
জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা। সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০৬ জন, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এ পরিস্থিতিতে করণীয়সহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ বছর অক্টোবরের শেষ ভাগে এসেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমার লক্ষণ নেই। বরং কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কারণ কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : প্রধান কারণ হচ্ছে বৃষ্টিপাত, জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বব্যাপী এরকম হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আসছে। ঘূর্ণিঝড় যদি নাও আঘাত হানে নিম্নচাপের প্রভাবে কিন্তু কমপক্ষে সাতদিন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির পানি জমে থাকা খানাখন্দ মশার প্রজননে খুবই উপযোগী। দ্বিতীয় হচ্ছে মশক নিয়ন্ত্রণ করায় এবং ডেঙ্গু রোগীদের ব্যবস্থাপনায় যে সর্বাত্মক উদ্যোগ, সেটা আমরা নিতে পারছি না। এখানে একজন রোগীর চিকিৎসা করবার জন্য নিয়মকানুন আছে, মানে হাসপাতালে রোগী এলো আর আপনি চিকিৎসা করলেন, কিন্তু যখন কমিউনিটিতে রোগ ছড়িয়ে পড়ে তখন স্থানীয়ভাবে মহামারীর সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য একটা স্থানিক মহামারী। এ পরিস্থিতিতে রোগীর চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা ভিন্নভাবে করতে হয়। জনস্বাস্থ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কী হতে পারে?
ডা. মুশতাক হোসেন : কমিউনিটি বা জনগোষ্ঠীভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সিঙ্গেল রোগীর চিকিৎসার যে প্রটোকল সেটা দিয়ে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ হবে না। সিটি করপোরেশন কিছু কিছু এলাকায় করছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট না। তাদের জনবল নেই, সম্পদ নেই। যে এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী আসছে হাসপাতাল থেকে সেখানকার ঠিকানা নিয়ে তারা সে এলাকায় কীটনাশক ছিটানো, মানুষকে বলা এসব করছে। এটা ঠিক আছে, তবে তা খুবই সীমিত আকারে হচ্ছে। সরকার যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, তাহলে হবে না। এখন তো ঢাকার বাইরে অনেক জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমে ৫০টির বেশি জেলার কথা বলা হয়েছে। এটা উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়েছে। এখন টানা দুই/তিন বছর যদি কমিউনিটি মবিলাইজেশন করে একটা হচ্ছে মশক নিয়ন্ত্রণ, আরেকটা হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের সার্ভিলেন্স, মানে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করার কাজ করতে পারি তাহলেই এই যে প্রায় বছরই ডেঙ্গুর স্থানিক মহামারী হচ্ছে তা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
দেশ রূপান্তর : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যারা সফল হয়েছে, তারা কীভাবে পেরেছে?
ডা. মুশতাক হোসেন : ডেঙ্গু রোগী কীভাবে শনাক্ত হয়, কীভাবে চিকিৎসা করা হয়, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সবকিছু কিন্তু জানা। কভিডের মতো অজানা রোগ না। যারা এটি নির্মূলে সফল হয়েছে যেমন কলকাতা, নিকারাগুয়া, কিউবা তারা কমিউনিটিভিত্তিক মবিলাইজেশন করে সফল হয়েছে। আমাদেরও এটা নির্মূলের সক্ষমতা আছে। আমাদের গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিরা আছেন। ইউপি লেভেলে চেয়ারম্যান, কাউন্সিলররা আছেন। অনেক বেসরকারি সংস্থাও আছে। গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত আছে। শহরাঞ্চলে এমন এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। এটা অবিলম্বে করা দরকার। কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে এলাকার জনগণ সেখানে সম্পৃক্ত হয়। কারণ, তারা চোখের সামনে দেখে যে এই এই কাজগুলো করে মাত্র ৪/৫ জন লোক, তো আমরাও হাত লাগাই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবী তারাও এগিয়ে আসেন। সাধারণভাবে ডেঙ্গুকে কেন্দ্র করে আমরা যদি এটা করি তাহলে অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণেও এটা ভূমিকা রাখবে।
প্রয়োজন হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া। আমদের যে সম্পদ আছে সেটা যদি সমাবিষ্ট করা যায়, মবিলাইজড করা যায়, জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলেই সম্ভব।
দেশ রূপান্তর : চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০৬ জন, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট খুলেছে। রোগীর অনুপাতে এটা কি পর্যাপ্ত বলে মনে করেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত। অন্যান্য হাসপাতালেও স্বল্প সময়ে সেটা করা যাবে। কিন্তু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ফাঁকা করে ডেঙ্গু রোগীদের ইউনিট করলে বা তাদের ভর্তি করলে অন্য রোগী মানে সেসব ওয়ার্ডে যারা ছিল, তাদের চিকিৎসা ব্যাহত হবে। কিন্তু কমিউনিটি ভিত্তিক যদি আমি রোগী শনাক্ত করি, তাদের যদি আমি আগে থেকেই বলি যে কী করতে হবে তাহলে তো হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হবে না। তারা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই স্বাস্থ্য পরামর্শ পেয়ে যাবে।
দেশ রূপান্তর : এবার রোগী বাড়ার কারণ কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : কারণ হচ্ছে ডেঙ্গুর ভাইরাস নম্বর ৪ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এটার সংক্রমণ বেশি হয়েছে। যারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে তাদের অবস্থাই গুরুতর হচ্ছে। অনেকে তো জানেই না যে সে আগে আক্রান্ত হয়েছিল। হয়তো প্রথমবার তার জ¦রই হয়নি। মৃদু লক্ষণ ছিল, পরে ভালো হয়ে গেছে। এখন যদি সে ডেঙ্গু নম্বর ৪ দিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়, তাহলে তো তার অবস্থা গুরুতর হয়ে যাবে। এজন্যই আমরা যদি কমিউনিটি ভিত্তিক রোগী খুঁজতে থাকি তাহলে যারা আজ গুরুতর রোগী হয়ে হাসপাতালে আসছেন তাদের অনেকেই হাসপাতালে আসার আগেই চিকিৎসা পেয়ে যাবেন। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে কমিউনিটি লেভেলে যদি মনিটরিংয়ে আনা যায় গুরুতর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে যাবে বলে মনে করি।
দেশ রূপান্তর : আমরা এডিস মশার জন্ম ঠেকাতে পারলাম না, সিটি করপোরেশন মশা মারতে যে ওষুধ ছিটায়, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ব্যর্থতা কতটুকু? প্রযুক্তিগত কোনো সীমাবদ্ধতা কি আছে?
ডা. মুশতাক হোসেন : আমরা সফলভাবে অভিযান চালাতে পারিনি। কীটতত্ত্ববিদ আমাদের দেশে আছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও পরামর্শক এসেছিল। তারা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছে। একটা উদাহরণ দিই তারা বলেছিল, আপনি উড়ন্ত মশাকে মারতে ধোঁয়ার মাধ্যমে কীটনাশক দেন, এখন ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট বাড়ির সংখ্যা কত? ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ জায়গায় কি ধোঁয়াটা পৌঁছে? তো ঘরের মধ্যে ধোঁয়া পৌঁছাতে জনবল থাকতে হবে, ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের সম্পৃক্ত করে ঘরে যেতে হবে। তারপর আপনি একটা এলাকায় কীটনাশক দিলেন, সেখান থেকে মশা চলে গেল। কিন্তু তিনদিন পর তো পাশের এলাকা থেকে আবার মশা চলে আসবে। ফলে, একযোগে আপনাকে পুরো শহরে এটা করতে হবে। তো হিসাব করেন একযোগে এটা করতে কত জনবল লাগবে, কত কীটনাশক লাগবে, সম্পদ লাগবে। একমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতেই এটা করা সম্ভব। সরকার এটা জরুরিভিত্তিতে করতে পারে।
কীটনাশকের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, পরিস্থিতি এখন উন্নত হয়েছে। এখন এদিকে সবার নজর আছে, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি এগুলো পরীক্ষা করে, তারপর অনুমতি পায়। তবে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার জনবল এবং সম্পদের ঘাটতি আছে বলে মনে করি।
আমাদের প্রযুক্তির কোনো ঘাটতি নেই। আমরা জানি মশা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা কীভাবে করতে হয়। ঘাটতি হলো কমিউনিটি মবিলাইজেশনের। কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়ে আপনি কাজ সমাধা করবেন। আপনি পত্রিকায়, টিভিতে প্রচার চালাবেন, বক্তৃতা করলেন এটাতে হবে না। আপনাকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামতে হবে।
দেশ রূপান্তর : হাবীবুল্লাহ বাহার যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি এই ঢাকা শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, যা প্রবাদ হয়ে আছে। সে সময় পারলে এখন পারছি না কেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : হাবীবুল্লাহ বাহারের সময় যেটা হয়েছে সেটা একেবারে কমিউনিটিকে সন্বিবিষ্ট করে হয়েছে। পাড়ার লোকজন নেমেছে, ছাত্র-যুবকরা নেমেছে। যেটা বললেন, পাকিস্তান আমলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এভাবেই হয়েছিল। কয়েক বছর আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নেতৃত্বে খুব সীমিত আকারে হলেও কমিউনিটি মবিলাইজেশনের কাজটা দেখিয়েছেন। সেটা ছিল উদাহরণ, পাইলট হিসেবে। হাবীবুল্লাহ বাহারের সময় সেটাই করা হয়েছে, তারা কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়েছে। সঙ্গে কর্মকর্তারা, এক্সপার্টরা ছিলেন। এক্ষেত্রে উদ্যোগটা সরকার থেকে নিতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারেন, সেখানে ডেঙ্গু এখনো আমাদের শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ, আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কেন করতে পারব না!
দেশ রূপান্তর : সরকারের বিভিন্ন ভবনে, প্রকল্পে কাজ চলার সময়ও পানি ও ময়লা আবর্জনা জমে থাকে; যা থেকে এডিসের বংশবিস্তার ঘটে। আবার আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসাধীন ২৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগী মশারি ব্যবহার করছেন না। করণীয় কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : এখানেও সরকারি অফিসে যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের মবিলাইজড করার বিষয়। হাসপাতালের ছাদে গিয়ে দেখেন, সেখানে বৃষ্টির পানি জমে কি না। সরকারি বহুতল অফিসের কথা বাদই দিলাম, থানার পাশে যেসব সিজ করা গাড়ি পড়ে থাকে, সেসব গাড়ির মধ্যে পানি জমে থাকে। তো কমিউনিটি মবিলাইজেশনের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তো পড়বেন। তার বিল্ডিংয়ের ছাদে, কার্নিশে, এসির নিচে পানি জমছে কি না, মশার বিস্তার হচ্ছে কি না সেসব দেখতে হবে। এটা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব না, তার দায়িত্ব হতে পারে। সব জায়গায় নজরদারি চালাতে হবে। পাড়ায় কোনো সরকারি অফিস থাকলে সেখানে পানি জমে আছে কি না সেটা স্থানীয়রাও খোঁজ নিতে পারেন। ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
আর মশারি তো সবার ব্যবহার করতে হবে। সুস্থ মানুষকেও দিতে হবে, ডেঙ্গু রোগীকেও দিতে হবে। এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে কার মশারি নেই, কাকে দিতে হবে তা বোঝা সহজ হবে। এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মশারি বিতরণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : জনগণের সচেতনতার ঘাটতি আছে বলে মনে করেন কি?
ডা. মুশতাক হোসেন : সচেতনতা শব্দটি নিয়ে আপত্তি আছে। মবিলাইজড করা। জনগণকে সমাবিষ্ট করে জনগণকে কাজ দেওয়া, তাকে সম্পৃক্ত করে আগাতে হবে। সচেতনতা একটা বায়বীয় শব্দ। জনগণ যথেষ্ট সচেতন, তাদের কাছে টিভি আছে, পত্রিকা পড়ে, তারা জানে। আপনার তাদের সঙ্গে নিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করতে হবে, কেবল টিভিতে বললে হবে না। তাকে গিয়ে বলতে হবে যে চলেন আমরা কাজে হাত লাগাই বা চলেন আপনার বাড়ির ছাদটা দেখে আসি।
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা এবং দেশকে সংক্রামক রোগমুক্ত করার কাজে নেতৃত্বদান করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে আর এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রবীণ এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : গত ১০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে ব্যক্তির ব্যয়। এখন দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে। এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-ষষ্ঠ রাউন্ড’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। চিকিৎসাব্যয়ের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ের এটা একটা ওভারঅল অবজার্ভেশন। চিকিৎসা ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে যায় আর এক-তৃতীয়াংশের মতো সরকার বহন করে। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা সারা দেশের মানুষের বা জনগণের সব অংশের সম্মিলিত বা গড়পড়তা একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টা অনেকটা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মতো। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এবং জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এই আয় দেশের অতিধনী ও ধনীদের কতটা বাড়ছে আর সাধারণ ও গরিব মানুষদের কতটা বাড়ছে বা আদৌ বাড়ছে কি না সেটা মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় না। তেমনি জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয় বা মানুষের চিকিৎসাব্যয়ের এই পরিসংখ্যান থেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বা গরিব মানুষদের বাস্তবতা বোঝার উপায় নেই। তাই বলা যায়, চিকিৎসা ব্যয়ের এই জাতীয় হিসাবে গরিবদের বাস্তবতা যথাযথভাবে উঠে আসেনি।
দেশ রূপান্তর : এরকম তথ্য কিন্তু পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে মোট খরচের ৫৪ শতাংশই খরচ করেন দেশের শীর্ষ ধনীরা। বাকিটা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রসহ জনসংখ্যার অন্যান্য সব অংশ মিলে। আবার সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য না হলে হাসপাতালে বা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না বলেও উঠে আসছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : আসলে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এমন পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু যেটা বলছিলাম যে, এমন হিসাবে দেশের সব মানুষের ডিটেইল পিকচারটা পাওয়া যাচ্ছে না। ধরুন খুবই প্রান্তিক একটা মানুষ, গ্রামেরও সাধারণ মানুষ তিনি কিন্তু চিকিৎসাব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ কেন এক-তৃতীয়াংশ বহন করার মতো অবস্থাতেও নেই। কারণ খাদ্য কেনার মতো যথেষ্ট টাকাই তার হাতে নেই। তো তিনি কীভাবে চিকিৎসার খরচ মেটাবেন? ধরুন তার ক্যানসার হয়েছে, তিনি তো ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা বা জেলা পর্যায়েও এই চিকিৎসা পাবেন না। আবার ঢাকায় এসে চিকিৎসা করানো মতো আর্থিক ক্ষমতা তো দূরের কথা আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়াই তার কাছে নেই। তাহলে প্রশ্নটা হলো, দেশের কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসায় কতটা ব্যয় করল শুধু সেটা হিসাব করলে হবে না; কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত সেই হিসাবটাও জরুরি। কিন্তু এ ধরনের পরিসংখ্যানে সেসব তথ্য উঠে আসছে না।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে এই গবেষণায়। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির খরচের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ওষুধে, যা মোট চিকিৎসাব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর মেডিকেল ও ডায়াগনস্টিকে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, চিকিৎসক দেখাতে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ইত্যাদি। ওষুধে এত বেশি ব্যয়ের কারণ কী বলে মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এ বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার। কিন্তু এসব কথা বললে অনেকে মাইন্ড করবেন। আমি নিজেও একজন চিকিৎসক। কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক চিকিৎসকই রোগীকে প্রেসক্রিপশনে এমন অনেক ওষুধ লিখে দিচ্ছেন যার হয়তো দরকার নেই। আবার অনেক সময় ওষুধ লেখা না লেখার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কথা ভাবেন।
দেশ রূপান্তর : আপনি যা বলছেন সে বিষয়ে কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার সচিবও অভিযোগ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার প্রশ্ন তুলেছেন যে, দেশে ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং সংক্রান্ত বিধি মানা হচ্ছে কি না। তিনি বলেছেন, অনেক চিকিৎসক শুনি ওমরাহ পালনে যান ওষুধ কোম্পানির টাকায়। অনেকে নাকি ফ্রিজ নেন টেলিভিশন নেন। কেউ আছে ফ্ল্যাট পর্যন্ত কিনে দেয়। আপনার কী মনে হয়?
ডা. নজরুল ইসলাম : স্বাস্থ্য সচিব এক্ষেত্রে সত্য কথাটাই বলেছেন। সত্য কথা বললে সব দিক নিয়েই বলা দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে সত্য কথা বলতে গেলে এত কথা উঠে আসবে, এত সব সমস্য ও সংকট এখানে আছে যেসব নিয়ে আসলে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা প্রয়োজন। ওই যে, কথায় বলে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা’, স্বাস্থ্য খাতের অবস্থাটাও তেমন।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের সিংহভাগ ওষুধের পেছনে ব্যয় হওয়া থেকে কি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওষুধ নির্ভরতার বিষয়টি সামনে আসছে? বিশ্লেষকরা বলে থাকেন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত ‘প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ার’ নয় ‘কিউরেটিভ হেলথ কেয়ার’-এর ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকে। আপনি কী মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা ঠিকই বলা হয়। এখন কথা হলো প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ারে আপনি কীভাবে যাবেন? সেজন্য পুরো ব্যবস্থাটা পাল্টাতে হবে। আর যেসব ব্যবস্থা আছে, অবকাঠামো ও জনবল আছে সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। যেমন ধরুন আমাদের যে ইপিআই বা এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন আছে সেটা খুবই দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু সেটাও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘হেপাটাইটিস-বি’ পুরোপুরি নির্মূল করবে। অর্থাৎ আমাদের হাতে আছে আর মাত্র ৭ বছর। এখন একজন প্রসূতি-মা যদি ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত থাকে তাহলে ভূমিষ্ঠ সন্তানটিরও ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভ্যাকসিন এবং ইমিউনোগ্লোবিন দেওয়া হলে শিশুটি আর তাতে আক্রান্ত হবে না। এই বিষয়টা আমরা জানি, এমন ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা প্রতিটি হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত প্রসূতির সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি কি? এখন এমন ভ্যাকসিনেশন না হওয়ার কারণে যে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে তারা তো আর ২০৩০ সালের মধ্যেই মারা যাবে না। তাহলে এই সময়ের মধ্যে কীভাবে আমরা হেপাটাইটিস-বি নির্মূল করব। আমি বলতে চাচ্ছি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান সুযোগও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। একই কথা প্রযোজ্য সার্ভিক্যাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে। এখন এর কার্যকর ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা কি ‘এট এন-মাস’ বা সারা দেশের সব নারীদের এই ভ্যাকসিন দিচ্ছি? দিচ্ছি না। তাহলে তো সার্ভিক্যাল ক্যানসারও থেকেই যাবে।
দেশ রূপান্তর : আবার একটু ওষুধ ও প্রেসক্রিপশনের আলোচনায় ফিরে যাই। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে। প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ব্র্যান্ড-নাম না লিখে শুধু ওষুধের জেনরিক-নাম লিখে দেওয়ার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এছাড়া, চিকিৎসকরা দুর্বোধ্য হাতের লেখায় ওষুধের নামসহ প্রেসক্রিপশন দেন এতেও সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছে। আবার অনেকেই বলছেন প্রেসক্রিপশন কেন বাংলায় লেখা হচ্ছে না? অথচ এই বিষয়ের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আপনি বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা নিয়েও তো আদালত একটা নির্দেশনাও দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ওষুধের নাম ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লিখতে। যাতে সবাই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই তো পাল্টায়নি। আমার মনে হয় এখানে দুটো বিষয় আছে। একটা হলো চরম উদাসীনতা আরেকটি হলো দুর্নীতি। এই দুটোই এখন আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই সম্ভবত এ বিষয়ে উদাসীন। আর অনেকেই ওষুধ কোম্পানির সুবিধা নিয়ে জেনরিক-নাম না লিখে ব্র্যান্ড-নাম লিখছে। স্বাস্থ্য প্রশাসনও এসব বিষয় দূর করার ব্যাপারে উদাসীন। ফলে সব মিলিয়েই এই সমস্যাগুলো দূর হচ্ছে না।
দেশ রূপান্তর : সাধারণ মানুষের মানসম্মত চিকিৎসাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসা ব্যয় লাঘব করতে হলে দেশব্যাপী গ্রামাঞ্চলসহ উপজেলা-জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ছে না বললেই চলে। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো সারা দেশে যতটুকুই স্বাস্থ্য-অবকাঠামো আছে সেটা সামগ্রিকভাবে একে-অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্কিত না। একজন রোগী গ্রাম বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা-জেলা হয়ে যে বিভাগীয় বড় হাসপাতাল বা রাজধানীতে আসছেন এমন নয়। এসব কারণে নাগরিকদের ‘হেলথ ডেটা’ বা স্বাস্থ্য তথ্যের কোনো একক ভান্ডার গড়ে উঠছে না। কিন্তু একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার তো উচ্চতর গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণী কাজের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এই বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার খুবই প্রয়োজনীয়। আর আপনি স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর যে কথা বলছেন সেটাকে আমরা বলি ‘রেফারাল সিস্টেম’। একজন রোগী কীভাবে পর্যায়ক্রমে সাধারণ চিকিৎসকের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাবেন এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে চিকিৎসা নেবেন সেই কাঠামো বা চর্চা এখানে গড়েই ওঠেনি। একইভাবে একটা ‘এমআইএস’-ও গড়ে ওঠেনি। আমি যতদূর জানি এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেটা সম্ভবত এখনো কার্যকরভাবে এগোয়নি। আসলে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ না নিলে এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে এমন আয়োজন সফল হওয়ার সুযোগ দেখি না। তবে আমি মনে করি, দুর্নীতিমুক্ত হয়ে উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলে আমাদের দেশেও এগুলো সবই সম্ভব।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. নজরুল ইসলাম : আপনাকে এবং দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
আন্দালিব রাশদী কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। পড়াশোনা ঢাকা, ওয়েলস ও লন্ডনে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন, যা বাংলাদেশে বিরল। উপন্যাস, ছোটগল্পের পাশাপাশি তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কলাম ও প্রবন্ধ লেখেন। বিদায়ী ও নতুন বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বিদায়ী বছরকে কী দিয়ে মূল্যায়ন করবেন মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক লুট নাকি পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল দিয়ে?
আন্দালিব রাশদী : যে কটা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার সবগুলোই বাস্তবতা। সময় সংকট ও সাফল্যের মূলে রয়েছে আর্থিক ক্ষমতা এবং ব্যবস্থাপনা। সঙ্গে যোগ হয় বৈশ্বক পরিস্থিতি। বৈশ্বিক মহামারী কিংবা যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারের যে অস্থিতিশীলতা সেখানে বাংলাদেশের হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। কিন্তু রাষ্ট্র যা ঠেকাতে পারে তা হচ্ছে তহবিল লুণ্ঠন ও পাচার। ক্ষমতার সমর্থন ছাড়া সংগঠিত দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব নয়। ব্যাংক মালিকরা এক সময় রাষ্ট্র গঠনে উদার হাতে অর্থব্যয় করতেন, এখন রাষ্ট্রের অর্থ দুহাতে তুলে নিয়ে ব্যাংক মালিক হওয়া যায়, ব্যাংকের সমুদয় অর্থ লোপাট করে জনগণের সঞ্চয় ফিরিয়ে দেওয়ার দায় সরকারের ঘাড়ে ফেলে হাওয়া খেয়ে বেড়ানো যায়।
কেবল ২০২২ নয়, অনেক বছর ধরেই চলছে প্রতিষ্ঠানের ‘ইন্টেগ্রিটি’ ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়া। যদি প্রশ্ন করি বলুন বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানটির ইন্টেগ্রিটি নিয়ে আপনি গৌরবান্বিত বিশ্ববিদ্যালয়, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ন্যায়বিচার, প্রশাসন, পূর্ত ও নির্মাণ, ব্যাংক, শুল্ক, সংবাদ মাধ্যম আপনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বেন। জোর গলায় কেন, মিনমিন করেও গৌরব প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত হবেন। প্রশংসিত থাকবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী, প্রবাসী ওয়েজ আর্নার প্রমুখ।
অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই প্রশংসনীয় এটাই অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। একই সঙ্গে উন্নয়নের জন্য প্রদেয় মূল্যও পরীক্ষণীয়।
দেশ রূপান্তর : আগামী বছর বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর। একে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন কি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন?
আন্দালিব রাশদী : আমি রাজনীতিবিদ নই, রাজনীতি বিশ্লেষকও নই; গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকার এসব বিভ্রান্তিকর বুলি আমরা যাদের কাছে শিখেছি, মূলত ব্রিটেনের কাছে, আমরা মোটেও তাদের মতো মানুষ নই, তাদের চেয়ে হীনমানের। ২০২২ সালেই তো সেখানে তিন প্রধানমন্ত্রীর শাসন চলেছে, একজন লিজ ট্রাস দেড় মাস অতিক্রম করতে পারেননি। ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা কি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা করেন না? অবশ্যই করেন। রাজনৈতিক কৌশলে তা করেন। আমরা, ক্ষমতায় যারাই অধিষ্ঠিত হই না কেন ক্ষমতা ধরে রাখতে ছল-বল-কৌশলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে থাকি। কোনো কোনো দেশের জন্য ভোটার গুরুত্বপূর্ণ নন, গুরুত্বপূর্ণ যিনি ভোট গণনা করেন। ১৯৭০-এর যে নির্বাচন কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার রায় দিয়েছিল সে নির্বাচনে চিফ ইলেকশন কমিশনার ছিলেন একজন বাঙালি বিচারপতি। সেই বিচারপতি আবদুস সাত্তার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। যে দল যখন বিরোধী পক্ষ হয় তাদের পছন্দ থাকে ভারতের সেই বিখ্যাত টি এন সেমানের মতো ব্যক্তি যেন চিফ ইলেকশন কমিশনার হন। যেন নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের চিরকালীন চাওয়া একজন দলনফর প্রধান নির্বাচক। পরস্পরবিরোধী চাওয়া উত্তেজনা ও টানাপড়েন সৃষ্টি করতে বাধ্য। বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস হাস্যকর গণতন্ত্র সৃষ্টি করেছে। কর্মজীবনে ব্যক্তিগতভাবে একটি নির্বাচন কন্ট্রোলরুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজন রিটার্নিং অফিসারকে আমি অনুরোধ করেছিলাম, প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা একটু কমিয়ে বলুন, প্রায় শতভাগ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আমার আশপাশে কোনো স্ট্যাটিসশিয়ান নেই, যা করার আপনারাই করে নিন। আশির দশকের এক জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী বন্ধ-দরজা বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছিলেন : এই জেলায় অপজিশনকে একটা সিট দিতেই হবে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন তা দুই অতিক্রম না করে। পেশাগত কারণে আমিও বন্ধ দরজা বৈঠকে হাজির ছিলাম। পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টে গেছে। দলমত নির্বিশেষে ‘আমি জিতলেই’ গণতন্ত্রের জয় জয়কার অন্যথায় সব প্রহসন। জর্জ বার্নাড শ প্রায় সোয়া শত বছর আগে বলেছিলেন : নির্বাচন হচ্ছে নৈতিক সন্ত্রাস, যুদ্ধের মতোই তবে রক্তপাতহীন। এর সঙ্গে যুক্ত সবার আত্মাই কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে।’ ২০২৪-এর নির্বাচনী অস্থিরতা ও দ্বন্দ্ব ইন্টার পার্টি এবং ইন্ট্রা পার্টি অতি ভয়ংকর হয়ে উঠলে কথিত গণতন্ত্র চর্চা থেমে যাবে।
দেশ রূপান্তর : বর্তমানে সারা বিশ্বেই আমরা একটা কর্র্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর উত্থান দেখতে পাচ্ছি, এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দালিব রাশদী : কর্তৃত্ববাদ এখন অজেয় বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। গণতন্ত্রের প্রবক্তারা ভাবেননি যে ‘ইললিবারেল ডেমোক্রেসি’ পৃথিবীতে জাঁকিয়ে বসবে। গ্লোবাল ফ্রিডম প্রতিবেদনটি দেখুন। বিভিন্ন সূচক বলে পৃথিবীর ষাটটি দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থান নেমে গেছে। পৃথিবীর কুড়ি শতক মানুষ মোটামুটিভাবে লিবারেল গণতন্ত্রের ছায়াতলে বসবাস করছে। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের দোহাইয়ের আড়ালে গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। একদা জনমুখী বাম হিসেবে সমাদৃত নেতৃবৃন্দের অনেকেই গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় জুনিয়র পার্টনার হয়ে গেছেন। ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক কর্তৃত্ববাদী হলেও পৃথিবীকে ভারসাম্যপূর্ণ দ্বি-মেরু করে রাখতে সক্ষম ছিল। ভাঙনের পর এক মেরুর কথিত গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জেই গণতন্ত্রের লিবারেলিজমকে দেহচ্যুত করতে বিভিন্নমুখী অস্ত্রোপচার চালিয়েছে। গণতন্ত্রায়নের নামে স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসমূহের চর্চাই বেশি হয়েছে। সামরিক অভ্যুথান ঘটাতে সামরিক বাহিনী যতটা না এগিয়ে এসেছে তার চেয়ে কথিত গণতান্ত্রিক শক্তিই তাদের আসার পথ সুগম করে স্বাগত জানিয়েছে। ‘দ্য রাস্ট উইদিন ডেমোক্রেসি’- গণতন্ত্রের ভেতরের পচন চেনার জন্য মার্কিন সাধারণ নির্বাচন-উত্তর ক্যাপিটল হিল অবরোধ, তছনছ ও লুণ্ঠনের দৃশ্যই যথেষ্ট। সাড়ে চারশ বছর আগে অসন্তুষ্ট জনতা নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ইউনান ডি উইট ও তার ক্ষমতাধর ভাইকে শুধু হত্যাই করেনি, তাদের মৃতদেহ নিয়ে গণউল্লাস হয়েছে এবং তাদের বুক ফেঁড়ে ক্ষিপ্ত মানুষ কলজেতে কামড় বসিয়েছে, তাদের চোখ তুলে স্যুভেনির হিসেবে নিয়ে গেছে। ক’বছর পর সেই জনতাই বলেছে, ইউনান ডি উইট-ইতো ভালো ছিলেন। ২০২২-এর অন্যতম দৃষ্টি উন্মোচক শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকারের পতন, পলায়ন, রাজভবনের গণদখল। আমরা অবহিত আছি মাহিন্দা রাজাপাকসে ফিরে এসেছেন, নিরাপদ জীবনযাপন করছেন; আসছে নির্বাচনে গণতন্ত্রের হাত ধরেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন মনে করা হচ্ছে। যে মার্কোসকে ফিলিপাইন গণঅভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশ থেকে তাড়িয়েছিল তার পুত্র বংবং মার্কোস এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট, বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।
দেশ রূপান্তর : বছর শেষের দিকে বিশ্বের নানা দেশে ফের করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর যেমন পেয়েছি, তেমনি সারা বছর আলোচনায় ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সবাই বলছে ২০২৩ সাল অমঙ্গল বার্তা বয়ে আনতে যাচ্ছে। আপনার মতামত কী?
আন্দালিব রাশদী : নস্ত্রাদামুস কিংবা জিন ডিক্সনের পথে না হেঁটেও এক সপ্তাহের খবরের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করলে মোটামুটি সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় : যদিও ১৩ বিলিয়ন শট ড্যাক্সিন এর মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে তারপরও কভিড-১৯ ভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট যে বছরভর অবস্থান করবে তা দ্বিধা ঝেড়ে বলে দেওয়া যায়।
আর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ? যুদ্ধ করিয়েছে গ্লোবাল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। করোনাকালে অনেক অস্ত্র গুদামে জমে গেছে, গুদাম খালি করতে হবে। কভিডের মতোই অস্ত্রের নতুন ভ্যারিয়েন্ট বাজারে ছাড়ার আগে গুদামজাত করতে হবে। আসলে ইউক্রেন-ক্রেমলিন-পেন্টাগন-ন্যাটো-জাতিসংঘ সবই মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ক্রীড়নক। বাংলাদেশি মানি লন্ডারদের কেউ এই কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার হোল্ডার এ কথা কোনোদিন প্রকাশিত হলে আমি অন্তত বিস্মিত হব না। ২০২৩ যতটা না আশার তার চেয়ে বেশি আশঙ্কার।
দেশ রূপান্তর : কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প, সংবাদমাধ্যম একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। আপনার কি মনে হয়, এর প্রভাব আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ওপর কতটুকু পড়বে?
আন্দালিব রাশদী : চলুন একটু উল্টো করে ভাবি- যে দামে আমরা কাগজ কিনব বলে প্রত্যাশা করেছিলাম, বাজারে গিয়ে দেখলাম কাগজ প্রত্যাশিত দামের সিকিভাগ দামে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশক-মুদ্রক সেই টাকায় চারগুণ বেশি পরিমাণ কাগজ কিনে নিয়ে চলে এলেন। এবার এই বাড়তি কাগজ কিংবা সস্তা কাগজ কি আমাদের শিল্পসাহিত্য চেষ্টার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে? কাগজ যদি বিনে পয়সায়ও সরবরাহ করা হয় তাতেও শিল্পসাহিত্য চর্চায় তেমন হেরফের হবে না। মহার্ঘ কাগজ কিংবা পানির দামের কাগজের প্রভাব পড়বে শিল্পসাহিত্য বহির্ভূত অন্যান্য কাগুজে কারবারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সাইবারফোবিক মানুষ, অবশ্যই ব্যাকডেটেড, আমার কোনো ফেইসবুক অ্যাকাউন্টও নেই, কিন্তু আমি মোটেও ফেইসবুক-বিরোধী নই, ব্লগ-বিরোধী নই, সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার বিরোধী নই, কিন্তু আমি তাতে নেই কারণ আমি ফোবিক আমার ধারণা আমি ম্যানেজ করতে পারব না। আমার জীবন ধারণের প্রধান সহায় ছাপা বই এবং ছাপা লেখালেখি। কাগজের দুর্মূল্য এবং আনুমনিক আমদানি দ্রব্যেও মূল্যবৃদ্ধিতে আমার বই ছাপা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে প্রকাশক অবশ্যই মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আমি কি লেখালেখি ছেড়ে দেব? আমি অনলাইন প্রকাশনার দিকে মনোযোগী হব, সাইবারফোরিয়া উতরানোর সবক নেব।
কাগজের দাম বাড়ার আগেই ই-পেপারের কাছে ছাপা পেপার, ই-বুকের কাছে ছাপা বই মার খেয়ে আসছে। বিখ্যাত একটি পত্রিকাসহ যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ হয়েছে ৭০টি দৈনিক এবং ২ হাজারের বেশি সাপ্তাহিক।
দেশ রূপান্তর : এ বছর বেশ রেহানা মরিয়ম নূর, হাওয়া’র মতো কিছু আলোচিত-প্রশংসিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে আশা করছেন, নাকি কয়েকটি ভালো সিনেমা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েই থাকবে?
আন্দালিব রাশদী : ডিসেম্বরের শেষার্ধে এসে জানলাম মুহাম্মদ কাইয়ুম পরিচালিত বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের হাওর-বাঁওড়ের জলকাদার গল্প নিয়ে তৈরি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের মর্যাদা পেয়েছে। অথচ দিনের পর দিন তাকে প্রযোজকের অনুসন্ধান করতে হয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। নিজের জীবনের সমুদয় কামাই লগ্নি করে সিনেমা বানিয়েছেন, নিজের শিল্পসাধ মিটিয়ে মেধা ও শ্রম ঢেলে দিয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ার মতো উঁচু স্থানে একে স্থাপন করতে পেরেছেন। কলকাতাই হোক কি কান-ই হোক কেউ তাকে উত্তম না বলা পর্যন্ত অধমই রয়ে থাকে। রেহানা মরিয়ম নূর কিংবা হাওয়া’র মতো ছবি হতে থাকবে না এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা এ প্রশ্নের জবাবটা কঠিন নয়। সিনেমা হোক কি গান হোক কি সাহিত্য সংস্কৃতির ভালোটার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। সুতরাং প্রতিকূলতা ঠেলে যদি ব্যক্তি মেধা ও সামর্থ্য দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ বের করে আনতে পারেন।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভ নববর্ষ।
আন্দালিব রাশদী : ধন্যবাদ। আপনাকে ও দেশ রূপান্তরের পাঠকদেরও শুভ নববর্ষ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত গবেষক, ঐতিহাসিক, অনুবাদক, সমাজবিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক ও চিন্তাবিদ। তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি দেশের রাজনীতির উন্নতির জন্য চিন্তা ও কাজ করেন, লেখেন এবং মত প্রকাশ করেন। সম্প্রতি ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী।
দেশ রূপান্তর : অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের সংবিধানসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার দরকার বলে অনেকেই বলে আসছেন। যারা ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আছেন তারাও নানা সময়ে এসব বলে এসেছেন। দেখা গেছে মেনিফেস্টোতে যে কথা থাকে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটা ভুলে যান। এরশাদ পতনের আন্দোলনে ‘তিন জোটের রূপরেখা’র কথা সবাই ভুলে গিয়েছে। বিএনপি ‘রূপকল্প ২০৩০’ দিয়েছিল। অন্যদিকে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘রূপকল্প ২০২১’ নামে যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তা সময়ের একটি রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজন নানাভাবে ব্যক্ত হচ্ছে। যেসব দল ক্ষমতায় ছিল এবং আছে, তাদের থেকেও সংবিধানের সংস্কারের কথা বলা হয়। গত অর্ধশতাব্দীতে সংবিধানের সতেরোটি সংশোধন হয়েছে। রাজনীতির উন্নতি হচ্ছে না। জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ অল্পই করা হয়। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলো আন্দোলন করেছে নিতান্তই ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। শেষে অবস্থার চাপে তিন জোটের রূপরেখা প্রণীত হয়। এই রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য কোনো দলেরই কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী দল, শক্তিশালী। বিএনপি সে তুলনায় শক্তিশালী নয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে আন্দোলনকারী সব দলই রাজনৈতিক কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য ঘোষণা না করে কেবল সরকার উৎখাতের ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ব্যাপারটিকে বলা হয়েছে বিরাজনীতিকরণ বা নিঃরাজনীতিকরণ। রাজনৈতিক দলগুলোর এই রাজনীতি-শূন্যতার মধ্যে বিএনপি ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেভাবে বক্তব্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সংশোধন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে সারা দেশে এটি প্রচার করলে বাংলাদেশের গোটা রাজনীতির গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হবে। নেতৃত্বের প্রশ্ন আছে। বিএনপিতে ২৭ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন চালানোর মতো নেতৃত্ব নেই।
দেশ রূপান্তর : এই রূপরেখা তারা ক্ষমতায় এলে বাস্তবায়ন করবে বা করতে পারবে বলে কি মনে করেন? অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের ওপর কি সে আস্থা রাখা যায়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের এবং ২৭ দফা বাস্তবায়নের মতো নেতৃত্ব বিএনপিতে নেই। উত্তরাধিকারভিত্তিক ও পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব দিয়ে সুফল হবে না। সুবিধাবাদী ভোগবাদী নেতৃত্ব বাঞ্ছনীয় নয়। জনগণ রাজনীতিবিমুখ, ঘুমন্ত। গণজাগরণ দরকার। গণজাগরণ কী? গণজাগরণের উপায় কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন যত ভালোভাবেই সম্পন্ন হোক, তা দ্বারা রাজনীতির উন্নতিশীলতা সূচিত হবে না। কেবল নির্বাচন নিয়ে এত আশা কেন?
দেশ রূপান্তর : বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফা দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে বিএনপি সেখান থেকে সরে এসেছিল। এবারের ২৭ দফা রূপরেখা দেওয়ার মধ্যে কি তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের বার্তা দেখতে পান।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেখা যাক, কোন দল কী করে। প্রত্যেক দলেরই রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়। উত্থান-পতন আছে। রাজনৈতিক দলগুলো ভালোর দিকে অগ্রসর হোক এটাই কাম্য। শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ঘুমিয়ে থাকলে সুফল হবে না। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : বিএনপি একদিকে বলছে আওয়ামী লীগ সরকার কর্র্তৃক গৃহীত সব অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী সংশোধন বা রহিত করবে। অন্যদিকে বলছে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করবে। এর আগে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কেউই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, সামনে কী হবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : হিংসা-প্রতিহিংসা চলছে। খুন-খারাপি চলছে। এ থেকে মুক্তি দরকার। বিবেক ও যুক্তির প্রাধান্য চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবেক ও যুক্তি প্রাধান্য পেলে ক্রমে সব কিছু ভালোর দিকে চলবে। রাজনৈতিক দলকে গুরুত্ব দিতে হবে। দল গঠন নিয়ে চিন্তা ও কাজ করা দরকার। দল উন্নত চরিত্রের না হলে সরকার ভালো হবে কী করে? চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনীতির চরিত্র উন্নত হবে না।
দেশ রূপান্তর : প্রতি পাঁচ বছর পর পর ‘একটি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারই কি একমাত্র সমাধান?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ বা রাজনীতি নিরপেক্ষ, বা অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধাযক সরকার দিয়ে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, হচ্ছে না, হবে না। দেশের রাজনীতিকে, রাজনৈতিক দলগুলোকে এত নিকৃষ্ট অবস্থায় রেখে, জনমননকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে, জাতীয় রাজনীতির সমস্যার সমাধান হতে পারে না। উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনে নিরন্তন প্রয়াসপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই, উৎকৃষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি চাই, সর্বোপরি চাই উন্নতিশীল জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা চাই। এসবের কোনোটাই রাতারাতি অর্জন করা যাবে না। রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার প্রত্যেক জাতি ও জনজীবনের জন্য। রাজনীতিবিদদের ও সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ব্যাপার। ‘আটাশ দফা : আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’ নামে আমার একটি লেখা আছে। তাতে আমি বাংলাদেশে আমাদের সংকটের স্বরূপ এবং মুক্তি ও উন্নতির উপায় সম্পর্কে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছি।
দেশ রূপান্তর : মোটা দাগে আপনার প্রস্তাব আমাদের সংকট ও রাষ্ট্র নিয়ে কী বলছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমি মনে করি, ওই প্রস্তাবে যে পথ নির্দেশিত হয়েছে, কেবলমাত্র সেই পথে অগ্রসর হয়েই সমস্যার সমাধান হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সর্বজনীন কল্যাণে চিন্তা ও কাজ করতে হবে, দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মেয়াদি সরকার গঠন করে এগোতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন লাগবে। গোটা পৃথিবীর সব নেশনের বা জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন দরকার। জাতিসংঘ দিয়ে কাজ অল্পই হচ্ছে। এই জাতিসংঘকে সংস্কার করে বিশ্বব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন করতে হবে। সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে, পুনর্গঠিত নতুন রাষ্ট্রসংঘের পরিচালনায় একটিমাত্র সেনাবাহিনী রাখতে হবে। মানব প্রজাতি চাইলে, চেষ্টা করলে পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারবে। মানুষের অন্তরে আশা ও সাহস চাই। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষকেই গড়ে তুলতে হবে অভিপ্রেত নেতৃত্ব। মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনা বিকাশমান। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ঞৎঁঃয ংযধষষ ঢ়ৎবাধরষ. মিথ্যাকে পরাজিত অবস্থায় রাখতে হবে, বিলুপ্ত করা যাবে কীভাবে।
দেশ রূপান্তর : ‘পরপর দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না’। বিএনপি কি তাহলে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েই চিন্তা করছে? এটা কি রাজনীতিতে একটা পালাবদলের ইঙ্গিত?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : বাংলাদেশে চলছে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার-ভিত্তিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র। গণতন্ত্রকে পর্যবসিত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। বাংলাদেশ নির্বাচনের মাধ্যেমে সরকার গঠনের যোগ্যতাও অর্জন করেনি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিকে পর্যবসিত করেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসমুখী ও ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক-অভিমুখী। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কী করবে, কী করতে পারবে, জনসাধারণের দিক থেকে তার বিচার করে দেখা দরকার। আমার মনে হয় গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মের দ্বারা সমাধান হবে না, সংকটের সমাধানের জন্য নতুন ধারার চিন্তা ও কাজ লাগবে। আমি আটাশ দফা কর্মসূচিতে যে পথনির্দেশ করেছি একমাত্র সেই প্রশ্ন ধরে চিন্তা ও কাজ করতে হবে। আমার মতে আমাদের রাজনীতির ও সার্বিক উন্নতির পথ সেটাই। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী সেটাও বিচার করে দেখা দরকার। যারা আগে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে আত্মপরিচয় দিতেন, তারা এখন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে আত্মপরিচয় দেন। কেন এই পরিবর্তন?
দেশ রূপান্তর : ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা নিয়ে আপনার অন্য পর্যবেক্ষণগুলো কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে তাতে বিএনপি যদি তার ২৭ দফা কর্মসূচির কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে দেশব্যাপী প্রচার করে, তাহলে তার ফল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এবং জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে। সব দলের নেতাকর্মীদের এবং বুদ্ধিজীবীদের থেকেই উন্নতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্ম আশা করি। জনচরিত্রকেও উন্নত করতে হবে। জনসাধারণকে বিচারকের ভূমিকায় রাখতে হবে। চিন্তা ও কর্মের নবউত্থান চাই।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন চার দশকের বেশি সময়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বায়ান্নতে পা দিল বাংলাদেশদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত ৫১ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থান থেকে আমরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কভিড সংকটের সময়েও ৭ শতাংশের ধারেকাছে ছিল। গত দেড় দশক এই উন্নতি দ্রুত হয়েছে, তবে কভিড সংকট এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে বিশাল সংকট সৃষ্টি করেছে তার অভিঘাতে আমরা এখন বিপদে আছি।
উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য প্রকট করেছে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিত্তবানদের লোভ এবং বিদেশে টাকা পাচারের চর্চা। কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ, অথচ তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের এখন তিন বেলা আহার জোটানো কঠিন। এ অবস্থার জন্য দায়ী নীতি ও কৌশলের দুর্বলতা, মন্ত্রণালয়গুলোর এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকান্ডে অস্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব। ব্যাংকের তহবিল লুটে নেওয়ার খবর আমরা শুনি, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেখি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার যদি কঠোর হয়, আইন-আদালত কঠোর অবস্থানে যায়, তাহলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। এটি না হলে সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য মøান হয়ে যাবে।
সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, প্রধানত শিক্ষার বিস্তারের ফলে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। বড় কিছু এনজিও সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব রেখেছে। তাদের কাজে দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। সরকারের অনেক নীতি ও কর্মসূচি বিশেষ করে স্কুল-কলেজের মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। উল্টোপিঠে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি এবং সংঘাত বেড়েছে। উগ্রবাদের প্রসার ঘটেছে। সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চলতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।
রাজনীতিতে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় চিরস্থায়ী হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে যে রাজনীতিচর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বড় দুই দল পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস পোষণ করে, এটি রাজনীতিতে সুস্থতা আনতে পারে না। ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করার, এর প্রধান নায়কদের সম্পূর্ণভাবে আড়ালে ঠেলে ১৯৪৮ সাল থেকে চলা পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চব্বিশ বছরের আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে একটি পক্ষ। এই মানসিকতার অবসান না হলে রাজনীতি কখনো সংঘাতমুক্ত হবে না, একাত্তরে যারা স্বজাতি হত্যা করেছিল, তাদের শক্তিশালী করা হবে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, ১৯৭১ নিয়ে ছড়ানো নানা বিভ্রান্তিও দেশের রাজনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।
দেশ রূপান্তর : আপনাদের বেড়ে ওঠার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধরন কেমন ছিল? এখন কেমন দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি ১৯৬৮ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বুদ্ধিজীবী শব্দটি সমীহ জাগাত। কারণ বুদ্ধিজীবী তাদেরই বলা হতো যারা তাদের চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধির চর্চা দিয়ে কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতেন, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নিরন্তর চেষ্টা করে যেতেন, অনেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও নেমেছেন যেমন সাম্য, মানবাধিকার, দেশের সম্পদে গরিবের ন্যায্য অধিকার, শোষণ-বঞ্চনার অবসান। তাদের প্রায় সবাই পেশাজীবী ছিলেন, কিন্তু নিজস্ব পেশার বাইরে গিয়ে দেশের কল্যাণে তারা নিবেদিত থাকতেন। এরা অবধারিতভাবে ছিলেন এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী অনেকে কারাভোগও করতেন।
আমাদের এই সময়ে বুদ্ধিজীবী যারা আছেন, তারা প্রধানত নিজেদের পেশাতেই নিয়োজিত থাকেন, এবং পেশাজীবী হিসেবে হয়তো সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু পেশার বাইরে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তরুণ এবং পরিবর্তনকামী মানুষের পক্ষে তারা কোনো সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন না। মাত্র কয়েকজনই আছেন, যারা পুরনো ধারার বুদ্ধিজীবী, যারা ক্ষমতাকে ভয় না পেয়ে সত্য কথাটা বলে যান।
দেশ রূপান্তর : ৭০-এর দশকে প্রফেসর রাজ্জাক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন, পরবর্তী সময়ে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। সবশেষ, তরুণদের ভেতর আহমদ ছফার জনপ্রিয়তা দেখা গেছে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? নতুন কেউ আসছেন না কেন, নাকি আমরা দেখতে পারছি না নতুনদের?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এদের দুজনই এস্টাব্লিশমেন্ট যেদিকে চলত, তার বিপরীতে ছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক মানুষের নিজস্বতাকে মূল্য দিতেন, কোনো আদেশ-নির্দেশকে পরোয়া করতেন না, প্রকৃত জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে সবাইকে উৎসাহ দিতেন। ফলে প্রতিবাদী এবং পরিবর্তনকামী তরুণদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। আহমদ ছফা শুধু তার চিন্তাচেতনা নয়, জীবনযাপনেও এক প্রচলবিরোধী মানুষ হিসেবে নন্দিত হয়েছিলেন। তিনিও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সক্রিয়তাকে, পুরনোকে প্রশ্ন করতে এবং হায়ারার্কি অথবা সমাজের মোড়লদের দ্বিমুখী চরিত্র এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর হতে তরুণদের বলতেন। নতুনরা যে আসছেন না, তা নয়, কিন্তু এখন সমাজটাই তো বদলে গেছে। এখন আহমদ ছফার মতো মানুষ যদি দলনির্বিশেষে রাজনীতিকে তার অন্তঃসারশূন্যতার জন্য প্রশ্ন করতে থাকেন, তাকে অনেক তরুণের বাধার সামনে পড়তে হবে।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাসিত গুজব আর মেকি খবর এবং দৃশ্য মাধ্যমের তারল্যের যুগে এবং মুখস্থবিদ্যাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে প্রফেসর রাজ্জাক এবং আহমদ ছফার মতো মানুষকে সহজে গ্রহণ করার মতো তরুণদের সংখ্যাই তো কম।
দেশ রূপান্তর : বলা হয়ে থাকে গত ৫০ বছরে দেশের সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে, এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের দায় কতটুকু বা আদৌ তাদের কোনো দায় আছে কি না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত পঞ্চাশ বছরে সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি সংগঠিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্রবাদ বেড়েছে, সংস্কৃতিকে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে নিতে এরা তৎপর। এখন রাষ্ট্র সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের বিপদ ভাবে। এসব কারণে মুক্তচিন্তার মানুষেরা একদিকে এই সংস্কৃতিবিরোধী শক্তির আঘাত, অন্যদিকে সরকারের সমর্থনের অভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ফলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরাও যেমন সংখ্যায় নিতান্ত কম, সমাজও তাদের আর খোলা মন নিয়ে গ্রহণ করতে রাজি নয়। সংস্কৃতির অবনমনের কারণ যদি হয় সমাজের অবস্থান পরিবর্তন (উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক থেকে চূড়ান্ত রক্ষণশীল, এবং অনেক সময় সংস্কৃতিবিরোধী), দায়টা তো সবার।
দেশ রূপান্তর : একসময় বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার যে চর্চা তার একটা প্রভাব ছিল। এখন সেটা তেমন দেখা যাচ্ছে না। আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কি শেষ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। কিন্তু সমাজের অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন, জাগতিক লোভের কাছে আত্মসমর্পিত অংশটির যেরকম শক্তি বাড়ছে, তাতে আদর্শের কথাটা এখন অচল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। বুদ্ধিজীবীরা তখনই তাদের কাজের প্রভাব দেখেন যখন মানুষ নিজেদের অধিকারের (যার মধ্যে সাংস্কৃতিক অধিকার অন্যতম, যেমন ছিল ৫০-৬০ এর দশকে) জন্য সংগ্রামে নামে। সেই পরিবেশ এখন নেই। সেজন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই প্রথমে করতে হবে, কিন্তু যেখান থেকে এই সংগ্রাম শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারসেখানেই তো দুর্বলতা প্রকট।
দেশ রূপান্তর : ইন্টারনেটের প্রসারে অনলাইনে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দাবি করা হয়। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পশ্চিমা বিশ্বে, এশিয়ার অনেক দেশে, এমনকি ভারতেও ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চার একটা শক্তিশালী ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। কভিডের দুই-আড়াই বছরে আমি পশ্চিমের দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম-আলোচনায় অংশ নিয়েছি, ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও দেখেছি, যেখানে জ্ঞানের নানা অঞ্চলে আলো ফেলে কেউ লেকচার দিয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন অথবা প্রশ্নোত্তরে তাদের কথাগুলো বলেছেন। ইউটিউবে আমাদের দেশের সেরকম ভিডিও আমি খুব কমই পেয়েছি। ইউটিউবে (এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) একবার ঘুরে এলে দেখবেন কীরকম হিংসা, বিদ্বেষ, অসূয়া, নারীকে নিয়ে কটূক্তি, মানুষকে অপমান করার নিরন্তর চর্চা সেখানে হয়। ইন্টারনেটে বুদ্ধিবৃত্তির যে সত্যিকার চর্চা এখানে হয়, তা এতই সীমিত যে আঠারো কোটি মানুষের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা সত্যিই দুঃখজনক।
ইউটিউবে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যদি কোনো বক্তৃতা পান, দেখবেন, সেই বক্তৃতা শুনেছে খুব বেশি হলে ৫ হাজার মানুষ। অথচ গালিগালাজ করা, বিদ্বেষ আর উগ্রতা ছড়ানো হয় যেসব ভিডিওতে, সেগুলো শোনে লাখ লাখ মানুষ।
ইন্টারনেটকে আমরা হয়তো একদিন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের একটা মাধ্যম হিসেবে পাব, কিন্তু সেজন্য অনেক সময় লাগবে। ততদিনে হয়তো ইন্টারনেটই প্রাচীন হয়ে যাবে। নতুন কোনো প্রযুক্তি আসবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও গবেষক। সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে নিয়মিত লিখছেন তিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলে পাসের হার, জিপিএ ৫ প্রাপ্তির আধিক্যসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ‘করোনা ব্যাচ’ বলে অভিহিত করেছেন কেউ কেউ। ২০২০ সালে নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরুর মাত্র আড়াই মাসের মাথায় করোনা মহামারীর কারণে শ্রেণিকক্ষে তাদের সশরীরে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালে দশম শ্রেণি শেষ করা পর্যন্ত সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ তারা খুব কমই পেয়েছে। অনলাইন আর অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক লেখাপড়াই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। তারপরও এবার পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়ার হার বেশির কারণ কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : যদি আমরা বছর হিসেবে পাসের হারের গ্রাফ আঁকি, গ্রাফটা হবে নম্বর অব জিপিএ ৫ এর। প্রথম বছর ২০০১-এ দেখা যাবে ৭৬ জন। তারপরের বছর ৩০০-এর কিছু বেশি, এরকম ভাবে ২০০৮-এ বোধ হয় ৪১ হাজার। এভাবে ২০২২ সালে দুই লাখ ৭০ হাজার। গ্রাফটায় দেখা যাবে প্রচন্ড রেইটে জিপিএ ৫ বাড়ছিল। তো বৃদ্ধির এই হার যদি ঠিক রাখতে হয় তাহলে সংখ্যাটা এরকমই হয়। তারপরও এবারের সংখ্যাটা একটু বেশি মনে হয়। আমার ধারণা করোনাকালে যেহেতু পড়াশোনা হয়নি, সরকার মনে করেছে সবাইকে একটু খুশিটুশি করি। তো সবাইকে খুশি করা তো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য না। পড়াশোনা তো ভালো হয়নি, তাই ওটা নিয়ে মানুষ যেন খোঁটা না দেয়, তাই একটু সেফ সাইডে থাকার জন্য হয়তো বা ইচ্ছে করেই জিপিএ ৫ একটু বেশি দেওয়া হয়েছে। তবে এ কারণেই যে বেশি হয়েছে তা না। কারণ আমরা তো জানি গত কয়েক বছর ধরেই জিপিএ ৫ বেশি দেওয়ার জন্য স্কুলের শিক্ষকদের চাপ দেওয়া হয়েছে। এমনও হয়েছে বলে আমি শুনেছি যে, ভালো নম্বর না দেওয়া হলে শিক্ষককে শোকজ করা হয়। তো পরীক্ষক যিনি, যিনি মূল্যায়ন করবেন, তাকে যদি এরকম চাপে রাখা হয়, তিনি তো ভাববেন যে আমি কার জন্য সঠিক মূল্যায়ন করব, আমি বরং বেশি নম্বর দিয়ে দেব, যাই লিখুক না কেন আমি পাঁচের মধ্যে পাঁচ দিয়ে দেব, পারলে ছয় দেব! তবে করোনার কারণে কম পড়ানো হলো, তারপরও এত বেশি জিপিএ ৫ পেল, এর মধ্য দিয়ে পরীক্ষা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কাছে একটা ভুল বার্তা গেল। পড়াশোনা নিয়েও ভুল বার্তা গেল যে, ‘আরে পড়াশোনা কোনো ব্যাপার নাকি! জিপিএ ৫, গোল্ডেন এ... এগুলো কোনো ব্যাপার নাকি! এই যে ব্যাপার না, এটা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে মারাত্মক একটা খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
দেশ রূপান্তর : প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার পরেই একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। সেটি হচ্ছে কত শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে আর কত শতাংশ পরীক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। এই দুটো মানদন্ড কি আসলেই শিক্ষার কাক্সিক্ষত মানের কথা বলে?
ড. কামরুল হাসান মামুন : পাস আর জিপিএ’র সংখ্যার রেশিওটা আসলে কী? এই যে এবারের পরীক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর ১৫ শতাংশ জিপিএ ৫ পেল, তার মানে বাকি ৮৫ ভাগ যে জিপিএ ৫ পায়নি, আসলে এই ৮৫ ভাগ ফেল করেছে। কারণ এখন এমন ফল দেওয়া হচ্ছে যে, মনে হয় জিপিএ ৫ না পেলে জীবনটা ষোলো আনাই মিছে। জিপিএ ৫ না পেলে বাবা-মাও মুখ লুকান। শিক্ষার্থী, তার বাবা-মা সবাই লজ্জায় কেউ কাউকে ফলের কথা বলেন না। আমরা আসলে রেজাল্টকে তরলীকরণ করতে করতে এমন করেছি যে, ধরেন এক গ্লাস পানির মধ্যে যদি আমি লেবু, চিনি মিশিয়ে একজনের জন্য শরবত বানাই, তারপর গেস্ট বেড়ে গেলে ওই এক গ্লাস শরবতেই অনবরত কেবল পানি মিশিয়ে অতিথিদের শরবত খাওয়ানো শুরু করি... তো এটা এক পর্যায়ে আর শরবত থাকবে না। আমাদের শিক্ষা এবং পরীক্ষার ব্যাপারটাও ওই রকম হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষা সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাও নাই। পরীক্ষা মানে কী? পরীক্ষা মানে হলো এক ধরনের ফিল্টারিং প্রসেস, চালুনির মতো। অনেক মিশ্রণের থেকে সবচেয়ে ভালো কে, মধ্যম মানের কে, খুব ভালো মানের কে, বেশ ভালো কে কিংবা খারাপ কে... এগুলো যেন আমি আলাদা করতে পারি। এই বিভাজন করতে পারাটা পরীক্ষার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা, যারা ব্যতিক্রমভাবে ভালো, তাদেরও যদি আমি খারাপদের সঙ্গে মূল্যায়ন করি তাহলে সেই দেশে ব্যতিক্রমী মানুষ তৈরি হবে না। সবার গুরুত্ব একরকম না, ব্যতিক্রমী ভালো খুবই কম এক বা দুই ভাগ। গুরুত্ব কম যাদের তারা না থাকলে আবার গুরুত্ববানেরও মূল্য থাকে না। পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা এই বিভাজনটা পাই। একসময় আমরা যখন পরীক্ষা দিতাম, ২০ জন করে চার বোর্ডে ৮০ জন স্ট্যান্ড করত। তাদের ছবি পত্রিকায় আসত। তাদের বাবা-মায়ের ছবি আসত। তাদের স্কুল ও শিক্ষকদের ছবি আসত। তাদের সাফল্যের গল্প ছাপা হতো। এই ৮০ জন ছাত্রের মধ্যে একটা আত্মসম্মানবোধ তৈরি হতো। এরপরেও ছিল স্টার মার্কস, ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন। বাংলাদেশে এমন অনেক সফল মানুষ আছেন যারা এসএসসি বা এইচএসসি-তে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছেন। গবেষণা করলে দেখা যাবে, আমাদের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকরা সবাই স্ট্যান্ড করে আসা। তার মানে এই যে ভালো-মন্দের মিশ্রণ থেকে যে আমি সবচেয়ে ভালোগুলো আলাদা করতে পারলাম এটাই তো পরীক্ষার উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যটা এই জিপিএ ৫ এনে, এটাকে তরলীকরণ করা হয়েছে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতিকে নষ্ট করে আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিটাকেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর অত্যন্ত ক্ষতিকর ফল পাওয়া যাবে আগামী ১০ বছর পরে।
দেশ রূপান্তর : দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি ও গণিতের মতো বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই। শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই এ দুটি বিষয়ের দুর্বলতা নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তর পার করে। অথচ পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারে কোনো এক জাদুর পরশে দেখা যায় এ দুটো বিষয়ে পাসের হার আকাশছোঁয়া। তার মানে কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : এটার মানে হলো, স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষকরাও কোনো না কোনোভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের বেশি মার্কস পেতে হেল্প করেন। সেটা অসৎ উপায়ে হোক বা যেকোনো প্রকারেই হোক। আবার সরকারও চায় জিপিএ ৫ বেশি পাক, এতে তার সুনাম বাড়বে। মানুষ বলবে এই সরকারের আমলে ছেলেমেয়েরা বেশি করে পাস করছে, বেশি জিপিএ ৫ পাচ্ছে। এর আরও একটা কারণ আছে, আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে অনেকগুলো, তাদেরও তো ছাত্র দরকার। এখন একটা খারাপ ছাত্রও যখন জিপিএ ৫ পেয়ে যায়, যার সত্যিকার অর্থে যোগ্যতা নেই জিপিএ ৫ পাওয়ার, সে তখন তার বাবা-মাকে চাপ দিতে পারে যে, আমি তো এখন ভালো ছাত্র, আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই! কিন্তু দেখা গেল সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল না, তখন সে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। অর্থাৎ এই রেজাল্ট ভালো করার পেছনে হয়তো এর ভূমিকাও রয়েছে। মানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক তো সব ক্ষমতাবানরাই। তো এরাও হয়তো সরকারকে বেশি করে জিপিএ ৫ এর জন্য চাপ দেয়। জিপিএ ৫ বেশি হলে তাদের ছাত্রসংখ্যাও বেশি হবে।
সত্যি বলতে গেলে আমাদের স্কুল লেভেলে তো ভালো শিক্ষকই নেই। যে মানের শিক্ষক দেওয়ার কথা, শুধু গণিত কেন, বাংলার গুরুত্ব কি নেই? ভাষা তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা ছাড়া আমি তো কমিউনিকেটই করতে পারি না। আমাদের ক্লাস নাইনের এক ছাত্র ও ইউরোপের সমশ্রেণির এক ছাত্রের সঙ্গে মিলালে বোঝা যায় আমরা ভাষাতে কত দুর্বল। আমরা যেদিন থেকে অ, আ, ক, খ পড়ি আমরা তো সেদিন থেকেই এ, বি, সি, ডি’ও পড়ি। কিন্তু দেখা যায়, আমরা একটা লাইনও ইংরেজি বলতে পারি না। কারণ, আমাদের এ বি সি ডির পর আর ইংরেজির শিক্ষক নেই। যে শিক্ষক ইংরেজি পড়ান, তিনি নিজেই ইংরেজি জানেন না। যে শিক্ষক গণিত শেখান, তিনি নিজেই জানেন না গণিত। যিনি বাংলা পড়ান, তিনি জানেন না বাংলা। কারণ আমরা স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের যে বেতন দিই, সেই বেতনে ভালো মানের কোনো শিক্ষক পাওয়া যাবে না। মানসম্পন্ন কেউ ওখানে চাকরি করতে যাবেন না। আর কেউ কেউ গেলেও, এত কম আর খারাপ বেতন দেখে প্রাইভেট পড়ানোর ধান্দাবাজি করতে বাধ্য হবেন। তিনি দেখবেন কীভাবে কোচিং করানো যায়। কয়েকদিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম, সেখানে আমার এক ভাগনির কাছে শুনলাম যে, স্কুলের ক্লাসে তাদের শিক্ষক ঠিকমতো পড়ান না, যাতে তার কাছে প্রাইভেট পড়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। কাজেই, একজন ছাত্র যখন জেনে যায় শিক্ষক ইচ্ছে করে ক্লাসে ভালো করে পড়ান না, তখন শিক্ষকের ওপরই বা কীভাবে তার রেসপেক্ট থাকবে!
দেশ রূপান্তর : প্রশ্নফাঁসের পাশাপাশি আমাদের দেশে প্রশ্ন কমন পড়ানোর মতো একটি পান্ডিত্য জাহির করার চর্চা আছে... দেখা গেছে যে শিক্ষকের যত বেশি প্রশ্ন পরীক্ষায় কমন পড়ে তার তত চাহিদা। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ওই যে প্রাইভেট ও কোচিংয়ের কথা বললাম। এখন, শিক্ষা তো কারোর বাণিজ্যের মুখ্য বিষয় হতে পারে না। রাষ্ট্র শিক্ষককে এমন বেতন দেবে যে তার মধ্যে কোনো লোভ-লালসা থাকবে না। সে একটা আদর্শ, উদাহরণীয় মানুষ হবে। এখন আমরা তো সেভাবে ও সেই ধরনের শিক্ষক নিয়োগ দিই না। এই যে কয়েকদিন আগে ফুটবল বিশ^কাপে জাপানের দর্শকরা খেলা দেখা শেষে স্টেডিয়ামের গ্যালারি পরিষ্কার করে মাঠ ত্যাগ করল, খেলোয়াড়রাও তাদের রেস্টরুম ব্যবহারের পর খেলা শেষে সেটা পরিষ্কার করে বের হলোকেন? কারণ, তাদের প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুলে এমন শিক্ষক দেওয়া হয় যে তারা এইসব নিয়মকানুন, এইসব সততা সেখান থেকে সেই শিক্ষকদের কাছ থেকেই শিখে বের হয়। তারা সেখান থেকেই এভাবে ভাবতে শেখে। আমাদের দেশের মানুষ যে আজ এত অসৎ হয়ে গেছে কেন? কারণ আমাদের শিক্ষক আর শিক্ষাব্যবস্থাটাই তো অসৎ।
ঝালকাঠির রাজাপুরে ট্রাকচাপায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যসহ দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার ঝালকাঠি-পিরোজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের নৈকাঠি পালেরবাড়ি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত দুই মোটরসাইকেল আরোহী হলেন- উপজেলার সদর ইউনিয়নের পূর্ব রাজাপুর এলাকার মৃত আব্দুল করিম হাওলাদারের ছেলে মো. আলী হায়দার মহারাজ (৫৩) ও একই ইউনিয়নের আংগারিয়া গ্রামের মৃত নাজেম আলী তালুকদারের ছেলে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন শাহিন (৫৬)। নিহতরা একে অপরের মামাতো ও ফুপাতো ভাই।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, মংলা বন্দর থেকে ছেড়ে আসা একটি কাভার্ডভ্যান বরিশালের দিকে যাচ্ছিলো। এসময় রাজাপুর থেকে পিরোজপুরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল মোটরসাইকেল আরোহীরা। পথিমধ্যে নৈকাঠি পালের বাড়ি এলাকায় ট্রাকটি মোটরসাইকেল আরোহীদের চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। খবর পেয়ে রাজাপুর থানা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করে এবং লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।
এ ঘটনার পর চালক ট্রাক নিয়ে পালিয়ে গেলেও রাত ১১টার দিকে রাজাপুর সদর হাসপাতালের সামনে থেকে ট্রাকটি জব্দ করে পুলিশ।
রাজাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পুলক চন্দ্র রায় বলেন, চালক পালিয়ে গেলেও ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে। পরিবারের কোন আপত্তি না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।এ ব্যাপারে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করা হবে।
আইন অনুযায়ী তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হলেও তাদের তা করতে দেওয়া হয় না। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের একক এখতিয়ার কমিশনের থাকলেও সম্প্রতি সেটিও খর্ব হয়েছে।
সরকারের নির্বাহী আদেশ আর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের হস্তক্ষেপের কারণে লাইসেন্সসংক্রান্ত কাজের পাশাপাশি সীমিত পরিসরে বিরোধ মীমাংসা ছাড়া আর কিছুই এককভাবে করতে পারছে না জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে ভোক্তার মতোই কমিশনও অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে কমিশনের মোট জনবল সংখ্যা ৮৪। প্রতি বছর বেতনভাতা ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দিনে দিনে ক্ষমতা খর্ব হওয়ায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ কী বা এ কমিশনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী গত সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, “এখন শুধু লাইসেন্সসংক্রান্ত কিছু কাজ আর ‘আরবিট্রেশনটা’ (বিরোধ মীমাংসা) কমিশনের হাতে আছে। দরকার হলে দুদিন পর সরকার সেটাও ‘উইথড্র’ (প্রত্যাহার) করবে। যখন দেখবে আরবিট্রেশনগুলো সুবিধাভোগীদের বিপক্ষে যাচ্ছে তখন এটাও উইথড্র হবে। সরকারের নির্বাহী ক্ষমতায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির সুযোগ রেখে যে আইন হলো তা করা হয়েছে তাদের মোটাতাজা করার জন্য।” তিনি বলেন, ‘নতুন এ আইন করার ফলে আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে গেল না কাছে এলো সেই বিষয়টা অনুধাবন করা দরকার।’
খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বিইআরসির এ সদস্য বলেন, ‘আমার মেয়াদ আছে আর কয়েক দিন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আবেদন করিনি। কারণ আমার বাবা আমাকে শিখিয়েছেন যেটা তোমার পছন্দ হবে না সেই কাজ তুমি করবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছি।’
বিইআরসির কার্যাবলির প্রথমেই জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিশ্চিত এবং এনার্জি অডিটের মাধ্যমে জ্বালানি ব্যবহারের খরচের হিসাব যাচাইয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এগুলোর বাস্তবায়ন নেই বললে চলে। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করা এবং সরকারকে সুপারিশ করা কমিশনের কার্যাবলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এর বাস্তবায়ন তেমন একটা চোখে পড়ে না।
উচ্চ আদালতের আদেশে কমিশন প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের মূল্য সমন্বয় শুরু করেছে। কিন্তু বাজারে কখনই বিইআরসি ঘোষিত মূল্যহার অনুযায়ী এলপি গ্যাস পাওয়া যায় না। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গ্যাস বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানির সামান্য সিস্টেম লস কমাতে পারে না কমিশন। সেখানে অন্যান্য কাজ কীভাবে করবে? বিইআরসি নির্দেশ দেয়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না। এ জন্য কিছু করারও সক্ষমতা নেই কমিশনের।’
সূত্রমতে, অভিযোগের ভিত্তিতে বিইআরসি আইন অনুযায়ী লাইসেন্সি প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তার মধ্যে অভিযোগ নিষ্পত্তি করে কমিশন। কিন্তু গত ১০ বছরে কমিশনে ৩৭৮টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ২১০টি অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির হার কম হওয়া এবং জনসচেতনার অভাবে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ কম করা হয় বলে অনেকে মনে করেন।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিইআরসির ক্ষমতা খর্ব করতে করতে প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা ভোক্তার জন্য এবং বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত তথা সামগ্রিক দেশের জন্য অশনিসংকেত।’ তিনি বলেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত পুরোপুরি কারিগরি। এর সঙ্গে আইনের নানারকম বিষয় জড়িত। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের এসব বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সই করা ছাড়া তারা কিছুই করে না। এভাবে তো সাধারণ মানুষের কল্যাণ সম্ভব নয়। বিইআরসি গণশুনানির মাধ্যমে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করত বলে সেখানে কিছুটা হলেও বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতা করতে হতো। তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার সুযোগ ছিল। সেখানে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল বলে কোম্পানিগুলোও যেনতেন হিসাব উপস্থাপন করে মূল্যহার বাড়ানোর ব্যাপারে কঠিন চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন হয়। কিন্তু আইন সংশোধনের কারণে সেই সুযোগ আর থাকল না। তড়িঘড়ি করে করা এ সংশোধন অসাধু ব্যবসাকে সুরক্ষা দেবে বলে তিনি দাবি করেন।
শামসুল আলম মনে করেন, বিইআরসি আইন সংশোধন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে ক্ষমতার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে সরকার। অন্যদিকে বিইআরসি আইন অনুযায়ী তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণের একক ক্ষমতা বিইআরসির হলেও তারা তা করতে পারে না। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ আইন লঙ্ঘন করে অনেক আগে থেকেই অবৈধভাবে তরল জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করে আসছে।
খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) নিজে তরল জ্বালানি ব্যবসায়ী তথা বিইআরসির লাইসেন্সি হওয়া সত্ত্বেও ফার্নেস অয়েলের মূল্য বিপিসিই নির্ধারণ করে। আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) মালিকানাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে অন্যসব কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি তেলের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে মন্ত্রণালয়। এসব ক্ষেত্রে সিস্টেম লসের নামে তেল চুরি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল ও কয়লার ব্যবহার বেশি দেখানো হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে।
এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন কোম্পানি এবং সংস্থার পরিচালনা বোর্ডে পদাধিকারবলে মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্য কর্মকর্তা কোম্পানিগুলোর চেয়ারম্যান ও পরিচালক। ফলে ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় বিইআরসি এসব প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয় না।
সরকারের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রবল চাপে ২০০৩ সালের মার্চ মাসে বিইআরসি আইন করা হয়। এরপর ২০০৫, ২০১০ ও ২০২০ সালে এ আইন সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে আইনের ৩৪ ধারার উপধারা-৫-এ উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনা হয় ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর। এর আগে বছরে সর্বোচ্চ একবার বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম সমন্বয় বা পুনর্নির্ধারণের সুযোগ থাকলেও নতুন ওই সংশোধনীতে একাধিকবার দাম পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে গ্রাহকের কাঁধে এক বছরেই একাধিকবার দাম বৃদ্ধির খড়গ নেমে আসে।
সম্প্রতি বিইআরসির পাশাপাশি সরকারকে ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম পুনর্র্নির্ধারণ ও সমন্বয় করার ক্ষমতা দিয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এরপরই গণশুনানি ছাড়াই চলতি মাসে এক সপ্তাহের মধ্যে নির্বাহী আদেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে।
সরকারের ওই আদেশ জারির আগে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর আবেদন নিয়ে গত ৮ জানুয়ারি গণশুনানি করেছিল বিইআরসি। চলতি মাসে মূল্যসংক্রান্ত নতুন আদেশ দেবে বলে জানিয়েছিল কমিশন। কিন্তু এর মধ্যেই গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় সরকার। এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নিয়ে বিইআরসির কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।
বিইআরসির আইন অনুযায়ী, গণশুনানির মাধ্যমে দাম সমন্বয় হবে। এ ক্ষেত্রে বাড়তেও পারে কমতেও পারে। কিন্তু বিইআরসির দাম কমানোর কোনো নজির নেই। গণশুনানিতে ভোক্তারা দাম কমানোর বিষয়টি যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেও তা আমলে না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দাম বাড়ানোর সময় অবশ্য সংস্থাগুলোকে সাশ্রয়ী ও দক্ষ হওয়ার পরামর্শসহ নানারকম শর্ত জুড়ে দেয় কমিশন।
তবে বিতরণ ও সঞ্চালন কোম্পানির প্রস্তাব অনুসারে, কখনই দাম বাড়ায়নি বিইআরসি। এর আগে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৬৬ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও বিইআরসি বাড়িয়েছে ২০ শতাংশ। গ্যাসের দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব এলে বিইআরসি বাড়িয়েছে প্রায় ২৩ শতাংশ।
চলতি বিপিএলে দারুণ খেলছেন পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার ওয়াহাব রিয়াজ। ৬ ম্যাচে ১২ উইকেট নিয়ে এখনও পর্যন্ত আসরের সর্বাধিক উইকেট শিকারি খুলনা টাইটান্সের এই তারকা। মাঠে দারুণ সময় কাটানো ৩৭ বছর বয়সী এবার মাঠের বাইরে থেকে পেলেন দারুণ এক সুখবর। বিপিএল চলাকালেই মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেলেন তিনি।
পাকিস্তান জাতীয় দলের সাবেক পেসারকে পাঞ্জাব তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্রীড়া মন্ত্রী করা হয়েছে। দেশটির খেলাধুলা বিষয়ক জনপ্রিয় চ্যানেল ‘এ’ স্পোর্টস এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী মহসীন নাকভির অধীনে ক্রীড়া মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ওয়াহাব। সব সংস্করণ মিলিয়ে যিনি দেশের হয়ে ১৫৬ ম্যাচ খেলেছেন। উইকেট নিয়েছেন ২৩৭টি।
২০১৭ সালে পাকিস্তানের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী দলের সদস্য ছিলেন ওয়াহাব। জাতীয় দলের হয়ে সবশেষ খেলেছেন তিনি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে।
চলতি বিপিএলে বিশ্বের ষষ্ঠ বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টি সংস্করণে ৪০০ উইকেটের মাইলফলকও ছুঁয়েছেন ওয়াহাব। সব মিলিয়ে মাঠ ও মাঠের বাইরে দারুণ সময় কাটছে তার।
অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মিক্সড ডাবলসে হেরে গিয়ে গ্র্যান্ড স্ল্যামকে বিদায় জানিয়েছেন সানিয়া মির্জা। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার সকালে শেষ হয় সেই ম্যাচ। যে ম্যাচের প্রায় দশ ঘণ্টা পর স্ত্রী সানিয়াকে শুভেচ্ছা জানান শোয়েব মালিক। এই মুহূর্তে বিপিএলে ব্যস্ত সময় কাটানো পাকিস্তানের ক্রিকেটার জানিয়েছেন, স্ত্রীর কৃতিত্বে তিনি গর্বিত।
গ্র্যান্ড স্ল্যামে সানিয়া শেষ ম্যাচ খেলার পর থেকেই দেশ-বিদেশ জুড়ে অগণিত বার্তা পেয়েছেন। কিন্তু শোয়েবের বার্তা কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। দু’জনের মধ্যে তৈরি হওয়া সাম্প্রতিক দূরত্বের জল্পনা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল এই নৈঃশব্দ্য। অবশেষে শুক্রবার সন্ধ্যার পর টুইট করেন শোয়েব।
সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক লিখেছেন, ‘খেলাধুলোর জগতে সব নারীদের কাছেই তুমি আশার প্রতীক ছিলে। গোটা টেনিস জীবনে যা যা অর্জন করেছ, তার জন্য অত্যন্ত গর্বিত। তুমি অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা। এ ভাবেই শক্তিশালী হয়ে আগামী দিনে এগিয়ে যাও। অবিশ্বাস্য টেনিস জীবনের জন্যে অনেক শুভেচ্ছা।’
আরও পড়ুন
বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে আজও শীর্ষ অবস্থানে রাজধানী ঢাকা। এনিয়ে টানা আটদিন শীর্ষে রয়েছে ঢাকা।
শনিবার (২৮ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) স্কোর ২২১ রেকর্ড করা হয়েছে। যার অর্থ হলো জনবহুল এ শহরের বাতাসের মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে রয়েছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার এ তালিকা প্রকাশ করেছে।
২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোর 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' বলা হয়, যেখানে ৩০১ থেকে ৪০০ এর স্কোর ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
এ তালিকায় ২১৬ একিউআই স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে পাকিস্তানের লাহোর; ১৯০ নিয়ে তৃতীয় ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই। এরপর চতুর্থ স্থানে থাকা মঙ্গোলিয়ার উলানবাটোরের স্কোর ১৮৭ এবং পঞ্চম স্থানে থাকা উজবেকিস্তানের তাসখন্দের স্কোর ১৭১।
মেগাসিটি ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে বায়ুদূষণে। এর বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে কিছুটা উন্নত হয়।
২০১৯ সালের মার্চ মাসে পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো: ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলা।
বর্তমানে শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজ, রাস্তার ধুলা ও অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণার ব্যাপক নিঃসরণের কারণে ঢাকা শহরের বাতাসের গুণমান দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে।
রাজপথে খালি পায়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিচ্ছে এক পথশিশু। পেছনে বিক্ষুব্ধ মিছিল। শিশুটির পরনে চার পকেটের হাফপ্যান্ট; গেঞ্জিটা কোমরে বাঁধা। কণ্ঠে স্বৈরতন্ত্রের কবর রচনার হুঙ্কার। দৃঢ় চোয়ালে অগ্নিস্পর্ধী সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পাঁজরগুলো যেন শরীরের ভেতর থেকে তীরের ফলার মতো বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মিছিলের অগ্রভাগে থাকা অপ্রতিরোধ্য শিশুটি সেদিন সবার নজর কাড়ে। ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সকালে বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের এ প্রতিবাদী মুহূর্তটি ক্যামেরায় বন্দি করেছিলেন প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার।
সেই সময়ে দৈনিক সংবাদের নিজস্ব সংবাদচিত্রী ছিলেন তিনি। ছবিটি ফ্রেমবন্দি করে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি ইতিহাসের মূর্ত সাক্ষীর আলোকচিত্রী। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আইকনিক আলোকচিত্র হিসেবে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এ ছবি। ছবিটি আমাদের সংগ্রামী অতীতকে স্মরণ করিয়ে দে য়। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র শিশুটির চোখ-মুখের ভাষা মানুষকে মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নের কথা। ছবিটির দৃশ্য-ভাষা এতই শক্তিশালী যে, এখনো মানুষের মনে শিহরন জাগায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আহ্বান জানায়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছাত্রসমাজের ১১ দফা মুক্তিসনদকে সামনে নিয়ে ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি দাবানলের মতো জ্বলে উঠে পূর্ব বাংলা ও তার রাজধানী ঢাকা। এর ধারাবাহিকতায় ২৪ জানুয়ারি কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে ঢাকার রাজপথে নামে জনতার ঢল। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল তরঙ্গমালাকেও ম্লান করে দেয় সেদিনের জনসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ ঊর্মিদল। অধিকার-সচেতন জনতার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারীর আসন। সেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য গর্জে উঠে স্বৈরাচারের বন্দুক। বুলেটের আঘাতে রাজপথে ঝরে পড়ে কয়েকটি প্রাণ। শহীদের লাশ নিয়ে রাজপথে মিছিলের ঢল নামে। রাত ৮টায় কারফিউ জারির মাধ্যমে জনতাকে নিবৃত্ত করার সর্বশেষ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দিয়ে রাতের নৈঃশব্দ্যকে প্রকম্পিত করে মুক্তিপাগল জনতা। এর কয়েক দিন পর জনতার অদম্য আন্দোলনের মুখে অত্যাচারী সরকারকে পালাতে হয়। সমাধি রচিত হয় আইয়ুব-মোনায়েমের রাজত্বের।
সেদিন ছিল আধাবেলা হরতাল। ঢাকায় সেক্রেটারিয়েটের ভেতর থেকে পুলিশ দুই দফা গুলিবর্ষণ করে। প্রথম দফা গুলিবর্ষণ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে। দুপুরে দ্বিতীয় দফা। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক ও নোয়াখালীর নান্দিয়াপাড়া হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সৈয়দ রুস্তম আলী। প্রেস ট্রাস্ট অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে আরও একজন নিহত হয়। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআরের গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জে আহত হয় ২১ জন। পরদিন সব দৈনিক পত্রিকা হতাহতদের নাম, বাবার নাম, বয়স, পেশা, কার-কোথায় গুলি লেগেছে, কীভাবে ঘটনা ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ ছাপায়। বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় শহীদ মতিউর ও রুস্তমের মৃত মুখের ছবি ছাপা হয়। সেদিন কোনো পত্রিকায় কোনো পথশিশুর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়নি।
আইকনিক ফটো : রশীদ তালুকদারের তোলা পথশিশুর ছবিটি প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি দৈনিক সংবাদের বিশেষ ক্রোড়পত্রে। এরপর থেকে প্রতি বছর ২৪ জানুয়ারি ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক ঘটনার লেখনীর সঙ্গে ছবিটি দৈনিক সংবাদ প্রকাশ করে। রশীদ তালুকদার ১৯৭৫ সালে সংবাদ ছেড়ে ইত্তেফাকে যোগদান দেন। এরপর ইত্তেফাকও ছবিটি প্রতি বছর প্রকাশ করে। অনেক দিন এ ছবির নেপথ্য ঘটনার অনুসন্ধান হয়নি। কোনো পত্রিকায় ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন, ফিচার, প্রবন্ধ-নিবন্ধও লেখা হয়নি। রশীদ তালুকদারও এই ছবি সম্পর্কে কোথাও কিছু লিখে যাননি। দীর্ঘ ৫৪ বছর শিশুটির কথা অজানাই রয়ে গেছে। খোঁজ মেলেনি বলে সবাই ধরে নিয়েছে শিশুটি সেদিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি গোলাম রাব্বানী তার ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে শিশুটির পরিচয় তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটির নাম মো. হোসেন আলী। সেই সূত্রেই পাওয়া যায় হোসেন আলীর খোঁজ।
হোসেন আলীর কথা : ৬৪ বছর বয়সী হোসেন আলী বলেছেন, মিছিলের অগ্রভাগে থাকা শিশুটি তিনিই। তার বক্তব্য, ‘ঊনসত্তরে আমার বয়স আছিল দশ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমারে ডাকতেন পালোয়ান বইলা। ওই দিন জগন্নাথ কলেজের দিক থাইক্যা ছাত্রলীগের একটা মিছিল আইতেছিল। আমি তখন ফুলবাড়িয়া ইস্টিশনে থাকি। “জেলের তালা ভাঙবো, মুজিব ভাইকে আনবো” স্লোগান শুইন্যা আমিও যোগ দিলাম ওই মিছিলে। মিছিলে আমার মতো কয়েকটি শিশুও আছিল। রেগওলা (স্ট্রাইপ) হাফশার্ট গায়ে ছেলেডা আমার পেছনে আছিল। মিছিল পলাশী ব্যারাক হইয়া শাহবাগের দিকে আইলো। আমি কিন্তু মিছিলের সামনে। গরমে ঘামাইয়া গেছি। তাই গেঞ্জিটা খুইলা কোমরে বাঁধলাম। শাহবাগের সামনে আইসা দেখি, রেডিও অফিসের সামনে ইপিআর পজিশন লইয়া আছে। দুইবার মাইকিং করছে “চল যাও, চল যাও”। কে কার কথা শুনে? আমি জয় বাংলা বলে স্লোগান দিচ্ছি। তিন-চারজন ছবি তুলতাছে। তিনবার বলার পর দেখি বন্দুক রেডি করতাছে। সাথে সাথে একটা গুলির আওয়াজ পাইলাম। দৌড়াইয়া তারের ঘের দেওয়া রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। এরপর মন্দির, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট হয়ে জিন্নাহ অ্যাভিনিউর রুচিতা হোটেলে আইলাম। কাঙালি হিসেবে আমারে তখন জিন্নাহ অ্যাভিনিউর অনেকে চিনতো। একদিন কয়েকজন আমারে পত্রিকার ছবি দেখাইয়া কইলো ‘তোরে তো পাঞ্জাবিরা মাইরালাইবো।’
হোসেন আলী বলেন, ‘আমি বহুদিন বহু লোকরে কইছি ওই শিশুটা আমি। আমি তো কাঙাল মানুষ, তাই আমার কথা কেউ শোনে না, পাত্তা দেয় না। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোজাফ্ফর হোসেন পল্টু, বঙ্গবন্ধুর বডিগার্ড মহিউদ্দীন ভাই তো এখনো বাঁইচা আছে। আমারে তাগো কাছে লইয়া যান।’ বুকে একটা কালো দাগ দেখিয়ে বললেন, ‘আসল ছবিটার সঙ্গে মিলাইয়া দ্যাখেন। সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যাইবো।’ হোসেন আলীর ছেলে উজ্জ্বল হোসেন বাবু বলেন, ‘ছোটবেলা বেলা থেকে বাবার মুখে এই কথা শুনে শুনে বড় হয়েছি। বাবার চুলের শেপটা দেখেন, মিল পাবেন।’
হোসেন আলীর গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার চান্দেরকান্দিতে। মফিজ উদ্দিন ও ফাতেমা বেগমের একমাত্র সন্তান তিনি। পথশিশু পরিচয়ে শৈশব কাটে ফুলবাড়িয়া টার্মিনালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকতেন আওয়ামী লীগ অফিসের নিচে। ৭৭ সালে ২২ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শুরু করেন টোকানো কাগজের ব্যবসা। আটাশির বন্যায় দোকান তলিয়ে গেলে আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অনেক দিন রিকশা চালিয়েছেন। এখন আট হাজার টাকা বেতনে নৈশপ্রহরীর চাকরি নিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বেকার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মান্ডার কদমতলী এলাকার ঝিলপাড়ে।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে : ছবিটি কেমন করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সেই গল্প বলেন ভারতের পদ্মশ্রী খেতাবপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী টি কাশীনাথ। বাহাত্তরে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফেয়ারে অংশ নেয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নেগেটিভগুলো ফটোসাংবাদিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দিল্লিতে যান ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ জহিরুল হক। বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি লিখে দেন। জহিরুল হক সেই চিঠি পৌঁছান ভারতের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর হাতে। তথ্যমন্ত্রী ফটোগ্রাফি বিভাগের পরিচালক টি কাশীনাথকে ডেকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করতে বলেন। কাশীনাথের তত্ত্বাবধানে ২০ ফুট বাই ৩০ ফুট সাইজে ছবিগুলো পরিবর্ধিত (এনলার্জ) করা হয়। রশীদ তালুকদারের তোলা ঊনসত্তরের পথশিশুর ছবি ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ছবিটি প্রদর্শন করা হয় স্টলের প্রবেশমুখে। ছবি দুটি দেখার জন্য মেলায় আসা লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাংলাদেশের স্টলের সামনের ভিড় সরাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করতেও বাধ্য হয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার এই চমকপদ তথ্যটি অনেক দিন এ দেশের মানুষের অজানা ছিল। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি) রিসোর্স পারসন হিসেবে টি কাশীনাথ বাংলাদেশে এসে এ গল্পটি করেন।
নীরব অভিমান : ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে প্রথিতযশা আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদারের তোলা ছবিগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৫৯ সালে রশীদ তালুকদারের কর্মজীবন শুরু। বাষট্টিতে দৈনিক সংবাদে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করার আগে তিন বছর ৮০ টাকা বেতনে ফটো টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন পিআইডিতে। সংবাদে কাজ করেছেন টানা ১৩ বছর। এরপর তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যার ঘটনা প্রভৃতির অসংখ্য ছবি তুলে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির অল রোভস প্রোগ্রামে প্রতি বছর বিশ্বের একজন সেরা ফটোসাংবাদিককে পাইওনিয়ার ফটোগ্রাফার অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পদক পান রশীদ তালুকদার। তার তোলা ছবি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া এনসাইক্লোপিডিয়ায় যুক্ত হয়েছে। এত কিছুর পরও আমাদের রাষ্ট্র তাকে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হয়নি। রাষ্ট্রের অন্যমনস্কতায় নীরব অভিমানে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে পরলোকে চলে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাস নির্মাণকালের এই রূপকার।
লেখক : দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক
কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গড়ে উঠছে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে প্রবেশ করতে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নীল পানির চ্যানেল (জাহাজ চলাচলের পথ) দেখে মনে হবে যেন উন্নত কোনো দেশের বন্দর। এই নীল জলরাশির তীরেই গড়ে উঠবে উপমহাদেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এই নীল পানি দেখে আশাবাদী হওয়ার বদলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) কপালে এখন চিন্তার ভাঁজ। যার কারণ হলো কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত চ্যানেলের জন্য খরচ হওয়া প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার দায় পড়তে যাচ্ছে চবকের কাঁধে।
গত রবিবার মাতারবাড়ী ঘুরে দেখা যায়, ৩৫০ মিটার চওড়া ও ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল নির্মাণের কাজ শেষ। কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় জেটি নির্মাণও হয়ে গেছে, সেই জেটিতে ইতিমধ্যে ১১২টি জাহাজ ভিড়েছেও। কিন্তু চ্যানেলের জন্য চবককে পরিশোধ করতে হবে ৯ হাজার ৩৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) ঋণ হিসেবে রয়েছে ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ এবং বাংলাদেশ সরকারের ১ হাজার ৪২৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এই টাকা কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় খরচ করা হয়েছিল। আর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যই চ্যানেলটি নির্মাণ হয়েছিল। এখন যেহেতু এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠছে, তাই তা নির্মাণের সব খরচ চবককে পরিশোধ করতে হবে বলে গত ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিবকে প্রধান করে একটি সাব কমিটি গঠন করা হয়, যে কমিটি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের কাছে চ্যানেলটি ও তা নির্মাণের ব্যয় হস্তান্তরের পদ্ধতি নির্ধারণ করবে।
কিন্তু এই টাকা পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছে চবক। এ বিষয়ে বন্দর কর্র্তৃপক্ষের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জাইকার ৭ হাজার ৯২২ কোটি ১৬ লাখ ঋণের পরিশোধ শুরু হবে আগামী বছর থেকে। সেই হিসাবে প্রথম বছরে পরিশোধ করতে হবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা এবং পরবর্তী বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। শুধু কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ঋণ নয়, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য জাইকা থেকে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে চবক। এই টাকার বিপরীতে ২০২৯ সালে জাইকাকে দিতে হবে ১ হাজার ৮১৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা, পরে প্রতি বছর ঋণ ও সুদ বাবদ দিতে হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মাতারবাড়ী বন্দরের ড্রেজিং বাবদ বছরে খরচ হবে প্রায় ৫০ কোটি এবং এই বন্দর পরিচালনায় প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে শুধু ঋণ শোধ বাবদ চবককে পরিশোধ করতে হবে ৪ হাজার ৪২৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে আগামী বছর লাগবে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা পর্যায়ক্রমে ২০২৬ সাল থেকে প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া বে টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার ও চ্যানেল নির্মাণের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে চবক। অন্যদিকে চবকের বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তাহলে চবক এত টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
চবকের দাবি, চ্যানেল নির্মাণের খরচ যাতে তাদের কাঁধে দেওয়া না হয়। কিন্তু এই টাকা পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছেন কয়লাবিদ্যুৎ (কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড সিপিজিসিবিএল) প্রকল্পের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। এ প্রসঙ্গে তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই চ্যানেল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নিমির্ত হয়েছে। এখন যেহেতু বন্দর কর্র্তৃপক্ষ চ্যানেল ব্যবহার করবে, তাহলে তো তাদের টাকা দিতেই হবে। আর এই টাকা তো ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হবে।’
উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। কয়লাবিদ্যুতের চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা যায় বলে জাইকা একটি প্রস্তাবনা দেয়। সেই প্রস্তাবনা ও পরে সমীক্ষার পর ‘মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। আর এরই আওতায় চ্যানেলের প্রশস্ততা ১০০ মিটার বাড়ানোর পাশাপাশি গভীরতাও ১৮ মিটারে উন্নীত করা হয়। এ জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকার বাজেট একনেক থেকে অনুমোদন করে। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ীতে ৩৫০ মিটার দীর্ঘ ও ১৬ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের গভীরতা) জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে ২০০ মিটার দীর্ঘ ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। মাতারবাড়ী চালু হলে এর সঙ্গে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রাবন্দরের নেটওয়ার্ক আরও বাড়বে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ী বন্দর।
প্রণয় রায়কে কোথায় পাব? ২০০০ সালের শুরুতে এরকম একটা জিজ্ঞাসা নিয়ে আমি তখন ফোন করেছিলাম এনডিটিভিরই এক স্পোর্টস রিপোর্টারকে, যে প্রণয় রায়কে ব্যক্তিগতভাবে বহু বছর খুব ভালো চেনে, তার প্রতিষ্ঠানে বহু বছর চাকরি করেছে। মনে রাখতে হবে, এমন একটা সময় তখন, যখন সেলফোন সবে এসেছে বা আসেনি, সেই সময় কাউকে ধরার জন্য, এখন যেরকম একটা যন্ত্রই সতেরো সেকেন্ডে কাউকে ধরিয়ে দেয়, তখন তা সম্ভব ছিল না। আর প্রণয় রায়ের মতো বিখ্যাত কেউ হলে তো সেটা প্রায় অসম্ভব। আমি এনডিটিভিতে কয়েকবার ফোন করে নিষ্ফল চেষ্টার পর এই রিপোর্টারের শরণ নেই। তখন সে খোঁজটোজ নিয়ে জানাল, প্রণয় রায় এখন ট্রেনে করে দিল্লি থেকে বোম্বে যাচ্ছেন। আমি সে সময় একটা বই লিখি, যে বইটা ছিল অনেক প্রফেশনালের লেখার সংকলন। বইটার নাম ছিল সেলিব্রেটি এখন আপনিও। আমার কোথাও মনে হয়েছিল যে, এই বইটা যেহেতু টেলিভিশন দুনিয়ায় কী করে সফল হতে হবে এবং সফল হয়ে কীভাবে চলতে হবে তার ওপর একটা কম্পাইলেশন, সেখানে প্রণয় রায়ের কোনো কিছু থাকবে না এটা হতেই পারে না এবং সেই বইটাতে অনেকেই লিখেছিলেন। রাজদীপ, অর্ণব গোস্বামী, রজত শর্মা, তখন খুব বিখ্যাত আরজে রুবি ভাটিয়া, প্রিয়া টেন্ডুলকার। আমার মনে হয়েছিল যে, এই বইটার মুখবন্ধ, তারই করা উচিত, যিনি ভারতীয় টেলিভিশনের জনক এবং সেই কাজটা প্রণয় রায় ছাড়া আর কে করতে পারেন! কিন্তু আমি খুব আশ্চর্য শুনে, যে এনডিটিভির মালিক, তিনি কি না দিল্লি থেকে মুম্বাই যাচ্ছেন ট্রেনে করে! এবং শুনলাম ট্রেন থেকে তিনি মুম্বাইতে নেমে, আবার নাকি ট্রেনে উঠবেন। অর্থাৎ সারমর্ম হচ্ছে, আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি তাকে ধরতে পারব না। আমার জন্য যেটা তখনকার মতো সবচেয়ে অবাক লেগেছিল যে, টানা তিন দিন ট্রেনে চড়ে ভারতবর্ষ ঘুরছেন, এত বড় এমন একজন মানুষ যার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ড দামি। তখন আমায় ওর সহকর্মীরা বললেন যে, উনি এরকমই মাঝেমধ্যে ট্রেনে করে ভারত দেখতে বেরিয়ে পড়েন। বহুকষ্টে প্রণয় রায়কে তারপর ধরা গিয়েছিল। মুখবন্ধটা উনিই লিখেছিলেন আমার বইয়ের। কিন্তু আমার বিস্ময় এখনো কাটেনি। এরকম একজন মিডিয়া ব্যারেন কী করে তার ব্যস্ততার মধ্যে ট্রেন ট্রাভেলের মতো একটা ইচ্ছাকৃত ঝুঁকি নিতে পারেন, ঝক্কি নিতে পারেন, যেখানে তিনি সহজেই দুই ঘণ্টায় মুম্বাই থেকে দিল্লি প্লেনে পৌঁছে যেতে পারেন। প্রণয় রায় নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আর সবার মতোই অনেক দূর থেকে। ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’ বলে একটা অনুষ্ঠান থেকে এবং তখন দেখেই মনে হয়েছিল যে, ফেলুদার কখনো ইংলিশ ভার্সন হলে, সেখানে তার রোলটা করার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রণয় রায়। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, হাইট; ফেলুদা অবশ্য কখনো ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রাখেননি, কিন্তু তিনি যে বাঙালি, ইন্টেলেকচুয়াল, যে মননের সঙ্গে ফেলুদাকে দেখতে অভ্যস্ত বা বাঙালি এক করে ফেলেছে, সেই পুরো ফেলুদার ভাবধারাটাই যেন প্রণয় রায় তার মধ্যে বহন করেন। অর্থাৎ তিনি অকুতোভয়। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি শিক্ষিত এবং তিনি খুব সচল, খুব অ্যালার্ট। ওয়ার্ল্ড দিস উইক-এ তাকে দেখে যেরকম সারা ভারতবর্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তারপর আমরা তাকে দেখলাম ইলেকশন অ্যানালাইসিস করতে এবং তখনই একটা নতুন টার্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটল। যার নাম হচ্ছে সেফোলজিস্টস অর্থাৎ যিনি ইলেকশন ট্রেন্ডস এবং স্ট্যাটিসটিকস বিশ্লেষণ করেন। ভারতবর্ষে তার আগে, প্রাক-প্রণয় রায় যুগে যেমন পেশাদার টেলিভিশন ছিল না, তেমনি সেফোলজিস্ট শব্দটাও শোনা যায়নি। যাই হোক, প্রণয় রায় তারপর আমাদের সঙ্গে, নির্বাচনের আগে প্রাক-নির্বাচনী সিট পোল করা শুরু করলেন। নির্বাচনের পর বিশ্লেষণ শুরু করলেন এবং নতুন একটা ঘরানা নিয়ে এলেন যেটা এর আগে ভারতীয় টেলিভিশনে কেউ দেখেনি। এবং যেটার মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিতে অসম্ভব একটা আন্তর্জাতিকতা আছে। আমার তখন থেকেই মনে হতো যে, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যে করে হোক, আলাপ করতে হবে, আবার একই সঙ্গে মনে হতো যে, আলাপ হলে যদি মুগ্ধতা কেটে যায় তাহলে আলাপ না হওয়াই ভালো। দূর থেকে তাকে দেখাটাই ভালো। দুরকম একটা, স্ববিরোধী একটা ভাবনা নিজের মনের মধ্যে ঘুরত। এরপর প্রণয় রায় দেখালেন যে, তিনি শুধু এককভাবে স্টার নন। অর্থাৎ তার শুধু স্টার হলেই চলছিল। স্টার প্রণয় রায়ই যথেষ্ট ছিলেন ভারতবর্ষের জন্য যেভাবে তিনি বিল গেটসকে ইন্টারভিউ করেছেন, যেভাবে তিনি নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে কথা বলেছেন, যেভাবে তার শোগুলো বিশ্লেষণ করেছেন, কখনো কখনো বড় শো করতে এসেছেন লাইভ শো, সেটাই যথেষ্ট ছিল টেলিভিশনের পৃথিবীতে, তাকে পাকাপাকিভাবে রেখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি ঠিক করলেন যে, তাকে শুধু ভারতীয় টেলিভিশনের অমিতাভ বচ্চন হলেই চলবে না, তাকে একই সঙ্গে হতে হবে ভারতীয় টেলিভিশনের রাজ কাপুর। তাই এনডিটিভি প্রতিষ্ঠা করে নিলেন, তার আগপর্যন্ত তিনি অনুষ্ঠানগুলো স্টারে করছিলেন, অন্য চ্যানেলে করছিলেন, এবার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানে একটা, যেটাকে লেফট লিবারেল সেন্টিমেন্ট আমরা বলি, সেটার তো ধারক এবং বাহক হয়ে গেলেন গোটা ভারতবর্ষে, একই সঙ্গে অনেক তারার জন্ম দিলেন।
এ তারার জন্ম দেওয়া নিয়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া জগতে দুই রকম মতবাদ আছে। বেশিরভাগ মিডিয়া ব্যারেন, তারা মনে করেন যে স্টার তৈরি করাটা বিপজ্জনক, কারণ স্টার আজ আছে, কাল অন্যের হয়ে তারাবাজি করবে। আমাকে ছেড়ে দেবে। তখন সেই তারাবাজির আলোটা আমাকে সহ্য করতে হবে। তার চেয়ে বাবা সবচেয়ে ভালো হচ্ছে, আমি যদি কিছু স্ক্রিন প্রফেশনাল তৈরি করি যাদের বাহ্যিক সেরকম কোনো পরিচিতি নামডাক থাকবে না, কিন্তু যারা খুব এফিশিয়েন্ট হবে। যেটাকে আমরা অনেক সময় ক্রিকেটের ভাষায় বলি লাইন অ্যান্ড লেন বোলার। অর্থাৎ তার ফ্ল্যামবয়েন্স থাকবে না, সে অত্যন্ত পেশাদার হবে, মানে কাজটা তুলে দেবে। যদি সেরকম করি তাহলে সুবিধা হচ্ছে যে, সেই ধরনের পেশাদার সে যদি অন্য জায়গায় চলে যায় আমি আরেকটা পেশাদারকে নিয়ে আসতে পারব। কিন্তু যদি আমার এখান থেকে একটা রাজদীপ চলে যায়, কী অর্ণব চলে যায়, তাহলে আমার সমস্যা যে লোকে প্রতিনিয়ত জিজ্ঞেস করবে যে, ও চলে গেল কেন? ও নেই কেন? তখন অনেক রকম আমার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশিরভাগ ভারতীয়, আবার বলছি, বেশিরভাগ ভারতীয় মিডিয়া ব্যারেন আজও তাই মনে করেন, ভারতের সবচেয়ে বড় খবরের কাগজ টাইমস অব ইন্ডিয়া তারা আজও ওই ঘরানায় বিশ্বাসী যে, স্টার তোলার দরকার নেই, তোলার দরকার আছে এফিশিয়েন্ট প্রফেশনাল, প্রণয় রায় এখানেও ইউনিক, তিনি এই ধারণাটা কমপ্লিটলি ভেঙে দিয়েছেন, এত সব স্তর তিনি তুলেছেন, যে ভারতীয় টেলিভিশনে সেকেন্ড কোনো নমুনাও নেই বোধহয়। এক থেকে দশ, দিকে দিকে কতগুলো নাম বলব? অর্ণব গোস্বামী, বরখা দত্ত, রাজদীপ, নিধি, রাজদান, রবিশ কুমার, শ্রীনিবাসন জৈন, বিক্রম চন্দ প্রত্যেকে একেকজন স্টার ভারতীয় মিডিয়া জগতের এবং ওদের প্রত্যেককে কিন্তু তুলেছেন প্রণয় রায়। অনেকেই ছেড়ে গেছেন, তাতে তার কিছু এসে যায়নি। তিনি স্টার তৈরির কারখানাতে একইরকমভাবে মনোনিবেশ করেছেন। পরের লোকটাকে বের করে আনার জন্য ইভেন এই চাপের মুখে অচঞ্চলতা এটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ ট্রেডমার্ক। আমি কখনো দেখিনি কোনো ছবিতে, কখনো শুনিনি যে তিনি অত্যন্ত স্ট্রেসড হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই স্ট্রেসড হয়েছেন গত কিছুদিন, কয়েক মাসের ঘটনা যে রকম যখন তিনি এনডিটিভি ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন, অবশ্যই স্ট্রেসের মুখে ছিলেন, কিন্তু কোথাও কখনো পাবলিকলি স্ট্রেসের ভাবটা দেখাননি, যাতে তার ডিগনিটিটা অক্ষুন্ন থাকে, এই পাবলিক লাইফে প্রচ- স্ট্রেসের মধ্যে ডিগনিটি বজায় রাখাটাও প্রণয় রায়ের একটা হিউজ হিউজ ট্রেডমার্ক এবং এটা অনুকরণযোগ্য। আমার একটা সময় বারবার মনে হতো যে প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করছি না কেন? কেন প্রণয় রায়ের কোম্পানিতে কাজ করার চেষ্টা করছি না? তারপর সবাই বলত যে, একটু প্রণয় রায়ের সঙ্গে কাজ করতে হলে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ থেকে পাস করতে হবে অথবা তাদের বাবাদের হতে হবে আইএফএস কিংবা আইএস, প্রণয় যাদের রিক্রুট করেন তাদের যদি আমরা দেখি তারা কোথা থেকে এসেছে, তাহলে দেখা যাবে তারা অত্যন্ত উচ্চবিত্ত সমাজ থেকে এসেছে।
প্রণয় রায়ের ওখানে একেবারে লোয়ার মিডল ক্লাস কেউ নেই, হয়তো কথাটা কতটা অসত্য, হয়তো কথাটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমি সাম হাউ আর কখনো চেষ্টা করিনি। দূর থেকে সবসময় একটা অদ্ভুত রেসপেক্ট এনডিটিভি গ্রুপ সম্পর্কে আমার এবং অন্য অনেক সাংবাদিককুলের বজায় ছিল যে, এরা হয়তো চাপের মুখে তাদের টেকনিক চেঞ্জ করেনি। তারা হয়তো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলছে না, অনেকে বলত যে এনডিটিভিতে ডিসকাশনগুলো খুব বোরিং হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে কিন্তু তারা সাবেকি যে ছাঁচটা সাংবাদিকতার, সেটা টেলিভিশনের ঢঙ্কানিনাদে এসেও কিন্তু বজায় রেখেছিল। এবং এই চিৎকার-চেঁচামেচি, মারদাঙ্গা যেটা আধুনিক ভারতীয় টেলিভিশনের ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে, সেটা থেকে বরাবর এনডিটিভি দূরে থেকেছে।
তাতে তাদের টিআরপি পড়েছে। তারা কেয়ারও করেনি। তারা মনে করেছে, আমরা এভাবে করতে চাই। এভাবেই করব। বাকি পৃথিবী যা ইচ্ছে বলুক, কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতি ভবনে এনডিটিভির একটা বিশাল অনুষ্ঠান হয়েছিল যখন প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতি, সেটাতে অমিতাভ বচ্চন, শচীন টেন্ডুলকার, আশা ভোঁসলেসহ অনেকে এসেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানটা দেখতে দেখতে আমার মনে হচ্ছিল যে, একজন মানুষের কতটা হোল্ড থাকলে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠান করতে পারেন। পরবর্তীকালে সেটা নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল কী করে রাষ্ট্রপতি একটা প্রাইভেট চ্যানেলকে সেখানে অনুষ্ঠান করতে দিতে পারেন। কিন্তু আমার বারবার মনে হচ্ছিল যে, শ্রদ্ধার কোন পর্যায়ে গেলে, কন্টাক্টস কোন পর্যায়ে থাকলে, তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে তার ব্যক্তিগত চ্যানেলের এরকম একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেন! মহেন্দ্র সিং ধোনি একটা সময় এনডিটিভির সঙ্গে ছিলেন এবং তখন এনডিটিভির দু-একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমার মনে আছে, ধোনি একবার সাউথ আফ্রিকায় বললেন, আরে এনডিটিভি কী করে করছে! এটাই প্রণয় রায়ের সবচেয়ে বড় সাফল্য এ কথাটা যে মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো মানুষ বলছেন! এটা ঠিক শোভা পায় না অর্থাৎ সবসময় এনডিটিভির একটা নির্দিষ্ট বেঞ্চমার্ক ছিল। সেটা হচ্ছে শাসকের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই। প্রশ্ন তোলা। সাহসী প্রশ্ন তোলা। আবার চাপের মুখে মাথা না নামানো, ওই যে বললাম একটা বামপন্থি লেফট লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি।
অনেকেই বলত যে, প্রণয়ের স্ত্রী রাধিকা রায়ের বোন যেহেতু বৃন্দা কারাত, সেজন্যই এ দৃষ্টিভঙ্গি। আমার কখনো তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছিল প্রণয় রায়ের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। একেবারে তিনি কলকাতায় হয়তো খুব বেশি সময় কাটাননি। কিন্তু কলকাতার ওই উদার বামপন্থি যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই উদার বামপন্থার সঙ্গে তার মনোভাব একেবারে একরকম। এবং সে জন্যই, বদলে যাওয়া ভারতবর্ষে তার বারবার করে সমস্যা হচ্ছিল এবং সমস্যা হওয়ার বোধহয় কথাও ছিল। কারণ তিনি যেটা বলছিলেন, শাসকরা বলছিলেন কমপ্লিটলি তার বিপরীত কিছু। এখনকার ভারতবর্ষের মিডিয়ায় বিপরীতমুখী আওয়াজটা আর কিছুদিন বাদে আমার ধারণা একমাত্র ফিল্মেই দেখা যাবে, ভারতবর্ষের টেলিভিশনে দেখা যাবে না।
আমার তো মনে হয় যখন এই ছবিগুলো দেখানো হবে যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কী রকম লড়াই করেছিল, এককালে আনন্দবাজার গ্রুপ কী লড়াই করেছিল, টাইমস নিয়ে মাঝখানে গিয়ে লড়াই করেছে, এনডিটিভি দীর্ঘদিন ধরে কী লড়াই করেছে সেগুলো বোধহয় ইতিহাসের পাতাতেই চলে গেল। তাই বলে প্রণয় রায়! যিনি কখনো ইতিহাসের কথায় যাবেন না। প্রণয় রায় ইতিহাস হয়ে ইতিহাসের পাতায় থাকবেন। আমার মনে হয়েছে যখন একটা সময় জগমোহন ডালমিয়া রবি শাস্ত্রীকে ইন্ডিয়ান টিমের কোচ হতে বলছিলেন এবং তিনি কোচ হব কি হব না এটা নিয়ে নানান কথা বলছিলেন। তখন আমায় শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, আমি তিনটে শর্ত দিয়েছি, একটা শর্ত যে টিম সিলেকশনের ভার আমাকে দিতে হবে। দুই, টিম সিলেকশনের ভার আমার যদি না থাকে, আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মত থাকবে। তিন, চূড়ান্ত এগারোর ব্যাপারে আমার মতামত থাকবে। ফোর্থ, টিমের ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কিছু কথা বলব। আমি তখন বলেছিলাম যে, আপনি ম্যানেজার হয়তো হবেন। কিন্তু আপনি থাকতে পারবেন না। কারণ আজাহারউদ্দিন। আপনি যদি এসব কথা বলেন তাহলে আজহারউদ্দিন আপনাকে ম্যানেজার রাখবেন না। উনি যেরকম পাওয়ারফুল, ডালমিয়ার সঙ্গে যেরকম সম্পর্ক, আপনাকে চলে যেতে হবে। তখন শাস্ত্রী বলেছিলেন যে, চলে যেতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু গোটা ড্রেসিংরুম জানবে, আমায় কেন চলে যেতে হয়েছিল। ওই রেসপেক্টটাই আমার পাওনা হবে। শাস্ত্রী সেই সময় ভারতীয় দলের কোচ হননি এবং হন অনেক পরে, কিন্তু আজ কোথাও মনে হচ্ছে যে, প্রণয় রায়ের এনডিটিভি থেকে চলে যাওয়া তার অসম্মান, তার অমর্যাদা এসবকিছু ইতিহাসে থেকে গেল, এভাবে ইতিহাস জানল লোকটাকে কেন চলে যেতে হয়েছিল। আমি ইমরান খানকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাকে এই যে জেলে পুরে অসম্মান করা হলো, আপনার কী মনে হয়েছিল সেই সময়? উনি বলেছিলেন, আমার কিছুই মনে হয়নি, আমার মনে হয়েছিল, গবেটগুলো যে ভুল করেছিল, সেগুলো ইতিহাসের পাতায় চলে গেল।
প্রণয় রায়ের কাহিনী সম্পর্কে আবার তাই মনে হয় যে, গবেটগুলো কী করে জানবে যে ওরা নিজেদেরও ইতিহাসের পাতায় নিয়ে চলে গেল। কিন্তু এটা নিশ্চয়ই সাময়িক। আর তাই বলছি, প্রণয় রায় চলে যাবেন নতুন প্রণয় রায় নিশ্চয়ই ফেরত আসবেন, তাই এটা দীর্ঘকালীন হতে পারে না। এটা সাময়িক। তাই লেখাটার হেডিং বললাম, মেরুদণ্ডের টাইম আউট।
শ্রুতিলিপি : শিমুল সালাহ্উদ্দিন
প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। অথচ সরকারি শুল্ক সুবিধার আওতায় বিদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। এমন ৫৩টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থার প্রাথমিক তদন্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া আরও ৭১টি প্রতিষ্ঠান একই সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করার মাধ্যমে আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারে যুক্ত বলে এনবিআরের তদন্তে জানা গেছে।
চিহ্নিত এই ১২৪টি প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে পর্যায়ক্রমে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাব জব্দ করা হয়। এ ছাড়া ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর অধিকাংশই তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী শিল্পের প্রতিষ্ঠান। তাদের পাচার করা অর্থের পরিমাণ চিহ্নিত করতে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেকটি প্রতিষ্ঠান একাধিক চালানে কম করেও ৫ কোটি থেকে ২৫ কোটি টাকার পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করেছে। অন্যদিকে একেকটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের পরিমাণও ৮ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকা বা তার বেশি। এই হিসাবে ১২৪ প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য এনে অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এবং আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব পাওয়া গেলেও চূড়ান্ত হিসাবের কাজ চলছে। চূড়ান্ত হিসাবে অর্থের পরিমাণ বাড়তে বা কমতে পারে।
এভাবে শুল্ক সুবিধায় কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার কারণে দেশি শিল্পে কী ধরনের প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশি শিল্প সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করে পণ্য উৎপাদন করে বলে তাদের উৎপাদন খরচ বেশি। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় পণ্য আমদানিতে শুল্ক দেওয়া লাগে না বলে খরচ কম হয়। তাই দাম কম থাকে। কম দামে পণ্য পাওয়ায় ক্রেতারা এসব পণ্য বেশি কেনে। অন্যদিকে দেশি পণ্য ন্যূনতম লাভ রেখে বিক্রি করলেও এর সঙ্গে পেরে ওঠে না। ফলে দেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ছে।
এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি ১২৪ প্রতিষ্ঠানের পাঁচ বছরের (২০১৭-২০২১) আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখেছে। বিশেষভাবে কী পরিমাণ কাঁচামাল আমদানি হয়েছে, কতটা উৎপাদন করা হয়েছে, রপ্তানির পরিমাণ কত, ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্রের মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ কোন কোন দেশের অনুকূলে পাঠানো হয়েছে, তদন্তে এসব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে। টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যে ৭১ প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে, তারা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আর্থিক অনিয়ম করেছে। যে পরিমাণের কাঁচামাল প্রয়োজন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। অন্যদিকে যা রপ্তানি করার কথা তার চেয়ে কম পরিমাণ এবং নামসর্বস্ব পণ্য উৎপাদন করে রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরে থেকে কিনে নামমাত্র পণ্য রপ্তানি করেছে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক ও সহযোগী শিল্প কারখানা ছাড়াও ইলেকট্রিক, প্লাস্টিক খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। কাঁচামাল হিসেবে তারা আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, মিডিয়াম পেপার, লাইনার পেপার, পলিপ্রোপাইলিন (পিপি), বিএপিপি ও এডহেসিভ টেপ, প্লাস্টিক দানা, হ্যাঙ্গার, পলিথিন, সুতা, কাপড়, তারসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আমদানি করেছে। কিন্তু সেসব কাঁচামাল কারখানায় না নিয়ে রাজধানীর নয়াবাজার, বংশাল, বকশীবাজার, হাতেম টাওয়ার, ধোলাইখাল, টঙ্গীতে বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিরপুর ২ নম্বরের বেলুকুচি নিট ওয়্যার, আদাবরের ঠিকানায় কভারস অ্যান্ড কভার ইন্ডাস্ট্রি, শ্যামপুর কদমতলীর ইমপেকস প্যাকেজিং লিমিটেড, টঙ্গীর এম এম ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, বনানীর বিমানবন্দর সড়কের পারসা লিমিটেড, বনানী জি ও এইচ ব্লকে রাইন ফ্যাশন লিমিটেড, টঙ্গীর ওয়েলড ড্রেসেস লিমিটেড, মিরপুর পল্লবী সেকশন ৭-এর মারকাভ ডিজাইনারস লিমিটেড, ঢাকার কোতোয়ালির ঠিকানায় ম্যানিলা পলিমার ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডসহ ১২৪ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকানায় গিয়ে ৫৩টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাস্তবে কোথাও দোকান, আবাসিক ভবন, শপিং মল, ছাত্রী হোস্টেল, স্কুল পাওয়া গেছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার ঠিকানায় আফট্যাকস লিমিটেড অবস্থিত বলা হলেও বাস্তবে সেখানে রয়েছে দোকান।
প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী হিসেবে ১২৪টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্ত। উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা পরিচালক হিসেবে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের দাবি, কাঁচামাল আমদানি ও পণ্য রপ্তানিসংক্রান্ত একটি কাগজেও তাদের স্বাক্ষর নেই। তবে এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এসব ব্যক্তিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর বাবুবাজারে বিক্রি করতে নেওয়ার সময় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা বন্ড সুবিধা বা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাগজসহ একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। এসব কাগজ এবি প্যাকেজিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে খালাস করে এনেছিল। আটক পণ্যের বাজারমূল্য প্রায় ১৪ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক-করসহ দাম হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন চালানে এক বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করেছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনে সরকার কাঁচামাল আমদানিতে ‘বন্ড সুবিধা’ নামে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। এই সুবিধা নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় না। এই সুবিধা পেতে হলে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। শর্তগুলোর অন্যতম হলো, শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানিকৃত কাঁচামালের সবটা উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানি করতে হবে এবং সামান্য কাঁচামালও খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। এসব শর্ত ভঙ্গ করলে শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসায়ের লাইসেন্স স্থগিত হবে। আর্থিক অনিয়মের সমপরিমাণ অর্থ, রাজস্ব এবং জরিমানাসহ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। প্রয়োজনে কারখানার জমি, যন্ত্রপাতি জব্দ করা হবে। আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার আইনি সুযোগ আছে। শাস্তি হিসেবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা যাবে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২৪টি প্রতিষ্ঠান আমদানিকৃত কাঁচামালের যে দাম উল্লেখ করে ঋণপত্র বা এলসি খুলে অর্থ পাঠিয়েছে, প্রকৃতপক্ষে আমদানি করেছে তার চেয়ে কম দামের ও কম পরিমাণের পণ্য। আমদানিকারকরা গোপনে বিদেশে নিজস্ব মালিকানাধীন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান খুলে তার অনুকূলে দাম হিসেবে অর্থ পাঠিয়েছে। এ অবৈধ কারবারে ব্যাংক, বন্দর ও এনবিআরের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার এবং এনবিআর সদস্য ড. শহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করতে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে। তবে আইনি প্যাঁচে অনেক সময় তাদের শাস্তির আওতায় আনতে সময় লেগে যায়। এ বিষয়ে আরও কাজ করার সুযোগ আছে।
বন্ড দুর্নীতি চিহ্নিত করতে প্রিভেন্টিভ, নিয়মিত ও বিশেষ অডিট করা হয়। এসব অডিটে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর চূড়ান্ত তদন্ত করা হয়। তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহে মাস থেকে বছরও পার হয়ে যায়। এরপর শুনানির জন্য অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়। তারপর মামলা হয় এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলা নিষ্পত্তিতে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। রায় হওয়ার পর যেকোনো পক্ষের উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ আছে। আটকে থাকা মামলার সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে।
এনবিআর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে বন্ড দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আইন সংশোধনসহ এনবিআরকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আর কখনো রাজনীতিতে জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। মুচলেকা দিয়ে এ কথা বলেছে তারা। সংগঠনটির নেতারা আরও বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের অংশও হবেন না তারা। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রকাশ্য বা গোপন কোনো সম্পর্কেই জড়াবে না হেফাজতে ইসলাম।
হেফাজতে ইসলাম বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে। শর্তে তারা বলেছে, হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ যেসব নেতা কারাবন্দি রয়েছেন তাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে হবে এবং মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম গত বছর ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে এ মুচলেকা দেয় এবং এসব শর্ত বা দাবি জানায়।
আগে হেফাজত নেতারা তিন মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তারপর দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে মুচলেকা দেন। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা হেফাজতের মুচলেকা দেওয়ার কথা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন। সরকারের সহযোগী হিসেবে থাকার অঙ্গীকার করেছে হেফাজত।
১৪ দলের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশনের নেতা নজিবুল বশর মাইজভা-ারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়; তারা রাজনীতি করবে না। কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তারা জোটবদ্ধও হবে না।
হেফাজতে ইসলাম আরও কিছু শর্ত দিয়েছে, যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে এবং বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোর বৃহত্তম বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক) সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার ও তাদের মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে মামুনুল হক এবং আরও কয়েকজনকে এখনই মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছে সরকারি মহল। একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মামুনুলকে ছাড়তে হবে, যা সময়সাপেক্ষ।
সূত্রে আরও জানা গেছে, কাদিয়ানি সম্প্রদায় বিষয়ে হেফাজতের দাবি আপাতত আমলে নেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের অমুসলিম ঘোষণা করা হলে বিদেশি চাপ আসবে। যে চাপ সামলানো প্রায় অসম্ভব। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ঝামেলায় জড়ানো যাবে না বলে হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে। বেফাক ইস্যুতেও আপাতত কোনো উদ্যোগ নিতে চায় না সরকার। বেফাককে সরকারি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মানাও আপাতত অসম্ভব, জানিয়েছে সরকার। তবে হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, অন্য শর্তগুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
হেফাজত নেতাদের বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিভিন্ন অপপ্রচার চলছে সরকারের বিরুদ্ধে; এসব ব্যাপারে কথা বলতে হবে তাদের। জামায়াতবিরোধী অবস্থান নিয়ে কাজ করতে হবে হেফাজতকে। হেফাজত নেতারা বলেছেন, জামায়াত ইস্যুতে তারা কোনো ছাড় দেবে না। জামায়াতকে তারা ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে না।
বলা যায়, হেফাজতের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক বোঝাপড়া হয়েছে। এটা একটা ‘পলিটিক্যাল ডিল অর আন্ডারস্ট্যান্ডিং’। জানা গেছে, এ সমঝোতার ভিত্তিতেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ২০৩টি মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে এবং নেতারা জামিন পেতে যাচ্ছেন। এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার।
২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় এখনো তদন্ত হচ্ছে ২০৩টি মামলার। অনেক দিন ধরেই তদন্ত হচ্ছে। কিন্তু সুরাহা করতে পারছে না তদন্তকারী সংস্থাগুলো। হেফাজত নেতাকর্মীদের অনেকে কারাগারেও আছেন। তবে বেশিরভাগ আসামি প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন।
পুলিশের পাশাপাশি হেফাজত নেতারা মামলাগুলো নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত। তারা এগুলোর নিষ্পত্তি চান। এ নিয়ে কয়েক দফা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন হেফাজত নেতারা। সর্বশেষ গত ১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে হয়েছে। বৈঠকে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির অনুরোধ জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
সরকারের নির্দেশনা পেয়ে পুলিশও কাজ শুরু করে দিয়েছে। গত এক মাসে অন্তত ১০ জন নেতা জামিন পেয়েছেন। তারা যেকোনো সময় কারামুক্ত হবেন। তবে মামুনুল হক আপাতত মুক্ত হচ্ছেন না।
হেফাজত নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তারা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও ‘সবুজ সংকেত’ দিয়েছেন। তারা বলেন, এসবের জন্যই সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়েছি আমরা। তবে সমঝোতার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, হেফাজতের মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে মৌখিক নির্দেশনা পাওয়া গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার পরিকল্পনা আছে আমাদের। হেফাজত নেতারা সরকারের অঙ্গীকার করেছে, তারা রাজনৈতিক কর্মকা- চালাবেন না। শুধু ইসলাম নিয়ে কথা বলবেন। জামায়াতে ইসলামীর কর্মকা-ের সমালেচনাও করবে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্বস্ত করেছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন তদন্তকারী কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশনা এসেছে। আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। মামলাগুলোর অনেক আসামি জামিনে আছে, কেউ কেউ জামিন ছাড়াই প্রকাশ্যে ঘুরছে। দীর্ঘদিন ধরে মামলাগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ায় সমালোচনাও হচ্ছে সবখানে। এগুলোর দ্রুত সুরাহা চাচ্ছি আমরাও।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ করে তারা। একপর্যায়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। সে সময় হেফাজতের বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থকের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। তারা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন ভাঙচুর করে এবং বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সহিংসতায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
২০২১ সালের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। ২৬ মার্চ রাজধানীর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। সংঘর্ষে ১৯ জনের মৃত্যু হয় এবং পুলিশসহ সহস্রাধিক হেফাজত নেতাকর্মী আহত হয়। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হয় সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায়। এসব ঘটনায় সারা দেশে ১৫৪টি মামলা হয়। ওইসব মামলার কোনোটাতেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
হেফাজত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসখানেক আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই ছিলেন। বৈঠকে আমরা বলেছি, আমরা কোনো ধরনের রাজনীতি করি না। ইসলাম নিয়ে কাজ করি। একটি মহল আমাদের নামে অপবাদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি, আমরা রাজনীতি করছি না, আর করবও না।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশ রূপান্তরকে বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। আমরাও চাচ্ছি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। হেফাজতের কেন্দ্রীয় এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমরা গত ১৭ ডিসেম্বর বৈঠক করেছি। তাতে সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট বৈঠক হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। আমাদের শর্তও তাকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, সমঝোতা ছাড়া কোনো কিছুরই সমাধান হয় না। আমরা চাই না সরকারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হোক। আমরা কথা বলেছি। সরকারপ্রধান ইতিবাচক হিসেবে বিষয়টি আমলে নিয়েছেন।