বাজেটে সম্পদবৈষম্য কমানোর বিশেষ উদ্যোগ নেই
ড. বিনায়ক সেন
ড. বিনায়ক সেন রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক। বিনায়ক সেন ১৯৮২ সালে রাশিয়ার মস্কো লমনোসভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ও ১৯৮৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিআইডিএসে যোগ দেন তিনি। সামষ্টিক অর্থনীতির নানা বিষয় ছাড়াও দারিদ্র্যের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। দারিদ্র্য সংক্রান্ত তার গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণ হয়েছে। এছাড়া আয়বৈষম্য ও মানব উন্নয়ন, শ্রমবাজার, সামাজিক সুরক্ষা, সুশাসন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ছাড়াও আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে ড. বিনায়ক সেনের। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহসান মাহমুদ
শুরুতেই জানতে চাইছি, এবারের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে। বাজেট কেমন হয়েছে?
এবারের বাজেট ম্যাক্রো ইকোনমিক্স স্ট্যাবল করার বাজেট। একটি গতিশীল অর্থনীতি চালু করতে একটি পাটাতন তৈরির বছর বলব এই বছরকে। বাজেটের কিছু কিছু পদক্ষেপ সঠিক দিকে থাকলেও আবার কিছ ুকিছু দিক নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে যেভাবে বাজেট দেওয়া হয়েছে তা রাজস্বের দিক থেকে বাস্তবসম্মত। গ্রোথের দিক থেকে অপটিমিস্টিক। যদি আমরা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের কথা বলি, তবে কিছু ক্ষেত্রে ঠিক পথেই আছে বলা যায়। আর গ্রোথের দিক থেকে অপটিমিস্টিক বলছি এ কারণে যে, গত পাঁচ বছর ধরেই আমাদের এখানে বিনিয়োগের হার ৩১-৩২ শতাংশে থমকে আছে। তা সত্ত্বেও এখানে এবার প্রবৃদ্ধি হারের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে গত বছরের চেয়ে বেশি। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছিলেন, আমাদের উচিত সরকারি ব্যয় ২০ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া। সে জায়গায় আমরা উল্টো পথে চলেছি। কমিয়ে ১৫ এর নিচে আনা হয়েছে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে এ বছর কৃচ্ছ্র সাধনের বছর, ব্যয় কমিয়ে আনার বছর। ডলারের দাম ঠিক রাখতে নিকট অতীতে আমাদের রিজার্ভ থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। এতে করে হয়তো রিজার্ভ চুয়াল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ বা আরও দুই কমে চল্লিশে নেমে এসেছে। কিন্তু এটা তো কোনো পন্থা হতে পারে না।
এবারের বাজেটটি এমন একটা সময়ে এলো, যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলানো এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে অর্থনীতিতে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ডলারের দামের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে। এমন অবস্থায় এই বাজেট বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কতটা কাজে দেবে বলে মনে করেন?
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তো আমাদের হাতে নেই। এটা আমাদের সৃষ্টও নয়। আবার করোনা মহামারীর যে প্রভাব তা থেকে উত্তরণেই এই পন্থা নেওয়া হয়েছে। এটা তো আমরা এড়াতে পারতাম না। এখন আমরা যেটা পারব এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। যার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে পারি। আমার মূল বক্তব্যটা হচ্ছে এবারের অর্থনৈতিক শকটি ২০০৭-০৮ এর মতো কাঠামোগত নয়। সেই সময়ে আমেরিকার হাউজিং মার্কেট থেকে যেভাবে একটি ধাক্কা এসেছিল সেটি সারা বিশ্বেই একটি প্রভাব ফেলেছিল। এবার সেভাবে হবে না। ইউক্রেনের সমস্যাটি কাঠামোগত নয়। তবে উন্নত বিশ্বে এর একটি প্রভাব পড়ছে আবার সারা বিশ্বেই এর প্রভাব বাড়ছে। ধরা যাক, আজকে যদি ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়ে যায় তবে তারপরের দিনই তেল-গ্যসের দামে প্রভাব পড়বে। তা কমতে শুরু করবে। সারসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমতে শুরু করবে। আমি মনে করি, ইউরোপ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের মাশুল বইতে পারবে না। কারণ, সামনে শীত আসছে। তাদের গ্যাসের মজুদ নেই। তারা এখন চাইলেও নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে ফিরতে পারবে না। এর জন্য যথেষ্ট সময় দরকার। আমি আশাবাদী হতে চাই যে, এই গ্রীষ্মেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের একটি মীমাংসা দেখা যাবে। তাই এখন ডলারের দাম থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক যেসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে তা সেপ্টেম্বরের মধ্যেই একটি গন্তব্যে যাবে।
এবারের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগে মানুষের দুর্নীতিতে আগ্রহী হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে কিনা?
বাজেটে এই বিষয়টি নাটকীয়ভাবে এসেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এর থেকে খুব বেশি অভিঘাত আমরা পাব না। কারণ এখন যারা বিদেশের ব্যাংকে অর্থ রেখেছেন, সেটা আনতেও তাদের আপত্তি নেই। শুধু ট্যাক্সের পরিমাণটা তাদের বেশি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতরেই কালো টাকা সাদা করার জন্য এতদিন যে ১০ ভাগ ট্যাক্সের মাধ্যমে সাদা করার সুযোগ ছিল, তার বদলে তারা এখন ৭ ভাগ ট্যাক্সের মাধ্যমে পাচার টাকা সাদা করবে। এতে করে আবার দেশের মধ্যেই যারা কালো টাকা রেখেছিল তারা এখন হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠাবে এবং পরে আবার ৭ ভাগ ট্যাক্স দিয়ে পাচারকরা টাকা হিসেবে ছাড় করিয়ে দেশে আনতে পারবে। এটা কালো টাকা উৎপাদনকারীদের জন্য লাভ। এখন এখানে একটি কিন্তু রাখা দরকার ছিল। এই টাকা যদি কোনো উৎপাদন খাতে বা বিনিয়োগ খাতে ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা থাকত তাহলে আমাদের লাভ হতো। কিন্তু এই টাকা যদি জমি কেনা বা ফ্ল্যাট কেনার কাজে ব্যয় হয় তাহলে তো আর কোনো লাভ হবে না। আর যদি ধরেও নিই এই উপায়ে বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা এলো, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে যদি দেশের ফ্ল্যাট বা জমি কিনতে চায় তাহলে এখন যারা দেশের মধ্যে থেকেই টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বা জমি কিনতে চাইছেন তারা অনেক বেকায়দায় পড়ে যাবেন।
গত দুই বছরে করোনার প্রভাবে দেশের শিক্ষা খাত পিছিয়ে পড়েছে। আবার স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশাও দেখা গেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই দুটি খাতের বরাদ্দ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
আমি সংক্ষিপ্তভাবে বাজেট যেভাবে দেখেছি, তাতে দেখেছি গত বছরের তুলনায় এবার স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়েনি। শিক্ষা খাতে কিছুটা বেড়েছে। আবার শিক্ষা খাতের সবগুলো উপ-খাতে বাড়েনি। কিছু উপ খাতে বেড়েছে। কিছু উপ খাতে বাড়েনি। যেমন প্রাইমারিতে বাড়লেও উচ্চশিক্ষা খাতে বাড়েনি। তাই আমি বলব না, সামাজিক অবকাঠামো খাতে বাজেট বেড়েছে। সামাজিক খাতের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে এই বাজেটে বলা হয়েছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে যা বরাদ্দ আছে তা যথাযথভাবে খরচ করা। কারণ এর আগে দেখা গেছে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের অর্থ অব্যবহৃত থেকে গেছে। আমি একটি অঙ্ক উল্লেখ করতে পারি, একবার দেখা গেল স্বাস্থ্য খাত তার এডিপি বরাদ্দের পঞ্চাশ ভাগও ব্যবহার করতে পারেনি। নগরের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমি একটা কথা সবসময়ই বলি, সেটা হচ্ছে গ্রামের স্বাস্থ্যসেবার জন্য যেরকম স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, নগরের স্বাস্থ্যসেবার জন্য এমন কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তাই আমরা শহরের বিশেষ করে, সিটি করপোরেশন এলাকায় যদি দেখি ধনী এবং গরিবের স্বাস্থ্যসেবার পার্থক্য অনেক। আবার একইভাবে শিশুদের পুষ্টির দিক থেকেও ধনী-গরিবের পুষ্টির বৈষম্য অনেক। এটা তো হওয়ার কথা নয়। কারণ, সংবিধানেই ১৮ নম্বর ধারায় একইমাত্রার ন্যূনতম পুষ্টির অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলা আছে। তাই পুষ্টির এই বৈষম্য তো হওয়ার কথা নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বাজেট হিসেবে মোটাদাগে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে এটা স্বাভাবিক। কারণ কোনো দেশ যখন শিল্পে-বাণিজ্যে নির্ভর করতে শুরু করে তখন এসব প্রতিষ্ঠান বান্ধব হয়ে কাজ করবে এটা মেনে নিতেই হবে। তাই ব্যবসাবান্ধব হওয়াটা দোষের নয়। দেশীয় শিল্প ও কৃষি খাতে সুযোগ রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে আমরা এখন সমৃদ্ধি অর্জন করেছি। কিন্তু এই সমৃদ্ধিতে কার কী হলো? বঙ্কিমচন্দ্র একশো পঁচিশ বছর আগে প্রবন্ধে যেভাবে লিখেছেন শুনিতেছি আজিকাল দেশের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে। কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেছিলেন, এই শ্রীবৃদ্ধিতে কি রামা কৈবর্ত্য এবং রহিম শেখের কোনো উন্নতি সাধিত হইয়াছে? সেই প্রশ্ন আমরা এখনো করতে পারি। আমরা যদি আমাদের শ্রমিক পরিবারগুলোর দিকে তাকাই তাহলে আমরা কী দেখতে পাই? আমাদের সমৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কত বাড়ছে? শ্রমিকপরিবারের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা কী? এর দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই! এইসব জায়গাতে আমরা এখনো উন্নতি করতে পারিনি। আমরা কি একটি উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পারি কোনো একটি শ্রমিক পরিবারের সন্তান যে কিনা গত ৩০ বছরে সচিব হয়েছে? যুগ্মসচিব হতে পেরেছে? উপসচিব হতে পেরেছে?
তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল, এতসবের পরেও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই যে আলোচনা শোনা যাচ্ছিল, দেশে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। এই বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কিছু রয়েছে কিনা? রেওয়াজ অনুযায়ী আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এই বাজেট পাস হয়ে যাবে। যদি সুযোগ থাকে এই বাজেটের কোন অংশ আপনি বাদ দেবেন বা সংযোজন করতে বলবেন?
আমি বলব জরুরি ভিত্তিতে মজুদের পরিমাণ বাড়াতে হবে। শ্রমিক এলাকায় রেশনিং করার ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি সফল করতে হলে সরকারি মজুদ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আরেকটা বিষয় খাদ্যের ব্যাপারে। বলা হচ্ছে ৫০ লাখ মানুষকে পাঁচ মাস ধরে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। তাতে আমাদের লাগবে আট লাখ ২৭ হাজার টন। এখন আমাদের কাছে মজুদ আছে ২০ লাখ টন এবং তার মধ্যে চার লাখ টন সবসময়ের জন্য মজুদ রাখতে হবে। তাহলে থাকল ১৬ লাখ টন। এর মধ্য থেকেই ৮ লাখ ২৭ হাজার টন চলে যাবে এই ৫০ লাখ মানুষের জন্য। আমরা যদি ৭ বছরে পদ্মা সেতু বানিয়ে ফেলতে পারি, তবে ১০ বছরে কেন ৮টি সাইলো বানাতে পারব না? খাদ্য নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে সাইলো। গরিব মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ চাল মজুদ করা প্রয়োজন তা অনেকাংশে কম। সুতরাং সাইলোর সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাজেটে এ ব্যাপারে তেমন কিছু লক্ষ করা গেল না। আগামীতে গামের্ন্টসকর্মী ছাড়াও অনেককে সহায়তা দিতে হতে পারে। তখন মজুদ নিয়ে সংকট তৈরি হবে। বাজেট বক্তব্যে এটি প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে সম্পদবৈষম্য। বড় দুর্বলতা হলো সম্পদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না। ভিত্তি ধরা হচ্ছে সম্পদ ক্রয়মূল্যকে, ন্যায্য বাজারমূল্যকে নয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর

ড. বিনায়ক সেন রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক। বিনায়ক সেন ১৯৮২ সালে রাশিয়ার মস্কো লমনোসভ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ও ১৯৮৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিআইডিএসে যোগ দেন তিনি। সামষ্টিক অর্থনীতির নানা বিষয় ছাড়াও দারিদ্র্যের গতিপ্রকৃতি বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। দারিদ্র্য সংক্রান্ত তার গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণ হয়েছে। এছাড়া আয়বৈষম্য ও মানব উন্নয়ন, শ্রমবাজার, সামাজিক সুরক্ষা, সুশাসন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ছাড়াও আর্থসামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার অভিজ্ঞতা রয়েছে ড. বিনায়ক সেনের। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহসান মাহমুদ
শুরুতেই জানতে চাইছি, এবারের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে। বাজেট কেমন হয়েছে?
এবারের বাজেট ম্যাক্রো ইকোনমিক্স স্ট্যাবল করার বাজেট। একটি গতিশীল অর্থনীতি চালু করতে একটি পাটাতন তৈরির বছর বলব এই বছরকে। বাজেটের কিছু কিছু পদক্ষেপ সঠিক দিকে থাকলেও আবার কিছ ুকিছু দিক নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে যেভাবে বাজেট দেওয়া হয়েছে তা রাজস্বের দিক থেকে বাস্তবসম্মত। গ্রোথের দিক থেকে অপটিমিস্টিক। যদি আমরা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের কথা বলি, তবে কিছু ক্ষেত্রে ঠিক পথেই আছে বলা যায়। আর গ্রোথের দিক থেকে অপটিমিস্টিক বলছি এ কারণে যে, গত পাঁচ বছর ধরেই আমাদের এখানে বিনিয়োগের হার ৩১-৩২ শতাংশে থমকে আছে। তা সত্ত্বেও এখানে এবার প্রবৃদ্ধি হারের প্রক্ষেপণ করা হয়েছে গত বছরের চেয়ে বেশি। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছিলেন, আমাদের উচিত সরকারি ব্যয় ২০ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া। সে জায়গায় আমরা উল্টো পথে চলেছি। কমিয়ে ১৫ এর নিচে আনা হয়েছে। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে এ বছর কৃচ্ছ্র সাধনের বছর, ব্যয় কমিয়ে আনার বছর। ডলারের দাম ঠিক রাখতে নিকট অতীতে আমাদের রিজার্ভ থেকে দুই বিলিয়ন ডলার বাজারে ছাড়া হয়েছে। এতে করে হয়তো রিজার্ভ চুয়াল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ বা আরও দুই কমে চল্লিশে নেমে এসেছে। কিন্তু এটা তো কোনো পন্থা হতে পারে না।
এবারের বাজেটটি এমন একটা সময়ে এলো, যখন বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনা মহামারীর ধাক্কা সামলানো এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে অর্থনীতিতে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ডলারের দামের বিপরীতে টাকার মান প্রতিনিয়ত কমছে। এমন অবস্থায় এই বাজেট বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কতটা কাজে দেবে বলে মনে করেন?
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তো আমাদের হাতে নেই। এটা আমাদের সৃষ্টও নয়। আবার করোনা মহামারীর যে প্রভাব তা থেকে উত্তরণেই এই পন্থা নেওয়া হয়েছে। এটা তো আমরা এড়াতে পারতাম না। এখন আমরা যেটা পারব এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। যার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে পারি। আমার মূল বক্তব্যটা হচ্ছে এবারের অর্থনৈতিক শকটি ২০০৭-০৮ এর মতো কাঠামোগত নয়। সেই সময়ে আমেরিকার হাউজিং মার্কেট থেকে যেভাবে একটি ধাক্কা এসেছিল সেটি সারা বিশ্বেই একটি প্রভাব ফেলেছিল। এবার সেভাবে হবে না। ইউক্রেনের সমস্যাটি কাঠামোগত নয়। তবে উন্নত বিশ্বে এর একটি প্রভাব পড়ছে আবার সারা বিশ্বেই এর প্রভাব বাড়ছে। ধরা যাক, আজকে যদি ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়ে যায় তবে তারপরের দিনই তেল-গ্যসের দামে প্রভাব পড়বে। তা কমতে শুরু করবে। সারসহ অন্যান্য পণ্যের দাম কমতে শুরু করবে। আমি মনে করি, ইউরোপ দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের মাশুল বইতে পারবে না। কারণ, সামনে শীত আসছে। তাদের গ্যাসের মজুদ নেই। তারা এখন চাইলেও নবায়নযোগ্য জ¦ালানিতে ফিরতে পারবে না। এর জন্য যথেষ্ট সময় দরকার। আমি আশাবাদী হতে চাই যে, এই গ্রীষ্মেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের একটি মীমাংসা দেখা যাবে। তাই এখন ডলারের দাম থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক যেসব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হচ্ছে তা সেপ্টেম্বরের মধ্যেই একটি গন্তব্যে যাবে।
এবারের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগে মানুষের দুর্নীতিতে আগ্রহী হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে কিনা?
বাজেটে এই বিষয়টি নাটকীয়ভাবে এসেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এর থেকে খুব বেশি অভিঘাত আমরা পাব না। কারণ এখন যারা বিদেশের ব্যাংকে অর্থ রেখেছেন, সেটা আনতেও তাদের আপত্তি নেই। শুধু ট্যাক্সের পরিমাণটা তাদের বেশি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতরেই কালো টাকা সাদা করার জন্য এতদিন যে ১০ ভাগ ট্যাক্সের মাধ্যমে সাদা করার সুযোগ ছিল, তার বদলে তারা এখন ৭ ভাগ ট্যাক্সের মাধ্যমে পাচার টাকা সাদা করবে। এতে করে আবার দেশের মধ্যেই যারা কালো টাকা রেখেছিল তারা এখন হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠাবে এবং পরে আবার ৭ ভাগ ট্যাক্স দিয়ে পাচারকরা টাকা হিসেবে ছাড় করিয়ে দেশে আনতে পারবে। এটা কালো টাকা উৎপাদনকারীদের জন্য লাভ। এখন এখানে একটি কিন্তু রাখা দরকার ছিল। এই টাকা যদি কোনো উৎপাদন খাতে বা বিনিয়োগ খাতে ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা থাকত তাহলে আমাদের লাভ হতো। কিন্তু এই টাকা যদি জমি কেনা বা ফ্ল্যাট কেনার কাজে ব্যয় হয় তাহলে তো আর কোনো লাভ হবে না। আর যদি ধরেও নিই এই উপায়ে বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা এলো, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে যদি দেশের ফ্ল্যাট বা জমি কিনতে চায় তাহলে এখন যারা দেশের মধ্যে থেকেই টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট বা জমি কিনতে চাইছেন তারা অনেক বেকায়দায় পড়ে যাবেন।
গত দুই বছরে করোনার প্রভাবে দেশের শিক্ষা খাত পিছিয়ে পড়েছে। আবার স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশাও দেখা গেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই দুটি খাতের বরাদ্দ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।
আমি সংক্ষিপ্তভাবে বাজেট যেভাবে দেখেছি, তাতে দেখেছি গত বছরের তুলনায় এবার স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়েনি। শিক্ষা খাতে কিছুটা বেড়েছে। আবার শিক্ষা খাতের সবগুলো উপ-খাতে বাড়েনি। কিছু উপ খাতে বেড়েছে। কিছু উপ খাতে বাড়েনি। যেমন প্রাইমারিতে বাড়লেও উচ্চশিক্ষা খাতে বাড়েনি। তাই আমি বলব না, সামাজিক অবকাঠামো খাতে বাজেট বেড়েছে। সামাজিক খাতের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে এই বাজেটে বলা হয়েছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়িয়ে যা বরাদ্দ আছে তা যথাযথভাবে খরচ করা। কারণ এর আগে দেখা গেছে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের অর্থ অব্যবহৃত থেকে গেছে। আমি একটি অঙ্ক উল্লেখ করতে পারি, একবার দেখা গেল স্বাস্থ্য খাত তার এডিপি বরাদ্দের পঞ্চাশ ভাগও ব্যবহার করতে পারেনি। নগরের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমি একটা কথা সবসময়ই বলি, সেটা হচ্ছে গ্রামের স্বাস্থ্যসেবার জন্য যেরকম স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, নগরের স্বাস্থ্যসেবার জন্য এমন কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তাই আমরা শহরের বিশেষ করে, সিটি করপোরেশন এলাকায় যদি দেখি ধনী এবং গরিবের স্বাস্থ্যসেবার পার্থক্য অনেক। আবার একইভাবে শিশুদের পুষ্টির দিক থেকেও ধনী-গরিবের পুষ্টির বৈষম্য অনেক। এটা তো হওয়ার কথা নয়। কারণ, সংবিধানেই ১৮ নম্বর ধারায় একইমাত্রার ন্যূনতম পুষ্টির অধিকারের নিশ্চয়তার কথা বলা আছে। তাই পুষ্টির এই বৈষম্য তো হওয়ার কথা নয়।
প্রস্তাবিত বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বাজেট হিসেবে মোটাদাগে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
বাজেট ব্যবসাবান্ধব হবে এটা স্বাভাবিক। কারণ কোনো দেশ যখন শিল্পে-বাণিজ্যে নির্ভর করতে শুরু করে তখন এসব প্রতিষ্ঠান বান্ধব হয়ে কাজ করবে এটা মেনে নিতেই হবে। তাই ব্যবসাবান্ধব হওয়াটা দোষের নয়। দেশীয় শিল্প ও কৃষি খাতে সুযোগ রাখা হয়েছে। বলা হচ্ছে আমরা এখন সমৃদ্ধি অর্জন করেছি। কিন্তু এই সমৃদ্ধিতে কার কী হলো? বঙ্কিমচন্দ্র একশো পঁচিশ বছর আগে প্রবন্ধে যেভাবে লিখেছেন শুনিতেছি আজিকাল দেশের শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে। কিন্তু এই শ্রীবৃদ্ধি কাহার? প্রশ্ন রেখে তিনি বলেছিলেন, এই শ্রীবৃদ্ধিতে কি রামা কৈবর্ত্য এবং রহিম শেখের কোনো উন্নতি সাধিত হইয়াছে? সেই প্রশ্ন আমরা এখনো করতে পারি। আমরা যদি আমাদের শ্রমিক পরিবারগুলোর দিকে তাকাই তাহলে আমরা কী দেখতে পাই? আমাদের সমৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কত বাড়ছে? শ্রমিকপরিবারের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির অবস্থা কী? এর দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই! এইসব জায়গাতে আমরা এখনো উন্নতি করতে পারিনি। আমরা কি একটি উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পারি কোনো একটি শ্রমিক পরিবারের সন্তান যে কিনা গত ৩০ বছরে সচিব হয়েছে? যুগ্মসচিব হতে পেরেছে? উপসচিব হতে পেরেছে?
তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল, এতসবের পরেও মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই যে আলোচনা শোনা যাচ্ছিল, দেশে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। এই বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কিছু রয়েছে কিনা? রেওয়াজ অনুযায়ী আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এই বাজেট পাস হয়ে যাবে। যদি সুযোগ থাকে এই বাজেটের কোন অংশ আপনি বাদ দেবেন বা সংযোজন করতে বলবেন?
আমি বলব জরুরি ভিত্তিতে মজুদের পরিমাণ বাড়াতে হবে। শ্রমিক এলাকায় রেশনিং করার ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি সফল করতে হলে সরকারি মজুদ সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আরেকটা বিষয় খাদ্যের ব্যাপারে। বলা হচ্ছে ৫০ লাখ মানুষকে পাঁচ মাস ধরে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। তাতে আমাদের লাগবে আট লাখ ২৭ হাজার টন। এখন আমাদের কাছে মজুদ আছে ২০ লাখ টন এবং তার মধ্যে চার লাখ টন সবসময়ের জন্য মজুদ রাখতে হবে। তাহলে থাকল ১৬ লাখ টন। এর মধ্য থেকেই ৮ লাখ ২৭ হাজার টন চলে যাবে এই ৫০ লাখ মানুষের জন্য। আমরা যদি ৭ বছরে পদ্মা সেতু বানিয়ে ফেলতে পারি, তবে ১০ বছরে কেন ৮টি সাইলো বানাতে পারব না? খাদ্য নিয়ে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে সাইলো। গরিব মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ চাল মজুদ করা প্রয়োজন তা অনেকাংশে কম। সুতরাং সাইলোর সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাজেটে এ ব্যাপারে তেমন কিছু লক্ষ করা গেল না। আগামীতে গামের্ন্টসকর্মী ছাড়াও অনেককে সহায়তা দিতে হতে পারে। তখন মজুদ নিয়ে সংকট তৈরি হবে। বাজেট বক্তব্যে এটি প্রায় অনুপস্থিত। দারিদ্র্য দূরীকরণের কথা বলা হলেও আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য দূরীকরণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। আয়বৈষম্য ও ভোগবৈষম্যের তুলনায় বেশি হারে বাড়ছে সম্পদবৈষম্য। বড় দুর্বলতা হলো সম্পদের মূল্যায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে না। ভিত্তি ধরা হচ্ছে সম্পদ ক্রয়মূল্যকে, ন্যায্য বাজারমূল্যকে নয়।
আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।