কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেনি
বদিউল আলম মজুমদার
ড. বদিউল আলম মজুমদার কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পোলাইয়া গ্রামে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে শেষ দিকের গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ইকবাল হলের (বর্তমানে জহুরুল হক হল) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এছাড়া তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’তেও কনসালটেন্ট ছিলেন। তিনি এখন ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট। এছাড়া তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের সম্পন্ন হওয়া দুটি ধাপের নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, স্থানীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের প্রতিনিধিত্বসহ স্থানীয় নির্বাচন ও সরকারের নানা বিষয় নিয়ে দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : গণতন্ত্রের ক্ল্যাসিকাল ডিকটাম (ধ্রুপদী অনুশাসন) হচ্ছে, ‘স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ’। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের তৃতীয় স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী এ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রক্রিয়া, অংশগ্রহণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, স্বচ্ছতা-সর্বোপরি গুণগত মান নিয়ে জনমনে হতাশা, উদাসীনতা এবং অনাস্থা লক্ষ করছি। এ পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
বদিউল আলম মজুমদার : স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ বলা হয়। স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়। এ সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্ত ‘সাহায্য কাঠামো’ তৈরি করে। গণতন্ত্রের জন্য পাটাতন তৈরি করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ‘তৃণমূলের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমাদের তৃণমূলের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে, যেটা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু করা যেতে পারে। এজন্যই স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা এ পর্যন্ত যা দেখছি, তা আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে। দেশের পৌর নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশ আর দ্বিতীয় দফায় ৬১ দশমিক ৯২ শতাংশ। অথচ আমরা দেখেছি, প্রথম দফা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের আকাল ছিল। আর দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে তুলনামূলক ভোটার উপস্থিতি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। এটা কোনোভাবেই বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। দেখা গিয়েছে যে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের চেয়ে পেপার ব্যালটে ১৪ শতাংশ বেশি ভোট পড়েছে। তাহলে আমরা কাকে সঠিক ধরে নিতে পারি? যদি ইভিএমের ভোট সঠিক হয় তাহলে পেপার ব্যালটে জাল ভোট পড়েছে। আগের রাতে জাল ভোট দেওয়া ঠেকাতে ইভিএমের প্রচলন শুরু হয়েছে। তাহলে ইভিএম ব্যবহার করেও তো পেপার ব্যালটের জাল ভোট থামানো যাচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আবার পেপার ব্যালট যদি সঠিক হয়, তাহলে তো ইভিএম প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শুধু তাই নয়, পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে যথাক্রমে ৬৪ ও ৬০ শতাংশ। আর বিএনপি পেয়েছে ১৩ ও ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। বাস্তবতার সঙ্গে ঘোষিত পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলের মিল দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভোটের এত ব্যবধান! এটি সংগতিপূর্ণ মনে হয় না। এছাড়া সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং আচরণবিধি বহুলাংশে লঙ্ঘন করা হয়েছে। অথচ নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিল। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেনি। তাদের আচরণ ছিল অনেকটা ‘কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে দিয়েছি কুলো’র মতো। তাই এ নির্বাচন আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সর্বোপরি এ ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য প্রকৃত অর্থে এক ধরনের অশনিসংকেত।
দেশ রূপান্তর : পৌর নির্বাচনের প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী বিএনপির মধ্যে ফলাফলের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যবধান কেন পরিলক্ষিত হচ্ছে?
বদিউল আলম মজুমদার : এ ধরনের ফলাফলের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই বললেই চলে। বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৯ শতাংশ ভোট আর বিএনপি পেয়েছিল ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ। এবার বিএনপি পেয়েছে ১৩ শতাংশ ও ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। তাই এটা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
দেশ রূপান্তর : এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
বদিউল আলম মজুমদার : দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তারা আমাদের আমানতের খেয়ানত করেছে। তারা যে জাল ভোটসহ নানা অনিয়মকে প্রশ্রয় শুধু নয়, তা অনুষ্ঠিত করতে ভূমিকা যে রাখছে, সেটা এখন প্রতিষ্ঠিত। তার ওপরে তারা এবার একটি অভূতপূর্ব নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এবার করদাতাদের অর্থ প্রশিক্ষণের নামে ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ এ কারণেই অভূতপূর্ব যে, অতীতে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কারচুপির নির্বাচন করার কিংবা নির্বাচন পরিচালনায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু অতীতে কোনোদিন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। এ নির্বাচন কমিশনের স্ব-অবস্থানে বহাল থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।
দেশ রূপান্তর : পৌর নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনী সহিংসতার যেমন বাড়বাড়ন্ত ছিল, তেমনি বিদ্রোহী প্রার্থীর আধিক্য ছিল। এ প্রবণতাগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
বদিউল আলম মজুমদার : মূলত দুটি কারণে নির্বাচনে সহিংসতা সংঘটিত হয়। একটা হলো দলীয় নির্বাচন। দলীয় নির্বাচনে তো দলতন্ত্র, দলবাজির কারণে দলীয় মারামারি একদম মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এটাই এখন বেশি পরিমাণে ঘটছে। আমাদের দেশে এটা বেশি পরিমাণ ঘটছে, কেননা বিরোধী দল দুর্বল। তাদের মধ্যে মারামারির পরিমাণ কমে গিয়েছে। তাই এখন সরকারি দলের মধ্যেই এটা বেশি ঘটছে। এর মূল কারণ হলো ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি অর্জন করা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাধারী কোনো বিশেষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হলে অনেক ব্যক্তিগত ফায়দা তোলা যায়। এটা দেশের ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। তারা যদি ন্যায়সংগত সুযোগ-সুবিধা পেত, তাহলে অসুবিধা থাকত না। কিন্তু এসব ফায়দার বেশিরভাগই কায়েমি স্বার্থে পরিচালিত এবং ন্যায়সংগত নয়। আর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা পার পেয়ে যাচ্ছে এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এবং এটা সম্ভব হয় ক্ষমতাসীন দলে যুক্ত থাকার কারণে। এটা শুধু এ সরকারের সময় নয়, আগের সরকারের সময়ও হয়েছে। এ প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনোভাবে মনোনয়ন পেলে এবং কাক্সিক্ষত পদে অধিষ্ঠিত হলে নানা সুযোগ-সুবিধা তো পাওয়া যায়, তেমনি নিজেদের আর্থিক ভবিষ্যৎও সমৃদ্ধ করা যায়। এজন্যই মনোনয়নবাণিজ্য চলে এবং সরকারের প্রতিনিধিত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা চলে। এজন্যই এত বিদ্রোহী প্রার্থী হয়, এত সহিংসতা সংঘটিত হয়। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন হলো শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদলের ব্যবস্থা। তাই যদি নির্বাচনব্যবস্থার স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়, তাহলে সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখলের রাস্তা প্রশস্ত হয়। যেমনটি সর্বশেষ ২০০৭ সালে ঘটেছিল। বিএনপি তখন নির্বাচনে ম্যানিপুলেশন করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা কারসাজি করেছিল। তারা ম্যানিপুলেট করার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। তার ফলে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। সুতরাং নির্বাচনী ব্যবস্থা সুসংহত রাখা যেকোনো গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য প্রধান কর্তব্য।
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ৬০টি পৌরসভার মধ্যে ২৮টিতে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের মাধ্যমে ভোট নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গায় ইভিএমে ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং এ ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
বদিউল আলম মজুমদার : আমার কাছে মনে হচ্ছে, ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এ ভোটিং মেশিনটি আমাদের এখানে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এ যন্ত্রটির নিয়ন্ত্রণ থাকে নির্বাচন কমিশনের কিছু সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির হাতে। তারা ইচ্ছে করলে ভোটের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তারা যদি ইভিএমের ফলাফল নিজেদের ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করে থাকে এবং এ যন্ত্রের মাধ্যমে জাল ভোটের ব্যবস্থা করে, তা চেক করার বা এ ঘটনার প্রতিকার করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে পেপার ট্রেইলের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের ইভিএমের কোথাও ব্যবস্থা রয়েছে কি না, এটা আমার জানা নেই। অন্যান্য দেশে ইভিএমে ভোট দিলে একটা ব্যালট বেরিয়ে আসে এবং তাতে ভোটারের নাম থাকে না কিন্তু ভোটের তথ্য দেওয়া থাকে। অর্থাৎ আপনি কাকে ভোট দিলেন, সেই তথ্য দেওয়া থাকে। এর মাধ্যমে অডিট করার সময় কিংবা পুনর্গণনা করার সময় ভোটের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়। আপনারা দেখেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে তিনবার ভোটগণনা হয়েছে। প্রথমবার গণনার পর দ্বিতীয়বার তারা ইভিএম থেকে প্রাপ্ত ব্যালট পেপার গণনা করেছে এবং সর্বশেষ, তারা প্রতিটি ব্যালট আলাদা আলাদা করে গণনা করেছে। এর ফলে ট্রাম্প যে কারচুপির অভিযোগ করেছিল, সেটি মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যবহৃত ইভিএম অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ এবং নিম্নমানের। ইভিএমের মাধ্যমে ভোট যথার্থ হয়েছে কি না সেটি সার্টিফাই করার জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ভোটার ভেরিফিয়াবল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি আন্তর্জাতিক বডি রয়েছে। তাদের নির্ধারিত মানদন্ডের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি বিষয় হলো ইভিএমে পেপার ট্রেইল বা ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে কি না। কিন্তু আমাদের এখানে এ মানদন্ডটি কার্যকর নেই। পাশের দেশ ভারতে একসময় আমাদের মতো ইভিএমের প্রচলন ছিল। কিন্তু সেখানকার উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছে যে পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেননা এটা ছাড়া যন্ত্রটি নিরাপদ নয়। আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে প্রধান করে একটি অ্যাডভাইজরি কমিটি করেছিল। কিন্তু কমিশন যখন বর্তমানের ভোটিং যন্ত্রটি কেনার বন্দোবস্ত করা শুরু করল, তখন তিনি শুধু আপত্তিই করেননি, এমনকি রিকমান্ডেশন পেপারে স্বাক্ষর পর্যন্ত করেননি। আমরা এখানে বাইরের দেশের বিশেষজ্ঞ, পাশের দেশের অভিজ্ঞতা এবং দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এমন একটি ভোটিং যন্ত্র ব্যবহার করে চলছি, যেটা দিয়ে সহজেই নির্বাচনের ফলাফল ম্যানিপুলেট করা যায়। আমাদের আগে ভোট কারচুপির সুযোগ ছিল, এখন ডিজিটাল জালিয়াতির ব্যবস্থা হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : দ্বিতীয় ধাপের ৬০ পৌরসভার মেয়র পদে মোট ২২১ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাদের মধ্যে নারী ছিলেন ৭ জন। দেশে যখন নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে, তখন এই চিত্র কি হতাশাব্যঞ্জক নয়?
বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের বাস্তবতা হলো, আমরা একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি। এ মানসিকতা শুধু দেশের পুরুষদের মধ্যেই বিদ্যমান নয়, এটা নারীদের মধ্যেও বিদ্যমান। আমাদের দেশে আগে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে গিয়েছে। এখন অবশ্য পরিমাণটা আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা ছিল। কিন্তু বর্তমানে পরিমাণটা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, বাস্তবতা সেরকম নয়। বরং আমরা এখনো পুরুষতান্ত্রিক ঘেরাটোপের মধ্যেই রয়ে গিয়েছি। আমাদের যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা রয়েছে, সেটার বিলোপ সাধন কিংবা বিপুলাংশে হ্রাস করা খুবই কঠিন। এটা করতে গেলে আমাদের পুরুষদের নিজেদের সঙ্গেই লড়াই করতে হয়। যদিও এটার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান তৈরি করা জরুরি, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ করা খুবই দুরূহ। আর এটারই প্রতিফলন ঘটছে আমাদের এ নির্বাচনে প্রার্থিতা পাওয়া থেকে সমাজের সর্বস্তরেই।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

ড. বদিউল আলম মজুমদার কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পোলাইয়া গ্রামে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে শেষ দিকের গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন ইকবাল হলের (বর্তমানে জহুরুল হক হল) সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে ১৯৭৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এছাড়া তিনি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’তেও কনসালটেন্ট ছিলেন। তিনি এখন ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট। এছাড়া তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনের সম্পন্ন হওয়া দুটি ধাপের নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা, স্থানীয় নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের প্রতিনিধিত্বসহ স্থানীয় নির্বাচন ও সরকারের নানা বিষয় নিয়ে দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের অনিন্দ্য আরিফ
দেশ রূপান্তর : গণতন্ত্রের ক্ল্যাসিকাল ডিকটাম (ধ্রুপদী অনুশাসন) হচ্ছে, ‘স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ’। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের তৃতীয় স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী এ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রক্রিয়া, অংশগ্রহণ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, স্বচ্ছতা-সর্বোপরি গুণগত মান নিয়ে জনমনে হতাশা, উদাসীনতা এবং অনাস্থা লক্ষ করছি। এ পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
বদিউল আলম মজুমদার : স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রের সূতিকাগৃহ বলা হয়। স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়। এ সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শক্ত ‘সাহায্য কাঠামো’ তৈরি করে। গণতন্ত্রের জন্য পাটাতন তৈরি করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ‘তৃণমূলের গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে আমাদের তৃণমূলের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হবে, যেটা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে শুরু করা যেতে পারে। এজন্যই স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা এ পর্যন্ত যা দেখছি, তা আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক ঘটিয়েছে। দেশের পৌর নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৬৫ শতাংশ আর দ্বিতীয় দফায় ৬১ দশমিক ৯২ শতাংশ। অথচ আমরা দেখেছি, প্রথম দফা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটারের আকাল ছিল। আর দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে তুলনামূলক ভোটার উপস্থিতি বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে। এটা কোনোভাবেই বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। দেখা গিয়েছে যে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের চেয়ে পেপার ব্যালটে ১৪ শতাংশ বেশি ভোট পড়েছে। তাহলে আমরা কাকে সঠিক ধরে নিতে পারি? যদি ইভিএমের ভোট সঠিক হয় তাহলে পেপার ব্যালটে জাল ভোট পড়েছে। আগের রাতে জাল ভোট দেওয়া ঠেকাতে ইভিএমের প্রচলন শুরু হয়েছে। তাহলে ইভিএম ব্যবহার করেও তো পেপার ব্যালটের জাল ভোট থামানো যাচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আবার পেপার ব্যালট যদি সঠিক হয়, তাহলে তো ইভিএম প্রশ্নবিদ্ধ হয়। শুধু তাই নয়, পৌরসভা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে যথাক্রমে ৬৪ ও ৬০ শতাংশ। আর বিএনপি পেয়েছে ১৩ ও ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। বাস্তবতার সঙ্গে ঘোষিত পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলের মিল দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভোটের এত ব্যবধান! এটি সংগতিপূর্ণ মনে হয় না। এছাড়া সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এবং আচরণবিধি বহুলাংশে লঙ্ঘন করা হয়েছে। অথচ নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিল। তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারেনি। তাদের আচরণ ছিল অনেকটা ‘কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে দিয়েছি কুলো’র মতো। তাই এ নির্বাচন আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সর্বোপরি এ ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য প্রকৃত অর্থে এক ধরনের অশনিসংকেত।
দেশ রূপান্তর : পৌর নির্বাচনের প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী বিএনপির মধ্যে ফলাফলের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ব্যবধান কেন পরিলক্ষিত হচ্ছে?
