বাংলাকে যদি সর্বত্র ব্যবহার করতে না পারি, তবে বাঙালি দাবি করি কী করে
আহমদ রফিক
বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। লেখালেখি ও গবেষণার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয়া ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন। এছাড়া রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি পেয়েছেন টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : এই বছর আমরা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করলাম। ১৯৫২-তে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলন আপনারা করেছিলেন, স্বাধীন দেশে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি না?
আহমদ রফিক : বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের যে লক্ষ্য তা অর্জিত হয়নি। বাহান্নর যে চেতনা তা পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি ষাটের দশকের ছয়দফা ও একাত্তরে বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামে। সবাই একটি কথা বলেন যে, অনেকেই স্বীকার করেন ভাষা আন্দোলন সব আন্দোলনের সূতিকাগার। তাই বাহান্নকে সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও দাবি আদায়ের প্রেরণা মনে করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সংবিধান প্রস্তুত করলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। কিন্তু, তার মৃত্যুর পরেই দুই জেনারেল এসে সেটি ছিন্নভিন্ন করলেন। সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। তাদের শাসনকে আমার কাছে মনে হয়েছে পাকিস্তানি শাসনের ধারাবাহিকতা। যে সংবিধান দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা পেয়েছিলাম সেটি বদলে ফেলা হলো। তবে আমার কাছে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কোনো একটি দুর্বোধ্য কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে জিয়াউর রহমানের খুবই জনপ্রিয়তা ছিল। যে কারণে কর্নেল তাহের তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আবার পরে দেখা যায় এই জিয়াউর রহমানের আমলেই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। এরপরে দেখা গেল দল গঠন করলেন জিয়াউর রহমান। রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতি করা দোষের নয়। কিন্তু তিনি সংবিধানে পরিবর্তন আনলেন। সংবিধানে এই পরিবর্তন আনা তো কোনো দরকার ছিল না। এভাবে দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে দেশ ভাষা আন্দোলনের যে লক্ষ্য ছিল সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা সব জায়গায় মাধ্যম হিসেবে বাংলার কথা বলা হয়েছিল। উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে তা আর হলো কই! দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শেখ সাহেব পর্যন্ত বহুবার বলেছিলেন, কিন্তু তা আর হলো না। বরং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা বেসরকারি সব সেক্টরে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই ইংরেজি হয়ে উঠল শিক্ষার মাধ্যম। স্বাধীনতার পরে খুব অল্প সময়ে আমরা দেখলাম সমাজে ধনিক শ্রেণির ভার্টিক্যাল গ্রোথ হয়েছে। এই শ্রেণির লোকজনের হাতে প্রচুর টাকা। তাদের সন্তানরা চাইলেই অধিক টাকা দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারছে। ভাষা আন্দোলনের সময়ে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি সেগুলো হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু করো।
বর্তমানে দেশে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা হওয়ায় আরও ক্ষতি হচ্ছে। কারণ উচ্চশিক্ষায় প্রায় সবই ইংরেজি মাধ্যমে হয়ে থাকে। যারা একটু পিছিয়ে পড়া বা গ্রামের অসচ্ছল পরিবারের সন্তান তারা এতে করে পিছিয়ে থাকে। তাই উচ্চশিক্ষায় এসে তাদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই সমস্যাটা হয়েছে অর্ধেক বাংলা মাধ্যমে করায়। যদি উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বাংলায় পড়াশোনার সুযোগ হতো তাহলে তারা আরও ভালো করত। উচ্চশিক্ষায় বাংলা, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় হওয়া নিয়ে আমি একবার কথা বলেছিলাম দেশের বরেণ্য আইনজীবী কামাল হোসেনের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় বলা ও লেখা সম্ভব কি না? তিনি বলেছিলেন, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় হওয়া সম্ভব। তবে একটু কষ্টসাধ্য। এখন কথা হচ্ছে কত কষ্টই তো আমরা করেছি। এই কষ্টটুকু করতে পারছি না কেন! দুই একজন বিচারপতিকে আমরা দেখেছি বাংলায় রায় দিতে। তাদের কার্যক্রম আমরা প্রশংসা জানিয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখা গেল এতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। নতুন আর কেউ এগিয়ে আসছেন না। এ থেকেই বোঝা যায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর অবস্থা কী। উচ্চশিক্ষা বা বিচারকাজে বাংলা যে উপেক্ষিত হচ্ছে এটাই তার প্রমাণ। আমরা তো খুব গর্ব করে বলি ভাষিক জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন না করে আমরা কি তার দাবি করতে পারি?
আমরা যদি ইউরোপের দেশগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব তারা প্রায় প্রত্যেকেই ভাষিক জাতিরাষ্ট্র। যেমন স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে স্পেনের অধিবাসীরা। আবার একইভাবে ইংরেজিতে কথা বলে ইংরেজরা। জাপানিরা বলে জাপানিজ ভাষায়। এখন আমরা যদি নিজ দেশেও বাংলাকে সর্বত্র ব্যবহার করতে না পারি তবে আমরা বাঙালি দাবি করি কী করে। ভাষা আন্দোলনের যে দাবিগুলো ছিল, তা পুরোপুরি পালন হয়নি। সেগুলো হওয়া উচিত।
অপরদিকে গত কয়েক বছর যাবৎ ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করার চেষ্টা চলছে। হাইকোর্ট এটা নিয়ে নির্দেশনাও দিয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরে এই তালিকা কি সঠিকভাবে করা সম্ভব? ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতজন আর জীবিত আছেন? ভাষা আন্দোলন এর সত্যিকার ঘটনা এখন আর কোনোভাবেই কি নির্ণয় করা সম্ভব? যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবাদকারী তাদের সংখ্যা এখন কত? এই তালিকা প্রণয়নের আগে দরকার ছিল ভালো আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করা। সেসবে কারও আগ্রহ আছে বলে দেখা যায় না। সব মিলিয়ে আমি বলবো ভাষা আন্দোলনের যে মূল লক্ষ্য ছিল তা এখনো অর্জিত হয়নি।
দেশ রূপান্তর : স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হলো। এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের প্রাপ্তি কী?
আহমদ রফিক : প্রাপ্তি তো আছে অনেক। একটি জাতিরাষ্ট্র পাওয়া গেল। একটি সংবিধান পাওয়া গেল, যদিও সেই সংবিধানটি নানা সময়ে ছেঁড়াফাড়া করা হয়েছে। তবুও তো পাওয়া গেল। জাতিসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে স্বাধীন দেশের মর্যাদা পাওয়া গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য দূর হয়েছে। কীভাবে নিজ দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়, তার একটা স্বাধীনতা পাওয়া যাচ্ছে। বেশকিছু উন্নয়ন হয়েছে দৃশ্যমান যেমন পদ্মা সেতুর কথা বলা যায়। আবার কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। সেগুলো আমি বলতে চাই না। মূল কথা হচ্ছে এই পঞ্চাশ বছর ভালো-মন্দে মেশানো।
দেশ রূপান্তর : অপ্রাপ্তি বিষয়ে বলুন ...
আহমদ রফিক : অপ্রাপ্তি নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। আমি সেদিকে যেতে চাই না। তবে অল্প কথায় বললে, বাংলাদেশ যে চেতনা নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এটা কষ্টের। যে সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল সেটির গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : বিগত কয়েক বছরে দেশে সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে...
আহমদ রফিক : পাকিস্তান আমলে দেশে বৈষম্য ছিল। তখন ২২টি পরিবারের হাতে সম্পদ ছিল বলা হয়। এখন স্বাধীন দেশে শ্রেণিবৈষম্য কমে আসার কথা ছিল। সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে বৈষম্য বেড়েছে। বৈষম্য বেড়েছে ভার্টিক্যালি। দেখা যাচ্ছে ধনী হয়েছে আরও ধনী। অপরদিকে গরিব হয়েছে আরও গরিব। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ছাড়া শ্রেণিবৈষম্য দূর হয় না। আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা সেখান থেকে সরে এসেছি।
দেশ রূপান্তর : এমন কেন ঘটল বলে মনে করেন?
আহমদ রফিক : আমাদের এই উপমহাদেশে একটি বড় ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৭-এ দেশভাগে। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলো। আবার ১৯৭১-এ আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হলাম। এখন লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এই বড় বড় ঘটনার সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ অনুসন্ধান নিয়ে আমাদের দেশে কী ধরনের গবেষণা হয়েছে? উল্লেখ করার মতো কিছু কি আছে? আবার এসব নিয়ে কাজ করবেন এমন নিবেদিত গবেষক, লেখক, বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাও কম। এই সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার কোনো পাঠ ও বিশ্লেষণ আমাদের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তাদের আছে বলে মনে হয় না। তাই তারা জনমানুষের মনের ভাষা জানতে পারছেন না। এর ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈষম্য কমানোর জন্য কার্যকর সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত থেকে যায়।
দেশ রূপান্তর : একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা হয়েছিল। এই পঞ্চাশ বছরে তা পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন কিনা?
আহমদ রফিক : শূন্যতা সংখ্যায় পূরণ হয়েছে, কিন্তু গুণগত উৎকর্ষতায় নয়। এটুকুই বললাম অল্প কথায়।
দেশ রূপান্তর : আপনার প্রত্যাশিত বাংলাদেশ কেমন? বাংলাদেশকে নিয়ে কেমন স্বপ্ন দেখেন?
আহমদ রফিক : এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে সংখ্যায় নয় গুণগত উৎকর্ষের বিবেচনায় বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বাড়বে। যারা স্বাধীন দেশকে এগিয়ে যেতে মেধা ও পরামর্শ দেবেন। একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আহমদ রফিক : ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক, প্রাবন্ধিক ও ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। লেখালেখি ও গবেষণার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয়া ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন। এছাড়া রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি পেয়েছেন টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলকাতা থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : এই বছর আমরা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করলাম। ১৯৫২-তে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলন আপনারা করেছিলেন, স্বাধীন দেশে সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কি না?
আহমদ রফিক : বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের যে লক্ষ্য তা অর্জিত হয়নি। বাহান্নর যে চেতনা তা পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি ষাটের দশকের ছয়দফা ও একাত্তরে বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামে। সবাই একটি কথা বলেন যে, অনেকেই স্বীকার করেন ভাষা আন্দোলন সব আন্দোলনের সূতিকাগার। তাই বাহান্নকে সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও দাবি আদায়ের প্রেরণা মনে করা হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি সংবিধান প্রস্তুত করলেন। সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য একটি সেক্যুলার সংবিধান প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। কিন্তু, তার মৃত্যুর পরেই দুই জেনারেল এসে সেটি ছিন্নভিন্ন করলেন। সমাজতন্ত্রকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। তাদের শাসনকে আমার কাছে মনে হয়েছে পাকিস্তানি শাসনের ধারাবাহিকতা। যে সংবিধান দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা পেয়েছিলাম সেটি বদলে ফেলা হলো। তবে আমার কাছে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, কোনো একটি দুর্বোধ্য কারণে সেনাবাহিনীর মধ্যে জিয়াউর রহমানের খুবই জনপ্রিয়তা ছিল। যে কারণে কর্নেল তাহের তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আবার পরে দেখা যায় এই জিয়াউর রহমানের আমলেই কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। এরপরে দেখা গেল দল গঠন করলেন জিয়াউর রহমান। রাজনৈতিক দল গঠন করে রাজনীতি করা দোষের নয়। কিন্তু তিনি সংবিধানে পরিবর্তন আনলেন। সংবিধানে এই পরিবর্তন আনা তো কোনো দরকার ছিল না। এভাবে দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে দেশ ভাষা আন্দোলনের যে লক্ষ্য ছিল সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা সব জায়গায় মাধ্যম হিসেবে বাংলার কথা বলা হয়েছিল। উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে তা আর হলো কই! দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শেখ সাহেব পর্যন্ত বহুবার বলেছিলেন, কিন্তু তা আর হলো না। বরং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা বেসরকারি সব সেক্টরে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই ইংরেজি হয়ে উঠল শিক্ষার মাধ্যম। স্বাধীনতার পরে খুব অল্প সময়ে আমরা দেখলাম সমাজে ধনিক শ্রেণির ভার্টিক্যাল গ্রোথ হয়েছে। এই শ্রেণির লোকজনের হাতে প্রচুর টাকা। তাদের সন্তানরা চাইলেই অধিক টাকা দিয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে পারছে। ভাষা আন্দোলনের সময়ে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি সেগুলো হলো রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু করো।
বর্তমানে দেশে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা হওয়ায় আরও ক্ষতি হচ্ছে। কারণ উচ্চশিক্ষায় প্রায় সবই ইংরেজি মাধ্যমে হয়ে থাকে। যারা একটু পিছিয়ে পড়া বা গ্রামের অসচ্ছল পরিবারের সন্তান তারা এতে করে পিছিয়ে থাকে। তাই উচ্চশিক্ষায় এসে তাদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই সমস্যাটা হয়েছে অর্ধেক বাংলা মাধ্যমে করায়। যদি উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বাংলায় পড়াশোনার সুযোগ হতো তাহলে তারা আরও ভালো করত। উচ্চশিক্ষায় বাংলা, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় হওয়া নিয়ে আমি একবার কথা বলেছিলাম দেশের বরেণ্য আইনজীবী কামাল হোসেনের সঙ্গে। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় বলা ও লেখা সম্ভব কি না? তিনি বলেছিলেন, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় হওয়া সম্ভব। তবে একটু কষ্টসাধ্য। এখন কথা হচ্ছে কত কষ্টই তো আমরা করেছি। এই কষ্টটুকু করতে পারছি না কেন! দুই একজন বিচারপতিকে আমরা দেখেছি বাংলায় রায় দিতে। তাদের কার্যক্রম আমরা প্রশংসা জানিয়েছিলাম। কিন্তু পরে দেখা গেল এতে বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। নতুন আর কেউ এগিয়ে আসছেন না। এ থেকেই বোঝা যায় সর্বস্তরে বাংলা চালুর অবস্থা কী। উচ্চশিক্ষা বা বিচারকাজে বাংলা যে উপেক্ষিত হচ্ছে এটাই তার প্রমাণ। আমরা তো খুব গর্ব করে বলি ভাষিক জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন না করে আমরা কি তার দাবি করতে পারি?
আমরা যদি ইউরোপের দেশগুলোর দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব তারা প্রায় প্রত্যেকেই ভাষিক জাতিরাষ্ট্র। যেমন স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে স্পেনের অধিবাসীরা। আবার একইভাবে ইংরেজিতে কথা বলে ইংরেজরা। জাপানিরা বলে জাপানিজ ভাষায়। এখন আমরা যদি নিজ দেশেও বাংলাকে সর্বত্র ব্যবহার করতে না পারি তবে আমরা বাঙালি দাবি করি কী করে। ভাষা আন্দোলনের যে দাবিগুলো ছিল, তা পুরোপুরি পালন হয়নি। সেগুলো হওয়া উচিত।
অপরদিকে গত কয়েক বছর যাবৎ ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করার চেষ্টা চলছে। হাইকোর্ট এটা নিয়ে নির্দেশনাও দিয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরে এই তালিকা কি সঠিকভাবে করা সম্ভব? ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতজন আর জীবিত আছেন? ভাষা আন্দোলন এর সত্যিকার ঘটনা এখন আর কোনোভাবেই কি নির্ণয় করা সম্ভব? যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবাদকারী তাদের সংখ্যা এখন কত? এই তালিকা প্রণয়নের আগে দরকার ছিল ভালো আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে সংরক্ষণ করা। সেসবে কারও আগ্রহ আছে বলে দেখা যায় না। সব মিলিয়ে আমি বলবো ভাষা আন্দোলনের যে মূল লক্ষ্য ছিল তা এখনো অর্জিত হয়নি।
দেশ রূপান্তর : স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার হলো। এই পঞ্চাশ বছরে আমাদের প্রাপ্তি কী?
আহমদ রফিক : প্রাপ্তি তো আছে অনেক। একটি জাতিরাষ্ট্র পাওয়া গেল। একটি সংবিধান পাওয়া গেল, যদিও সেই সংবিধানটি নানা সময়ে ছেঁড়াফাড়া করা হয়েছে। তবুও তো পাওয়া গেল। জাতিসংঘের স্বীকৃতির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে স্বাধীন দেশের মর্যাদা পাওয়া গেল। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য দূর হয়েছে। কীভাবে নিজ দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়, তার একটা স্বাধীনতা পাওয়া যাচ্ছে। বেশকিছু উন্নয়ন হয়েছে দৃশ্যমান যেমন পদ্মা সেতুর কথা বলা যায়। আবার কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। সেগুলো আমি বলতে চাই না। মূল কথা হচ্ছে এই পঞ্চাশ বছর ভালো-মন্দে মেশানো।
দেশ রূপান্তর : অপ্রাপ্তি বিষয়ে বলুন ...
আহমদ রফিক : অপ্রাপ্তি নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। আমি সেদিকে যেতে চাই না। তবে অল্প কথায় বললে, বাংলাদেশ যে চেতনা নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল সেখান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এটা কষ্টের। যে সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল সেটির গতিপথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : বিগত কয়েক বছরে দেশে সম্পদের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান বেড়ে যাচ্ছে...
আহমদ রফিক : পাকিস্তান আমলে দেশে বৈষম্য ছিল। তখন ২২টি পরিবারের হাতে সম্পদ ছিল বলা হয়। এখন স্বাধীন দেশে শ্রেণিবৈষম্য কমে আসার কথা ছিল। সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে বৈষম্য বেড়েছে। বৈষম্য বেড়েছে ভার্টিক্যালি। দেখা যাচ্ছে ধনী হয়েছে আরও ধনী। অপরদিকে গরিব হয়েছে আরও গরিব। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ছাড়া শ্রেণিবৈষম্য দূর হয় না। আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা সেখান থেকে সরে এসেছি।
দেশ রূপান্তর : এমন কেন ঘটল বলে মনে করেন?
আহমদ রফিক : আমাদের এই উপমহাদেশে একটি বড় ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৭-এ দেশভাগে। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলো। আবার ১৯৭১-এ আমরা পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন হলাম। এখন লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এই বড় বড় ঘটনার সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ অনুসন্ধান নিয়ে আমাদের দেশে কী ধরনের গবেষণা হয়েছে? উল্লেখ করার মতো কিছু কি আছে? আবার এসব নিয়ে কাজ করবেন এমন নিবেদিত গবেষক, লেখক, বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাও কম। এই সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনার কোনো পাঠ ও বিশ্লেষণ আমাদের রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তাদের আছে বলে মনে হয় না। তাই তারা জনমানুষের মনের ভাষা জানতে পারছেন না। এর ফলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈষম্য কমানোর জন্য কার্যকর সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত থেকে যায়।
দেশ রূপান্তর : একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টা হয়েছিল। এই পঞ্চাশ বছরে তা পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন কিনা?
আহমদ রফিক : শূন্যতা সংখ্যায় পূরণ হয়েছে, কিন্তু গুণগত উৎকর্ষতায় নয়। এটুকুই বললাম অল্প কথায়।
দেশ রূপান্তর : আপনার প্রত্যাশিত বাংলাদেশ কেমন? বাংলাদেশকে নিয়ে কেমন স্বপ্ন দেখেন?
আহমদ রফিক : এমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে সংখ্যায় নয় গুণগত উৎকর্ষের বিবেচনায় বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা বাড়বে। যারা স্বাধীন দেশকে এগিয়ে যেতে মেধা ও পরামর্শ দেবেন। একটি গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আহমদ রফিক : ধন্যবাদ।