শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন বাংলাদেশের রাজনীতিকরা
এম হুমায়ুন কবির | ১৫ মে, ২০২২ ০৯:১৮
কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিন দশকের বেশি সময় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও কলকাতায় উপহাইকমিশনারসহ বিভিন্ন উচ্চতর পদে আসীন ছিলেন। কাজ করেছেন জাতিসংঘে। বর্তমানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শ্রীলঙ্কার চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট, দেশটিতে সিংহলী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। কূটনীতিক হুমায়ুন কবির মনে করেন শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহ থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা নিতে পারেন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পরও শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট কমেনি। তার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এখন পর্যন্ত পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করে আসছেন। যদিও কিছু ছাড় দিতে এখন তিনি বাধ্য হচ্ছেন। কিছু ক্ষমতা পার্লামেন্টকে দিতে রাজি হয়েছেন। তিনি এখন প্রবীণ রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে একটি জাতীয় সরকার গঠন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল এবং শ্রীলঙ্কার প্রভাবশালী বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতারাও রনিলের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার সবশেষ পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
হুমায়ুন কবির : রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা আসলে এই মুহূর্তে আন্দোলনের গতি স্তিমিত করে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে এগুনোর একটা সাময়িক প্রয়াস বলে মনে হয়। কিন্তু এই প্রয়াস কতটা সফল হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। গত কয়েক মাস ধরে শ্রীলঙ্কায় যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে সেটাকে আমি একইসঙ্গে শাসনব্যবস্থার সংকট বলেও মনে করি। এটা একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট। নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ হলেও সংকট সমাধানের কোনো রূপকল্প এখনো সামনে আসেনি। অন্যদিকে এটা মাথায় রাখা জরুরি যে এই সংকট হুট করে তৈরি হয়নি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীনদের স্বেচ্ছাচার, রাজনৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি এবং ভুল অর্থনৈতিক নীতির ফল হিসেবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এখানে কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করা যায়। ২০০৯ সালে তামিলদের বিরুদ্ধে সামরিক বলপ্রয়োগ করে এলটিটিকে নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়েই রাজাপাকসে ভাইদের উত্থান জোরদার হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াও তখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তামিলদের যে শুধু সামরিকভাবে পরাস্ত করা হয়েছে তা নয়, সেসময় সেখানে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের মতো নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে জোর অভিযোগ আছে। পশ্চিমা দেশগুলোসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই অভিযোগ করে আসছে। খেয়াল করা দরকার, সেসময় গৃহযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজাপাকসে ভাইয়েরা ক্রমাগত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন, একচেটিয়া শাসন চালিয়ে গেছেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তামিল জনগোষ্ঠী যেমন আরও কোণঠাসা হয়েছে তেমনি মুসলিম জনগোষ্ঠীও আরও প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে। একই সময়েই শ্রীলঙ্কায় উগ্র সিংহলী জাতীয়তাবাদ, বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উত্থানের মতো নেতিবাচক ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংস করেছেন তারা। বিশেষত ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে রাজাপাকসে ভাইয়েরা একচেটিয়া ক্ষমতাচর্চায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। ফলে, বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে দেশটির এসব রাজনৈতিক সংকট বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করি।
দেশ রূপান্তর : মাহিন্দা রাজাপাকসে ও রাজাপাকসে ভাইয়েরা একসময় শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধে জয়ের নায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। যুদ্ধের পর বিজয় কুচকাওয়াজ ও বিশাল সমাবেশে তাকে সিংহলের প্রাচীন বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বর্তমান সংকটে এসে তারা দেশটির রাজনীতির খলনায়কে পরিণত হয়েছেন বলে দৃশ্যমান। সেনা পাহারায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছেড়ে যেতে হয়েছে মাহিন্দা রাজাপাকসেকে। রাজনীতির এই পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে মূল্যয়ান করছেন?
হুমায়ুন কবির : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিবেচনা। প্রথমত এটা থেকে বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যেটাকে বড় সাফল্য মনে হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে সেটা টিকে নাও থাকতে পারে। আজকের শ্রীলঙ্কাকে এর একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। খেয়াল করলে দেখা যাবে তামিলদের সংগ্রামের প্রধান দাবিই ছিল ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের, সবার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার। তামিলদের এই যৌক্তিক দাবি যদি গঠনমূলকভাবে মেনে নেওয়া হতো তাহলে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া যেত। আর সামরিক বিজয়ের পর যে উগ্র সিংহলী জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে সেটাও হতো না। পরবর্তী এক দশকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিই এর প্রমাণ।
এখনকার বাস্তবতাতেও দেখা যাচ্ছে তামিলরা শ্রীলঙ্কাতে আরও প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে। তামিলদের অধিকার ও যুক্তিসংগত দাবিগুলোও পূরণ হয়নি। আর যুদ্ধের পর রাজনৈতিকভাবে তামিলদের আত্মীকরণের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেসবের কিছুই রক্ষা করা হয়নি। শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা কখনোই তামিলদের অধিকারের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। খেয়াল করলে দেখা যাবে একই ধারাবাহিকতাতেই তামিলদের পর দেশটির দ্বিতীয় বড় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মুসলিমরাও হামলার শিকার হয়েছে। একইভাবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও হামলার শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে চার্চ ও হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ সমাজে একটা উগ্রপন্থার চর্চা হলে, উগ্রপন্থার ক্ষমতায়ন করা হলে সেখানকার সামাজিক ঐক্যগুলো ধসে পড়তে থাকে। এভাবে শ্রীলঙ্কায় জাতিগত বিদ্বেষ-সহিংসতার বিস্তারের ক্ষেত্রেও এই উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজাপাকসে ভাইয়েরা একের পর এক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা শুরুতে চমকপ্রদ মনে হলেও রাষ্ট্রের জন্য জনগণের জন্য কী ফল বয়ে আনবে সেটা তারা বিবেচনায় নেননি। এসময় তারা এমন অনেক বৈদেশিক ঋণ নিয়েছেন, এমন অনেক প্রকল্প নিয়েছেন যেখানে অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাই মুখ্য ছিল। ফলে, এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও তারা আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না। এসব কারণেই ২০০৯ সালের নায়েকরা ২০২২ সালে এসে খলনায়কে পরিণত হয়েছেন।
দেশ রূপান্তর : রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই তখন মুখ খোলেনি। কিন্তু এখন গোটা দেশ ভুগছে। বেঁচে থাকার লড়াই রাজপথে সব নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এমনকি সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন সিংহলী বিক্ষোভকারীরাও। এর মধ্য দিয়ে কি দেশটিতে দীর্ঘদিনের জাতিগত দ্বন্দ্ব-মিলনের নতুন কোনো সমীকরণের সম্ভাবনা দেখতে পান?
হুমায়ুন কবির : এরকম একটা ক্ষীণ আশা হয়তো দেখা যায়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ধরনের জাতিগত বিরোধের একটা প্রক্রিয়া যখন চালু হয়ে যায়, এটা যখন সংকটকে ঘনীভূত করে ফেলে তখন এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, মিসরের কথা। ২০১১ সালে মিসরে যখন হোসনি মোবারকের পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় তখন সেখানে খ্রিস্টান ও মুসলিমরাসহ বহু রাজনৈতিক গোষ্ঠী রাজপথের লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনের সময় সেই ঐক্য আর থাকল না। নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুসলিম ব্রাদারহুড এমন পরিস্থিতি তৈরি করল যে সেখানে সামরিক সরকার চলে এলো। ফলে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে স্বীকৃত না হলে এই সংকট কাটে না।
দেশ রূপান্তর : ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি তার ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। অনেকে বলেছেন এটা চীনের ঋণের ফাঁদ। অনেকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার চেষ্টা করেছেন। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এখন দেশটিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করে ফেলছে। বাংলাদেশের মানুষ এসব বিষয় আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
হুমায়ুন কবির : শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের সুন্দর সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই শ্রীলঙ্কার বিষয়ে আগ্রহী। শ্রীলঙ্কা শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে অনেক আগে থেকেই অগ্রসর দেশ। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও শ্রীলঙ্কা বেশ আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। এখন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে যে যাই বলুক না কেন সেসব অতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। তবে, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এখন কয়েকটা বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছে। একটা হলো, অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর একটা দেশও ভুল অর্থনৈতিক নীতির কারণে পতিত হতে পারে। বাংলাদেশ গত দুই দশক ধরে অর্থনৈতিকভাবে অনেক অগ্রসর হয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২৬ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠব। এটা যেমন আশা দেখায় তেমনি শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটা সতর্কবার্তা দিচ্ছে যে, ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভুল নীতির কারণে যেন পা পিছলে পড়ে না যাই। আরেকটি বিষয় হলো, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা এবং একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা শিক্ষা নিতে পারেন।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
