বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫
সড়ক, রেল ও জলপথে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে ঢাকা মহানগরে
সাঈদ নূর আলম
ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা মহানগরের ওপর জনসংখ্যার চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আদর্শ মহানগরের মানদ-ে পরিবহন ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, মুক্ত পরিসর, খেলার মাঠ, পার্কসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিবেচনায় প্রায় সব দিক দিয়েই পিছিয়ে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য করা মহাপরিকল্পনা ছিল মূলত একটি স্থির রূপকল্পভিত্তিক নগর-পরিকল্পনা। এ ধরনের পরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী অপ্রাসঙ্গিক বা বিবর্তিত সময়ের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হওয়ায় নগর-পরিকল্পনার ধরন পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে কৌশলগত পরিকল্পনার দিকে এগোতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকার জন্য তিন স্তরবিশিষ্ট পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে চূড়ান্তভাবে যে পরিকল্পনাটি প্রস্তুত হয়, তার শিরোনাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা’। এর স্তরগুলো ছিল যথাক্রমে ঢাকা কৌশলগত পরিকল্পনা, নগর এলাকা পরিকল্পনা, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। সর্বশেষ বর্তমানে যে মহাপরিকল্পনাটি করা হয়েছে তা ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’ বা ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা২০১৬-২০৩৫’ (সংশোধিত)। এই মহাপরিকল্পনায় ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাভুক্ত করা হয়েছে। ঢাকার এ মহাপরিকল্পনার নানা দিক নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজউক-এর চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তোফাজ্জল হোসেন রুবেল
দেশ রূপান্তর : ঢাকা মহানগরের বর্তমান মহাপরিকল্পনায় রাজউকের সীমানা আসলে কতটুকু ধরা হয়েছে? আপনারা কীভাবে চিহ্নিত করছেন? দুই দশকের এই পরিকল্পনা হালনাগাদ হবে কীভাবে?
সাঈদ নূর আলম : রাজউকের সীমানা বলতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, কালীগঞ্জ পৌরসভা, কেরানীগঞ্জ উপজেলা ও সাভার উপজেলা। বর্তমান ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাটি’ ২০ বছর মেয়াদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে একে প্রতি ৫ বছরে হালনাগাদ ও পরিমার্জনের সুপারিশ রয়েছে। আর পুরো পরিকল্পনাটির অবয়ব ও বিন্যাস এমনভাবে তৈরির প্রয়াস নেওয়া হয়েছে, যেন প্রতিটি ক্ষুদ্র এলাকা বা অঞ্চলের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা বা উন্নয়নবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ওই সময়ের এবং উক্ত এলাকার স্থানীয় চরিত্র ও চাহিদা অনুযায়ী গ্রহণ কিংবা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা যায়।
দেশ রূপান্তর : এতদিনের ‘বন্যা প্রবাহ এলাকা’র সংজ্ঞা পরিবর্তন করে নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ‘ওভার লে জোন’ করার কারণ কী?
সাঈদ নূর আলম : বন্যা প্রবাহ এলাকাকে ভূমি ব্যবহার জোন হিসেবে প্রস্তাবনা করা হয়েছিল। বন্যা প্রবাহ এলাকাকে সাধারণভাবে বন্যা অববাহিকা এলাকা, সাধারণ জলস্রোত এলাকা এবং মুখ্য জলস্রোত এলাকা এই তিন ভাগে ভূমি ব্যবহার জোন হিসেবে প্রস্তাব না করে বরঞ্চ সামগ্রিকভাবে ‘ওভার লে জোন’ হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়েছে এই পরিকল্পনায়। আসলে বন্যা প্রবাহ এলাকাগুলোর ভূমি-ব্যবহার ঐতিহাসিকভাবেই ছিল কৃষি বা চাষাবাদের। এখন ‘ওভার লে জোন’কে ‘ভূমি ব্যবহার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত না করে বরঞ্চ ‘বিশেষ ব্যবস্থাপনা জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ভূমি ব্যবহার এলাকা যেমন কৃষি এলাকা, বনাঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান, আবাসিক এলাকা, আবাসিক-বাণিজ্যিক, বাণিজ্যিক এলাকা, ভারী ও দূষণকারী শিল্প এলাকা, প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা, জলাশয়, পরিবহন ও যোগাযোগের বিশেষ ব্যবস্থাপনা এলাকা, বন্যা ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এলাকা, মুখ্য