
১লা কার্তিক ১২৯৭। বাউল সাধক ফকির লালন শাহ'র তিরোধান দিবস। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে ১৩২তম তিরোধান দিবস পালনে আয়োজিত তিনদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম দিন সোমবার (১৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে আখড়াবাড়ি সংলগ্ন কালীগঙ্গা নদীর মাঠে।
তবে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক আয়োজনের বাইরে প্রিয় এই মহামানবের ওফাত দিবসকে ঘিরে প্রতি বছরই ভক্ত আশেকান অনুসারীরা ছুটে আসেন সাঁইজির এই তীর্থধামে। পরম গুরুভক্তির আস্বাদনে গানের বানীতে তৃষ্ণার্ত ও অস্থির আত্মার শান্তি পাওয়ার টানে ছুটে এসেছেন তারা। প্রতিক্ষীত এই দিনটিতে সাইজির বাণীর পরশ পাওয়ার ব্যাকুল বাসনায় দুই একদিন আগেই ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন তারা। নিজেদের ঘরানায় ছোট ছোট মজমা করে আত্মস্থ বাণীগুলি একে অন্যের সাথে বিনিময় করে থাকেন গানের মাধ্যমে। ‘হাওয়া দমে দেখনা রে তার আসল ব্যানা, কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা’ দোতারা হাতে লালন শাহের মাজার মিলনায়তনে বসে আসর জমিয়েছেন আগত লালন ভক্ত বাউল অনুসারীরা। শতাধিক উৎসুক দর্শক শ্রোতা কেউবা বসে কেউবা দাঁড়িয়ে শুনছেন এসব বাউল গান।
এসময় সেখানে দেখা হয় লালন অনুসারী ফকির মহরম শাহয়ের সাথে। দেশ রূপান্তরকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি হাসান আলী।
হাসান আলী: ‘হাওয়া দমে দেখনা রে তার আসল ব্যানা’ সাঁইজির এই বাণীতে কি বলতে চেয়েছেন?
ফকির মহরম শাহ: মানুষ যে বেঁচে আছে তার প্রমাণ হলো- প্রতিক্ষনে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেন নিতে পারছে এটাই তার প্রাণের অস্তিত্ত্ব। তাহলে এই যে বেঁচে আছে মানুষ কিভাবে? কোন কারিগরি কায়দায় এই দেহঘরি তৈরি হয়েছে? কোন যন্ত্রের সাহায্যে এই ঘড়ি চলছে, কিভাবে চলছে? কতক্ষণ চলবে? এর কারিগরই বা কে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে, জানতে হবে।
হাসান আলী: সাঁইজির কালাম বা বাণীগুলি বোঝার সহজ উপায় কী?
ফকির মহরম শাহ: সাঁইজি বলেছেন, সহজ মানুষ ভইজে দ্যাখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, দিন রাত, জন্ম-মৃত্যু যেমন শ্বাস্বত: দিবালোকের মতো চিরসত্য। তেমনি মানুষ জন্মগত ভাবেই তার মধ্যে দিব্যজ্ঞান নিয়েই পৃথিবীতে আসে। কিন্তু জগৎ সংসারের নানা জটিলতার মাঝে ডুবে যাওয়ার কারণে তার দিব্যজ্ঞানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এইডা যদি সে বুঝতে পারে যে, ওরে বাবা তার মাঝেও তো আলোর দ্যুতি রয়েছে। তবে কেন অন্ধকারে ঘুইরে মরে? সেই জন্যই বেশী বেশী দরকার সাধুসঙ্গ। সাধু হলেন তিনি যিনি দিব্যজ্ঞানের ভাণ্ডার। ওই যে বলে না, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ
হাসান আলী: সাঁইজির বাণীই কীভাবে আত্মার শান্তি দিতে পারে?
ফকির মহরম শাহ: দেখেন, ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন খাবার খাওয়া তাগিদ বোঝে? ঠিক তেমনি অশান্ত আত্মার যন্ত্রণা যদি কাউকে তাইড়ি বেড়াই তালি সেই জগৎ সংসারের মায়া ছাইরি শান্তির খোঁজে দিক-বিদ্বিক ছুটে বেড়াবে। যে কোথায় গেলে পাবো তারে? তাইতো সাঁইজি বলেছেন, ‘লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা, হাতের কাছে ভরা কলস তবু তৃষ্ণা মেটে না’। এই যে ক্ষুধার যন্ত্রণা যার আছে সেই বুঝবে সাঁইজির কালাম হৃদয়ে ধারণ ও তা বৈষয়িক জীবনে পালনের মধ্যদিয়ে কিভাবে আত্মার শান্তি খুঁজে পায়।
হাসান আলী: আরও বেশি মানুষের মাঝে লালনের বাণী কিভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়?
ফকির মহরম শাহ: দেখেন এই ভেগ বা লেবাসধারী নয়; শুধু মুখে বলবেন সাধুর বাণী কিন্তু হৃদয় ভরা অন্ধকার এসব লোকদের দিয়ে তো এসব হবে না। প্রকৃতঅর্থে এই কালাম ধারণ করে নিজের উপলব্ধির উদয় ঘটাতে হবে। তারপর না সে ভক্ত আশেকানদের মাধ্যমে বেশি বেশি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। যতবেশি মানুষ সাঁইজির কালাম মনে প্রাণে ধারণ করতে পারবে ততবেশি মানব সমাজের অস্থিরতার পথ রুদ্ধ হবে। এই যে মানুষে মানুষে, ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, গোত্র ভেদে যে হানাহানি এখান থেকে গুরু বাণীর দীক্ষা হতে পারে মুক্তির নিশানা। আপনেরা দেখতেই পান অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারী শিক্ষিতজনদের মধ্যেও এখন সাঁইজির দর্শন আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। তিনি তো উনাদের মতো এতো বড় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। তবুও কীভাবে তিনি দিন দুনিয়ার দর্শন জগতে ঢুকতে পেরেছিলেন?
কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী- এই ট্রিলজি কয়েক প্রজন্মের বাঙালি পাঠককে মোহিত, তাড়িত ও অনুপ্রাণিত করেছে। এর বাইরে অনেক পাঠকপ্রিয় উপন্যাস ও গল্প লিখেছেন সমরেশ মজুমদার।
সোমবার আমাদের ছেড়ে চলে যান এ কথাসাহিত্যিক।
তার জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ। ছেলেবেলা কেটেছে জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে। পড়েছেন স্কটিশ চার্চ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পাঠকপ্রিয় এ ঔপন্যাসিক ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা এসেছিলেন। তখন ঢাকা ক্লাবে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ।
দেশ রূপান্তর: আপনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জনপ্রিয়। সমকালীন তিন প্রজন্মের চিন্তা, স্বপ্নকে প্রভাবিত করেছেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
সমরেশ মজুমদার: আপনার বাসার কোনো মেয়ে যদি ভালোবেসে প্রেগনেন্ট হয়, বিয়ে থা না করে এবং একটা বাচ্চার মা হয় আপনি তাকে একসেপ্ট করবেন? আপনার বোনের ক্ষেত্রে ঘটলে আপনি একসেপ্ট করবেন? যারা বলবেন একসেপ্ট করবেন, তারা জেদের বশে বলবেন। কিন্তু জীবনের সত্য এটা না। আপনি এমন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না এবং তাকে আপনি আদর করে বাসায় ডাকবেন না। আপনি যদি বলেন, হ্যাঁ ডাকব তবে আপনি মেকি কথা বলছেন। এই কথাটা আপনি আপনার স্ত্রীর সামনে, আপনার বাবার সামনে বা আপনার মায়ের সামনে বলতে পারবেন না। আপনি নিজেকে প্রগতিবাদী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য পাবলিকলি বলতে পারেন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে বলবেন না। আর একটা সমীক্ষা বলছে, দুজন করে পাঠক একটা বই পড়লে কালবেলা উপন্যাসটা দশ লক্ষ পাঠক পড়েছে। একটা সমীক্ষা বলছে, মাধবীলতা একসেপ্টেড বাই অল রিডার্স, প্রত্যেক পাঠকই মাধবীলতার ফ্যান। জীবনে যাকে একসেপ্ট করতে পারব না, বাসায় যাকে নিয়ে যেতে পারব না, তার ফ্যান কেন হচ্ছি? মানুষ তো ফ্যান হয় তারই যার আইডিয়া সে অনুসরণ করে, যার কাজকর্ম সে রেসপেক্ট করে, যাকে ভালোবাসে। মাধবীলতার কাজকর্ম আমি একসেপ্ট করি না অথচ তার জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস আমি পয়সা খরচ করে কিনি। বলি, আহা কালবেলা আমার প্রিয় উপন্যাস। এটা কি মিথ্যাচার নয়?
এমন হতে পারে আমি যা করতে পারি না, আমার পছন্দের চরিত্র তা করছে বলে আমি তার ফ্যান। আমার কল্পনার জগতে সে কাজ করতে পারে।
সমরেশ মজুমদার: আপনি যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দশটা সৈন্যকে মোকাবিলা করে আসতে পারেন না। কিন্তু আরেকজন সেটা পারলে আপনি তাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। কিন্তু এখানে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এক সঙ্গে পড়ত। তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ল। তাদের শারীরিক সম্পর্ক হলো। ছেলেটা মেয়েটার দায়িত্ব নেয়নি। না নিয়ে সে রাজনীতি করছিল। এত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে। সে যে মেয়েটির জীবনে এত বড় একটা সর্বনাশ করল তা নিয়ে তার জীবনে কোনো অনুতাপ এলো না। তারপর তিন বা চার বছর পর সে যখন জেল থেকে বেরিয়ে জানল, সে যে কাজটি করেছে তা থেকে একটা শিশুর জন্ম হয়েছে তখন সে বলল, আমার উচিত তোমাকে বিয়ে করা। মেয়েটি তাকে রিফিউজ করল। বলল, বিয়ে করার কথা বলে তাকে সে অপমান করেছে। মেয়েটির এই অ্যাডামেন্ট অবস্থানের কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কেন এখন বিয়ের কথা বললে সে অপমানিত হবে। আমি লজিক খোঁজার চেষ্টা করছি, কেন এই উপন্যাসটা লোকে গ্রহণ করেছে?
এমন হতে পারে, লোকে পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিত এতে পেয়েছে।
সমরেশ মজুমদার: কলকাতা শহরে বাড়িঅলার কাছে ভাড়া চাইতে এলেন দুজন। ভদ্রলোক একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। বয়স আঠাশ। ভদ্রমহিলা একটা বড় ফার্মে চাকরি করেন। বয়স ছাব্বিশ। বাড়িঅলা নাম জানতে চাইলে দেখলেন দুজনের দুটো আলাদা টাইটেল। আলাদা টাইটেল কেন? তারা বলে, আমরা তো বিয়ে-থা করিনি। আপনারা স্বামী-স্ত্রী না? না। এবার ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেলেন। স্বামী-স্ত্রী না হলে ভাড়া দেব কেন? তারা বলে, আমরা ভালোবাসি। এখনো আমাদের দেশে কেউ যদি বলে আমরা ভালোবাসি তাই একসঙ্গে থাকি, হজম করতে কষ্ট হয় অনেকের। কিন্তু এই পরিবর্তিত অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। আজ আমার মা যদি বেঁচে থাকতেন তিনি কি হজম করতে পারতেন যদি তার নাতনি এ কাজটি করত? তিনি একটা স্ট্রাকচারের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। সে স্ট্রাকচারে তিনি এতকাল যা শোভন বলে মনে করেছেন তা-ই তিনি আশা করেন। সেদিন একটা অনুষ্ঠানে আমি অনেক লোকের মাঝে এই প্রশ্নটা করেছিলাম, আপনারা মাধবীলতাকে সমর্থন করেন কি করেন না। কেউ কথা বলে না। শেষ পর্যন্ত একটা একুশ বছর বয়সী মেয়ে উঠে দাঁড়াল সে মাধবীলতাকে সমর্থন করে। সে তার মায়ের দৃষ্টান্ত বলেছে আমাকে। সে ঠিক আছে, কিন্তু বেশিরভাগই মুখোশ পরে হাঁটি। সাহিত্য কখনো কখনো ভালোলাগা বা না লাগা সত্তে¡ও জীবন থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা একটা জায়গায় পৌঁছে যায়।
কয়েকটা জেনারেশনকে ধারন করার যে ব্যাপার এটা আপনি কীভাবে পারলেন?
সমরেশ মজুমদার: আগেকার দিনে দেখা যেত, বাড়িতে কাজের লোক আছে। রান্নার লোক। বিধবা হয়ে আঠারো-উনিশ বছরে এসেছে। তারপর পঞ্চাশ বছর ধরে রান্না করছে। তখন যারা বাচ্চা ছিল তারা বড় হয়ে চলে যাচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। সে কিন্তু রান্না করে যাচ্ছে। অমুকের মা বলে ডাকে তাকে। অমুকের মার রান্না খেতে খুব মজা, খুব ভালো। ঠাকুরদা বলছে, বাবা বলছে, ছেলেও বলছে। কেন?
আপনাদের তারুণ্যে একটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনীতি সে স্বপ্নের পথে যাচ্ছে না। আপনি হতাশ হন না?
সমরেশ মজুমদার: এগুলো তো আমার হাতের মধ্যে নেই। আমি কলকাতা শহরে যে বাঙালিকে দেখি তাতে আমি আনন্দ পাই, আবার দুঃখ পাই। আবার ঢাকায় যখন আসি একই অনুভূতি হয়। আমি যখন প্রথম আসি তখন ইউনিভার্সিটিতেই বোরখা পরা মেয়ের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তখন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেই মেয়েরা বোরখা খুলে ফেলত। রিকশা থেকে নামত। ফেরার পথে রিকশায় ওঠার আগে বোরখা পরে রিকশায় উঠত। হেঁটে রাস্তা দিয়ে আসত না। প্রথম এসে মেয়েদের রাস্তায় হাঁটতে খুব একটা দেখিনি। এখন মেয়েরা অনেক চলাফেরা করছে। কোথাও কোথাও মেয়েরা ফুটপাতে বসে সিগারেট খায়। এটা আমার খারাপ লাগেনি। নিজের সম্মান বজায় রেখে যদি এটা করতে পারে তবে ভালো। আরেকটা জিনিস দেখতে থাকলাম- বোরখা নয়, মুখঢাকা পোশাক বা হিজাব পরার চলটা যেন দিন দিন বাড়ছে। আমি ভাবতাম, আত্মরক্ষা করার জন্য হিজাব একটা বড় ভূমিকা নিচ্ছে। মেয়েটি নিজেকে অন্যের কাছে এক্সপোজ করতে চায় না, তাই হিজাব পরে। এই আত্মরক্ষার প্রয়োজনটা হচ্ছে কেন। পুরুষদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য আত্মরক্ষা করতে হচ্ছে? নিজেকে আমি জিজ্ঞেস করি। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে, আর বলবেন না দিনকে দিন হিজাব বেড়েই চলেছে। আপনারা আরও ভালো বলতে পারবেন। ধর্মান্ধতা নাকি সংস্কার কোনটি কারণ। মা হিজাব পরত না মেয়ে পরছে। আবার এও দেখছি, প্যান্ট, কামিজ পরে মাথায় হিজাব পরছে।
এখন পশ্চিমবঙ্গে যে অস্থিরতা চলছে, এনআরসি...
সমরেশ মজুমদার: এই যে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা সমুদ্র পেরিয়ে বাংলাদেশে এলো। আপনারা না পারছেন তাদের গিলতে, না পারছেন হজম করতে, না পারছেন বের করে দিতে। কেন পারছেন না? দেখুন অন্যকে আক্রমণ করতে খুব আনন্দ হয়। নিজে আক্রান্ত হলে দুঃখ হয়।
আমাদের পশ্চিবঙ্গের যিনি মুখ্যমন্ত্রী তার আবেগ মাঝে মাঝে আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল থাকে না। যখন আসামে দেখা গেল ১৯ লাখ লোক, এরা ভারতীয় না। এদের রেশনকার্ড নেই। কিচ্ছু নেই। উনিশ লক্ষ লোক কম না। তাদের যখন আশ্রয়হীন করার চেষ্টা হচ্ছে, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, আমি নিয়ে নেব। এরা বাঙালি। দেখা গেল, এদের সবাই বাঙালি নয়। সবাই হিন্দু নয়, প্রচুর মুসলমান আছে। তাকে বলা হলো, আপনার বাসায় চারজনকে দেওয়া হলে রাখবেন তো? তিনি বললেন, আমার বাসায় কেন? আমি তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করব। মানে আরেকটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ব্যবস্থা করব, আরেকটা দণ্ডাকারণ্যের ব্যবস্থা করব। এর কোনো সুরাহা নেই। পৃথিবী জুড়ে হচ্ছে। এই যে লোকগুলো গেল, কেন গেল? আমি তো এখানে কত বছর ধরে আসছি। আমি সে-রকম জাতিগত দাঙ্গা তো দেখিনি এখানে। এখান থেকে যারা যাচ্ছে তারা আতঙ্কে যাচ্ছে? কীসের আতঙ্ক? নাকি আরেকটু বড় কিছু প্রাপ্তির আশায় যাচ্ছে?
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকের মধ্যে কোনো পার্থক্য আপনি দেখেন?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৭১ এর আগে এখানে বাংলা বই খুব কম আসত। আমার বলতে লজ্জাও নেই, দ্বিধাও নেই একাত্তরের পর এখানে যত পাঠক হয়েছে সব হুমায়ূনের কল্যাণে তৈরি হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ না জন্মালে বাংলাদেশে এত পাঠক তৈরি হতো না। হুমায়ূনের আগে যারা লিখতেন, অনেক পাওয়ারফুল লেখক ছিলেন তারা। তাদের তুলনায় হুমায়ূন কিছুই না, কিন্তু তাদের বই বিক্রি হতো না। এই ঢাকা ক্লাবে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন এমন অনেক বড় লেখক আছেন- খুব বিনয়ী, কিন্তু খুব দরিদ্র। তাদের বই বিক্রি হতো না। আমি হুমায়ূনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার এ ব্যাপারে কী বক্তব্য। হুমায়ূন বলেছে, সমরেশ দা, যে ছেলে বা মেয়ে ষোলো বছর বয়সে হুমায়ূন পড়া ধরে না তাকে আমি বাঙালি বলে মনে করি না। আর যে ২৪ বছরের পরও হুমায়ূন পড়ে সে মানুষ না। ২৪-এর পর একটা অ্যাডাল্ট লোক যার বোধবুদ্ধি আছে সে হুমায়ূন পড়বে কেন? যেখানে কোনোরকম ডেপথ নেই, কোনো রকম গভীরতা নেই একমাত্র হিমু চরিত্র ছাড়া। সে নিজে বলেছে আমাকে। আমি এটা লিখেওছি অনেক জায়গায়। ও নিজেকে জানত খুব ভালোভাবে।
আপনি সম্প্রতি বললেন, বাংলা সাহিত্যের রাজধানী ঢাকায় চলে এসেছে। এর তাৎপর্য কী? সাহিত্যের নিজস্ব একটা ধারা আছে এখানে, কিন্তু সেই অর্থে স্থায়ী পাঠক কম বা বই প্রকাশের সংস্কৃতি তত জোরালো নয়।
সমরেশ মজুমদার: বাংলাভাষায় সমরেশ মজুমদার নামে একজন লেখক আছেন। তিনি যে গল্প উপন্যাস লিখছেন সেগুলো বিক্রি হয়। কিন্তু পাঠকের ইচ্ছা আরও সমরেশ মজুমদার হোক। আমি যত বই লিখেছি তার থেকে বেশি বই এখানে চলে। আমার নামে বই লিখে এখানে চালানো হয়। পাঠকরা বাংলা পড়তে পারে, পড়তে চায়, পড়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। সেটাকে এক্সপ্লোয়েট করছে কিছু খারাপ ব্যবসায়ী। পাঠক নেই, এটা বলছেন কেন? এখানে পাঠক রয়েছে। প্রচন্ড পাঠক আছে। হুমায়ূনের বই বিক্রি হচ্ছে। মৃত্যুর পর সুনীলের বই বিক্রি একদম কমে গেছে। কিন্তু মৃত্যুর ছয় বছর পর হুমায়ূনের বই বিক্রি হচ্ছে। একজন প্রকাশক আমাকে বলেছেন হয়তো ১০% বিক্রি কমেছে। পশ্চিমবাংলার বইমেলাতে ২১ থেকে ২২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, এগুলো কি ভূতে কেনে? অথচ বলা হয় পশ্চিমবাংলায় পাঠক নেই। আপনাদের এখানে বলা হয়, পাঠক কমে গেছে। কিন্তু একুশের মেলা থেকে বাংলাবাজারের পাবলিশাররা ৫০% আয় করেন। নভেম্বর মাসে এখানে একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা হবে। দুটো বইমেলা করার দরকার কী যদি বিক্রি না হবে?
আপনি অনেক লিখেছেন। এখন একেবারে পরিণত বয়স আপনার। লেখা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
সমরেশ মজুমদার: সকালে ঘুম থেকে উঠি ধরেন সাড়ে ছ’টায়। ব্রাশট্রাশ করার পর এক কাপ চা হাতে সূর্য ওঠা দেখতে খুব মজা লাগে। খবরের কাগজ আসে। চার চারটে কাগজ। সেটা পড়তে আরম্ভ করি। পড়তে পড়তে নটা বাজে। তখন নাস্তা খাই। নাস্তা খাওয়ার পর ফোন করি, একে ওকে তাকে। ধরেন, দশটা বেজে গেল। দশটা সাড়ে দশটা বেজে গেলে আর তো লেখার টাইম নাই। আর কখন লিখব। এখন লিখতে ইচ্ছা করে না বলে যত রকমের বাহানা আছে নিজেকে দিই। আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন যে পাড়ায় আমি থাকতাম সে পাড়ায় একজন বিখ্যাত লেখক থাকতেন, তার নাম শিবরাম চক্রবর্তী। তিনি আমাদের ছোটবেলায় হাসির লেখক হিসেবে আমাদের বুকের মধ্যে ছিলেন। আমি একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সকাল থেকে কী করেন। তিনি বললেন, ঘুম থেকে উঠি। তারপর? তারপর চা খাই। তারপর? বিনাপয়সার কাগজ পড়ি। বিনাপয়সার মানে? আমাকে আনন্দবাজার পত্রিকা বিনাপয়সায় কাগজ পাঠায়, ওটা পড়ি। পড়তে পড়তে ঘুম পেয়ে যায়। আবার শুয়ে, ঘুমিয়ে পড়ি। আবার উঠি। তারপর? উঠে গোসল করতে যাই। ভাত খাই। ভাত খেলে ঘুম পায়। ঘুমায়ে পড়ি। বিকাল হয়, আমি সাজুগুজু করে বাস ধরে আমার প্রেমিকাদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। প্রেমিকা? কেন, পড়োনি আমার লেখার মধ্যে? আটটা অব্দি তাদের সঙ্গে গল্প করে গল্প করে মন প্রফুল্ল হয়। তুমি দেখবে, মেয়েদের সঙ্গে গল্প করলে তোমার মন অনেক বড় হয়ে যাবে। তারপর ঘরে আসি। আবার ভাত খাই। ঘুমায়ে পড়ি। আমি তখন বললাম, আপনি লেখেন কখন? কেন, পরের দিন সকালে। পরের দিন সকালটা কবে আমি জানি না। আমি এখন সেই জায়গায়। লিখতে ইচ্ছা করে না। সাধারণত আমি সকালে লিখি। এখন বাধ্যবাধকতার জন্যই লিখতে হয়। অল্প বয়সে অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল, তখন যখন ইচ্ছা তখন লিখতাম।
[৪ অক্টোবর, ২০১৯ দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত]
বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান এনপিপি, বিসিজিএমএস, এনডিসি, পিএসসি কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৪ সালের ২৪ জুলাই। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর দায়িত্ব পালন করেছেন নৌবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। সাফল্যের সঙ্গে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে।
এম. শাহজাহান তার আগে ছিলেন বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের উপ-মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্যের (হারবার ও মেরিন) দায়িত্বে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্লু ইকোনমি সেলের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের বন্দর, ব্লু ইকোনমি, বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট-হাব হিসেবে গড়ে তোলাসহ সার্বিক মেরিটাইম খাত এবং ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বঙ্গোপসাগর ও তার নিরাপত্তা নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন দৈনিক দেশ রূপান্তরের সঙ্গে।
তার সঙ্গে আলাপ করেছেন দৈনিক দেশ রূপান্তরের হেড অব ইভেন্টস অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং শিমুল সালাহ্উদ্দিন।
দৈনিক দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা শুনে খুব আনন্দিত যে চট্টগ্রাম বন্দর অনেকগুলো সাফল্য অর্জন করেছে আপনার নেতৃত্বে। প্রথমে জানতে চাই, লয়েড’স লিস্টে আমাদের বন্দরের এখনকার অবস্থান কত?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: লয়েড’স লিস্টে আমাদের বর্তমান অবস্থান ৬৪তম। এর মানে পৃথিবীর এক শ ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান এখন চৌষট্টি।
আপনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন এ বন্দর কততম অবস্থানে ছিল? সারা বিশ্বের যে বন্দরগুলো, তার তুলনায় আমাদের বন্দরের ইতিহাস যে রকম পুরোনো..., বন্দরটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক কারণে, আপনি দায়িত্ব নেয়ার পর প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য কী ছিল?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমি চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বভার গ্রহণ করি ৩১ জানুয়ারি ২০২১-এ। যখন একদম কোভিডের মাঝপথে আমরা এসে পৌঁছেছি, কোভিড আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল। তখন চট্টগ্রাম বন্দর মোটামুটি স্থবির হয়ে ছিল, আমরা লয়েড’স লিস্টেও ছিলাম না। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর না, সারা বিশ্বের সব বন্দরই মোটামুটি বন্ধ অবস্থায় ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরকে আমরা দ্রুত অনেক ভালো অবস্থায় নিয়ে যাই। আমরা, বন্দরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, চট্টগ্রাম বন্দরকে আমরা চব্বিশ ঘণ্টা সচল রেখেছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে দর্শন ছিল, যে জীবন এবং জীবিকার সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে- আমরা সেভাবে সেই দর্শন লালন করে, বুকে ধারণ করে কার্যক্রম পরিকল্পনা করেছিলাম। আমরা চব্বিশ ঘণ্টা চট্টগ্রাম বন্দর সচল রেখেছিলাম। এতে আমাদের বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ সচল ছিল এবং সেই পিরিয়ডেও কিন্তু আমাদের ১৩% গ্রোথ হয়ে ছিল। এর বিনিময়ে আমাদের ৫৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আমরা হারিয়েছি। আজকে আমি তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
১৯৭৭ সালে ছয়টি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরের। এ বন্দর এখন বছরে ৩২ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করছে। সে হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের যাত্রাটি চমকপ্রদ। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান: চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরোনো, প্রায় আড়াই হাজার বছরের। তবে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং শুরু হয় ১৯৭৭ সালে, মাত্র ছয় টিইইউ কনটেইনার দিয়ে। সে সময় অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ১০ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের মাইলফলক স্পর্শ করতে আমাদের ৩১ বছর লেগে গেছে। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর প্রথমবারের মতো ১০ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করে। এর পরের অর্থাৎ ২০০৯ সাল পরবর্তী সাফল্য ঈর্ষণীয়। ২০ লাখ টিইইউর মাইলফলক স্পর্শ করতে সময় লেগেছে মাত্র সাত বছর। ২০১৫ সালেই ২০ লাখ টিইইউর বেশি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করে চট্টগ্রাম বন্দর। এর মাত্র চার বছর পর ২০১৯ সালে ৩০ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করে নজির সৃষ্টি করে বন্দর। ২০২১ সালে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ লাখ টিইইউর ঘরে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এ সাফল্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত দিক-নির্দেশনা এবং সেই আলোকে সরকারের গৃহীত বন্দরকেন্দ্রিক নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা। সরকারের ও আমরা যারা বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছি, তাদের ধারাবাহিকতাও এ ক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা রেখেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি এসব পরিসংখ্যানে।
এই পর্যায়ে আসতে বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা অনেক বাড়াতে হয়েছে। সেটা কীভাবে হয়েছে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান: পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই দেখবেন চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। গত পাঁচ বছর গড়ে ১২-১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এই প্রবৃদ্ধিকে সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি অর্থাৎ সক্ষমতা প্রতিনিয়ত বাড়াতে হচ্ছে। এখন আমাদের কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫৮০ টিইইউ। আমাদের সক্ষমতাও অনেক বেড়েছে এবং বিশ্বের যেকোনো আধুনিক বন্দরের সঙ্গে একে তুলনা করা যায়।
এ ছাড়া ইকুইপমেন্টও বেড়েছে। আমি যখন চট্টগ্রাম বন্দরে সদস্য (হারবার ও মেরিন) হিসেবে যোগ দিই ২০১০ সালে, তখন সিসিটিতে মাত্র চারটি কিউজিসি (কি গ্যানট্রি ক্রেন) ছিল। বর্তমানে আমাদের কিউজিসি ১৮টি। সেই সময় আমাদের আরটিজি ছিল ৭টার মতো। আরটিজির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এখন ৪৭। আরএমজিসি (রেল মাউন্টেড গ্যানট্রি ক্রেন) বন্দরে যুক্ত হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ শেষ করেছি। ফলে আমাদের বন্দরের সক্ষমতা চার মিলিয়ন টিইইউতে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বা কনটেইনারের কোনো জট নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ইচ্ছায় এত অল্প সময়ে আমরা এই সক্ষমতা বাড়াতে পেরেছি।
সব মিলিয়ে বলতে পারি, বিভিন্ন ধারণক্ষমতার বিপুলসংখ্যক যেসব ক্রেন আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছে। নিঃসন্দেহে সেগুলো বন্দরের সক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং অভূতপূর্ব একটা পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বন্দরের উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। সরকার ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সব ধরনের নীতি ও বিনিয়োগ দিয়েছে বলেই চট্টগ্রাম বন্দরকে আজ আমরা একটা আধুনিক বন্দরে উন্নীত করতে পেরেছি। বন্দরের ধারণক্ষমতা ও সক্ষমতা দুটোই বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি।
কর্ণফুলী চ্যানেলকে আমরা প্রশস্ত করেছি। ড্রাফটও বেড়েছে। বন্দরে আগে ১৮৬ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ আসতে পারত না। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর এটি ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরের জেটিতে আনতে পেরেছি।
বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অটোমেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম বন্দর এ ক্ষেত্রে কতটা এগিয়েছে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: চট্টগ্রাম বন্দরকে এক সময় ম্যানুয়াল বন্দর বলা হতো। সেই পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। বন্দরে আমরা টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম (টস) চালু করেছি। সবচেয়ে বড় যে কাজটা আমরা করেছি তা হলো ইলেকট্রনিক ডেলিভারি সিস্টেম। এটা একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভেহিকল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে ট্রাকের ফি আদায় অটোমেশনের আওতায় এসেছে। পুরোপুরি না হলেও সেমি-অটোমেটিক বন্দরে আমরা উন্নীত হয়েছি।
বহির্নোঙর ও চ্যানেলে চলাচলকারী জাহাজ নজরদারিতে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস) চালু রয়েছে। বহির্নোঙরের (পোর্ট লিমিট) আওতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাহাজ পাইলটিংয়ে পাইলট সার্ভিস অটোমেশন চালু করা হয়েছে।
বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে বাস্তবায়ন করা হয়েছে একগুচ্ছ উন্নয়ন পরিকল্পনা। নিরাপদ বন্দর নিশ্চিতে স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার, রয়েছে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম। যান চলাচল নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অটোমেটিক গেট কন্ট্রোল সিস্টেম, আন্ডার ভেহিকল সার্ভিল্যান্স সিস্টেম (ইউভিএসএস) ও স্ক্যানার।
এসব অর্জন আপনাকে কোথাও কী তৃপ্ত করছে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: সব সময় আমাদের আমাদের লক্ষ্যই থাকে অংশীজন ও ব্যবহারকারীদের সর্বোৎকৃষ্ট সেবা দেওয়া। সেটা নিশ্চিত করতেই বন্দরকেন্দ্রিক এত আয়োজন। কাঙ্ক্ষিত সেবা যে এখন পাওয়া যাচ্ছে, ব্যবহারকারীরাই তা বলছেন। কোভিডকালীন সারা বিশ্বের বন্দর যেখানে স্থবির হয়ে গিয়েছিল, তখনো আমরা অংশীজন ও ব্যবহারকারীদের ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে গেছি। কোভিডকালেও ৪১ শতাংশ জাহাজ অন-অ্যারাইভাল বার্থিং পেয়েছে। এখন আমরা ৮০ শতাংশ জাহাজকে অন-অ্যারাইভাল বার্থিং দিচ্ছি।
এ ছাড়া অটোমেশনের বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও সুফল দুটোই আমরা পাচ্ছি। যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথের গবেষণা যখন বলে যে, এশিয়া অঞ্চলের ৬৫টি সেমি-অটোমেটিক বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান সবার ওপরে তখন ভালো তো লাগেই। তবে এ অর্জন বন্দরের একার নয়, সব ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীদেরও।
২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার যে অভীষ্ট তা অর্জনেও বড় ভূমিকা রয়েছে বন্দরের। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বর্ধিত চাহিদা পূরণে বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা আরো বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। সে ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তুতি কী?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে প্রয়াস তাকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে আমাদের এখানেই থেমে থাকলে হবে না। ধারণক্ষমতা ও সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা কাজও করছি। আমরা ইতিমধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করেছি। আমাদের আরো ইয়ার্ড তৈরির কার্যক্রম চলছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে ৫৫ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণ করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া আমরা বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনাল নির্মাণ করছি। বে টার্মিনালের কাজ শেষ হলে ২৮৫ মিটার দীর্ঘ ও ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ সেখানে আসতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে যেখানে ৩ হাজার টিইইউর জাহাজ আসে আর বে টার্মিনালে আসবে ৫-৬ হাজার টিইইউর জাহাজ। মাতারবাড়িতে ড্রাফট ১৮ মিটার। সেখানে ১০-১২ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষমতার ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ আসতে পারবে। তখন আমরা বাংলাদেশকে অত্র অঞ্চলের ট্রান্সশিপমেন্ট হাব বানাতে পারব। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজ সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় যেতে পারবে।
মাতারবাড়ি ও বে টার্মিনাল কবে নাগাদ কার্যক্রমে আসতে পারে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনালের মূল চ্যানেলের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা কনটেইনারবাহী জাহাজের বেসিন তৈরি করছি। মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জামবাহী ১১৭টির বেশি জাহাজ এরই মধ্যে সেখানে এসেছে। আমরা টাগবোট ও কন্ট্রোল রুমের ব্যবস্থা করেছি। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনালের কাজ পুরোদমে চলছে এবং আশা করছি ২০২৬ সালের মধ্যে কনটেইনার পরিবহনের সুফল আমরা পাব।
বে টার্মিনালের ডিটেইল ড্রয়িং ও ডিজাইনের জন্য আমরা দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছি এবং এরই মধ্যে তারা তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ ও চ্যানেল খননের জন্যও আন্তর্জাতিক একটি যৌথ কোম্পানিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নির্মাণ শেষ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে এটি কার্যক্রমে আসবে বলে আমরা আশা করতে পারি। বে টার্মিনালে মোট তিনটি টার্মিনাল থাকবে; একটি মাল্টিপারপাস এবং দুটি কনটেইনার টার্মিনাল।
বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ঘোষণা করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমি শুরু থেকেই এ কথাটি বলে আসছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পূর্ব এশিয়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এবং ভারতের ব্যবসার অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে। আমরা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক হাব হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের নিজস্ব ১৭ কোটি জনগণ ছাড়াও প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের একটি বিশাল বাজারের যোগাযোগের পথ হতে পারে বাংলাদেশ।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ দর্শনই আমাদের জন্য দিক-নির্দেশনা এবং বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
সাবরিজিয়নাল ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হওয়ার অর্থ হলো অন্যান্য দেশ আমাদের এ বন্দরকে ব্যবহার করবে। সে জন্য আমাদের বন্দরের উন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংযোগ, সেবার প্রাপ্যতা, দক্ষ জনশক্তি সর্বোপরি পর্যাপ্ত নাব্যতা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়াটাও জরুরি। সবগুলো সুবিধাই আমাদের আছে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনাল চালু হলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা (বর্তমানে শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর), হলদিয়া, বিশাখাপত্তম, কাকিনাদা ও আন্দামান-নিকবরের অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর বেল্টের বন্দরগুলো এটি ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন এবং থাইল্যান্ডের ফুকেটসহ আরো দুই-একটি ছোট বন্দরও এটি ব্যবহার করতে পারবে। অর্থাৎ এ বন্দরগুলো হবে মাতারবাড়ি-কেন্দ্রীক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা মাতারবাড়ি ব্যবহার করবে? কারণ এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ির ড্রাফট সবচেয়ে বেশি। ১৮ মিটার ড্রাফট হওয়ায় ১০ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারবে এখানে। এখন একটি জাহাজে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টিইইউ কনটেইনার আনা হয়। এর পরিবর্তে ১০ হাজার টিইইউ কনটেইনার আনলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ফ্রেইট কমে যাবে। ব্যবসায়ীরা তখন এমনিতেই মাতারবাড়ি বন্দরকে বেছে নেবেন। কারণ, ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি দ্রুত পণ্যের ডেলিভারিও তারা পাবেন। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর তখন মাতারবাড়িকে ফিডার পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করবে।
এ ছাড়া মাতারবাড়ি চালু হলে এখান থেকে জাহাজগুলো সরাসরি পাড়ি দেবে ইউরোপ ও আমেরিকার বন্দরের উদ্দেশ্যে। ফলে সময় অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশ থেকে মধ্যবর্তী ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হয়ে ইউরোপীয় গন্তব্যে পণ্য পরিবহনে এখন গড়ে ৬-৭ সপ্তাহ এবং যুক্তরাষ্ট্রের গন্তব্যে গড়ে ১২-১৬ সপ্তাহ সময় লাগে। যুক্তরাষ্ট্রের গন্তব্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা গেলে পণ্য পরিবহনে সময় অর্ধেকে নেমে আসবে। ইউরোপের যেসব দেশের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচল চালু হয়েছে সেখানে আমরা ১৬-২০ দিনের মধ্যে জাহাজ পৌঁছাতে পারছি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে আপনি এরই মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করেছেন। এটা অব্যাহত রাখা কতটা জরুরি?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এরই মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও ইতালির পোর্ট অব র্যাভেনা বন্দরের মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয় এবং পরবর্তীতে স্লোভেনিয়ার কোপার বন্দরের সঙ্গেও সেবাটি চালু হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিটেনের পোর্টসমাউথের ফ্লেক্সটো পোর্ট, পর্তুগাল, জার্মানির পোর্ট অব হামবুর্গের সঙ্গেও সরাসরি জাহাজ চলাচল সেবা চালুর প্রস্তুতি রয়েছে। ব্যবসায়ীদের সময় ও খরচ বাঁচাতে সেবাটি অব্যাহত রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য প্রয়োজন গভীর সমুদ্রবন্দর। সেই অর্জনের দিকেই যাচ্ছি আমরা।
একটা কথা আপনি প্রায়ই বলে থাকেন এবং তা হলো লায়াবিলিটিজকে আমাদের অ্যাসেটে পরিণত করতে হবে। ট্রান্সশিপমেন্ট হাবের মাধ্যমে লায়াবিলিটিজকে নিশ্চয় অ্যাসেটে রূপান্তরের একটা সুযোগ তৈরি হবে। সেটা কীভাবে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাজ হলো দায়কে সম্পদে পরিণত করা। এটাই মূল। অর্থাৎ, আমাদের দায়কে যদি আমরা সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারি তাহলেই আর কোনো সমস্যা থাকে না। আমাদের বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে উন্নীত করার মধ্য দিয়েও সেটা সম্ভব। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। এখন কোনো কনটেইনার চার দিনের বেশি বন্দরের অভ্যন্তরে পড়ে থাকলে আমদানিকারককে ডিটেনশন চার্জ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু যদি বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ঘোষণা দেওয়া যায়, তখন এমএলওদের খালি কনটেইনার সিঙ্গাপুর বা কলম্বো ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে নিতে হবে না। তারা তখন কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরেই রাখবে। আমাদের স্পেস রেন্ট বাবদ ফি পরিশোধ করবে। তাও আবার বৈদেশিক মুদ্রায়। অর্থাৎ, ব্যবসায়ীদের আর ডিটেনশন বা ড্যামারেজ চার্জ দিতে হবে না এবং স্পেস রেন্ট হিসেবে বন্দর রাজস্ব পাবে এমএলওদের থেকে। একদিকে ব্যবসায়ীদের খরচ বাঁচবে, অন্যদিকে বন্দরের আয় বাড়বে। বন্দরের আয় বৈদেশিক মুদ্রায় হওয়ায় এর একটা বড় প্রভাব পড়বে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
বন্দরের দায় আসলে কী কী এখন, একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমরা এর আগে আমাদের সার্ভিসগুলো সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকা, ফার ইস্টার্ন কান্ট্রি চীন-জাপানে পাঠাতে পারতাম না। কেন না আমাদের এটা হাব হিসেবে আগে পরিচিত ছিল না। আমাদের বন্দরটা থেকে যদি আমরা সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকা এবং অন্যান্য ডেস্টিনেশনে প্রেরণ করতে পারি, তাহলে কিন্তু ট্রানজিট টাইমটা কমে যাবে। আমাদের ট্রানশিপমেন্ট হাবগুলো আমাদের ব্যবহার করতে হবে না, ফলে আমাদের সেখানে ট্রান্সশিপমেন্টের যে ব্যয়, সেটাও কমে যাবে। এবং যে সময় লাগে, এখান থেকে সিঙ্গাপুর অথবা পোর্ট ক্লিয়ং অথবা তিয়ানজিং পোর্ট অথবা কলম্বো হাব আমরা ব্যবহার করি বর্তমানে। সেই হাবগুলো যদি আমাদের ব্যবহার করতে না হয়, আমরা যদি সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকাতে পাঠাতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের এই যে অতিরিক্ত সময় এবং অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়, হাব পোর্টে সেটা আমাদের সাশ্রয় হবে। এবং সে ক্ষেত্রে আমরা যদি এই চট্টগ্রাম বন্দরকে, যেটা আমাদের বে-টার্মিনাল, এবং মাতারবাড়িতে যেই ডিপ সি টার্মিনাল হচ্ছে, সেটাকে যদি আমরা ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলে এখন বর্তমানে আমাদের যে ডিটেনশন এবং ডেমারেজ চার্জ দিতে হয় পোর্টে, অনেক বেশি ফিক্সড অপারেটিং কস্ট আমাদের পে করতে হয় জাহাজের অবস্থানের জন্য, সেই সব কস্ট আর আমাদের বহন করতে হবে না। তখন এই যে কন্টেইনারগুলো আসে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে, যখন আসে, প্রথম চার দিন এমএলও-রা আমাদের ফ্রি টাইম দিয়ে থাকে। ওই চার দিনের পর থেকে তারা কিন্তু কন্টেইনারের ওপর ডিটেনশন চার্জ ও ডেমারেজ চার্জ আরোপ করে ফেলে। এটা থেকে আমরা মুক্তি পাই তখনই, যখন আমরা ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে আবার খালি কন্টেইনারটাকে ফেরত পাঠাতে পারি অথবা লোডেড কন্টেইনারটাকে ফেরত পাঠাতে পারি। এই যে ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে তারা যখন যায়, সেখানে কিন্তু ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে এমএলও-রা ট্রান্সশিপমেন্ট স্পেস রেন্ট দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে যতক্ষণ পর্যন্ত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের তাদের কন্টেইনারের ভাড়াই দিতে হয়, যে তার একটা কন্টেইনার আমার এখানে পড়ে আছে, সেজন্য। আমি যদি এটাকে হাবে পরিণত করতে পারি, তাহলে আমাকে ওই কন্টেইনারটা এম্পটি হওয়ার পরে আর এটার জন্য কোন ডিটেনশন বা ডেমারেজ চার্জ দিতে হবে না, বরং আমার যে স্পেসের ভেতর তার কন্টেইনারটাকে স্টোর করে রাখা হবে, এবং এখান থেকে অন্যান্য জায়গায় পরবর্তীতে সে খালি কন্টেইনারটা রপ্তানি করবে, সে জন্য উল্টো আমাকে চার্জ পরিশোধ করতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত প্রতিবছর যে কন্টেইনারগুলো আমরা এখানে ইউজ করে থাকি, আমাদের এখানে আসা-যাওয়া করে যে কন্টেইনার, সেটার পরিমাণ ৩.২ মিলিয়ন ছিল গত বছর, গড়ে। প্রতি কনটেইনারে ১০০০ ডলারও যদি ডিটেনশন এবং ডেমারেজ চার্জ আসে, সেখানে কিন্তু বিশাল বড় অঙ্ক। আমি অত্যন্ত নগণ্য একটা এমাউন্ট বললাম, হিসাবের সুবিধার জন্য। ৩.২ ইনটু ১০০০ হলো ৩.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। তো ৩.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার যদি ফরেন ক্যাশের সাশ্রয় হয়, ডেমারেজ এবং ডিটেনশন চার্জ বাবদ দিতে না হয়, তাহলে এটা রিজার্ভে আরও বড় অবদান রাখবে। এটা তো একটা সেগমেন্ট। এ রকম আরো পাঁচ-সাতটা সেগমেন্ট আছে- ডিটেনশন, ডেমারেজ, ফিক্সড অপারেটিং কস্ট এগুলোর ওপর ভিত্তি করে; তখন দেখা যায় যে বিশাল এমাউন্ট। আমাদের এই বর্তমানে যে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার আমরা ক্রস করেছি, সেটার সঙ্গে যদি আরো ২০/৩০ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হয়, এটা তো বিশাল একটা এমাউন্ট, আমাদের রিজার্ভ অনেক বৃদ্ধি পাবে। আমাদের বন্দরগুলা যদি রিজওনাল হাব হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে আমরা কিন্তু নিজেরা নিজেদের বন্দরকে রিজওনাল হাব হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আমাদের মাতারবাড়িটা যদি ডিপ সি টার্মিনাল হিসেবে আমরা ইউজ করি, এই মাতারবাড়িটা হবে আমাদের হাব; এবং চিটাগাং পোর্ট, মোংলা পোর্ট, পায়রা পোর্ট-এ তিনটা হবে আমাদের অ্যান্ড ইউজার পোর্ট অথবা আমাদের ফাইনাল ডেস্টিনেশন। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর এবং মোংলা ও পায়রা-এ তিন বন্দরের একটা অ্যাডভান্টেজ হলো, আমাদের এখানে কারো কার্গোর ওপর আমাদের ডিপেন্ড করতে হয় না। যেমন সিঙ্গাপুর, পোর্ট ক্লাং, কলম্বো এরা কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল হাব। এদের কিন্তু কার্গো অ্যাট্রাক্ট করতে হয়। আরেকজনের থেকে কার্গোটা ছিনিয়ে আনতে হয়, কম পয়সা দিয়ে, বা ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটা নয়। আমাদের কার্গোটাই... ধরেন চায়না থেকে র’ ম্যাটেরিয়াল আসে, সিঙ্গাপুরে ট্রান্সশিপমেন্ট হয়, অথবা সিঙ্গাপুরে না হলেও পোর্ট ক্লাং-এ হয়, অথবা কলম্বোয় হয়। এখন কলম্বো, পোর্ট ক্লাং এবং সিঙ্গাপুর, এরা যখন ইউজারকে ফ্যাসিলিটিজ দেয়, তখন তারা তাদের ওখানে যায়। আমাদের এখানে সে সমস্যা নাই। আমাদের এখানে তাদের কোনো সুবিধা দিতে হয় না। ওখানে দেখা যায় তারা প্রতি কনটেইনারে টু পার্সেন্ট, থ্রি পার্সেন্ট, ফাইভ পার্সেন্ট করে তারা তাদের কনসেশন দেয়, যেটা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য প্রযোজ্য নয়। চট্টগ্রাম বন্দর হলো অ্যান্ড ইউজার পোর্ট, এটা হল ফাইনাল ডেস্টিনেশন। আমরাই ইম্পোর্টার আমরাই এক্সপোর্টার, আমাদের এখানে আসতেই হয়। বরং আমাদের বন্দরে আসতে হলে আমরা তাদের স্পেশাল পারমিশন দিয়ে থাকি। আমরা সব জাহাজকে সমভাবে পারমিশন দিই না। তার কারণ হলো, বড় জাহাজগুলোকে আমরা পারমিশন দিয়ে থাকি যেন আমাদের বন্দরে একটা সিঙ্গেল জাহাজও যদি আনা যায়, দেখা যাবে যে আমাদের ফ্রেট কমে যাবে, আমাদের সময় কমে যাবে, ডিটেনশন এবং ডেমারেজ চার্জগুলো থেকে আমরা অব্যাহতি পাব। এ জন্য আমাদের বন্দরের যে সুবিধাগুলা, এই যে লায়াবিলিটিজ, একে আমরা যদি অ্যাসেটে কনভার্ট করতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের দেশটাকে উন্নত বিশ্বে নেয়ার আমাদের যে লক্ষ্য, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে স্বপ্ন, ২০৪১ সালের ভেতর উন্নত বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন; আমার মনে হয় সেটা আমরা দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে পারব। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর এ অপ্রত্যাশিত খরচগুলো আমরা যদি কমাতে পারি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ৯৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারে উন্নীত করা বেশি কষ্টের বিষয় নয়, এক বা দুই বছরেই সেটা আয় করা সম্ভব, শুধু পোর্টের ফ্যাসিলিটিজ এবং পোর্টকে ইউজ করে।
বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এত আগ্রহের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: বাংলাদেশের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের অন্যতম কারণ হচ্ছে এর উড়ন্ত প্রবৃদ্ধি। সেই সঙ্গে রয়েছে ১৭ কোটি মানুষের বিশাল বাজার। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও বঙ্গোপসাগর ঘিরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় জাপানের অর্থায়নে ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা বিগ-বি কার্যক্রম চলছে। তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই বিগ-বি। প্রথমটি শিল্প ও বাণিজ্য, যার মূলে আছে গভীর সমুদ্রবন্দর। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে তা দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য অংশের বাণিজ্যের দুয়ার হিসেবে কাজ করবে। দ্বিতীয় স্তম্ভটি হলো জ্বালানি। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিগ-বি আওতাভুক্ত এলাকা শুধু নয়, পুরো বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যে গতি সঞ্চার করবে। তৃতীয় স্তম্ভটি পরিবহন ব্যবস্থা। দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের স্বার্থে ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পরিবহন’ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলো পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের মতো বাড়বে।
সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর ‘ব্লু ইকোনমি’ বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। সে সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা কোন অবস্থানে আছি?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে আজকের এই যে উচ্ছ্বাস তার ভিত্তি রচনা করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গোপসাগরের ওপর আমাদের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালেই তিনি ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। আনক্লজ (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি) আসে এরও আট বছর পর, ১৯৮২ সালে।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিস্তৃত এ সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদ আহরণে আগে প্রয়োজন তা নিয়ে জরিপ, অনুসন্ধান ও গবেষণা। সমুদ্র গবেষণার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বেশ কয়েকটি জাহাজ রয়েছে। বানৌজা অনুসন্ধান নামে নৌবাহিনীর একটি জাহাজ হাইড্রোগ্রাফি সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সমুদ্রবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হয় বিএনটি খাদেম নামের বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ওশান গোয়িং স্যালভেজ শিপ।
সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: বাংলাদেশের অধিকারে আসা বঙ্গোপসাগরের বিপুল সমুদ্রসম্পদ কেবল আহরণ করলেই হবে না। এর সুরক্ষাও দিতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আমাদের একটি সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে নাবিক ও জেলেদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। এর মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের খনিজ ও মৎস্যসম্পদ সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ অর্জন সম্ভব হবে। আমাদের নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সমুদ্র এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীকে একটি ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীতে রূপ দিয়েছেন। একই সঙ্গে কোস্ট গার্ডকেও আমাদের দীর্ঘ উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অধিকতর সক্ষম করে তুলছেন। বাহিনী দুটির উত্তরোত্তর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। যা বঙ্গোপসাগর জুড়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি দেশের সমুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও জোরদার করছে।
প্রশিক্ষিত ও দক্ষ মেরিন জনশক্তি এ মুহূর্তে আমাদের অনেক বেশি দরকার। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেই মেরিন জনশক্তি আমরা কতটা তৈরি করতে পারছি?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: সমুদ্র অর্থনীতির সর্বোচ্চ সুফল কাজে লাগাতে সমুদ্র জ্ঞান সমৃদ্ধ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। এ জন্য নতুন চারটিসহ আমাদের রয়েছে পাঁচটি সরকারি মেরিন একাডেমি। রয়েছে বেসরকারি আরও কয়েকটি মেরিন একাডেমি। বিশেষায়িত জ্ঞান আহরণের জন্য আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। তবে মেরিন একাডেমি থেকে বের হওয়া মেরিনারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে আমাদের নিবন্ধিত জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া মার্চেন্ট শিপিং অরডিন্যান্স সংশোধন করে চট্টগ্রাম বন্দরেও যাতে জাহাজ নিবন্ধিত হতে পারে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তখন বাধ্যতামূলকভাবে এসব জাহাজকে বাংলাদেশের মেরিনারদের চাকরি দিতে হবে। এর ফলে আরো বেশি মেরিনারের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটানো যাবে। চূড়ান্ত বিচারে বৈদেশিক আয়ও বাড়বে। আপনি এর আগে কোস্টগার্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন। বন্দর একটা দারুণ স্মার্ট অবস্থায় এসেছে আপনার সময়ে। আমরা শুনতে পাচ্ছি দ্রুতই আপনার মেয়াদ শেষ হবে। তো আপনার পরে যিনি দায়িত্ব নেবেন, তার জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: তার জন্য আমার পরামর্শ থাকবে যে, আমাদের যেসব কার্যকলাপ বা প্রোগ্রাম আমরা গ্রহণ করেছি, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা। ইতিমধ্যে আমাদের কিছু কিছু টার্মিনালকে প্রাইভেটাইজেশনের জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেসব পদক্ষেপগুলো আরো দ্রুত এগিয়ে নেয়া। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, এ কার্যক্রমের ট্রানজেকশনের অ্যাডভাইজারের রিপোর্টটা আমরা যথাসময়ে পাইনি। তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কেন না ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার যখন স্টাডি করে, তাদেরও অনেক সময় দিতে হয়, অনেক তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে তাদের বের করতে হয়। কিন্তু আমাদের তো তাড়াতাড়ি দরকার। সেই তাড়াতাড়ির জন্য আমরা তাদের বলেছি এবং তারা সেভাবেই কাজ করছে। আশা করি ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার আমাদের রিপোর্টগুলো দিলে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা আমাদের প্রাইভেট টার্মিনালের অপারেটর, ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের অপারেটর যারা আছেন তাদের দ্রুত নিয়োগ করতে পারব। তখন দেখা যাবে আমাদের এখানে আরো কমপিটিশন বাড়বে এবং আমাদের দক্ষতা এবং তাদের দক্ষতা দুটো মিলে আমাদের বন্দরকে আমরা অন্য একটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। এ ছাড়া বন্দরের যেসব উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো আছে, বে-টার্মিনাল, মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনাল এগুলো দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারব। ২০৪১ সালের ভেতরে আমাদের যে ডিমান্ড হবে, সেই ডিমান্ড আমরা অ্যাড্রেস করতে পারব।
বন্দর তো নানারকম বাণিজ্যের একটা জায়গা, অর্থ লেনদেনেরও জায়গা, আবার বন্দর ঘিরে নানা অপরাধও ঘটে। আপনার সময়ে আপনি অপরাধ এবং দুর্নীতি দমনে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে আমরা ম্যাক্সিমাম জিনিস অটোমেশন করে ফেলেছি। এটা হলো ডিজিটালাইজেশনের একটা সুফল, যার ফলে অনেক কম পরিমাণ জনবল সম্পৃক্ত থাকে, তখন দুর্নীতিটা সেখানে হ্রাস পায়। আর আরেকটা জিনিস হলো পেমেন্ট সিস্টেমগুলো... এখন কিন্তু আগে যেভাবে ম্যানুয়ালি হাতে হাতে টাকা পয়সা লেনদেন হতো, এখন অটোমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে আপনাকে পেমেন্ট করতে হয়। সুতরাং যেখানে অর্থের সরাসরি লেনদেন নাই, সেখানে দুর্নীতির সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এ ছাড়া আমরা বন্দরে কার্যক্রম পরিচালনায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছি। এই ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে একই জায়গায় একই রুমের ভেতর থেকে সবার সঙ্গে চেইন সিস্টেমে..., পাশাপাশি বসা- সবার সামনে জিনিসগুলো লেনদেন হচ্ছে, সুতরাং স্বচ্ছতা অনেক বেশি। আমাদের যে বার্থিং মিটিংটা হয় প্রতিদিন, সেই বার্থিং মিটিংটা কিন্তু অত্যন্ত স্বচ্ছ একটা প্রক্রিয়া, যেটাতে অনলাইনেও চাইলে যে কেউ যুক্ত হতে পারে। আমাদের জাহাজেও পুরো অটোমেশন বার্থিং সিস্টেম। আমাদের ভিটিএমআইএস আছে, যার মাধ্যমে কোন জাহাজ কখন কার আগে কে আসল, একদম পুরো রেকর্ড হয়ে থাকে। এখানে কোনো জাহাজকে আগে-পিছে করার কোন সুযোগ নাই। আগে-পিছে করতে গেলেই তখন তাকে জবাবদিহির ভেতর পড়ে যেতে হয়। সেই দুর্নীতিটা এখন আর করার সুযোগ নাই। একসময় যখন ছিল ম্যানুয়ালি, তখন হয়তো অনেকে অনেক কিছু চিন্তা করত। কিন্তু এখন টোটালি অটোমেটেড একটা বার্থিং সিস্টেম, সেখানে কারো হাত দেওয়ার কিছু নাই। কেউ চাইলেই কোনো সিস্টেমে এটা টেম্পারিং করতে পারে না, কারণ কম্পিউটারে কোন জাহাজ কয়টার সময় আসবে, সেই টাইম উল্লেখ করা থাকে-কোন সময় কোন জাহাজ কোন জায়গায় এসেছে এবং কোথায় নোঙর করেছে। এটা একটা জিনিস। আরেকটা হলো, যে পাইরেসির ব্যাপারে, আমাদের এখানে যে জলদস্যুতা এবং বহির্নোঙরে যে চুরি-ডাকাতি হতো, সেটাও ইনশা আল্লাহ আমাদের এখানে কমে গেছে। গত পরপর কয়েক বছর ধরে যে রেকর্ড আপনারা দেখতে পাবেন, সে রেকর্ডে আমরা কিন্তু ‘জিরো পাইরেসি’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছি। আমাদের বাংলাদেশের কোস্টগার্ড, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং পোর্টের যে সিকিউরিটি, সবাই মিলে আমরা যেভাবে কাজ করি এবং আমাদের টাস্কফোর্সের যে লোকবল, সবাই মিলে যৌথভাবে যে অপারেশন ও কার্যক্রম পরিচালনা করে, তার সুফল আমরা পেয়েছি। এর ফলে আমাদের বন্দরে দুর্ঘটনা, পাইরেসি, জলদস্যুতা বা ছিঁচকে চুরি-ডাকাতির ঘটনা এখন নাই বললেই চলে।
কিন্তু ব্যবসায়ীদের নানা অভিযোগ শোনা যায় বন্দর নিয়ে। আপনারা কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং নিয়ে এত দুর্দান্ত উন্নয়ন করেছেন, ঠিক সময় নেমে যাচ্ছে, কিন্তু বন্দর থেকে সেটা ছাড়ানোর জন্য অনেক ব্যবসায়ীকে নাকি স্পিড মানি দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগ আপনি কীভাবে দেখেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: স্পিড মানির কথা আপনাকে আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে এ সমস্যাটা চট্টগ্রাম বন্দরে নেই। এই সমস্যাটা হলো কাস্টমসের। লোকজন আমাদের বেশির ভাগ সময় গুলিয়ে ফেলে। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ হলো জাহাজ থেকে কার্গোটা নামিয়ে আমাদের ইয়ার্ডে আমরা স্টেক করে রাখি, এর পরে সবকিছু কিন্তু কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের। আর কাস্টমস থেকে দেখা যায়, অনেক সময় কোনো একটা জিনিসকে টেস্ট করতে পাঠায়, কোনো একটা জিনিসের এইচএস কোডে সমস্যা থাকে, ডিজি কার্গোর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকে... তখন তাদের সঙ্গে যখন কাজটা হয়, সেখানে তাদের বিলম্ব হয়। সেই বিলম্বের জন্য কিন্তু আসলে সবাই বলে যে বন্দরে বিলম্ব হচ্ছে, দেরি হচ্ছে, অনেক সমস্যা, কিন্তু আসলে সেটা বন্দরের সমস্যা না। বন্দর অন্যের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বসে আছে। যখনই কাস্টমসের ডকুমেন্ট আমরা পাই, আমরা কিন্তু দুই-চার ঘণ্টার ভেতরে আমাদের বন্দর থেকে কার্গোটা গেট দিয়ে আউট করে দিই। কাস্টমস এনবিআর-এর আন্ডারে, তাদের সমস্যাটা তাদেরই লুক আফটার করতে হবে। তারাও চেষ্টা করছে, কিছু কিছু অটোমেশন তারাও করেছে। কাস্টমসের তো জনবলের অনেক স্বল্পতা আছে, ইকুইপমেন্টের স্বল্পতা আছে, আর ল্যাবরেটরির সমস্যাটা হলো সবচেয়ে বেশি প্রকট। বিভিন্ন জিনিস টেস্ট করতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। তারাও চেষ্টা করছে নতুন নতুন ল্যাবরেটরি স্থাপন করার জন্য এবং বাইরে আউটসোর্সিং করেও কিছু দেওয়া যায় কিনা সেটাও তারা চেষ্টা করছে। আশা করি এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের বন্দরের বাইরে বিভিন্ন সময়ে আপনারা বিভিন্ন লিটারেচর দেখবেন- চট্টগ্রাম বন্দরে কনজেশন, চট্টগ্রাম বন্দরে ইয়ার্ড স্পেস কম, চট্টগ্রাম বন্দরে ইকুইপমেন্ট কম–এগুলো কিন্তু ওয়ানস আপন এ টাইম ছিল। এখন কিন্তু সেটা নাই। এখন চট্টগ্রাম বন্দরে জেটির সংখ্যা পর্যাপ্ত, ইকুইপমেন্ট পর্যাপ্ত। আমি যখন মেম্বার হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে এখানে কাজ করি, তখন মাত্র চারটা কি গ্রেনটি ক্রেইন এখানে ছিল। এখন সেখানে ১৮টা, এবং প্রত্যেকটা জাহাজে আমরা তিনটা করে ক্রেনকে একসঙ্গে দিতে পারি। সুতরাং আগে যেখানে জাহাজ কন্টেইনার নিয়ে এসে তিন থেকে পাঁচ দিন লেগে যেত ডেলিভারি ডিসচার্জ করতে, এখন সেখানে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টার ভেতর তারা ডেলিভারি করে চলে যায়। এক সময় জেটিতে আসার জন্য জাহাজকে বহির্নোঙরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, এখন সেটা নেই। এখন জাহাজের জন্য জেটি খালি হয়ে থাকে, আমরা জাহাজ আসার সঙ্গে সঙ্গে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টার ভেতর ডিসচার্জ করে জাহাজকে সেল আউট করে দিচ্ছি। সেই ইফিসিয়েন্সি এখন আমাদের অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। সুতরাং আমাদের চিন্তা করতে হবে, যে সব লিটারেচরগুলো আছে আমার মনে হয়, এখন সময় এসেছে ইন্টারনেটের ওই সব লিটারেচরগুলাকে দূরীভূত করার। চট্টগ্রাম বন্দর এখন আর সেই দশ বছর আগের বন্দর নয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের যেভাবে ইকুইপমেন্ট দিয়েছেন, যেভাবে অর্থ বরাদ্দ করেছেন, যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেই দিকনির্দেশনার জন্য আজকে চট্টগ্রাম বন্দর এ অবস্থানে আসতে পেরেছে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের যতগুলো উন্নয়ন প্রকল্প, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবগুলো করিয়েছেন। আজকে যে আমরা এ জায়গায় এসে পৌঁছেছি, তার কিন্তু কৃতিত্ব আমাদের আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। তিনি বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে হলে বন্দরগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। তিনি বন্দরগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছেন। তিনি যেভাবে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি দেশের অন্যান্য সেক্টর যেভাবে ডেভেলপ করছেন, চিটাগাং পোর্টের জন্যও তিনি সেভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তিনি আমাদের অনুমোদন দিয়েছেন বে-টার্মিনালের, অনুমোদন দিয়েছেন মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনালের, অনুমোদন দিয়েছেন পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের। সম্প্রতি ১০৪টা ইকুইপমেন্ট কেনারও তিনি অনুমোদন দিয়েছেন, যে ইকুইপমেন্ট প্রাইসের অর্ধেক অংশ ইতিমধ্যে আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছে। সুতরাং আমাদের এখানে এখন কোনো ইকুইপমেন্টের স্বল্পতা নাই। ইয়ার্ড স্পেস সম্বন্ধে বলি, আমাদের এখানে আমি যখন জয়েন করি, তখন ইয়ার্ড স্পেস ছিল ৩৯ হাজার টিইউস-এর মতো। এখন সেখানে ইয়ার্ড স্পেস হয়ে গিয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইউস-এর বেশি। সেটা দিন দিন আমরা বাড়াচ্ছি। এর ভেতর আরো কয়েকটা ইয়ার্ড আমাদের বাড়ছে। সেগুলা হলে আগামী এক মাস/দেড় মাসের ভেতর ৫৫ হাজার টিইউস–এ উন্নীত হবে। সুতরাং আমাদের ইয়ার্ড স্পেস খালি। আগে যেখানে কন্টেইনার স্তূপ হয়ে থাকত। এখন আমাদের কন্টেইনার ইয়ার্ডে দেখবেন যেখানে কন্টেইনার আগে সিক্স আই হয়ে থাকত, এখন সেখানে থ্রি আই/ফোর আই-তে নেমে এসেছে। মানে আমাদের ইয়ার্ড স্পেস আমরা এখন অনেক বেশি পাচ্ছি। আমরা ওভার ফ্লো ইয়ার্ড তৈরি করেছি। আমাদের এলসিএল যে কার্গোগুলো আছে, সেগুলো আগে জেটির ভেতর থেকেই ডিসচার্জ করতে হতো। এখনো করে, কিন্তু আমরা তার পাশাপাশি এক্স ওয়াই শিপকে বন্দরের বাইরে একটা স্থানে নিয়ে গেছি। আগামী অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেটাও চালু হবে এবং সেখানে এলসিএল কার্গোগুলো আসলে জেটির ভেতর থেকে যেই কার্গো ডিসচার্জের প্রক্রিয়া, সেটা বাইরে চলে যাচ্ছে। সেটা হলে বন্দরের ভেতর অনেক কম পরিমাণ ট্রাক ঢুকবে। এভাবেই কিন্তু বন্দরটা কনজেশন ফ্রি হয়। আমাদের বন্দরে এখন কোনো কনজেশন নেই, কোনো ইয়ার্ড স্পেস শর্টেজ নাই, কোনো ইকুইপমেন্টেরও শর্টেজ নাই। এখন আন্তর্জাতিক যেকোনো বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরকে তুলনা করতে পারি। যে কেউ বন্দরে এসে একবার ভিজিট করে গেলে বুঝবে যে আমরা সিঙ্গাপুর বলেন, কলম্বো বলেন, মালয়েশিয়া বলেন, ইন্দোনেশিয়া বলেন -সব জায়গাতেই যে বন্দরগুলা আছে, আমাদের এশিয়ার যে বন্দরগুলো আছে, প্রত্যেকটা বন্দরের সঙ্গে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনা করা যায়। একসময় আমাদের বন্দরের ওপর একটা স্টাডি হয়েছিল লন্ডন ভিত্তিক একটা জায়গা থেকে, তারা বলেছিল যে এশিয়ান রিজনে যে ৬৯টা বন্দর আছে, তার ভেতরে সেমি-অটোমেটিক এবং ম্যানুয়াল মুডে যে বন্দরগুলো চলে, তার ভেতরে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান এক নম্বর।
যোগাযোগ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা কতটুকু? কীভাবে এই বিনিয়োগ খাতটিকে আরো এগিয়ে নিতে পারে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: পরিবহন এবং লজিস্টিক খাতে দক্ষতা ও গতিশীলতা আনতে বেসরকারি বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে ভালো একটি বিকল্প হতে পারে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখানকার সড়ক এবং রেলের ফ্রেইট পরিবহন কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণ শিপিং লাইনগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যে নতুন ধরনের ফিডার বার্জ-সার্ভিস চালু করা সম্ভব হলে সড়কপথে ট্রাকযোগে কার্গো পরিবহনের ওপর চাপ কমবে। ফলে নৌপথের ব্যবহার বাড়লে লজিস্টিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে। এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি আমরা। আমাদের বন্দর, রেল, সড়ক ও নৌপরিবহন সেবাসহ প্রতিটি খাতের অব্যাহত উন্নয়ন নিশ্চিত করা আবশ্যক। বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনালেও বিদেশি বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আগামী দিনের ‘এশিয়ান টাইগার’ হয়ে ওঠার পথে দেশকে এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে আমরাও প্রস্তুত।
দেশ রূপান্তরকে সময় দিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে দৈনিক দেশ রূপান্তরের সবাইকে ধন্যবাদ ও ঈদের শুভেচ্ছা জানাই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। রোবটিক্স বিষয়ক তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিশ্বের সেরা সেরা জার্নালে। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ ও আগ্রহী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' কে তিনি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও সমাজে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
দেশ রূপান্তর: এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
লাফিফা জামাল: এবারের প্রতিপাদ্য খুবই সুন্দর এবং সময়োপযোগী হয়েছে। একদিক দিয়ে আমরা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি, উদ্ভাবনের কথা বলছি।অন্যদিক থেকে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনের কথাও বলছি। তথ্য প্রযুক্তি একটা স্কিল। আমাদের সবাইকে প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। হয়তোবা আমরা সবাই আবিষ্কার করতে পারব না, কিন্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান আমাদের প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আপনি যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর কতদিন ভোক্তা হয়ে থাকব। এখন সময় এসেছে, আমাদের নিজেদের আবিষ্কার করা দরকার। প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠা প্রয়োজন।
দেশ রূপান্তর: আমরা যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি,তাহলে প্রযুক্তি শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেমন?
লাফিফা জামিল: মেয়েদের আগ্রহ অনেক বেশি। সময়ের সাথে সাথে এই আগ্রহ বেড়েছে। প্রযুক্তির বিষয়টা এমন যে, এখানে খুব ডেডিকেটেডলি সময় দিতে হয়। এই জায়গায় মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে নারীর অংশগ্রহণ কেমন?
লাফিফা জামাল: বর্তমানে আমাদের দেশে ৩০ শতাংশ নারীরা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করছে। যদিও পেশাগত জায়গায় ১০ শতাংশের মত নারীদের পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা যাদের পাই, ক্যারিয়ারে গিয়ে তাদের পাই না। এটা যে শুধু প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানে এমন নয়, সব সেক্টরেই নারী শিক্ষার্থীরা ড্রপ আউট হয়। পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয় না, আবার অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হয়েও পরে নানা কারণে ড্রপ আউট হয় বা চাকরি ছেড়ে দেয়।
দেশ রূপান্তর: সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীদের উপস্থিতি কেমন?
লাফিফা জামাল: সাধারণত এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলে আমরা যতটা মেয়েদের পাই, হায়ার লেভেল বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তুলনামূলক ভাবে নারীদের উপস্থিতি কম। যদিও এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনেক সেক্টরেই নারী প্রধান হচ্ছেন। এই জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন কে আরও বেগবান করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে একটা মেয়ে ডাক্তার হওয়ার চিন্তা যতটা সহজে চিন্তা করতে পারে, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হওয়ার চিন্তা ততটা করতে পারে না কেন?
লাফিফা জামাল: আমাদের সমাজে কতজন বাবা-মা চান আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হোক। পরিবার থেকেই মেয়েদের এই সাইকোলজি তৈরি হয়। একটা মেয়ে জন্মের পর থেকে শুনে আসে গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং খুব কঠিন। কঠিন সাব্জেক্ট মেয়েদের জন্য নয়- এই যে সামাজিক ট্যাবু, এটা একটা বড় ব্যারিয়ার। অথচ আপনি যখন গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন এতে আপনার ব্রেইনের চর্চা হয়। ব্রেইন তো নারী পুরুষ উভয়ের ই সমান। এখানে তো শক্তি লাগতেছে না। পেশি শক্তিতে হয়তো মেয়েরা কিছুটা পিছিয়ে থাকে। এই ব্যারিয়ার দূর করতে হবে ।
দেশ রূপান্তর: আপনি একদিক দিয়ে একাডেমিশিয়ান অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে, অভিভাবকদের ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার পরিবর্তে মেয়েকেও কিনে দেব এই চিন্তাটা এসেছে কি?
লাফিফা জামাল: এই উত্তর টা একটু অন্যভাবে দেই। এই চিন্তার কিন্ত পরিবর্তন ঘটেছে। এটা বেশ আশাব্যঞ্জক। আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই ৫০ ভাগ নারী শিক্ষার্থী ১ম বর্ষে ভর্তি হচ্ছে। যাদের একটা বড় অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছে। বর্তমানে স্কুল-কলেজে ঝড়ে পড়া কমেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ডিনস অ্যাওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি থাকে। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ও জিপিএতে মেয়েরাই এগিয়ে থাকছে। ঢাবিসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে নারী ফ্যাকাল্টির সংখ্যা বাড়ছে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে নারীদের একটা বড় অংশ গার্মেন্টসে কাজ করছে, তাদেরকে কীভাবে প্রযুক্তি সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা যায়?
লাফিফা জামাল: এর জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। গার্মেন্টস মালিকদের এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েরা এখন হাতে কাজ করছে। কিছুদিন পর যখন অটো মেশিনে কাজ শুরু হবে, তখন তারা কাজ হারাবে। সেই কাজ হারানোর আগেই তাদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এই মেয়েগুলো যাতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে কাজ করতে পারে, সে জন্য এখন থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: মফস্বলের স্কুল কলেজে ব্যবহারিকের চেয়ে থিওরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে কি শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না?
লাফিফা জামাল: এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া টা জরুরি। হয়তোবা দেখা যাচ্ছে যিনি জীববিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তার ব্যাকগ্রাউন্ডে জীববিজ্ঞান নয় অন্য কোন সাব্জেক্ট রয়েছে। কম্পিউটার বা আইসিটি যিনি পড়াচ্ছেন তিনি হয়তো কম্পিউটারের ব্যবহার ই জানেন না। ফলে ব্যবহারিক বাদ দিয়ে থিওরি পড়াচ্ছেন।
দেশ রূপান্তর: নারীদের দক্ষ করার কাজে যারা যুক্ত তাদের দাবি প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী তারা পাচ্ছেন না।
লাফিফা জামাল: এটা কেবল প্রযুক্তি নয়, সব সেক্টরের চিত্র। স্কুল কলেজের শিক্ষক হিসেবে আমরা মেয়েদের বেশি দেখতে পাই। তবে এখানে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আগে কিন্ত উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের অংশ গ্রহণ কম ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা বাড়ছে। ফলে আমি মনে করি সামনে এই সংখ্যা বাড়বে।
দেশ রূপান্তর: নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু?
লাফিফা জামাল: আমি তো মনে করি পরিবারের সাপোর্টটা খুব বেশি দরকার। পারিবারিক ভাবে যদি কোন মেয়ে বাধার সম্মুখীন হয়, তাহলে শুরুতেই মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাই পরিবারে পিতা মাতা এবং পরবর্তিতে জীবন সঙ্গীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে নারীদের সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি বাড়বে কি না?
লাফিফা জামাল: আমি তা মনে করি না। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে সাইবার বুলিং বাড়বে বিষয়টা এমন নয়। আপনি যদি সচেতন না হন তাহলে একদিন ব্যবহার করেও বিপদে পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুলিং প্রতিরোধ করতে হলে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সমাজেও তো বুলিং হয়, সে জন্য কি আমরা দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। কাজেই বুলিংয়ের ভয়ে প্রযুক্তিতে মেয়েরা আসবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না। যত বেশি প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হতে পারবে, ততই বুলিংয়ের সম্ভাবনা কমবে।
দেশ রূপান্তর: কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপদ পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করা গেছে?
লাফিফা জামাল: আমরা কি গণ পরিবহনে নিরাপদ পরিবেশ দিতে পেরেছি? পারি নি। শুধু গণ পরিবহনে কেন, রাতের বেলা যদি আমি হেঁটেও রাস্তায় বের হই, নিজেকে নিরাপত্তা দিতে পারি না। একইভাবে কর্মক্ষেত্রেও শত ভাগ নিরাপদ পরিবেশ এখনও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই উদ্যোগ প্রয়োজন।'
দেশ রূপান্তর: ধন্যবাদ আপনাকে।
লাফিফা জামাল: দেশ রূপান্তরকেও ধন্যবাদ।
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা এবং দেশকে সংক্রামক রোগমুক্ত করার কাজে নেতৃত্বদান করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে আর এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রবীণ এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : গত ১০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে ব্যক্তির ব্যয়। এখন দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে। এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-ষষ্ঠ রাউন্ড’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। চিকিৎসাব্যয়ের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ের এটা একটা ওভারঅল অবজার্ভেশন। চিকিৎসা ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে যায় আর এক-তৃতীয়াংশের মতো সরকার বহন করে। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা সারা দেশের মানুষের বা জনগণের সব অংশের সম্মিলিত বা গড়পড়তা একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টা অনেকটা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মতো। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এবং জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এই আয় দেশের অতিধনী ও ধনীদের কতটা বাড়ছে আর সাধারণ ও গরিব মানুষদের কতটা বাড়ছে বা আদৌ বাড়ছে কি না সেটা মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় না। তেমনি জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয় বা মানুষের চিকিৎসাব্যয়ের এই পরিসংখ্যান থেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বা গরিব মানুষদের বাস্তবতা বোঝার উপায় নেই। তাই বলা যায়, চিকিৎসা ব্যয়ের এই জাতীয় হিসাবে গরিবদের বাস্তবতা যথাযথভাবে উঠে আসেনি।
দেশ রূপান্তর : এরকম তথ্য কিন্তু পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে মোট খরচের ৫৪ শতাংশই খরচ করেন দেশের শীর্ষ ধনীরা। বাকিটা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রসহ জনসংখ্যার অন্যান্য সব অংশ মিলে। আবার সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য না হলে হাসপাতালে বা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না বলেও উঠে আসছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : আসলে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এমন পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু যেটা বলছিলাম যে, এমন হিসাবে দেশের সব মানুষের ডিটেইল পিকচারটা পাওয়া যাচ্ছে না। ধরুন খুবই প্রান্তিক একটা মানুষ, গ্রামেরও সাধারণ মানুষ তিনি কিন্তু চিকিৎসাব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ কেন এক-তৃতীয়াংশ বহন করার মতো অবস্থাতেও নেই। কারণ খাদ্য কেনার মতো যথেষ্ট টাকাই তার হাতে নেই। তো তিনি কীভাবে চিকিৎসার খরচ মেটাবেন? ধরুন তার ক্যানসার হয়েছে, তিনি তো ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা বা জেলা পর্যায়েও এই চিকিৎসা পাবেন না। আবার ঢাকায় এসে চিকিৎসা করানো মতো আর্থিক ক্ষমতা তো দূরের কথা আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়াই তার কাছে নেই। তাহলে প্রশ্নটা হলো, দেশের কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসায় কতটা ব্যয় করল শুধু সেটা হিসাব করলে হবে না; কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত সেই হিসাবটাও জরুরি। কিন্তু এ ধরনের পরিসংখ্যানে সেসব তথ্য উঠে আসছে না।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে এই গবেষণায়। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির খরচের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ওষুধে, যা মোট চিকিৎসাব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর মেডিকেল ও ডায়াগনস্টিকে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, চিকিৎসক দেখাতে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ইত্যাদি। ওষুধে এত বেশি ব্যয়ের কারণ কী বলে মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এ বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার। কিন্তু এসব কথা বললে অনেকে মাইন্ড করবেন। আমি নিজেও একজন চিকিৎসক। কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক চিকিৎসকই রোগীকে প্রেসক্রিপশনে এমন অনেক ওষুধ লিখে দিচ্ছেন যার হয়তো দরকার নেই। আবার অনেক সময় ওষুধ লেখা না লেখার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কথা ভাবেন।
দেশ রূপান্তর : আপনি যা বলছেন সে বিষয়ে কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার সচিবও অভিযোগ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার প্রশ্ন তুলেছেন যে, দেশে ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং সংক্রান্ত বিধি মানা হচ্ছে কি না। তিনি বলেছেন, অনেক চিকিৎসক শুনি ওমরাহ পালনে যান ওষুধ কোম্পানির টাকায়। অনেকে নাকি ফ্রিজ নেন টেলিভিশন নেন। কেউ আছে ফ্ল্যাট পর্যন্ত কিনে দেয়। আপনার কী মনে হয়?
ডা. নজরুল ইসলাম : স্বাস্থ্য সচিব এক্ষেত্রে সত্য কথাটাই বলেছেন। সত্য কথা বললে সব দিক নিয়েই বলা দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে সত্য কথা বলতে গেলে এত কথা উঠে আসবে, এত সব সমস্য ও সংকট এখানে আছে যেসব নিয়ে আসলে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা প্রয়োজন। ওই যে, কথায় বলে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা’, স্বাস্থ্য খাতের অবস্থাটাও তেমন।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের সিংহভাগ ওষুধের পেছনে ব্যয় হওয়া থেকে কি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওষুধ নির্ভরতার বিষয়টি সামনে আসছে? বিশ্লেষকরা বলে থাকেন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত ‘প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ার’ নয় ‘কিউরেটিভ হেলথ কেয়ার’-এর ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকে। আপনি কী মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা ঠিকই বলা হয়। এখন কথা হলো প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ারে আপনি কীভাবে যাবেন? সেজন্য পুরো ব্যবস্থাটা পাল্টাতে হবে। আর যেসব ব্যবস্থা আছে, অবকাঠামো ও জনবল আছে সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। যেমন ধরুন আমাদের যে ইপিআই বা এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন আছে সেটা খুবই দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু সেটাও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘হেপাটাইটিস-বি’ পুরোপুরি নির্মূল করবে। অর্থাৎ আমাদের হাতে আছে আর মাত্র ৭ বছর। এখন একজন প্রসূতি-মা যদি ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত থাকে তাহলে ভূমিষ্ঠ সন্তানটিরও ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভ্যাকসিন এবং ইমিউনোগ্লোবিন দেওয়া হলে শিশুটি আর তাতে আক্রান্ত হবে না। এই বিষয়টা আমরা জানি, এমন ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা প্রতিটি হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত প্রসূতির সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি কি? এখন এমন ভ্যাকসিনেশন না হওয়ার কারণে যে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে তারা তো আর ২০৩০ সালের মধ্যেই মারা যাবে না। তাহলে এই সময়ের মধ্যে কীভাবে আমরা হেপাটাইটিস-বি নির্মূল করব। আমি বলতে চাচ্ছি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান সুযোগও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। একই কথা প্রযোজ্য সার্ভিক্যাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে। এখন এর কার্যকর ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা কি ‘এট এন-মাস’ বা সারা দেশের সব নারীদের এই ভ্যাকসিন দিচ্ছি? দিচ্ছি না। তাহলে তো সার্ভিক্যাল ক্যানসারও থেকেই যাবে।
দেশ রূপান্তর : আবার একটু ওষুধ ও প্রেসক্রিপশনের আলোচনায় ফিরে যাই। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে। প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ব্র্যান্ড-নাম না লিখে শুধু ওষুধের জেনরিক-নাম লিখে দেওয়ার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এছাড়া, চিকিৎসকরা দুর্বোধ্য হাতের লেখায় ওষুধের নামসহ প্রেসক্রিপশন দেন এতেও সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছে। আবার অনেকেই বলছেন প্রেসক্রিপশন কেন বাংলায় লেখা হচ্ছে না? অথচ এই বিষয়ের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আপনি বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা নিয়েও তো আদালত একটা নির্দেশনাও দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ওষুধের নাম ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লিখতে। যাতে সবাই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই তো পাল্টায়নি। আমার মনে হয় এখানে দুটো বিষয় আছে। একটা হলো চরম উদাসীনতা আরেকটি হলো দুর্নীতি। এই দুটোই এখন আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই সম্ভবত এ বিষয়ে উদাসীন। আর অনেকেই ওষুধ কোম্পানির সুবিধা নিয়ে জেনরিক-নাম না লিখে ব্র্যান্ড-নাম লিখছে। স্বাস্থ্য প্রশাসনও এসব বিষয় দূর করার ব্যাপারে উদাসীন। ফলে সব মিলিয়েই এই সমস্যাগুলো দূর হচ্ছে না।
দেশ রূপান্তর : সাধারণ মানুষের মানসম্মত চিকিৎসাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসা ব্যয় লাঘব করতে হলে দেশব্যাপী গ্রামাঞ্চলসহ উপজেলা-জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ছে না বললেই চলে। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো সারা দেশে যতটুকুই স্বাস্থ্য-অবকাঠামো আছে সেটা সামগ্রিকভাবে একে-অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্কিত না। একজন রোগী গ্রাম বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা-জেলা হয়ে যে বিভাগীয় বড় হাসপাতাল বা রাজধানীতে আসছেন এমন নয়। এসব কারণে নাগরিকদের ‘হেলথ ডেটা’ বা স্বাস্থ্য তথ্যের কোনো একক ভান্ডার গড়ে উঠছে না। কিন্তু একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার তো উচ্চতর গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণী কাজের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এই বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার খুবই প্রয়োজনীয়। আর আপনি স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর যে কথা বলছেন সেটাকে আমরা বলি ‘রেফারাল সিস্টেম’। একজন রোগী কীভাবে পর্যায়ক্রমে সাধারণ চিকিৎসকের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাবেন এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে চিকিৎসা নেবেন সেই কাঠামো বা চর্চা এখানে গড়েই ওঠেনি। একইভাবে একটা ‘এমআইএস’-ও গড়ে ওঠেনি। আমি যতদূর জানি এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেটা সম্ভবত এখনো কার্যকরভাবে এগোয়নি। আসলে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ না নিলে এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে এমন আয়োজন সফল হওয়ার সুযোগ দেখি না। তবে আমি মনে করি, দুর্নীতিমুক্ত হয়ে উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলে আমাদের দেশেও এগুলো সবই সম্ভব।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. নজরুল ইসলাম : আপনাকে এবং দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকে বলা হয় ‘লাশের সাক্ষ্য’। সেই প্রতিবেদনে প্রায়ই ভুল থাকছে। হত্যা হয়ে যাচ্ছে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা। দেশের মর্গগুলোর আধুনিকায়ন না হওয়া, চিকিৎসকদের অদক্ষতা এবং মর্গে আসার আগেই মরদেহের আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ভুলের অন্যতম কারণ। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য এরকমই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বেশিরভাগ মর্গে মরদেহের ভিসেরা বা বিভিন্ন নমুনা সংরক্ষণের আধুনিক সুবিধাসংবলিত জায়গা নেই। এসব ধারণের জন্য কনটেইনার, প্রিজারভেটিভ বা রাসায়নিকের সরবরাহও প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনেক সময় প্রিজারভেটিভ না থাকলে লবণ পানির সাহায্যে মর্গে লাশ সংরক্ষণ করা হয় এবং হিস্টোপ্যাথলজিক্যাল ল্যাবে যেসব স্যাম্পল বা নমুনা পাঠানো হয়, সেসব ভালোমানের ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষিত করে পাঠানো হয় না। ফলে আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও ভুলের আশঙ্কা বাড়ে। কখনো চিকিৎসক প্রভাবিত হয়েও ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেন।
ময়নাতদন্তসংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলেন, আমাদের দেশে আধুনিক মর্গ ব্যবস্থাপনা নেই। তাছাড়া লাশ মর্গে আসার আগেই অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে প্রথমে থানায় নেয়; তারপর থানা থেকে নেয় মেডিকেল কলেজে। এরপর অ্যাম্বুলেন্স, লেগুনা বা ট্রাকে বা ভ্যানে করে আনে মর্গে। এত আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। এসব কারণে ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আসে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ময়নাতদন্তের ভুল প্রতিবেদনের প্রধান কারণ আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আধুনিক মর্গের অভাব। দ্বিতীয় কারণ, লাশ যখন আমাদের কাছে আসে তখন আমরা সিন অব দ্য ক্রাইম (অপরাধের দৃশ্য) ভিজিট করি না। ফলে অনেক ইনফরমেশন ধরা পড়ে না। উন্নতবিশ্বে কোথাও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে পুলিশ ওই স্থানকে হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে রাখে এবং সবার আগে ভিজিট করে একজন ফরেনসিক স্পেশালিস্ট। ওখান থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগৃহীত হয়ে মর্গে চলে আসে। মর্গে লাশ পাঠায় পুলিশ, পরে পোস্টমর্টেম করে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে মরদেহের ফাইন্ডিংস মিলিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। সেটাই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এমন হয় না।’
ময়নাতদন্ত কী : খুন বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর ভুক্তভোগীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানার জন্য একজন ফরেনসিক চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞ মরদেহের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অঙ্গ বা অঙ্গবিশেষের গভীর নিরীক্ষণ করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করে মন্তব্যসহ যে প্রতিবেদন দেওয়া হয় তাই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি মনে করেন, ময়নাতদন্ত হওয়া জরুরি, তখন মৃতদেহ সিভিল সার্জন বা মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়।
সম্প্রতি ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা ও রেল দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কথা উল্লেখ থাকা ২২টি মামলা তদন্ত করে পিবিআই জানায়, এগুলো ছিল পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। ওই মামলাগুলোতে পুলিশের অন্যান্য সংস্থা তদন্ত করে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল।
পিবিআইপ্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হত্যা বা অপমৃত্যুর মামলার তদন্তে ময়নাতদন্তের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ময়নাতদন্ত মামলার রহস্য উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যদিকে ময়নাতদন্ত সঠিক না হলে তদন্ত ভিন্ন পথে মোড় নেয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সাহায্য করে, ঘটনার রহস্য উদঘাটনে দারুণভাবে সহায়তা করে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিটফোর্ড বা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ২০২১ সালে ৭৪০টি, ২০২২ সালে ৬০০টি ও চলতি বছর ১৫ মে পর্যন্ত ১৪৫টি মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়েছে। গত ১৫ মে দুপুরে সেখানকার মর্গে গিয়ে দেখা গেছে জরাজীর্ণ দশা। দুটি মরদেহ পড়ে আছে পোস্টমর্টেমের অপেক্ষায়। মর্গ সহকারী নাম প্রকাশ না করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মর্গের লাশ রাখার একমাত্র ফ্রিজটি তিন বছর ধরে নষ্ট। ময়নাতদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় মালামালের সংকট সবসময়ই থাকে। নেই আধুনিক কোনো সুবিধা। তিনজন মর্গ সহকারীই বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিতে কাজ করছেন।’
জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য মর্গের দশা একই।
ময়নাতদন্ত সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে পিবিআইয়ের এক প্রতিবেদনে দেশের মর্গসংশ্লিষ্টদের ফরেনসিক বিষয়ে আধুনিক ও বিশ্বমানের প্রশিক্ষণের অভাব, বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক চিকিৎসকের তুলনায় লাশের সংখ্যা বেশি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও হিমাগারসহ মানসম্মত অবকাঠামো না থাকাকে ভুল ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডোমের স্বল্পতা, জটিল ও চাঞ্চল্যকর মরদেহের ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে বোর্ড গঠন করে ময়নাতদন্ত না করা, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা থাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ময়নাতদন্ত কাজে অংশ নিতে চান না বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ময়নাতদন্ত বিষয়ে পিবিআইয়ের প্রতিবেদন ও দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মর্গগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও আলোর ব্যবস্থাসহ আধুনিক অবকাঠামো ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। অনেক জেলায় মর্গে বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে জেনারেটর নেই। অনেক জেলায় মর্গে পর্যাপ্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নেই। বংশ পরম্পরায় মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট বা ডোমরা ময়নাতদন্তের সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও তাদের কোনো মৌলিক প্রশিক্ষণ নেই। তাছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ ব্যস্ত মর্গগুলোতে মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্টদের স্বল্পতা প্রকট। অনেক জায়গায় দেখা গেছে, লাশ সংরক্ষণের সুরক্ষিত পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব। বিদেশি নাগরিক ও বিশেষ ক্ষেত্রে মরদেহ প্রচলিত নিয়মে হিমঘরে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে। অল্পসংখ্যক মর্গে কুলিং বা ফ্রিজিং বা মর্চুয়ারি কুলার সিস্টেম থাকলেও অধিকাংশ সময় নষ্ট থাকে বলে গরমের সময় লাশে দ্রুত পচন ধরে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর সম্ভাব্য সময়ের উল্লেখ থাকা জরুরি। মর্গে আধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় অভিমত প্রদানে বিশেষজ্ঞদের সমস্যা হয়। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ১ জুন রাজধানীর কলাবাগান থানা এলাকায় নিজ বাসা থেকে ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি খুন হয়েছিলেন। মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) মর্গে। খুনের ধরন মোটামুটি স্পষ্ট হলেও ঘটনার রহস্য উন্মোচনে খুনের ‘সম্ভাব্য সময়’ জানার জন্য পিবিআই ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকদের সুযোগ-সুবিধা কম হওয়ায় চিকিৎসা শিক্ষায় এ শাখাটি অবহেলিত এবং কম গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ ফরেনসিক ডাক্তারের স্বল্পতা রয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, সিএমএম আদালতের নির্দেশে ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের লালমোহন থানা এলাকা থেকে কামাল মাঝির (৪৫) ৩৮ মাসের পুরনো মরদেহ তুলে ভোলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়। সেখানে কর্মরতদের কারও এ ধরনের মরদেহের ময়নাতদন্তের অভিজ্ঞতা না থাকায় মরদেহটি ভোলা থেকে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নেওয়া হয়। দায়িত্বরত প্রভাষক জানান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকের পদে কেউ কর্মরত নেই। তিনি মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য অন্য কোনো মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে নেওয়ার অনুরোধ করেন। পিবিআই মরদেহটি বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সংশ্লিষ্ট বিভাগে নিয়ে যায়।
হত্যা কেন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনা হিসেবে আসে জানতে চাইলে ফরেনসিক চিকিৎসকরা জানান, কাউকে হত্যা করে রেললাইনে ফেলে রাখলে তার ওপর দিয়ে ট্রেন গিয়ে একেবারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে হাড়গোড় বেরিয়ে দলিত হয়ে যায়। একে চিকিৎসাশাস্ত্রে মিউটিলেডেট লাশ বলে। ওইসব লাশের আলামত বোঝা যায় না। আগের আলামত নষ্ট হয়ে নতুন আলামত তৈরি হয়। তখন রেল দুর্ঘটনাই মনে হয়। এতে অনেক সময় চিকিৎসকরা মিসগাইডেড হয়।
ফরেনসিক বিভাগে চিকিৎসকের সংকট বিষয়ে এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমি ঢাকায়ে আছি, অথচ আমাকে কক্সবাজার বা পঞ্চগড় গিয়ে স্বাক্ষর দিতে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার, বিশেষ করে একা, বিপদ আছে অনেক, সংক্ষুব্ধ পক্ষ হামলা চালাতে পারে। এজন্য অনেক চিকিৎসক এ বিভাগে থাকতে চান না। এখানে সুবিধাও অনেক কম। মফস্বলে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে মিসগাইড করে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে রিপোর্ট লেখানো হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রথম সেট ২৫ মিনিট, দ্বিতীয়টি ২৮ মিনিটে জিতলেন কার্লোস আলকারাজ। মনে হচ্ছিল কোয়ালিফায়ার ফ্যাভিও কোবোলিকে বুঝি উড়িয়েই দিচ্ছেন শীর্ষ বাছাই।
না, তৃতীয় সেটতে প্রতিরোধ গড়লেন ইতালিয়ান। সময় গড়ালো ঘন্টায়। শেষপর্যন্ত জয় এসেছে ৬৬ মিনিটে। ৬-০, ৬-২, ৭-৫ গেমে প্রথম রাউন্ডের ম্যাচ জিতে রাফায়েল নাদালের উত্তরসুরি ক্লে কোর্টের সর্বোচ্চ আসর শুরু করলেন।
নাদালের চোটজনিত অনুপস্থিতিতে শীর্ষবাছাই আলকারাজ। ২০২১ এ তৃতীয় রাউন্ড, গতবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। এবার আরো এগোলে সেমিফাইনালে নোভাক জকোভিচের সংগে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা।
সে দেখা যাবে। আপাতত দ্বিতীয় রাউন্ডে আলকারাজকে টপকাতে হবে জাপানের টি. দানিয়লেকে।
দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের মধ্যকার ফেডারেশন কাপ ফুটবলের ফাইনাল দেখতে কুমিল্লায় উড়ে গেছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে আজ বেলা ৩টা ১৫ মিনিটে শুরু হয়েছে ম্যাচটি। সালাউদ্দিন ম্যাচ শুরুর ঘণ্টা খানেক আগে কুমিল্লায় পৌঁছান।
ঢাকা থেকে সড়ক পথে কুমিল্লায় পাড়ি দিতে মাত্র দুই ঘণ্টা সময় লাগে। তবে সালাউদ্দিন দূরত্বটা পাড়ি দিয়েছেন হেলিকপ্টারে করে। যা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
টাকার অভাবে কদিন আগে নারী ফুটবলারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে পাঠায়নি বাফুফে। অথচ ঢাকা থেকে কুমিল্লায় যেতে বাফুফে সভাপতি বেছে নিলেন হেলিকপ্টার।
হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে কুমিল্লার এই যাত্রায় বাফুফে সভাপতির সঙ্গী হয়েছেন সংস্থার নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ।
ফ্যাটি লিভার রোগটি এখন ঘরে ঘরে। প্রাথমিকভাবে এই রোগের লক্ষণ না বুঝতে পারলে, অনেক সমস্যাই দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকরা জানান, এই রোগ থেকে বাঁচতে জীবনধারায় বদল আনতে হবে।
কোন কোন উপসর্গ দেখলে সতর্ক হবেন? শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, হঠাৎ ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়া, হলুদ রঙের দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব, ওজন অত্যন্ত বেড়ে যাওয়া, সারাক্ষণ ক্লান্তিভাব— এই উপসর্গগুলি ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ হতে পারে। অনেকের ধারণা, মদ্যপান করলেই এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে। তবে কেবল মদ্যপান ছেড়ে দিলেই এই রোগের ঝুঁকি কমবে না। কম তেলমশলার খাবার খাওয়া, বাড়ির খাবারে অভ্যস্ত হওয়া, মদ ছেড়ে দেওয়া— এই অভ্যাসগুলিই লিভারকে ভাল রাখার অন্যতম উপায়। এই অসুখকে ঠেকিয়ে রাখতে ডায়েটের ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে এগুলিই শেষ কথা নয়। লিভার ভাল রাখতে মেনে চলতে হয় আরও কিছু নিয়মকানুন। কিন্তু কী কী?
চিনির মাত্রা কমানো
সহজে রোগা হতে চেয়ে অনেকেই নিজের খুশি মতো ডায়েট প্ল্যান বানিয়ে নেন। চিনি বাদ দিয়ে দেদারে কৃত্রিম চিনির উপরেই ভরসা করেন। এতেই আসলে চরম ক্ষতি করছেন শরীরের। অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার অভ্যাস আমাদের লিভারের ব্যাপক ক্ষতি করে। ফ্রুকটোজ হোক কিংবা কৃত্রিম চিনি, লিভারের অসুখ ডেকে আনে।
ব্যথার ওষুধ কম খান
বেশকিছু বেদনানাশক ওষুধ লিভারের ক্ষতি করে। কিছু প্যারাসিটামল বা কোলেস্টেরলের ওষুধও লিভারের প্রভূত ক্ষতি করে। ঘুম না হলে অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঘুমের ওষুধ খেতে শুরু করেন। এই অভ্যাসের কারণে লিভারের জটিল রোগে ভুগতে হতে পারে।
পানি বেশি করে খান
শরীর থেকে যতটা দূষিত পদার্থ বার করে দিতে পারবেন, লিভার ততটাই সুস্থ থাকবে। তাই বেশি করে পানি খেতে হবে। তবেই প্রস্রাবের সঙ্গে শরীরের টক্সিন পদার্থগুলি বেরিয়ে যাবে। দিনে কয়েক বার গরম পানিতে পাতিলেবুর রস দিয়ে সেই পানি খান। ডায়েটে রাখুন টক দইয়ের মতো প্রোবায়োটিক।
পর্যাপ্ত ঘুম
সারাদিন কর্মব্যস্ততা আর রাত জেগে মোবাইলে চোখ রেখে সিনেমা দেখা— সব মিলিয়ে ঘুমের সঙ্গে আপস। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দীর্ঘদিন ঘুমের অভাব হলে তার প্রভাব পড়ে লিভারের উপরেও।
ওজন কমান
শুধু সুন্দর দেখানোর জন্যই নয়, লিভার সুরক্ষিত রাখতে চাইলেও কিন্তু ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমাদের শরীরে কার্বহাইড্রেট-প্রোটিন-ফ্যাটের সঠিক ভারসাম্য থাকা ভীষণ জরুরি। তবে ইদানিং বাড়ির খাবার নয়, বরং রেস্তোরাঁর খাবার, রেড মিট, বাইরের ভাজাভুজি, প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খেয়ে অভ্যস্ত। আর এর জেরেই শরীরে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা বাড়ছে। লিভারের পক্ষে এই ফ্যাট মোটেই ভাল নয়।
আইপিএলের পঞ্চম শিরোপা জিততে চেন্নাই সুপার কিংসের চাই ১৫ ওভারে ১৭১ রান। আহমেদাবাদে রাত ১২.৪০ মিনিটে শুরু হবে খেলা। গুজরাট টাইট্যান্সের ২১৪ রানের জবাবে খেলতে নেমে ৩ বলে ৪ রান করার পর বৃ্স্টিতে বন্ধ হয় ফাইনাল। অর্থাৎ বাকি ১৪.৩ ওভারে আরো ১৬৭ রান চাই ধোনীর দলের।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতিতে জোর করে হারানো হয়েছে।
গতকাল রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে জানতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভিন্ন কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরের যেকোনো আসন থেকে মনোনয়ন পাবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে গাজীপুর সিটির ভোটে যে সংসদ সদস্য দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার তথ্য মিলবে তাকেই বাদ দেওয়া হবে। এ সিটি ভোটে হারের কারণ জানতে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব একটি সংস্থাকে নির্ভুল তথ্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে মন্ত্রীর দায়িত্বও পেতে পারেন আজমত, ওই সূত্র দাবি করে। সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
নানা অব্যবস্থাপনায় এগোচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা। প্রায় শতভাগ শিশু ভর্তির আওতায় এসেছে অনেক আগে। এরপর মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের কাজ অনেকটাই আটকে আছে। খোদ সরকারি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে প্রাথমিকে চরম দুরবস্থার কথা। গবেষয়ণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কাক্সিক্ষত মানের চেয়ে শিশুরা অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু কাজ করার চেষ্টা করলেও কথায় কথায় তাদের ওপর নেমে আসছে শাস্তির খড়গ। মানের উন্নয়ন না হলেও ঠিকই অধিদপ্তরে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় সম্প্রতি এই গবেষণা করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেখানে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা গড়ে ইংরেজি বিষয়ে যতটা শিখত, করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে তা সাড়ে ১২ শতাংশ কমে গেছে। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের হার কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। আর তৃতীয় শ্রেণির বাংলায় কমেছে ১৫ শতাংশের মতো।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার আগে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিল প্রায় ৪৯ শতাংশ। করোনাকালে বন্ধের প্রভাবে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশ। একই শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ^পরিচয় বিষয়ে শিখন অর্জনের গড় হার ৫১ শতাংশের বেশি, যা আগে ছিল ৬৮ শতাংশের মতো। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানেও ক্ষতি বেড়েছে।
এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এ ধরনের গবেষণার দরকার ছিল। আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রেখেই তা করা হয়েছে। আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদন দু-এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা অন্তত এক বছরের জন্য রেমিডিয়াল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছি। মন্ত্রণালয় সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা দিন দিন পিছিয়ে পড়লেও সেদিকে তেমন একটা নজর নেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের। তারা ব্যস্ত আছে লাখ লাখ শিক্ষক এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি-পদায়ন নিয়ে। কেউ কথা বললেই তার ওপর নেমে আসছে শাস্তি। ফলে শিক্ষকরাও দিন দিন তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন; কোনো রকমে দিন পার করছেন।
জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় উদ্ভাবনী ও অনন্য অবদানের জন্য ২০১৯ সালে সারা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন রাজবাড়ী জেলার স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুল ইসলাম। একই বছর রাজধানীর মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক খায়রুন নাহার লিপি শ্রেষ্ঠ সহকারী শিক্ষিক নির্বাচিত হন। সাধারণত আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এসব শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি সেরা শিক্ষার্থীদের পদক দেওয়া হয় একই অনুষ্ঠানে। কিন্তু করোনাকালে তাদের হাতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষক পদক তুলে দেওয়া যায়নি। গত ১২ মার্চ রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। তাই অনুষ্ঠানের কয়েক দিন আগে স্বাভাবিকভাবে তারা দাবি তুলেছিলেন, দেরি হলেও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে তারা পদক নেবেন; যা তাদের সারা জীবনের স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা প্রতিমন্ত্রীর হাত থেকে ঠিকই পদক নেন। তবে এর ৬৮ দিনের মাথায় এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবি তোলায় চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। একই ঘটনায় জয়পুরহাটের হিন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুবুর রহমানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তার বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এ পদক নিতে ১১ মার্চ ঢাকা এসেছিল। ওই শিক্ষকও প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পদক নেওয়ার দাবিকে সমর্থন করেছিলেন। সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও তাদের কাউকে শোকজ করা হয়নি; যা বিধিবহির্ভূত বলছেন শিক্ষকরা।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আবদুল আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাময়িক বরখাস্তের পরবর্তী যে প্রক্রিয়া আছে, সেদিকেই আমরা যাব।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি হননি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াতের সঙ্গে এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য গতকাল একাধিকবার চেষ্টা করলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদের সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক নেওয়া একজন শিক্ষকের জীবনে সেরা প্রাপ্তি। এ জন্য শিক্ষকদের দাবি থাকতেই পারে, প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। শিক্ষকদের যেভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, তা মোটেও ঠিক হয়নি বলে আমার মনে হয়। এর প্রভাব অন্যান্য শিক্ষকের মধ্যেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শুধু তা-ই নয়, করোনাকালে বন্ধ থাকা প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখতে কিছু শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা স্বউদ্যোগে কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেন; যাতে অনলাইন ক্লাস, শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনাসহ নানা কাজ করা হয়। এতে প্রতিটি ফেসবুক গ্রুপে লাখ থেকে হাজারো শিক্ষক যুক্ত হয়েছেন। এখনো সেসব গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু সেই গ্রুপগুলোকেই এখন শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারের অজুহাত দেখিয়ে অনলাইনে যুক্ত থাকা অনেক শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাকেই দেওয়া হচ্ছে কারণ দর্শানো নোটিস (শোকজ)। সরকার যেখানে শিক্ষকদের ডিজিটালি আপডেট হওয়ার কথা বলছে, সেখানে প্রায় অনেকটাই উল্টো পথে হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
শিক্ষকরা জানান, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে দীর্ঘদিন ধরে আসন গেড়ে বসেছেন কিছু কর্মকর্তা। অনেকেই ৬ থেকে ১২ বছর ধরে একই দপ্তরে চাকরি করছেন। তাদের যে দায়িত্বই থাক না কেন যত লাভজনক কাজ আছে, সেগুলোতেই তারা হাত দিচ্ছেন। যোগ্য কর্মকর্তাকে অধিদপ্তরে আনলে তাদের সরে যেতে হবে, এ জন্য তারা নানাভাবে ঊর্ধ্বতনদের ভুল বুঝিয়ে মাঠপর্যায়ে শাস্তি দিয়ে সবাইকে ভীত করে তুলছেন। এতে পিছিয়ে পড়ছে প্রাথমিক শিক্ষার মান।
প্রায় দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত মার্চ-এপ্রিলে অনলাইনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। যদিও নিয়ম ছিল, অনলাইনে নির্দিষ্ট মানদন্ড পূরণ ছাড়া কেউ বদলি হতে পারবেন না। কিন্তু তা মানেনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে নিয়ম ভেঙে কয়েক শো শিক্ষকের বদলির আদেশ জারি করা হয়। আর এই বদলি-পদায়নে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন হয়েছে বলে দাবি শিক্ষকদের; যা ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে। আবার অনেক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বদলিতেও সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। কাউকে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েও অনেক দূরে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন।
জানা যায়, চলতি বছর থেকে প্রথম শ্রেণিতে চালু হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। আর আগামী বছর থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ২০২৫ সাল থেকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। কিন্তু তা পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেই অধিদপ্তরের। শিক্ষকদের নামমাত্র প্রশিক্ষণেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। আসলে এই শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীরা কতটুকু আত্মস্থ করতে পারছে বা এ জন্য আর কী করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে তেমন নজর নেই।
এ ছাড়া এখনো প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা বেতন পান ১১তম গ্রেডে ও সহকারী শিক্ষকরা পান ১৩তম গ্রেডে। দুই ধরনের প্রায় চার লাখ শিক্ষকই ১০ম গ্রেডে বেতনের দাবি করে আসছেন। এ ছাড়া সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার ও সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারাও দীর্ঘদিন ধরে নবম গ্রেডের দাবি করছেন। আর মাঠে কাজ করা এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদোন্নতিও নেই বললেই চলে। কিন্তু এগুলো সমাধানেও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের; যা প্রাথমিকের মান উন্নীতের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রবীণ শিক্ষক নেতা মো. সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনো মফস্বলে বা দুর্গম অঞ্চলের অনেক স্কুলেই এক-দুজন শিক্ষক। অনেক স্কুলে শিক্ষকের পদ তিন-চার বছর ধরে শূন্য। শিক্ষক না থাকলে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপরও পড়ে। এ ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সাধারণত দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা আসে। তাদের একটু আলাদা যতœ নেওয়া প্রয়োজন। সেগুলোও হচ্ছে না। শিক্ষকরাও তাদের বেতন-ভাতায় সন্তুষ্ট নন। সব মিলিয়ে আমরা প্রাথমিক শিক্ষায় কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছি না।’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে।
গণভবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজমত উল্লা খানকে ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। ওই আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আকবর হোসেন পাঠান (নায়ক ফারুক) গত ১৫ মে থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় ওই শূন্য আসনে আজমতকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
গাজীপুরের দ্বিধা-বিভক্ত রাজনীতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দুই দফায় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খানকে ভোটে পরাজিত করে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগী, দক্ষ, মেধাবী ও ভাবমূর্তি সম্পন্ন আজমত উল্লাকে বরং আরও ওপরে রাখতে চেষ্টা করছেন। দলীয় সভাপতি টের পেয়েছেন মেয়র প্রার্থী আজমত হারেননি, তাকে গাজীপুরের দলীয় রাজনীতি জোর করে হারানো হয়েছে।
গত রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাকে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে ডেকে পাঠান। আজমতের সঙ্গে গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন চক্রান্তের ব্যাপারগুলো শেখ হাসিনা জানেন এবং জানান। গণভবনে পরাজিত প্রার্থী আজমতকে বোঝান পরাজয়ের কারণ আমরাই। বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রার্থী দেয়নি গাজীপুরের সিটি ভোটে। তারা নৌকা হারাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে জাহাঙ্গীর আলম। এর সঙ্গে দলেরও কেউ কেউ রসদ জুগিয়েছে। এতে রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে এমন নয়।
সূত্রটি আরও জানায়, প্রধানমন্ত্রী যার ওপর ক্ষুব্ধ হন তার যেমন শাস্তি দেন তেমনি যার ওপর সন্তুষ্ট ও যিনি ধৈর্য ধারণ করেন তাকে একই সঙ্গে সব দেন। গত ১৫ বছরে বহুজন এর উদাহরণ। গাজীপুরে মেয়র পদে আজমতকে হারা বা হারানোয়, প্রধানমন্ত্রী ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা জাহাঙ্গীরের ভোটকে ঘিরে যে নাটকীয় আচরণ করেছেন সে সম্পর্কে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। গাজীপুরের আওয়ামী লীগের রাজনীতি আজমতকে নিয়ে যে খেলাধুলায় মেতেছে সে আজমতকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ভাবছেন আরও ওপরে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য নায়ক ফারুক গাজীপুরের কালিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আজমতও টঙ্গী কালিগঞ্জের। তা ছাড়া ঢাকা লাগোয়া এই জেলার বাসিন্দা আজমত। গাজীপুরের অনেক মানুষ ওই আসনে বসবাসও করেন। এসব মিলিয়ে আজমত প্রায়োরিটি পেতে যাচ্ছেন ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনে।
আজমতের বিভিন্ন ঘনিষ্ঠজনেরা এসব তথ্য দিলেও আজমত উল্লা খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এসব ব্যাপারে তার কোনো কিছুই জানা নেই। চিন্তাও করেন না তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে বিজয়ী হয়েছেন জায়েদা খাতুন।
তিনি ঘড়ি প্রতীকে মোট ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তার নিকটতম আওয়ামী লীগ মনোনিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।
বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় এ সিটির ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রির্টানিং কর্মকর্তা স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুনকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করেন।
নির্বাচনের অন্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২ ভোট, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ ৭ হাজার ২০৬ ভোট, মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪ ভোট, স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন-অর-রশীদ ২ হাজার ৪২৬ ভোট এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট পেয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নির্মিত হয়েছে বিশেষ কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ‘ও ভোরের পাখি’। ঈমাম হোসাইনের প্রযোজনায় এটি উপস্থাপনা করেছেন তামান্ন তিথি। অনুষ্ঠানটিতে আবৃত্তি করেছেন আশরাফুল আলম, মীর বরকত, রফিকুল ইসলাম, পলি পারভিন, শাকিলা মতিন মৃদুলা, মাসকুর-এ সাত্তার কল্লোল, আসলাম শিশির, সংগীতা চৌধুরী, আহসান উল্লাহ তমাল। প্রচারিত হয় ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টায়।
এছাড়াও নির্মিত হয়েছে বিশেষ অনুষ্ঠান ‘আমারে দেবো না ভুলিতে’। অনুষ্ঠানটিতে গান, কবিতা ও আলোচনার সমন্বয়ে কবিকে সামগ্রিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও বাচিকশিল্পীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ইয়াসমিন মুসতারী, সালাউদ্দিন আহমেদ, শেলু বড়ুয়া, ছন্দা চক্রবর্ত্তী ও ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেছেন প্রফেসর মুন্সী আবু সাইফ। মনিরুল হাসানের প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছে ২৫ মে দুপুর ১ টা ০৫ মিনিটে। আরও প্রচারিত হবে সংগীতানুষ্ঠান ‘দোলনচাঁপা’ ও ‘সন্ধ্যামালতী’। রাত ৯টায় প্রচারিত হবে নাটক ‘বনের পাপিয়া’ (পুনপ্রচার)।