পরিকল্পনা ও জবাবদিহির অভাবে নৌদুর্ঘটনা, নৌপথ ধ্বংস
ড. এম শামসুল হক
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ঢাকার মেট্রোরেল ও হাতিরঝিল প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি, বিআরটি, এমআরটি ও সাবওয়ে প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। হাতিরঝিলের ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ছিলেন তিনি। এ ছাড়া কুড়িল মোড়ে দেশের প্রথম ‘ইন্টারচেঞ্জার’-এর প্ল্যানার তিনি। পুরকৌশলের এই অধ্যাপক দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত। নারায়ণগঞ্জের পাগলায় ‘পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল’ এবং ‘কর্ণফুলী মেগা কন্টেইনার টার্মিনাল’-এর প্ল্যানার তিনি। সম্প্রতি সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনা এবং নৌদুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর: ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইতিমধ্যেই ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্মরণকালের ভয়াবহতম এই নৌদুর্ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন। আসলে দেশে একের পর এক নৌদুর্ঘটনার কারণ কী? সমস্যাটা কোথায় বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: প্রথম কথা হলো, শুধু নৌপথ নয়, রেল ও সড়কপথে যারা সেবা দিচ্ছেন কেউই নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে এই সেবা পরিচালনার কোনো অত্যাবশ্যক বা ইন্টিগ্রাল পার্ট মনে করেন না। অর্থাৎ আমরা উন্নয়নে জোর দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু সেই উন্নয়ন যথাযথ হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে পরিকল্পনায় যে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হয়, যে পেশাদারত্ব থাকতে হয়সেটা থাকছে না। আবার পরিকল্পনা কার্যকরের পর পরবর্তী ধাপে যে তদারকি থাকতে হয় সেটাই করা হয় না। নিয়ন্ত্রকরা ভাবছেন না যে, আমরা একটা সেবা দিচ্ছি তা-ও আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। সেই সেবা নিরাপদ হচ্ছে কি না সেটা তারা দেখছেন না। এটা মনে রাখতে হবে যে, বেসরকারি সেবাদাতা মানেই এটা বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত। ব্যবসায়ীদের লক্ষ্যই থাকে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন বা সর্বোচ্চ মুনাফা করা। তাই খালি আইনকানুন দিয়ে তাকে বাধ্য করা যায় না। এজন্য সার্বক্ষণিক এবং নিরপেক্ষ লোকজনকে দিয়ে নিবিড় তদারকি এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা করতে হয়।
আমি বলব যে, এটা আমাদের দেশে একেবারেই হয় না। বেশি যাত্রী বহন করা, মাত্রাতিরিক্ত গতিতে চলাচল করা, পথে অন্য যানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া, পরিবহনের ফিটনেস ঠিক না থাকা এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলো ঠিক না থাকার ঘটনা এসব কারণেই ঘটে থাকে। সুগন্ধা ট্র্যাজেডির মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো এসবের অভাবেই ঘটছে।
দেশ রূপান্তর: নৌপথের তদারকির জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি রয়েছে। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পেশাদারত্বের অভাব ও দায়িত্বহীনতা এবং বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী উভয়ের গাফিলতির কারণেই নৌদুর্ঘটনা থামছে না, নৌপথ নিরাপদ হচ্ছে না?
ড. এম শামসুল হক: আমি আসলে বেসরকারি খাতের নৌযান মালিকদের দোষ দেব না। কারণ তারা ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী মুনাফা বাড়ানোর জন্য সেবার মান ও নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস করে। দুনিয়ার সবখানেই এই প্রবণতা আছে। কিন্তু সেবার মান ও নিরাপত্তায় কোনো আপস যাতে না ঘটেসেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। ফলে শেষ বিচারে সব দায়দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরই বর্তায়।
এখন, আপনি যদি বিআইডব্লিউটিসি-কেও দায়ী করেন। তারা বলবে আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। কথা হলো, দেশের নৌপথে নৌযানের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, যাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে, রুট বাড়ছে। অর্থাৎ সেবার পরিধি বাড়ছে কিন্তু তার সঙ্গে মানানসইভাবে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সংস্থার লোকবল বাড়ছে না। সংস্থার অর্গানোগ্রাম আপডেটেড হচ্ছে না। এমনকি সংখ্যাগতভাবেই তারা এমপাওয়ার্ড হচ্ছে না। এজন্য বিদেশে এসব ক্ষেত্রে লোকবল আউটসোর্স করে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে সরকারি চাকরিতে একবার ঢুকলে আর বাদ দেওয়ার উপায় নেই। আমাদের এখানে তাই এমন আউটসোর্সিং হয় না।
সমস্যাটা হলো, এই ধরনের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোতে যারা কর্তাব্যক্তি হিসেবে আসেন আর পরিচালনা করেন তারা ওই সংস্থার হোম গ্রোউন না। এরকম ইমপ্ল্যান্টেড চেয়ারম্যান বা কর্তাব্যক্তিরা ওই ইনস্টিটিউশনের যে ধারাবাহিকতা, সেসব ওউন করেন না। এরা তিন-চার বছর থাকেন তারপর অন্য কোথাও চলে যান। ফলে সেবা খাতটির উন্নয়নের চেয়েও প্রাপ্তির দিকেই তাদের নজর বেশি থাকে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, এরা সংশ্লিষ্ট সেবা খাতের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ নন। যিনি হয়তো ভালো বৈমানিক বা নাবিক, তিনি সেই কাজটা ভালো পারার কথা। কিন্তু তাকে সেবা খাতের পরিচালক বানিয়ে আমরা যথাযথ সেবা নাও পেতে পারি। তাই সেবার পরিধির সঙ্গে তদারকির পরিধি বাড়ছে না। এখন রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে এরকম ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার বানিয়ে রাখার দায় আসলে সরকারকেই নিতে হবে।
সরকার বলেন বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তারা এই সমস্যাগুলো জানে। ধরুন বিশ বছর বা পঁচিশ বছর আগে পরিদর্শকের যে সংখ্যা ছিল এখনো প্রায় তা-ই রয়ে গেছে। সড়কপথেও কিন্তু একই অবস্থা। সড়কে যখন ৮ লাখ গাড়ি ছিল তখন ইন্সপেক্টর ছিল ৭২ জন। এখন ৫৮ লাখ গাড়ি হয়েছে কিন্তু ইন্সপেক্টরের সংখ্যা একই রকম রয়ে গেছে। তারা বলেন এখন আছেন ১০২ জন। একটা সেবা খাত এই রকম অসামঞ্জস্যপূর্ণ তদারকি দিয়ে চলতে পারে না। তাই নৌপথ বলেন আর সড়কপথ, দেশের জনগণকে বছরের পর নিহত-আহতের সংখ্যায় উঠে জানান দিতে হয় এই অব্যবস্থাপনার কথা।
দেশ রূপান্তর: এখানে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। একটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান অবলম্বন কী হবে আর সড়ক, নৌ কিংবা রেল বা আকাশপথ কোথায় তার গ্রোথ বেশি হবেএই বিষয়টা প্রাথমিকভাবে ওই দেশের ভূগোল দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের পরিচয় নদীমাতৃক দেশ ও সাগরমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও নৌপথ এদেশে অবহেলিত। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন নৌপথ হওয়া সত্ত্বেও এটা ক্রমাগত পিছিয়েছে আর সড়কপথের বিস্তার ঘটেছে। এটা কেন হলো বা নৌপথ নিয়ে সরকারগুলো অমনোযোগী কেন বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনা সামনে আনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। একটা দেশের ভৌগোলিক চরিত্রই নির্ধারণ করত দেশটির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম কী হবে। তার ভিত্তিতেই নৌ, সড়ক আর রেল বা আকাশপথের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা বিকশিত হতো। ধরুন বাংলাদেশের মতোই নেদারল্যান্ডস হচ্ছে একটা রিভারাইন কান্ট্রি। সারা দেশে ক্রিসক্রসের মতো অসংখ্য নদী। এ ছাড়া দেশটির এক বিরাট অংশের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে কম। নেদারল্যান্ডস কিন্তু একটা নদী বা শাখা নদীকেও শুকিয়ে যেতে দেয়নি। ওরা আবার পাহাড়ি আর সমতলের নদীগুলোকে খাল কেটে সংযুক্ত করে নিয়েছে। নদী-সমুদ্র ও পানিসম্পদকে নেদারল্যান্ডস প্রাকৃতিক আশীর্বাদ হিসেবে দেখেছে এবং পানিবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করে তারা এখন সারা বিশ্বে এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই খাত তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। পর্যটক আকর্ষণ করছে। এবং একইসঙ্গে দেশের প্রতিবেশ-পরিবেশ রক্ষার মেরুদন্ড হিসেবে নদী ও পানিকে কাজে লাগাতে পেরেছে। আমাদেরও সেই পথে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
দেশ রূপান্তর: এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণগুলো কী বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিন্তু শুরুটা ভালো ছিল। সেসময় নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যে জাতীয় বাজেট অনুমোদন করেছিলেন সেখানেও নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিরূপ ছিল। উন্নয়নের জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। আর দাতাগোষ্ঠীগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অর্থ বা ঋণ নিয়ে বসেছিল দেওয়ার জন্য। কিন্তু দাতাদের একটা গোপন লক্ষ্য ছিল। তারা চিন্তা করেছে সড়কপথে বিনিয়োগ করলে তাদের ইন্ডাস্ট্রির গাড়ি, বাস, ট্রাক এখানে বিক্রি হবে, রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদারি হবে, তেল বিক্রি হবে। এসব কারণেই তারা সড়কপথ বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছে, ঋণ দিয়েছে।
এদিকে, দেশের মানুষ চাচ্ছিল ডোর টু ডোর ফ্যাসিলিটি। আর দাতারাই চাইছিল সড়কপথের উন্নয়ন। এভাবে দাতা ও গ্রহীতার চাহিদা মিলে গেল। আর সরকারগুলো ভোটের রাজনীতির সুবিধা নিতে এই শর্টকাট পথে পা দিয়েছিল। আর এলজিইডি যেভাবে সারা দেশে এসব রাস্তা তৈরি করেছে তাতে আমাদের যে ৪-২৫ হাজার কিলোমিটারের নৌপথ ছিল সেগুলোকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন নৌপথকে ৪-৫ হাজার কিলোমিটারে নামিয়ে নিয়ে এসেছি। এসব কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথের সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।
দেশ রূপান্তর: সড়কপথের এই অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে একই সঙ্গে দেশের নৌপথগুলো ধ্বংস হয়েছে। চৌষট্টি জেলায় সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে যে শত শত ব্রিজ কালভার্ট করতে হয়েছে সেসব যথাযথ উচ্চতায় নির্মিত হয়নি। ফলে বর্ষাকালে নৌপথে পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলে বিঘœ হয়েছে। আঞ্চলিক নৌপথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আবার সেসব কম উচ্চতার ব্রিজ ভেঙে নতুন করে নির্মাণের চিন্তা হচ্ছে।
ড. এম শামসুল হক: একদমই তাই। শুধু যে সড়কের উন্নয়ন করা হয়েছে তা নয়। এই প্রক্রিয়ায় নৌপথকে অকার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের উন্নয়ন দর্শনের মধ্যেই ভুল ছিল। শুরুতেই আমাদের ফোকাস নষ্ট হয়ে গেছে। একটা জাতি বা রাষ্ট্রের উন্নয়নের লক্ষ্য বা মূল ফোকাস নির্ধারণ করার জন্য একটা অভিভাবক বডি থাকে। সেটা পরিকল্পনা কমিশন। আমাদেরও এই কমিশন আছে। কিন্তু সারা দুুনিয়ায় যেটা করা হয় যে, বিশেষজ্ঞ ও পেশাদার মানুষদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ পেশাদারদের নিয়ে আসা হয়। যাতে দেশের উন্নয়ন ফোকাস থেকে সরে না যায়। যাতে ভুল পরিকল্পনার কারণে উন্নয়নের জট তৈরি না হয়।
পরিকল্পনা কমিশনেরই কিন্তু দায়িত্ব বিভিন্ন রকমের উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে ভারসাম্য নির্ধারণ করা এবং সামঞ্জস্য বিধান করা। ধরুন সড়কের একটা পরিকল্পনা এলো, নৌপথের পরিকল্পনা এলো, রেলপথের পরিকল্পনা এলো। এসব পরিকল্পনা কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি করবে কি না, এসব পরিকল্পনা দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে সবকিছু বিচার করে তারা সিদ্ধান্ত দেবেন উন্নয়নটা কীভাবে হবে। কোথায় কতটুকু হবে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন এভাবে কাজ করছে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে তারা প্রকল্প প্রস্তাব পাচ্ছে আর অর্থকড়ি ও অন্যান্য বিষয় বিচার করেই সেগুলো পাস হয়ে যাচ্ছে। সামগ্রিক পরিকল্পনার বিষয়টা মনোযোগে থাকছে না। আমাদের দেশেও অনেকগুলো ভালো পরিকল্পনা হয়েছে। যেমন ২০১৩ সালে হলো, বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার রূপকল্প বা ‘মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’। এখন এই পরিকল্পনার অভিভাবক কে? এর দায়িত্ব তো আলাদাভাবে সড়ক, নৌ বা রেল কর্তৃপক্ষ নেবে না। তাহলে এটা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? এই দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশনের। কিন্তু আমাদের কমিশনে কোনো পরিকল্পনাবিদ নেই। সেখানকার কর্তারা খালি বাজেট দেখেন আর কাটছাঁট করেন। এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে, এখানে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় কোনো জোর নেই।
দেশ রূপান্তর: আমরা বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এলাম। সংগত কারণেই বিগত পঞ্চাশ বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর আগামীর সম্ভাবনার কথা সামনে আসছে। এক্ষেত্রে বিশেষত আগামীতে বাংলাদেশের নৌপথ ও নৌপরিবহনের অর্থে যেমন তেমনি নদ-নদী-জলাশয় বাঁচিয়ে রাখার সম্ভাবনা কতটুকু বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ যেটা করা হয়েছে সেটা আশাব্যঞ্জক। এখন নদীভিত্তিক রি-জুভিনিশনের বিষয়টা যদি মাথায় রাখা হয় আর একটা সমন্বিত পদক্ষেপ যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই সম্ভাবনা আছে। এই পরিকল্পনাটা নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় করা হয়েছে। কিন্তু সেদেশে সুশাসন আছে। এখানে নেই। ফলে একটা বলিষ্ঠ রেগুলেটরি অথরিটি, একটা নলেজ এমপাওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। ঢাকার মেট্রোরেল ও হাতিরঝিল প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি, বিআরটি, এমআরটি ও সাবওয়ে প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। হাতিরঝিলের ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানার ছিলেন তিনি। এ ছাড়া কুড়িল মোড়ে দেশের প্রথম ‘ইন্টারচেঞ্জার’-এর প্ল্যানার তিনি। পুরকৌশলের এই অধ্যাপক দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় যুক্ত। নারায়ণগঞ্জের পাগলায় ‘পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল’ এবং ‘কর্ণফুলী মেগা কন্টেইনার টার্মিনাল’-এর প্ল্যানার তিনি। সম্প্রতি সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনা এবং নৌদুর্ঘটনার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর: ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ইতিমধ্যেই ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া অর্ধশতাধিক মানুষ আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। স্মরণকালের ভয়াবহতম এই নৌদুর্ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন। আসলে দেশে একের পর এক নৌদুর্ঘটনার কারণ কী? সমস্যাটা কোথায় বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: প্রথম কথা হলো, শুধু নৌপথ নয়, রেল ও সড়কপথে যারা সেবা দিচ্ছেন কেউই নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে এই সেবা পরিচালনার কোনো অত্যাবশ্যক বা ইন্টিগ্রাল পার্ট মনে করেন না। অর্থাৎ আমরা উন্নয়নে জোর দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু সেই উন্নয়ন যথাযথ হচ্ছে কি না সেই বিষয়ে পরিকল্পনায় যে বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হয়, যে পেশাদারত্ব থাকতে হয়সেটা থাকছে না। আবার পরিকল্পনা কার্যকরের পর পরবর্তী ধাপে যে তদারকি থাকতে হয় সেটাই করা হয় না। নিয়ন্ত্রকরা ভাবছেন না যে, আমরা একটা সেবা দিচ্ছি তা-ও আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। সেই সেবা নিরাপদ হচ্ছে কি না সেটা তারা দেখছেন না। এটা মনে রাখতে হবে যে, বেসরকারি সেবাদাতা মানেই এটা বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত। ব্যবসায়ীদের লক্ষ্যই থাকে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশন বা সর্বোচ্চ মুনাফা করা। তাই খালি আইনকানুন দিয়ে তাকে বাধ্য করা যায় না। এজন্য সার্বক্ষণিক এবং নিরপেক্ষ লোকজনকে দিয়ে নিবিড় তদারকি এবং চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের ব্যবস্থা করতে হয়।
আমি বলব যে, এটা আমাদের দেশে একেবারেই হয় না। বেশি যাত্রী বহন করা, মাত্রাতিরিক্ত গতিতে চলাচল করা, পথে অন্য যানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া, পরিবহনের ফিটনেস ঠিক না থাকা এবং নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাগুলো ঠিক না থাকার ঘটনা এসব কারণেই ঘটে থাকে। সুগন্ধা ট্র্যাজেডির মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো এসবের অভাবেই ঘটছে।
দেশ রূপান্তর: নৌপথের তদারকির জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি রয়েছে। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, নিয়ন্ত্রক সংস্থার পেশাদারত্বের অভাব ও দায়িত্বহীনতা এবং বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী উভয়ের গাফিলতির কারণেই নৌদুর্ঘটনা থামছে না, নৌপথ নিরাপদ হচ্ছে না?
ড. এম শামসুল হক: আমি আসলে বেসরকারি খাতের নৌযান মালিকদের দোষ দেব না। কারণ তারা ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী মুনাফা বাড়ানোর জন্য সেবার মান ও নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস করে। দুনিয়ার সবখানেই এই প্রবণতা আছে। কিন্তু সেবার মান ও নিরাপত্তায় কোনো আপস যাতে না ঘটেসেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। ফলে শেষ বিচারে সব দায়দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরই বর্তায়।
এখন, আপনি যদি বিআইডব্লিউটিসি-কেও দায়ী করেন। তারা বলবে আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। কথা হলো, দেশের নৌপথে নৌযানের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, যাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে, রুট বাড়ছে। অর্থাৎ সেবার পরিধি বাড়ছে কিন্তু তার সঙ্গে মানানসইভাবে তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সংস্থার লোকবল বাড়ছে না। সংস্থার অর্গানোগ্রাম আপডেটেড হচ্ছে না। এমনকি সংখ্যাগতভাবেই তারা এমপাওয়ার্ড হচ্ছে না। এজন্য বিদেশে এসব ক্ষেত্রে লোকবল আউটসোর্স করে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে সরকারি চাকরিতে একবার ঢুকলে আর বাদ দেওয়ার উপায় নেই। আমাদের এখানে তাই এমন আউটসোর্সিং হয় না।
সমস্যাটা হলো, এই ধরনের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোতে যারা কর্তাব্যক্তি হিসেবে আসেন আর পরিচালনা করেন তারা ওই সংস্থার হোম গ্রোউন না। এরকম ইমপ্ল্যান্টেড চেয়ারম্যান বা কর্তাব্যক্তিরা ওই ইনস্টিটিউশনের যে ধারাবাহিকতা, সেসব ওউন করেন না। এরা তিন-চার বছর থাকেন তারপর অন্য কোথাও চলে যান। ফলে সেবা খাতটির উন্নয়নের চেয়েও প্রাপ্তির দিকেই তাদের নজর বেশি থাকে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, এরা সংশ্লিষ্ট সেবা খাতের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষ নন। যিনি হয়তো ভালো বৈমানিক বা নাবিক, তিনি সেই কাজটা ভালো পারার কথা। কিন্তু তাকে সেবা খাতের পরিচালক বানিয়ে আমরা যথাযথ সেবা নাও পেতে পারি। তাই সেবার পরিধির সঙ্গে তদারকির পরিধি বাড়ছে না। এখন রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে এরকম ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার বানিয়ে রাখার দায় আসলে সরকারকেই নিতে হবে।
সরকার বলেন বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তারা এই সমস্যাগুলো জানে। ধরুন বিশ বছর বা পঁচিশ বছর আগে পরিদর্শকের যে সংখ্যা ছিল এখনো প্রায় তা-ই রয়ে গেছে। সড়কপথেও কিন্তু একই অবস্থা। সড়কে যখন ৮ লাখ গাড়ি ছিল তখন ইন্সপেক্টর ছিল ৭২ জন। এখন ৫৮ লাখ গাড়ি হয়েছে কিন্তু ইন্সপেক্টরের সংখ্যা একই রকম রয়ে গেছে। তারা বলেন এখন আছেন ১০২ জন। একটা সেবা খাত এই রকম অসামঞ্জস্যপূর্ণ তদারকি দিয়ে চলতে পারে না। তাই নৌপথ বলেন আর সড়কপথ, দেশের জনগণকে বছরের পর নিহত-আহতের সংখ্যায় উঠে জানান দিতে হয় এই অব্যবস্থাপনার কথা।
দেশ রূপান্তর: এখানে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করতে চাই। একটা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধান অবলম্বন কী হবে আর সড়ক, নৌ কিংবা রেল বা আকাশপথ কোথায় তার গ্রোথ বেশি হবেএই বিষয়টা প্রাথমিকভাবে ওই দেশের ভূগোল দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের পরিচয় নদীমাতৃক দেশ ও সাগরমাতৃক দেশ হওয়া সত্ত্বেও নৌপথ এদেশে অবহেলিত। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন নৌপথ হওয়া সত্ত্বেও এটা ক্রমাগত পিছিয়েছে আর সড়কপথের বিস্তার ঘটেছে। এটা কেন হলো বা নৌপথ নিয়ে সরকারগুলো অমনোযোগী কেন বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনা সামনে আনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। একটা দেশের ভৌগোলিক চরিত্রই নির্ধারণ করত দেশটির যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম কী হবে। তার ভিত্তিতেই নৌ, সড়ক আর রেল বা আকাশপথের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা বিকশিত হতো। ধরুন বাংলাদেশের মতোই নেদারল্যান্ডস হচ্ছে একটা রিভারাইন কান্ট্রি। সারা দেশে ক্রিসক্রসের মতো অসংখ্য নদী। এ ছাড়া দেশটির এক বিরাট অংশের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়ে কম। নেদারল্যান্ডস কিন্তু একটা নদী বা শাখা নদীকেও শুকিয়ে যেতে দেয়নি। ওরা আবার পাহাড়ি আর সমতলের নদীগুলোকে খাল কেটে সংযুক্ত করে নিয়েছে। নদী-সমুদ্র ও পানিসম্পদকে নেদারল্যান্ডস প্রাকৃতিক আশীর্বাদ হিসেবে দেখেছে এবং পানিবিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি করে তারা এখন সারা বিশ্বে এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই খাত তাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। পর্যটক আকর্ষণ করছে। এবং একইসঙ্গে দেশের প্রতিবেশ-পরিবেশ রক্ষার মেরুদন্ড হিসেবে নদী ও পানিকে কাজে লাগাতে পেরেছে। আমাদেরও সেই পথে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
দেশ রূপান্তর: এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণগুলো কী বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: স্বাধীনতা-উত্তরকালে কিন্তু শুরুটা ভালো ছিল। সেসময় নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের একটা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যে জাতীয় বাজেট অনুমোদন করেছিলেন সেখানেও নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিরূপ ছিল। উন্নয়নের জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। আর দাতাগোষ্ঠীগুলো অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অর্থ বা ঋণ নিয়ে বসেছিল দেওয়ার জন্য। কিন্তু দাতাদের একটা গোপন লক্ষ্য ছিল। তারা চিন্তা করেছে সড়কপথে বিনিয়োগ করলে তাদের ইন্ডাস্ট্রির গাড়ি, বাস, ট্রাক এখানে বিক্রি হবে, রাস্তা নির্মাণের ঠিকাদারি হবে, তেল বিক্রি হবে। এসব কারণেই তারা সড়কপথ বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছে, ঋণ দিয়েছে।
এদিকে, দেশের মানুষ চাচ্ছিল ডোর টু ডোর ফ্যাসিলিটি। আর দাতারাই চাইছিল সড়কপথের উন্নয়ন। এভাবে দাতা ও গ্রহীতার চাহিদা মিলে গেল। আর সরকারগুলো ভোটের রাজনীতির সুবিধা নিতে এই শর্টকাট পথে পা দিয়েছিল। আর এলজিইডি যেভাবে সারা দেশে এসব রাস্তা তৈরি করেছে তাতে আমাদের যে ৪-২৫ হাজার কিলোমিটারের নৌপথ ছিল সেগুলোকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা এখন নৌপথকে ৪-৫ হাজার কিলোমিটারে নামিয়ে নিয়ে এসেছি। এসব কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথের সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।
দেশ রূপান্তর: সড়কপথের এই অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে একই সঙ্গে দেশের নৌপথগুলো ধ্বংস হয়েছে। চৌষট্টি জেলায় সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে যে শত শত ব্রিজ কালভার্ট করতে হয়েছে সেসব যথাযথ উচ্চতায় নির্মিত হয়নি। ফলে বর্ষাকালে নৌপথে পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলে বিঘœ হয়েছে। আঞ্চলিক নৌপথগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আবার সেসব কম উচ্চতার ব্রিজ ভেঙে নতুন করে নির্মাণের চিন্তা হচ্ছে।
ড. এম শামসুল হক: একদমই তাই। শুধু যে সড়কের উন্নয়ন করা হয়েছে তা নয়। এই প্রক্রিয়ায় নৌপথকে অকার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের উন্নয়ন দর্শনের মধ্যেই ভুল ছিল। শুরুতেই আমাদের ফোকাস নষ্ট হয়ে গেছে। একটা জাতি বা রাষ্ট্রের উন্নয়নের লক্ষ্য বা মূল ফোকাস নির্ধারণ করার জন্য একটা অভিভাবক বডি থাকে। সেটা পরিকল্পনা কমিশন। আমাদেরও এই কমিশন আছে। কিন্তু সারা দুুনিয়ায় যেটা করা হয় যে, বিশেষজ্ঞ ও পেশাদার মানুষদের সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ পেশাদারদের নিয়ে আসা হয়। যাতে দেশের উন্নয়ন ফোকাস থেকে সরে না যায়। যাতে ভুল পরিকল্পনার কারণে উন্নয়নের জট তৈরি না হয়।
পরিকল্পনা কমিশনেরই কিন্তু দায়িত্ব বিভিন্ন রকমের উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে ভারসাম্য নির্ধারণ করা এবং সামঞ্জস্য বিধান করা। ধরুন সড়কের একটা পরিকল্পনা এলো, নৌপথের পরিকল্পনা এলো, রেলপথের পরিকল্পনা এলো। এসব পরিকল্পনা কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি করবে কি না, এসব পরিকল্পনা দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর কী প্রভাব ফেলবে সবকিছু বিচার করে তারা সিদ্ধান্ত দেবেন উন্নয়নটা কীভাবে হবে। কোথায় কতটুকু হবে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন এভাবে কাজ করছে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে তারা প্রকল্প প্রস্তাব পাচ্ছে আর অর্থকড়ি ও অন্যান্য বিষয় বিচার করেই সেগুলো পাস হয়ে যাচ্ছে। সামগ্রিক পরিকল্পনার বিষয়টা মনোযোগে থাকছে না। আমাদের দেশেও অনেকগুলো ভালো পরিকল্পনা হয়েছে। যেমন ২০১৩ সালে হলো, বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার রূপকল্প বা ‘মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম’। এখন এই পরিকল্পনার অভিভাবক কে? এর দায়িত্ব তো আলাদাভাবে সড়ক, নৌ বা রেল কর্তৃপক্ষ নেবে না। তাহলে এটা বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? এই দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশনের। কিন্তু আমাদের কমিশনে কোনো পরিকল্পনাবিদ নেই। সেখানকার কর্তারা খালি বাজেট দেখেন আর কাটছাঁট করেন। এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে, এখানে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনায় কোনো জোর নেই।
দেশ রূপান্তর: আমরা বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে এলাম। সংগত কারণেই বিগত পঞ্চাশ বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর আগামীর সম্ভাবনার কথা সামনে আসছে। এক্ষেত্রে বিশেষত আগামীতে বাংলাদেশের নৌপথ ও নৌপরিবহনের অর্থে যেমন তেমনি নদ-নদী-জলাশয় বাঁচিয়ে রাখার সম্ভাবনা কতটুকু বলে মনে করেন?
ড. এম শামসুল হক: এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ যেটা করা হয়েছে সেটা আশাব্যঞ্জক। এখন নদীভিত্তিক রি-জুভিনিশনের বিষয়টা যদি মাথায় রাখা হয় আর একটা সমন্বিত পদক্ষেপ যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে সত্যিকার অর্থেই সম্ভাবনা আছে। এই পরিকল্পনাটা নেদারল্যান্ডসের সহায়তায় করা হয়েছে। কিন্তু সেদেশে সুশাসন আছে। এখানে নেই। ফলে একটা বলিষ্ঠ রেগুলেটরি অথরিটি, একটা নলেজ এমপাওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য অবশ্যই সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে।