একপক্ষীয় পার্লামেন্টে নির্বাচন কমিশন আইন করা সমীচীন হবে না
খালেকুজ্জামান
খালেকুজ্জামান বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। রাষ্ট্রপতির সংলাপ, নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন। আপনারা সংলাপে অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন ইতিমধ্যে। সংলাপে অংশ না নেওয়ার কারণ কী?
খালেকুজ্জামান : আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, এর আগে ২০১১ সালের ২৭ জুন এবং ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে এবং ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে আমরা উপস্থিত হয়ে আমাদের লিখিত মতামত ও মৌখিক বক্তব্য পেশ করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমাদের চিন্তা ও মতামতকে সমৃদ্ধ করা কিংবা সংশোধিত করার লক্ষ্যে শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতি, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দিক থেকে কোনো পদক্ষেপ না থাকায় আমরা আমাদের বক্তব্যের সীমাবদ্ধতা কিংবা কার্যকারিতা কোনোটাই বুঝে উঠতে পারিনি। সেই দুর্বলতা নিয়েই বর্তমানের আলোচ্য বিষয় ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা’ অনুষ্ঠানে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা এর আগেও সংলাপে অংশ নিয়েছিলাম ও কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি বলেই দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে সংলাপে অংশ নিলেও বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তরণের ব্যাপারে আস্থার অভাব থেকেই যায়। এভাবে মতামত উপেক্ষা করে কমিশন গঠনের দিকে এগিয়ে গেলে পারিপার্শ্বিক, দূরবর্তী ও পরোক্ষ বহু বিষয়ও সংশ্লিষ্ট রয়েছে যেগুলো বিবেচনায় এনে সুরাহা না করলে, অতীতের মতো আপাত মীমাংসা, পরবর্তী সময়ে জিঘাংসার জন্ম দিতে পারে। তাই আমরা সংলাপে অংশ নিইনি। তবে কিছু প্রস্তাব চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি।
দেশ রূপান্তর : নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আপনাদের প্রস্তাব কী?
খালেকুজ্জামান : ‘নির্বাচন কমিশন: সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ : নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ প্রসঙ্গে ‘কোন আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন’ বলে যা নির্দেশিত হয়েছে, সেই আইনটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত করা হয়নি। ফলে আইনটি ও তার বিধানাবলি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তবে বর্তমান একপক্ষীয় পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তড়িঘড়ি করে আইনের খসড়া ব্যাপক পরিসরে আলোচনা-পর্যালোচনা না করেই করা সমীচীন হবে না, বরং তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এবং বিদ্যমান আস্থার সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
আমরা লিঙ্গবৈষম্য যথাসম্ভব দূর করে নির্বাচন কমিশনকে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্র এই চার স্তরে স্থায়ী জনবলসহ স্বতন্ত্র কাঠামোয় দাঁড় করানোর কথা বলেছি। লিঙ্গবৈষম্য যথাসম্ভব দূর করে ‘সার্চ কমিটি’ বা ‘সিলেক্ট কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি দলের ১ জন মনোনীত প্রতিনিধি, নিবন্ধিত দলসমূহের বাইরে ক্রিয়াশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী সেক্যুলার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দল ও শক্তির প্রতিনিধি, বিচার বিভাগ কর্তৃক মনোনীত আপিলেট ডিভিশনের ১ জন বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ বা সিলেক্ট কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি কর্তৃক মোট উত্থাপিত নামের মধ্য থেকে সর্বসম্মতিতে বা ভোটে দশ জনের প্যানেল তৈরি করবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে কেন্দ্রীয় কমিশনের ৯ জন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। কমিশনাররা নিজেদের মধ্য থেকে ঐকমত্যে অথবা সর্বোচ্চ ভোটে একজনকে নির্বাচিত করবেন, তাকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দান করবেন। অন্যান্য কাঠামোর প্রধানসহ কমিশনাররা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে বিধানাবলি সাপেক্ষে (যা প্রণয়ন করতে হবে) নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
জাতীয় বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য পৃথক সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে (স্থায়ী কাঠামোগত ব্যয় ও নির্বাচনী খরচ)। যাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বমুক্ত অর্থ ছাড় করার ব্যবস্থা থাকবে।
নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন কমিশন সচিবালয় পরিচালিত হবে ও জনবল সংগৃহীত হবে। নির্বাচনকে টাকা, পেশিশক্তি, আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, নির্বাচনমুখী দান-অনুদান, রাজনৈতিক দলীয় এবং কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তিসহ যে কোনো প্রতিবন্ধকতা মুক্ত রাখতে সারা বছরের অনুসন্ধান, গবেষণা ও দুদকসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় প্রতিকারমূলক কার্যক্রম কমিশন সচিবালয়কে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে নিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি নির্বাচন কমিশন আইন করা যায়নি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর দায় কতটুকু?
খালেকুজ্জামান : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণআকাক্সক্ষার আপেক্ষিকভাবে যতটুকু প্রতিফলন আমাদের ৭২ সালের সংবিধানে ঘটেছিল, সে অঙ্গীকার ৫০ বছরে শাসকশ্রেণি রক্ষা করতে পারেনি, বহু ক্ষেত্রে বিকৃতি সাধন ও পশ্চাৎগমনেও দ্বিধা করেনি। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, সংস্কৃতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক সরকার দাঁড়ায়নি, নির্বাচিত-অনির্বাচিত স্বৈরশাসন ও তারই উত্তরাধিকার বহনের পথে দেশ পরিচালিত হয়ে এসেছে। এ যাবৎকাল একটি নির্বাচনও অংশগ্রহণকারী সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। জাতীয় সংসদ কার্যকর ছিল না, এখনো কার্যকর নয়, একদলীয় ও একপক্ষীয় সংসদ চলছে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত প্রধান দুই বুর্জোয়া দল কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। একের ধ্বংস অপরের টিকে থাকার শর্ত হয়ে উঠেছে। দেশের জনগণও এই দলসমূহের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে এ বিশ্বাস স্থাপন করে উঠতে পারেনি। তার জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা তদারকি রেফারি-সরকার ব্যবস্থা এসেছিল। তাকেও বিতর্কিত করা হয়েছে এবং তা বিলুপ্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আইন না হওয়াতে রাজনৈতিক দলসমূহের দায় অবশ্যই রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যে সব দল শাসনক্ষমতায় ছিল তাদের দায় বেশি।
ব্যক্তি সন্ত্রাস, জঙ্গি সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রাজনীতির বাণিজ্য, বাণিজ্যের রাজনীতি ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, দুর্বৃত্তদের হাতে রাজনীতি হাত ধরাধরি করে চলছে। নীতি-আদর্শবাদী রাজনীতিকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা, আঞ্চলিক উত্তেজনা, দখলদারিত্বের বেপরোয়া অভিযান অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো মর্যাদা হারাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারে যতটা উচ্চগামী, মানের দিক থেকে ততোধিক নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ সব সেবা কার্যক্রমে গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নামে যতটা প্রচারিত ততটাই তারা বঞ্চিত। উচ্ছেদ ও নিপীড়ন আতঙ্কে আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবোধ বেড়ে চলেছে। নারী-শিশু নির্যাতন সীমাহীন। তারপরও আমরা আশাবাদী। কারণ যে জনগোষ্ঠী রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করেছে তারাই ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে।
দেশ রূপান্তর : এইভাবে আপনাদের মতামত উপেক্ষা করে যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় তবে সেই কমিশনের অধীনে আপনারা নির্বাচনে যাবেন কি না?
খালেকুজ্জামান : আমরা আগাগোড়া এই জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আমরা অনেক সময়ে নির্বাচনে গিয়েছি, অনেক সময়ে যাইনি। যেমন আমরা এরশাদের সময়ে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে যাইনি। ১৯৯৬-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনার সময়ে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনে যাইনি। এখনই বলা মুশকিল যে, আমরা সামনের নির্বাচনে যাব কি না। যদি জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলনের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিস্থিতি দেখা যায় তবেই আমরা নির্বাচনে যাব। তাই এখনই আগামী নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত মতামত দেওয়া যাবে না।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
খালেকুজ্জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

খালেকুজ্জামান বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। রাষ্ট্রপতির সংলাপ, নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। নতুন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছেন। আপনারা সংলাপে অংশ নেবেন না বলে জানিয়েছেন ইতিমধ্যে। সংলাপে অংশ না নেওয়ার কারণ কী?
