দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান
মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম
মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তার জন্ম চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে। অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত চার বছর মিয়ানমারে বাংলাদেশ সরকারের কনস্যুলেট প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যোগ দেন এবং বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতিসংঘ ফোর্স কমান্ডারের সর্বোচ্চ প্রশংসাপত্র পান। সম্প্রতি তার লেখা ‘রোহিঙ্গা : নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী’ (প্রথমা প্রকাশন) এবং ‘শেষ সীমান্তের পর কোথায় যাব আমরা’ (খড়িমাটি প্রকাশনী) শিরোনামে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন সম্ভাবনার নানা দিক নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : মিয়ানমারে গত পহেলা ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে দেশটিতে টানা কয়েকদিন ধরে জনতার বিক্ষোভ চলছে। মঙ্গলবার রাজধানী নেপিডোতে জনতার বিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে দেশটির পুলিশ। ইয়াঙ্গুনেও ব্যাপক বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান কার্যালয়েও অভিযান চালিয়েছে দেশটির সামরিক জান্তা। মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : এমনটা হয়ে থাকে। কারণ একটা রাজনৈতিক দল নির্বাচনে বড় ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়েছে। তারা সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। রাজধানী নেপিডোতে যেদিন তাদের পার্লামেন্টে শপথ নেওয়ার কথা তার আগের রাতেই অং সান সু চি’সহ শীর্ষ নেতাদের আটক করা, পার্লামেন্ট বসতে না দেওয়া, সরকার ভেঙে দেওয়া, এক বছরের জন্য সামরিক শাসন জারি করা এসব কিছুর প্রতিবাদেই কিন্তু মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। সেখানে একটা গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য অনেক দিন ধরেই আন্দোলন চলছিল। গত নির্বাচনকে ঘিরেও নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে পরিশ্রম করেছেন, সাধারণ মানুষেরও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। চলমান বিক্ষোভ সে ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে, সেখানকার পূর্বাপর পরিস্থিতি আমলে নিয়ে আমার মনে হয় না যে, এ ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে সামরিক জান্তাকে তারা সহজে হটাতে পারবে।
দেশ রূপান্তর : আমরা জানি, মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলকারী সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিন অং হ্লাইং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকান্ডের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অভিযুক্ত। তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাও আছে। এদিকে, সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সোমবার জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে তিনি বলেছেন ‘বাংলাদেশে থাকা মিয়ানমারের নাগরিকদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ফেরত নেওয়া হবে।’ তবে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাম তিনি উল্লেখ করেননি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার এই আশ্বাসকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের এই বক্তব্যকে আমি অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কেননা, ক্ষমতাগ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণেই মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বিশ^বাসীকে এই বার্তাটি দিতে চান। তিনি যদি এই ভাষণে বিষয়টির উল্লেখ না করতেন বা এড়িয়ে যেতেন তাহলে মনে করতাম যে, রোহিঙ্গা সংকট নিরসন হয়তো আরও দীর্ঘ একটা অচলাবস্থার মধ্যে পতিত হচ্ছে। তিনি নিজে থেকে নিজের ভাষণে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ায় মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একটা ইতিবাচক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বক্তব্যের সূত্র ধরে আরেকটি বিষয় জানতে চাচ্ছি। জেনারেল মিন অং হ্লাইং যেমন তার বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়টি উল্লেখ না করে কেবল ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ বলছেন তেমনি আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি যে দেশটির সব সরকার এমনকি সরকার সমর্থক গণমাধ্যমও রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সময়ে ‘বাঙালি’ কিংবা ‘বাংলাদেশি’ কিংবা কেবল ‘মুসলিম জনগোষ্ঠী’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রোহিঙ্গাদের ‘মুসলিম রোহিঙ্গা’ কিংবা ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’ হিসেবে উল্লেখ করছে। রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় আড়াল করার এই ‘পরিচয়ের রাজনীতি’র নেপথ্য কারণটি কী বলে আপনার মনে হয়?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : এই রাজনীতিটা শুরু করেছিলেন মিয়ানমারের সাবেক সামরিক প্রধান জেনারেল নে উইন। ১৯৬২ সালে যখন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন মিয়ানমারের বহুধাবিভক্ত জাতিসত্তার জাতিগত পরিচয়ের রাজনীতিটা তিনি উসকে দেন। সাংবিধানিকভাবেই মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিসত্তার স্বীকৃতি আছে মিয়ানমারে। একটা রাষ্ট্রের মধ্যে এতগুলো জাতিসত্তাকে একটা ইউনিফায়েড বা ঐক্যবদ্ধ পরিচয়ের মধ্যে আনতে হলে কিছু ফ্যানাটিসিজম বা উগ্রপন্থা সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন জেনারেল নে উইন। সেটার বড় শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা। কারণ তারা নৃতাত্ত্বিকভাবে যেমন দেশটির অন্য জাতিগোষ্ঠী থেকে আলাদা তেমনি ধর্মীয় পরিচয়েও তারা স্বতন্ত্র বা আলাদা। মিয়ানমারে বামার থেকে শুরু করে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কারেনরা খ্রিস্টান। তখন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একটা ধর্মীয় ঘৃণা ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে মিয়ানমারের অন্য সব জাতিগোষ্ঠী বামার, কারেন, কাচিন, মগ, কাইয়া, মং সবাইকে একটা অবস্থানে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সেখান থেকেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকট আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ জন্যই মিয়ানমারের অন্য সব জাতিরা এটা বলতে চায় যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি বা বাঙালি। খেয়াল করা দরকার যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের যে পরিচয়পত্র দিয়েছে সেখানে জাতীয়তার ক্ষেত্রে লেখা ‘বাঙালি মুসলমান’। কিন্তু ‘বাঙালি মুসলমান’ বলে কোনো জাতীয়তা থাকতে পারে না। একজন বাঙালির ধর্ম ইসলাম হতে পারে, কিন্তু তার জাতীয়তা বাঙালি।
তাই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি যে কেবল জেনারেল মিন অং হ্লাইং ব্যবহার করছেন না তা নয়। মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই এই নীতি অনুসরণ করছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে যখন জাতিসংঘের ‘কফি আনান কমিশন’ কাজ করছিল, তখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের আগে অং সান সু চি’র সঙ্গে কফি আনানের যে বৈঠক হয় সেখানে সু চি’র পক্ষ থেকে একটা শর্ত ছিল যে এই প্রতিবেদনের কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি লেখা যাবে না। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয়েছিল আনান কমিশন লিখবে ‘রাখাইন অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী’।
দেশ রূপান্তর : আবার মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের কথায় ফিরে যাই। তিনি ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তি’র অধীনে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। আমরা দেখছি বাংলাদেশ সরকারও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়েই জোর দিয়ে আসছে। কিন্তু জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীগুলো বরাবরই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বহুপক্ষীয় উদ্যোগের প্রতি জোর দিয়ে আসছে এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কারণে বাংলাদেশের সমালোচনা করছে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি এই দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় উদ্যোগের বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : বহুপক্ষীয় উদ্যোগ কথাটা উপহাসযোগ্য। জাতিসংঘ নিজেই তো একটা বহুপক্ষীয় প্ল্যাটফরম। অথচ জাতিসংঘ আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটা প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারল না। চীন ও রাশিয়ার ভেটোতে যে সেটা করা যাচ্ছে না, সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে বহুপক্ষীয় উদ্যোগের কথা বলা মানে মানুষের সঙ্গে তামাশা করা। নিরাপত্তা পরিষদের বারংবার ব্যর্থতার কারণে প্রস্তাবটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যায়। সেখানে ১৩৬টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। কিন্তু তাতে কি দুই চারজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো গেছে? পশ্চিমা বিশ্ব কিছুই করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
এক মাস দুই মাস না তিন বছর পেরিয়ে গেছে। বিশে^র সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হয়েও বাংলাদেশ সাড়ে এগারো লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণ-চিকিৎসাসহ সব ধরনের দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ পালন করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ বা পশ্চিমা বিশ্ব কতটা সাহায্য করেছে? আজ সিরিয়া বা লিবিয়ার অল্প কিছু শরণার্থী নিয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়ন হিমশিম খাচ্ছে। আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিয়ে পুনর্বাসনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে পশ্চিমা বিশ্ব নয় মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতাতেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে বলে আমি মনে করি।
আর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং যে এখন ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তি’র কথা বলেছেন, সেখানেও চীনের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করি। মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ব্যাপক। চীন কখনোই চায়নি যে বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের বহুপক্ষীয় কোনো চুক্তি হোক। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের একটা সমঝোতার জন্য দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে চীনের এই ভূমিকার প্রতিফলন দেখা যায়। সর্বশেষ চীনের মধ্যস্থতায় গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকা-নেপিডো-বেইজিং উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র সচিব এই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। এই বৈঠকে সব পক্ষই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং পুনর্বাসনের বিষয়ে করণীয় সব কিছু করতে নীতিগতভাবে একমত হয়। বর্তমান সামরিক সরকারের প্রধানও সেই ধারাবাহিকতাতেই কথা বলেছেন। বিগত সময়ে আশি এবং নব্বই দশকে মিয়ানমারে সামরিক শাসনামলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টা বিবেচনায় নিলেও আশা করা যায় যে, বর্তমান সামরিক সরকারও সেই পথে হাঁটতে পারে।
দেশ রূপান্তর : ওআইসি বা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার উদ্যোগে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার করা মামলার অগ্রগতি বিষয়ে এখন কী করণীয় বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে একটা দেশের বিচার করতে পারে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কোনো ব্যক্তির এ ধরনের অপরাধের বিচারে কাজ করে। মিয়ানমার আইসিজে-এর স্বাক্ষরকারী না হলেও বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষরকারী দেশ। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হিসেবে এই বিচার পাওয়ার দাবিদার। এখন দেখুন গাম্বিয়া একটি গরিব দেশ হিসেবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই মামলা করলেও এই মামলা চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু পশ্চিমারা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এত কথা বললেও এই মামলার অর্থ জোগান দেওয়ার বিষয়েও নিশ্চুপ।
সাড়ে এগারো লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে এই মানবেতর জীবন থেকে উদ্ধার করতে পশ্চিমা বিশ^ এখানেও এগিয়ে আসতে পারত। আজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অস্ত্রের পেছনে খরচ করে। ফ্রান্স যে ভারতের কাছে রাফায়েল যুদ্ধ বিমান বিক্রি করছে; একটা রাফায়েলের বিক্রয়মূল্যের দশ ভাগের এক ভাগও লাগবে না আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা চালাতে। আমেরিকার ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলোর একটা মিসাইলের একশ ভাগের এক ভাগও লাগবে না অসহায় রোহিঙ্গাদের সংকট নিরসনে মামলা চালাতে। তারা তো এগিয়ে আসছে না। বরং প্রশ্ন উঠতে পারে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নানা যুদ্ধের ভূমিকা নিয়েই। তাদের বিরুদ্ধেই তো এমন বহু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে। সেগুলোরও তো কোনো বিচার হচ্ছে না। ফলে পশ্চিমাদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। তার জন্ম চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে। অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত চার বছর মিয়ানমারে বাংলাদেশ সরকারের কনস্যুলেট প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে যোগ দেন এবং বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য জাতিসংঘ ফোর্স কমান্ডারের সর্বোচ্চ প্রশংসাপত্র পান। সম্প্রতি তার লেখা ‘রোহিঙ্গা : নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী’ (প্রথমা প্রকাশন) এবং ‘শেষ সীমান্তের পর কোথায় যাব আমরা’ (খড়িমাটি প্রকাশনী) শিরোনামে দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন সম্ভাবনার নানা দিক নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : মিয়ানমারে গত পহেলা ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে দেশটিতে টানা কয়েকদিন ধরে জনতার বিক্ষোভ চলছে। মঙ্গলবার রাজধানী নেপিডোতে জনতার বিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে দেশটির পুলিশ। ইয়াঙ্গুনেও ব্যাপক বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান কার্যালয়েও অভিযান চালিয়েছে দেশটির সামরিক জান্তা। মিয়ানমারের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : এমনটা হয়ে থাকে। কারণ একটা রাজনৈতিক দল নির্বাচনে বড় ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়েছে। তারা সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। রাজধানী নেপিডোতে যেদিন তাদের পার্লামেন্টে শপথ নেওয়ার কথা তার আগের রাতেই অং সান সু চি’সহ শীর্ষ নেতাদের আটক করা, পার্লামেন্ট বসতে না দেওয়া, সরকার ভেঙে দেওয়া, এক বছরের জন্য সামরিক শাসন জারি করা এসব কিছুর প্রতিবাদেই কিন্তু মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। সেখানে একটা গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য অনেক দিন ধরেই আন্দোলন চলছিল। গত নির্বাচনকে ঘিরেও নেতাকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে পরিশ্রম করেছেন, সাধারণ মানুষেরও প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। ফলে স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। চলমান বিক্ষোভ সে ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ। তবে, সেখানকার পূর্বাপর পরিস্থিতি আমলে নিয়ে আমার মনে হয় না যে, এ ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে সামরিক জান্তাকে তারা সহজে হটাতে পারবে।
দেশ রূপান্তর : আমরা জানি, মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলকারী সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিন অং হ্লাইং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকান্ডের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অভিযুক্ত। তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাও আছে। এদিকে, সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সোমবার জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে তিনি বলেছেন ‘বাংলাদেশে থাকা মিয়ানমারের নাগরিকদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ফেরত নেওয়া হবে।’ তবে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাম তিনি উল্লেখ করেননি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার এই আশ্বাসকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের এই বক্তব্যকে আমি অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। কেননা, ক্ষমতাগ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণেই মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, তিনি বিশ^বাসীকে এই বার্তাটি দিতে চান। তিনি যদি এই ভাষণে বিষয়টির উল্লেখ না করতেন বা এড়িয়ে যেতেন তাহলে মনে করতাম যে, রোহিঙ্গা সংকট নিরসন হয়তো আরও দীর্ঘ একটা অচলাবস্থার মধ্যে পতিত হচ্ছে। তিনি নিজে থেকে নিজের ভাষণে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ায় মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে একটা ইতিবাচক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বক্তব্যের সূত্র ধরে আরেকটি বিষয় জানতে চাচ্ছি। জেনারেল মিন অং হ্লাইং যেমন তার বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়টি উল্লেখ না করে কেবল ‘মিয়ানমারের নাগরিক’ বলছেন তেমনি আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি যে দেশটির সব সরকার এমনকি সরকার সমর্থক গণমাধ্যমও রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সময়ে ‘বাঙালি’ কিংবা ‘বাংলাদেশি’ কিংবা কেবল ‘মুসলিম জনগোষ্ঠী’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রোহিঙ্গাদের ‘মুসলিম রোহিঙ্গা’ কিংবা ‘রোহিঙ্গা মুসলিম’ হিসেবে উল্লেখ করছে। রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় আড়াল করার এই ‘পরিচয়ের রাজনীতি’র নেপথ্য কারণটি কী বলে আপনার মনে হয়?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : এই রাজনীতিটা শুরু করেছিলেন মিয়ানমারের সাবেক সামরিক প্রধান জেনারেল নে উইন। ১৯৬২ সালে যখন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন মিয়ানমারের বহুধাবিভক্ত জাতিসত্তার জাতিগত পরিচয়ের রাজনীতিটা তিনি উসকে দেন। সাংবিধানিকভাবেই মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিসত্তার স্বীকৃতি আছে মিয়ানমারে। একটা রাষ্ট্রের মধ্যে এতগুলো জাতিসত্তাকে একটা ইউনিফায়েড বা ঐক্যবদ্ধ পরিচয়ের মধ্যে আনতে হলে কিছু ফ্যানাটিসিজম বা উগ্রপন্থা সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন জেনারেল নে উইন। সেটার বড় শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা। কারণ তারা নৃতাত্ত্বিকভাবে যেমন দেশটির অন্য জাতিগোষ্ঠী থেকে আলাদা তেমনি ধর্মীয় পরিচয়েও তারা স্বতন্ত্র বা আলাদা। মিয়ানমারে বামার থেকে শুরু করে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। কারেনরা খ্রিস্টান। তখন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একটা ধর্মীয় ঘৃণা ও জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে মিয়ানমারের অন্য সব জাতিগোষ্ঠী বামার, কারেন, কাচিন, মগ, কাইয়া, মং সবাইকে একটা অবস্থানে আনার চেষ্টা করেছিলেন। সেখান থেকেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকট আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ জন্যই মিয়ানমারের অন্য সব জাতিরা এটা বলতে চায় যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি বা বাঙালি। খেয়াল করা দরকার যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের যে পরিচয়পত্র দিয়েছে সেখানে জাতীয়তার ক্ষেত্রে লেখা ‘বাঙালি মুসলমান’। কিন্তু ‘বাঙালি মুসলমান’ বলে কোনো জাতীয়তা থাকতে পারে না। একজন বাঙালির ধর্ম ইসলাম হতে পারে, কিন্তু তার জাতীয়তা বাঙালি।
তাই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি যে কেবল জেনারেল মিন অং হ্লাইং ব্যবহার করছেন না তা নয়। মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই এই নীতি অনুসরণ করছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে যখন জাতিসংঘের ‘কফি আনান কমিশন’ কাজ করছিল, তখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের আগে অং সান সু চি’র সঙ্গে কফি আনানের যে বৈঠক হয় সেখানে সু চি’র পক্ষ থেকে একটা শর্ত ছিল যে এই প্রতিবেদনের কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি লেখা যাবে না। অনেক আলাপ-আলোচনার পর ঠিক হয়েছিল আনান কমিশন লিখবে ‘রাখাইন অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী’।
দেশ রূপান্তর : আবার মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের কথায় ফিরে যাই। তিনি ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তি’র অধীনে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন। আমরা দেখছি বাংলাদেশ সরকারও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়েই জোর দিয়ে আসছে। কিন্তু জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠীগুলো বরাবরই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বহুপক্ষীয় উদ্যোগের প্রতি জোর দিয়ে আসছে এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির কারণে বাংলাদেশের সমালোচনা করছে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি এই দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় উদ্যোগের বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : বহুপক্ষীয় উদ্যোগ কথাটা উপহাসযোগ্য। জাতিসংঘ নিজেই তো একটা বহুপক্ষীয় প্ল্যাটফরম। অথচ জাতিসংঘ আজ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটা প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারল না। চীন ও রাশিয়ার ভেটোতে যে সেটা করা যাচ্ছে না, সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে বহুপক্ষীয় উদ্যোগের কথা বলা মানে মানুষের সঙ্গে তামাশা করা। নিরাপত্তা পরিষদের বারংবার ব্যর্থতার কারণে প্রস্তাবটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যায়। সেখানে ১৩৬টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। কিন্তু তাতে কি দুই চারজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো গেছে? পশ্চিমা বিশ্ব কিছুই করতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও কিছু করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।
এক মাস দুই মাস না তিন বছর পেরিয়ে গেছে। বিশে^র সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হয়েও বাংলাদেশ সাড়ে এগারো লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণ-চিকিৎসাসহ সব ধরনের দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ পালন করে যাচ্ছে। জাতিসংঘ বা পশ্চিমা বিশ্ব কতটা সাহায্য করেছে? আজ সিরিয়া বা লিবিয়ার অল্প কিছু শরণার্থী নিয়েই ইউরোপীয় ইউনিয়ন হিমশিম খাচ্ছে। আমেরিকা বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিয়ে পুনর্বাসনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে পশ্চিমা বিশ্ব নয় মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতাতেই রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে বলে আমি মনে করি।
আর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং যে এখন ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তি’র কথা বলেছেন, সেখানেও চীনের একটা ভূমিকা আছে বলে মনে করি। মিয়ানমারে চীনের প্রভাব ব্যাপক। চীন কখনোই চায়নি যে বাংলাদেশের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের বহুপক্ষীয় কোনো চুক্তি হোক। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের একটা সমঝোতার জন্য দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে চীনের এই ভূমিকার প্রতিফলন দেখা যায়। সর্বশেষ চীনের মধ্যস্থতায় গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকা-নেপিডো-বেইজিং উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র সচিব এই বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। এই বৈঠকে সব পক্ষই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং পুনর্বাসনের বিষয়ে করণীয় সব কিছু করতে নীতিগতভাবে একমত হয়। বর্তমান সামরিক সরকারের প্রধানও সেই ধারাবাহিকতাতেই কথা বলেছেন। বিগত সময়ে আশি এবং নব্বই দশকে মিয়ানমারে সামরিক শাসনামলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টা বিবেচনায় নিলেও আশা করা যায় যে, বর্তমান সামরিক সরকারও সেই পথে হাঁটতে পারে।
দেশ রূপান্তর : ওআইসি বা ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার উদ্যোগে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার করা মামলার অগ্রগতি বিষয়ে এখন কী করণীয় বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম : আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে একটা দেশের বিচার করতে পারে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কোনো ব্যক্তির এ ধরনের অপরাধের বিচারে কাজ করে। মিয়ানমার আইসিজে-এর স্বাক্ষরকারী না হলেও বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষরকারী দেশ। রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হিসেবে এই বিচার পাওয়ার দাবিদার। এখন দেখুন গাম্বিয়া একটি গরিব দেশ হিসেবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই মামলা করলেও এই মামলা চালানোর মতো আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু পশ্চিমারা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এত কথা বললেও এই মামলার অর্থ জোগান দেওয়ার বিষয়েও নিশ্চুপ।
সাড়ে এগারো লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে এই মানবেতর জীবন থেকে উদ্ধার করতে পশ্চিমা বিশ^ এখানেও এগিয়ে আসতে পারত। আজ ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অস্ত্রের পেছনে খরচ করে। ফ্রান্স যে ভারতের কাছে রাফায়েল যুদ্ধ বিমান বিক্রি করছে; একটা রাফায়েলের বিক্রয়মূল্যের দশ ভাগের এক ভাগও লাগবে না আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলা চালাতে। আমেরিকার ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলোর একটা মিসাইলের একশ ভাগের এক ভাগও লাগবে না অসহায় রোহিঙ্গাদের সংকট নিরসনে মামলা চালাতে। তারা তো এগিয়ে আসছে না। বরং প্রশ্ন উঠতে পারে ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের নানা যুদ্ধের ভূমিকা নিয়েই। তাদের বিরুদ্ধেই তো এমন বহু যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে। সেগুলোরও তো কোনো বিচার হচ্ছে না। ফলে পশ্চিমাদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই।