করোনা নাই হয়ে গেছে এটা ভেবে স্বাস্থ্যবিধিতে উদাসীনতা নয়
ডা. মুশতাক হোসেন
জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি চলতি মার্চ থেকে বিশ্বব্যাংকের ‘রিস্ক কমিউনিকেশন’ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএস-সিডিসির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি আইইডিসিআরের চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি, করোনার সামাজিক সংক্রমণ কমে আসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে পাঠদান শুরুসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহসান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : দেশে বর্তমানে করোনার যে অবস্থা সেটিকে কীভাবে দেখছেন? করোনা এখনো কতটা ভীতিকর বলে মনে করেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : দেখুন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, মনে করাটা ভালো। তাহলে মানুষ ভয়ভীতি বা গুজব দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বদলে যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হবে। কিন্তু সবকিছু যদি শিথিল হয়ে যায়, স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলাফেরা শুরু করে সবাই তাহলে বিপদ আছে। আমরা যদি মাস্ক না পরি, যেখানে সেখানে থুুতু ফেলি, বারবার সাবান দিয়ে হাত না ধুই, পরস্পর নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব রাখাটা না মেনে চলি, তাহলে কিন্তু আমাদের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। বিভিন্ন দেশে আমরা এমনটা দেখেছি। অনেক বড় বড় উন্নত পশ্চিমা দেশেও এমন ঘটেছিল। তারা বলছিল চীনের এই ভাইরাস আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থাকা সত্ত্বেও তারা করোনার সংক্রমণ রোধ করতে পারেননি। করোনা মোকাবিলা করতে পারেননি। তাই বলছি, করোনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চড়া মূল্য দিতে হবে। তাই আমাদের অবশ্যই স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকা- এবং জীবন-জীবিকার সংগ্রামের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, শতকরা ১০ ভাগ মানুষও যদি যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানে তাহলে বাকি ৯০ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেও সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। তাই সারা দেশের সব মানুষকেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। করোনা নাই হয়ে গেছে এটা ভেবে স্বাস্থ্যবিধিতে উদাসীনতা করা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : চলতি বছরের শুরুতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। একটা পর্যায়ে বেশ আশঙ্কাজনক হারে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। এবার প্রথম বারের মতো লকডাউন দেওয়া হয়নি, আবার জনসাধারণের মধ্যেও করোনার বিধিনিষেধ মেনে চলায় এক ধরনের শিথিলতা দেখা দিয়েছে। তবে টিকা কার্যক্রম বেশ জোরেশোরেই হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে করোনার সংক্রমণ কমে আসছে। এর পেছনে টিকার সফলতা নাকি অন্যকিছু কাজ করেছে?
ডা. মুশতাক হোসেন : টিকার একটি সুফল পেয়েছি সত্যি। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আমাদের যাদের করোনা শনাক্ত হচ্ছে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আক্রান্তদের আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। শনাক্ত রোগীদের জন্য একটি ভালো ব্যবস্থা করা গেলে নতুন উপসর্গধারীরা শনাক্তে আরও এগিয়ে আসবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে। সবাইকে টিকা দিতে হবে। পুরো জনগোষ্ঠীকে করোনার ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে।
এইসব কাজের সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে প্রথমত সরকারি নেতৃত্বে, সরকারের পরিকল্পনা মাফিক একটি নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এটা মোটামুটি এখন হচ্ছে। এরপর যে বিষয়ে জোর দিতে হবে, তা হচ্ছে জনসাধারণকে সব কাজে সম্পৃক্ত করা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে যদি জনসাধারণকে এসব কাজে যুক্ত করা যায় তবে এখন যে ফলাফল আসছে, তারচেয়ে আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে। আমাদের জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা রয়েছে। তারা করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করাতে অনীহা দেখান। টিকা গ্রহণে নেতিবাচক ধারণা প্রচার করেন। এমন পরিস্থিতিতে যদি এলাকার নেতৃস্থানীয়রা বা জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে আসেন এবং লোকজনকে বলেন যে, তোমার জ¦র হয়েছে, পরীক্ষা করাও। আক্রান্ত হলে যদি বলা হয়, তুমি ঘরে অবস্থান করো। তোমার বাসায় খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। তাহলে কিন্তু লোকজন নিয়ম মানবে। ঘরে থাকবে। নতুন সংক্রমণ এতে কমে আসবে। কিংবা বলেন যে, তোমার বয়স হয়েছে এখন টিকা দিতে পারবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি বলেন, অযথা বাইরে জনসমাগম করা যাবে না, মসজিদে কম লোকের উপস্থিতি থাকতে হবে, দুর্যোগকালে ঘরে বসে নামাজ আদায় করো তাহলে সংক্রমণের ছড়িয়ে পড়াটা অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে। এলাকার যারা নেতৃস্থানীয় আছেন, তারা যদি বলেন তবে অনেকেই তা মানবেন। মসজিদের ইমাম সাহেব যদি বলেন তবে মুসল্লিরা বুঝবেন। এভাবে পারিবারিক দাওয়াত থেকে শুরু করে জনসমাগম হয় এমন সবকিছু যদি কমানো যায়, যদি সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তবে সুফল আসবে।
সমাজের বয়োবৃদ্ধ এবং পিছিয়ে পড়াদের টিকার রেজিস্ট্রেশনে সহায়তা করতে হবে। টিকাকেন্দ্র খুঁজে পেতে যদি একজন আরেক জনকে সাহায্য করে তবে টিকাগ্রহীতার সংখ্যাও বাড়বে। এছাড়া এখন তো ইউনিয়ন পর্যায়ে কেবল ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখিয়েই টিকা নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে। করোনা শনাক্ত এবং টিকাদানের প্রতি মানুষের ভীতি কমাতে কাজ করতে হবে। মানুষ যদি মানুষের কাজে সহায়ক হয়ে এগিয়ে আসে তাহলে করোনার বিপক্ষে লড়াই করা সহজ হবে। জনসাধারণকে সংযুক্ত করা গেলে সুফল মিলবে। নইলে কেবল সরকারি কর্মচারী দিয়ে কাজ করিয়ে সুফল আশা করা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : সরকার যেভাবে গণটিকার কর্মসূচি পালন করছে এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? সব শ্রেণির মানুষের জন্য টিকা সহজলভ্য করতে এই কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে, আপনার কী মনে হয় এই লক্ষ্য সফল হবে?
ডা. মুশতাক হোসেন : দেশে প্রতি বছর একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া হয়। নারী ও শিশুদের নিয়মিত টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এসব নিয়ে কর্মসূচিও রয়েছে। এসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির স্থায়ী কর্মী ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। এখন করোনার টিকা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে সহজেই টিকাদানে জনসাধারণকে উৎসাহী করা থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ের কাজ করা সম্ভব। এলাকাভিত্তিক এইভাবে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। কারণ এলাকার ছেলেমেয়েদের কথা লোকজন শুনবে। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে লোকজনকে সচেতন করার চেয়ে এলাকার শিক্ষার্থী বা এলাকার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি লোকজনকে বুঝিয়ে বলেন, সেটি বেশি সুফল দেবে।
দেশ রূপান্তর : রাস্তাঘাটে বের হলে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি অবহেলিত দেখা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে করোনার ভীতি কমে আসছে বলে মনে হয়। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধিতে উদাসীনতায় আবার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : খেয়াল করতে হবে যারা মাস্ক পরছেন না বা পরতে পারছেন না তাদের একটা বড় অংশই শ্রমজীবী মানুষ। গায়ে-গতরে খেটে কাজ করা এই মানুষদের কাছে মাস্ক কেনার চেয়েও দিনের খাবারের টাকা জোগাড় করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আমি অনুরোধ করব আপনারা শ্রমিক এলাকাগুলোতে, বস্তিগুলোতে বস্তা ভর্তি করে কাপড়ে তৈরি ধুয়ে ব্যবহার করার উপযোগী মাস্ক নিয়ে যান। শ্রমিক-দিনমজুরদের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করুন। কারখানাগুলোতে যান। কারাখানার মালিকদের বলুন সব শ্রমিককে পাঁচ-সাতটা করে মাস্ক দিতে। আপনারা ঘনবসতি এলাকাগুলোতে গিয়ে নারীদের কাপড়ের মাস্ক তৈরি করার কাজ দিন। তাদের বলুন, আপনাদের কাছ থেকে আমরা ৫ টাকা করে মাস্ক কিনে নেব। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলছেন, কিন্তু ঘনবসতি এলাকাগুলোতে তো বিপুলসংখ্যক মানুষের পানির সরবরাহ নেই, হাত ধোয়ার বেসিন নেই। তাদের জন্য অন্তত চলমান পানির ধারা নিশ্চিত করুন। এসব কাজে স্থানীয় কমিউনিটিকে সংযুক্ত করুন। তরুণ-তরুণীদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করুন। এভাবে পাড়া-মহল্লায় কমিউনিটি পর্যায়ে সবার কাছে এই বার্তাটা পৌঁছে দিতে হবে যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। তারপর আপনি বলতে পারেন যে, মাস্ক না পরলে জরিমানা করা হবে, শাস্তি দেওয়া হবে। তা না করে শুধু ভয় দেখিয়ে তো মানুষকে বাধ্য করা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : দীর্ঘদিন পরে দেশে সশরীরে শ্রেণিপাঠদান শুরু হয়েছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : দেখেন, কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যে করোনা ছড়িয়ে পড়ে তা তো নয়। করোনার প্রভাবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আর সব কিছু খুলে রাখা হয়েছিল। তাতে ফল কী হয়েছে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। কিন্তু অফিস, ব্যাংক, শপিংমল তো খোলা ছিল। তাহলে কীভাবে হবে! করোনা লোকসমাগমের স্থলে ছড়িয়ে পড়ে বেশি, কিন্তু আমরা তো লোকসমাগমের অন্য স্থানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।
দেশ রূপান্তর : একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না?
ডা. মুশতাক হোসেন : প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে শনাক্ত রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আইসোলেশন করা গেলে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এই সময়ে করোনা থেকে এড়াতে যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে তা যথাযথ মানতে হবে। আমরা সবাইকে টিকা দিয়ে দেব। টিকা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষা দেবে।
দেশ রূপান্তর : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ডা. মুশতাক হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি চলতি মার্চ থেকে বিশ্বব্যাংকের ‘রিস্ক কমিউনিকেশন’ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএস-সিডিসির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি আইইডিসিআরের চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। দেশে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি, করোনার সামাজিক সংক্রমণ কমে আসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে পাঠদান শুরুসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহসান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : দেশে বর্তমানে করোনার যে অবস্থা সেটিকে কীভাবে দেখছেন? করোনা এখনো কতটা ভীতিকর বলে মনে করেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : দেখুন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে, মনে করাটা ভালো। তাহলে মানুষ ভয়ভীতি বা গুজব দ্বারা পরিচালিত হওয়ার বদলে যুক্তি দিয়ে পরিচালিত হবে। কিন্তু সবকিছু যদি শিথিল হয়ে যায়, স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই চলাফেরা শুরু করে সবাই তাহলে বিপদ আছে। আমরা যদি মাস্ক না পরি, যেখানে সেখানে থুুতু ফেলি, বারবার সাবান দিয়ে হাত না ধুই, পরস্পর নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব রাখাটা না মেনে চলি, তাহলে কিন্তু আমাদের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। বিভিন্ন দেশে আমরা এমনটা দেখেছি। অনেক বড় বড় উন্নত পশ্চিমা দেশেও এমন ঘটেছিল। তারা বলছিল চীনের এই ভাইরাস আমাদের কিচ্ছু করতে পারবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা থাকা সত্ত্বেও তারা করোনার সংক্রমণ রোধ করতে পারেননি। করোনা মোকাবিলা করতে পারেননি। তাই বলছি, করোনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চড়া মূল্য দিতে হবে। তাই আমাদের অবশ্যই স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকা- এবং জীবন-জীবিকার সংগ্রামের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, শতকরা ১০ ভাগ মানুষও যদি যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি না মানে তাহলে বাকি ৯০ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললেও সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। তাই সারা দেশের সব মানুষকেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। করোনা নাই হয়ে গেছে এটা ভেবে স্বাস্থ্যবিধিতে উদাসীনতা করা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : চলতি বছরের শুরুতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। একটা পর্যায়ে বেশ আশঙ্কাজনক হারে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। এবার প্রথম বারের মতো লকডাউন দেওয়া হয়নি, আবার জনসাধারণের মধ্যেও করোনার বিধিনিষেধ মেনে চলায় এক ধরনের শিথিলতা দেখা দিয়েছে। তবে টিকা কার্যক্রম বেশ জোরেশোরেই হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে করোনার সংক্রমণ কমে আসছে। এর পেছনে টিকার সফলতা নাকি অন্যকিছু কাজ করেছে?
ডা. মুশতাক হোসেন : টিকার একটি সুফল পেয়েছি সত্যি। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আমাদের যাদের করোনা শনাক্ত হচ্ছে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আক্রান্তদের আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। শনাক্ত রোগীদের জন্য একটি ভালো ব্যবস্থা করা গেলে নতুন উপসর্গধারীরা শনাক্তে আরও এগিয়ে আসবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সবাইকে। সবাইকে টিকা দিতে হবে। পুরো জনগোষ্ঠীকে করোনার ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে।
এইসব কাজের সফলতার চাবিকাঠি হচ্ছে প্রথমত সরকারি নেতৃত্বে, সরকারের পরিকল্পনা মাফিক একটি নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এটা মোটামুটি এখন হচ্ছে। এরপর যে বিষয়ে জোর দিতে হবে, তা হচ্ছে জনসাধারণকে সব কাজে সম্পৃক্ত করা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে যদি জনসাধারণকে এসব কাজে যুক্ত করা যায় তবে এখন যে ফলাফল আসছে, তারচেয়ে আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে। আমাদের জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা রয়েছে। তারা করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করাতে অনীহা দেখান। টিকা গ্রহণে নেতিবাচক ধারণা প্রচার করেন। এমন পরিস্থিতিতে যদি এলাকার নেতৃস্থানীয়রা বা জনপ্রতিনিধিরা এগিয়ে আসেন এবং লোকজনকে বলেন যে, তোমার জ¦র হয়েছে, পরীক্ষা করাও। আক্রান্ত হলে যদি বলা হয়, তুমি ঘরে অবস্থান করো। তোমার বাসায় খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। তাহলে কিন্তু লোকজন নিয়ম মানবে। ঘরে থাকবে। নতুন সংক্রমণ এতে কমে আসবে। কিংবা বলেন যে, তোমার বয়স হয়েছে এখন টিকা দিতে পারবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যদি বলেন, অযথা বাইরে জনসমাগম করা যাবে না, মসজিদে কম লোকের উপস্থিতি থাকতে হবে, দুর্যোগকালে ঘরে বসে নামাজ আদায় করো তাহলে সংক্রমণের ছড়িয়ে পড়াটা অনেকটা রোধ করা সম্ভব হবে। এলাকার যারা নেতৃস্থানীয় আছেন, তারা যদি বলেন তবে অনেকেই তা মানবেন। মসজিদের ইমাম সাহেব যদি বলেন তবে মুসল্লিরা বুঝবেন। এভাবে পারিবারিক দাওয়াত থেকে শুরু করে জনসমাগম হয় এমন সবকিছু যদি কমানো যায়, যদি সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তবে সুফল আসবে।
সমাজের বয়োবৃদ্ধ এবং পিছিয়ে পড়াদের টিকার রেজিস্ট্রেশনে সহায়তা করতে হবে। টিকাকেন্দ্র খুঁজে পেতে যদি একজন আরেক জনকে সাহায্য করে তবে টিকাগ্রহীতার সংখ্যাও বাড়বে। এছাড়া এখন তো ইউনিয়ন পর্যায়ে কেবল ন্যাশনাল আইডি কার্ড দেখিয়েই টিকা নেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছে এই বার্তাটি পৌঁছে দিতে হবে। করোনা শনাক্ত এবং টিকাদানের প্রতি মানুষের ভীতি কমাতে কাজ করতে হবে। মানুষ যদি মানুষের কাজে সহায়ক হয়ে এগিয়ে আসে তাহলে করোনার বিপক্ষে লড়াই করা সহজ হবে। জনসাধারণকে সংযুক্ত করা গেলে সুফল মিলবে। নইলে কেবল সরকারি কর্মচারী দিয়ে কাজ করিয়ে সুফল আশা করা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : সরকার যেভাবে গণটিকার কর্মসূচি পালন করছে এই বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? সব শ্রেণির মানুষের জন্য টিকা সহজলভ্য করতে এই কর্মসূচির কথা বলা হচ্ছে, আপনার কী মনে হয় এই লক্ষ্য সফল হবে?
ডা. মুশতাক হোসেন : দেশে প্রতি বছর একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া হয়। নারী ও শিশুদের নিয়মিত টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এসব নিয়ে কর্মসূচিও রয়েছে। এসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির স্থায়ী কর্মী ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। এখন করোনার টিকা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে সহজেই টিকাদানে জনসাধারণকে উৎসাহী করা থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ের কাজ করা সম্ভব। এলাকাভিত্তিক এইভাবে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। কারণ এলাকার ছেলেমেয়েদের কথা লোকজন শুনবে। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে লোকজনকে সচেতন করার চেয়ে এলাকার শিক্ষার্থী বা এলাকার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি লোকজনকে বুঝিয়ে বলেন, সেটি বেশি সুফল দেবে।
দেশ রূপান্তর : রাস্তাঘাটে বের হলে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি অবহেলিত দেখা যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে করোনার ভীতি কমে আসছে বলে মনে হয়। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধিতে উদাসীনতায় আবার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : খেয়াল করতে হবে যারা মাস্ক পরছেন না বা পরতে পারছেন না তাদের একটা বড় অংশই শ্রমজীবী মানুষ। গায়ে-গতরে খেটে কাজ করা এই মানুষদের কাছে মাস্ক কেনার চেয়েও দিনের খাবারের টাকা জোগাড় করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে আমি অনুরোধ করব আপনারা শ্রমিক এলাকাগুলোতে, বস্তিগুলোতে বস্তা ভর্তি করে কাপড়ে তৈরি ধুয়ে ব্যবহার করার উপযোগী মাস্ক নিয়ে যান। শ্রমিক-দিনমজুরদের মধ্যে মাস্ক বিতরণ করুন। কারখানাগুলোতে যান। কারাখানার মালিকদের বলুন সব শ্রমিককে পাঁচ-সাতটা করে মাস্ক দিতে। আপনারা ঘনবসতি এলাকাগুলোতে গিয়ে নারীদের কাপড়ের মাস্ক তৈরি করার কাজ দিন। তাদের বলুন, আপনাদের কাছ থেকে আমরা ৫ টাকা করে মাস্ক কিনে নেব। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলছেন, কিন্তু ঘনবসতি এলাকাগুলোতে তো বিপুলসংখ্যক মানুষের পানির সরবরাহ নেই, হাত ধোয়ার বেসিন নেই। তাদের জন্য অন্তত চলমান পানির ধারা নিশ্চিত করুন। এসব কাজে স্থানীয় কমিউনিটিকে সংযুক্ত করুন। তরুণ-তরুণীদের নিয়ে এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করুন। এভাবে পাড়া-মহল্লায় কমিউনিটি পর্যায়ে সবার কাছে এই বার্তাটা পৌঁছে দিতে হবে যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। তারপর আপনি বলতে পারেন যে, মাস্ক না পরলে জরিমানা করা হবে, শাস্তি দেওয়া হবে। তা না করে শুধু ভয় দেখিয়ে তো মানুষকে বাধ্য করা যাবে না।
দেশ রূপান্তর : দীর্ঘদিন পরে দেশে সশরীরে শ্রেণিপাঠদান শুরু হয়েছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : দেখেন, কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই যে করোনা ছড়িয়ে পড়ে তা তো নয়। করোনার প্রভাবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে আর সব কিছু খুলে রাখা হয়েছিল। তাতে ফল কী হয়েছে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। কিন্তু অফিস, ব্যাংক, শপিংমল তো খোলা ছিল। তাহলে কীভাবে হবে! করোনা লোকসমাগমের স্থলে ছড়িয়ে পড়ে বেশি, কিন্তু আমরা তো লোকসমাগমের অন্য স্থানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।
দেশ রূপান্তর : একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি না?
ডা. মুশতাক হোসেন : প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে শনাক্ত রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা। আইসোলেশন করা গেলে নতুন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এই সময়ে করোনা থেকে এড়াতে যেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে তা যথাযথ মানতে হবে। আমরা সবাইকে টিকা দিয়ে দেব। টিকা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষা দেবে।
দেশ রূপান্তর : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ডা. মুশতাক হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ।