গণমাধ্যমকর্মী বিল অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। তার জন্ম ১৯৫৯ সালে শেরপুরে। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করেছে।
সম্প্রতি ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী বিল, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন এই সাংবাদিক নেতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২’ উপস্থাপিত হয়েছে। আমরা মনে করতে পারি, দেশে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য প্রথম আইন হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। তখন গণমাধ্যম বলতে ছিল শুধু সংবাদপত্র। এখন এতদিন পরে প্রস্তাবিত বিলটিকে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : ১৯৭৪ সালে গণমাধ্যম বলতে ছিল শুধু সংবাদপত্র। রেডিও এবং টেলিভিশন ছিল শুধু সরকারি, তাদের জন্য আলাদা আইন ছিল। ১৯৭৪-এর আইনটি কেবল সংবাদপত্রের কর্মীদের জন্য ছিল। ২০০৬ সালের তৎকালীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার কয়েকদিন আগে শ্রম আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের বিপদে ফেলে এই আইনটি বাতিল করে যায়। শ্রম আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের বলা হয়েছে, সংবাদপত্র শ্রমিক। সেখানে আবার অনলাইন এবং ব্রডকাস্ট অর্থাৎ রেডিও-টেলিভিশন কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
২০০৯ সাল থেকে শ্রম আইন কয়েক দফা সংশোধন করা হয়, ২০১৫ সালে শ্রম আইনের বিধিমালা তৈরি করা হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের শ্রমিক করেই রাখা হলো। ২৮ মার্চ ২০২২ ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল, ২০২২’ শিরোনামে সংসদে যেটি উত্থাপন করা হলো তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৬০ দিন সময় দিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। অথচ এর আগে ৬ বছর ধরে পরীক্ষ-নিরীক্ষা করার পরেই আইনটি সংসদে উঠেছিল।
এখন এই বিলটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। পর্যালোচনা করছি। এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি ৫৪টি ধারার মধ্যে ৩৭টি ধারাই সাংবাদিকবান্ধব নয় বলেও অনেকেই মতামত দিয়েছেন। আইনটি পাস হলে সাংবাদিকরা রুটি-রুজি এবং অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন না। তারা শ্রম আইনের সুবিধা পাবেন না। এই আইনে সাংবাদিকদের চাকরিজীবন শেষে সার্ভিস বেনিফিট অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন করার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এই আইনটিতে সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য আলাদা কিছু বলা হয়নি। তাই এটা একটা এখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ আইন বলে মনে হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিলটি সংসদে উত্থাপন করার পরে বিলটি ৬০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এর আগে যিনি তথ্যমন্ত্রী ছিলেন হাসানুল হক ইনু, তিনি এখন সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তাই এ বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে। তিনি যেহেতু বিষয়টি জানতেন তাই এখন আশা করি আলোচনা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে একটি সঠিক পথ পাবে বলে আশা করতে চাই।
দেশ রূপান্তর : আইনটি চূড়ান্ত করার আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হবে কি? যদি হয়ে থাকে তাহলে আপনারা কোনো মতামত দেবেন কি?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : আমরা প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে এখন আলোচনা করব। অংশীজনরা রয়েছেন। সরকার আমাদের কথা শুনতে চাইবে। এখনো আমাদের কিছু বলেননি। আমরা তাদের মতামত জানাব। আমরা চাই এই আইনটি যেন গণমাধ্যমকর্মীবান্ধব হয়। আমরা কমিটির সদস্যরা এই আইনটিকে প্রথমে পর্যালোচনা করব। ৬০ দিন সময় আছে। এই আইনটিকে সংবাদকর্মীদের জন্য উপযোগী করতে করণীয় বিষয়ে মতামত দেওয়ার চেষ্টা করব।
দেশ রূপান্তর : প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। খসড়াটিকে বৈষম্যমূলক হিসেবেও চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। তবে তথ্যমন্ত্রী বলছেন, টিআইবি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে এই বিবৃতি দিয়েছে। এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : টিআইবি যেভাবে কাজ করে, অর্থাৎ সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জবাবদিহি নিয়ে তার মধ্যে সাংবাদিকতাও রয়েছে। তারা সাংবাদিকতার জন্য পুরস্কার দিয়ে থাকে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাংবাদিকদের পুরস্কার দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই তারা যখন এটি বলছে এটা বলার একটি ন্যায্যতা তাদের আছে বলে আমার মনে হয়।
দেশ রূপান্তর : প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ শোনা যায়। এই বিষয়ে আপনার মতামত শুনতে চাই।
মনজুরুল আহসান বুলবুল : কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এটা সত্যি। কিন্তু এই আমলারাই যখন ভালো কাজ করেন, এর কৃতিত্ব কিন্তু রাজনৈতিক সরকারই নেয়। তাই কোনো আমলা যদি কোনো অন্যায্য কাজ করে থাকেন, তবে সেই মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি বা মন্ত্রীকেও সেই দায় নিতে হবে। মন্ত্রী যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন, তবে কোনো আমলার অসৎ উদ্দেশ্য থাকলেও তা নস্যাৎ হয়ে যায়। আমরা জানি যে, আমলাদের জবাবদিহি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় থাকে দেশের মানুষের কাছে।
দেশ রূপান্তর : এইবার ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে বাধা বা অন্তরায় হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে, ৫৭ ধারা। এই আইনটি সংশোধন বা বাতিলে আপনাদের কোনো উদ্যোগ আছে কি? সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : পৃথিবীতে প্রযুক্তি যেমন আমাদের জন্য তথ্যের সব ভা-ার উন্মুক্ত করেছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও তৈরি করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি যেমন তথ্য জগতে সবার জন্য অবারিত করেছে, তেমনি এর অপব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃত্ত দল। কিন্তু কিছু দুর্বৃত্তের জন্য এমন অবারিত সুযোগ যেমন সীমিত করা যায় না, তেমনি দুর্বৃত্তদের অবাধ বিচরণভূমি করা যায় না এই পৃথিবীকে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বেধড়ক অপব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকেই আপত্তি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে আইনটিকে আরও কঠোর করা হয়। ৫৭ ধারার যে অপব্যবহার হচ্ছিল, তা কিন্তু মন্ত্রীরাও স্বীকার করছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন, নতুন আইনে এ রকম উদ্বেগজনক কিছু থাকবে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াতেই আমরা দেখলাম : ওই ৫৭ ধারাই নানাভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে।
দেশ রূপান্তর : দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের চাওয়া কী?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : দেশের সংবাদমাধ্যমকর্মীরা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে যারা অপরাধ করে তাদের নিয়ন্ত্রণ বা দমনের জন্য কঠোর আইন চান। তবে সেই আইনের অপপ্রয়োগ যাতে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি চোখ রাঙিয়ে ভীতি না ছড়ায়, তারও নিশ্চয়তা চান। সহজ কথায় বলতে হলে পেশাদার সংবাদকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুরক্ষা চান।
দেশ রূপান্তর : এই চাওয়া কীভাবে নিশ্চিত করা যায় বলে মনে করেন?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : এমন একটি পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে কোনো সংবাদকর্মীর কোনো কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার হাতে হাতকড়া পরানোর আগে বিষয়টি নিবিড়ভাবে দেখা হয়। বিষয়টি কি ভুল, নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে উসকানি বা বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য করা হয়েছে, তা দেখা জরুরি। বিষয়টি যদি স্রেফ পেশাগত ভুল হয়, তাহলে সব সুযোগ দেওয়ার পরও যদি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চান, তাহলে মামলাও হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার নয়, সমন জারিই হোক গ্রহণযোগ্য পন্থা। আর যদি দেখা যায়, অপতথ্য দিয়ে, সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা না মেনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাহলে সেটি হবে তার ব্যক্তিগত দায়। এই দায় তাকে বহন করতে হবে। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পেশাদার সাংবাদিকরা নেবেন না।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মনজুরুল ইসলাম বুলবুল : আপনাকেও ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল। তার জন্ম ১৯৫৯ সালে শেরপুরে। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২০ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করেছে।
সম্প্রতি ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। গণমাধ্যমকর্মী বিল, সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন এই সাংবাদিক নেতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২’ উপস্থাপিত হয়েছে। আমরা মনে করতে পারি, দেশে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য প্রথম আইন হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। তখন গণমাধ্যম বলতে ছিল শুধু সংবাদপত্র। এখন এতদিন পরে প্রস্তাবিত বিলটিকে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : ১৯৭৪ সালে গণমাধ্যম বলতে ছিল শুধু সংবাদপত্র। রেডিও এবং টেলিভিশন ছিল শুধু সরকারি, তাদের জন্য আলাদা আইন ছিল। ১৯৭৪-এর আইনটি কেবল সংবাদপত্রের কর্মীদের জন্য ছিল। ২০০৬ সালের তৎকালীন সরকার ক্ষমতা ছাড়ার কয়েকদিন আগে শ্রম আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের বিপদে ফেলে এই আইনটি বাতিল করে যায়। শ্রম আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের বলা হয়েছে, সংবাদপত্র শ্রমিক। সেখানে আবার অনলাইন এবং ব্রডকাস্ট অর্থাৎ রেডিও-টেলিভিশন কর্মীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
২০০৯ সাল থেকে শ্রম আইন কয়েক দফা সংশোধন করা হয়, ২০১৫ সালে শ্রম আইনের বিধিমালা তৈরি করা হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের শ্রমিক করেই রাখা হলো। ২৮ মার্চ ২০২২ ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল, ২০২২’ শিরোনামে সংসদে যেটি উত্থাপন করা হলো তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৬০ দিন সময় দিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। অথচ এর আগে ৬ বছর ধরে পরীক্ষ-নিরীক্ষা করার পরেই আইনটি সংসদে উঠেছিল।
এখন এই বিলটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। পর্যালোচনা করছি। এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি ৫৪টি ধারার মধ্যে ৩৭টি ধারাই সাংবাদিকবান্ধব নয় বলেও অনেকেই মতামত দিয়েছেন। আইনটি পাস হলে সাংবাদিকরা রুটি-রুজি এবং অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন না। তারা শ্রম আইনের সুবিধা পাবেন না। এই আইনে সাংবাদিকদের চাকরিজীবন শেষে সার্ভিস বেনিফিট অর্ধেক করে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিক ইউনিয়ন করার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। এই আইনটিতে সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য আলাদা কিছু বলা হয়নি। তাই এটা একটা এখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ এবং ত্রুটিপূর্ণ আইন বলে মনে হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিলটি সংসদে উত্থাপন করার পরে বিলটি ৬০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। এর আগে যিনি তথ্যমন্ত্রী ছিলেন হাসানুল হক ইনু, তিনি এখন সংসদীয় কমিটির সভাপতি। তাই এ বিষয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে। তিনি যেহেতু বিষয়টি জানতেন তাই এখন আশা করি আলোচনা ও পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে একটি সঠিক পথ পাবে বলে আশা করতে চাই।
দেশ রূপান্তর : আইনটি চূড়ান্ত করার আগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হবে কি? যদি হয়ে থাকে তাহলে আপনারা কোনো মতামত দেবেন কি?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : আমরা প্রস্তাবিত আইনটি নিয়ে এখন আলোচনা করব। অংশীজনরা রয়েছেন। সরকার আমাদের কথা শুনতে চাইবে। এখনো আমাদের কিছু বলেননি। আমরা তাদের মতামত জানাব। আমরা চাই এই আইনটি যেন গণমাধ্যমকর্মীবান্ধব হয়। আমরা কমিটির সদস্যরা এই আইনটিকে প্রথমে পর্যালোচনা করব। ৬০ দিন সময় আছে। এই আইনটিকে সংবাদকর্মীদের জন্য উপযোগী করতে করণীয় বিষয়ে মতামত দেওয়ার চেষ্টা করব।
দেশ রূপান্তর : প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইনে গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। খসড়াটিকে বৈষম্যমূলক হিসেবেও চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। তবে তথ্যমন্ত্রী বলছেন, টিআইবি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে এই বিবৃতি দিয়েছে। এই বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : টিআইবি যেভাবে কাজ করে, অর্থাৎ সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জবাবদিহি নিয়ে তার মধ্যে সাংবাদিকতাও রয়েছে। তারা সাংবাদিকতার জন্য পুরস্কার দিয়ে থাকে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাংবাদিকদের পুরস্কার দিয়ে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই তারা যখন এটি বলছে এটা বলার একটি ন্যায্যতা তাদের আছে বলে আমার মনে হয়।
দেশ রূপান্তর : প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ শোনা যায়। এই বিষয়ে আপনার মতামত শুনতে চাই।
মনজুরুল আহসান বুলবুল : কিছু ক্ষেত্রে হয়তো এটা সত্যি। কিন্তু এই আমলারাই যখন ভালো কাজ করেন, এর কৃতিত্ব কিন্তু রাজনৈতিক সরকারই নেয়। তাই কোনো আমলা যদি কোনো অন্যায্য কাজ করে থাকেন, তবে সেই মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি বা মন্ত্রীকেও সেই দায় নিতে হবে। মন্ত্রী যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন, তবে কোনো আমলার অসৎ উদ্দেশ্য থাকলেও তা নস্যাৎ হয়ে যায়। আমরা জানি যে, আমলাদের জবাবদিহি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় থাকে দেশের মানুষের কাছে।
দেশ রূপান্তর : এইবার ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনকে বাধা বা অন্তরায় হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে, ৫৭ ধারা। এই আইনটি সংশোধন বা বাতিলে আপনাদের কোনো উদ্যোগ আছে কি? সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : পৃথিবীতে প্রযুক্তি যেমন আমাদের জন্য তথ্যের সব ভা-ার উন্মুক্ত করেছে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও তৈরি করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি যেমন তথ্য জগতে সবার জন্য অবারিত করেছে, তেমনি এর অপব্যবহারের সুযোগ নিচ্ছে দুর্বৃত্ত দল। কিন্তু কিছু দুর্বৃত্তের জন্য এমন অবারিত সুযোগ যেমন সীমিত করা যায় না, তেমনি দুর্বৃত্তদের অবাধ বিচরণভূমি করা যায় না এই পৃথিবীকে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বেধড়ক অপব্যবহারের অভিজ্ঞতা থেকেই আপত্তি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রথম করা হয় ২০০৬ সালে। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে আইনটিকে আরও কঠোর করা হয়। ৫৭ ধারার যে অপব্যবহার হচ্ছিল, তা কিন্তু মন্ত্রীরাও স্বীকার করছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন, নতুন আইনে এ রকম উদ্বেগজনক কিছু থাকবে না। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াতেই আমরা দেখলাম : ওই ৫৭ ধারাই নানাভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন আইনে।
দেশ রূপান্তর : দেশের গণমাধ্যমকর্মীদের চাওয়া কী?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : দেশের সংবাদমাধ্যমকর্মীরা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে যারা অপরাধ করে তাদের নিয়ন্ত্রণ বা দমনের জন্য কঠোর আইন চান। তবে সেই আইনের অপপ্রয়োগ যাতে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি চোখ রাঙিয়ে ভীতি না ছড়ায়, তারও নিশ্চয়তা চান। সহজ কথায় বলতে হলে পেশাদার সংবাদকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুরক্ষা চান।
দেশ রূপান্তর : এই চাওয়া কীভাবে নিশ্চিত করা যায় বলে মনে করেন?
মনজুরুল আহসান বুলবুল : এমন একটি পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে কোনো সংবাদকর্মীর কোনো কাজ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তার হাতে হাতকড়া পরানোর আগে বিষয়টি নিবিড়ভাবে দেখা হয়। বিষয়টি কি ভুল, নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে উসকানি বা বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য করা হয়েছে, তা দেখা জরুরি। বিষয়টি যদি স্রেফ পেশাগত ভুল হয়, তাহলে সব সুযোগ দেওয়ার পরও যদি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চান, তাহলে মামলাও হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার নয়, সমন জারিই হোক গ্রহণযোগ্য পন্থা। আর যদি দেখা যায়, অপতথ্য দিয়ে, সাংবাদিকতার কোনো নীতিমালা না মেনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করা হয়েছে, তাহলে সেটি হবে তার ব্যক্তিগত দায়। এই দায় তাকে বহন করতে হবে। কারও ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পেশাদার সাংবাদিকরা নেবেন না।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মনজুরুল ইসলাম বুলবুল : আপনাকেও ধন্যবাদ।