জলস্রোত এলাকা, সাধারণ জলস্রোত এলাকা, সাধারণ বন্যা অববাহিকা, দুর্যোগ-সংক্রান্ত, ভূতাত্ত্বিক ও ভূকম্প-সংক্রান্ত, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা/নিদর্শন, বিমান উড্ডয়ন সংক্রান্ত উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ এলাকা, জনঘনত্ব বিন্যাস, পরিবেশ ও প্রতিবেশ, নদীতীর ব্যবস্থাপনা, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, পরিবেশগত সংবেদনশীল এলাকা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন এলাকায় রূপান্তর করা হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : এ পরিকল্পনায় অঞ্চলভিত্তিক প্রস্তাবিত মিশ্র ভূমি ব্যবহারের রূপরেখা সম্পর্কে জানতে চাই।
সাঈদ নূর আলম : এ পরিকল্পনায় মূলত নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ভূমি ব্যবহার জোনের প্রস্তাব করা হয়েছে। পুরো মেট্রোপলিটন এলাকার প্রায় ৯৪ হাজার ৫৮ দশমিক ৪২ হেক্টর জমিকে ‘নগর এলাকা’ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট পরিকল্পনা এলাকার ৬১ দশমিক ৬১ ভাগ। মিশ্র ব্যবহার এলাকায় আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যপ্রধান এবং শিল্পপ্রধান এলাকা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। আর কৃষি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মোট এলাকার ১ লাখ ১১ হাজার ২০৩ দশমিক ৬৯ একর যা সমগ্রের ২৯ দশমিক ৪৮ ভাগ। এছাড়া পুরো এলাকার প্রায় ৭ দশমিক ৮৭ ভাগ জমি জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা, উন্মুক্ত স্থান এবং ভারী শিল্প এলাকা হিসেবে পরিকল্পনায় বরাদ্দ আছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫৯ ভাগ, ১ দশমিক ৪ ভাগ এবং ১ দশমিক ৭১ ভাগ জমি।
দেশ রূপান্তর : ঢাকা মহানগরের একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত আবাসন সংকট। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আবাসনের বিপুল চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে রূপরেখা কী হবে?
সাঈদ নূর আলম : আবাসন সংকটকে দুটি দিক থেকে দেখা বা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। একটি চাহিদা ও অন্যটি জোগান। চাহিদার কেন্দ্রে আছে যারা এই আবাসনের ব্যবহারকারী অর্থাৎ নগরে বসবাসকারী মানুষ। মনে রাখা দরকার ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত বা তারও নিচে অবস্থান করছে। অপরপক্ষে জোগানের দিকটি দেখলে মূলত আসে আবাসন নির্মাণকারী (ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান)। আবাসনের সিংহভাগের জোগানদাতা এখনো বেসরকারি খাত। এমন অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি আনুষ্ঠানিক খাতের মাধ্যমে সরাসরি আবাসন ইউনিটের জোগান দেওয়ার চেয়ে সবচেয়ে বড় জোগানদাতা অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তি খাতকে যথাযথ সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার নীতিই অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। এক্ষেত্রে এ পরিকল্পনায় ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্লকভিত্তিক আবাসনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো উলম্ব অর্থাৎ উচ্চতা সম্প্রসারণে উৎসাহিত করা, যাতে যত্রতত্র নগরাঞ্চল সম্প্রসারণ কমিয়ে আনা এবং শহরের নিচু জমি ও কৃষিজমির সুরক্ষা হয়। এই পদ্ধতিতে রাজউকের যে কোনো এলাকায় (অনুমোদিত ভূমি ব্যবহার এলাকায়) ব্লকের আকার অনুযায়ী ১২, ১৫ থেকে তার চেয়ে বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে, যেখানে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ থেকে নির্ধারিত সর্বোচ্চ উচ্চতা হবে তার সীমা। ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন পদ্ধতির অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য হলোবিকল্প উপায়ে উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
দেশ রূপান্তর : একুশ শতকের উপযোগী একটি জনবহুল মহানগরের জন্য গণপরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোর যে চাহিদা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় সে বিষয়ে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন? সড়কপথ, রেলপথ জলপথকে সমন্বয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকবে কি?
