সরকার মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে
কামরুল হাসান মামুন
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। এই বিভাগ থেকেই বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৯২ সালে তিনি ইতালির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (আইসিটিপি) থেকে কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০০-০১ সালে তিনি হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। আরও তিন পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ফ্র্যাকটাল প্যাটার্নস ইন নন লিনিয়ার ডিনামিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন্স (সিআরসি প্রেস, ২০১৯) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। দ্য আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি (এপিএস) প্রকাশিত ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে ১৮ গবেষণা নিবন্ধসহ খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে তার আরও ১৯টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার নানা সংকট নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় ৫০ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির জন্য ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। বাকি টাকার বেশিরভাগই খরচ হবে কেনাকাটায়। বিপুল অর্থ ব্যয়ে এমন অবকাঠামো নির্মাণকে কীভাবে দেখছেন?
কামরুল হাসান মামুন : প্রথম কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি বিষয়। উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হতেই পারে। তবে, এটা মাথায় রাখতে হবে যে, অবকাঠামো মানেই বিশ্ববিদ্যালয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর আগে একটা মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যায়ক্রমিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নানা পরিকল্পনা থাকবে। কিন্তু এক দফাতেই সবকিছু নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। পৃথিবিতে কোথাও এমন হয় না।
দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদনে দেখলাম কেনাকাটার তালিকায় সুপার কম্পিউটার আছে। সুপার কম্পিউটার কোনো সাধারণ কাজের জন্য নয়। কথা হলো, এমন সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে বিশেষায়িত উচ্চতর গবেষণা করার মতো স্কলার আমরা তৈরি করেছি কি না। যদি সেটা আমরা না করি তাহলে এটা দিয়ে কী হবে? যে বিভাগের জন্য সুপার কম্পিউটার কেনা হবে সেই বিভাগে তো আগে একজন হেড অব ডিপার্টমেন্ট নিয়োগ দিতে হবে। যিনি হবেন আন্তর্জাতিক মানের একজন স্কলার। কী কী বিষয় পড়ানো হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষণা হবে সেসবের সাপেক্ষে তিনি ধীরে ধীরে ল্যাবরেটরি ডিজাইন করবেন। তার তত্ত্বাবধানে বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে এবং তিনি শিক্ষা ও গবেষণার নেতৃত্ব দেবেন। এটা পর্যায়ক্রমিক বিষয়। এই ধরনের কোনো পরিকল্পনা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণেই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কোনো লাভ নেই।
দেশ রূপান্তর : ইউজিসি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপিপি মূল্যায়ন করে অবকাঠামো নির্মাণ ও ক্রয় প্রস্তাবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া যেসব অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে সেসবের ব্যয় ধরা হয়েছে আকাশচুম্বী। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি টাকা। অথচ ইউজিসির সংশ্লিষ্টরা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন পাঁচতলা একটি মডেল মসজিদ নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয় মাত্র ছয় কোটি টাকা।
কামরুল হাসান মামুন : এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এসব অবকাঠামো নির্মাণ এবং কেনাকাটার প্রস্তাব আসলে ভিন্ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য যে শিক্ষা ও গবেষণা সেদিকে জোর না দিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের দিকে না গিয়ে এক দফাতেই এসব নির্মাণের উদ্দেশ্য মহত কিছু বলে মনে হয় না। তা ছাড়া যে উপাচার্যের নেতৃত্বে এটা করা হচ্ছে তার মেয়াদও সম্ভবত আগামী মাসেই শেষ হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের অতীত সম্পর্কেও জানা দরকার। তিনি ছিলেন ওআইসি’র সহায়তায় পরিচালিত গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ভিসি। সেখানকার নব্বইভাগ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আন্দোলনের মুখে তাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, যিনি এমন একটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তাকে কেন বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো? এসব সিদ্ধান্ত আসলে কারা নেন? কী উদ্দেশ্যে নেন? এটা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, উপাচার্যই হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার প্রধান। উপাচার্যের মানের ওপর নির্ভর করবে বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি কীভাবে পরিচালিত করবেন।
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা বারবার আলোচনায় এসেছেন নানারকম দুর্নীতির অভিযোগে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতিসহ প্রমাণ মিলেছে। একজন উপাচার্যকে জেলও খাটতে হয়েছে। আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এতে উপাচার্যের সম্মানজনক পদটিই কি কলুষিত হচ্ছে না? এমন অসৎ মানুষরা কীভাবে শিক্ষা-গবেষণার নেতৃত্ব দেবেন?
কামরুল হাসান মামুন : মাত্র কয়েকদিন আগেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেওয়া হলো। তিনি বিশ্বখ্যাত একজন নিউরো সায়েন্টিস্ট। তার গবেষণাপত্র-সাইটেশনের সংখ্যা ঈর্ষণীয়। এখন দুনিয়ার পাঁচজন নিউরো সায়েন্টিস্টের নাম নিতে হলে তার নাম অবশ্যই সেখানে থাকবে। উপাচার্য হওয়ার প্রথম এবং প্রাথমিক যোগ্যতা হলো তিনি স্কলার হিসেবে কেমন। এটা অত্যাবশ্যক কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কেবল জ্ঞান বিতরণ আর চর্চাই করে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য একইসঙ্গে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। এখন যে ব্যক্তি নিজে স্কলার না, যার গবেষণা নেই তিনি কীভাবে বাকি শিক্ষকদের গবেষণায় উৎসাহিত করবেন? খেয়াল করা দরকার এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়। দুনিয়ার কোথাও এটা হয় না। আমলারা এমন ব্যক্তিদেরই নির্বাচন করেন যারা সরকারের আস্থাভাজন। অর্থাৎ মৌলিক যে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে তিনি স্কলার হিসেবে কেমন সেটা বিবেচনাতেই আসে না। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে প্রকৃত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে? জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা কীভাবে হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬টা গবেষণা কেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্রে কী ধরনের কী মানের গবেষণা হয়। অথচ উচিত ছিল সত্যিকারের মানসম্মত দুই-চারটা গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা। আমরা কেবল সংখ্যাই বাড়াই মানের দিকে তাকাই না।
দেশ রূপান্তর : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার করুণ দশা ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে আমরা জানি, দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দই সবচেয়ে কম। জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ মাত্র ২ শতাংশ। যদিও ইউনেস্কোর পরামর্শ দেশগুলো যেন শিক্ষা খাতে কমপক্ষে জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। তার ওপর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দের সিংহভাগ অবকাঠামো উন্নয়ন আর পরিচালন ব্যয়ে চলে যায় তাহলে গবেষণা কীভাবে হবে?
কামরুল হাসান মামুন : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও যথাযথ একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশের যত সমস্যা, ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে সব ধরনের লুটপাট ও দুর্নীতিসহ সব সমস্যারই অন্যতম প্রধান কারণ আমরা ভালো মানুষ তৈরি করতে পারছি না। মানুষ তৈরির কারখানা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মানসম্মত মানুষরাই দেশ গড়ার কাজ করবে। আমরা যদি জাপান বা এরকম উন্নত দেশগুলোর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই আর নিজেদের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে যে চিত্রটা দেখব সেটা খুবই করুণ। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখলে করুণা জাগে। যারা অসচ্ছল জীবনের চাপে স্বপ্নহীন হয়ে পড়েন। এই মানুষরা কীভাবে আমাদের কোমলমতি শিশুদের মধ্যে স্বপ্ন বুনবেন, তাদের শিক্ষিত করে তুলবেন? শিক্ষকরা স্কুলে এমনভাবে পড়ান যাতে তার কাছে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে আসে, কোচিং সেন্টারে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। জরিপ করলে দেখা যাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই একাধিক চাকরি করছেন। নানারকম কর্মকান্ডে সময় দিচ্ছেন। তাহলে তারা গবেষণা করবেন কখন আর শিক্ষার্থীদের কীভাবে শিক্ষা-গবেষণায় উৎসাহিত করবেন?
আর এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া। এমন মানের শিক্ষক আমরা নিয়োগ দিই যাদের মানসম্মত গবেষণার যোগ্যতাই নেই। এদিকে এমন একটা চক্রের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি যে, গবেষণা হয় না বলে টাকা দেওয়া হয় না আর টাকা দেওয়া হয় না বলে গবেষণা হয় না। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে ৮০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ হচ্ছে। এই টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন এবং ল্যাবরেটরি-শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জামাদি কেনাকাটার পর গবেষণার জন্য নামমাত্র টাকাও থাকে না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থার ভোটারদের খুশি করার কারণে যতটুকু টাকা থাকে সেটা আবার সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। বিষয়টা হয়ে গেছে গবেষণা ভাতার মতো। যে গবেষণা করছে না তাকেও দেওয়া হচ্ছে আর যে করছে তাকেও একই পরিমাণ দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এমনটা আর পাওয়া যাবে না।
পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা এমন কলুষিত করে ফেলেছি যে এটা একটা চক্রের মতো একের পর এক খাদে পড়ছে। সারা দুনিয়ার কথা বাদ, দক্ষিণ এশিয়াতেও আমরা শিক্ষার মানে সবচেয়ে নিচে। নেপাল আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। এমনকি ভুটানও আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। একই কারণে গবেষণাতেও আমরা অনেক পিছিয়ে। নেপালে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। নেপালের লোকসংখ্যাও মাত্র কয়েক কোটি। কিন্তু প্রতি বছর নেপাল থেকে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। আমাদের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শত শত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। অথচ বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৮ হাজার শিক্ষার্থী সেখানে পড়তে যাচ্ছে। এই ধরনের সবকিছু থেকেই বোঝা যায় আমাদের সরকারগুলো মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আমরা মানসম্মত মানুষ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আর এসব কারণেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক। এই বিভাগ থেকেই বিএসসি (অনার্স) এবং এমএসসি ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৯২ সালে তিনি ইতালির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স (আইসিটিপি) থেকে কনডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্স বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন। ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০০-০১ সালে তিনি হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন। আরও তিন পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ফ্র্যাকটাল প্যাটার্নস ইন নন লিনিয়ার ডিনামিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লিকেশন্স (সিআরসি প্রেস, ২০১৯) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। দ্য আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি (এপিএস) প্রকাশিত ফিজিক্যাল রিভিউ জার্নালে ১৮ গবেষণা নিবন্ধসহ খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে তার আরও ১৯টি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার নানা সংকট নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি দেশ রূপান্তরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় ৫০ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির জন্য ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজাল জমা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। বাকি টাকার বেশিরভাগই খরচ হবে কেনাকাটায়। বিপুল অর্থ ব্যয়ে এমন অবকাঠামো নির্মাণকে কীভাবে দেখছেন?
কামরুল হাসান মামুন : প্রথম কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষা অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি বিষয়। উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হতেই পারে। তবে, এটা মাথায় রাখতে হবে যে, অবকাঠামো মানেই বিশ্ববিদ্যালয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর আগে একটা মাস্টারপ্ল্যান থাকতে হবে। যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যায়ক্রমিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য নানা পরিকল্পনা থাকবে। কিন্তু এক দফাতেই সবকিছু নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। পৃথিবিতে কোথাও এমন হয় না।
দেশ রূপান্তরের প্রতিবেদনে দেখলাম কেনাকাটার তালিকায় সুপার কম্পিউটার আছে। সুপার কম্পিউটার কোনো সাধারণ কাজের জন্য নয়। কথা হলো, এমন সুপার কম্পিউটার ব্যবহার করে বিশেষায়িত উচ্চতর গবেষণা করার মতো স্কলার আমরা তৈরি করেছি কি না। যদি সেটা আমরা না করি তাহলে এটা দিয়ে কী হবে? যে বিভাগের জন্য সুপার কম্পিউটার কেনা হবে সেই বিভাগে তো আগে একজন হেড অব ডিপার্টমেন্ট নিয়োগ দিতে হবে। যিনি হবেন আন্তর্জাতিক মানের একজন স্কলার। কী কী বিষয় পড়ানো হবে, কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষণা হবে সেসবের সাপেক্ষে তিনি ধীরে ধীরে ল্যাবরেটরি ডিজাইন করবেন। তার তত্ত্বাবধানে বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে এবং তিনি শিক্ষা ও গবেষণার নেতৃত্ব দেবেন। এটা পর্যায়ক্রমিক বিষয়। এই ধরনের কোনো পরিকল্পনা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণেই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কোনো লাভ নেই।