হুমায়ুন কবির : দেশ রূপান্তর এবং আপনাকেও ধন্যবাদ
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
এম হুমায়ুন কবির | ১৫ মে, ২০২২ ০৯:১৮

কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিন দশকের বেশি সময় কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি ও নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও কলকাতায় উপহাইকমিশনারসহ বিভিন্ন উচ্চতর পদে আসীন ছিলেন। কাজ করেছেন জাতিসংঘে। বর্তমানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শ্রীলঙ্কার চলমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট, দেশটিতে সিংহলী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। কূটনীতিক হুমায়ুন কবির মনে করেন শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহ থেকে রাজনৈতিক শিক্ষা নিতে পারেন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পরও শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক সংকট কমেনি। তার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এখন পর্যন্ত পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করে আসছেন। যদিও কিছু ছাড় দিতে এখন তিনি বাধ্য হচ্ছেন। কিছু ক্ষমতা পার্লামেন্টকে দিতে রাজি হয়েছেন। তিনি এখন প্রবীণ রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে একটি জাতীয় সরকার গঠন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল এবং শ্রীলঙ্কার প্রভাবশালী বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতারাও রনিলের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার সবশেষ পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
হুমায়ুন কবির : রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা আসলে এই মুহূর্তে আন্দোলনের গতি স্তিমিত করে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিকে এগুনোর একটা সাময়িক প্রয়াস বলে মনে হয়। কিন্তু এই প্রয়াস কতটা সফল হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। গত কয়েক মাস ধরে শ্রীলঙ্কায় যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে সেটাকে আমি একইসঙ্গে শাসনব্যবস্থার সংকট বলেও মনে করি। এটা একইসঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট। নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ হলেও সংকট সমাধানের কোনো রূপকল্প এখনো সামনে আসেনি। অন্যদিকে এটা মাথায় রাখা জরুরি যে এই সংকট হুট করে তৈরি হয়নি। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীনদের স্বেচ্ছাচার, রাজনৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি এবং ভুল অর্থনৈতিক নীতির ফল হিসেবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এখানে কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করা যায়। ২০০৯ সালে তামিলদের বিরুদ্ধে সামরিক বলপ্রয়োগ করে এলটিটিকে নিশ্চিহ্ন করার মধ্য দিয়েই রাজাপাকসে ভাইদের উত্থান জোরদার হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াও তখন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তামিলদের যে শুধু সামরিকভাবে পরাস্ত করা হয়েছে তা নয়, সেসময় সেখানে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের মতো নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে জোর অভিযোগ আছে। পশ্চিমা দেশগুলোসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই অভিযোগ করে আসছে। খেয়াল করা দরকার, সেসময় গৃহযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই রাজাপাকসে ভাইয়েরা ক্রমাগত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন, একচেটিয়া শাসন চালিয়ে গেছেন। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তামিল জনগোষ্ঠী যেমন আরও কোণঠাসা হয়েছে তেমনি মুসলিম জনগোষ্ঠীও আরও প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে। একই সময়েই শ্রীলঙ্কায় উগ্র সিংহলী জাতীয়তাবাদ, বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উত্থানের মতো নেতিবাচক ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংস করেছেন তারা। বিশেষত ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে রাজাপাকসে ভাইয়েরা একচেটিয়া ক্ষমতাচর্চায় আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। ফলে, বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে দেশটির এসব রাজনৈতিক সংকট বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করি।
দেশ রূপান্তর : মাহিন্দা রাজাপাকসে ও রাজাপাকসে ভাইয়েরা একসময় শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধে জয়ের নায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। যুদ্ধের পর বিজয় কুচকাওয়াজ ও বিশাল সমাবেশে তাকে সিংহলের প্রাচীন বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বর্তমান সংকটে এসে তারা দেশটির রাজনীতির খলনায়কে পরিণত হয়েছেন বলে দৃশ্যমান। সেনা পাহারায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছেড়ে যেতে হয়েছে মাহিন্দা রাজাপাকসেকে। রাজনীতির এই পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে মূল্যয়ান করছেন?
হুমায়ুন কবির : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিবেচনা। প্রথমত এটা থেকে বোঝা যায় যে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যেটাকে বড় সাফল্য মনে হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদে সেটা টিকে নাও থাকতে পারে। আজকের শ্রীলঙ্কাকে এর একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে। খেয়াল করলে দেখা যাবে তামিলদের সংগ্রামের প্রধান দাবিই ছিল ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের, সবার জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার। তামিলদের এই যৌক্তিক দাবি যদি গঠনমূলকভাবে মেনে নেওয়া হতো তাহলে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং নানা ধরনের যুদ্ধাপরাধের মতো ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাওয়া যেত। আর সামরিক বিজয়ের পর যে উগ্র সিংহলী জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে সেটাও হতো না। পরবর্তী এক দশকে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিই এর প্রমাণ।
এখনকার বাস্তবতাতেও দেখা যাচ্ছে তামিলরা শ্রীলঙ্কাতে আরও প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে। তামিলদের অধিকার ও যুক্তিসংগত দাবিগুলোও পূরণ হয়নি। আর যুদ্ধের পর রাজনৈতিকভাবে তামিলদের আত্মীকরণের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেসবের কিছুই রক্ষা করা হয়নি। শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা কখনোই তামিলদের অধিকারের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়নি। খেয়াল করলে দেখা যাবে একই ধারাবাহিকতাতেই তামিলদের পর দেশটির দ্বিতীয় বড় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী মুসলিমরাও হামলার শিকার হয়েছে। একইভাবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও হামলার শিকার হয়েছে। ২০১৯ সালের ইস্টার সানডেতে চার্চ ও হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ সমাজে একটা উগ্রপন্থার চর্চা হলে, উগ্রপন্থার ক্ষমতায়ন করা হলে সেখানকার সামাজিক ঐক্যগুলো ধসে পড়তে থাকে। এভাবে শ্রীলঙ্কায় জাতিগত বিদ্বেষ-সহিংসতার বিস্তারের ক্ষেত্রেও এই উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভূমিকা রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজাপাকসে ভাইয়েরা একের পর এক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা শুরুতে চমকপ্রদ মনে হলেও রাষ্ট্রের জন্য জনগণের জন্য কী ফল বয়ে আনবে সেটা তারা বিবেচনায় নেননি। এসময় তারা এমন অনেক বৈদেশিক ঋণ নিয়েছেন, এমন অনেক প্রকল্প নিয়েছেন যেখানে অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাই মুখ্য ছিল। ফলে, এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও তারা আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না। এসব কারণেই ২০০৯ সালের নায়েকরা ২০২২ সালে এসে খলনায়কে পরিণত হয়েছেন।
দেশ রূপান্তর : রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণের অভিযোগ রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই তখন মুখ খোলেনি। কিন্তু এখন গোটা দেশ ভুগছে। বেঁচে থাকার লড়াই রাজপথে সব নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এমনকি সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন সিংহলী বিক্ষোভকারীরাও। এর মধ্য দিয়ে কি দেশটিতে দীর্ঘদিনের জাতিগত দ্বন্দ্ব-মিলনের নতুন কোনো সমীকরণের সম্ভাবনা দেখতে পান?
হুমায়ুন কবির : এরকম একটা ক্ষীণ আশা হয়তো দেখা যায়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এ ধরনের জাতিগত বিরোধের একটা প্রক্রিয়া যখন চালু হয়ে যায়, এটা যখন সংকটকে ঘনীভূত করে ফেলে তখন এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, মিসরের কথা। ২০১১ সালে মিসরে যখন হোসনি মোবারকের পতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় তখন সেখানে খ্রিস্টান ও মুসলিমরাসহ বহু রাজনৈতিক গোষ্ঠী রাজপথের লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনের সময় সেই ঐক্য আর থাকল না। নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুসলিম ব্রাদারহুড এমন পরিস্থিতি তৈরি করল যে সেখানে সামরিক সরকার চলে এলো। ফলে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে স্বীকৃত না হলে এই সংকট কাটে না।
দেশ রূপান্তর : ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটি তার ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছে। অনেকে বলেছেন এটা চীনের ঋণের ফাঁদ। অনেকে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করার চেষ্টা করেছেন। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এখন দেশটিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন করে ফেলছে। বাংলাদেশের মানুষ এসব বিষয় আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করছে। আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?
হুমায়ুন কবির : শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের সুন্দর সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই শ্রীলঙ্কার বিষয়ে আগ্রহী। শ্রীলঙ্কা শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে অনেক আগে থেকেই অগ্রসর দেশ। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও শ্রীলঙ্কা বেশ আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। এখন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করে যে যাই বলুক না কেন সেসব অতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি না। তবে, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এখন কয়েকটা বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছে। একটা হলো, অর্থনৈতিকভাবে অপেক্ষাকৃত অগ্রসর একটা দেশও ভুল অর্থনৈতিক নীতির কারণে পতিত হতে পারে। বাংলাদেশ গত দুই দশক ধরে অর্থনৈতিকভাবে অনেক অগ্রসর হয়েছে। আমরা আশা করছি ২০২৬ সালে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠব। এটা যেমন আশা দেখায় তেমনি শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটা সতর্কবার্তা দিচ্ছে যে, ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভুল নীতির কারণে যেন পা পিছলে পড়ে না যাই। আরেকটি বিষয় হলো, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা এবং একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চা। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকরা শিক্ষা নিতে পারেন।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
হুমায়ুন কবির : দেশ রূপান্তর এবং আপনাকেও ধন্যবাদ