বদিউল আলম মজুমদার : এ ধরনের ফলাফলের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই বললেই চলে। বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্যে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৯ শতাংশ ভোট আর বিএনপি পেয়েছিল ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ। এবার বিএনপি পেয়েছে ১৩ শতাংশ ও ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। তাই এটা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
দেশ রূপান্তর : এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
বদিউল আলম মজুমদার : দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। তারা আমাদের আমানতের খেয়ানত করেছে। তারা যে জাল ভোটসহ নানা অনিয়মকে প্রশ্রয় শুধু নয়, তা অনুষ্ঠিত করতে ভূমিকা যে রাখছে, সেটা এখন প্রতিষ্ঠিত। তার ওপরে তারা এবার একটি অভূতপূর্ব নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এবার করদাতাদের অর্থ প্রশিক্ষণের নামে ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগ এ কারণেই অভূতপূর্ব যে, অতীতে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে কারচুপির নির্বাচন করার কিংবা নির্বাচন পরিচালনায় সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু অতীতে কোনোদিন নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। এ নির্বাচন কমিশনের স্ব-অবস্থানে বহাল থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।
দেশ রূপান্তর : পৌর নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে নির্বাচনী সহিংসতার যেমন বাড়বাড়ন্ত ছিল, তেমনি বিদ্রোহী প্রার্থীর আধিক্য ছিল। এ প্রবণতাগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
বদিউল আলম মজুমদার : মূলত দুটি কারণে নির্বাচনে সহিংসতা সংঘটিত হয়। একটা হলো দলীয় নির্বাচন। দলীয় নির্বাচনে তো দলতন্ত্র, দলবাজির কারণে দলীয় মারামারি একদম মাঠপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এটাই এখন বেশি পরিমাণে ঘটছে। আমাদের দেশে এটা বেশি পরিমাণ ঘটছে, কেননা বিরোধী দল দুর্বল। তাদের মধ্যে মারামারির পরিমাণ কমে গিয়েছে। তাই এখন সরকারি দলের মধ্যেই এটা বেশি ঘটছে। এর মূল কারণ হলো ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি অর্জন করা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাধারী কোনো বিশেষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হলে অনেক ব্যক্তিগত ফায়দা তোলা যায়। এটা দেশের ফায়দাভিত্তিক রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। তারা যদি ন্যায়সংগত সুযোগ-সুবিধা পেত, তাহলে অসুবিধা থাকত না। কিন্তু এসব ফায়দার বেশিরভাগই কায়েমি স্বার্থে পরিচালিত এবং ন্যায়সংগত নয়। আর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা পার পেয়ে যাচ্ছে এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এবং এটা সম্ভব হয় ক্ষমতাসীন দলে যুক্ত থাকার কারণে। এটা শুধু এ সরকারের সময় নয়, আগের সরকারের সময়ও হয়েছে। এ প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনোভাবে মনোনয়ন পেলে এবং কাক্সিক্ষত পদে অধিষ্ঠিত হলে নানা সুযোগ-সুবিধা তো পাওয়া যায়, তেমনি নিজেদের আর্থিক ভবিষ্যৎও সমৃদ্ধ করা যায়। এজন্যই মনোনয়নবাণিজ্য চলে এবং সরকারের প্রতিনিধিত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা চলে। এজন্যই এত বিদ্রোহী প্রার্থী হয়, এত সহিংসতা সংঘটিত হয়। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন হলো শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদলের ব্যবস্থা। তাই যদি নির্বাচনব্যবস্থার স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়, তাহলে সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতা দখলের রাস্তা প্রশস্ত হয়। যেমনটি সর্বশেষ ২০০৭ সালে ঘটেছিল। বিএনপি তখন নির্বাচনে ম্যানিপুলেশন করার লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নানা কারসাজি করেছিল। তারা ম্যানিপুলেট করার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। তার ফলে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। সুতরাং নির্বাচনী ব্যবস্থা সুসংহত রাখা যেকোনো গণতান্ত্রিক শক্তির জন্য প্রধান কর্তব্য।
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিক পৌর নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ৬০টি পৌরসভার মধ্যে ২৮টিতে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের মাধ্যমে ভোট নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনেক জায়গায় ইভিএমে ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং এ ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
বদিউল আলম মজুমদার : আমার কাছে মনে হচ্ছে, ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এ ভোটিং মেশিনটি আমাদের এখানে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। এ যন্ত্রটির নিয়ন্ত্রণ থাকে নির্বাচন কমিশনের কিছু সীমিতসংখ্যক ব্যক্তির হাতে। তারা ইচ্ছে করলে ভোটের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তারা যদি ইভিএমের ফলাফল নিজেদের ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করে থাকে এবং এ যন্ত্রের মাধ্যমে জাল ভোটের ব্যবস্থা করে, তা চেক করার বা এ ঘটনার প্রতিকার করার কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানে পেপার ট্রেইলের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ধরনের ইভিএমের কোথাও ব্যবস্থা রয়েছে কি না, এটা আমার জানা নেই। অন্যান্য দেশে ইভিএমে ভোট দিলে একটা ব্যালট বেরিয়ে আসে এবং তাতে ভোটারের নাম থাকে না কিন্তু ভোটের তথ্য দেওয়া থাকে। অর্থাৎ আপনি কাকে ভোট দিলেন, সেই তথ্য দেওয়া থাকে। এর মাধ্যমে অডিট করার সময় কিংবা পুনর্গণনা করার সময় ভোটের পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়। আপনারা দেখেছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে তিনবার ভোটগণনা হয়েছে। প্রথমবার গণনার পর দ্বিতীয়বার তারা ইভিএম থেকে প্রাপ্ত ব্যালট পেপার গণনা করেছে এবং সর্বশেষ, তারা প্রতিটি ব্যালট আলাদা আলাদা করে গণনা করেছে। এর ফলে ট্রাম্প যে কারচুপির অভিযোগ করেছিল, সেটি মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যবহৃত ইভিএম অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ এবং নিম্নমানের। ইভিএমের মাধ্যমে ভোট যথার্থ হয়েছে কি না সেটি সার্টিফাই করার জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল ভোটার ভেরিফিয়াবল ফাউন্ডেশন’ নামে একটি আন্তর্জাতিক বডি রয়েছে। তাদের নির্ধারিত মানদন্ডের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি বিষয় হলো ইভিএমে পেপার ট্রেইল বা ব্যালটের ব্যবস্থা রয়েছে কি না। কিন্তু আমাদের এখানে এ মানদন্ডটি কার্যকর নেই। পাশের দেশ ভারতে একসময় আমাদের মতো ইভিএমের প্রচলন ছিল। কিন্তু সেখানকার উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিয়েছে যে পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। কেননা এটা ছাড়া যন্ত্রটি নিরাপদ নয়। আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে প্রধান করে একটি অ্যাডভাইজরি কমিটি করেছিল। কিন্তু কমিশন যখন বর্তমানের ভোটিং যন্ত্রটি কেনার বন্দোবস্ত করা শুরু করল, তখন তিনি শুধু আপত্তিই করেননি, এমনকি রিকমান্ডেশন পেপারে স্বাক্ষর পর্যন্ত করেননি। আমরা এখানে বাইরের দেশের বিশেষজ্ঞ, পাশের দেশের অভিজ্ঞতা এবং দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এমন একটি ভোটিং যন্ত্র ব্যবহার করে চলছি, যেটা দিয়ে সহজেই নির্বাচনের ফলাফল ম্যানিপুলেট করা যায়। আমাদের আগে ভোট কারচুপির সুযোগ ছিল, এখন ডিজিটাল জালিয়াতির ব্যবস্থা হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : দ্বিতীয় ধাপের ৬০ পৌরসভার মেয়র পদে মোট ২২১ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাদের মধ্যে নারী ছিলেন ৭ জন। দেশে যখন নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে, তখন এই চিত্র কি হতাশাব্যঞ্জক নয়?
বদিউল আলম মজুমদার : আমাদের বাস্তবতা হলো, আমরা একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাস করছি। এ মানসিকতা শুধু দেশের পুরুষদের মধ্যেই বিদ্যমান নয়, এটা নারীদের মধ্যেও বিদ্যমান। আমাদের দেশে আগে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে গিয়েছে। এখন অবশ্য পরিমাণটা আগের চেয়ে কমে গিয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা ছিল। কিন্তু বর্তমানে পরিমাণটা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তাই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, বাস্তবতা সেরকম নয়। বরং আমরা এখনো পুরুষতান্ত্রিক ঘেরাটোপের মধ্যেই রয়ে গিয়েছি। আমাদের যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা রয়েছে, সেটার বিলোপ সাধন কিংবা বিপুলাংশে হ্রাস করা খুবই কঠিন। এটা করতে গেলে আমাদের পুরুষদের নিজেদের সঙ্গেই লড়াই করতে হয়। যদিও এটার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান তৈরি করা জরুরি, কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ করা খুবই দুরূহ। আর এটারই প্রতিফলন ঘটছে আমাদের এ নির্বাচনে প্রার্থিতা পাওয়া থেকে সমাজের সর্বস্তরেই।