সাঈদ নূর আলম : পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবস্থায় সড়কপথ, জলপথ ও রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় সড়কপথকে নতুন ধারণার আওতায় ‘নগরজীবনরেখা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে তা যোগাযোগব্যবস্থার সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব গাছ রোপণের মাধ্যমে আমাদের শহরের একঘেয়ে জীবনকে প্রাণবন্ত করতে সহায়তা করবে। ঢাকা মহানগরে সরকারের কোনো মুখ্য সহযোগিতা বা প্রভাব ছাড়াই নগর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা খাতে দক্ষ জনবল, দীর্ঘমেয়াদি গণপরিবহন পরিকল্পনার অভাবে পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। সমন্বয়হীন পরিবহনব্যবস্থা, জননিরাপত্তার অভাব, হকার অব্যবস্থাপনা, অবৈধ পার্কিং, অপর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। পরিবহন খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘মাল্টিমোডাল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম’। যার অর্থ হচ্ছে একাধিক পরিবহন মাধ্যম ব্যবহার করে একটি যাত্রাকে সহজতর করা। বর্তমানে শহরভিত্তিক পরিবহনব্যবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যম (যেমন বাস, ট্রেন, নৌযান, অযান্ত্রিক যান) ব্যবহৃত হচ্ছে; নতুন আরও পরিকল্পনা হচ্ছে। যেমন এমআরটি, বিআরটি, সার্কুলার রেল নেটওয়ার্ক, সার্কুলার ওয়াটার নেটওয়ার্ক। এসব মোডের মধ্যে সুন্দর একটি সমন্বয় প্রয়োজন, যাতে যাত্রী খুব সহজেই একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করে তার গন্তব্যে যেতে পারে।
দেশ রূপান্তর : রাজউক এলাকার যোগাযোগ অবকাঠামোকে যে আপনারা ‘নগরজীবনরেখা’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। বলছেন নতুন পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব মহানগর গড়ে উঠবে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বিকাশে ভূমিকা রাখবে, সেটা কীভাবে হবে?
সাঈদ নূর আলম : এ পরিকল্পনায় মোট ২ হাজার ১৯৮ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার সড়কপথ এবং ৫৪৪ কিলোমিটার জলপথকে ‘নগর জীবনরেখা’ আঙ্গিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সড়কপথে প্রায় ১ লাখ ফলদ গাছ, প্রায় পঞ্চাশ হাজার কাঠ উৎপাদনের গাছ আর সমানসংখ্যক ঔষধি গাছ রোপণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে জলপথে প্রায় ৭২ হাজার ফলদ গাছ, প্রায় ছত্রিশ হাজার কাঠ উৎপাদনের গাছ আর সমানসংখ্যক ঔষধি গাছ রোপণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আর ভৌত জরিপ থেকে দেখা যায়, ঢাকার জলাভূমি ও গাছপালা সংবলিত এলাকা ৬ হাজার ২৭ ও ২ হাজার ৮১২ হেক্টর হ্রাস পেয়েছে। ঢাকায় মোট উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ মোট এলাকার মাত্র ০.৯%, যা খুবই নগণ্য। পরিবেশবান্ধব শহর তৈরির লক্ষ্যে এ পরিকল্পনায় মহানগরের পাঁচটি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক, ৪৯টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ৫টি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ) এবং ৮টি অন্যান্য পার্ক এবং খেলার মাঠের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া শহরে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র, ক্ষুদ্র এলাকার জলবায়ুর প্রভাব প্রশমন, নগরের বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধার বা পুনরুজ্জীবন, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পানি ধারণের জন্য অস্থায়ী জলাধার, সর্বস্তরের মানুষ এর বিনোদনের স্থান হিসেবে কাজ করতে পারে এমন এলাকাভিত্তিক পার্ক ও খেলার মাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : ঢাকা ঐতিহাসিকভাবে যেমন নদীবেষ্টিত তেমনি ঢাকা মহানগরের মধ্যেও অগুনতি খাল-জলাশয় ছিল। নতুন মহাপরিকল্পনায় নদী ও জলাশয় ঘিরে কী পরিকল্পনা করা হয়েছে? আর ঢাকার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনাই বা কী?
সাঈদ নূর আলম : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় মোট ১ হাজার ৩২৬.৯ কিলোমিটার নদী ও খাল রয়েছে। কিন্তু নদী ও খালগুলোর কোনো কোনোটি কম প্রশস্ত ও নাব্য কম হওয়ায়, কালভার্ট বা বক্স কালভার্টের কারণে নৌযান চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে। এখানে প্রায় ৫৬৬ দশমিক ৬০২ কিলোমিটার নৌপথকে শ্রেণিক্রম অনুসারে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর রেলপথের ক্ষেত্রে শহরের চারপাশে একটি বৃত্তাকার রেল রুট নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী, ৮১ দশমিক ৯ কিমি বৃত্তাকার ট্রেন নেটওয়ার্ক উন্নত রাস্তা এবং দুই লাইনবিশিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড গেজ থাকবে। বৃত্তাকার রুটে ২০টি স্টেশন থাকবে : টঙ্গী, তেরমুখ, পূর্বাচল সড়ক, বেরাইদ, কায়েতপাড়া, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, চৌধুরীবাড়ী, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, শ্যামপুর, সদরঘাট, বাবুবাজার, নবাবগঞ্জ, শংকর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা, বিরুলিয়া, উত্তরা ও ধৌড়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ট্রেনটি ক্রমাগত উভয় পাশে চলাচল করবে।
দেশ রূপান্তর : জনবহুল ঢাকা মহানগরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় কী আছে?
সাঈদ নূর আলম : এ পরিকল্পনার আওতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষা খাতের উন্নয়ন। এ কারণে প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় সরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে বণ্টন করা হয়েছে যাতে সব জনগোষ্ঠী শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা পায়। সেই সঙ্গে জনসংখ্যার স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ উদ্দেশে অধ্যয়ন এলাকার ৭৪টি উপ-অঞ্চলে বর্তমানে বিদ্যমান হাসপাতালের পরিমাণ নির্ণয় করে ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার ছাত্রছাত্রীদের বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যও একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকবে এই পরিকল্পনায়।
দেশ রূপান্তর : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় অনুমোদনবিহীন ইমারত বৈধকরণের বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সাঈদ নূর আলম : ঢাকা মহানগরীর বিপুলসংখ্যক স্থাপনা/ইমারত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বা অনুমোদন গ্রহণ সত্ত্বেও অনুমোদনের শর্তাবলি লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তিবর্গের আইনভঙ্গের প্রবণতা, জনসচেতনতার অভাব, মনিটরিংয়ের অভাব, কিংবা মহাপরিকল্পনা ও বিধিবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি। এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার অধীনে ভৌত জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে অত্র এলাকায় বিদ্যমান সর্বমোট স্থাপনার সংখ্যা ২১ লাখের ওপরে। ডেটাবেইজ ও রাজউকের স্থাপনা নকশা অনুমোদন তথ্য-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর মাত্র ৪ দশমিক ৬৪ ভাগ স্থাপনা রাজউক থেকে অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে নির্মিত হয়েছে। বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন (বিসি) আইন, ১৯৫২ এর বিধান অনুযায়ী অনুমোদনবিহীন/ব্যত্যয়কৃত ইমারতকে বৈধকরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, বর্তমানে নতুন ভবনের নির্মাণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮ এর যেসব বিধি/শর্ত অনুসরণ করা হয়, ওই একই বিধি বা শর্ত অনুযায়ী অনুমোদনহীন/ব্যত্যয়কৃত ইমারতে প্রয়োজনীয় সংশোধন বা পরিবর্তন সাধন করা হলেই কেবল অনুমোদনবিহীন ইমারতকে বৈধতা দেওয়া হবে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা মহানগরের ওপর জনসংখ্যার চাপ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আদর্শ মহানগরের মানদ-ে পরিবহন ব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, মুক্ত পরিসর, খেলার মাঠ, পার্কসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার বিবেচনায় প্রায় সব দিক দিয়েই পিছিয়ে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৯ সালে ঢাকার জন্য করা মহাপরিকল্পনা ছিল মূলত একটি স্থির রূপকল্পভিত্তিক নগর-পরিকল্পনা। এ ধরনের পরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী অপ্রাসঙ্গিক বা বিবর্তিত সময়ের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হওয়ায় নগর-পরিকল্পনার ধরন পরিবর্তিত হয়ে ধীরে ধীরে কৌশলগত পরিকল্পনার দিকে এগোতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকার জন্য তিন স্তরবিশিষ্ট পরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে চূড়ান্তভাবে যে পরিকল্পনাটি প্রস্তুত হয়, তার শিরোনাম দেওয়া হয় ‘ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা’। এর স্তরগুলো ছিল যথাক্রমে ঢাকা কৌশলগত পরিকল্পনা, নগর এলাকা পরিকল্পনা, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা। সর্বশেষ বর্তমানে যে মহাপরিকল্পনাটি করা হয়েছে তা ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান’ বা ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা২০১৬-২০৩৫’ (সংশোধিত)। এই মহাপরিকল্পনায় ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাভুক্ত করা হয়েছে। ঢাকার এ মহাপরিকল্পনার নানা দিক নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজউক-এর চেয়ারম্যান মো. সাঈদ নূর আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তোফাজ্জল হোসেন রুবেল
দেশ রূপান্তর : ঢাকা মহানগরের বর্তমান মহাপরিকল্পনায় রাজউকের সীমানা আসলে কতটুকু ধরা হয়েছে? আপনারা কীভাবে চিহ্নিত করছেন? দুই দশকের এই পরিকল্পনা হালনাগাদ হবে কীভাবে?
সাঈদ নূর আলম : রাজউকের সীমানা বলতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন, কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, কালীগঞ্জ পৌরসভা, কেরানীগঞ্জ উপজেলা ও সাভার উপজেলা। বর্তমান ‘বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনাটি’ ২০ বছর মেয়াদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে একে প্রতি ৫ বছরে হালনাগাদ ও পরিমার্জনের সুপারিশ রয়েছে। আর পুরো পরিকল্পনাটির অবয়ব ও বিন্যাস এমনভাবে তৈরির প্রয়াস নেওয়া হয়েছে, যেন প্রতিটি ক্ষুদ্র এলাকা বা অঞ্চলের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে পরিকল্পনা বা উন্নয়নবিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ওই সময়ের এবং উক্ত এলাকার স্থানীয় চরিত্র ও চাহিদা অনুযায়ী গ্রহণ কিংবা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা যায়।
দেশ রূপান্তর : এতদিনের ‘বন্যা প্রবাহ এলাকা’র সংজ্ঞা পরিবর্তন করে নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় ‘ওভার লে জোন’ করার কারণ কী?
সাঈদ নূর আলম : বন্যা প্রবাহ এলাকাকে ভূমি ব্যবহার জোন হিসেবে প্রস্তাবনা করা হয়েছিল। বন্যা প্রবাহ এলাকাকে সাধারণভাবে বন্যা অববাহিকা এলাকা, সাধারণ জলস্রোত এলাকা এবং মুখ্য জলস্রোত এলাকা এই তিন ভাগে ভূমি ব্যবহার জোন হিসেবে প্রস্তাব না করে বরঞ্চ সামগ্রিকভাবে ‘ওভার লে জোন’ হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়েছে এই পরিকল্পনায়। আসলে বন্যা প্রবাহ এলাকাগুলোর ভূমি-ব্যবহার ঐতিহাসিকভাবেই ছিল কৃষি বা চাষাবাদের। এখন ‘ওভার লে জোন’কে ‘ভূমি ব্যবহার জোন’ হিসেবে চিহ্নিত না করে বরঞ্চ ‘বিশেষ ব্যবস্থাপনা জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ভূমি ব্যবহার এলাকা যেমন কৃষি এলাকা, বনাঞ্চল, উন্মুক্ত স্থান, আবাসিক এলাকা, আবাসিক-বাণিজ্যিক, বাণিজ্যিক এলাকা, ভারী ও দূষণকারী শিল্প এলাকা, প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা, জলাশয়, পরিবহন ও যোগাযোগের বিশেষ ব্যবস্থাপনা এলাকা, বন্যা ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এলাকা, মুখ্য জলস্রোত এলাকা, সাধারণ জলস্রোত এলাকা, সাধারণ বন্যা অববাহিকা, দুর্যোগ-সংক্রান্ত, ভূতাত্ত্বিক