মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার সমাজ এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি
শহীদুল্লাহ খান বাদল
বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদলের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ জুন, পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকার গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আক্রমণসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক সফল গেরিলা অপারেশনে তিনি নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং জাতীয় ইংরেজি দৈনিক নিউএজ এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডের প্রকাশক। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে তিনি দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : আপনার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের প্রেক্ষাপটটা কি একটু বর্ণনা করবেন?
শহীদুল্লাহ খান বাদল : আমাদের প্রজন্মটা আসলে খুবই ভাগ্যবান। কেননা আমরা এমন একটি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পেরেছি, যখন গোটা বিশ্ব বিভিন্ন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সংগ্রামে উত্তাল। আর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানেও আমরা ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত থাকতে পেরেছি, ১৯৭০-এর নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছি, তৎপরবর্তী স্বাধিকার আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকেছি এবং সর্বশেষ ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বামপন্থি ছাত্ররাজনীতি অর্থাৎ ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ছিলাম এবং হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলের ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমরা তখন বুঝে বা না বুঝে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার স্লোগান তুলেছিলাম। অন্যদের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকলেও আমরা সবাই একই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাসী ছিলাম সেটা হলো পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা। এমনকি তখন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা এনএসএফের একটি গ্রুপও আমাদের সঙ্গে ১১ দফার প্রশ্নে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দিয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের সবার মধ্যে একটা চিন্তা কাজ করছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এটা অবশ্য পরে জোরালো হয়েছিল। বিশেষ করে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বঙ্গবন্ধুকে সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা হলো এবং পরবর্তীকালে পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে মেনে না নেওয়া হলো, তখন আমরা বুঝলাম স্বাধীনতার বিকল্প নেই। তখন জনগণের সঙ্গে ছাত্ররা আন্দোলন বেগবান করে তুলল। সেই সংগ্রামের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং নয় মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলো।
দেশ রূপান্তর : সে ক্ষেত্রে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৫ মার্চের গণহত্যা কী ধরনের প্রভাব রেখেছিল?
শহীদুল্লাহ খান বাদল : আসলে ৭ মার্চের আগেই ৩ মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চলছিল। প্রশাসনিকভাবে তা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো এখানে কাজ করছিল না। আর ৭ মার্চ তখনকার রেসকোর্স ময়দান অর্থাৎ বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময়ে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অভূতপূর্ব জনসমাবেশ হয়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, শুধু ছাত্রলীগ নয়, আমরা ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরাও লাল ফিতা মাথায় বেঁধে ওই সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। আসলে ওইরকম বিশাল একটা সামরিক বাহিনীর সামনে দাঁড়ানোর মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। তাই তারা পরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাতে পেরেছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল। এরপর ২২ অথবা ২৩ মার্চ মওলানা ভাসানীও অনুরূপভাবে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্দীপক বক্তব্য দেন। সেই সমাবেশে স্লোগান উঠেছিল ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র। এরপর ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রির কথা এখনো আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। আমাদের বাসা তখন ছিল লালমাটিয়ায়। আমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বোমা তৈরি করেছিলাম। সেই বোমা তৈরির খবর জেনে পাশের মোহাম্মদপুরের অবাঙালি বিহারিরা আমাদের বাসাসহ আশপাশের কয়েকটি বাসভবনে হামলা চালায়। এর ফলে আমাদের এক বন্ধু মারাত্মক আহত হয়।
আমি তখন বাসা ছেড়ে ধানমন্ডি ৫ নম্বরে একজন বন্ধুর বাসায় থাকতাম। আমার ওই বন্ধু তখন বিদেশে থাকায় আমি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতাম। ২৫ মার্চ রাত্রে পাশের পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর অর্থাৎ এখনকার বিজিবি সদর দপ্তরে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনি। রাত্রের আকাশ গুলি আর সার্চলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিল। এখানে আমার একটি দুঃখজনক স্মৃতি আছে। খোকন নামে আমার এক বন্ধু একটি টু-টু বোর বন্দুক নিয়ে বাসা থেকে নেমে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করতে। তখন সেসহ অসংখ্য মানুষ এদের হাতে হতাহত হয়। আসলে আমাদের তখন প্রস্তুতি না থাকলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধের একটা তীব্র আকাক্সক্ষা কাজ করছিল। এরপর ২৭ মার্চের পর থেকেই আমাদের মতো ছাত্রজনতা দলে দলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।
দেশ রূপান্তর : আপনি মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে অংশগ্রহণ করলেন? সেই ঘটনাটি যদি একটু বলতেন।
শহীদুল্লাহ খান বাদল : আমি ২৫ মার্চ রাত্রে ধানমন্ডি ৫ নম্বরে বন্ধুর বাসায় রাত কাটাই। পরদিন সকালে কারফিউ তিন ঘণ্টার জন্য উঠলে আমার বন্ধু তৌহিদ, হাদী এবং তাদের সঙ্গে বদি সেই বাসায় আসল। তাদের সঙ্গে দেখলাম তৎকালীন জিন্নাহ হল অর্থাৎ এখনকার সূর্য সেন হলের এনএসএফ নেতা বদি। এই বদিই কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ওপর হামলা করেছিল। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল না, বরং রাজনৈতিক বিরোধিতা তীব্র ছিল। তাই তাকে দেখে আমি খুব বিস্মিত হলাম। বদি সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিল। আমার মনোভাব বুঝতে পেরে ও ইংরেজিতে বলে উঠল, ‘হেই কমি, ইউ ওয়ান্ট রেভিউলিশন, সো লেটস গো’। আমার মনে তখন অনিশ্চয়তাও কাজ করছিল, আবার ভীতিও চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সে তখন তার পকেট থেকে তখনকার সময়ের ছোট শেভিং ব্লেড দিয়ে কবজিতে টান দিল এবং তার ওখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। সে তখন বলল, ‘ফ্রম টুডে উই আর ব্লাড ব্রাদার্স, লেটস গো অ্যান্ড ফাইট’। আমি তখন তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম।
এরপর আমরা তৌহিদের বাসায় গেলাম। সেখানে হাজির হলো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক আতাউস সামাদের ভ্রাতুষ্পুত্র আসফাকুস সামাদ। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নভেম্বর মাসে লেফটেন্যান্ট আসফাকুস শাহাদাতবরণ করেন। আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ পরে যোগ দিল আমাদেরই বন্ধু মাসুদ ওমর। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বেরিয়ে যাব। তৌহিদও আমাদের সঙ্গে যেতে চাইলে আমরা তাকে নিষেধ করলাম। কেননা সে ছিল তখন সদ্য বিবাহিত। আমি বদির মোটরসাইকেলে গোটা ঢাকা শহর ঘুরলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবালসহ অন্যান্য জায়গায় গিয়ে দেখলাম শুধু লাশ আর লাশ। এর মধ্যে আমি আমার লালমাটিয়ার বাসায় গেলাম। আমাদের সেই বাসার পাশেই ছিল মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমের শ্বশুরবাড়ি। আমরা দেখলাম সেই বাসা পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ করে তছনছ করে দিয়েছে এবং সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। আর বাসার সামনে দারোয়ানদের লাশ পড়ে আছে। আমরা তখন ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেলা ৩টার দিকে রওনা দিয়ে বাড্ডা হয়ে বেরিয়ে গেলাম।
আমার বড় ভাই রাশেদ খান মেনন ছিলেন বাম রাজনীতিক। তাই আমাদের লালমাটিয়ার বাসার বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড মিটিং হতো। সেসব মিটিংয়ের সূত্রে আমার সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা সুনীল রায়ের পরিচয় ঘটেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন মুক্তাঞ্চলের কথা। আমি তখন ভাবলাম সিলেটের মুক্তাঞ্চলে যেতে হবে। আমাদের মধ্যে তখন একটা দৃঢ় বিশ্বাস কাজ করছিল যে কোথাও না কোথাও প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। কোনো কিছুই আনচ্যালেঞ্জড থাকবে না। নদীতে ট্রলারে পার হওয়ার সময় দেখলাম হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। আমি তখন সবাইকে বললাম, ‘আমি শুনেছি যে সিলেটে মুক্তাঞ্চল আছে। চলো সেখানে যাই।’ তখন বদি বলল, ‘আমাদের কাছে তো টাকা নেই। তাই কিশোরগঞ্জে আমার মামার বাসায় গেলে সেখান থেকে কিছু টাকা পাওয়া যাবে।’ আমরা কিশোরগঞ্জ গিয়ে দেখলাম সেখানে পুরো দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে সার্কিট হাউজে অবস্থান নিয়েছে। আমরা তাদের দেখে উৎসাহিত হলাম। আমরা মনে করলাম সেনাবাহিনীতে যেহেতু বিদ্রোহ হয়েছে, তাহলে আমরা প্রস্তুতি নেওয়ার ভালো একটা সাপোর্ট পাব। আমরা তাদের আশপাশে ঘুরতে লাগলাম। তখন বদি একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদকে চিনতে পারল। হয়তো সে তার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু ছিল। আমরা তার কাছে বললাম যে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই। সে প্রথমে আমাদের তেমন একটা পাত্তা না দিলেও আমাদের পীড়াপীড়িতে একসময় নরম হলো। সে তখন আমাদের ক্যাম্পের ভেতরে তৎকালীন মেজর এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কেএম শফিউল্লাহর কাছে নিয়ে গেল। তার পাশেই বসে ছিলেন বয়স্ক একজন সেনা কর্মকর্তা, যার নাম কর্নেল নুরুজ্জামান। আমাদের তিনি আগে থেকেই চিনতেন। ১৯৭০ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভোলায় বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ত্রাণ দেওয়ার সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমাদের দেখে বললেন, ‘শফি, দে আর গুড বয়েস, আই নো দেম, ইউ ক্যান ট্রাস্ট দেম।’ তখন শফি সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন যে আমাদের প্রশিক্ষণ আছে কি না। আমরা বললাম যে আমরা রাইফেল চালাতে পারলেও অতটা পরিপক্ব নই। তখন তিন আমাদের তিন-চার দিনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে চারটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর ২৫টি গ্রেনেড দিলেন। এর মধ্যে আমরা সেখানে ক্যাপ্টেন মাহবুবের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি ছিলেন খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ২ নম্বর সেক্টরে। আমি তখন তাকে বললাম যে খালেদ মোশাররফের আমার পরিচয় আছে। তার মাধ্যমে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সংযোগ ঘটল। এপ্রিলের ২ অথবা ৩ তারিখে আমরা খড়ের মধ্যে রাইফেল এবং বস্তায় গ্রেনেড ভরে ঢাকায় ফিরলাম।
আমরা প্রথমে গোপীবাগ হয়ে পুরনো ইত্তেফাক অফিসের পাশে আতাউস সামাদের বাসায় আশ্রয় নিলাম। কিন্তু জায়গাটা নিরাপদ মনে না হওয়ায় পরদিন ধানমন্ডিতে চলে গেলাম। আমরাই মনে হয় ঢাকায় আসা প্রথম গেরিলা দল। এরপর আমরা ঢাকায় কয়েকটি ছোটখাটো অপারেশন পরিচালনা করি। পরে মেলাঘরে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর অনেকগুলো অপারেশন চালাই। পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগকে বিঘিœত করা এবং ইলেকট্রিক্যাল ইনস্টলেশনগুলো উড়িয়ে দেওয়া ছিল আমাদের প্রধান কাজ। আমি এসব অপারেশনের নেতৃত্ব দিই, কেননা আমি ছিলাম স্টাফ অফিসার। এর মধ্যে ৯ জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আক্রমণ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন। আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রদের সঙ্গে কৃষকের ছেলে, এমনকি ওয়াগন ব্রেকাররাও যুক্ত হয়েছিল।
দেশ রূপান্তর : আপনারা যে আকাক্সক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে সেই আকাঙ্ক্ষার কতটুকু প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছেন?
শহীদুল্লাহ খান বাদল : ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল যে ঘোষণা ঘোষিত হয়েছিল, তাতে গণতন্ত্রের কথা ছিল, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, সামাজিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের এখানে অনেক বেশি দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে, বড় ধরনের সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে। এটার জন্য আমরা সবাই সমানভাবে দায়ী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের সবার স্বপ্ন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজের। সেখানে ডান-বাম সবাই মিলে একই সঙ্গে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এখন আমরা বিভাজনের রাজনীতি এবং বিভাজনের সমাজ দেখতে পাই। গণতন্ত্র কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো, দেশের নিয়ন্ত্রণ এখন রাজনীতিকদের হাতে নেই, তা ক্রমেই আমলাতন্ত্রের খপ্পরে পড়ছে। আমরা আমলানির্ভর দেশ হয়ে উঠছি। তবে আমাদের অর্জনও অনেক। আর এ অর্জনের কৃতিত্ব সবার। আমরা এখন আর সামন্ততন্ত্রে নেই। দেশে এনজিওরা বড় ভূমিকা রেখেছে, ওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট হয়েছে, জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি হয়েছে। আগামীতে সুন্দর একটা দেশ গড়ার বড় সুযোগ রয়েছে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদলের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ জুন, পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহসাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকার গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আক্রমণসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক সফল গেরিলা অপারেশনে তিনি নেতৃত্ব দেন। বর্তমানে তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং জাতীয় ইংরেজি দৈনিক নিউএজ এবং ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডের প্রকাশক। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে তিনি দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : আপনার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের প্রেক্ষাপটটা কি একটু বর্ণনা করবেন?
শহীদুল্লাহ খান বাদল : আমাদের প্রজন্মটা আসলে খুবই ভাগ্যবান। কেননা আমরা এমন একটি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পেরেছি, যখন গোটা বিশ্ব বিভিন্ন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সংগ্রামে উত্তাল। আর তখনকার পূর্ব পাকিস্তানেও আমরা ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত থাকতে পেরেছি, ১৯৭০-এর নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছি, তৎপরবর্তী স্বাধিকার আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকেছি এবং সর্বশেষ ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বামপন্থি ছাত্ররাজনীতি অর্থাৎ ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি ছিলাম এবং হাজী মুহাম্মদ মহসীন হলের ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমরা তখন বুঝে বা না বুঝে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার স্লোগান তুলেছিলাম। অন্যদের সঙ্গে মতপার্থক্য থাকলেও আমরা সবাই একই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাসী ছিলাম সেটা হলো পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা। এমনকি তখন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা এনএসএফের একটি গ্রুপও আমাদের সঙ্গে ১১ দফার প্রশ্নে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দিয়েছিল। অর্থাৎ আমাদের সবার মধ্যে একটা চিন্তা কাজ করছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে মুক্তি এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। এটা অবশ্য পরে জোরালো হয়েছিল। বিশেষ করে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বঙ্গবন্ধুকে সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা হলো এবং পরবর্তীকালে পার্লামেন্টে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে মেনে না নেওয়া হলো, তখন আমরা বুঝলাম স্বাধীনতার বিকল্প নেই। তখন জনগণের সঙ্গে ছাত্ররা আন্দোলন বেগবান করে তুলল। সেই সংগ্রামের পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং নয় মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলো।
দেশ রূপান্তর : সে ক্ষেত্রে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৫ মার্চের গণহত্যা কী ধরনের প্রভাব রেখেছিল?
শহীদুল্লাহ খান বাদল : আসলে ৭ মার্চের আগেই ৩ মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় চলছিল। প্রশাসনিকভাবে তা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো এখানে কাজ করছিল না। আর ৭ মার্চ তখনকার রেসকোর্স ময়দান অর্থাৎ বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময়ে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অভূতপূর্ব জনসমাবেশ হয়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, শুধু ছাত্রলীগ নয়, আমরা ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরাও লাল ফিতা মাথায় বেঁধে ওই সমাবেশে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করেছিল। আসলে ওইরকম বিশাল একটা সামরিক বাহিনীর সামনে দাঁড়ানোর মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। তাই তারা পরে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালাতে পেরেছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আমাদের রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল। এরপর ২২ অথবা ২৩ মার্চ মওলানা ভাসানীও অনুরূপভাবে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্দীপক বক্তব্য দেন। সেই সমাবেশে স্লোগান উঠেছিল ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র। এরপর ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রির কথা এখনো আমার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। আমাদের বাসা তখন ছিল লালমাটিয়ায়। আমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য বোমা তৈরি করেছিলাম। সেই বোমা তৈরির খবর জেনে পাশের মোহাম্মদপুরের অবাঙালি বিহারিরা আমাদের বাসাসহ আশপাশের কয়েকটি বাসভবনে হামলা চালায়। এর ফলে আমাদের এক বন্ধু মারাত্মক আহত হয়।
আমি তখন বাসা ছেড়ে ধানমন্ডি ৫ নম্বরে একজন বন্ধুর বাসায় থাকতাম। আমার ওই বন্ধু তখন বিদেশে থাকায় আমি তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতাম। ২৫ মার্চ রাত্রে পাশের পিলখানায় তৎকালীন ইপিআর অর্থাৎ এখনকার বিজিবি সদর দপ্তরে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দ শুনি। রাত্রের আকাশ গুলি আর সার্চলাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছিল। এখানে আমার একটি দুঃখজনক স্মৃতি আছে। খোকন নামে আমার এক বন্ধু একটি টু-টু বোর বন্দুক নিয়ে বাসা থেকে নেমে গিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধ করতে। তখন সেসহ অসংখ্য মানুষ এদের হাতে হতাহত হয়। আসলে আমাদের তখন প্রস্তুতি না থাকলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধের একটা তীব্র আকাক্সক্ষা কাজ করছিল। এরপর ২৭ মার্চের পর থেকেই আমাদের মতো ছাত্রজনতা দলে দলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।
দেশ রূপান্তর : আপনি মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে অংশগ্রহণ করলেন? সেই ঘটনাটি যদি একটু বলতেন।
শহীদুল্লাহ খান বাদল : আমি ২৫ মার্চ রাত্রে ধানমন্ডি ৫ নম্বরে বন্ধুর বাসায় রাত কাটাই। পরদিন সকালে কারফিউ তিন ঘণ্টার জন্য উঠলে আমার বন্ধু তৌহিদ, হাদী এবং তাদের সঙ্গে বদি সেই বাসায় আসল। তাদের সঙ্গে দেখলাম তৎকালীন জিন্নাহ হল অর্থাৎ এখনকার সূর্য সেন হলের এনএসএফ নেতা বদি। এই বদিই কয়েক দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ওপর হামলা করেছিল। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল না, বরং রাজনৈতিক বিরোধিতা তীব্র ছিল। তাই তাকে দেখে আমি খুব বিস্মিত হলাম। বদি সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিল। আমার মনোভাব বুঝতে পেরে ও ইংরেজিতে বলে উঠল, ‘হেই কমি, ইউ ওয়ান্ট রেভিউলিশন, সো লেটস গো’। আমার মনে তখন অনিশ্চয়তাও কাজ করছিল, আবার ভীতিও চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। সে তখন তার পকেট থেকে তখনকার সময়ের ছোট শেভিং ব্লেড দিয়ে কবজিতে টান দিল এবং তার ওখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। সে তখন বলল, ‘ফ্রম টুডে উই আর ব্লাড ব্রাদার্স, লেটস গো অ্যান্ড ফাইট’। আমি তখন তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলাম।
