শ্রীলঙ্কার মতো শেষ মুহূর্তে ঋণের চেয়ে এখনই ঋণ নেওয়া ভালো
ড. জাহিদ হোসেন | ৩১ জুলাই, ২০২২ ১২:৩১
ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকে যোগদান করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাউথ এশিয়া ফাইনান্স অ্যান্ড পোভার্টি গ্রুপের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি প্রায় ১৪ বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন রচনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ব্যাপক মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানি সংকট ও লোডশেডিংসহ অর্থনীতির চাপ সামলাতে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি এবং আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : মূল্যস্ফীতির প্রবল চাপে দিশেহারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। বিবিএস-এর হিসাবে গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন গরিব মানুষের ওপর প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের মতো আছে। এই চাপ সামাল দিতে সরকার কি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারছে?
ড. জাহিদ হোসেন : এ পর্যন্ত সরকারের যে পদক্ষেপগুলো আমরা দেখেছি সেখানে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ তো নেই। যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে সে কারণগুলো দূর করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না তার ওপর নির্ভর করছে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে কি না। কারণ মোটা দাগে দুটো। প্রথমটা হলো আন্তর্জাতিক বাজারে নানা পণ্যের দাম বেড়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার নেই। তবে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যবৃদ্ধি যাতে দেশের বাজারে সংক্রমিত না হয় সেক্ষেত্রে সরকারের কিছু করণীয় থাকে। দেশের বাজারে অনেক পণ্য আছে যেগুলোর মূল্য সরকার নিজেই নির্ধারণ করে। যেমন তেল, সার, গ্যাস এগুলোর দাম সরকার নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে গ্যাস ছাড়া তেল ও সারের দাম কিন্তু সরকার অ্যাডজাস্ট করেনি। জ¦ালানি তেলের দামবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সেজন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও সরকার এখনো দাম বাড়ায়নি। ডিজেল গত নভেম্বরে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ডিজেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে আরও বাড়লেও সরকার দেশে দাম আর বাড়ায়নি। এভাবে তেল, সার, বিদ্যুতে ভর্তুকি আরও বাড়ছে। সরকারকে এই কৃতিত্ব দিতে হবে যে, সরকার এসব পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বাজেটে ভর্তুকি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেত।
মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় কারণটি হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়া। করোনা মহামারীর প্রকোপ কমে আসা, গণটিকাকরণে সাফল্য, ইত্যাদি কারণে সমাজ স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার কারণে করোনা-পরবর্তী এই চাহিদা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যার বুরোর বিভিন্ন পণ্যের মূল্য তালিকার বিশদ দেখলে দেখা যাচ্ছে যে কেবল আমদানিকৃত পণ্যের দামই যে বেড়েছে তা নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও অনেক বেড়েছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির শতভাগ কারণ কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার নয়। যেমন চাল কিন্তু আমরা সামান্যই আমদানি করি। তাহলে চালের দাম কেন এত বেড়ে গেল। আবার ধরুন লন্ড্রিতে যে সার্ভিস চার্জ আমরা দিই সেটা কেন বেড়ে গেল? অভ্যন্তরীণ বাজারে এই চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে যে তাপ বেড়েছে সেটা কমানোর জন্য বাজেটে কিংবা মুদ্রানীতিতে আমরা সরকারের কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। বরং উল্টোটা দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেটা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। যদি এটা বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেটা অভ্যন্তরীণ চাহিদার সঙ্গে আরও যোগ করবে। চাহিদার তাপটা আরও বেড়ে যাবে। মুদ্রানীতিটাও মোটাদাগে সম্প্রসারণমূলক। সেখানে তাপ কমানোর যে অস্ত্র ছিল, অর্থাৎ সুদের হার। কিন্তু সেটাকে তো ক্যাপ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে গত বছর ভোক্তাঋণ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। মানুষ ধার করে গাড়ি কিনছে, টেলিভিশন-কম্পিউটার কিনছে। এখন সুদের হার যদি বৃদ্ধি করা যেত তাহলে অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোক্তার চাহিদার এই তাপ কিছুটা কমানো যেত। কিন্তু সেটা হয়নি।
দেশ রূপান্তর : কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে সরকার। এজন্য অফিস-দোকানপাটের সময় কমিয়ে আনা, কম জ্বালানি খরচ করা এবং কম অগ্রাধিকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ স্থগিত রাখার কথাও বলা হচ্ছে। এই কৌশল কতটা কাজ করবে বলে মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : এবারের বাজেটে ঘাটতি বৃদ্ধির প্রাক্কলন থাকলেও সরকার বাজেট বাস্তবায়নের শুরুর দিন থেকেই কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলো কৃচ্ছ্রসাধনের। সরকার এ পর্যন্ত এ বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোকে মোটা দাগে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হলো সরকারি ব্যয় কমানো। সেটা উন্নয়ন বাজেট এবং উন্নয়ন বহির্ভূত ব্যয়ও কমিয়েছে। সরকার ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ শ্রেণিতে ভাগ করে বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমানোর একটা মার্জিন টেনে দিয়েছে। এখানে দুটো উদ্দেশ্য আছে। একটা হলো, ডলার সংকটের কারণে ডলারের চাহিদা কমানো। এজন্য আমদানি ব্যয় কমানো এবং বৈদেশিক ভ্রমণের মতো নানা খাতে ব্যয় কমানো। উন্নয়ন বাজেটে নিজস্ব অর্থায়নে যেসব প্রকল্প আছে যা আমদানিনিবিড় সেসব স্থগিত করা হয়েছে। এসব বাস্তবায়ন হলে ডলারের ব্যয় কমবে। এখানো দুটো সুযোগ আছে। সরকারি ব্যয় কমালে ডলার যেমন কম লাগছে তেমনি অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমবে। এটা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেমন সহায়ক হবে তেমনি ডলার সংকটও কমাবে। এই সিদ্ধান্তগুলো সঠিক। কিন্তু সরকার এসব সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন করতে পারছে তার ওপরই এক্ষেত্রে সাফল্য নির্ভর করছে। দ্বিতীয় যে নীতি সরকার গ্রহণ করেছে সেটা হলো আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া। বাজেটেও অনেক সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য সরকারি ব্যয়ের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যয় কমিয়ে আনা। অনেক ক্ষেত্রে এলসি মার্জিনও বাড়ানো হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে ৭৫-১০০ শতাংশও বাড়ানো হয়েছে। এই সবগুলো সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য হলো আমদানি ব্যয় কমানো এবং ডলারের সংকট কমিয়ে আনা। খেয়াল করা দরকার, এসবের কিছু সুফল ইতিমধ্যেই দেখা গেছে।
দেশ রূপান্তর : চাপে থাকা অর্থনীতিতে একটা বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুতের সংকট। কিন্তু এ কারণে কি দেশের শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্প চাপে পড়তে পারে? আপনার কি মনে হয়, সরকার লোডশেডিংয়ের যে কৌশল গ্রহণ করেছে সেটা কতটা কাজে লাগবে?
ড. জাহিদ হোসেন : জ¦ালানি আমদানিতে বিপুল ডলার ব্যয় করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের দামও বেড়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের মোটাদাগের পদক্ষেপ ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও দেশে আরও বিপুল ডিজেল ব্যবহৃত হচ্ছে। সেটার পরিমাণ কিন্তু কমছে না। এখন লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প উৎপাদন কমছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ আটকে যাচ্ছে, উৎপাদনশীলতা কমছে। এর কারণে আবার রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এছাড়া দেশের অন্যান্য যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা আছে, যারা দেশের বাজারে পণ্য সরবরাহ করছে তাদের উৎপাদনও কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আবার আমদানির চাহিদা বেড়ে যেতে পারে, তাতে আমদানিব্যয় মেটাতে আরও ডলার লাগবে। এর সঙ্গে জুলাই মাসের ভরা বর্ষাকালেও বৃষ্টিহীনতার কারণে উত্তরাঞ্চলে আমনের ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন লোডশেডিং শুরু হওয়ার কারণে ডিজেলভিত্তিক সেচযন্ত্র ব্যবহার করে সেচের কাজ করতে হচ্ছে। আবার শহরের বাড়িঘরে লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলভিত্তিক জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে দেখা যাচ্ছে একটা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে পরিমাণ ডিজেল লাগে তার বিপরীতে ওই বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ছোট ছোট জেনারেটর-সেচযন্ত্রে আরও অনেক বেশি ডিজেল খরচ করা হচ্ছে। এসব কারণে এই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, ডলার সংকট মোকাবিলায় জ¦ালানি সাশ্রয় করতে গিয়ে যে নীতি আমরা গ্রহণ করছি সেটা হিতে বিপরীত হয়ে উঠবে কি না?
দেশ রূপান্তর : ডলারের বিপরীতে দফায় দফায় টাকার দাম কমছে। সর্বশেষ খোলাবাজারে এক ডলারের বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকায়। এদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৯ মিলিয়ন ডলারে। এই পরিস্থিতি বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কী করতে পারে সরকার?
ড. জাহিদ হোসেন : বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খোলাবাজারে ডলার ১১২ টাকা হয়ে গেলেও ইন্টারব্যাংক মার্কেটে ধরুন যে, ১০২-১০৩ টাকা ব্যাংকাররা কিনছেন আবার ১০৩-১০৪ টাকায় বিক্রি করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই ডলারের দর বেঁধে দিচ্ছে। কিন্তু সেই দরে তো ডলার কেনাবেচা হচ্ছে না। এখন বেঁধে দেওয়া দর কার্যকর না থাকার কারণ বাজারে চাহিদা আর জোগানের ফারাক। এখন যে ফারাকটুকু বা যে ঘাটতিটা আছে সেটা পুরোটা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দিতে পারত তাহলে কিন্তু ওই দরেই ডলার কেনাবেচা হতো। সেটা করা যাচ্ছে না কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অত পরিমাণ ডলার নেই। দুমাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিল যে তারা এই বাজারে আর হস্তক্ষেপ করবে না। আর এখনো তারা প্রতিদিন দর বেঁধে দিলেও ব্যাংকারদের বলেছে আপনারা এই দরে কেনাবেচা করতে বাধ্য নন, আপনারা বাজারের চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতে কেনাবেচা করুন কিন্তু কেনাবেচার ফারাকটা যেন এক টাকার বেশি না হয়। সমস্যাটা হচ্ছে আসলে তো আমাদের হাতে ৩৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ নেই। এর মধ্যে অনেক অংশ আছে যেগুলো ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ না। এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে যে ৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ আছে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে যে ২ কোটি ডলার বিনিয়োগ আছে সেসবও এই ৩৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই। শ্রীলঙ্কাকে যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে সেটাও এর মধ্যে ধরা আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হয়তো সবমিলিয়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ আছে। এখন ডলারে রেট বাড়তে না দিলে রিজার্ভ খরচ করতে হবে। কিন্তু রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে আমরা টিকতে পারব না। ফলে সংকটটা দুই দিকেই। হাতে এখনো যথেষ্ট রিজার্ভ থাকাকালে ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। বাজার খুব অস্থিতিশীল হয়ে গেলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ খরচ করে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
দেশ রূপান্তর : অর্থনীতির চাপ সামলাতে আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি, এডিবি থেকে ১০০ কোটি, বিশ্বব্যাংক থেকে ৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। এসব ঋণেরৎ ক্ষেত্রে কী ধরনের শর্ত থাকতে পারে আর এসব ঋণ পাওয়া গেলে তা কতটা সহায়ক হবে বলে মনে করছেন?
ড. জাহিদ হোসেন : আমার মনে হয় সরকারের এই পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল। হাতে এখনো ৩০ মিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ থাকা অবস্থাতেই আইএমএফ-এর কাছ থেকে এমন ঋণ নেওয়া ভালো। শ্রীলঙ্কার মতো একদম শেষ বেলায় বাধ্য হয়ে ঋণ নিতে যাওয়ার চেয়ে এখনই ঋণ নেওয়া ভালো। তাতে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্ষমতা বাড়তে পারে। আর আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা যেসব শর্ত দেবে সেসব নিশ্চয়ই আমরা পরে জানতে পারব। তবে আমার মনে হয় তারা কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো এবং আর্থিক খাতের কিছু সংস্কারের কথাই হয়তো বলবে। তারা হয়তো ভ্যাটের যে অনেকগুলো স্তর আছে সেগুলো কমিয়ে সরলীকরণ করতে বলবে। কর প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অটোমেশনের দিকে অগ্রগতির কথা বলতে পারে। এছাড়া তারা ভর্তুকি কমানোর কথা বলতে পারে। জ্বালানি মূল্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ও অভ্যন্তরীণ বাজার মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হবে সেটার একটা স্পষ্ট ফর্মুলার কথা বলতে পারে। তেলের মূল্য বাড়িয়ে যে ভর্তুকি সাশ্রয় করা যাবে সেটা দরিদ্র মানুষদের সহায়তায় ব্যয় করার বা সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা বলতে পারে। এ ধরনের শর্তই হয়তো তারা দিতে পারে যার অনেকগুলোই আমাদের এমনিতেই করা দরকার।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
ড. জাহিদ হোসেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
শেয়ার করুন
এই পাতার আরো খবর
ড. জাহিদ হোসেন | ৩১ জুলাই, ২০২২ ১২:৩১

ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকে যোগদান করেন। তিনি দীর্ঘদিন সাউথ এশিয়া ফাইনান্স অ্যান্ড পোভার্টি গ্রুপের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া তিনি প্রায় ১৪ বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন রচনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ব্যাপক মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানি সংকট ও লোডশেডিংসহ অর্থনীতির চাপ সামলাতে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি এবং আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : মূল্যস্ফীতির প্রবল চাপে দিশেহারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। বিবিএস-এর হিসাবে গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন গরিব মানুষের ওপর প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের মতো আছে। এই চাপ সামাল দিতে সরকার কি বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে পারছে?
ড. জাহিদ হোসেন : এ পর্যন্ত সরকারের যে পদক্ষেপগুলো আমরা দেখেছি সেখানে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ তো নেই। যেসব কারণে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে সে কারণগুলো দূর করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না তার ওপর নির্ভর করছে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে কি না। কারণ মোটা দাগে দুটো। প্রথমটা হলো আন্তর্জাতিক বাজারে নানা পণ্যের দাম বেড়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের কিছু করার নেই। তবে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্যবৃদ্ধি যাতে দেশের বাজারে সংক্রমিত না হয় সেক্ষেত্রে সরকারের কিছু করণীয় থাকে। দেশের বাজারে অনেক পণ্য আছে যেগুলোর মূল্য সরকার নিজেই নির্ধারণ করে। যেমন তেল, সার, গ্যাস এগুলোর দাম সরকার নির্ধারণ করে। এক্ষেত্রে গ্যাস ছাড়া তেল ও সারের দাম কিন্তু সরকার অ্যাডজাস্ট করেনি। জ¦ালানি তেলের দামবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। সেজন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও সরকার এখনো দাম বাড়ায়নি। ডিজেল গত নভেম্বরে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর ডিজেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে আরও বাড়লেও সরকার দেশে দাম আর বাড়ায়নি। এভাবে তেল, সার, বিদ্যুতে ভর্তুকি আরও বাড়ছে। সরকারকে এই কৃতিত্ব দিতে হবে যে, সরকার এসব পণ্যের দাম না বাড়িয়ে বাজেটে ভর্তুকি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেত।
মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় কারণটি হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়া। করোনা মহামারীর প্রকোপ কমে আসা, গণটিকাকরণে সাফল্য, ইত্যাদি কারণে সমাজ স্বাভাবিকতায় ফিরে আসার কারণে করোনা-পরবর্তী এই চাহিদা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যার বুরোর বিভিন্ন পণ্যের মূল্য তালিকার বিশদ দেখলে দেখা যাচ্ছে যে কেবল আমদানিকৃত পণ্যের দামই যে বেড়েছে তা নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও অনেক বেড়েছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির শতভাগ কারণ কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজার নয়। যেমন চাল কিন্তু আমরা সামান্যই আমদানি করি। তাহলে চালের দাম কেন এত বেড়ে গেল। আবার ধরুন লন্ড্রিতে যে সার্ভিস চার্জ আমরা দিই সেটা কেন বেড়ে গেল? অভ্যন্তরীণ বাজারে এই চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে যে তাপ বেড়েছে সেটা কমানোর জন্য বাজেটে কিংবা মুদ্রানীতিতে আমরা সরকারের কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। বরং উল্টোটা দেখা গেছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেটা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। যদি এটা বাস্তবায়ন করা হয় তাহলে সেটা অভ্যন্তরীণ চাহিদার সঙ্গে আরও যোগ করবে। চাহিদার তাপটা আরও বেড়ে যাবে। মুদ্রানীতিটাও মোটাদাগে সম্প্রসারণমূলক। সেখানে তাপ কমানোর যে অস্ত্র ছিল, অর্থাৎ সুদের হার। কিন্তু সেটাকে তো ক্যাপ করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে গত বছর ভোক্তাঋণ প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। মানুষ ধার করে গাড়ি কিনছে, টেলিভিশন-কম্পিউটার কিনছে। এখন সুদের হার যদি বৃদ্ধি করা যেত তাহলে অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোক্তার চাহিদার এই তাপ কিছুটা কমানো যেত। কিন্তু সেটা হয়নি।
দেশ রূপান্তর : কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে সরকার। এজন্য অফিস-দোকানপাটের সময় কমিয়ে আনা, কম জ্বালানি খরচ করা এবং কম অগ্রাধিকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ স্থগিত রাখার কথাও বলা হচ্ছে। এই কৌশল কতটা কাজ করবে বলে মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : এবারের বাজেটে ঘাটতি বৃদ্ধির প্রাক্কলন থাকলেও সরকার বাজেট বাস্তবায়নের শুরুর দিন থেকেই কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলো কৃচ্ছ্রসাধনের। সরকার এ পর্যন্ত এ বিষয়ে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোকে মোটা দাগে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হলো সরকারি ব্যয় কমানো। সেটা উন্নয়ন বাজেট এবং উন্নয়ন বহির্ভূত ব্যয়ও কমিয়েছে। সরকার ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ শ্রেণিতে ভাগ করে বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমানোর একটা মার্জিন টেনে দিয়েছে। এখানে দুটো উদ্দেশ্য আছে। একটা হলো, ডলার সংকটের কারণে ডলারের চাহিদা কমানো। এজন্য আমদানি ব্যয় কমানো এবং বৈদেশিক ভ্রমণের মতো নানা খাতে ব্যয় কমানো। উন্নয়ন বাজেটে নিজস্ব অর্থায়নে যেসব প্রকল্প আছে যা আমদানিনিবিড় সেসব স্থগিত করা হয়েছে। এসব বাস্তবায়ন হলে ডলারের ব্যয় কমবে। এখানো দুটো সুযোগ আছে। সরকারি ব্যয় কমালে ডলার যেমন কম লাগছে তেমনি অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমবে। এটা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেমন সহায়ক হবে তেমনি ডলার সংকটও কমাবে। এই সিদ্ধান্তগুলো সঠিক। কিন্তু সরকার এসব সিদ্ধান্ত কতটা বাস্তবায়ন করতে পারছে তার ওপরই এক্ষেত্রে সাফল্য নির্ভর করছে। দ্বিতীয় যে নীতি সরকার গ্রহণ করেছে সেটা হলো আমদানি ব্যয় কমানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া। বাজেটেও অনেক সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য সরকারি ব্যয়ের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ের ব্যয় কমিয়ে আনা। অনেক ক্ষেত্রে এলসি মার্জিনও বাড়ানো হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে ৭৫-১০০ শতাংশও বাড়ানো হয়েছে। এই সবগুলো সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য হলো আমদানি ব্যয় কমানো এবং ডলারের সংকট কমিয়ে আনা। খেয়াল করা দরকার, এসবের কিছু সুফল ইতিমধ্যেই দেখা গেছে।
দেশ রূপান্তর : চাপে থাকা অর্থনীতিতে একটা বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে জ্বালানি ব্যবস্থাপনা ও বিদ্যুতের সংকট। কিন্তু এ কারণে কি দেশের শিল্প উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্প চাপে পড়তে পারে? আপনার কি মনে হয়, সরকার লোডশেডিংয়ের যে কৌশল গ্রহণ করেছে সেটা কতটা কাজে লাগবে?
ড. জাহিদ হোসেন : জ¦ালানি আমদানিতে বিপুল ডলার ব্যয় করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ¦ালানি তেলের দামও বেড়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের মোটাদাগের পদক্ষেপ ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও দেশে আরও বিপুল ডিজেল ব্যবহৃত হচ্ছে। সেটার পরিমাণ কিন্তু কমছে না। এখন লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প উৎপাদন কমছে। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে কাজ আটকে যাচ্ছে, উৎপাদনশীলতা কমছে। এর কারণে আবার রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এছাড়া দেশের অন্যান্য যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা আছে, যারা দেশের বাজারে পণ্য সরবরাহ করছে তাদের উৎপাদনও কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আবার আমদানির চাহিদা বেড়ে যেতে পারে, তাতে আমদানিব্যয় মেটাতে আরও ডলার লাগবে। এর সঙ্গে জুলাই মাসের ভরা বর্ষাকালেও বৃষ্টিহীনতার কারণে উত্তরাঞ্চলে আমনের ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন লোডশেডিং শুরু হওয়ার কারণে ডিজেলভিত্তিক সেচযন্ত্র ব্যবহার করে সেচের কাজ করতে হচ্ছে। আবার শহরের বাড়িঘরে লোডশেডিংয়ের কারণে ডিজেলভিত্তিক জেনারেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। এভাবে দেখা যাচ্ছে একটা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যে পরিমাণ ডিজেল লাগে তার বিপরীতে ওই বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে ছোট ছোট জেনারেটর-সেচযন্ত্রে আরও অনেক বেশি ডিজেল খরচ করা হচ্ছে। এসব কারণে এই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, ডলার সংকট মোকাবিলায় জ¦ালানি সাশ্রয় করতে গিয়ে যে নীতি আমরা গ্রহণ করছি সেটা হিতে বিপরীত হয়ে উঠবে কি না?
দেশ রূপান্তর : ডলারের বিপরীতে দফায় দফায় টাকার দাম কমছে। সর্বশেষ খোলাবাজারে এক ডলারের বিক্রি হচ্ছে ১১২ টাকায়। এদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছে ৩৯ মিলিয়ন ডলারে। এই পরিস্থিতি বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখতে কী করতে পারে সরকার?
ড. জাহিদ হোসেন : বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল রাখাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খোলাবাজারে ডলার ১১২ টাকা হয়ে গেলেও ইন্টারব্যাংক মার্কেটে ধরুন যে, ১০২-১০৩ টাকা ব্যাংকাররা কিনছেন আবার ১০৩-১০৪ টাকায় বিক্রি করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই ডলারের দর বেঁধে দিচ্ছে। কিন্তু সেই দরে তো ডলার কেনাবেচা হচ্ছে না। এখন বেঁধে দেওয়া দর কার্যকর না থাকার কারণ বাজারে চাহিদা আর জোগানের ফারাক। এখন যে ফারাকটুকু বা যে ঘাটতিটা আছে সেটা পুরোটা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক জোগান দিতে পারত তাহলে কিন্তু ওই দরেই ডলার কেনাবেচা হতো। সেটা করা যাচ্ছে না কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অত পরিমাণ ডলার নেই। দুমাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিল যে তারা এই বাজারে আর হস্তক্ষেপ করবে না। আর এখনো তারা প্রতিদিন দর বেঁধে দিলেও ব্যাংকারদের বলেছে আপনারা এই দরে কেনাবেচা করতে বাধ্য নন, আপনারা বাজারের চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতে কেনাবেচা করুন কিন্তু কেনাবেচার ফারাকটা যেন এক টাকার বেশি না হয়। সমস্যাটা হচ্ছে আসলে তো আমাদের হাতে ৩৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ নেই। এর মধ্যে অনেক অংশ আছে যেগুলো ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ না। এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে যে ৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ আছে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে যে ২ কোটি ডলার বিনিয়োগ আছে সেসবও এই ৩৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই। শ্রীলঙ্কাকে যে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়া হয়েছে সেটাও এর মধ্যে ধরা আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হয়তো সবমিলিয়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ আছে। এখন ডলারে রেট বাড়তে না দিলে রিজার্ভ খরচ করতে হবে। কিন্তু রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে আমরা টিকতে পারব না। ফলে সংকটটা দুই দিকেই। হাতে এখনো যথেষ্ট রিজার্ভ থাকাকালে ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। বাজার খুব অস্থিতিশীল হয়ে গেলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ খরচ করে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।
দেশ রূপান্তর : অর্থনীতির চাপ সামলাতে আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি, এডিবি থেকে ১০০ কোটি, বিশ্বব্যাংক থেকে ৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার। এসব ঋণেরৎ ক্ষেত্রে কী ধরনের শর্ত থাকতে পারে আর এসব ঋণ পাওয়া গেলে তা কতটা সহায়ক হবে বলে মনে করছেন?
ড. জাহিদ হোসেন : আমার মনে হয় সরকারের এই পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় ছিল। হাতে এখনো ৩০ মিলিয়ন ডলারের মতো রিজার্ভ থাকা অবস্থাতেই আইএমএফ-এর কাছ থেকে এমন ঋণ নেওয়া ভালো। শ্রীলঙ্কার মতো একদম শেষ বেলায় বাধ্য হয়ে ঋণ নিতে যাওয়ার চেয়ে এখনই ঋণ নেওয়া ভালো। তাতে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সক্ষমতা বাড়তে পারে। আর আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তারা যেসব শর্ত দেবে সেসব নিশ্চয়ই আমরা পরে জানতে পারব। তবে আমার মনে হয় তারা কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো এবং আর্থিক খাতের কিছু সংস্কারের কথাই হয়তো বলবে। তারা হয়তো ভ্যাটের যে অনেকগুলো স্তর আছে সেগুলো কমিয়ে সরলীকরণ করতে বলবে। কর প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অটোমেশনের দিকে অগ্রগতির কথা বলতে পারে। এছাড়া তারা ভর্তুকি কমানোর কথা বলতে পারে। জ্বালানি মূল্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ও অভ্যন্তরীণ বাজার মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হবে সেটার একটা স্পষ্ট ফর্মুলার কথা বলতে পারে। তেলের মূল্য বাড়িয়ে যে ভর্তুকি সাশ্রয় করা যাবে সেটা দরিদ্র মানুষদের সহায়তায় ব্যয় করার বা সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা বলতে পারে। এ ধরনের শর্তই হয়তো তারা দিতে পারে যার অনেকগুলোই আমাদের এমনিতেই করা দরকার।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
ড. জাহিদ হোসেন : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