বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ভোক্তাবান্ধব নয়
এম শামসুল আলম | ১৭ জুলাই, ২০২২ ০৯:৪১
অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা। দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি, জ্বালানি সংকট, লোডশেডিংসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ-
দেশ রূপান্তর : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখন গভীর সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো বলে মনে করেন?
এম শামসুল আলম : বিদ্যুৎ সংকট হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়েছে এটা বলা যাবে না। বিদ্যুতের সংকট আগেও ছিল। আমাদের দেশে আমরা দেখেছি, বিদ্যুতের সংকট মূলত শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশক থেকে। এরপর ২০০৫-২০০৬ এর দিকের ঘটনা আমরা মনে করতে পারি, তখন মাইলের পর মাইল আমরা বিতরণ লাইন বসিয়েছিলাম, কিন্তু তাতে বিদ্যুৎ ছিল না। তারপরে আবার আমরা দেখলাম ২০২০ এর সময় থেকে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের লাইন সঞ্চালন করা হলো। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা আমরা করতে পারলাম না। তাই বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যা থেকেই গেল। এটা যেমন সত্যি আবার একইসঙ্গে এই সমস্যাটি যে পুরনো তাও সত্যি। মাঝে এক বছর বা আধা বছর সমস্যাটা কম ছিল তুলনামূলক।
একটা সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন ছিল না, আর এখন মেশিন আছে কিন্তু জ্বালানির অভাবে উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের নিজস্ব জ্বালানি গ্যাস ও কয়লা আমরা উত্তোলন করিনি। আমরা এক সময় গ্যাস দিয়ে, কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার মেশিন জোগাড় করতে পারিনি তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল। আবার এখন মেশিন হয়েছে কিন্তু গ্যাস ও কয়লা নেই! আমরা এলএনজি আমদানি করা শুরু করলাম, বলা হলো আমদানি করা এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু তাতে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি করেও সমন্বয় করতে পারিনি। ২০২০ সালে আমরা ৩৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে একটি ব্যালেন্স পজিশনে এলাম। এরপরে করোনা মহামারী চলে এলো। সেই সময়ে ভালোভাবেই চলতে থাকল। করোনা পরিস্থিতির এক সময়ে উন্নতি হলো। আর তার ঠিক পরেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এই যুদ্ধের ফলে একটি নতুন মাত্রা যোগ হলো জ্বালানি সংকটে।
দেশ রূপান্তর : এখন জ্বালানি সংকটের পর দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এটা সংকট শুরুর আগেই করার সুযোগ ছিল কি?
এম শামসুল আলম : আমরা মনে করতে পারি, একটা সময়ে দেশের গ্যাস ও কয়লা রপ্তানি ঠেকাতে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। তখন আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে তা বন্ধও হয়েছিল। কিন্তু এতে করে যেটি হয়েছে, রপ্তানি বন্ধ হলেও নতুন গ্যাস-কয়লা অনুসন্ধান, উত্তোলনও বন্ধ হয়েছে। যদি রপ্তানিটা চালু থাকত তাহলে হয়তো অনুসন্ধান বা উত্তোলনও থাকত। এখন বলতে পারি যে, রপ্তানি করতে দিলাম না বলেই নতুন গ্যাস বা কয়লা উৎপাদন হলো না। এ ছাড়া আর কী ব্যাখ্যা আছে! কিন্তু বোকার মতো আমরা কোন দিকে গেলাম? আমরা করলাম কী? আমরা উৎপাদন বন্ধ করে দিলাম। উল্টো আমদানি শুরু করে দিলাম। ধরা যাক, আমার গ্যাস আমি তুললে এক টাকা তিন পয়সায় তুলতে পারতাম। এখন সেটা আমদানি করতে হয় তিরাশি টাকায়! এই যে ভয়ংকর রকমের অসংগতি এর কোনো ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই। জ¦ালানি নীতি সমন্বয়ের কাজটি আমরা জনস্বার্থ ও জনকল্যাণের বিবেচনা করে করিনি।
দেশ রূপান্তর : এখন বিশ্ববাজারেও এলএনজির দাম চড়া। তাই আমদানি কমেছে। আর এ কারণেই বর্তমান সংকট এমন আলোচনাও রয়েছে ...
এম শামসুল আলম : এলএনজি আমদানিতে সরকার এগারো হাজার আটশ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে ভর্তুকি পরের বিষয়, এটা যে ক্রয় করতে হবে, সেই ক্রয়ের টাকাটাও সরকারের নেই। অর্থাৎ, প্রথমে সরকারকে এটি ক্রয় করতে হবে। তারপরে বাজারে বিক্রি করলে সরকারের এগারো হাজার আটশ কোটি টাকা লোকসান হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ক্রয়ের টাকাটাই নেই। ভর্তুকি তো পরের বিষয়। প্রথমে কিনতে হবে। তারপর সেটি বিক্রি করতে হবে। এই বিক্রির পর সেই টাকাটা ঘরে আসবে। এতে করেও অন্তত দুই তিনমাস লাগবে।
দেশ রূপান্তর : লোডশেডিংয়ে সারা দেশের গ্রাহকের ভোগান্তি হচ্ছে, এটা কীভাবে কমানো যায়? আবার সরকারপ্রধানও বলেছেন লোডশেডিংয়ের সময় আগেই জানিয়ে দিতে। পুরো বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এম শামসুল আলম : লোডশেডিয়েংর কোনো পরিকল্পনা কি আমরা পেয়েছি? এখনো পাইনি। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কথা। কিন্তু এখনো পরিপূর্ণ পরিকল্পনা আমরা কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। যেভাবে সমস্যার কথা ওপরের দিক থেকে শোনা গেল, সমাধানের কথা তো সেভাবে শোনা গেল না। লোডশেডিং কেন হচ্ছে? জ্বালানি সংকটের জন্য। এখন জ্বালানি সংকটের জন্য বিদ্যুতের ঘাটতি হয়েছে বলা হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মূল্যবৃদ্ধি করা হলো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অনেক টাকা সরিয়ে নেওয়া হলো। এসব কেন হলো এর সদুত্তর আমাদের সামনে নেই।
দেশ রূপান্তর : উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন এগোতে পারেনি। এর জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে, আপনি কী মনে করছেন?
এম শামসুল আলম : বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, তার জন্য সঞ্চালন লাইনে ঘাটতি নেই। প্রক্ষেপণ অনুসারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। বিশেষ করে শিল্প খাতে বাড়েনি। এটিও আমাদের জন্য অশনিসংকেত। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় এসব খাতের বড় অংশ নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল রয়ে গেছে। তাই জাতীয় গ্রিডে চাহিদা বাড়েনি। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। এ খাতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও শোনা গিয়েছিল। এটি হলে আরও ভয়াবহ হতো।
দেশ রূপান্তর : সরকার তো বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়নের দাবি করে থাকে। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা হয়েছে উল্লেখ করে এটি উদ্্যাপনও করা হয়েছিল।
এম শামসুল আলম : প্রকৃত অর্থে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন হয়নি। বলতে পারি, শতভাগ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ঢাকার বাইরে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। কারণ, বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে। অভিযোগ রয়েছে, ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনও এখন কম করা হয়। বাস্তবে দেখা যায়, সক্ষমতা উন্নয়নে মান রক্ষা না হওয়ায় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ন্ত্রণে নেই। ১০ ডলারের মিটার ২৫ ডলারে কিনে প্রান্তিক ভোক্তার ৩০ টাকারও কম বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে মাসে ৪০ টাকা মিটার ভাড়া আদায় করা হয়। চুক্তির প্রথম মেয়াদেই প্রদত্ত ক্যাপাসিটি চার্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয় উশুল হয়েছে অথচ এরপর চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও সেই চুক্তির মেয়াদ বারবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে অথচ চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো অব্যাহত রাখা হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে কম দামে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। অথচ সেই গ্যাস ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিয়ে সেখান থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা সাশ্রয়ী মূল্যে উত্তোলন ও ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানিকৃত কয়লা, এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কৌশলে বিদ্যুৎ খাতের এমন সব উন্নয়ন হয়েছে, যা ভোক্তা বা গণবান্ধব নয়, অসাধু ব্যবসাবান্ধব।
দেশ রূপান্তর : কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে...
এম শামসুল আলম : বিদ্যুৎ সংকটের দোহাই দিয়ে সরকার অনেক কোম্পানিকে এ সুযোগ দিয়েছিল। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধারণাটি জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী। কোম্পানিগুলো থেকে সরকার উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনেছে। একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে অসাধু ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে যাচ্ছে। আমরা তখন বলেছিলাম, রেন্টাল, কুইক রেন্টালের দরকার নেই। পিডিবির সক্ষমতা বাড়ালে তারা বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবে। কিন্তু কী কারণে এসব অসাধু ব্যবসায়ীকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তার কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই।
দেশ রূপান্তর : আপনার পরামর্শ কী?
এম শামসুল আলম : এখন পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের যে কথা বলা হচ্ছে তা একটি যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে করতে হবে। কোন সঞ্চালনে কতজন গ্রাহক, কোন ফিডারে কত ঘাটতি আগে তা পরিমাপ করতে হবে। তারপরে সুপরিকল্পিতভাবে এটা করতে হবে। কখন কোন লাইন কতক্ষণ বন্ধ থাকবে, সচল থাকবে তা নির্ধাারিত হতে হবে। তা না হলে মুখে মুখে লোডশেডিংয়ের কথা বলে আর জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে সমাধান আসবে না। শুধু মুখে মুখে পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কথা বলার আগেও যেমন লোডশেডিং হতো পরিকল্পনা না থাকলে সামনেও এমন হবে।
দেশ রূপান্তর : ধন্যবাদ আপনাকে।
এম শামসুল আলম : আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকে ধন্যবাদ।
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
এম শামসুল আলম | ১৭ জুলাই, ২০২২ ০৯:৪১

অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা। দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি, জ্বালানি সংকট, লোডশেডিংসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ-
দেশ রূপান্তর : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এখন গভীর সংকটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো বলে মনে করেন?
এম শামসুল আলম : বিদ্যুৎ সংকট হঠাৎ করেই সৃষ্টি হয়েছে এটা বলা যাবে না। বিদ্যুতের সংকট আগেও ছিল। আমাদের দেশে আমরা দেখেছি, বিদ্যুতের সংকট মূলত শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশক থেকে। এরপর ২০০৫-২০০৬ এর দিকের ঘটনা আমরা মনে করতে পারি, তখন মাইলের পর মাইল আমরা বিতরণ লাইন বসিয়েছিলাম, কিন্তু তাতে বিদ্যুৎ ছিল না। তারপরে আবার আমরা দেখলাম ২০২০ এর সময় থেকে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের লাইন সঞ্চালন করা হলো। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা আমরা করতে পারলাম না। তাই বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যা থেকেই গেল। এটা যেমন সত্যি আবার একইসঙ্গে এই সমস্যাটি যে পুরনো তাও সত্যি। মাঝে এক বছর বা আধা বছর সমস্যাটা কম ছিল তুলনামূলক।
একটা সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন ছিল না, আর এখন মেশিন আছে কিন্তু জ্বালানির অভাবে উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের নিজস্ব জ্বালানি গ্যাস ও কয়লা আমরা উত্তোলন করিনি। আমরা এক সময় গ্যাস দিয়ে, কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার মেশিন জোগাড় করতে পারিনি তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল। আবার এখন মেশিন হয়েছে কিন্তু গ্যাস ও কয়লা নেই! আমরা এলএনজি আমদানি করা শুরু করলাম, বলা হলো আমদানি করা এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু তাতে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধি করেও সমন্বয় করতে পারিনি। ২০২০ সালে আমরা ৩৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে একটি ব্যালেন্স পজিশনে এলাম। এরপরে করোনা মহামারী চলে এলো। সেই সময়ে ভালোভাবেই চলতে থাকল। করোনা পরিস্থিতির এক সময়ে উন্নতি হলো। আর তার ঠিক পরেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এই যুদ্ধের ফলে একটি নতুন মাত্রা যোগ হলো জ্বালানি সংকটে।
দেশ রূপান্তর : এখন জ্বালানি সংকটের পর দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। এটা সংকট শুরুর আগেই করার সুযোগ ছিল কি?
এম শামসুল আলম : আমরা মনে করতে পারি, একটা সময়ে দেশের গ্যাস ও কয়লা রপ্তানি ঠেকাতে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। তখন আন্দোলন ও প্রতিবাদের মুখে তা বন্ধও হয়েছিল। কিন্তু এতে করে যেটি হয়েছে, রপ্তানি বন্ধ হলেও নতুন গ্যাস-কয়লা অনুসন্ধান, উত্তোলনও বন্ধ হয়েছে। যদি রপ্তানিটা চালু থাকত তাহলে হয়তো অনুসন্ধান বা উত্তোলনও থাকত। এখন বলতে পারি যে, রপ্তানি করতে দিলাম না বলেই নতুন গ্যাস বা কয়লা উৎপাদন হলো না। এ ছাড়া আর কী ব্যাখ্যা আছে! কিন্তু বোকার মতো আমরা কোন দিকে গেলাম? আমরা করলাম কী? আমরা উৎপাদন বন্ধ করে দিলাম। উল্টো আমদানি শুরু করে দিলাম। ধরা যাক, আমার গ্যাস আমি তুললে এক টাকা তিন পয়সায় তুলতে পারতাম। এখন সেটা আমদানি করতে হয় তিরাশি টাকায়! এই যে ভয়ংকর রকমের অসংগতি এর কোনো ব্যাখ্যা কারও কাছে নেই। জ¦ালানি নীতি সমন্বয়ের কাজটি আমরা জনস্বার্থ ও জনকল্যাণের বিবেচনা করে করিনি।
দেশ রূপান্তর : এখন বিশ্ববাজারেও এলএনজির দাম চড়া। তাই আমদানি কমেছে। আর এ কারণেই বর্তমান সংকট এমন আলোচনাও রয়েছে ...
এম শামসুল আলম : এলএনজি আমদানিতে সরকার এগারো হাজার আটশ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে ভর্তুকি পরের বিষয়, এটা যে ক্রয় করতে হবে, সেই ক্রয়ের টাকাটাও সরকারের নেই। অর্থাৎ, প্রথমে সরকারকে এটি ক্রয় করতে হবে। তারপরে বাজারে বিক্রি করলে সরকারের এগারো হাজার আটশ কোটি টাকা লোকসান হবে। কিন্তু কথা হচ্ছে এই ক্রয়ের টাকাটাই নেই। ভর্তুকি তো পরের বিষয়। প্রথমে কিনতে হবে। তারপর সেটি বিক্রি করতে হবে। এই বিক্রির পর সেই টাকাটা ঘরে আসবে। এতে করেও অন্তত দুই তিনমাস লাগবে।
দেশ রূপান্তর : লোডশেডিংয়ে সারা দেশের গ্রাহকের ভোগান্তি হচ্ছে, এটা কীভাবে কমানো যায়? আবার সরকারপ্রধানও বলেছেন লোডশেডিংয়ের সময় আগেই জানিয়ে দিতে। পুরো বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এম শামসুল আলম : লোডশেডিয়েংর কোনো পরিকল্পনা কি আমরা পেয়েছি? এখনো পাইনি। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কথা। কিন্তু এখনো পরিপূর্ণ পরিকল্পনা আমরা কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। যেভাবে সমস্যার কথা ওপরের দিক থেকে শোনা গেল, সমাধানের কথা তো সেভাবে শোনা গেল না। লোডশেডিং কেন হচ্ছে? জ্বালানি সংকটের জন্য। এখন জ্বালানি সংকটের জন্য বিদ্যুতের ঘাটতি হয়েছে বলা হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মূল্যবৃদ্ধি করা হলো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অনেক টাকা সরিয়ে নেওয়া হলো। এসব কেন হলো এর সদুত্তর আমাদের সামনে নেই।
দেশ রূপান্তর : উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন এগোতে পারেনি। এর জন্য খেসারত দিতে হচ্ছে, আপনি কী মনে করছেন?
এম শামসুল আলম : বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, তার জন্য সঞ্চালন লাইনে ঘাটতি নেই। প্রক্ষেপণ অনুসারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি। বিশেষ করে শিল্প খাতে বাড়েনি। এটিও আমাদের জন্য অশনিসংকেত। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় এসব খাতের বড় অংশ নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল রয়ে গেছে। তাই জাতীয় গ্রিডে চাহিদা বাড়েনি। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বাড়ানোর পরিকল্পনা ছিল। এ খাতে বেসরকারি খাতকে যুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও শোনা গিয়েছিল। এটি হলে আরও ভয়াবহ হতো।
দেশ রূপান্তর : সরকার তো বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়নের দাবি করে থাকে। বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা হয়েছে উল্লেখ করে এটি উদ্্যাপনও করা হয়েছিল।
এম শামসুল আলম : প্রকৃত অর্থে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন হয়নি। বলতে পারি, শতভাগ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ঢাকার বাইরে ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে। কারণ, বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা। আবার বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে। অভিযোগ রয়েছে, ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনও এখন কম করা হয়। বাস্তবে দেখা যায়, সক্ষমতা উন্নয়নে মান রক্ষা না হওয়ায় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ন্ত্রণে নেই। ১০ ডলারের মিটার ২৫ ডলারে কিনে প্রান্তিক ভোক্তার ৩০ টাকারও কম বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে মাসে ৪০ টাকা মিটার ভাড়া আদায় করা হয়। চুক্তির প্রথম মেয়াদেই প্রদত্ত ক্যাপাসিটি চার্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ব্যয় উশুল হয়েছে অথচ এরপর চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও সেই চুক্তির মেয়াদ বারবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। মালিকদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া অব্যাহত রাখা হয়েছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে অথচ চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো অব্যাহত রাখা হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে কম দামে সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো হয়েছে। অথচ সেই গ্যাস ব্যক্তি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিয়ে সেখান থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। নিজস্ব গ্যাস ও কয়লা সাশ্রয়ী মূল্যে উত্তোলন ও ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমদানিকৃত কয়লা, এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে কৌশলে বিদ্যুৎ খাতের এমন সব উন্নয়ন হয়েছে, যা ভোক্তা বা গণবান্ধব নয়, অসাধু ব্যবসাবান্ধব।
দেশ রূপান্তর : কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে...
এম শামসুল আলম : বিদ্যুৎ সংকটের দোহাই দিয়ে সরকার অনেক কোম্পানিকে এ সুযোগ দিয়েছিল। রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধারণাটি জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী। কোম্পানিগুলো থেকে সরকার উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনেছে। একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রেন্টাল, কুইক রেন্টালের নামে অসাধু ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে যাচ্ছে। আমরা তখন বলেছিলাম, রেন্টাল, কুইক রেন্টালের দরকার নেই। পিডিবির সক্ষমতা বাড়ালে তারা বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবে। কিন্তু কী কারণে এসব অসাধু ব্যবসায়ীকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে তার কোনো উত্তর আমাদের জানা নেই।
দেশ রূপান্তর : আপনার পরামর্শ কী?
এম শামসুল আলম : এখন পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের যে কথা বলা হচ্ছে তা একটি যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে করতে হবে। কোন সঞ্চালনে কতজন গ্রাহক, কোন ফিডারে কত ঘাটতি আগে তা পরিমাপ করতে হবে। তারপরে সুপরিকল্পিতভাবে এটা করতে হবে। কখন কোন লাইন কতক্ষণ বন্ধ থাকবে, সচল থাকবে তা নির্ধাারিত হতে হবে। তা না হলে মুখে মুখে লোডশেডিংয়ের কথা বলে আর জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে সমাধান আসবে না। শুধু মুখে মুখে পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কথা বলার আগেও যেমন লোডশেডিং হতো পরিকল্পনা না থাকলে সামনেও এমন হবে।
দেশ রূপান্তর : ধন্যবাদ আপনাকে।
এম শামসুল আলম : আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকে ধন্যবাদ।