসময় তাতে পানি উঠছে দেখে ভয়ে আরেক নারী তার শিশুটির চিন্তায় চিৎকার করছে। সে এক হাতে শিশুকে ধরে আরেক হাতে ভেলা আঁকড়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে ওই কিশোরী ওই নারীকে বলল আপনি চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ঢাকা থেকেও যাওয়া ওই নারী বলল এত মানুষ, ডুবে যাব তো! এই কথা শুনে কিশোরীটি আস্তে করে ভেলা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তলিয়ে গেল! এখন এমন ত্যাগ কি আমরা করতে পারব? এই কিশোরী মেয়েটিকে কি আমরা ‘বীর’ বলছি? তাহলে কাকে বীর বলব?
দেশ রূপান্তর : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ‘মুজিববর্ষে’ প্রকাশিত হলো আপনার বই ‘শেখ মুজিবুর রহমান অ্যান্ড বাংলাদেশ : দ্য কোয়েস্ট ফর অ্যা স্টেট (১৯৩৭-১৯৭১’। আপনি শেষ না করলেও এই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়েই আপনি পিএইচডি শুরু করেছিলেন। এই বই সম্পর্কে বলুন।
আফসান চৌধুরী : অনেক আগে এটা নিয়ে কাজ শুরু করলেও এ বই আমার একেবারে পরিণত বয়সের। কয়েক দশকে ইতিহাস চর্চা নিয়ে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে, আমি যে দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছি সেখান থেকে লেখা। আমার সবচেয়ে বড় যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা হলো গ্রামে যাওয়া। সেখানে বুঝেছি গ্রামের মানুষের যে ইতিহাস সেটা আমাদের শহরের মানুষের চেয়েও অনেক বেশি দীর্ঘদিনের। সেটা হলো উপনিবেশের ধারাবাহিকতার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত, গ্রামের মানুষগুলো কিন্তু সারাক্ষণই অন্য শ্রেণির সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করেছে। অন্য যে শ্রেণি এই গ্রামের মানুষের সঙ্গে মিলতে পারে তারাই সাংঘাতিকভাবে সফল হয়। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। একাত্তরে তাই হয়েছে। গ্রাম হচ্ছে আধার। সেখান থেকেই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবকে বুঝতে গিয়ে আমার যে ধারণা ছিল সেটাও ক্রমাগত পাল্টেছে।
আমরা সবাই ‘৪৭ থেকে ৭১’ এভাবেই আলোচনা করতে অভ্যস্ত। আমি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছিলাম যে, শেখ মুজিবকে বুঝতে হলে ৪৭ থেকে শুরু করলে হবে না। তারও আগে যেতে হবে। আমার খুব বড় সুবিধা হয়েছে শেখ সাহেবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা পেয়ে। এটা খুবই মৌলিক একটা গ্রন্থ। আমাদের দেশে তো সামাজিক ইতিহাস নিয়ে কেউ লেখে না। বাংলাদেশের ইতিহাস বুঝতে গেলে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ছাড়া সেটা বোঝা অসম্ভব। রাজনৈতিক ইতিহাস তো বটেই, সামাজিক ইতিহাসও। এটা নিয়ে বিশদ কথা বলা দরকার। এখন আমার কথা শুনে কেউ বলতে পারেন আমি আওয়ামী লীগ করি কি না? আমি আওয়ামী লীগ করি না, কিন্তু কিচ্ছু করার নাই। এই বই ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের আলোচনা এগোবে না।