এরপর আমরা তৌহিদের বাসায় গেলাম। সেখানে হাজির হলো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক আতাউস সামাদের ভ্রাতুষ্পুত্র আসফাকুস সামাদ। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নভেম্বর মাসে লেফটেন্যান্ট আসফাকুস শাহাদাতবরণ করেন। আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ পরে যোগ দিল আমাদেরই বন্ধু মাসুদ ওমর। আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বেরিয়ে যাব। তৌহিদও আমাদের সঙ্গে যেতে চাইলে আমরা তাকে নিষেধ করলাম। কেননা সে ছিল তখন সদ্য বিবাহিত। আমি বদির মোটরসাইকেলে গোটা ঢাকা শহর ঘুরলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবালসহ অন্যান্য জায়গায় গিয়ে দেখলাম শুধু লাশ আর লাশ। এর মধ্যে আমি আমার লালমাটিয়ার বাসায় গেলাম। আমাদের সেই বাসার পাশেই ছিল মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমের শ্বশুরবাড়ি। আমরা দেখলাম সেই বাসা পাকিস্তানি হানাদাররা আক্রমণ করে তছনছ করে দিয়েছে এবং সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। আর বাসার সামনে দারোয়ানদের লাশ পড়ে আছে। আমরা তখন ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেলা ৩টার দিকে রওনা দিয়ে বাড্ডা হয়ে বেরিয়ে গেলাম।
আমার বড় ভাই রাশেদ খান মেনন ছিলেন বাম রাজনীতিক। তাই আমাদের লালমাটিয়ার বাসার বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টির অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড মিটিং হতো। সেসব মিটিংয়ের সূত্রে আমার সঙ্গে কমিউনিস্ট নেতা সুনীল রায়ের পরিচয় ঘটেছিল। তিনি প্রায়ই বলতেন মুক্তাঞ্চলের কথা। আমি তখন ভাবলাম সিলেটের মুক্তাঞ্চলে যেতে হবে। আমাদের মধ্যে তখন একটা দৃঢ় বিশ্বাস কাজ করছিল যে কোথাও না কোথাও প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। কোনো কিছুই আনচ্যালেঞ্জড থাকবে না। নদীতে ট্রলারে পার হওয়ার সময় দেখলাম হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ছে। আমি তখন সবাইকে বললাম, ‘আমি শুনেছি যে সিলেটে মুক্তাঞ্চল আছে। চলো সেখানে যাই।’ তখন বদি বলল, ‘আমাদের কাছে তো টাকা নেই। তাই কিশোরগঞ্জে আমার মামার বাসায় গেলে সেখান থেকে কিছু টাকা পাওয়া যাবে।’ আমরা কিশোরগঞ্জ গিয়ে দেখলাম সেখানে পুরো দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে সার্কিট হাউজে অবস্থান নিয়েছে। আমরা তাদের দেখে উৎসাহিত হলাম। আমরা মনে করলাম সেনাবাহিনীতে যেহেতু বিদ্রোহ হয়েছে, তাহলে আমরা প্রস্তুতি নেওয়ার ভালো একটা সাপোর্ট পাব। আমরা তাদের আশপাশে ঘুরতে লাগলাম। তখন বদি একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদকে চিনতে পারল। হয়তো সে তার ক্যাডেট কলেজের বন্ধু ছিল। আমরা তার কাছে বললাম যে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই। সে প্রথমে আমাদের তেমন একটা পাত্তা না দিলেও আমাদের পীড়াপীড়িতে একসময় নরম হলো। সে তখন আমাদের ক্যাম্পের ভেতরে তৎকালীন মেজর এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কেএম শফিউল্লাহর কাছে নিয়ে গেল। তার পাশেই বসে ছিলেন বয়স্ক একজন সেনা কর্মকর্তা, যার নাম কর্নেল নুরুজ্জামান। আমাদের তিনি আগে থেকেই চিনতেন। ১৯৭০ সালের ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভোলায় বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে ত্রাণ দেওয়ার সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমাদের দেখে বললেন, ‘শফি, দে আর গুড বয়েস, আই নো দেম, ইউ ক্যান ট্রাস্ট দেম।’ তখন শফি সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন যে আমাদের প্রশিক্ষণ আছে কি না। আমরা বললাম যে আমরা রাইফেল চালাতে পারলেও অতটা পরিপক্ব নই। তখন তিন আমাদের তিন-চার দিনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন এবং প্রশিক্ষণ শেষে চারটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর ২৫টি গ্রেনেড দিলেন। এর মধ্যে আমরা সেখানে ক্যাপ্টেন মাহবুবের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তিনি ছিলেন খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ২ নম্বর সেক্টরে। আমি তখন তাকে বললাম যে খালেদ মোশাররফের আমার পরিচয় আছে। তার মাধ্যমে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে সংযোগ ঘটল। এপ্রিলের ২ অথবা ৩ তারিখে আমরা খড়ের মধ্যে রাইফেল এবং বস্তায় গ্রেনেড ভরে ঢাকায় ফিরলাম।
আমরা প্রথমে গোপীবাগ হয়ে পুরনো ইত্তেফাক অফিসের পাশে আতাউস সামাদের বাসায় আশ্রয় নিলাম। কিন্তু জায়গাটা নিরাপদ মনে না হওয়ায় পরদিন ধানমন্ডিতে চলে গেলাম। আমরাই মনে হয় ঢাকায় আসা প্রথম গেরিলা দল। এরপর আমরা ঢাকায় কয়েকটি ছোটখাটো অপারেশন পরিচালনা করি। পরে মেলাঘরে গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর অনেকগুলো অপারেশন চালাই। পাকিস্তানি বাহিনীর যোগাযোগকে বিঘিœত করা এবং ইলেকট্রিক্যাল ইনস্টলেশনগুলো উড়িয়ে দেওয়া ছিল আমাদের প্রধান কাজ। আমি এসব অপারেশনের নেতৃত্ব দিই, কেননা আমি ছিলাম স্টাফ অফিসার। এর মধ্যে ৯ জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল আক্রমণ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অপারেশন। আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রদের সঙ্গে কৃষকের ছেলে, এমনকি ওয়াগন ব্রেকাররাও যুক্ত হয়েছিল।
দেশ রূপান্তর : আপনারা যে আকাক্সক্ষা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে সেই আকাঙ্ক্ষার কতটুকু প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছেন?
শহীদুল্লাহ খান বাদল : ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল যে ঘোষণা ঘোষিত হয়েছিল, তাতে গণতন্ত্রের কথা ছিল, সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, সামাজিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের এখানে অনেক বেশি দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে, বড় ধরনের সামাজিক অবক্ষয় ঘটেছে। এটার জন্য আমরা সবাই সমানভাবে দায়ী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুসহ আমাদের সবার স্বপ্ন ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ সমাজের। সেখানে ডান-বাম সবাই মিলে একই সঙ্গে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এখন আমরা বিভাজনের রাজনীতি এবং বিভাজনের সমাজ দেখতে পাই। গণতন্ত্র কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো, দেশের নিয়ন্ত্রণ এখন রাজনীতিকদের হাতে নেই, তা ক্রমেই আমলাতন্ত্রের খপ্পরে পড়ছে। আমরা আমলানির্ভর দেশ হয়ে উঠছি। তবে আমাদের অর্জনও অনেক। আর এ অর্জনের কৃতিত্ব সবার। আমরা এখন আর সামন্ততন্ত্রে নেই। দেশে এনজিওরা বড় ভূমিকা রেখেছে, ওম্যান এমপাওয়ারমেন্ট হয়েছে, জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি হয়েছে। আগামীতে সুন্দর একটা দেশ গড়ার বড় সুযোগ রয়েছে।