ও ভূকম্প-সংক্রান্ত, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (কেপিআই) ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা/নিদর্শন, বিমান উড্ডয়ন সংক্রান্ত উচ্চতা নিয়ন্ত্রণ এলাকা, জনঘনত্ব বিন্যাস, পরিবেশ ও প্রতিবেশ, নদীতীর ব্যবস্থাপনা, প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, পরিবেশগত সংবেদনশীল এলাকা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন এলাকায় রূপান্তর করা হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : এ পরিকল্পনায় অঞ্চলভিত্তিক প্রস্তাবিত মিশ্র ভূমি ব্যবহারের রূপরেখা সম্পর্কে জানতে চাই।
সাঈদ নূর আলম : এ পরিকল্পনায় মূলত নিয়ন্ত্রিত মিশ্র ভূমি ব্যবহার জোনের প্রস্তাব করা হয়েছে। পুরো মেট্রোপলিটন এলাকার প্রায় ৯৪ হাজার ৫৮ দশমিক ৪২ হেক্টর জমিকে ‘নগর এলাকা’ হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট পরিকল্পনা এলাকার ৬১ দশমিক ৬১ ভাগ। মিশ্র ব্যবহার এলাকায় আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যপ্রধান এবং শিল্পপ্রধান এলাকা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে। আর কৃষি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মোট এলাকার ১ লাখ ১১ হাজার ২০৩ দশমিক ৬৯ একর যা সমগ্রের ২৯ দশমিক ৪৮ ভাগ। এছাড়া পুরো এলাকার প্রায় ৭ দশমিক ৮৭ ভাগ জমি জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা, উন্মুক্ত স্থান এবং ভারী শিল্প এলাকা হিসেবে পরিকল্পনায় বরাদ্দ আছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫৯ ভাগ, ১ দশমিক ৪ ভাগ এবং ১ দশমিক ৭১ ভাগ জমি।
দেশ রূপান্তর : ঢাকা মহানগরের একটি বিরাট সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত আবাসন সংকট। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আবাসনের বিপুল চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে রূপরেখা কী হবে?
সাঈদ নূর আলম : আবাসন সংকটকে দুটি দিক থেকে দেখা বা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। একটি চাহিদা ও অন্যটি জোগান। চাহিদার কেন্দ্রে আছে যারা এই আবাসনের ব্যবহারকারী অর্থাৎ নগরে বসবাসকারী মানুষ। মনে রাখা দরকার ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত বা তারও নিচে অবস্থান করছে। অপরপক্ষে জোগানের দিকটি দেখলে মূলত আসে আবাসন নির্মাণকারী (ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান)। আবাসনের সিংহভাগের জোগানদাতা এখনো বেসরকারি খাত। এমন অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি আনুষ্ঠানিক খাতের মাধ্যমে সরাসরি আবাসন ইউনিটের জোগান দেওয়ার চেয়ে সবচেয়ে বড় জোগানদাতা অর্থাৎ অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তি খাতকে যথাযথ সহায়তা ও প্রণোদনা দেওয়ার নীতিই অগ্রাধিকারের দাবি রাখে। এক্ষেত্রে এ পরিকল্পনায় ব্লকভিত্তিক আবাসন পদ্ধতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ব্লকভিত্তিক আবাসনের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো উলম্ব অর্থাৎ উচ্চতা সম্প্রসারণে উৎসাহিত করা, যাতে যত্রতত্র নগরাঞ্চল সম্প্রসারণ কমিয়ে আনা এবং শহরের নিচু জমি ও কৃষিজমির সুরক্ষা হয়। এই পদ্ধতিতে রাজউকের যে কোনো এলাকায় (অনুমোদিত ভূমি ব্যবহার এলাকায়) ব্লকের আকার অনুযায়ী ১২, ১৫ থেকে তার চেয়ে বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে, যেখানে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ থেকে নির্ধারিত সর্বোচ্চ উচ্চতা হবে তার সীমা। ব্লক ভিত্তিক উন্নয়ন পদ্ধতির অন্যতম আরেকটি উদ্দেশ্য হলোবিকল্প উপায়ে উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
দেশ রূপান্তর : একুশ শতকের উপযোগী একটি জনবহুল মহানগরের জন্য গণপরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামোর যে চাহিদা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় সে বিষয়ে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন? সড়কপথ, রেলপথ জলপথকে সমন্বয়ের কোনো ব্যবস্থা থাকবে কি?
সাঈদ নূর আলম : পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবস্থায় সড়কপথ, জলপথ ও রেলপথকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় সড়কপথকে নতুন ধারণার আওতায় ‘নগরজীবনরেখা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে তা যোগাযোগব্যবস্থার সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব গাছ রোপণের মাধ্যমে আমাদের শহরের একঘেয়ে জীবনকে প্রাণবন্ত করতে সহায়তা করবে। ঢাকা মহানগরে সরকারের কোনো মুখ্য সহযোগিতা বা প্রভাব ছাড়াই নগর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা খাতে দক্ষ জনবল, দীর্ঘমেয়াদি গণপরিবহন পরিকল্পনার অভাবে পরিবহনব্যবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। সমন্বয়হীন পরিবহনব্যবস্থা, জননিরাপত্তার অভাব, হকার অব্যবস্থাপনা, অবৈধ পার্কিং, অপর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। পরিবহন খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘মাল্টিমোডাল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম’। যার অর্থ হচ্ছে একাধিক পরিবহন মাধ্যম ব্যবহার করে একটি যাত্রাকে সহজতর করা। বর্তমানে শহরভিত্তিক পরিবহনব্যবস্থায় বিভিন্ন মাধ্যম (যেমন বাস, ট্রেন, নৌযান, অযান্ত্রিক যান) ব্যবহৃত হচ্ছে; নতুন আরও পরিকল্পনা হচ্ছে। যেমন এমআরটি, বিআরটি, সার্কুলার রেল নেটওয়ার্ক, সার্কুলার ওয়াটার নেটওয়ার্ক। এসব মোডের মধ্যে সুন্দর একটি সমন্বয় প্রয়োজন, যাতে যাত্রী খুব সহজেই একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করে তার গন্তব্যে যেতে পারে।
দেশ রূপান্তর : রাজউক এলাকার যোগাযোগ অবকাঠামোকে যে আপনারা ‘নগরজীবনরেখা’ হিসেবে উল্লেখ করছেন। বলছেন নতুন পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব মহানগর গড়ে উঠবে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বিকাশে ভূমিকা রাখবে, সেটা কীভাবে হবে?
সাঈদ নূর আলম : এ পরিকল্পনায় মোট ২ হাজার ১৯৮ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার সড়কপথ এবং ৫৪৪ কিলোমিটার জলপথকে ‘নগর জীবনরেখা’ আঙ্গিকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সড়কপথে প্রায় ১ লাখ ফলদ গাছ, প্রায় পঞ্চাশ হাজার কাঠ উৎপাদনের গাছ আর সমানসংখ্যক ঔষধি গাছ রোপণের প্রস্তাব করা হয়েছে। একইভাবে জলপথে প্রায় ৭২ হাজার ফলদ গাছ, প্রায় ছত্রিশ হাজার কাঠ উৎপাদনের গাছ আর সমানসংখ্যক ঔষধি গাছ রোপণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আর ভৌত জরিপ থেকে দেখা যায়, ঢাকার জলাভূমি ও গাছপালা সংবলিত এলাকা ৬ হাজার ২৭ ও ২ হাজার ৮১২ হেক্টর হ্রাস পেয়েছে। ঢাকায় মোট উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ মোট এলাকার মাত্র ০.৯%, যা খুবই নগণ্য। পরিবেশবান্ধব শহর তৈরির লক্ষ্যে এ পরিকল্পনায় মহানগরের পাঁচটি বৃহৎ আঞ্চলিক পার্ক, ৪৯টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, ৫টি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ) এবং ৮টি অন্যান্য পার্ক এবং খেলার মাঠের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া শহরে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র, ক্ষুদ্র এলাকার জলবায়ুর প্রভাব প্রশমন, নগরের বাস্তুসংস্থান পুনরুদ্ধার বা পুনরুজ্জীবন, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পানি ধারণের জন্য অস্থায়ী জলাধার, সর্বস্তরের মানুষ এর বিনোদনের স্থান হিসেবে কাজ করতে পারে এমন এলাকাভিত্তিক পার্ক ও খেলার মাঠের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : ঢাকা ঐতিহাসিকভাবে যেমন নদীবেষ্টিত তেমনি ঢাকা মহানগরের মধ্যেও অগুনতি খাল-জলাশয় ছিল। নতুন মহাপরিকল্পনায় নদী ও জলাশয় ঘিরে কী পরিকল্পনা করা হয়েছে? আর ঢাকার চারপাশ ঘিরে বৃত্তাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিকল্পনাই বা কী?