দেশ রূপান্তর : ইউজিসি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপিপি মূল্যায়ন করে অবকাঠামো নির্মাণ ও ক্রয় প্রস্তাবে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া যেসব অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে সেসবের ব্যয় ধরা হয়েছে আকাশচুম্বী। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯ কোটি টাকা। অথচ ইউজিসির সংশ্লিষ্টরা ধর্ম মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন পাঁচতলা একটি মডেল মসজিদ নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয় মাত্র ছয় কোটি টাকা।
কামরুল হাসান মামুন : এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এসব অবকাঠামো নির্মাণ এবং কেনাকাটার প্রস্তাব আসলে ভিন্ন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য যে শিক্ষা ও গবেষণা সেদিকে জোর না দিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের দিকে না গিয়ে এক দফাতেই এসব নির্মাণের উদ্দেশ্য মহত কিছু বলে মনে হয় না। তা ছাড়া যে উপাচার্যের নেতৃত্বে এটা করা হচ্ছে তার মেয়াদও সম্ভবত আগামী মাসেই শেষ হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের অতীত সম্পর্কেও জানা দরকার। তিনি ছিলেন ওআইসি’র সহায়তায় পরিচালিত গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ভিসি। সেখানকার নব্বইভাগ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন। আন্দোলনের মুখে তাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, যিনি এমন একটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন তাকে কেন বঙ্গবন্ধুর নামে প্রতিষ্ঠিত একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো? এসব সিদ্ধান্ত আসলে কারা নেন? কী উদ্দেশ্যে নেন? এটা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, উপাচার্যই হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার প্রধান। উপাচার্যের মানের ওপর নির্ভর করবে বিশ্ববিদ্যালয়কে তিনি কীভাবে পরিচালিত করবেন।
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা বারবার আলোচনায় এসেছেন নানারকম দুর্নীতির অভিযোগে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে অনেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতিসহ প্রমাণ মিলেছে। একজন উপাচার্যকে জেলও খাটতে হয়েছে। আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এতে উপাচার্যের সম্মানজনক পদটিই কি কলুষিত হচ্ছে না? এমন অসৎ মানুষরা কীভাবে শিক্ষা-গবেষণার নেতৃত্ব দেবেন?
কামরুল হাসান মামুন : মাত্র কয়েকদিন আগেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেওয়া হলো। তিনি বিশ্বখ্যাত একজন নিউরো সায়েন্টিস্ট। তার গবেষণাপত্র-সাইটেশনের সংখ্যা ঈর্ষণীয়। এখন দুনিয়ার পাঁচজন নিউরো সায়েন্টিস্টের নাম নিতে হলে তার নাম অবশ্যই সেখানে থাকবে। উপাচার্য হওয়ার প্রথম এবং প্রাথমিক যোগ্যতা হলো তিনি স্কলার হিসেবে কেমন। এটা অত্যাবশ্যক কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কেবল জ্ঞান বিতরণ আর চর্চাই করে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য একইসঙ্গে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। এখন যে ব্যক্তি নিজে স্কলার না, যার গবেষণা নেই তিনি কীভাবে বাকি শিক্ষকদের গবেষণায় উৎসাহিত করবেন? খেয়াল করা দরকার এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রণালয়। দুনিয়ার কোথাও এটা হয় না। আমলারা এমন ব্যক্তিদেরই নির্বাচন করেন যারা সরকারের আস্থাভাজন। অর্থাৎ মৌলিক যে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার যে তিনি স্কলার হিসেবে কেমন সেটা বিবেচনাতেই আসে না। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে প্রকৃত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে? জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা কীভাবে হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৬টা গবেষণা কেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্রে কী ধরনের কী মানের গবেষণা হয়। অথচ উচিত ছিল সত্যিকারের মানসম্মত দুই-চারটা গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা। আমরা কেবল সংখ্যাই বাড়াই মানের দিকে তাকাই না।
দেশ রূপান্তর : বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার করুণ দশা ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে আমরা জানি, দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দই সবচেয়ে কম। জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বাজেট বরাদ্দ মাত্র ২ শতাংশ। যদিও ইউনেস্কোর পরামর্শ দেশগুলো যেন শিক্ষা খাতে কমপক্ষে জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়। তার ওপর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দের সিংহভাগ অবকাঠামো উন্নয়ন আর পরিচালন ব্যয়ে চলে যায় তাহলে গবেষণা কীভাবে হবে?
কামরুল হাসান মামুন : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও যথাযথ একটা প্রশ্ন। বাংলাদেশের যত সমস্যা, ট্রাফিক জ্যাম থেকে শুরু করে সব ধরনের লুটপাট ও দুর্নীতিসহ সব সমস্যারই অন্যতম প্রধান কারণ আমরা ভালো মানুষ তৈরি করতে পারছি না। মানুষ তৈরির কারখানা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মানসম্মত মানুষরাই দেশ গড়ার কাজ করবে। আমরা যদি জাপান বা এরকম উন্নত দেশগুলোর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই আর নিজেদের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে যে চিত্রটা দেখব সেটা খুবই করুণ। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখলে করুণা জাগে। যারা অসচ্ছল জীবনের চাপে স্বপ্নহীন হয়ে পড়েন। এই মানুষরা কীভাবে আমাদের কোমলমতি শিশুদের মধ্যে স্বপ্ন বুনবেন, তাদের শিক্ষিত করে তুলবেন? শিক্ষকরা স্কুলে এমনভাবে পড়ান যাতে তার কাছে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে আসে, কোচিং সেন্টারে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা। জরিপ করলে দেখা যাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই একাধিক চাকরি করছেন। নানারকম কর্মকান্ডে সময় দিচ্ছেন। তাহলে তারা গবেষণা করবেন কখন আর শিক্ষার্থীদের কীভাবে শিক্ষা-গবেষণায় উৎসাহিত করবেন?
আর এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া। এমন মানের শিক্ষক আমরা নিয়োগ দিই যাদের মানসম্মত গবেষণার যোগ্যতাই নেই। এদিকে এমন একটা চক্রের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি যে, গবেষণা হয় না বলে টাকা দেওয়া হয় না আর টাকা দেওয়া হয় না বলে গবেষণা হয় না। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে ৮০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ হচ্ছে। এই টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন এবং ল্যাবরেটরি-শ্রেণিকক্ষের সরঞ্জামাদি কেনাকাটার পর গবেষণার জন্য নামমাত্র টাকাও থাকে না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী ব্যবস্থার ভোটারদের খুশি করার কারণে যতটুকু টাকা থাকে সেটা আবার সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হয়। বিষয়টা হয়ে গেছে গবেষণা ভাতার মতো। যে গবেষণা করছে না তাকেও দেওয়া হচ্ছে আর যে করছে তাকেও একই পরিমাণ দেওয়া হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এমনটা আর পাওয়া যাবে না।
পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা এমন কলুষিত করে ফেলেছি যে এটা একটা চক্রের মতো একের পর এক খাদে পড়ছে। সারা দুনিয়ার কথা বাদ, দক্ষিণ এশিয়াতেও আমরা শিক্ষার মানে সবচেয়ে নিচে। নেপাল আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। এমনকি ভুটানও আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। একই কারণে গবেষণাতেও আমরা অনেক পিছিয়ে। নেপালে মাত্র দুটি বিশ্ববিদ্যালয়। নেপালের লোকসংখ্যাও মাত্র কয়েক কোটি। কিন্তু প্রতি বছর নেপাল থেকে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। আমাদের শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় শত শত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। অথচ বাংলাদেশ থেকে মাত্র ৮ হাজার শিক্ষার্থী সেখানে পড়তে যাচ্ছে। এই ধরনের সবকিছু থেকেই বোঝা যায় আমাদের সরকারগুলো মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে আমরা মানসম্মত মানুষ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আর এসব কারণেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।