মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডি
মো. এনামুল হক
মো. এনামুল হক আত্মনিবেদিত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাকা নারায়ণপুর পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৮১ সালে একই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রমোশন অফিসার হিসেবে পেশা জীবন শুরু করে ২০১৮ সালে সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মো. এনামুল হকের প্রকাশিত বই : চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ (অনুপম প্রকাশনী, ২০১৩), প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজশাহী বিভাগ (অনুপম প্রকাশনী, ২০১৫), রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ (অনুপম প্রকাশনী, ২০১৬), একাত্তরে গণহত্যা-বৃহত্তর রাজশাহী জেলা (কথাপ্রকাশ, ২০২০), বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ (অনুপম প্রকাশনী, ২০২১)। কৈশোরে চাক্ষুষ করা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, নিজের আত্মীয়স্বজন ও সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্মম নির্যাতনের মর্মবেদনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় উৎসাহিত হন মো. এনামুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় আপনি অঞ্চলভিত্তিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম আর পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের নিপীড়ন-নির্যাতন ও নির্মম গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় আপনার শুরুটা কীভাবে হলো?
মো. এনামুল হক : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক দিন ধরে বিকৃত হয়েছে। এখন পঞ্চাশ বছর পেরুতে চলল। আমরা সঠিকভাবে সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে পারিনি। বাঙালি জাতির জীবনের মহত্তম এই সংগ্রামের ইতিহাস যথাযথভাবে নথিবদ্ধ করতে না পারাটা যেমন মর্মবেদনার তেমনি আমাদের জন্য লজ্জারও বটে। আমি ভাবলাম একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে পারব না আমার সেই যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা কিংবা শিক্ষা-প্রশিক্ষণও নেই। তখন আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি আমার জেলা এবং আশপাশের জেলাগুলোর ইতিহাসের বিস্তারিত তুলে আনতে পারি, তাহলে একসময় এগুলো মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করবেন তাদের জন্য কাজে লাগবে। এই চিন্তা থেকেই আমি কাজ শুরু করি। অনেক বিদগ্ধজনও আমার বইগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে বলেছেন। কিন্তু আমি নিজে বলি না। আমি বলি এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপাদান তথ্য-উপাত্ত। আমার মনে হয়েছিল এখনই যদি মাঠপর্যায়ে সরেজমিন অনুসন্ধান না করি, একেকটা জেলা বা উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ না করি, তাহলে একসময় প্রত্যক্ষদর্শী আর তথ্যপ্রমাণের অভাবে কাজটা জটিল ও দুরূহ হয়ে যাবে। মূলত সেই তাগিদ থেকেই আমি মাঠপর্যায়ে গবেষণা আর সেসব লিপিবদ্ধ করার কাজে শুরু করি।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা এবং ইতিহাস রচনায় আপনার মনোযোগ নিবদ্ধ বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে। আপনার বইগুলোতে কি আপনি কেবল মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ, প্রতিরোধ সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধ এবং নির্যাতন-নিপীড়ন গণহত্যার ঘটনাগুলোই লিপিবদ্ধ করেছেন না আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ও এসেছে?
মো. এনামুল হক : মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ মূল কেন্দ্রে থাকলেও আমি এক্ষেত্রে যুদ্ধের পটভূমিসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে যুক্ত করতে চেয়েছি। যেমন ধরুন ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে আমার লেখা ‘রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি। এতে রাজশাহীর জেলা পরিচিতি, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রাজশাহী অর্থাৎ সাতচল্লিশের ভারত বিভাগ থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত রাজশাহীর আন্দোলন-সংগ্রামের একটা ইতিহাসও যুক্ত করেছি। কেননা জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকা থাকলেও রাজশাহীসহ সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল আর সেখানকার জনগণ নানাভাবে এই সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছে। সেসব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। অসহযোগ আন্দোলনে রাজশাহী শিরোনামের লেখায় একাত্তরের ১ থেকে ২৫ মার্চে রাজশাহীর ঘটনাপ্রবাহ এখানে লিপিবদ্ধ করেছি। এরপর প্রতিরোধযুদ্ধে রাজশাহী বিভাগ অধ্যায়ে ২৬ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। এই বইয়ে নাম, পিতার নাম ও গ্রামসহ রাজশাহীর মোট ৯৮৯ জন শহীদের পরিচিতি রয়েছে। একইভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধে শহীদ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ও পরিচিতি রয়েছে। এভাবে নানা পর্বে ভাগ করে একাত্তরের পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাই এখানে লেখার চেষ্টা করেছি। আমার সবগুলো বইয়েই আমি এভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছি।
দেশ রূপান্তর : রাজশাহী বিভাগ অনেক বড় একটা অঞ্চল। এর মধ্যে অনেকগুলো জেলা-উপজেলা আর শত শত গ্রাম। এ ধরনের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার জন্য মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন অনুসন্ধান প্রয়োজন, প্রয়োজন বিস্তারিত গবেষণার। এই কাজ করতে গিয়ে আপনি কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলেন? একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে এই কাজ সম্ভব করলেন কীভাবে?
