ঈদ ঘিরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় কড়াকড়ি আরোপ করা জরুরি
ডা. মুশতাক হোসেন | ৫ জুলাই, ২০২২ ১০:৩১
জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের ‘রিস্ক কমিউনিকেশন’ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। চাকরিজীবনে তিনি আইইডিসিআরের চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএস-সিডিসির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। দেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকা, আসন্ন ঈদুল আজহায় বিপুল সংখ্যক মানুষের গ্রামে ফেরা, ঈদযাত্রা ও ঈদের সময়ে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, টিকাকরণের মতো করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : জ্বর, সর্দি, কাশি, শরীর ব্যথা এমন উপসর্গ নিয়ে ১০০ জন মানুষ পরীক্ষা করালে ১৫ জনেরই করোনা শনাক্ত হচ্ছে। অনেকে এসব উপসর্গকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে কম। শনাক্ত না হওয়া করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসটি ছড়াতে ভূমিকা রাখছেন।
ডা. মুশতাক হোসেন : এখন দেশে করোনার যে সংক্রমণ চলছে এটাকে বেশিরভাগই তৃতীয় ঢেউ বললেও আমি মনে করি এটা করোনার চতুর্থ ঢেউ। এটা ঠিক যে, এর আগে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের যে সংক্রমণ হয়েছিল তার চেয়ে ওমিক্রনের চলমান ঢেউয়ে ক্ষয়ক্ষতির হার কিছুটা কম ছিল। কারণ যারা ডেল্টায় সংক্রমিত হয়েছিলেন এবং যারা টিকা নিয়েছেন তারা এতে গুরুতর অসুস্থ হননি। এখন ওমিক্রনেরই বিএ-৪ ও বিএ-৫ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে এর ক্ষয়ক্ষতিও ওমিক্রনের আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মতোই কম হবে, ডেল্টার তুলনায়। কিন্তু সর্বশেষ রোগতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, বিএ-৫ ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর হার কিন্তু আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে বেশি। আবার এটাও দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে এখন যারা এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের অনেকেই আগে সংক্রমিত হয়েছিলেন, আবার অনেকেই টিকাও নিয়েছেন। খেয়াল করার মতো বিষয় হলো দেশে প্রতি তিন মাস বা চার মাস পরপরই নতুন ঢেউ দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর যেখানেই নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট বা উপ-ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হলে সেটা খুব দ্রুতই বাংলাদেশেও চলে আসছে। ফলে এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সতর্কতা অবলম্বন না করে দেশে করোনা নিয়ে যে গা-ছাড়া ভাবটা দেখা যাচ্ছে সেটা ভয়াবহ বিপদও ডেকে আনতে পারে।
দেশ রূপান্তর : আমরা দেখলাম দেশে গত ৩০ মে থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত করোনায় কোনো মৃত্যু ছিল না। ২০ জুন একজন মারা গেলেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যু ঘটছে। শুক্রবার দেশে করোনায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ১০ দিনে সারা দেশে ১৭ হাজার ৬০৮ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর শুক্রবার রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন ৫২৫ জন।
ডা. মুশতাক হোসেন : এখন যারা করোনায় মারা যাচ্ছেন, রোগতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী এরা কমপক্ষে তিন সপ্তাহ আগে সংক্রমিত হয়েছিলেন। সংক্রমণের শুরুতেই হয়তো তারা গুরুতর পর্যায়ে যাননি। কিন্তু দুই সপ্তাহ পর তাদের অবস্থা হয়ে যায় আইসিইউ-এ নেওয়ার মতো। আর তৃতীয় সপ্তাহে এসে হয় তাদের অবস্থার উন্নতি হয় কিংবা তাদের অনেকে মারা যান। দেখুন তিন সপ্তাহ আগে এখানে সংক্রমণের সংখ্যা এখনকার চেয়ে কম ছিল। শনাক্তের হারও এখনকার চেয়ে কম ছিল। বর্তমান মৃত্যুগুলো যদি তিন সপ্তাহ আগের সংক্রমণ থেকে হয়ে থাকে, তাহলে এখন যারা সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের মৃত্যু হারের বিষয়টা প্রতিফলিত হবে তিন সপ্তাহ পর। এখন যেহেতু এই নতুন ঢেউয়ে সংক্রমণ ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠতে দেখা যাচ্ছে তাই সতর্কতা খুবই জরুরি। আর যদি এই মৃত্যুগুলো বিএ-৫ ভ্যারিয়েন্টের কারণে হয়ে থাকে তাহলে আগামী সপ্তাহগুলোতে মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে। এই পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীকে অনুরোধ করব যারা টিকার বুস্টার ডোজ নেননি বা দুই ডোজ শেষ করেননি বা একেবারেই টিকা নেননি, সবাই যাতে অবিলম্বে টিকা নিয়ে নেন। অন্যদিকে যারা টিকা নিয়েছেন তারাও যেন অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। সবার জন্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি।
দেশ রূপান্তর : মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। পরীক্ষার হারও কম। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগেও ঢিলেঢালা ভাব। ওমিক্রনের উপধরন নিয়ে উদ্বেগ থেকে গত ১৪ জুন করোনা মোকাবিলা জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভা থেকে ছয়টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এরপর ১৬ দিন পেরিয়ে গেলেও সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। এক্ষেত্রে আসলে কী করণীয়?
ডা. মুশতাক হোসেন : জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সঠিক সময়ে সঠিক প্রস্তাবনা এবং ছয় দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের কথা বলেছে। সরকারের উচিত ছিল এটা বাস্তবায়নে উদ্যমী হওয়া। কিন্তু আমরা দেখলাম তারা বেশি সময় নিয়ে ফেললেন। কারণ একটা সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা জারি করলেই হয় না। সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির আরও কয়েকটি ধাপে বৈঠক করতে হয়, ক্রমান্বয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটা দূর করতে দেখভাল করতে হয়, সহযোগিতা করতে হয়। আর এটা শুধু সরকারের প্রশাসনের একার কাজ নয়। মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা আছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা আছেন, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মীরা আছেন, বাজার কমিটি, স্কুল-কলেজের কমিটি, মসজিদ-উপাসনালয়ের কমিটি এমন জনসম্পৃক্ত ধাপগুলোকে সক্রিয় করতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এভাবে ধাপে ধাপে সমাজের সব অংশকে সক্রিয় করার প্রচেষ্টা আমরা দেখছি না। সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতাল, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে শুরু করে সেবাদানের পর্যায়গুলোতে কি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে? স্বাস্থ্যসেবার ফ্রন্টলাইনারদের শতভাগ কি টিকার সবগুলো ডোজ নিয়েছেন? এসব প্রশ্নের উত্তরও আমাদের খোঁজা জরুরি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আসলে যে পর্যায়ে আমাদের সতর্কতা ও সচেতনতা দরকার সেটা করার জন্য সরকার কিংবা সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যেই দুর্বলতা রয়ে গেছে।
কিন্তু এখন সময় এসেছে এসব বিষয় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার। এখন বদ্ধ ঘরে সভা-সমাবেশ-সম্মিলন নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। যেখানে আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে না, সেসব স্থানে আয়তন অনুযায়ী কত মানুষ একত্রিত হতে পারবেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরে কীভাবে অংশ নেবেন সেসব নির্দেশনা জরুরি। মসজিদে নামাজের বিষয়ে যে ৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেটা মানা জরুরি। একইভাবে শপিং মল, বাজার, বাসস্ট্যান্ড, টার্মিনাল, লঞ্চঘাট সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় কড়াকড়ি আরোপ করা দরকার।
দেশ রূপান্তর : শুক্রবার পর্যন্ত দেশের ৫১টি জেলায় করোনা শনাক্তের তথ্য পাওয়া গেছে। আর মাত্র সাত দিন পর পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদকে কেন্দ্র করে পশুরহাট, বাজারঘাট, গণপরিবহনে জনসমাগম বাড়বে। এতে সংক্রমণ আরও ছড়ানোর ঝুঁকি আছে। আপনি কীভাবে দেখছেন।
ডা. মুশতাক হোসেন : এটা সত্যিই উদ্বেগের। ইতিমধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। ঈদকে ঘিরে গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর খামারিরা শহরগুলোতে আসছেন। নানা শহরেই গরুর হাট বসতে শুরু করেছে। আবার ঢাকাসহ বড় বড় শহরের মানুষরা ঈদ করতে, আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হতে গ্রামে ফিরতে শুরু করবেন। ঈদের নামাজে বড় ধরনের গণসম্মিলন হবে মানুষের। এসব ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বড় ধরনের ঝুঁকি থাকে। এখন কথা হলো, আমরা কিন্তু করোনাকালেই বিগত পাঁচটি ঈদ এভাবে পাড়ি দিয়েছি। ঈদে আগে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল সেই একই নির্দেশনা আর সতর্কতাগুলো এখন পরিপালন করা জরুরি। যাতায়াতের ক্ষেত্রে এবার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে আগের মতো ফেরিতে-লঞ্চে গাদাগাদি ভিড় করতে হবে না। পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলসহ সবখানেই ট্রেনে আর বাসে সবখানেই সতর্কতা মানতে হবে। ট্রেনেও কিন্তু মারাত্মক ভিড় হয়। এক্ষেত্রে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে সরকার। আর ঈদের জামাতে কোলাকুলি-হ্যান্ডশেক না করা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জামাতে দাঁড়ানো এগুলো মান্য করা দরকার। তবে আবারও বলছি, এটা কেবল সরকারের প্রশাসন একা সামলাতে পারবে না। এটা সবারই দায়িত্ব। সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে এক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ সাফল্য দেখিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ৪ শতাংশকে পূর্ণ দুই ডোজ টিকা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। টিকাকরণের কতটা সুফল পাচ্ছি আমরা? এখন করণীয় কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : টিকাকরণের সুফল আমরা অবশ্যই পাচ্ছি। টিকাকরণে এই সাফল্য এসেছে বলেই এখন মৃত্যুর হার কম। যারা টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে মৃত্যুহার যেমন কম একইভাবে টিকা নেওয়ার কারণেই এখন হাসপাতালগুলোতেও ভিড় নেই। ওমিক্রনের প্রথম-দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও আমরা এমন দেখেছি। তবে, আমি জোর দিয়ে যেটা বলতে চাই সেটা হলো, আমাদের দেখা দরকার বয়স্ক জনগোষ্ঠী, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে আক্রান্ত তাদের শতভাগ টিকাকরণ শেষ হয়েছে কি না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা পঞ্চাশোর্ধ্ব সবারই শতভাগ টিকাকরণ দরকার। আবার স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বাহিনীসহ নানা ক্ষেত্রে যারা ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করেন তাদের শতভাগ টিকাকরণ দরকার। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ এবং টিকার পূর্ণাঙ্গ ডোজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবারই ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হওয়া দরকার। একইভাবে এই কাজে যারা পিছিয়ে আছেন তাদের সামাজিকভাবে সহায়তা করতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে এ বিষয়ে জোরদার উদ্যোগ নিতে হবে পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। কারণ সরকার যদি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করতে না পারে তাহলে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রের সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ে। এই মহামারীর প্রথমদিকেই সেটা আমরা দেখেছি। তাই এই ক্ষেত্রেই সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. মুশতাক হোসেন : দেশ রূপান্তরকেও ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
ডা. মুশতাক হোসেন | ৫ জুলাই, ২০২২ ১০:৩১

জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় মুখ্য ভূমিকা পালনকারী রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি বিশ্বব্যাংকের ‘রিস্ক কমিউনিকেশন’ উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। চাকরিজীবনে তিনি আইইডিসিআরের চিকিৎসা সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউএস-সিডিসির উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। দেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকা, আসন্ন ঈদুল আজহায় বিপুল সংখ্যক মানুষের গ্রামে ফেরা, ঈদযাত্রা ও ঈদের সময়ে করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, টিকাকরণের মতো করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : জ্বর, সর্দি, কাশি, শরীর ব্যথা এমন উপসর্গ নিয়ে ১০০ জন মানুষ পরীক্ষা করালে ১৫ জনেরই করোনা শনাক্ত হচ্ছে। অনেকে এসব উপসর্গকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে কম। শনাক্ত না হওয়া করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসটি ছড়াতে ভূমিকা রাখছেন।
ডা. মুশতাক হোসেন : এখন দেশে করোনার যে সংক্রমণ চলছে এটাকে বেশিরভাগই তৃতীয় ঢেউ বললেও আমি মনে করি এটা করোনার চতুর্থ ঢেউ। এটা ঠিক যে, এর আগে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের যে সংক্রমণ হয়েছিল তার চেয়ে ওমিক্রনের চলমান ঢেউয়ে ক্ষয়ক্ষতির হার কিছুটা কম ছিল। কারণ যারা ডেল্টায় সংক্রমিত হয়েছিলেন এবং যারা টিকা নিয়েছেন তারা এতে গুরুতর অসুস্থ হননি। এখন ওমিক্রনেরই বিএ-৪ ও বিএ-৫ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। অনেকেই ধারণা করেছিলেন যে এর ক্ষয়ক্ষতিও ওমিক্রনের আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর মতোই কম হবে, ডেল্টার তুলনায়। কিন্তু সর্বশেষ রোগতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, বিএ-৫ ভ্যারিয়েন্টে মৃত্যুর হার কিন্তু আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চেয়ে বেশি। আবার এটাও দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে এখন যারা এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের অনেকেই আগে সংক্রমিত হয়েছিলেন, আবার অনেকেই টিকাও নিয়েছেন। খেয়াল করার মতো বিষয় হলো দেশে প্রতি তিন মাস বা চার মাস পরপরই নতুন ঢেউ দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর যেখানেই নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট বা উপ-ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হলে সেটা খুব দ্রুতই বাংলাদেশেও চলে আসছে। ফলে এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সতর্কতা অবলম্বন না করে দেশে করোনা নিয়ে যে গা-ছাড়া ভাবটা দেখা যাচ্ছে সেটা ভয়াবহ বিপদও ডেকে আনতে পারে।
দেশ রূপান্তর : আমরা দেখলাম দেশে গত ৩০ মে থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত করোনায় কোনো মৃত্যু ছিল না। ২০ জুন একজন মারা গেলেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যু ঘটছে। শুক্রবার দেশে করোনায় পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ১০ দিনে সারা দেশে ১৭ হাজার ৬০৮ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর শুক্রবার রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন ৫২৫ জন।
ডা. মুশতাক হোসেন : এখন যারা করোনায় মারা যাচ্ছেন, রোগতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী এরা কমপক্ষে তিন সপ্তাহ আগে সংক্রমিত হয়েছিলেন। সংক্রমণের শুরুতেই হয়তো তারা গুরুতর পর্যায়ে যাননি। কিন্তু দুই সপ্তাহ পর তাদের অবস্থা হয়ে যায় আইসিইউ-এ নেওয়ার মতো। আর তৃতীয় সপ্তাহে এসে হয় তাদের অবস্থার উন্নতি হয় কিংবা তাদের অনেকে মারা যান। দেখুন তিন সপ্তাহ আগে এখানে সংক্রমণের সংখ্যা এখনকার চেয়ে কম ছিল। শনাক্তের হারও এখনকার চেয়ে কম ছিল। বর্তমান মৃত্যুগুলো যদি তিন সপ্তাহ আগের সংক্রমণ থেকে হয়ে থাকে, তাহলে এখন যারা সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের মৃত্যু হারের বিষয়টা প্রতিফলিত হবে তিন সপ্তাহ পর। এখন যেহেতু এই নতুন ঢেউয়ে সংক্রমণ ক্রমাগত ওপরের দিকে উঠতে দেখা যাচ্ছে তাই সতর্কতা খুবই জরুরি। আর যদি এই মৃত্যুগুলো বিএ-৫ ভ্যারিয়েন্টের কারণে হয়ে থাকে তাহলে আগামী সপ্তাহগুলোতে মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা আছে। এই পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমরা দেশবাসীকে অনুরোধ করব যারা টিকার বুস্টার ডোজ নেননি বা দুই ডোজ শেষ করেননি বা একেবারেই টিকা নেননি, সবাই যাতে অবিলম্বে টিকা নিয়ে নেন। অন্যদিকে যারা টিকা নিয়েছেন তারাও যেন অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন। সবার জন্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি।
দেশ রূপান্তর : মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। পরীক্ষার হারও কম। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগেও ঢিলেঢালা ভাব। ওমিক্রনের উপধরন নিয়ে উদ্বেগ থেকে গত ১৪ জুন করোনা মোকাবিলা জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভা থেকে ছয়টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এরপর ১৬ দিন পেরিয়ে গেলেও সেসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। এক্ষেত্রে আসলে কী করণীয়?
ডা. মুশতাক হোসেন : জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সঠিক সময়ে সঠিক প্রস্তাবনা এবং ছয় দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের কথা বলেছে। সরকারের উচিত ছিল এটা বাস্তবায়নে উদ্যমী হওয়া। কিন্তু আমরা দেখলাম তারা বেশি সময় নিয়ে ফেললেন। কারণ একটা সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা জারি করলেই হয় না। সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির আরও কয়েকটি ধাপে বৈঠক করতে হয়, ক্রমান্বয়ে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোথাও ঘাটতি থাকলে সেটা দূর করতে দেখভাল করতে হয়, সহযোগিতা করতে হয়। আর এটা শুধু সরকারের প্রশাসনের একার কাজ নয়। মাঠ পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিরা আছেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা আছেন, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মীরা আছেন, বাজার কমিটি, স্কুল-কলেজের কমিটি, মসজিদ-উপাসনালয়ের কমিটি এমন জনসম্পৃক্ত ধাপগুলোকে সক্রিয় করতে হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, এভাবে ধাপে ধাপে সমাজের সব অংশকে সক্রিয় করার প্রচেষ্টা আমরা দেখছি না। সরকারি স্বাস্থ্যসেবায় হাসপাতাল, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র থেকে শুরু করে সেবাদানের পর্যায়গুলোতে কি যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হচ্ছে? স্বাস্থ্যসেবার ফ্রন্টলাইনারদের শতভাগ কি টিকার সবগুলো ডোজ নিয়েছেন? এসব প্রশ্নের উত্তরও আমাদের খোঁজা জরুরি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আসলে যে পর্যায়ে আমাদের সতর্কতা ও সচেতনতা দরকার সেটা করার জন্য সরকার কিংবা সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যেই দুর্বলতা রয়ে গেছে।
কিন্তু এখন সময় এসেছে এসব বিষয় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার। এখন বদ্ধ ঘরে সভা-সমাবেশ-সম্মিলন নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। যেখানে আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে না, সেসব স্থানে আয়তন অনুযায়ী কত মানুষ একত্রিত হতে পারবেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মাস্ক পরে কীভাবে অংশ নেবেন সেসব নির্দেশনা জরুরি। মসজিদে নামাজের বিষয়ে যে ৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেটা মানা জরুরি। একইভাবে শপিং মল, বাজার, বাসস্ট্যান্ড, টার্মিনাল, লঞ্চঘাট সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় কড়াকড়ি আরোপ করা দরকার।
দেশ রূপান্তর : শুক্রবার পর্যন্ত দেশের ৫১টি জেলায় করোনা শনাক্তের তথ্য পাওয়া গেছে। আর মাত্র সাত দিন পর পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদকে কেন্দ্র করে পশুরহাট, বাজারঘাট, গণপরিবহনে জনসমাগম বাড়বে। এতে সংক্রমণ আরও ছড়ানোর ঝুঁকি আছে। আপনি কীভাবে দেখছেন।
ডা. মুশতাক হোসেন : এটা সত্যিই উদ্বেগের। ইতিমধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলায় করোনা শনাক্ত হয়েছে। ঈদকে ঘিরে গ্রামাঞ্চল থেকে গরুর খামারিরা শহরগুলোতে আসছেন। নানা শহরেই গরুর হাট বসতে শুরু করেছে। আবার ঢাকাসহ বড় বড় শহরের মানুষরা ঈদ করতে, আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হতে গ্রামে ফিরতে শুরু করবেন। ঈদের নামাজে বড় ধরনের গণসম্মিলন হবে মানুষের। এসব ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বড় ধরনের ঝুঁকি থাকে। এখন কথা হলো, আমরা কিন্তু করোনাকালেই বিগত পাঁচটি ঈদ এভাবে পাড়ি দিয়েছি। ঈদে আগে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল সেই একই নির্দেশনা আর সতর্কতাগুলো এখন পরিপালন করা জরুরি। যাতায়াতের ক্ষেত্রে এবার দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে আগের মতো ফেরিতে-লঞ্চে গাদাগাদি ভিড় করতে হবে না। পদ্মা সেতু হয়ে গেছে। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলসহ সবখানেই ট্রেনে আর বাসে সবখানেই সতর্কতা মানতে হবে। ট্রেনেও কিন্তু মারাত্মক ভিড় হয়। এক্ষেত্রে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে সরকার। আর ঈদের জামাতে কোলাকুলি-হ্যান্ডশেক না করা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে জামাতে দাঁড়ানো এগুলো মান্য করা দরকার। তবে আবারও বলছি, এটা কেবল সরকারের প্রশাসন একা সামলাতে পারবে না। এটা সবারই দায়িত্ব। সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে এক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করতে হবে, কাজে লাগাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ সাফল্য দেখিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ৪ শতাংশকে পূর্ণ দুই ডোজ টিকা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। টিকাকরণের কতটা সুফল পাচ্ছি আমরা? এখন করণীয় কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : টিকাকরণের সুফল আমরা অবশ্যই পাচ্ছি। টিকাকরণে এই সাফল্য এসেছে বলেই এখন মৃত্যুর হার কম। যারা টিকা নিয়েছেন তাদের মধ্যে মৃত্যুহার যেমন কম একইভাবে টিকা নেওয়ার কারণেই এখন হাসপাতালগুলোতেও ভিড় নেই। ওমিক্রনের প্রথম-দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়েও আমরা এমন দেখেছি। তবে, আমি জোর দিয়ে যেটা বলতে চাই সেটা হলো, আমাদের দেখা দরকার বয়স্ক জনগোষ্ঠী, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে আক্রান্ত তাদের শতভাগ টিকাকরণ শেষ হয়েছে কি না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটা পঞ্চাশোর্ধ্ব সবারই শতভাগ টিকাকরণ দরকার। আবার স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বাহিনীসহ নানা ক্ষেত্রে যারা ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করেন তাদের শতভাগ টিকাকরণ দরকার। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ এবং টিকার পূর্ণাঙ্গ ডোজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবারই ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হওয়া দরকার। একইভাবে এই কাজে যারা পিছিয়ে আছেন তাদের সামাজিকভাবে সহায়তা করতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে এ বিষয়ে জোরদার উদ্যোগ নিতে হবে পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। কারণ সরকার যদি মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলা করতে না পারে তাহলে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রের সবকিছুই হুমকির মুখে পড়ে। এই মহামারীর প্রথমদিকেই সেটা আমরা দেখেছি। তাই এই ক্ষেত্রেই সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. মুশতাক হোসেন : দেশ রূপান্তরকেও ধন্যবাদ।