সাঈদ নূর আলম : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় মোট ১ হাজার ৩২৬.৯ কিলোমিটার নদী ও খাল রয়েছে। কিন্তু নদী ও খালগুলোর কোনো কোনোটি কম প্রশস্ত ও নাব্য কম হওয়ায়, কালভার্ট বা বক্স কালভার্টের কারণে নৌযান চলাচলের উপযোগিতা হারিয়েছে। এখানে প্রায় ৫৬৬ দশমিক ৬০২ কিলোমিটার নৌপথকে শ্রেণিক্রম অনুসারে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আর রেলপথের ক্ষেত্রে শহরের চারপাশে একটি বৃত্তাকার রেল রুট নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী, ৮১ দশমিক ৯ কিমি বৃত্তাকার ট্রেন নেটওয়ার্ক উন্নত রাস্তা এবং দুই লাইনবিশিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড গেজ থাকবে। বৃত্তাকার রুটে ২০টি স্টেশন থাকবে : টঙ্গী, তেরমুখ, পূর্বাচল সড়ক, বেরাইদ, কায়েতপাড়া, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, চৌধুরীবাড়ী, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, শ্যামপুর, সদরঘাট, বাবুবাজার, নবাবগঞ্জ, শংকর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা, বিরুলিয়া, উত্তরা ও ধৌড়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ট্রেনটি ক্রমাগত উভয় পাশে চলাচল করবে।
দেশ রূপান্তর : জনবহুল ঢাকা মহানগরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় কী আছে?
সাঈদ নূর আলম : এ পরিকল্পনার আওতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিক্ষা খাতের উন্নয়ন। এ কারণে প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় সরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব জনসংখ্যার ঘনত্ব অনুসারে বণ্টন করা হয়েছে যাতে সব জনগোষ্ঠী শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা পায়। সেই সঙ্গে জনসংখ্যার স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা পূরণেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ উদ্দেশে অধ্যয়ন এলাকার ৭৪টি উপ-অঞ্চলে বর্তমানে বিদ্যমান হাসপাতালের পরিমাণ নির্ণয় করে ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার ছাত্রছাত্রীদের বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যও একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকবে এই পরিকল্পনায়।
দেশ রূপান্তর : বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় অনুমোদনবিহীন ইমারত বৈধকরণের বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
সাঈদ নূর আলম : ঢাকা মহানগরীর বিপুলসংখ্যক স্থাপনা/ইমারত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া বা অনুমোদন গ্রহণ সত্ত্বেও অনুমোদনের শর্তাবলি লঙ্ঘন করে নির্মিত হয়েছে। এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তিবর্গের আইনভঙ্গের প্রবণতা, জনসচেতনতার অভাব, মনিটরিংয়ের অভাব, কিংবা মহাপরিকল্পনা ও বিধিবিধানের ত্রুটি-বিচ্যুতি। এবারের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার অধীনে ভৌত জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় যে অত্র এলাকায় বিদ্যমান সর্বমোট স্থাপনার সংখ্যা ২১ লাখের ওপরে। ডেটাবেইজ ও রাজউকের স্থাপনা নকশা অনুমোদন তথ্য-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর মাত্র ৪ দশমিক ৬৪ ভাগ স্থাপনা রাজউক থেকে অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে নির্মিত হয়েছে। বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন (বিসি) আইন, ১৯৫২ এর বিধান অনুযায়ী অনুমোদনবিহীন/ব্যত্যয়কৃত ইমারতকে বৈধকরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, বর্তমানে নতুন ভবনের নির্মাণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮ এর যেসব বিধি/শর্ত অনুসরণ করা হয়, ওই একই বিধি বা শর্ত অনুযায়ী অনুমোদনহীন/ব্যত্যয়কৃত ইমারতে প্রয়োজনীয় সংশোধন বা পরিবর্তন সাধন করা হলেই কেবল অনুমোদনবিহীন ইমারতকে বৈধতা দেওয়া হবে।