মো. এনামুল হক : আসলে মাঠ পর্যায়ে এ ধরনের গবেষণার কাজ একটা নেশার মতো। ইতিহাস অনুসন্ধানের সেই নেশায় মত্ত না হলে এটা করা সম্ভব না। সরকারি চাকুরে হিসেবে আমি পাঁচদিন কাজ করতাম আর দুদিন ছুটি পেতাম। বছরের পর বছর সপ্তাহের এই দুটো ছুটির দিন আমি এসব কাজে ব্যয় করেছি। আমি প্রথম কাজ শুরু করলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তরুণ বয়স থেকেই আমি মোটরসাইকেল চালাতাম। এটা আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন মোবাইল ফোন তো ছিলই না, যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক নাজুক ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছয়টা উপজেলার এমন কোনো ইউনিয়ন নেই যেখানে আমি যাইনি। তথ্য সংগ্রহ করেছি, প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি নিয়েছি, লড়াই-সংগ্রাম আর গণহত্যার গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো স্থানে গিয়েছি, সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প কোথায় ছিল, রাজাকাররা কোথায় ক্যাম্প করেছে, হানাদার বাহিনী কোথায় ক্যাম্প করেছে, কোথায় কোথায় সম্মুখ লড়াই হয়েছে সেইসব জায়গায় নিজে গিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছি। এখানে একটা কথা বলে রাখি। যেসব জায়গায় গণহত্যা হয়েছে প্রায় সবক্ষেত্রেই কিন্তু আপনি একজন-দুজনকে পাবেন যারা কোনো না কোনোভাবে ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মরার ভান করে পরে থেকে বেঁচেছে, কেউ দৈবক্রমে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে। এমন অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। আর যারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন তাদের জীবিত আত্মীয় স্ত্রী, ভাইবোন, বাবা-মা কিংবা সন্তানের সঙ্গে কথা বলেছি।
এই কাজের আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বা নির্যাতিত ব্যক্তি যখন কথা বলেন, তিনি হয়তো সত্য কথাই বলছেন; কিন্তু দেখা গেল স্মৃতি তাকে বিভ্রান্ত করছে। ফলে ঘটনাগুলো বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটা ঘটনা আর সাক্ষ্যপ্রমাণকে নানা আঙ্গিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আরও অনেক জনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে ঘটনাটিকে মিলিয়ে নিতে হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে গবেষণার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা সম্ভব না।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আপনার একটা অপ্রকাশিত পা-ুলিপি রয়েছে ‘একাত্তরে গণহত্যা : বৃহত্তর পাবনা জেলা’ শিরোনামে। এই বইটি সম্পর্কে জানতে চাই। বইটি এখনো প্রকাশ করা যায়নি কেন?
মো. এনামুল হক : ‘একাত্তরে গণহত্যা : বৃহত্তর পাবনা জেলা’ বইটিতে পাবনা জেলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলায় যতগুলো গণহত্যা হয়েছে সবগুলোর বর্ণনা আছে। এমনকি যে গণহত্যার কারণে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি হয়েছে তারও বিবরণ আছে এই বইয়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ আছে। শহীদদের আত্মীয়দের বিবরণ আছে। আসলে এই ধরনের বই প্রকাশ করা খুব কঠিন। আঞ্চলিক ইতিহাস বলে অন্য জেলার লোকদের কাছে চাহিদা নেই। আর প্রকাশকরা এমন বই প্রকাশে বিনিয়োগ করতে চান না।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ইতিমধ্যেই আপনার চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আরও একটি বইয়ের পান্ডুলিপি এখন প্রকাশের অপেক্ষায়। এছাড়া আপনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়েও কাজ করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আপনার ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ’ বইটির বিষয়ে জানতে চাই।
মো. এনামুল হক : পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা এবং তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যার ঘটনাকে আমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করি। দুঃখজনক বিষয় হলো পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডির পর দেশে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল সেটা এদেশের অনেকেই সঠিকভাবে জানেন না। জানতে দেওয়া হয়নি। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ করতে আগ্রহী হই।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে দুটো সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়েছিল। একটি টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে, আরেকটি চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বে।
আপনারা জানেন, একাত্তরে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলে ‘কাদেরীয়া বাহিনী’ নামে একটা স্থানীয় বাহিনী দেশের ভেতরে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সামরিক বাহিনীর বাইরে কাদের সিদ্দিকীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একাত্তরে বীরোচিত ভূমিকার জন্য ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে তখন কাদেরীয়া বাহিনীতে প্রায় ১৭ হাজার যোদ্ধা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য বাহিনী গঠন এবং ভারতীয় ভূখ- ব্যবহার করার বিষয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তা প্রার্থনা করেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীকে ইতিবাচক সম্মতি দিয়েছিলেন। জামালপুরের কামালপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের অভ্যন্তরে তিনি ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং দেশের ভেতরে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষজন আর তরুণদের তিনি সংগঠিত করেন। লালমনিরহাট থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জের সীমান্ত পর্যন্ত অনেকগুলো ক্যাম্প করেছিলেন তারা। অনেকে আরও বেশি দাবি করলেও আমার গবেষণায় আমি দেখেছি যে, ছয় থেকে সাত হাজার মানুষের একটা বাহিনী কাদের সিদ্দিকী তৈরি করতে পেরেছিলেন। তারা নাম দিয়েছিলেন‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। সীমান্ত এলাকায় হামলা আর দেশের ভেতরের নাশকতা ছাড়াও খন্দকার মুশতাককে হত্যার জন্যও তিন জনের একটা স্কোয়াড পাঠিয়েছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তবে ওই তিনজন ধরা পড়েছিলেন এবং নানা ঘটনায় এই বাহিনীর প্রায় শ’খানেক যোদ্ধা শহীদও হয়েছিলেন।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী ভারতের আগরতলায় অবস্থান নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করে নাম দিয়েছিলেন ‘জাতীয় মুজিব বাহিনী’। তাদের তৎপরতা চট্টগ্রাম এলাকাতে সীমিত ছিল।
কিন্তু এই সময় ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের পতন হয়। সাতাত্তরের মার্চে ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় আসেন। ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন সামরিক সরকারের একটা সমঝোতা হলে ভারত তাদের ভূখন্ডে অবস্থান নেওয়া এই দুটো বাহিনীর সবাইকে ধরে ধরে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। এতে এই বাহিনীগুলোর সদস্যরা চরম বিপর্যয়ে পড়েন। একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ ও ‘জাতীয় মুজিব বাহিনী’র যোদ্ধারা জেল-জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে পড়েন। মহিউদ্দীন চৌধুরী কলকাতায় আত্মগোপনে চলে যান। আর কাদের সিদ্দিকী ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আপনার উপলব্ধি কী হলো সেটা সংক্ষেপে শুনতে চাই।
মো. এনামুল হক : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশের মানুষ যে সীমাহীন আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, যে অমানুষিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যে কষ্ট-দুর্ভোগ সহ্য করেছেন সেটা ভাষায় বর্ণনার অতীত। আর মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে জীবনকে তুচ্ছ করে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করবার জন্য লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা হয় না। এজন্য জাতির কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই সম্মান প্রাপ্য। তবে, সবচেয়ে বড় কথা হলো জাতির জীবনের এই মহত্তম সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার কাজটি শেষ করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। এজন্য সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার কাজ খুবই জরুরি।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

মো. এনামুল হক আত্মনিবেদিত মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাকা নারায়ণপুর পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৭৬ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। ১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং ১৯৮১ সালে একই বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রমোশন অফিসার হিসেবে পেশা জীবন শুরু করে ২০১৮ সালে সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মো. এনামুল হকের প্রকাশিত বই : চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ (অনুপম প্রকাশনী, ২০১৩), প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজশাহী বিভাগ (অনুপম প্রকাশনী, ২০১৫), রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ (অনুপম প্রকাশনী, ২০১৬), একাত্তরে গণহত্যা-বৃহত্তর রাজশাহী জেলা (কথাপ্রকাশ, ২০২০), বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ (অনুপম প্রকাশনী, ২০২১)। কৈশোরে চাক্ষুষ করা মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, নিজের আত্মীয়স্বজন ও সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরদের নির্মম নির্যাতনের মর্মবেদনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় উৎসাহিত হন মো. এনামুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় আপনি অঞ্চলভিত্তিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম আর পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের নিপীড়ন-নির্যাতন ও নির্মম গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় আপনার শুরুটা কীভাবে হলো?
মো. এনামুল হক : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অনেক দিন ধরে বিকৃত হয়েছে। এখন পঞ্চাশ বছর পেরুতে চলল। আমরা সঠিকভাবে সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে পারিনি। বাঙালি জাতির জীবনের মহত্তম এই সংগ্রামের ইতিহাস যথাযথভাবে নথিবদ্ধ করতে না পারাটা যেমন মর্মবেদনার তেমনি আমাদের জন্য লজ্জারও বটে। আমি ভাবলাম একজন ব্যক্তি হিসেবে আমি সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে পারব না আমার সেই যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা কিংবা শিক্ষা-প্রশিক্ষণও নেই। তখন আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি আমার জেলা এবং আশপাশের জেলাগুলোর ইতিহাসের বিস্তারিত তুলে আনতে পারি, তাহলে একসময় এগুলো মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এবং যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করবেন তাদের জন্য কাজে লাগবে। এই চিন্তা থেকেই আমি কাজ শুরু করি। অনেক বিদগ্ধজনও আমার বইগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে বলেছেন। কিন্তু আমি নিজে বলি না। আমি বলি এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপাদান তথ্য-উপাত্ত। আমার মনে হয়েছিল এখনই যদি মাঠপর্যায়ে সরেজমিন অনুসন্ধান না করি, একেকটা জেলা বা উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ না করি, তাহলে একসময় প্রত্যক্ষদর্শী আর তথ্যপ্রমাণের অভাবে কাজটা জটিল ও দুরূহ হয়ে যাবে। মূলত সেই তাগিদ থেকেই আমি মাঠপর্যায়ে গবেষণা আর সেসব লিপিবদ্ধ করার কাজে শুরু করি।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা এবং ইতিহাস রচনায় আপনার মনোযোগ নিবদ্ধ বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে। আপনার বইগুলোতে কি আপনি কেবল মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ, প্রতিরোধ সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধ এবং নির্যাতন-নিপীড়ন গণহত্যার ঘটনাগুলোই লিপিবদ্ধ করেছেন না আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ও এসেছে?
মো. এনামুল হক : মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ মূল কেন্দ্রে থাকলেও আমি এক্ষেত্রে যুদ্ধের পটভূমিসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে যুক্ত করতে চেয়েছি। যেমন ধরুন ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে আমার লেখা ‘রাজশাহীতে মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি। এতে রাজশাহীর জেলা পরিচিতি, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রাজশাহী অর্থাৎ সাতচল্লিশের ভারত বিভাগ থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত রাজশাহীর আন্দোলন-সংগ্রামের একটা ইতিহাসও যুক্ত করেছি। কেননা জাতীয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকা থাকলেও রাজশাহীসহ সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল আর সেখানকার জনগণ নানাভাবে এই সংগ্রামে ভূমিকা রেখেছে। সেসব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। অসহযোগ আন্দোলনে রাজশাহী শিরোনামের লেখায় একাত্তরের ১ থেকে ২৫ মার্চে রাজশাহীর ঘটনাপ্রবাহ এখানে লিপিবদ্ধ করেছি। এরপর প্রতিরোধযুদ্ধে রাজশাহী বিভাগ অধ্যায়ে ২৬ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। এই বইয়ে নাম, পিতার নাম ও গ্রামসহ রাজশাহীর মোট ৯৮৯ জন শহীদের পরিচিতি রয়েছে। একইভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধে শহীদ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ও পরিচিতি রয়েছে। এভাবে নানা পর্বে ভাগ করে একাত্তরের পুরো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাই এখানে লেখার চেষ্টা করেছি। আমার সবগুলো বইয়েই আমি এভাবে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছি।
দেশ রূপান্তর : রাজশাহী বিভাগ অনেক বড় একটা অঞ্চল। এর মধ্যে অনেকগুলো জেলা-উপজেলা আর শত শত গ্রাম। এ ধরনের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার জন্য মাঠ পর্যায়ে সরেজমিন অনুসন্ধান প্রয়োজন, প্রয়োজন বিস্তারিত গবেষণার। এই কাজ করতে গিয়ে আপনি কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলেন? একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়ে এই কাজ সম্ভব করলেন কীভাবে?
মো. এনামুল হক : আসলে মাঠ পর্যায়ে এ ধরনের গবেষণার কাজ একটা নেশার মতো। ইতিহাস অনুসন্ধানের সেই নেশায় মত্ত না হলে এটা করা সম্ভব না। সরকারি চাকুরে হিসেবে আমি পাঁচদিন কাজ করতাম আর দুদিন ছুটি পেতাম। বছরের পর বছর সপ্তাহের এই দুটো ছুটির দিন আমি এসব কাজে ব্যয় করেছি। আমি প্রথম কাজ শুরু করলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তরুণ বয়স থেকেই আমি মোটরসাইকেল চালাতাম। এটা আমাকে খুব সাহায্য করেছিল। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন মোবাইল ফোন তো ছিলই না, যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক নাজুক ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের ছয়টা উপজেলার এমন কোনো ইউনিয়ন নেই যেখানে আমি যাইনি। তথ্য সংগ্রহ করেছি, প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি নিয়েছি, লড়াই-সংগ্রাম আর গণহত্যার গুরুত্বপূর্ণ সবগুলো স্থানে গিয়েছি, সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প কোথায় ছিল, রাজাকাররা কোথায় ক্যাম্প করেছে, হানাদার বাহিনী কোথায় ক্যাম্প করেছে, কোথায় কোথায় সম্মুখ লড়াই হয়েছে সেইসব জায়গায় নিজে গিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছি। এখানে একটা কথা বলে রাখি। যেসব জায়গায় গণহত্যা হয়েছে প্রায় সবক্ষেত্রেই কিন্তু আপনি একজন-দুজনকে পাবেন যারা কোনো না কোনোভাবে ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। কেউ গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মরার ভান করে পরে থেকে বেঁচেছে, কেউ দৈবক্রমে পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে। এমন অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমি। আর যারা গণহত্যার শিকার হয়েছেন তাদের জীবিত আত্মীয় স্ত্রী, ভাইবোন, বাবা-মা কিংবা সন্তানের সঙ্গে কথা বলেছি।
এই কাজের আরেকটা চ্যালেঞ্জ হলো মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বা নির্যাতিত ব্যক্তি যখন কথা বলেন, তিনি হয়তো সত্য কথাই বলছেন; কিন্তু দেখা গেল স্মৃতি তাকে বিভ্রান্ত করছে। ফলে ঘটনাগুলো বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে প্রতিটা ঘটনা আর সাক্ষ্যপ্রমাণকে নানা আঙ্গিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আরও অনেক জনের কাছ থেকে জেনে নিয়ে ঘটনাটিকে মিলিয়ে নিতে হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে গবেষণার এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা সম্ভব না।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আপনার একটা অপ্রকাশিত পা-ুলিপি রয়েছে ‘একাত্তরে গণহত্যা : বৃহত্তর পাবনা জেলা’ শিরোনামে। এই বইটি সম্পর্কে জানতে চাই। বইটি এখনো প্রকাশ করা যায়নি কেন?
মো. এনামুল হক : ‘একাত্তরে গণহত্যা : বৃহত্তর পাবনা জেলা’ বইটিতে পাবনা জেলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলায় যতগুলো গণহত্যা হয়েছে সবগুলোর বর্ণনা আছে। এমনকি যে গণহত্যার কারণে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি হয়েছে তারও বিবরণ আছে এই বইয়ে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ আছে। শহীদদের আত্মীয়দের বিবরণ আছে। আসলে এই ধরনের বই প্রকাশ করা খুব কঠিন। আঞ্চলিক ইতিহাস বলে অন্য জেলার লোকদের কাছে চাহিদা নেই। আর প্রকাশকরা এমন বই প্রকাশে বিনিয়োগ করতে চান না।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে ইতিমধ্যেই আপনার চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আরও একটি বইয়ের পান্ডুলিপি এখন প্রকাশের অপেক্ষায়। এছাড়া আপনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়েও কাজ করেছেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আপনার ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ’ বইটির বিষয়ে জানতে চাই।
মো. এনামুল হক : পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যসহ নির্মমভাবে হত্যা করা এবং তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যার ঘটনাকে আমি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করি। দুঃখজনক বিষয় হলো পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডির পর দেশে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিল সেটা এদেশের অনেকেই সঠিকভাবে জানেন না। জানতে দেওয়া হয়নি। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ করতে আগ্রহী হই।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে দুটো সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়েছিল। একটি টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে, আরেকটি চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বে।
আপনারা জানেন, একাত্তরে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইলে ‘কাদেরীয়া বাহিনী’ নামে একটা স্থানীয় বাহিনী দেশের ভেতরে থেকেই মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সামরিক বাহিনীর বাইরে কাদের সিদ্দিকীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি একাত্তরে বীরোচিত ভূমিকার জন্য ‘বীরউত্তম’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে তখন কাদেরীয়া বাহিনীতে প্রায় ১৭ হাজার যোদ্ধা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কাদের সিদ্দিকী ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য বাহিনী গঠন এবং ভারতীয় ভূখ- ব্যবহার করার বিষয়ে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তা প্রার্থনা করেন। তিনি কাদের সিদ্দিকীকে ইতিবাচক সম্মতি দিয়েছিলেন। জামালপুরের কামালপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের অভ্যন্তরে তিনি ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং দেশের ভেতরে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষজন আর তরুণদের তিনি সংগঠিত করেন। লালমনিরহাট থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জের সীমান্ত পর্যন্ত অনেকগুলো ক্যাম্প করেছিলেন তারা। অনেকে আরও বেশি দাবি করলেও আমার গবেষণায় আমি দেখেছি যে, ছয় থেকে সাত হাজার মানুষের একটা বাহিনী কাদের সিদ্দিকী তৈরি করতে পেরেছিলেন। তারা নাম দিয়েছিলেন‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। সীমান্ত এলাকায় হামলা আর দেশের ভেতরের নাশকতা ছাড়াও খন্দকার মুশতাককে হত্যার জন্যও তিন জনের একটা স্কোয়াড পাঠিয়েছিলেন কাদের সিদ্দিকী। তবে ওই তিনজন ধরা পড়েছিলেন এবং নানা ঘটনায় এই বাহিনীর প্রায় শ’খানেক যোদ্ধা শহীদও হয়েছিলেন।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী ভারতের আগরতলায় অবস্থান নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করে নাম দিয়েছিলেন ‘জাতীয় মুজিব বাহিনী’। তাদের তৎপরতা চট্টগ্রাম এলাকাতে সীমিত ছিল।
কিন্তু এই সময় ভারতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের পতন হয়। সাতাত্তরের মার্চে ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মোরারজি দেশাই ক্ষমতায় আসেন। ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের তৎকালীন সামরিক সরকারের একটা সমঝোতা হলে ভারত তাদের ভূখন্ডে অবস্থান নেওয়া এই দুটো বাহিনীর সবাইকে ধরে ধরে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। এতে এই বাহিনীগুলোর সদস্যরা চরম বিপর্যয়ে পড়েন। একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ ও ‘জাতীয় মুজিব বাহিনী’র যোদ্ধারা জেল-জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে পড়েন। মহিউদ্দীন চৌধুরী কলকাতায় আত্মগোপনে চলে যান। আর কাদের সিদ্দিকী ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন।
দেশ রূপান্তর : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আপনার উপলব্ধি কী হলো সেটা সংক্ষেপে শুনতে চাই।
মো. এনামুল হক : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দেশের মানুষ যে সীমাহীন আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, যে অমানুষিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যে কষ্ট-দুর্ভোগ সহ্য করেছেন সেটা ভাষায় বর্ণনার অতীত। আর মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে জীবনকে তুচ্ছ করে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করবার জন্য লড়াই করেছেন তার কোনো তুলনা হয় না। এজন্য জাতির কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবশ্যই সম্মান প্রাপ্য। তবে, সবচেয়ে বড় কথা হলো জাতির জীবনের এই মহত্তম সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার কাজটি শেষ করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। এজন্য সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার কাজ খুবই জরুরি।