খালেকুজ্জামান : আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, এর আগে ২০১১ সালের ২৭ জুন এবং ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর নির্বাচন কমিশনের আমন্ত্রণে এবং ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে আমরা উপস্থিত হয়ে আমাদের লিখিত মতামত ও মৌখিক বক্তব্য পেশ করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আমাদের চিন্তা ও মতামতকে সমৃদ্ধ করা কিংবা সংশোধিত করার লক্ষ্যে শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রপতি, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দিক থেকে কোনো পদক্ষেপ না থাকায় আমরা আমাদের বক্তব্যের সীমাবদ্ধতা কিংবা কার্যকারিতা কোনোটাই বুঝে উঠতে পারিনি। সেই দুর্বলতা নিয়েই বর্তমানের আলোচ্য বিষয় ‘নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা’ অনুষ্ঠানে আমাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা এর আগেও সংলাপে অংশ নিয়েছিলাম ও কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি বলেই দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন করে সংলাপে অংশ নিলেও বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তরণের ব্যাপারে আস্থার অভাব থেকেই যায়। এভাবে মতামত উপেক্ষা করে কমিশন গঠনের দিকে এগিয়ে গেলে পারিপার্শ্বিক, দূরবর্তী ও পরোক্ষ বহু বিষয়ও সংশ্লিষ্ট রয়েছে যেগুলো বিবেচনায় এনে সুরাহা না করলে, অতীতের মতো আপাত মীমাংসা, পরবর্তী সময়ে জিঘাংসার জন্ম দিতে পারে। তাই আমরা সংলাপে অংশ নিইনি। তবে কিছু প্রস্তাব চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি।
দেশ রূপান্তর : নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আপনাদের প্রস্তাব কী?
খালেকুজ্জামান : ‘নির্বাচন কমিশন: সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৮ : নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা’ প্রসঙ্গে ‘কোন আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন’ বলে যা নির্দেশিত হয়েছে, সেই আইনটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত করা হয়নি। ফলে আইনটি ও তার বিধানাবলি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। তবে বর্তমান একপক্ষীয় পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তড়িঘড়ি করে আইনের খসড়া ব্যাপক পরিসরে আলোচনা-পর্যালোচনা না করেই করা সমীচীন হবে না, বরং তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে এবং বিদ্যমান আস্থার সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
আমরা লিঙ্গবৈষম্য যথাসম্ভব দূর করে নির্বাচন কমিশনকে উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও কেন্দ্র এই চার স্তরে স্থায়ী জনবলসহ স্বতন্ত্র কাঠামোয় দাঁড় করানোর কথা বলেছি। লিঙ্গবৈষম্য যথাসম্ভব দূর করে ‘সার্চ কমিটি’ বা ‘সিলেক্ট কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি দলের ১ জন মনোনীত প্রতিনিধি, নিবন্ধিত দলসমূহের বাইরে ক্রিয়াশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী সেক্যুলার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দল ও শক্তির প্রতিনিধি, বিচার বিভাগ কর্তৃক মনোনীত আপিলেট ডিভিশনের ১ জন বিচারপতির সমন্বয়ে সার্চ বা সিলেক্ট কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি কর্তৃক মোট উত্থাপিত নামের মধ্য থেকে সর্বসম্মতিতে বা ভোটে দশ জনের প্যানেল তৈরি করবেন। রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে কেন্দ্রীয় কমিশনের ৯ জন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। কমিশনাররা নিজেদের মধ্য থেকে ঐকমত্যে অথবা সর্বোচ্চ ভোটে একজনকে নির্বাচিত করবেন, তাকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দান করবেন। অন্যান্য কাঠামোর প্রধানসহ কমিশনাররা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে বিধানাবলি সাপেক্ষে (যা প্রণয়ন করতে হবে) নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।
জাতীয় বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য পৃথক সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে (স্থায়ী কাঠামোগত ব্যয় ও নির্বাচনী খরচ)। যাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বমুক্ত অর্থ ছাড় করার ব্যবস্থা থাকবে।
নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন কমিশন সচিবালয় পরিচালিত হবে ও জনবল সংগৃহীত হবে। নির্বাচনকে টাকা, পেশিশক্তি, আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, নির্বাচনমুখী দান-অনুদান, রাজনৈতিক দলীয় এবং কায়েমি স্বার্থবাদী শক্তিসহ যে কোনো প্রতিবন্ধকতা মুক্ত রাখতে সারা বছরের অনুসন্ধান, গবেষণা ও দুদকসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় প্রতিকারমূলক কার্যক্রম কমিশন সচিবালয়কে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে নিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি নির্বাচন কমিশন আইন করা যায়নি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর দায় কতটুকু?
খালেকুজ্জামান : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণআকাক্সক্ষার আপেক্ষিকভাবে যতটুকু প্রতিফলন আমাদের ৭২ সালের সংবিধানে ঘটেছিল, সে অঙ্গীকার ৫০ বছরে শাসকশ্রেণি রক্ষা করতে পারেনি, বহু ক্ষেত্রে বিকৃতি সাধন ও পশ্চাৎগমনেও দ্বিধা করেনি। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, সংস্কৃতি, প্রথা-প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক সরকার দাঁড়ায়নি, নির্বাচিত-অনির্বাচিত স্বৈরশাসন ও তারই উত্তরাধিকার বহনের পথে দেশ পরিচালিত হয়ে এসেছে। এ যাবৎকাল একটি নির্বাচনও অংশগ্রহণকারী সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। জাতীয় সংসদ কার্যকর ছিল না, এখনো কার্যকর নয়, একদলীয় ও একপক্ষীয় সংসদ চলছে। ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাবহির্ভূত প্রধান দুই বুর্জোয়া দল কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। একের ধ্বংস অপরের টিকে থাকার শর্ত হয়ে উঠেছে। দেশের জনগণও এই দলসমূহের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে এ বিশ্বাস স্থাপন করে উঠতে পারেনি। তার জন্য তত্ত্বাবধায়ক বা তদারকি রেফারি-সরকার ব্যবস্থা এসেছিল। তাকেও বিতর্কিত করা হয়েছে এবং তা বিলুপ্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন আইন না হওয়াতে রাজনৈতিক দলসমূহের দায় অবশ্যই রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যে সব দল শাসনক্ষমতায় ছিল তাদের দায় বেশি।
ব্যক্তি সন্ত্রাস, জঙ্গি সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রাজনীতির বাণিজ্য, বাণিজ্যের রাজনীতি ও দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি, দুর্বৃত্তদের হাতে রাজনীতি হাত ধরাধরি করে চলছে। নীতি-আদর্শবাদী রাজনীতিকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা, আঞ্চলিক উত্তেজনা, দখলদারিত্বের বেপরোয়া অভিযান অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়ে চলেছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো মর্যাদা হারাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারে যতটা উচ্চগামী, মানের দিক থেকে ততোধিক নিম্নগামী হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ সব সেবা কার্যক্রমে গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নামে যতটা প্রচারিত ততটাই তারা বঞ্চিত। উচ্ছেদ ও নিপীড়ন আতঙ্কে আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবোধ বেড়ে চলেছে। নারী-শিশু নির্যাতন সীমাহীন। তারপরও আমরা আশাবাদী। কারণ যে জনগোষ্ঠী রক্ত ঢেলে দেশকে স্বাধীন করেছে তারাই ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে।
দেশ রূপান্তর : এইভাবে আপনাদের মতামত উপেক্ষা করে যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন গঠিত হয় তবে সেই কমিশনের অধীনে আপনারা নির্বাচনে যাবেন কি না?
খালেকুজ্জামান : আমরা আগাগোড়া এই জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা, মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি। আমরা অনেক সময়ে নির্বাচনে গিয়েছি, অনেক সময়ে যাইনি। যেমন আমরা এরশাদের সময়ে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে যাইনি। ১৯৯৬-তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনার সময়ে যে নির্বাচন হয়েছিল সেই নির্বাচনে যাইনি। এখনই বলা মুশকিল যে, আমরা সামনের নির্বাচনে যাব কি না। যদি জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলনের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিস্থিতি দেখা যায় তবেই আমরা নির্বাচনে যাব। তাই এখনই আগামী নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত মতামত দেওয়া যাবে না।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
খালেকুজ্জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ।