
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও খাদ্যনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. গোলাম রসুল। তিনি বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকার অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। সরকার বলছে আমনের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বাড়ায় বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ; অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ^জুড়ে। মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার মুখে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সহ-সম্পাদক সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতি ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়াদির মধ্যেই সুখবর পাওয়া গেল যে, আমনের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বাড়ায় বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে এবারে গত বছরের চেয়ে ১৩ লাখ টন আমন বেশি হবে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
গোলাম রসুল : আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে যে গত বছরের তুলনায় আমন ১৩ লাখ টন বেশি হবে, এটা আমার কাছে মনে হচ্ছে ইনকনক্লুসিভ। অসম্পূর্ণ, সিদ্ধান্তে আসার মতো কিছু না। এই সেন্সে যে, আমনের হারভেস্ট শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা এবার জানি, বাংলাদেশে এবার আমন চাষের সময় সমস্যা ছিল। বৃষ্টি ছিল না, সারের দাম, ডিজেলের দাম বাড়ল, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানল, উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও রিপোর্ট পাচ্ছি যে দেশের নর্থ-ওয়েস্টার্ন এলাকা রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর বেল্টে আমাদের আমন ধানটা ভালো হয়েছে। আমরা আশা করতে পারি যে ফলন আগের বছরের তুলনায় একটু বেশি হবে, কিন্তু কতটুকু বেশি হবে এটা আমার মনে হয় এখনো বলা যাবে না। কারণ আমরা এট দ্য সেইম টাইম দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের কোনো কোনো এলাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লাসহ আরও কোনো কোনো এলাকায় আমন উৎপাদন কম হচ্ছে। যদিও উপকূলীয় এলাকায় আমন ধান কম চাষ হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এবং অন্যান্য সব কিছু মিলিয়ে যে এফেক্ট তাতে নিট প্রোডাকশন কী হবে সেটা বলার জন্য মনে হয় আরেকটু সময় লাগবে। মাত্র তো ফসল তোলা শুরু হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : এ বছর বেশ দীর্ঘ খরা ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পাশাপাশি ছিল বিদ্যুৎ সংকট। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ও আঘাত হেনেছে। সরকার বলছে সেচ ও সেচ পাম্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমন উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আপনার মত কী?
গোলাম রসুল : এটা ঠিক যে আমাদের ইরিগেশন ও পাম্পিংয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার চেষ্টা করছে এবং অনেক জায়গায় সেটা করেছেও। কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে বিদ্যুতের বাইরেও কিন্তু বিরাট ইরিগেশন এরিয়া রয়েছে। এখনো আমাদের অধিকাংশ এলাকার ইরিগেশন হয় যে শ্যালো টিউবয়েলের মাধ্যমে, সেটা কিন্তু চলে ডিজেলে। যখন জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ে সেটা তাদের এফেক্ট করে। তারা সেচ করছে ডিজেলের মাধ্যমে, লাখ লাখ শ্যালো টিউবয়েল রয়েছে যারা বিদ্যুতের কানেকশন পায়নি। ফলে এখানে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ কতটুকু ভূমিকা রেখেছে তা পরিষ্কার না।
দেশ রূপান্তর : উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে অনেক কৃষক ধান চাষ বাদ দিয়ে অন্য লাভজনক ফসল উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকছে। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, অতিবৃষ্টি বন্যা তো রয়েছেই। প্রতি বছর দেশের কৃষিজমিও কমছে। এর মধ্যেও প্রতি বছর ধান উৎপাদন বাড়ছে, এর কারণ কী?
গোলাম রসুল : প্রতি বছর ধান উৎপাদন বাড়ছে এটা ঠিক। কিন্তু কৃষকদের ধান উৎপাদনে আগ্রহটাও কমে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে আশি-নব্বইয়ের দশকে যে সমস্ত জমিতে রবিশস্য হতো, মসুর ডাল হতো, সেগুলোতে ইরিগেশনের ফলে ধান চাষ শুরু হলো। এতে ধানের উৎপাদন বাড়ল। আমরা যখন ইরিগেশন ফ্যাসিলিটিজ দিতে পারলাম, শ্যালো টিউবয়েল স্থাপনের একটা বিপ্লব হলো, তখন অন্যান্য ফসল যেসব জমিতে হতো, সেগুলোতে ধান চাষ বাড়ল, উৎপাদন বেশি হলো। আমাদের ধান উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে মেজর রোল প্লে করছে ইরিগেশন। দেশে ড্রাই সিজনে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চে ধান চাষ করা যেত না পানির অভাবে। ইরিগেশনের ফলে ওইসময়ও ধান চাষ করা গেল। দুই নম্বর কারণ হলো নতুন নতুন উন্নত জাতের ধানের বীজ আমরা উৎপাদন করতে পারছি। এসব উন্নত জাতের ধানের চাষের ফলে ফলন বাড়ছে। কিন্তু আমরা এখন যদি দেখি, যেসব জমিতে বহু বছর ধরে এসব উচ্চফলনশীল ধান চাষ করা হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে। তারপর যদি লক্ষ করেন, কৃষকরা প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় অধিকমাত্রায় সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছে। যেটা একসময় একটা আনসাসটেইনেবল জায়গায় চলে যাবে। সত্তর এবং আশির দশকে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের ব্যবহার অনেক কম ছিল। কিন্তু এখন আমরা সাউথ এশিয়ার মধ্যে রাসায়নিক সারের ব্যবহারে টপে চলে গেছি মনে হয়। কৃষক এটা ব্যবহার করছে কারণ জমির যে উর্বরতা কমে যাচ্ছে, সেটাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। এটা আরেকটা ফিউচার কনসার্ন।
দেশ রূপান্তর : চলতি বছর প্রতি কেজি আমন চাল উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৪১ টাকা ৫৮ পয়সা; যা গত বছরের তুলনায় ৫৮ পয়সা বেশি। চলতি আমন মৌসুমে ধানের দাম কেজিতে ১ টাকা এবং চালের দাম ২ টাকা বাড়িয়ে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। সরকার নির্ধারিত এই মূল্য কি ঠিক আছে?
গোলাম রসুল : আমার কাছে, এখন, আমি জানি না, আমাদের কৃষি ডিপার্টমেন্ট এই এসেসমেন্টটা কীভাবে করেছে। তারা হয়তো প্রোডাকশন কস্ট হিসাব করে বের করেছে...। কিন্তু আমরা যখন বিভিন্ন জায়গায় যাই, গ্রাম এলাকায় যাই, কৃষকদের সঙ্গে কথা বলি সেখানে কৃষকদের যে হিসাব তাতে এই দামে তাদের উৎপাদন খরচই কভার করে না। প্রফিট বাদ দেন, খরচই ওঠে না। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা খরচের যে হিসাবটা করি সেখানে আমরা একটা জিনিস হিসাব করি নাÑ কৃষকদের যে লেবারটা যায়, প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে কৃষকের যে শ্রমটা যায়, সেটার হিসাব আমরা করি না। আমরা কেবল খরচের হিসাব করি। এখন যে সমস্ত ফ্যামিলিতে দুই/তিনজন লোক আছেন তারা হয়তো অন্যদের জমিতে কাজ না করে নিজেদের জমিতে কাজ করছেন এবং তারা তাদের শ্রমের হিসাবটা ধরছেন না, তারা সার্ভাইব করছে। কিন্তু এটাকে আমাদের ধান-চালের প্রোডাকশনকে যদি আপনি কমার্শিয়ালি দেখেন তাহলে দেখবেন এটা তেমন লাভজনক না। বেশি লাভজনক না বলেই কিন্তু দেখবেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধান ক্ষেতকে কেটে পুকুর বানানো হচ্ছে, মাছ চাষ করছে, অনেকে ফলমূল চাষ করছে, ধান চাষ থেকে সরে যাচ্ছে এসব কারণে। ধান চাষ যদি লাভজনক হতো, কৃষকরা তো অন্যদিকে যেত না। ধানচাষ লাভজনক না হওয়াতে লং রানে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে কিন্তু রিস্ক তৈরি হচ্ছে। আমার মনে হয়, আমরা যখন ধানের দাম নির্ধারণ করি তখন কৃষককে রিজনেবল প্রফিট দিয়ে দামটা ঠিক করা উচিত। এবার এখন পর্যন্ত আমি যা শুনেছি, অলরেডি মার্কেটে ১৩০০/১৪০০ টাকা মণ ধান। এবং সরকারের যে হিসাব প্রায় ১০০০ টাকার মতো, সেটা ৩/৪০০ টাকা আরও কমে যাচ্ছে বাজারদর থেকে। এই দামে কী করে সরকার যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ করতে পারবে বুঝতে পারছি না। কৃষকরা তো মার্কেটের চেয়ে কম দামে তার ধান বিক্রি করবে না। আরেকটা পয়েন্ট যেটা আমি বলতে চাই, এই সময় আমরা যদি প্রকিউরমেন্ট প্রাইসটা একটু হাই না রাখি এবং কৃষকদের যদি আমরা এখন এই সাপোর্টটা না দিই তার নিজস্ব মজুদের জন্য- তাহলে তো হবে না। সরকার মজুদ করছে সরকারের রিজার্ভে রাখার জন্য, কিন্তু আমাদের দেশে যে লাখ লাখ কৃষক আছেন যারা ধান উৎপাদন করেন, তারা আর্থিক অনটনের কারণে, দেনার কারণে তারা ধানটা বিক্রি করে দিচ্ছেন কম দামে। এতে তারা লুজার হচ্ছেন। এটা যদি তারা তিন/চার মাস ধরে রাখতে পারতেন, তারা বেশি দাম পেতেন। এখন সরকার তাদের একটা ঋণ দিতে পারে কয়েক মাসের জন্য। তারা এখন যে ডিপ্রেসড সেল করছেন, কিছু টাকা থাকলে তারা এটা করতেন না। তারা ফসল ধরে রাখতে পারলে একদিকে কৃষক পর্যায়ে স্টোরেজটা বাড়ত, অন্যদিকে সরকারের ওপর চাপ কমত। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিরাট একটা উদ্যোগ হতে পারত। এখন কৃষকরা ধান উৎপাদন করে টাকার অভাবে সেটা কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন কিন্তু তিন/চার মাস পরেই তাকে সেটা বেশি দামে কিনে খেতে হবে। এই যে ডিপ্রেসড সেলিংয়ের যে ক্রাইসিস, এটাকে থামানোর জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল।
দেশ রূপান্তর : সরকার দেশের ভেতর থেকে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও বিদেশ থেকেও চাল আমদানি করা হবে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
গোলাম রসুল : আমার মনে হয় এবার অন্য বছরের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। অন্য সময় হলে আমি হয়তো বলতাম এটা আমদানি করার দরকার নেই। কিন্তু এ বছর আমরা যদি গ্লোবাল মার্কেটটা দেখি, সেটা খুবই আনস্ট্যাবল। আমরা জানি না যে আগামী দুই বা তিন মাস পর মার্কেটটা কী রকম হবে। গত এক/দুই মাস একটু বেটার আছে যদিও। কিন্তু এ বছর বিভিন্ন দেশে শুনছি যে আবহাওয়ার কারণে খাদ্য উৎপাদন কম হয়েছে। শুনছি চীনে, ভারতে, ইউরোপে কম হয়েছে, আমেরিকাতেও কম হয়েছে। কাজেই এটার প্রভাব ২০২৩ সালে পড়তে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি আমদানি করে সেটা ভালো।
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি রুশ নৌবহরের ড্রোন হামলার অভিযোগ তুলে শস্য রপ্তানি চুক্তি স্থগিত করার হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। তো সেটা রাশিয়া করুক বা না করুক, প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধাবস্থায় যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ফলে যুদ্ধ-পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে কী করা উচিত?
গোলাম রসুল : রাশিয়া যদি এই চুক্তি থেকে সরে আসে বা অন্য কোনো কারণে যদি কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো থেকে শস্য রপ্তানি ফের বন্ধ হয়ে যায় সেটা গ্লোবালি খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। আমরা আশা করি এটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রিনিউ করা হবে। এটা স্ট্যাবল না থাকলে একদিকে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, অন্যদিকে আমদানির মাধ্যমে স্টক বাড়াতে হবে। একটা বাফার স্টক তৈরি করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও ডলার সংকটের মধ্যেই নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছে সরকার।
এছাড়া রয়েছে আইএমএফের ঋণের শর্তে অর্থনৈতিক সংস্কারের বাধ্যবাধকতা। নানা কারণেই এবারের বাজেট বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। প্রস্তাবিত এই বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী।
আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিনবারের শাসনামলের মধ্যে এবারই বাজেটের আলাদা গুরুত্ব কী?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই বাজেটের গুরুত্ব অনেকগুলো। প্রথম কথা হলো যেহেতু তিন ধাপে এই সরকার প্রায় ১৫ বছর দেশ চালিয়েছে, তো এই দেড় দশকে তার অর্জনকে এই বাজেটের ভেতর দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। তো, সেই চেষ্টাটা হয়েছে। দ্বিতীয়ত হলো যেহেতু এইটা নির্বাচনের আগে সরকারের শেষ বাজেট সেহেতু নির্বাচনকে মাথায় রেখে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে বিবেচনায় নিয়ে সে কিছু কথা বলবে, কিছু পদক্ষেপ নেবে এটাও প্রত্যাশিত, স্বাভাবিক। আর এই বাজেটের গুরুত্বের জায়গা হলো আইএমএফের সঙ্গে চুক্তি করার পরে সরকারের এটা প্রথম বাজেট। ফলে এক ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতির কাঠামোর ভেতরে সে বাজেট প্রস্তুত করেছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে। সেইটা হলো নতুনত্ব।
তো সর্বোপরি হলো দেশের ভেতরে এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই জটিল। যা আমরা সবাই জানি। মূল্যস্ফীতি মানুষকে বিপর্যস্ত করছে। দেশে যথেষ্ট পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় আমরা জ্বালানি আমদানি করতে পারছি না। সেজন্য আমাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু থাকতে পারছে না। লোডশেডিং হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আমাদের দেশের ব্যাংকব্যবস্থা একেবারেই ভঙ্গুর এবং সেখান থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ হওয়ার মতো অর্থ ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা পাচ্ছে না। দেশের বৈদেশিক লেনদেনের পরিস্থিতি খুবই চাপের মধ্যে থাকায় টাকায় মূল্যমান পড়ে যাচ্ছে... ইত্যাদি। তো অর্থনৈতিক এই পরিস্থিতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূ-কৌশলগত ব্যাপার। বিভিন্ন দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক রেষারেষির প্রতিফলন এখন আমরা বাংলাদেশের মধ্যেও দেখতে পাই। অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এটাও বিবেচনায় নিতে হয়। এ ধরনের বেশ কিছু গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিত এবারের বাজেটে আমি দেখতে পাচ্ছি।
বাজেট প্রস্তাব পেশের আগে থেকেই আইএমএফের শর্তেও বিষয়গুলো আলোচনায় ছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে সেসব শর্তের প্রতিফলন কেমন দেখছেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সবচেয়ে বড় প্রতিফলন হলো হঠাৎ করে সরকার কর আহরণের জন্য জেগে উঠেছে। বাংলাদেশের কর জিডিপির অনুপাত তুলনীয় দেশের চাইতে অন্যতমভাবে কম। এটা আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি। কিন্তু এবার আমরা প্রথম লক্ষ করলাম সরকার কর আহরণের জন্য বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এমন বেপরোয়া হয়েছে যে আপনার করযোগ্য আয় না থাকলেও তাদের ওপর ২০০০ টাকা করে কর আরোপের চিন্তা করেছে। এইটা একটা যেমন।
দ্বিতীয়ত, অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতার ভেতরে বেশ কিছু কথা আছে, যেটাতে দেখা যায় যে আইএমএফের সঙ্গে আমাদের যে সমস্ত শর্ত বা প্রতিশ্রুতি আছে তার প্রতিফলন রয়েছে। যেমন, টাকার মূল্যমানের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের সামঞ্জস্যকরণ, একীভূতকরণ। আমাদের ব্যাংকের যে নয়-ছয় সুদের হার বেঁধে দেওয়া আছে তাকে সুদের করিডরে নিয়ে আসা। নতুনভাবে মুদ্রানীতির চিন্তা করার প্রতিশ্রুতি। যেখানে আগে আমরা ঋণপ্রবাহের ওপর মনোযোগ দিতাম, এখন মূল্যস্ফীতির ওপর মনোযোগ দেব।
এছাড়া আমাদের দায়দেনা পরিস্থিতি সম্বন্ধে মূল্যায়ন, ব্যয় কাঠামোর খাত নিয়ে আমাদের যেখানে করের বিভিন্ন রেয়াত আছে সেগুলোকে কীভাবে সামঞ্জস্যকরণ করা যায় ইত্যাদি বহু বিষয় আছে যেটাকে আইএমএফের শর্তের প্রতিফলন হিসেবে দেখা যায়।
রিটার্ন জমা দিলেই ২০০০ টাকা কর দিতে হবে। আবার সাড়ে ৩ লাখ টাকা করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তাহলে ন্যূনতম করমুক্ত আয়ের সীমা কোনটি?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এটা তো প্রত্যক্ষভাবেই বৈপরীত্য আর কি। আইন অনুযায়ী সাড়ে তিন লাখ টাকার যে করমুক্ত সীমা সেটাই কার্যকর হওয়ার কথা। আর ওনারা যেটা বলছেন, সেটা হলো যে সরকারের বেশ কিছু পরিষেবা যিনি পাবেন তার সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় আছে তা মনে করতে হবে। সেটাও ঠিক আছে।
কিন্তু... কেউ যদি পরিষেবা নাও নেয়, শুধু মাত্র এলাকাতে থাকবে এজন্যও সে বাধ্য হতে পারে রিটার্ন দিতে...
বিষয়টা তো খুবই বিস্তৃত। ব্যবসা বা যে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে এই ৪৪ সেবা যে কারোর লাগতে পারে। ট্রেড লাইসেন্স করা থেকে শুরু করে সঞ্চয়পত্র কেনা, ১০ লাখ টাকার বেশি আমানত, জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচা, সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি পর্যন্ত। এছাড়া রয়েছে, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ, মোটরসাইকেলের নিবন্ধন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কেনাবেচা...।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ওই যে বললাম, কর আদায়ের জন্য সরকার হঠাৎ করে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এবং যেটা আইএমএফের কাছে জিডিপির আড়াই শতাংশ করে কর বাড়ানোর যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি সেটা পালনের চেষ্টা থেকে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। এই পদক্ষেপগুলোকে আরও বৈপরীত্যমূলক এজন্য যে, ধনী ও সম্পদশালীদের সম্পদের যে সারচার্জ থাকে সেখানে কিন্তু রেয়াত দেওয়া হয়েছে। তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি করা হয়েছে। নিম্নআয়ের মানুষের আয়ের ওপরে যেভাবে আমরা চাপ দিলাম, সেখানে আমরা সম্পদশালীদের সম্পদের ওপর থেকে আবার সেই চাপটা তুলে নিলাম।
একটার বেশি গাড়ি থাকলে যে দ্বিগুণ করের ব্যাপারটা...?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি এটার বিরুদ্ধে না।
যদি এমন হয় যে, পরিবারে স্বামী-স্ত্রীসহ ছেলেমেয়ে মিলিয়ে চারজন রয়েছে। তো একেকজনের নামে একটা করে গাড়ি থাকলেও তো চারটা গাড়ি...?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ওনারা বলতে পারবেন যে- পরিবার হিসেবে না যেহেতু আলাদা আলাদা হিসেবে ওনারা কর দেন সেহেতু ওনাদের আলাদা হিসেবে এটা বিবেচিত হবে। আমি তো তাই আন্দাজ করি। ব্যক্তিগত গাড়িতে আপনি যতই কর ধরেন না কেন বিষয়টা হলো অন্য জায়গায়, যদি দেশের ভেতরে গণপরিবহন সুলভ ও শোভন না হয় তাহলে তো মানুষ গাড়ি কিনেই চলার চেষ্টা করবে।
সেহেতু যেটা মনে রাখতে হবে, যখন আমরা প্রত্যেক সময়ে করের কথা বলি তখন একইসঙ্গে সরকারের ব্যয়ের গুণমান সম্পর্কেও আমাদের কথা বলতে হবে।
একটি বাড়তি করের টাকা দিলে প্রত্যেক করদাতা চিন্তা করে যে, এর বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে সে কী পেতে যাচ্ছে। তো বাজেট বক্তৃতায় সেই জায়গায় আমি কোনো গুরুত্ব দেখি না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, সামাজিক সুরক্ষা, নাগরিক নিরাপত্তা এ সমস্ত ক্ষেত্রে মানুষের যে অভিযোগ, অসন্তোষ আছে, সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সেবা-পরিষেবার গুণমানকে ভালো করার মাধ্যমে কর আহরণের জন্য প্রণোদিত করা এমন কোনো কৌশল তো আমি লক্ষ করি না।
এখন তো বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা একটা বড় ইস্যু। তো আইএমএফের শর্তের কারণেই হোক বা যে কোনো কারণেই হোক কৃষকের ভর্তুকি কমানো কি ঠিক হয়েছে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন পর্যন্ত শক্তির একটা জায়গা তো আমাদের শস্য উৎপাদন। এখানে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। লক্ষ রাখার বিষয় যে এই অর্থনৈতিক সংকটের সময় এই খাত যেন দুর্বল হয়ে না যায়।
তাই সরকারের পক্ষ থেকে যতই বিভিন্ন জায়গা থেকে ভর্তুকি কমানোর কথা হোক না কেন সেচের বিদ্যুৎ, ডিজেল, উৎপাদনের জন্য সার, কীটনাশক, বীজ এসবের যেন কোনো টান না পড়ে এটা লক্ষ রাখা উচিত। বাজেটের ভেতরে এই কথাগুলো খুব স্পষ্টভাবে নেই, যে কৃষককে আমরা যেসব সমর্থন দিই সেটা তো কমাবই না বরং এই সময়ে সেগুলো বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
আরেকটা বড় জায়গা যেটা আছে, সেটা হলো কৃষকের কাছ থেকে আমরা যে ধান-চাল, শস্য সংগ্রহ করি সেটার লক্ষ্যমাত্রা আমাদের কোনো সময়ই পূরণ হয় না। এখানে কৃষককে হয়রানি করা হয়, মধ্যস্বত্বভোগীরা থাকে, মিলাররা থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। তো বাজারকে সুসম বা আরও মসৃণ করা বা কার্যকর করার ক্ষেত্রেও আমরা কিন্তু কোনো ধরনের পদক্ষেপের কথা শুনি না।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির যে অঙ্ক অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবে পেশ করেছেন তা অর্জন কি সম্ভব বলে মনে করেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: একটিও বাস্তবসম্মত না। প্রথম কথা হলো উনি জিডিপি সাড়ে ৭ শতাংশ বলেছেন, সেটা বাস্তবতার নিরিখে মেলে না। এবং এটা মেলাতে গিয়ে উনি ব্যক্তি বিনিয়োগের একটা অবাস্তব সংখ্যা দিয়েছেন। এটাও মেলে না। সবচেয়ে বড় কথা মূল্যস্ফীতিকে ৬ শতাংশে আনতে হলে এখন যে ৮ বা ৯ শতাংশ যে মূল্যস্ফীতি চলছে সেটার খুব দ্রুত তিন মাসের মধ্যে নিচে নেমে আসতে হবে। এটা তো বাস্তব না। সেহেতু উনি এই অর্থবছরের যে গড় মূল্যস্ফীতি বলেছেন- সেটা মোটেও বাস্তবসম্মত না।
আগামী বছরের প্রবৃদ্ধিও যে প্রাক্কলন করেছেন সেটাও অত্যন্ত উচ্চাশার। এটার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু সেই অবাস্তব ভিত্তিকে স্থাপন করার জন্য যে বিনিয়োগের সংখ্যা বলেছেন ব্যক্তি খাতের, ওইটা কেউ কল্পনার মধ্যেও আনতে পারবে না। আর ওই বিনিয়োগকে কার্যকর করার জন্য যে ধরনের ঋণ প্রবাহ থাকা দরকার, যে ধরনের আমদানি ইত্যাদি করতে হতে পারে সেটা সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের ব্যাংকগুলোর নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও নেই।
বৈশ্বিক বাস্তবতা, মূল্যস্ফীতি, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভসহ নানামুখী চাপের মধ্যে সরকারের ‘স্মার্ট বাজেট’ কতটুকু স্মার্টনেস দেখাতে পেরেছে?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি তো মনে করি যে স্মার্ট হওয়ার জন্য যে ন্যূনতম প্রসাধন দরকার পড়ে, ওনারা সেই প্রসাধনটাও ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেনি। আমার অত্যন্ত দুঃখ লাগে, পরিতাপ হয় যে সরকার গত ১৫ বছরে অনেক ভালো কাজ করেছে, সেই ভালো কাজগুলোর সম্মিলিত যে প্রশংসা যেটা পাওয়ার কথা ছিল এই বাজেটের মাধ্যমে, এই নির্বাচনের প্রাক্কালে সেটা সরকার নিতে পারল না।
নির্বাচনী বাজেটের যে প্রবণতা আমরা দেখে আসছি, সামনে তো নির্বাচন যার কথা আপনিও উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি, জনতুষ্টির বিষয় থাকে। তো আগের নির্বাচনী বাজেটের সফলতা বা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের যে ফলাফল তার সাথে এবারের বাজেটের তুলনা কীভাবে করবেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এক কথায় বললে এইবারের বাজেট, নির্বাচনী বাজেট হয়নি। প্রথম কথা হলো আগের দুই নির্বাচনী বাজেট, ২০১৪ এবং ২০১৮ এর, তার ভালো-মন্দ বিচারে আমি যাচ্ছি না। ওই সময় অর্থনীতির যে শক্তি ছিল, প্রবৃদ্ধিও হারের যে গতি ছিল, বিনিয়োগ ছিল, মূল্যস্ফীতি নিচে ছিল, বৈদেশিক লেনদেনের যে শক্তি ছিল- সেগুলোর কিছুই এখন নেই। সেহেতু এই বছরের নির্বাচনের প্রাক্কালে আগের দুই নির্বাচনের আগের বাজেটের মতো আচরণ করার পরিস্থিতিও সরকারের ছিল না।
তা সত্ত্বেও যতটুকু ছিল, সেইটুকুও করার মতো সাহস বা উদ্যোগ আমরা দেখিনি। কারণ, যেহেতু বাজেট ঘাটতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আছে, জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশের আশপাশে, সেহেতু টাকা ঋণ করে হলেও একটু চেষ্টা করতে পারত সরকার। দুঃখের বিষয় হলো টাকা ঋণ করে নেওয়ার জায়গাটাও সেই অর্থে সীমিত। আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতিতেও সরকার টাকা না ডলার কোনোটাই সে মেলাতে পারেনি। আর তারপরও যেটুকু যা আছে, সেটুকুও যে খুব ভালোমতো খরচ করতে পারবে সেই বিশ্বাসও বোধহয় সরকারের নেই। সেজন্য এটা কোনো নির্বাচনী বাজেট হয়নি।
নির্বাচনী বাজেট করার জন্য যে ধরনের জনতুষ্টিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য যে মনকাড়া বিভিন্ন চিন্তা থাকে- বাজেটে সে ধরনের কোনো চিন্তাও নেই। কারণ হলো আমি সন্দেহ করি যে এই বাজেট কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দিয়ে তৈরি হয়নি। রাজনীতি অংশের মানুষরা যদি যুক্ত থাকতেন তাহলে আমি নিশ্চিত যে ওনারা সেই সমস্ত বিষয় ও চিন্তা এই বাজেটে সন্নিবেশিত করতেন। এটা আমার ধারণা।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী- এই ট্রিলজি কয়েক প্রজন্মের বাঙালি পাঠককে মোহিত, তাড়িত ও অনুপ্রাণিত করেছে। এর বাইরে অনেক পাঠকপ্রিয় উপন্যাস ও গল্প লিখেছেন সমরেশ মজুমদার।
সোমবার আমাদের ছেড়ে চলে যান এ কথাসাহিত্যিক।
তার জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ মার্চ। ছেলেবেলা কেটেছে জলপাইগুড়ির ডুয়ার্সে। পড়েছেন স্কটিশ চার্চ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পাঠকপ্রিয় এ ঔপন্যাসিক ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা এসেছিলেন। তখন ঢাকা ক্লাবে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ।
দেশ রূপান্তর: আপনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দারুণ জনপ্রিয়। সমকালীন তিন প্রজন্মের চিন্তা, স্বপ্নকে প্রভাবিত করেছেন। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
সমরেশ মজুমদার: আপনার বাসার কোনো মেয়ে যদি ভালোবেসে প্রেগনেন্ট হয়, বিয়ে থা না করে এবং একটা বাচ্চার মা হয় আপনি তাকে একসেপ্ট করবেন? আপনার বোনের ক্ষেত্রে ঘটলে আপনি একসেপ্ট করবেন? যারা বলবেন একসেপ্ট করবেন, তারা জেদের বশে বলবেন। কিন্তু জীবনের সত্য এটা না। আপনি এমন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না এবং তাকে আপনি আদর করে বাসায় ডাকবেন না। আপনি যদি বলেন, হ্যাঁ ডাকব তবে আপনি মেকি কথা বলছেন। এই কথাটা আপনি আপনার স্ত্রীর সামনে, আপনার বাবার সামনে বা আপনার মায়ের সামনে বলতে পারবেন না। আপনি নিজেকে প্রগতিবাদী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য পাবলিকলি বলতে পারেন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে বলবেন না। আর একটা সমীক্ষা বলছে, দুজন করে পাঠক একটা বই পড়লে কালবেলা উপন্যাসটা দশ লক্ষ পাঠক পড়েছে। একটা সমীক্ষা বলছে, মাধবীলতা একসেপ্টেড বাই অল রিডার্স, প্রত্যেক পাঠকই মাধবীলতার ফ্যান। জীবনে যাকে একসেপ্ট করতে পারব না, বাসায় যাকে নিয়ে যেতে পারব না, তার ফ্যান কেন হচ্ছি? মানুষ তো ফ্যান হয় তারই যার আইডিয়া সে অনুসরণ করে, যার কাজকর্ম সে রেসপেক্ট করে, যাকে ভালোবাসে। মাধবীলতার কাজকর্ম আমি একসেপ্ট করি না অথচ তার জীবন নিয়ে লেখা উপন্যাস আমি পয়সা খরচ করে কিনি। বলি, আহা কালবেলা আমার প্রিয় উপন্যাস। এটা কি মিথ্যাচার নয়?
এমন হতে পারে আমি যা করতে পারি না, আমার পছন্দের চরিত্র তা করছে বলে আমি তার ফ্যান। আমার কল্পনার জগতে সে কাজ করতে পারে।
সমরেশ মজুমদার: আপনি যুদ্ধের ময়দানে গিয়ে দশটা সৈন্যকে মোকাবিলা করে আসতে পারেন না। কিন্তু আরেকজন সেটা পারলে আপনি তাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করেন। কিন্তু এখানে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এক সঙ্গে পড়ত। তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ল। তাদের শারীরিক সম্পর্ক হলো। ছেলেটা মেয়েটার দায়িত্ব নেয়নি। না নিয়ে সে রাজনীতি করছিল। এত দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে। সে যে মেয়েটির জীবনে এত বড় একটা সর্বনাশ করল তা নিয়ে তার জীবনে কোনো অনুতাপ এলো না। তারপর তিন বা চার বছর পর সে যখন জেল থেকে বেরিয়ে জানল, সে যে কাজটি করেছে তা থেকে একটা শিশুর জন্ম হয়েছে তখন সে বলল, আমার উচিত তোমাকে বিয়ে করা। মেয়েটি তাকে রিফিউজ করল। বলল, বিয়ে করার কথা বলে তাকে সে অপমান করেছে। মেয়েটির এই অ্যাডামেন্ট অবস্থানের কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছি না। কেন এখন বিয়ের কথা বললে সে অপমানিত হবে। আমি লজিক খোঁজার চেষ্টা করছি, কেন এই উপন্যাসটা লোকে গ্রহণ করেছে?
এমন হতে পারে, লোকে পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিত এতে পেয়েছে।
সমরেশ মজুমদার: কলকাতা শহরে বাড়িঅলার কাছে ভাড়া চাইতে এলেন দুজন। ভদ্রলোক একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। বয়স আঠাশ। ভদ্রমহিলা একটা বড় ফার্মে চাকরি করেন। বয়স ছাব্বিশ। বাড়িঅলা নাম জানতে চাইলে দেখলেন দুজনের দুটো আলাদা টাইটেল। আলাদা টাইটেল কেন? তারা বলে, আমরা তো বিয়ে-থা করিনি। আপনারা স্বামী-স্ত্রী না? না। এবার ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেলেন। স্বামী-স্ত্রী না হলে ভাড়া দেব কেন? তারা বলে, আমরা ভালোবাসি। এখনো আমাদের দেশে কেউ যদি বলে আমরা ভালোবাসি তাই একসঙ্গে থাকি, হজম করতে কষ্ট হয় অনেকের। কিন্তু এই পরিবর্তিত অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। আজ আমার মা যদি বেঁচে থাকতেন তিনি কি হজম করতে পারতেন যদি তার নাতনি এ কাজটি করত? তিনি একটা স্ট্রাকচারের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। সে স্ট্রাকচারে তিনি এতকাল যা শোভন বলে মনে করেছেন তা-ই তিনি আশা করেন। সেদিন একটা অনুষ্ঠানে আমি অনেক লোকের মাঝে এই প্রশ্নটা করেছিলাম, আপনারা মাধবীলতাকে সমর্থন করেন কি করেন না। কেউ কথা বলে না। শেষ পর্যন্ত একটা একুশ বছর বয়সী মেয়ে উঠে দাঁড়াল সে মাধবীলতাকে সমর্থন করে। সে তার মায়ের দৃষ্টান্ত বলেছে আমাকে। সে ঠিক আছে, কিন্তু বেশিরভাগই মুখোশ পরে হাঁটি। সাহিত্য কখনো কখনো ভালোলাগা বা না লাগা সত্তে¡ও জীবন থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা একটা জায়গায় পৌঁছে যায়।
কয়েকটা জেনারেশনকে ধারন করার যে ব্যাপার এটা আপনি কীভাবে পারলেন?
সমরেশ মজুমদার: আগেকার দিনে দেখা যেত, বাড়িতে কাজের লোক আছে। রান্নার লোক। বিধবা হয়ে আঠারো-উনিশ বছরে এসেছে। তারপর পঞ্চাশ বছর ধরে রান্না করছে। তখন যারা বাচ্চা ছিল তারা বড় হয়ে চলে যাচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে। সে কিন্তু রান্না করে যাচ্ছে। অমুকের মা বলে ডাকে তাকে। অমুকের মার রান্না খেতে খুব মজা, খুব ভালো। ঠাকুরদা বলছে, বাবা বলছে, ছেলেও বলছে। কেন?
আপনাদের তারুণ্যে একটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনীতি সে স্বপ্নের পথে যাচ্ছে না। আপনি হতাশ হন না?
সমরেশ মজুমদার: এগুলো তো আমার হাতের মধ্যে নেই। আমি কলকাতা শহরে যে বাঙালিকে দেখি তাতে আমি আনন্দ পাই, আবার দুঃখ পাই। আবার ঢাকায় যখন আসি একই অনুভূতি হয়। আমি যখন প্রথম আসি তখন ইউনিভার্সিটিতেই বোরখা পরা মেয়ের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তখন ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেই মেয়েরা বোরখা খুলে ফেলত। রিকশা থেকে নামত। ফেরার পথে রিকশায় ওঠার আগে বোরখা পরে রিকশায় উঠত। হেঁটে রাস্তা দিয়ে আসত না। প্রথম এসে মেয়েদের রাস্তায় হাঁটতে খুব একটা দেখিনি। এখন মেয়েরা অনেক চলাফেরা করছে। কোথাও কোথাও মেয়েরা ফুটপাতে বসে সিগারেট খায়। এটা আমার খারাপ লাগেনি। নিজের সম্মান বজায় রেখে যদি এটা করতে পারে তবে ভালো। আরেকটা জিনিস দেখতে থাকলাম- বোরখা নয়, মুখঢাকা পোশাক বা হিজাব পরার চলটা যেন দিন দিন বাড়ছে। আমি ভাবতাম, আত্মরক্ষা করার জন্য হিজাব একটা বড় ভূমিকা নিচ্ছে। মেয়েটি নিজেকে অন্যের কাছে এক্সপোজ করতে চায় না, তাই হিজাব পরে। এই আত্মরক্ষার প্রয়োজনটা হচ্ছে কেন। পুরুষদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য আত্মরক্ষা করতে হচ্ছে? নিজেকে আমি জিজ্ঞেস করি। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলে, আর বলবেন না দিনকে দিন হিজাব বেড়েই চলেছে। আপনারা আরও ভালো বলতে পারবেন। ধর্মান্ধতা নাকি সংস্কার কোনটি কারণ। মা হিজাব পরত না মেয়ে পরছে। আবার এও দেখছি, প্যান্ট, কামিজ পরে মাথায় হিজাব পরছে।
এখন পশ্চিমবঙ্গে যে অস্থিরতা চলছে, এনআরসি...
সমরেশ মজুমদার: এই যে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা সমুদ্র পেরিয়ে বাংলাদেশে এলো। আপনারা না পারছেন তাদের গিলতে, না পারছেন হজম করতে, না পারছেন বের করে দিতে। কেন পারছেন না? দেখুন অন্যকে আক্রমণ করতে খুব আনন্দ হয়। নিজে আক্রান্ত হলে দুঃখ হয়।
আমাদের পশ্চিবঙ্গের যিনি মুখ্যমন্ত্রী তার আবেগ মাঝে মাঝে আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল থাকে না। যখন আসামে দেখা গেল ১৯ লাখ লোক, এরা ভারতীয় না। এদের রেশনকার্ড নেই। কিচ্ছু নেই। উনিশ লক্ষ লোক কম না। তাদের যখন আশ্রয়হীন করার চেষ্টা হচ্ছে, আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বললেন, আমি নিয়ে নেব। এরা বাঙালি। দেখা গেল, এদের সবাই বাঙালি নয়। সবাই হিন্দু নয়, প্রচুর মুসলমান আছে। তাকে বলা হলো, আপনার বাসায় চারজনকে দেওয়া হলে রাখবেন তো? তিনি বললেন, আমার বাসায় কেন? আমি তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করব। মানে আরেকটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ব্যবস্থা করব, আরেকটা দণ্ডাকারণ্যের ব্যবস্থা করব। এর কোনো সুরাহা নেই। পৃথিবী জুড়ে হচ্ছে। এই যে লোকগুলো গেল, কেন গেল? আমি তো এখানে কত বছর ধরে আসছি। আমি সে-রকম জাতিগত দাঙ্গা তো দেখিনি এখানে। এখান থেকে যারা যাচ্ছে তারা আতঙ্কে যাচ্ছে? কীসের আতঙ্ক? নাকি আরেকটু বড় কিছু প্রাপ্তির আশায় যাচ্ছে?
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের পাঠকের মধ্যে কোনো পার্থক্য আপনি দেখেন?
সমরেশ মজুমদার: ১৯৭১ এর আগে এখানে বাংলা বই খুব কম আসত। আমার বলতে লজ্জাও নেই, দ্বিধাও নেই একাত্তরের পর এখানে যত পাঠক হয়েছে সব হুমায়ূনের কল্যাণে তৈরি হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ না জন্মালে বাংলাদেশে এত পাঠক তৈরি হতো না। হুমায়ূনের আগে যারা লিখতেন, অনেক পাওয়ারফুল লেখক ছিলেন তারা। তাদের তুলনায় হুমায়ূন কিছুই না, কিন্তু তাদের বই বিক্রি হতো না। এই ঢাকা ক্লাবে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন এমন অনেক বড় লেখক আছেন- খুব বিনয়ী, কিন্তু খুব দরিদ্র। তাদের বই বিক্রি হতো না। আমি হুমায়ূনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার এ ব্যাপারে কী বক্তব্য। হুমায়ূন বলেছে, সমরেশ দা, যে ছেলে বা মেয়ে ষোলো বছর বয়সে হুমায়ূন পড়া ধরে না তাকে আমি বাঙালি বলে মনে করি না। আর যে ২৪ বছরের পরও হুমায়ূন পড়ে সে মানুষ না। ২৪-এর পর একটা অ্যাডাল্ট লোক যার বোধবুদ্ধি আছে সে হুমায়ূন পড়বে কেন? যেখানে কোনোরকম ডেপথ নেই, কোনো রকম গভীরতা নেই একমাত্র হিমু চরিত্র ছাড়া। সে নিজে বলেছে আমাকে। আমি এটা লিখেওছি অনেক জায়গায়। ও নিজেকে জানত খুব ভালোভাবে।
আপনি সম্প্রতি বললেন, বাংলা সাহিত্যের রাজধানী ঢাকায় চলে এসেছে। এর তাৎপর্য কী? সাহিত্যের নিজস্ব একটা ধারা আছে এখানে, কিন্তু সেই অর্থে স্থায়ী পাঠক কম বা বই প্রকাশের সংস্কৃতি তত জোরালো নয়।
সমরেশ মজুমদার: বাংলাভাষায় সমরেশ মজুমদার নামে একজন লেখক আছেন। তিনি যে গল্প উপন্যাস লিখছেন সেগুলো বিক্রি হয়। কিন্তু পাঠকের ইচ্ছা আরও সমরেশ মজুমদার হোক। আমি যত বই লিখেছি তার থেকে বেশি বই এখানে চলে। আমার নামে বই লিখে এখানে চালানো হয়। পাঠকরা বাংলা পড়তে পারে, পড়তে চায়, পড়ার আকাঙ্ক্ষা আছে। সেটাকে এক্সপ্লোয়েট করছে কিছু খারাপ ব্যবসায়ী। পাঠক নেই, এটা বলছেন কেন? এখানে পাঠক রয়েছে। প্রচন্ড পাঠক আছে। হুমায়ূনের বই বিক্রি হচ্ছে। মৃত্যুর পর সুনীলের বই বিক্রি একদম কমে গেছে। কিন্তু মৃত্যুর ছয় বছর পর হুমায়ূনের বই বিক্রি হচ্ছে। একজন প্রকাশক আমাকে বলেছেন হয়তো ১০% বিক্রি কমেছে। পশ্চিমবাংলার বইমেলাতে ২১ থেকে ২২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়, এগুলো কি ভূতে কেনে? অথচ বলা হয় পশ্চিমবাংলায় পাঠক নেই। আপনাদের এখানে বলা হয়, পাঠক কমে গেছে। কিন্তু একুশের মেলা থেকে বাংলাবাজারের পাবলিশাররা ৫০% আয় করেন। নভেম্বর মাসে এখানে একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা হবে। দুটো বইমেলা করার দরকার কী যদি বিক্রি না হবে?
আপনি অনেক লিখেছেন। এখন একেবারে পরিণত বয়স আপনার। লেখা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
সমরেশ মজুমদার: সকালে ঘুম থেকে উঠি ধরেন সাড়ে ছ’টায়। ব্রাশট্রাশ করার পর এক কাপ চা হাতে সূর্য ওঠা দেখতে খুব মজা লাগে। খবরের কাগজ আসে। চার চারটে কাগজ। সেটা পড়তে আরম্ভ করি। পড়তে পড়তে নটা বাজে। তখন নাস্তা খাই। নাস্তা খাওয়ার পর ফোন করি, একে ওকে তাকে। ধরেন, দশটা বেজে গেল। দশটা সাড়ে দশটা বেজে গেলে আর তো লেখার টাইম নাই। আর কখন লিখব। এখন লিখতে ইচ্ছা করে না বলে যত রকমের বাহানা আছে নিজেকে দিই। আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন যে পাড়ায় আমি থাকতাম সে পাড়ায় একজন বিখ্যাত লেখক থাকতেন, তার নাম শিবরাম চক্রবর্তী। তিনি আমাদের ছোটবেলায় হাসির লেখক হিসেবে আমাদের বুকের মধ্যে ছিলেন। আমি একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সকাল থেকে কী করেন। তিনি বললেন, ঘুম থেকে উঠি। তারপর? তারপর চা খাই। তারপর? বিনাপয়সার কাগজ পড়ি। বিনাপয়সার মানে? আমাকে আনন্দবাজার পত্রিকা বিনাপয়সায় কাগজ পাঠায়, ওটা পড়ি। পড়তে পড়তে ঘুম পেয়ে যায়। আবার শুয়ে, ঘুমিয়ে পড়ি। আবার উঠি। তারপর? উঠে গোসল করতে যাই। ভাত খাই। ভাত খেলে ঘুম পায়। ঘুমায়ে পড়ি। বিকাল হয়, আমি সাজুগুজু করে বাস ধরে আমার প্রেমিকাদের সঙ্গে দেখা করতে যাই। প্রেমিকা? কেন, পড়োনি আমার লেখার মধ্যে? আটটা অব্দি তাদের সঙ্গে গল্প করে গল্প করে মন প্রফুল্ল হয়। তুমি দেখবে, মেয়েদের সঙ্গে গল্প করলে তোমার মন অনেক বড় হয়ে যাবে। তারপর ঘরে আসি। আবার ভাত খাই। ঘুমায়ে পড়ি। আমি তখন বললাম, আপনি লেখেন কখন? কেন, পরের দিন সকালে। পরের দিন সকালটা কবে আমি জানি না। আমি এখন সেই জায়গায়। লিখতে ইচ্ছা করে না। সাধারণত আমি সকালে লিখি। এখন বাধ্যবাধকতার জন্যই লিখতে হয়। অল্প বয়সে অফুরন্ত প্রাণশক্তি ছিল, তখন যখন ইচ্ছা তখন লিখতাম।
[৪ অক্টোবর, ২০১৯ দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত]
বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান এনপিপি, বিসিজিএমএস, এনডিসি, পিএসসি কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৮৪ সালের ২৪ জুলাই। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি তিনি কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর দায়িত্ব পালন করেছেন নৌবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। সাফল্যের সঙ্গে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে।
এম. শাহজাহান তার আগে ছিলেন বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের উপ-মহাপরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্যের (হারবার ও মেরিন) দায়িত্বে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ব্লু ইকোনমি সেলের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশের বন্দর, ব্লু ইকোনমি, বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট-হাব হিসেবে গড়ে তোলাসহ সার্বিক মেরিটাইম খাত এবং ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বঙ্গোপসাগর ও তার নিরাপত্তা নিয়ে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন দৈনিক দেশ রূপান্তরের সঙ্গে।
তার সঙ্গে আলাপ করেছেন দৈনিক দেশ রূপান্তরের হেড অব ইভেন্টস অ্যান্ড ব্র্যান্ডিং শিমুল সালাহ্উদ্দিন।
দৈনিক দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা শুনে খুব আনন্দিত যে চট্টগ্রাম বন্দর অনেকগুলো সাফল্য অর্জন করেছে আপনার নেতৃত্বে। প্রথমে জানতে চাই, লয়েড’স লিস্টে আমাদের বন্দরের এখনকার অবস্থান কত?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: লয়েড’স লিস্টে আমাদের বর্তমান অবস্থান ৬৪তম। এর মানে পৃথিবীর এক শ ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান এখন চৌষট্টি।
আপনি যখন দায়িত্ব নেন, তখন এ বন্দর কততম অবস্থানে ছিল? সারা বিশ্বের যে বন্দরগুলো, তার তুলনায় আমাদের বন্দরের ইতিহাস যে রকম পুরোনো..., বন্দরটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক কারণে, আপনি দায়িত্ব নেয়ার পর প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য কী ছিল?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমি চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বভার গ্রহণ করি ৩১ জানুয়ারি ২০২১-এ। যখন একদম কোভিডের মাঝপথে আমরা এসে পৌঁছেছি, কোভিড আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছিল। তখন চট্টগ্রাম বন্দর মোটামুটি স্থবির হয়ে ছিল, আমরা লয়েড’স লিস্টেও ছিলাম না। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর না, সারা বিশ্বের সব বন্দরই মোটামুটি বন্ধ অবস্থায় ছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরকে আমরা দ্রুত অনেক ভালো অবস্থায় নিয়ে যাই। আমরা, বন্দরের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, চট্টগ্রাম বন্দরকে আমরা চব্বিশ ঘণ্টা সচল রেখেছি। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে দর্শন ছিল, যে জীবন এবং জীবিকার সঙ্গে সমন্বয় রেখে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে- আমরা সেভাবে সেই দর্শন লালন করে, বুকে ধারণ করে কার্যক্রম পরিকল্পনা করেছিলাম। আমরা চব্বিশ ঘণ্টা চট্টগ্রাম বন্দর সচল রেখেছিলাম। এতে আমাদের বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পূর্ণ সচল ছিল এবং সেই পিরিয়ডেও কিন্তু আমাদের ১৩% গ্রোথ হয়ে ছিল। এর বিনিময়ে আমাদের ৫৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আমরা হারিয়েছি। আজকে আমি তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
১৯৭৭ সালে ছয়টি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরের। এ বন্দর এখন বছরে ৩২ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করছে। সে হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের যাত্রাটি চমকপ্রদ। কীভাবে এটা সম্ভব হলো?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান: চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাস কিন্তু অনেক পুরোনো, প্রায় আড়াই হাজার বছরের। তবে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং শুরু হয় ১৯৭৭ সালে, মাত্র ছয় টিইইউ কনটেইনার দিয়ে। সে সময় অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ১০ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের মাইলফলক স্পর্শ করতে আমাদের ৩১ বছর লেগে গেছে। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বন্দর প্রথমবারের মতো ১০ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করে। এর পরের অর্থাৎ ২০০৯ সাল পরবর্তী সাফল্য ঈর্ষণীয়। ২০ লাখ টিইইউর মাইলফলক স্পর্শ করতে সময় লেগেছে মাত্র সাত বছর। ২০১৫ সালেই ২০ লাখ টিইইউর বেশি কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করে চট্টগ্রাম বন্দর। এর মাত্র চার বছর পর ২০১৯ সালে ৩০ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করে নজির সৃষ্টি করে বন্দর। ২০২১ সালে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ লাখ টিইইউর ঘরে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এ সাফল্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত দিক-নির্দেশনা এবং সেই আলোকে সরকারের গৃহীত বন্দরকেন্দ্রিক নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা। সরকারের ও আমরা যারা বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছি, তাদের ধারাবাহিকতাও এ ক্ষেত্রে বড় একটা ভূমিকা রেখেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি এসব পরিসংখ্যানে।
এই পর্যায়ে আসতে বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা অনেক বাড়াতে হয়েছে। সেটা কীভাবে হয়েছে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান: পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই দেখবেন চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। গত পাঁচ বছর গড়ে ১২-১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এই প্রবৃদ্ধিকে সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি অর্থাৎ সক্ষমতা প্রতিনিয়ত বাড়াতে হচ্ছে। এখন আমাদের কনটেইনার ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫৮০ টিইইউ। আমাদের সক্ষমতাও অনেক বেড়েছে এবং বিশ্বের যেকোনো আধুনিক বন্দরের সঙ্গে একে তুলনা করা যায়।
এ ছাড়া ইকুইপমেন্টও বেড়েছে। আমি যখন চট্টগ্রাম বন্দরে সদস্য (হারবার ও মেরিন) হিসেবে যোগ দিই ২০১০ সালে, তখন সিসিটিতে মাত্র চারটি কিউজিসি (কি গ্যানট্রি ক্রেন) ছিল। বর্তমানে আমাদের কিউজিসি ১৮টি। সেই সময় আমাদের আরটিজি ছিল ৭টার মতো। আরটিজির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এখন ৪৭। আরএমজিসি (রেল মাউন্টেড গ্যানট্রি ক্রেন) বন্দরে যুক্ত হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ শেষ করেছি। ফলে আমাদের বন্দরের সক্ষমতা চার মিলিয়ন টিইইউতে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বা কনটেইনারের কোনো জট নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় ইচ্ছায় এত অল্প সময়ে আমরা এই সক্ষমতা বাড়াতে পেরেছি।
সব মিলিয়ে বলতে পারি, বিভিন্ন ধারণক্ষমতার বিপুলসংখ্যক যেসব ক্রেন আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছে। নিঃসন্দেহে সেগুলো বন্দরের সক্ষমতা বাড়িয়েছে এবং অভূতপূর্ব একটা পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বন্দরের উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। সরকার ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সব ধরনের নীতি ও বিনিয়োগ দিয়েছে বলেই চট্টগ্রাম বন্দরকে আজ আমরা একটা আধুনিক বন্দরে উন্নীত করতে পেরেছি। বন্দরের ধারণক্ষমতা ও সক্ষমতা দুটোই বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি।
কর্ণফুলী চ্যানেলকে আমরা প্রশস্ত করেছি। ড্রাফটও বেড়েছে। বন্দরে আগে ১৮৬ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ আসতে পারত না। আমরা দায়িত্ব নেয়ার পর এটি ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরের জেটিতে আনতে পেরেছি।
বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অটোমেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম বন্দর এ ক্ষেত্রে কতটা এগিয়েছে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: চট্টগ্রাম বন্দরকে এক সময় ম্যানুয়াল বন্দর বলা হতো। সেই পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। বন্দরে আমরা টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম (টস) চালু করেছি। সবচেয়ে বড় যে কাজটা আমরা করেছি তা হলো ইলেকট্রনিক ডেলিভারি সিস্টেম। এটা একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভেহিকল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে ট্রাকের ফি আদায় অটোমেশনের আওতায় এসেছে। পুরোপুরি না হলেও সেমি-অটোমেটিক বন্দরে আমরা উন্নীত হয়েছি।
বহির্নোঙর ও চ্যানেলে চলাচলকারী জাহাজ নজরদারিতে ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস) চালু রয়েছে। বহির্নোঙরের (পোর্ট লিমিট) আওতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ সুবিধাও বাড়ানো হয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাহাজ পাইলটিংয়ে পাইলট সার্ভিস অটোমেশন চালু করা হয়েছে।
বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে বাস্তবায়ন করা হয়েছে একগুচ্ছ উন্নয়ন পরিকল্পনা। নিরাপদ বন্দর নিশ্চিতে স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার, রয়েছে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম। যান চলাচল নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অটোমেটিক গেট কন্ট্রোল সিস্টেম, আন্ডার ভেহিকল সার্ভিল্যান্স সিস্টেম (ইউভিএসএস) ও স্ক্যানার।
এসব অর্জন আপনাকে কোথাও কী তৃপ্ত করছে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: সব সময় আমাদের আমাদের লক্ষ্যই থাকে অংশীজন ও ব্যবহারকারীদের সর্বোৎকৃষ্ট সেবা দেওয়া। সেটা নিশ্চিত করতেই বন্দরকেন্দ্রিক এত আয়োজন। কাঙ্ক্ষিত সেবা যে এখন পাওয়া যাচ্ছে, ব্যবহারকারীরাই তা বলছেন। কোভিডকালীন সারা বিশ্বের বন্দর যেখানে স্থবির হয়ে গিয়েছিল, তখনো আমরা অংশীজন ও ব্যবহারকারীদের ২৪ ঘণ্টা সেবা দিয়ে গেছি। কোভিডকালেও ৪১ শতাংশ জাহাজ অন-অ্যারাইভাল বার্থিং পেয়েছে। এখন আমরা ৮০ শতাংশ জাহাজকে অন-অ্যারাইভাল বার্থিং দিচ্ছি।
এ ছাড়া অটোমেশনের বৈশ্বিক স্বীকৃতি ও সুফল দুটোই আমরা পাচ্ছি। যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথের গবেষণা যখন বলে যে, এশিয়া অঞ্চলের ৬৫টি সেমি-অটোমেটিক বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান সবার ওপরে তখন ভালো তো লাগেই। তবে এ অর্জন বন্দরের একার নয়, সব ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীদেরও।
২০৩১ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার যে অভীষ্ট তা অর্জনেও বড় ভূমিকা রয়েছে বন্দরের। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বর্ধিত চাহিদা পূরণে বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা আরো বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। সে ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তুতি কী?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে প্রয়াস তাকে বাস্তবে রূপ দিতে গেলে আমাদের এখানেই থেমে থাকলে হবে না। ধারণক্ষমতা ও সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা কাজও করছি। আমরা ইতিমধ্যে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করেছি। আমাদের আরো ইয়ার্ড তৈরির কার্যক্রম চলছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে ৫৫ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণ করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া আমরা বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনাল নির্মাণ করছি। বে টার্মিনালের কাজ শেষ হলে ২৮৫ মিটার দীর্ঘ ও ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ সেখানে আসতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে যেখানে ৩ হাজার টিইইউর জাহাজ আসে আর বে টার্মিনালে আসবে ৫-৬ হাজার টিইইউর জাহাজ। মাতারবাড়িতে ড্রাফট ১৮ মিটার। সেখানে ১০-১২ হাজার টিইইউ কনটেইনার ধারণক্ষমতার ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ আসতে পারবে। তখন আমরা বাংলাদেশকে অত্র অঞ্চলের ট্রান্সশিপমেন্ট হাব বানাতে পারব। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজ সরাসরি মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকায় যেতে পারবে।
মাতারবাড়ি ও বে টার্মিনাল কবে নাগাদ কার্যক্রমে আসতে পারে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনালের মূল চ্যানেলের কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা কনটেইনারবাহী জাহাজের বেসিন তৈরি করছি। মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জামবাহী ১১৭টির বেশি জাহাজ এরই মধ্যে সেখানে এসেছে। আমরা টাগবোট ও কন্ট্রোল রুমের ব্যবস্থা করেছি। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনালের কাজ পুরোদমে চলছে এবং আশা করছি ২০২৬ সালের মধ্যে কনটেইনার পরিবহনের সুফল আমরা পাব।
বে টার্মিনালের ডিটেইল ড্রয়িং ও ডিজাইনের জন্য আমরা দুটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছি এবং এরই মধ্যে তারা তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ ও চ্যানেল খননের জন্যও আন্তর্জাতিক একটি যৌথ কোম্পানিকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নির্মাণ শেষ করে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মধ্যে এটি কার্যক্রমে আসবে বলে আমরা আশা করতে পারি। বে টার্মিনালে মোট তিনটি টার্মিনাল থাকবে; একটি মাল্টিপারপাস এবং দুটি কনটেইনার টার্মিনাল।
বাংলাদেশকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ঘোষণা করা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমি শুরু থেকেই এ কথাটি বলে আসছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পূর্ব এশিয়া, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমে চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যবর্তী হওয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এবং ভারতের ব্যবসার অন্যতম ক্ষেত্র হতে পারে। আমরা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক হাব হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারি। আমাদের নিজস্ব ১৭ কোটি জনগণ ছাড়াও প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের একটি বিশাল বাজারের যোগাযোগের পথ হতে পারে বাংলাদেশ।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ দর্শনই আমাদের জন্য দিক-নির্দেশনা এবং বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
সাবরিজিয়নাল ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হওয়ার অর্থ হলো অন্যান্য দেশ আমাদের এ বন্দরকে ব্যবহার করবে। সে জন্য আমাদের বন্দরের উন্নত অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংযোগ, সেবার প্রাপ্যতা, দক্ষ জনশক্তি সর্বোপরি পর্যাপ্ত নাব্যতা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়াটাও জরুরি। সবগুলো সুবিধাই আমাদের আছে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনাল চালু হলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা (বর্তমানে শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর), হলদিয়া, বিশাখাপত্তম, কাকিনাদা ও আন্দামান-নিকবরের অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর বেল্টের বন্দরগুলো এটি ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের আরেক প্রতিবেশী মিয়ানমারের আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন এবং থাইল্যান্ডের ফুকেটসহ আরো দুই-একটি ছোট বন্দরও এটি ব্যবহার করতে পারবে। অর্থাৎ এ বন্দরগুলো হবে মাতারবাড়ি-কেন্দ্রীক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন তারা মাতারবাড়ি ব্যবহার করবে? কারণ এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ির ড্রাফট সবচেয়ে বেশি। ১৮ মিটার ড্রাফট হওয়ায় ১০ হাজার টিইইউ ধারণক্ষমতার জাহাজ ভিড়তে পারবে এখানে। এখন একটি জাহাজে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টিইইউ কনটেইনার আনা হয়। এর পরিবর্তে ১০ হাজার টিইইউ কনটেইনার আনলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ফ্রেইট কমে যাবে। ব্যবসায়ীরা তখন এমনিতেই মাতারবাড়ি বন্দরকে বেছে নেবেন। কারণ, ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি দ্রুত পণ্যের ডেলিভারিও তারা পাবেন। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দর তখন মাতারবাড়িকে ফিডার পোর্ট হিসেবে ব্যবহার করবে।
এ ছাড়া মাতারবাড়ি চালু হলে এখান থেকে জাহাজগুলো সরাসরি পাড়ি দেবে ইউরোপ ও আমেরিকার বন্দরের উদ্দেশ্যে। ফলে সময় অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশ থেকে মধ্যবর্তী ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হয়ে ইউরোপীয় গন্তব্যে পণ্য পরিবহনে এখন গড়ে ৬-৭ সপ্তাহ এবং যুক্তরাষ্ট্রের গন্তব্যে গড়ে ১২-১৬ সপ্তাহ সময় লাগে। যুক্তরাষ্ট্রের গন্তব্যের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা গেলে পণ্য পরিবহনে সময় অর্ধেকে নেমে আসবে। ইউরোপের যেসব দেশের সঙ্গে সরাসরি জাহাজ চলাচল চালু হয়েছে সেখানে আমরা ১৬-২০ দিনের মধ্যে জাহাজ পৌঁছাতে পারছি।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে আপনি এরই মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু করেছেন। এটা অব্যাহত রাখা কতটা জরুরি?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এরই মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও ইতালির পোর্ট অব র্যাভেনা বন্দরের মধ্য দিয়ে এটি শুরু হয় এবং পরবর্তীতে স্লোভেনিয়ার কোপার বন্দরের সঙ্গেও সেবাটি চালু হয়েছে। এ ছাড়া ব্রিটেনের পোর্টসমাউথের ফ্লেক্সটো পোর্ট, পর্তুগাল, জার্মানির পোর্ট অব হামবুর্গের সঙ্গেও সরাসরি জাহাজ চলাচল সেবা চালুর প্রস্তুতি রয়েছে। ব্যবসায়ীদের সময় ও খরচ বাঁচাতে সেবাটি অব্যাহত রাখা গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য প্রয়োজন গভীর সমুদ্রবন্দর। সেই অর্জনের দিকেই যাচ্ছি আমরা।
একটা কথা আপনি প্রায়ই বলে থাকেন এবং তা হলো লায়াবিলিটিজকে আমাদের অ্যাসেটে পরিণত করতে হবে। ট্রান্সশিপমেন্ট হাবের মাধ্যমে লায়াবিলিটিজকে নিশ্চয় অ্যাসেটে রূপান্তরের একটা সুযোগ তৈরি হবে। সেটা কীভাবে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাজ হলো দায়কে সম্পদে পরিণত করা। এটাই মূল। অর্থাৎ, আমাদের দায়কে যদি আমরা সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারি তাহলেই আর কোনো সমস্যা থাকে না। আমাদের বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে উন্নীত করার মধ্য দিয়েও সেটা সম্ভব। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। এখন কোনো কনটেইনার চার দিনের বেশি বন্দরের অভ্যন্তরে পড়ে থাকলে আমদানিকারককে ডিটেনশন চার্জ পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু যদি বন্দরকে ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে ঘোষণা দেওয়া যায়, তখন এমএলওদের খালি কনটেইনার সিঙ্গাপুর বা কলম্বো ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে নিতে হবে না। তারা তখন কনটেইনার চট্টগ্রাম বন্দরেই রাখবে। আমাদের স্পেস রেন্ট বাবদ ফি পরিশোধ করবে। তাও আবার বৈদেশিক মুদ্রায়। অর্থাৎ, ব্যবসায়ীদের আর ডিটেনশন বা ড্যামারেজ চার্জ দিতে হবে না এবং স্পেস রেন্ট হিসেবে বন্দর রাজস্ব পাবে এমএলওদের থেকে। একদিকে ব্যবসায়ীদের খরচ বাঁচবে, অন্যদিকে বন্দরের আয় বাড়বে। বন্দরের আয় বৈদেশিক মুদ্রায় হওয়ায় এর একটা বড় প্রভাব পড়বে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
বন্দরের দায় আসলে কী কী এখন, একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমরা এর আগে আমাদের সার্ভিসগুলো সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকা, ফার ইস্টার্ন কান্ট্রি চীন-জাপানে পাঠাতে পারতাম না। কেন না আমাদের এটা হাব হিসেবে আগে পরিচিত ছিল না। আমাদের বন্দরটা থেকে যদি আমরা সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকা এবং অন্যান্য ডেস্টিনেশনে প্রেরণ করতে পারি, তাহলে কিন্তু ট্রানজিট টাইমটা কমে যাবে। আমাদের ট্রানশিপমেন্ট হাবগুলো আমাদের ব্যবহার করতে হবে না, ফলে আমাদের সেখানে ট্রান্সশিপমেন্টের যে ব্যয়, সেটাও কমে যাবে। এবং যে সময় লাগে, এখান থেকে সিঙ্গাপুর অথবা পোর্ট ক্লিয়ং অথবা তিয়ানজিং পোর্ট অথবা কলম্বো হাব আমরা ব্যবহার করি বর্তমানে। সেই হাবগুলো যদি আমাদের ব্যবহার করতে না হয়, আমরা যদি সরাসরি ইউরোপ-আমেরিকাতে পাঠাতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের এই যে অতিরিক্ত সময় এবং অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়, হাব পোর্টে সেটা আমাদের সাশ্রয় হবে। এবং সে ক্ষেত্রে আমরা যদি এই চট্টগ্রাম বন্দরকে, যেটা আমাদের বে-টার্মিনাল, এবং মাতারবাড়িতে যেই ডিপ সি টার্মিনাল হচ্ছে, সেটাকে যদি আমরা ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে রূপান্তরিত করতে পারি, তাহলে এখন বর্তমানে আমাদের যে ডিটেনশন এবং ডেমারেজ চার্জ দিতে হয় পোর্টে, অনেক বেশি ফিক্সড অপারেটিং কস্ট আমাদের পে করতে হয় জাহাজের অবস্থানের জন্য, সেই সব কস্ট আর আমাদের বহন করতে হবে না। তখন এই যে কন্টেইনারগুলো আসে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে, যখন আসে, প্রথম চার দিন এমএলও-রা আমাদের ফ্রি টাইম দিয়ে থাকে। ওই চার দিনের পর থেকে তারা কিন্তু কন্টেইনারের ওপর ডিটেনশন চার্জ ও ডেমারেজ চার্জ আরোপ করে ফেলে। এটা থেকে আমরা মুক্তি পাই তখনই, যখন আমরা ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে আবার খালি কন্টেইনারটাকে ফেরত পাঠাতে পারি অথবা লোডেড কন্টেইনারটাকে ফেরত পাঠাতে পারি। এই যে ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে তারা যখন যায়, সেখানে কিন্তু ট্রান্সশিপমেন্ট হাবে এমএলও-রা ট্রান্সশিপমেন্ট স্পেস রেন্ট দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে যতক্ষণ পর্যন্ত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের তাদের কন্টেইনারের ভাড়াই দিতে হয়, যে তার একটা কন্টেইনার আমার এখানে পড়ে আছে, সেজন্য। আমি যদি এটাকে হাবে পরিণত করতে পারি, তাহলে আমাকে ওই কন্টেইনারটা এম্পটি হওয়ার পরে আর এটার জন্য কোন ডিটেনশন বা ডেমারেজ চার্জ দিতে হবে না, বরং আমার যে স্পেসের ভেতর তার কন্টেইনারটাকে স্টোর করে রাখা হবে, এবং এখান থেকে অন্যান্য জায়গায় পরবর্তীতে সে খালি কন্টেইনারটা রপ্তানি করবে, সে জন্য উল্টো আমাকে চার্জ পরিশোধ করতে হবে। আমাদের দেশে সাধারণত প্রতিবছর যে কন্টেইনারগুলো আমরা এখানে ইউজ করে থাকি, আমাদের এখানে আসা-যাওয়া করে যে কন্টেইনার, সেটার পরিমাণ ৩.২ মিলিয়ন ছিল গত বছর, গড়ে। প্রতি কনটেইনারে ১০০০ ডলারও যদি ডিটেনশন এবং ডেমারেজ চার্জ আসে, সেখানে কিন্তু বিশাল বড় অঙ্ক। আমি অত্যন্ত নগণ্য একটা এমাউন্ট বললাম, হিসাবের সুবিধার জন্য। ৩.২ ইনটু ১০০০ হলো ৩.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। তো ৩.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার যদি ফরেন ক্যাশের সাশ্রয় হয়, ডেমারেজ এবং ডিটেনশন চার্জ বাবদ দিতে না হয়, তাহলে এটা রিজার্ভে আরও বড় অবদান রাখবে। এটা তো একটা সেগমেন্ট। এ রকম আরো পাঁচ-সাতটা সেগমেন্ট আছে- ডিটেনশন, ডেমারেজ, ফিক্সড অপারেটিং কস্ট এগুলোর ওপর ভিত্তি করে; তখন দেখা যায় যে বিশাল এমাউন্ট। আমাদের এই বর্তমানে যে ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার আমরা ক্রস করেছি, সেটার সঙ্গে যদি আরো ২০/৩০ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হয়, এটা তো বিশাল একটা এমাউন্ট, আমাদের রিজার্ভ অনেক বৃদ্ধি পাবে। আমাদের বন্দরগুলা যদি রিজওনাল হাব হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে আমরা কিন্তু নিজেরা নিজেদের বন্দরকে রিজওনাল হাব হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আমাদের মাতারবাড়িটা যদি ডিপ সি টার্মিনাল হিসেবে আমরা ইউজ করি, এই মাতারবাড়িটা হবে আমাদের হাব; এবং চিটাগাং পোর্ট, মোংলা পোর্ট, পায়রা পোর্ট-এ তিনটা হবে আমাদের অ্যান্ড ইউজার পোর্ট অথবা আমাদের ফাইনাল ডেস্টিনেশন। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর এবং মোংলা ও পায়রা-এ তিন বন্দরের একটা অ্যাডভান্টেজ হলো, আমাদের এখানে কারো কার্গোর ওপর আমাদের ডিপেন্ড করতে হয় না। যেমন সিঙ্গাপুর, পোর্ট ক্লাং, কলম্বো এরা কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল হাব। এদের কিন্তু কার্গো অ্যাট্রাক্ট করতে হয়। আরেকজনের থেকে কার্গোটা ছিনিয়ে আনতে হয়, কম পয়সা দিয়ে, বা ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটা নয়। আমাদের কার্গোটাই... ধরেন চায়না থেকে র’ ম্যাটেরিয়াল আসে, সিঙ্গাপুরে ট্রান্সশিপমেন্ট হয়, অথবা সিঙ্গাপুরে না হলেও পোর্ট ক্লাং-এ হয়, অথবা কলম্বোয় হয়। এখন কলম্বো, পোর্ট ক্লাং এবং সিঙ্গাপুর, এরা যখন ইউজারকে ফ্যাসিলিটিজ দেয়, তখন তারা তাদের ওখানে যায়। আমাদের এখানে সে সমস্যা নাই। আমাদের এখানে তাদের কোনো সুবিধা দিতে হয় না। ওখানে দেখা যায় তারা প্রতি কনটেইনারে টু পার্সেন্ট, থ্রি পার্সেন্ট, ফাইভ পার্সেন্ট করে তারা তাদের কনসেশন দেয়, যেটা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য প্রযোজ্য নয়। চট্টগ্রাম বন্দর হলো অ্যান্ড ইউজার পোর্ট, এটা হল ফাইনাল ডেস্টিনেশন। আমরাই ইম্পোর্টার আমরাই এক্সপোর্টার, আমাদের এখানে আসতেই হয়। বরং আমাদের বন্দরে আসতে হলে আমরা তাদের স্পেশাল পারমিশন দিয়ে থাকি। আমরা সব জাহাজকে সমভাবে পারমিশন দিই না। তার কারণ হলো, বড় জাহাজগুলোকে আমরা পারমিশন দিয়ে থাকি যেন আমাদের বন্দরে একটা সিঙ্গেল জাহাজও যদি আনা যায়, দেখা যাবে যে আমাদের ফ্রেট কমে যাবে, আমাদের সময় কমে যাবে, ডিটেনশন এবং ডেমারেজ চার্জগুলো থেকে আমরা অব্যাহতি পাব। এ জন্য আমাদের বন্দরের যে সুবিধাগুলা, এই যে লায়াবিলিটিজ, একে আমরা যদি অ্যাসেটে কনভার্ট করতে পারি, তাহলে কিন্তু আমাদের দেশটাকে উন্নত বিশ্বে নেয়ার আমাদের যে লক্ষ্য, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে স্বপ্ন, ২০৪১ সালের ভেতর উন্নত বাংলাদেশ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন; আমার মনে হয় সেটা আমরা দ্রুতই বাস্তবায়ন করতে পারব। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর এ অপ্রত্যাশিত খরচগুলো আমরা যদি কমাতে পারি, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ৯৫ বিলিয়ন ইউএস ডলারে উন্নীত করা বেশি কষ্টের বিষয় নয়, এক বা দুই বছরেই সেটা আয় করা সম্ভব, শুধু পোর্টের ফ্যাসিলিটিজ এবং পোর্টকে ইউজ করে।
বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এত আগ্রহের কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: বাংলাদেশের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের অন্যতম কারণ হচ্ছে এর উড়ন্ত প্রবৃদ্ধি। সেই সঙ্গে রয়েছে ১৭ কোটি মানুষের বিশাল বাজার। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও বঙ্গোপসাগর ঘিরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় জাপানের অর্থায়নে ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা বিগ-বি কার্যক্রম চলছে। তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই বিগ-বি। প্রথমটি শিল্প ও বাণিজ্য, যার মূলে আছে গভীর সমুদ্রবন্দর। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে তা দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য অংশের বাণিজ্যের দুয়ার হিসেবে কাজ করবে। দ্বিতীয় স্তম্ভটি হলো জ্বালানি। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিগ-বি আওতাভুক্ত এলাকা শুধু নয়, পুরো বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যে গতি সঞ্চার করবে। তৃতীয় স্তম্ভটি পরিবহন ব্যবস্থা। দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের স্বার্থে ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পরিবহন’ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী, এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলো পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশের মতো বাড়বে।
সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর ‘ব্লু ইকোনমি’ বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। সে সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা কোন অবস্থানে আছি?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে আজকের এই যে উচ্ছ্বাস তার ভিত্তি রচনা করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গোপসাগরের ওপর আমাদের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালেই তিনি ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস অ্যাক্ট ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। আনক্লজ (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি) আসে এরও আট বছর পর, ১৯৮২ সালে।
ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিস্তৃত এ সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদ আহরণে আগে প্রয়োজন তা নিয়ে জরিপ, অনুসন্ধান ও গবেষণা। সমুদ্র গবেষণার জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বেশ কয়েকটি জাহাজ রয়েছে। বানৌজা অনুসন্ধান নামে নৌবাহিনীর একটি জাহাজ হাইড্রোগ্রাফি সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সমুদ্রবিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা কাজে ব্যবহৃত হয় বিএনটি খাদেম নামের বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি ওশান গোয়িং স্যালভেজ শিপ।
সমুদ্রসম্পদ রক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: বাংলাদেশের অধিকারে আসা বঙ্গোপসাগরের বিপুল সমুদ্রসম্পদ কেবল আহরণ করলেই হবে না। এর সুরক্ষাও দিতে হবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে আমাদের একটি সুরক্ষা বলয় গড়ে তুলতে হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে নাবিক ও জেলেদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। এর মাধ্যমে গভীর সমুদ্রের খনিজ ও মৎস্যসম্পদ সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ অর্জন সম্ভব হবে। আমাদের নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ড বাহিনীর সদস্যরা আগে থেকে বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সমুদ্র এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীকে একটি ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীতে রূপ দিয়েছেন। একই সঙ্গে কোস্ট গার্ডকেও আমাদের দীর্ঘ উপকূলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অধিকতর সক্ষম করে তুলছেন। বাহিনী দুটির উত্তরোত্তর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। যা বঙ্গোপসাগর জুড়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি দেশের সমুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও জোরদার করছে।
প্রশিক্ষিত ও দক্ষ মেরিন জনশক্তি এ মুহূর্তে আমাদের অনেক বেশি দরকার। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেই মেরিন জনশক্তি আমরা কতটা তৈরি করতে পারছি?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: সমুদ্র অর্থনীতির সর্বোচ্চ সুফল কাজে লাগাতে সমুদ্র জ্ঞান সমৃদ্ধ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই। এ জন্য নতুন চারটিসহ আমাদের রয়েছে পাঁচটি সরকারি মেরিন একাডেমি। রয়েছে বেসরকারি আরও কয়েকটি মেরিন একাডেমি। বিশেষায়িত জ্ঞান আহরণের জন্য আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি। তবে মেরিন একাডেমি থেকে বের হওয়া মেরিনারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে আমাদের নিবন্ধিত জাহাজের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া মার্চেন্ট শিপিং অরডিন্যান্স সংশোধন করে চট্টগ্রাম বন্দরেও যাতে জাহাজ নিবন্ধিত হতে পারে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তখন বাধ্যতামূলকভাবে এসব জাহাজকে বাংলাদেশের মেরিনারদের চাকরি দিতে হবে। এর ফলে আরো বেশি মেরিনারের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটানো যাবে। চূড়ান্ত বিচারে বৈদেশিক আয়ও বাড়বে। আপনি এর আগে কোস্টগার্ডের দায়িত্ব পালন করেছেন। বন্দর একটা দারুণ স্মার্ট অবস্থায় এসেছে আপনার সময়ে। আমরা শুনতে পাচ্ছি দ্রুতই আপনার মেয়াদ শেষ হবে। তো আপনার পরে যিনি দায়িত্ব নেবেন, তার জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: তার জন্য আমার পরামর্শ থাকবে যে, আমাদের যেসব কার্যকলাপ বা প্রোগ্রাম আমরা গ্রহণ করেছি, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা। ইতিমধ্যে আমাদের কিছু কিছু টার্মিনালকে প্রাইভেটাইজেশনের জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, সেসব পদক্ষেপগুলো আরো দ্রুত এগিয়ে নেয়া। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, এ কার্যক্রমের ট্রানজেকশনের অ্যাডভাইজারের রিপোর্টটা আমরা যথাসময়ে পাইনি। তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কেন না ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার যখন স্টাডি করে, তাদেরও অনেক সময় দিতে হয়, অনেক তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে তাদের বের করতে হয়। কিন্তু আমাদের তো তাড়াতাড়ি দরকার। সেই তাড়াতাড়ির জন্য আমরা তাদের বলেছি এবং তারা সেভাবেই কাজ করছে। আশা করি ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার আমাদের রিপোর্টগুলো দিলে সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা আমাদের প্রাইভেট টার্মিনালের অপারেটর, ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের অপারেটর যারা আছেন তাদের দ্রুত নিয়োগ করতে পারব। তখন দেখা যাবে আমাদের এখানে আরো কমপিটিশন বাড়বে এবং আমাদের দক্ষতা এবং তাদের দক্ষতা দুটো মিলে আমাদের বন্দরকে আমরা অন্য একটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। এ ছাড়া বন্দরের যেসব উন্নয়ন কার্যক্রমগুলো আছে, বে-টার্মিনাল, মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনাল এগুলো দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারব। ২০৪১ সালের ভেতরে আমাদের যে ডিমান্ড হবে, সেই ডিমান্ড আমরা অ্যাড্রেস করতে পারব।
বন্দর তো নানারকম বাণিজ্যের একটা জায়গা, অর্থ লেনদেনেরও জায়গা, আবার বন্দর ঘিরে নানা অপরাধও ঘটে। আপনার সময়ে আপনি অপরাধ এবং দুর্নীতি দমনে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে আমরা ম্যাক্সিমাম জিনিস অটোমেশন করে ফেলেছি। এটা হলো ডিজিটালাইজেশনের একটা সুফল, যার ফলে অনেক কম পরিমাণ জনবল সম্পৃক্ত থাকে, তখন দুর্নীতিটা সেখানে হ্রাস পায়। আর আরেকটা জিনিস হলো পেমেন্ট সিস্টেমগুলো... এখন কিন্তু আগে যেভাবে ম্যানুয়ালি হাতে হাতে টাকা পয়সা লেনদেন হতো, এখন অটোমেশন সিস্টেমের মাধ্যমে আপনাকে পেমেন্ট করতে হয়। সুতরাং যেখানে অর্থের সরাসরি লেনদেন নাই, সেখানে দুর্নীতির সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। এ ছাড়া আমরা বন্দরে কার্যক্রম পরিচালনায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছি। এই ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে একই জায়গায় একই রুমের ভেতর থেকে সবার সঙ্গে চেইন সিস্টেমে..., পাশাপাশি বসা- সবার সামনে জিনিসগুলো লেনদেন হচ্ছে, সুতরাং স্বচ্ছতা অনেক বেশি। আমাদের যে বার্থিং মিটিংটা হয় প্রতিদিন, সেই বার্থিং মিটিংটা কিন্তু অত্যন্ত স্বচ্ছ একটা প্রক্রিয়া, যেটাতে অনলাইনেও চাইলে যে কেউ যুক্ত হতে পারে। আমাদের জাহাজেও পুরো অটোমেশন বার্থিং সিস্টেম। আমাদের ভিটিএমআইএস আছে, যার মাধ্যমে কোন জাহাজ কখন কার আগে কে আসল, একদম পুরো রেকর্ড হয়ে থাকে। এখানে কোনো জাহাজকে আগে-পিছে করার কোন সুযোগ নাই। আগে-পিছে করতে গেলেই তখন তাকে জবাবদিহির ভেতর পড়ে যেতে হয়। সেই দুর্নীতিটা এখন আর করার সুযোগ নাই। একসময় যখন ছিল ম্যানুয়ালি, তখন হয়তো অনেকে অনেক কিছু চিন্তা করত। কিন্তু এখন টোটালি অটোমেটেড একটা বার্থিং সিস্টেম, সেখানে কারো হাত দেওয়ার কিছু নাই। কেউ চাইলেই কোনো সিস্টেমে এটা টেম্পারিং করতে পারে না, কারণ কম্পিউটারে কোন জাহাজ কয়টার সময় আসবে, সেই টাইম উল্লেখ করা থাকে-কোন সময় কোন জাহাজ কোন জায়গায় এসেছে এবং কোথায় নোঙর করেছে। এটা একটা জিনিস। আরেকটা হলো, যে পাইরেসির ব্যাপারে, আমাদের এখানে যে জলদস্যুতা এবং বহির্নোঙরে যে চুরি-ডাকাতি হতো, সেটাও ইনশা আল্লাহ আমাদের এখানে কমে গেছে। গত পরপর কয়েক বছর ধরে যে রেকর্ড আপনারা দেখতে পাবেন, সে রেকর্ডে আমরা কিন্তু ‘জিরো পাইরেসি’ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছি। আমাদের বাংলাদেশের কোস্টগার্ড, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং পোর্টের যে সিকিউরিটি, সবাই মিলে আমরা যেভাবে কাজ করি এবং আমাদের টাস্কফোর্সের যে লোকবল, সবাই মিলে যৌথভাবে যে অপারেশন ও কার্যক্রম পরিচালনা করে, তার সুফল আমরা পেয়েছি। এর ফলে আমাদের বন্দরে দুর্ঘটনা, পাইরেসি, জলদস্যুতা বা ছিঁচকে চুরি-ডাকাতির ঘটনা এখন নাই বললেই চলে।
কিন্তু ব্যবসায়ীদের নানা অভিযোগ শোনা যায় বন্দর নিয়ে। আপনারা কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং নিয়ে এত দুর্দান্ত উন্নয়ন করেছেন, ঠিক সময় নেমে যাচ্ছে, কিন্তু বন্দর থেকে সেটা ছাড়ানোর জন্য অনেক ব্যবসায়ীকে নাকি স্পিড মানি দিতে হয়। ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগ আপনি কীভাবে দেখেন?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: স্পিড মানির কথা আপনাকে আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে এ সমস্যাটা চট্টগ্রাম বন্দরে নেই। এই সমস্যাটা হলো কাস্টমসের। লোকজন আমাদের বেশির ভাগ সময় গুলিয়ে ফেলে। আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের কাজ হলো জাহাজ থেকে কার্গোটা নামিয়ে আমাদের ইয়ার্ডে আমরা স্টেক করে রাখি, এর পরে সবকিছু কিন্তু কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের। আর কাস্টমস থেকে দেখা যায়, অনেক সময় কোনো একটা জিনিসকে টেস্ট করতে পাঠায়, কোনো একটা জিনিসের এইচএস কোডে সমস্যা থাকে, ডিজি কার্গোর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা থাকে... তখন তাদের সঙ্গে যখন কাজটা হয়, সেখানে তাদের বিলম্ব হয়। সেই বিলম্বের জন্য কিন্তু আসলে সবাই বলে যে বন্দরে বিলম্ব হচ্ছে, দেরি হচ্ছে, অনেক সমস্যা, কিন্তু আসলে সেটা বন্দরের সমস্যা না। বন্দর অন্যের সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বসে আছে। যখনই কাস্টমসের ডকুমেন্ট আমরা পাই, আমরা কিন্তু দুই-চার ঘণ্টার ভেতরে আমাদের বন্দর থেকে কার্গোটা গেট দিয়ে আউট করে দিই। কাস্টমস এনবিআর-এর আন্ডারে, তাদের সমস্যাটা তাদেরই লুক আফটার করতে হবে। তারাও চেষ্টা করছে, কিছু কিছু অটোমেশন তারাও করেছে। কাস্টমসের তো জনবলের অনেক স্বল্পতা আছে, ইকুইপমেন্টের স্বল্পতা আছে, আর ল্যাবরেটরির সমস্যাটা হলো সবচেয়ে বেশি প্রকট। বিভিন্ন জিনিস টেস্ট করতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। তারাও চেষ্টা করছে নতুন নতুন ল্যাবরেটরি স্থাপন করার জন্য এবং বাইরে আউটসোর্সিং করেও কিছু দেওয়া যায় কিনা সেটাও তারা চেষ্টা করছে। আশা করি এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের বন্দরের বাইরে বিভিন্ন সময়ে আপনারা বিভিন্ন লিটারেচর দেখবেন- চট্টগ্রাম বন্দরে কনজেশন, চট্টগ্রাম বন্দরে ইয়ার্ড স্পেস কম, চট্টগ্রাম বন্দরে ইকুইপমেন্ট কম–এগুলো কিন্তু ওয়ানস আপন এ টাইম ছিল। এখন কিন্তু সেটা নাই। এখন চট্টগ্রাম বন্দরে জেটির সংখ্যা পর্যাপ্ত, ইকুইপমেন্ট পর্যাপ্ত। আমি যখন মেম্বার হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৫ সালে এখানে কাজ করি, তখন মাত্র চারটা কি গ্রেনটি ক্রেইন এখানে ছিল। এখন সেখানে ১৮টা, এবং প্রত্যেকটা জাহাজে আমরা তিনটা করে ক্রেনকে একসঙ্গে দিতে পারি। সুতরাং আগে যেখানে জাহাজ কন্টেইনার নিয়ে এসে তিন থেকে পাঁচ দিন লেগে যেত ডেলিভারি ডিসচার্জ করতে, এখন সেখানে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টার ভেতর তারা ডেলিভারি করে চলে যায়। এক সময় জেটিতে আসার জন্য জাহাজকে বহির্নোঙরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো, এখন সেটা নেই। এখন জাহাজের জন্য জেটি খালি হয়ে থাকে, আমরা জাহাজ আসার সঙ্গে সঙ্গে ৩৬ থেকে ৪৮ ঘণ্টার ভেতর ডিসচার্জ করে জাহাজকে সেল আউট করে দিচ্ছি। সেই ইফিসিয়েন্সি এখন আমাদের অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। সুতরাং আমাদের চিন্তা করতে হবে, যে সব লিটারেচরগুলো আছে আমার মনে হয়, এখন সময় এসেছে ইন্টারনেটের ওই সব লিটারেচরগুলাকে দূরীভূত করার। চট্টগ্রাম বন্দর এখন আর সেই দশ বছর আগের বন্দর নয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমাদের যেভাবে ইকুইপমেন্ট দিয়েছেন, যেভাবে অর্থ বরাদ্দ করেছেন, যেভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেই দিকনির্দেশনার জন্য আজকে চট্টগ্রাম বন্দর এ অবস্থানে আসতে পেরেছে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের যতগুলো উন্নয়ন প্রকল্প, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সবগুলো করিয়েছেন। আজকে যে আমরা এ জায়গায় এসে পৌঁছেছি, তার কিন্তু কৃতিত্ব আমাদের আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। তিনি বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে হলে বন্দরগুলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। তিনি বন্দরগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছেন। তিনি যেভাবে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি দেশের অন্যান্য সেক্টর যেভাবে ডেভেলপ করছেন, চিটাগাং পোর্টের জন্যও তিনি সেভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তিনি আমাদের অনুমোদন দিয়েছেন বে-টার্মিনালের, অনুমোদন দিয়েছেন মাতারবাড়ি ডিপ সি টার্মিনালের, অনুমোদন দিয়েছেন পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের। সম্প্রতি ১০৪টা ইকুইপমেন্ট কেনারও তিনি অনুমোদন দিয়েছেন, যে ইকুইপমেন্ট প্রাইসের অর্ধেক অংশ ইতিমধ্যে আমাদের বহরে যুক্ত হয়েছে। সুতরাং আমাদের এখানে এখন কোনো ইকুইপমেন্টের স্বল্পতা নাই। ইয়ার্ড স্পেস সম্বন্ধে বলি, আমাদের এখানে আমি যখন জয়েন করি, তখন ইয়ার্ড স্পেস ছিল ৩৯ হাজার টিইউস-এর মতো। এখন সেখানে ইয়ার্ড স্পেস হয়ে গিয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইউস-এর বেশি। সেটা দিন দিন আমরা বাড়াচ্ছি। এর ভেতর আরো কয়েকটা ইয়ার্ড আমাদের বাড়ছে। সেগুলা হলে আগামী এক মাস/দেড় মাসের ভেতর ৫৫ হাজার টিইউস–এ উন্নীত হবে। সুতরাং আমাদের ইয়ার্ড স্পেস খালি। আগে যেখানে কন্টেইনার স্তূপ হয়ে থাকত। এখন আমাদের কন্টেইনার ইয়ার্ডে দেখবেন যেখানে কন্টেইনার আগে সিক্স আই হয়ে থাকত, এখন সেখানে থ্রি আই/ফোর আই-তে নেমে এসেছে। মানে আমাদের ইয়ার্ড স্পেস আমরা এখন অনেক বেশি পাচ্ছি। আমরা ওভার ফ্লো ইয়ার্ড তৈরি করেছি। আমাদের এলসিএল যে কার্গোগুলো আছে, সেগুলো আগে জেটির ভেতর থেকেই ডিসচার্জ করতে হতো। এখনো করে, কিন্তু আমরা তার পাশাপাশি এক্স ওয়াই শিপকে বন্দরের বাইরে একটা স্থানে নিয়ে গেছি। আগামী অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেটাও চালু হবে এবং সেখানে এলসিএল কার্গোগুলো আসলে জেটির ভেতর থেকে যেই কার্গো ডিসচার্জের প্রক্রিয়া, সেটা বাইরে চলে যাচ্ছে। সেটা হলে বন্দরের ভেতর অনেক কম পরিমাণ ট্রাক ঢুকবে। এভাবেই কিন্তু বন্দরটা কনজেশন ফ্রি হয়। আমাদের বন্দরে এখন কোনো কনজেশন নেই, কোনো ইয়ার্ড স্পেস শর্টেজ নাই, কোনো ইকুইপমেন্টেরও শর্টেজ নাই। এখন আন্তর্জাতিক যেকোনো বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরকে তুলনা করতে পারি। যে কেউ বন্দরে এসে একবার ভিজিট করে গেলে বুঝবে যে আমরা সিঙ্গাপুর বলেন, কলম্বো বলেন, মালয়েশিয়া বলেন, ইন্দোনেশিয়া বলেন -সব জায়গাতেই যে বন্দরগুলা আছে, আমাদের এশিয়ার যে বন্দরগুলো আছে, প্রত্যেকটা বন্দরের সঙ্গে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনা করা যায়। একসময় আমাদের বন্দরের ওপর একটা স্টাডি হয়েছিল লন্ডন ভিত্তিক একটা জায়গা থেকে, তারা বলেছিল যে এশিয়ান রিজনে যে ৬৯টা বন্দর আছে, তার ভেতরে সেমি-অটোমেটিক এবং ম্যানুয়াল মুডে যে বন্দরগুলো চলে, তার ভেতরে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান এক নম্বর।
যোগাযোগ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা কতটুকু? কীভাবে এই বিনিয়োগ খাতটিকে আরো এগিয়ে নিতে পারে?
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: পরিবহন এবং লজিস্টিক খাতে দক্ষতা ও গতিশীলতা আনতে বেসরকারি বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। অভিজ্ঞ বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে ভালো একটি বিকল্প হতে পারে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এখানকার সড়ক এবং রেলের ফ্রেইট পরিবহন কোম্পানিগুলো অভ্যন্তরীণ শিপিং লাইনগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যে নতুন ধরনের ফিডার বার্জ-সার্ভিস চালু করা সম্ভব হলে সড়কপথে ট্রাকযোগে কার্গো পরিবহনের ওপর চাপ কমবে। ফলে নৌপথের ব্যবহার বাড়লে লজিস্টিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে। এ মুহূর্তে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে রয়েছি আমরা। আমাদের বন্দর, রেল, সড়ক ও নৌপরিবহন সেবাসহ প্রতিটি খাতের অব্যাহত উন্নয়ন নিশ্চিত করা আবশ্যক। বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র টার্মিনালেও বিদেশি বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আগামী দিনের ‘এশিয়ান টাইগার’ হয়ে ওঠার পথে দেশকে এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে আমরাও প্রস্তুত।
দেশ রূপান্তরকে সময় দিয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আলোচনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম. শাহজাহান: আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে দৈনিক দেশ রূপান্তরের সবাইকে ধন্যবাদ ও ঈদের শুভেচ্ছা জানাই।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। রোবটিক্স বিষয়ক তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিশ্বের সেরা সেরা জার্নালে। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ ও আগ্রহী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' কে তিনি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও সমাজে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
দেশ রূপান্তর: এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
লাফিফা জামাল: এবারের প্রতিপাদ্য খুবই সুন্দর এবং সময়োপযোগী হয়েছে। একদিক দিয়ে আমরা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি, উদ্ভাবনের কথা বলছি।অন্যদিক থেকে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনের কথাও বলছি। তথ্য প্রযুক্তি একটা স্কিল। আমাদের সবাইকে প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। হয়তোবা আমরা সবাই আবিষ্কার করতে পারব না, কিন্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান আমাদের প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আপনি যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর কতদিন ভোক্তা হয়ে থাকব। এখন সময় এসেছে, আমাদের নিজেদের আবিষ্কার করা দরকার। প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠা প্রয়োজন।
দেশ রূপান্তর: আমরা যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি,তাহলে প্রযুক্তি শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেমন?
লাফিফা জামিল: মেয়েদের আগ্রহ অনেক বেশি। সময়ের সাথে সাথে এই আগ্রহ বেড়েছে। প্রযুক্তির বিষয়টা এমন যে, এখানে খুব ডেডিকেটেডলি সময় দিতে হয়। এই জায়গায় মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে নারীর অংশগ্রহণ কেমন?
লাফিফা জামাল: বর্তমানে আমাদের দেশে ৩০ শতাংশ নারীরা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করছে। যদিও পেশাগত জায়গায় ১০ শতাংশের মত নারীদের পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা যাদের পাই, ক্যারিয়ারে গিয়ে তাদের পাই না। এটা যে শুধু প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানে এমন নয়, সব সেক্টরেই নারী শিক্ষার্থীরা ড্রপ আউট হয়। পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয় না, আবার অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হয়েও পরে নানা কারণে ড্রপ আউট হয় বা চাকরি ছেড়ে দেয়।
দেশ রূপান্তর: সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীদের উপস্থিতি কেমন?
লাফিফা জামাল: সাধারণত এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলে আমরা যতটা মেয়েদের পাই, হায়ার লেভেল বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তুলনামূলক ভাবে নারীদের উপস্থিতি কম। যদিও এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনেক সেক্টরেই নারী প্রধান হচ্ছেন। এই জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন কে আরও বেগবান করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে একটা মেয়ে ডাক্তার হওয়ার চিন্তা যতটা সহজে চিন্তা করতে পারে, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হওয়ার চিন্তা ততটা করতে পারে না কেন?
লাফিফা জামাল: আমাদের সমাজে কতজন বাবা-মা চান আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হোক। পরিবার থেকেই মেয়েদের এই সাইকোলজি তৈরি হয়। একটা মেয়ে জন্মের পর থেকে শুনে আসে গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং খুব কঠিন। কঠিন সাব্জেক্ট মেয়েদের জন্য নয়- এই যে সামাজিক ট্যাবু, এটা একটা বড় ব্যারিয়ার। অথচ আপনি যখন গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন এতে আপনার ব্রেইনের চর্চা হয়। ব্রেইন তো নারী পুরুষ উভয়ের ই সমান। এখানে তো শক্তি লাগতেছে না। পেশি শক্তিতে হয়তো মেয়েরা কিছুটা পিছিয়ে থাকে। এই ব্যারিয়ার দূর করতে হবে ।
দেশ রূপান্তর: আপনি একদিক দিয়ে একাডেমিশিয়ান অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে, অভিভাবকদের ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার পরিবর্তে মেয়েকেও কিনে দেব এই চিন্তাটা এসেছে কি?
লাফিফা জামাল: এই উত্তর টা একটু অন্যভাবে দেই। এই চিন্তার কিন্ত পরিবর্তন ঘটেছে। এটা বেশ আশাব্যঞ্জক। আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই ৫০ ভাগ নারী শিক্ষার্থী ১ম বর্ষে ভর্তি হচ্ছে। যাদের একটা বড় অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছে। বর্তমানে স্কুল-কলেজে ঝড়ে পড়া কমেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ডিনস অ্যাওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি থাকে। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ও জিপিএতে মেয়েরাই এগিয়ে থাকছে। ঢাবিসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে নারী ফ্যাকাল্টির সংখ্যা বাড়ছে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে নারীদের একটা বড় অংশ গার্মেন্টসে কাজ করছে, তাদেরকে কীভাবে প্রযুক্তি সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা যায়?
লাফিফা জামাল: এর জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। গার্মেন্টস মালিকদের এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েরা এখন হাতে কাজ করছে। কিছুদিন পর যখন অটো মেশিনে কাজ শুরু হবে, তখন তারা কাজ হারাবে। সেই কাজ হারানোর আগেই তাদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এই মেয়েগুলো যাতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে কাজ করতে পারে, সে জন্য এখন থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: মফস্বলের স্কুল কলেজে ব্যবহারিকের চেয়ে থিওরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে কি শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না?
লাফিফা জামাল: এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া টা জরুরি। হয়তোবা দেখা যাচ্ছে যিনি জীববিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তার ব্যাকগ্রাউন্ডে জীববিজ্ঞান নয় অন্য কোন সাব্জেক্ট রয়েছে। কম্পিউটার বা আইসিটি যিনি পড়াচ্ছেন তিনি হয়তো কম্পিউটারের ব্যবহার ই জানেন না। ফলে ব্যবহারিক বাদ দিয়ে থিওরি পড়াচ্ছেন।
দেশ রূপান্তর: নারীদের দক্ষ করার কাজে যারা যুক্ত তাদের দাবি প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী তারা পাচ্ছেন না।
লাফিফা জামাল: এটা কেবল প্রযুক্তি নয়, সব সেক্টরের চিত্র। স্কুল কলেজের শিক্ষক হিসেবে আমরা মেয়েদের বেশি দেখতে পাই। তবে এখানে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আগে কিন্ত উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের অংশ গ্রহণ কম ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা বাড়ছে। ফলে আমি মনে করি সামনে এই সংখ্যা বাড়বে।
দেশ রূপান্তর: নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু?
লাফিফা জামাল: আমি তো মনে করি পরিবারের সাপোর্টটা খুব বেশি দরকার। পারিবারিক ভাবে যদি কোন মেয়ে বাধার সম্মুখীন হয়, তাহলে শুরুতেই মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাই পরিবারে পিতা মাতা এবং পরবর্তিতে জীবন সঙ্গীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে নারীদের সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি বাড়বে কি না?
লাফিফা জামাল: আমি তা মনে করি না। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে সাইবার বুলিং বাড়বে বিষয়টা এমন নয়। আপনি যদি সচেতন না হন তাহলে একদিন ব্যবহার করেও বিপদে পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুলিং প্রতিরোধ করতে হলে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সমাজেও তো বুলিং হয়, সে জন্য কি আমরা দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। কাজেই বুলিংয়ের ভয়ে প্রযুক্তিতে মেয়েরা আসবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না। যত বেশি প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হতে পারবে, ততই বুলিংয়ের সম্ভাবনা কমবে।
দেশ রূপান্তর: কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপদ পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করা গেছে?
লাফিফা জামাল: আমরা কি গণ পরিবহনে নিরাপদ পরিবেশ দিতে পেরেছি? পারি নি। শুধু গণ পরিবহনে কেন, রাতের বেলা যদি আমি হেঁটেও রাস্তায় বের হই, নিজেকে নিরাপত্তা দিতে পারি না। একইভাবে কর্মক্ষেত্রেও শত ভাগ নিরাপদ পরিবেশ এখনও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই উদ্যোগ প্রয়োজন।'
দেশ রূপান্তর: ধন্যবাদ আপনাকে।
লাফিফা জামাল: দেশ রূপান্তরকেও ধন্যবাদ।
রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলের আলো ঝলমলে অডিটোরিয়ামে দেশি-বিদেশী মডেল ভাড়া করে এনে সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নারী ফুটবল আসর ওমেন্স সুপার লিগের। সিনে জগতের তারকাদের সঙ্গে মঞ্চে র্যাম্প করতে করতে প্রত্যাশার ঘুড়িটা দূর আকাশে উড়িয়েছিলেন সাবিনা-সানজিদারা। দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন এখন তারা। ফুটবলপ্রেমীদের তাদের নিয়ে অসীম আগ্রহকে পুঁজি করে কে-স্পোর্টস আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট করে ফায়দা লুটতে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, মেয়েদের স্বপ্ন ধূসর হয়েছে। এখন তো তা মিলিয়ে গেছে বহুদূরে।
কে-স্পোর্টস-বাফুফের কর্তারা বুঝেছেন, তাদের লেখা চিত্রনাট্য আর বাস্তবতায় বড্ড ফাঁরাক। তাই তারা বারবার টুর্নামেন্ট শুরুর তারিখ দিয়েও আলোচিত টুর্নামেন্টকে মাঠে নিয়ে যেতে পারেননি। সর্বশেষ ১০ জুন আসর শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সেটাও মিথ্যে হয়ে গেছে। তাই হতাশা ছাঁপিয়ে নারী ফুটবলারদের মনে ভর করেছে রাজ্যের ক্ষোভ।
কে-স্পোর্টস আর বাফুফের কর্তারা ভেবেছিলেন এমন একটা টুর্নামেন্টের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে হামলে পড়বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর নেপালে সাফ শিরোপা জয়ের পর মেয়েদের নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বপ্নবাজ করে তোলে সালাউদ্দিন-মাহফুজা আক্তার-ফাহাদ করিমদের। তবে হয়েছে উল্টো। সেটাই যে হওয়ার কথা! কে-স্পোর্টস কিংবা বাফুফে, দুটি প্রতিষ্ঠানই যে এখন ভীষণভাবে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে। এর মাঝে অগোচরে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যেটা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না। কে-স্পোর্টস আর বাফুফের দেখানো স্বপ্নে বুদ হয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলাররা। এমন একটা টুর্নামেন্টে খেলতে মুখিয়ে ছিলেন তারা। এমনিতে ঘরোয়া ফুটবল খেলে সেভাবে পারিশ্রমিক জুটে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে হলে একটা আকর্ষণীয় পারিশ্রমিকের হাতছানি ছিল। তারচেয়েও বেশি ছিল নানা দেশের নামী-দামী ফুটবলারদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করার সুবর্ণ সুযোগ। দারুণ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুখ বুজে মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন দিনের পর দিন। এর মাঝেই তারা দেখেছেন বাবার মতো কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের বিদায়। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ন্যায্য দাবী পুরোপুরি পূরণ না হওয়ার পরও তারা বাফুফের কঠোর অনুশাসন মেনে দুঃসহ গরমে সকাল-বিকাল ঘাম ঝড়িয়েছেন। এরপর যখন দেখলেন এই স্বপ্ন বারবার হোচট খাচ্ছে কে-স্পোর্টসের ব্যর্থতা আর বাফুফের অদূরদর্শীতায়, তখন আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। হতাশার কথা জানাতে গিয়ে অগোচরে তাদের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এসেছে ক্ষোভের আগুন।
অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি বৃহস্পতিবার ক্যাম্প বন্ধ ঘোষণা করে বাফুফে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় পাঁচ দিনের ছুটি। বৃহস্পতিবার রাতে বাসে করে সাতক্ষীরাগামী সাফজয়ের অগ্রনায়ক সাবিনা খাতুন দেশ রূপান্তরকে মুঠোফোনে বলছিলেন, 'ওমেন্স সুপার লিগ স্রেফ আমাদের আবেগ নিয়ে খেললো।' একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, 'প্রথমত সাফের পর কোন খেলা নেই। তারপর এই লিগ মেয়েদের নিয়ে দুই দফা এত কিছু করলো, এত আশা দিলো, মেয়েরা খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল। আর সব থেকে বড় ব্যাপার বিদেশী খেলোয়াড় যারা দক্ষিণ এশিয়ার, তাদের নিয়ে আমি নিজেও কাজ করছিলাম। তাদের কাছে এখন আমার সম্মান কই থাকলো! বারবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেয়েরা অনেক আশায় ছিল। কিন্তু... । এটা নিয়ে অবশ্য মেয়েরা অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আমিও কোন আশা দেখছি না।'
সতীর্থদের সংগে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বাড়ির যেতে যেতে জাতীয় দলের রাইট উইঙ্গার সানজিদা বলছিলেন, 'আসলে কিছু বলার ভাষাই হারায় ফেলেছি। একটা টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমরা কঠোর অনুশীলণ করছিলাম। আশা ছিল খেলবো। এখন সেটা হচ্ছে না বলে খুব কষ্ট লাগছে। যখন শুনলাম লিগটা হবে না, তখন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, বুঝতেই পারছেন।'
সাফের পর কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সিনিয়র ফুটবলাররা। এ নিয়ে ভীষণ হতাশ সানজিদা বলেন, 'নয়টা মাস ধরে অপেক্ষায় আছি খেলার। প্রীতি ম্যাচ বলেন কিংবা কোন টুর্নামেন্ট, একটা ম্যাচও আমরা খেলতে পারিনি সাফের পর। অথচ আমাদের সঙ্গে যারা সাফে খেলেছে, তারা প্রায় সবাই পাঁচটা-ছয়টা করে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফেলেছে এর মধ্যে।' মেয়েদের সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল, মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলার কথা ছিল। অথচ বাফুফে অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে তাদের খেলতে পাঠায়নি। সানজিদা বললেন, 'আমরা আসলে হতাশ হতেও ভুলে গেছি। বারবার টুর্নামেন্টে খেলার কথা বলা হয়, আবার সেটা বাতিল হয়। এরকমটা হতে হতে আসলে আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি।'
হতাশা, বঞ্চনায় বাফুফের চাকুরি থেকে পদত্যাগ করেছেন নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। প্রিয় কোচের জন্য কষ্ট পান সানজিদা, 'ছোটন স্যারের হাত ধরেই আমার এখানে আসা। তার কাছেই আমার ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠা। তিনি চলে গেছেন। এতে খুব কষ্ট পাই। তিনি আমাদের অনেক আদর-যত্ন করতেন। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন হয়, ঠিক তেমন সম্পর্ক ছিল।'
১৩ জুন সাবিনা-সানজিদাদের ক্যাম্পে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে বাফুফে। বিকল্প নেই বলে তারা হয়তো ফিরবেন। তবে ফেরার সময় তাদের চোখে থাকবে না বড় কোন স্বপ্ন। সেটা দেখাই বারণ। কে-স্পোর্টস আর বাফুফে মিলে যে মেয়েদের সব স্বপ্ন গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ের জামাতাকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার, কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য প্রটোকল দেওয়ার একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অনেকেই চিঠিটি শেয়ার করে সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই বলে কথা! কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই প্রটোকল কোন হিসেবে পান? আবার কেউবা বলছেন, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে!
জানা যায়, গত ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। পরে ৭ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালককে চিঠিটি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে চিঠিটির সত্যতাও পাওয়া যায়।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্ত্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের মেয়ের জামাতা মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ৯ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ইকে ৫৮৬ যোগে দুবাই থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। তাকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতিসহ মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার মশিউর রহমানকে কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশন এবং বিমানবন্দরের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য বোর্ডিং ব্রিজ পাস দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিমানবন্দর পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য পৃথক লাউঞ্জ রয়েছে। যেটাকে ভিআইপি লাউঞ্জ বলা হয়। ভিআইপি লাউঞ্জ কারা ব্যবহার করতে পারবেন এমন একটি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
লাউঞ্জ রজনীগন্ধা, বকুল, দোলনচাঁপা ও চামেলি নামে বিমানবন্দরে ৪টি ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। রজনীগন্ধা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ভিআইপিরা ব্যবহার করেন। বকুল ব্যবহার করেন অতিরিক্ত সচিব বা তার পদমযার্দার ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা। দোলনচাঁপা ব্যবহার করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর চামেলি দিয়ে একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রবেশ ও বের হতে পারেন।
আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভা আজ শুক্রবার। এদিন সন্ধ্যা ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি বাসভবন গণভবনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি জানান, সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংশ্লিষ্ট সবাইকে স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মেনে যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অ্যাক্রেডিটেশন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বাণিজ্য সম্প্রসারণে কার্যকর ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ অ্যাক্রেডিটেশন বোর্ডের (বিএবি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
তিনি ‘বিশ্ব অ্যাক্রেডিটেশন দিবস ২০২৩’ উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে এ আহবান জানান।
‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও শুক্রবার (৯ জুন) বিএবি’র উদ্যোগে ‘বিশ্ব অ্যাক্রেডিটেশন দিবস ২০২৩’ পালিত হচ্ছে জেনে সন্তোষ প্রকাশ করে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, অ্যাক্রেডিটেশন ও বাণিজ্য পারস্পরিক আস্থার সূত্রে গাঁথা।
তিনি বলেন, মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধি-বিধান, মেট্রোলজি, নিরপেক্ষ ও স্বীকৃত সাযুজ্য নিরূপণ ব্যবস্থা একটি দেশের গুণগত মান অবকাঠামোর প্রাথমিক ভিত্তি, যা ব্যবসায়ী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমকে সহজতর করার পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে সহায়তা করে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্যে কারিগরি বাধা অপসারণে অ্যাক্রেডিটেশনের গুরুত্ব অপরিসীম। জাতীয় মান ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং ভোক্তা ও উৎপাদকের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে অ্যাক্রেডিটেশন বিশ্ব বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এ প্রেক্ষিতে দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য-‘অ্যাক্রেডিটেশন : সাপোটিং দ্যা ফিউচার অব গ্লোবাল ট্রেড’ যথার্থ ও সময়োপযোগী হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বিএবি অ্যাক্রেডিটেশন সেবা প্রদানের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অবদান রাখছে। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অ্যাক্রেডিটেশন কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।
মাত্র এক বছরেই পাল্টে গেছে বাংলাদেশের চিত্র। শ্রীলঙ্কাকে ধার দিয়ে ঋণদাতা হিসেবে গর্ব করা দেশের মানুষের এখন নাকাল দশা। বিদেশি মুদ্রা বিশেষ করে ডলার সংকটের কারণে সরকার জরুরি অনেক পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এতে সরবরাহজনিত সংকট তৈরি হয়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম।
একই কারণে জ¦ালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে। গরম আর লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত মানুষ। হিটস্ট্রোকে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বাধ্য হয়ে সরকার অনেক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস সংকটে শিল্পোৎপাদন কমে ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এটিও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ।
এমন পরিস্থিতিতে পরিকল্পনামন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, নিত্যপণ্য আর বিদ্যুতে ভয়াবহ সংকটে আছে বাংলাদেশ।
সর্বশেষ মে মাসের মূল্যস্ফীতি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, যা ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। রেকর্ড মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সংগতি না মেলায় ধার করে চলতে হচ্ছে অনেককে। এখন গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে খরচ করতে হচ্ছে বেশি। যেটি কয়েক মাস আগেও গ্রামে বেশি ছিল। ব্যয়ের চাপ সামলাতে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শুধু আমদানি পণ্যে নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্য ঘিরেও নানান সিন্ডিকেট সক্রিয়। এসব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সব পণ্য। পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চমূল্যে পণ্য কিনতে গিয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) বাজেট পরবর্তী আলোচনায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতি ইস্যুতে বলেন, বিশে^র প্রায় সব দেশ সফলভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। শুধু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
২০২১ সালের আগস্টে দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। করোনায় আমদানি কমে যাওয়ায় এবং অনেক ঋণপত্রে (এলসি) নিষ্পত্তি ছয় মাস থেকে এক বছর পিছিয়ে দেওয়ায় রিজার্ভ ওই পরিমাণে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালসহ সব পণ্যের দাম ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হয়। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এক বছরের মধ্যে ৩০ বিলিয়নের নিচে নেমে আসে। বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধের চাপ এবং আমদানির পুরনো দায় পরিশোধের চাপে বেসামাল হয়ে পড়ে সরকার।
ফলে ২০২১ সালে যেখানে শ্রীলঙ্কাকে ধার দিয়েছিল বাংলাদেশ ২০২২ সালে সেই বাংলাদেশকেই ডলার ধারের জন্য আন্তর্জাতিক পরিম-লে হাত পাততে হয়েছে। নানা রকম শর্ত মেনে আইএমএফের কাছ থেকে ধার নিতে হয় বাংলাদেশকে। সংস্থাটির কাছ থেকে সাড়ে তিন বছরের কিস্তিতে ৪৭০ কোটি ডলার ধারের প্রথম কিস্তি পেলেও দেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং আইএমএফের শর্তের কারণে রিজার্ভ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে গিয়ে আমদানি সীমিত করে আনতে হয়েছে। অনেক আমদানির বিলও বকেয়া পড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে নেমেছে যে, এখন জরুরি প্রয়োজনের বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা, এলএনজির মতো জ¦ালানিও আনতে পারছে না।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সর্বশেষ হিসাব বলছে, শিল্পের অবদান কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপিতে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৭৯ শতাংশে। আগের অর্থবছরে যা ছিল ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
সামগ্রিক এই সংকটের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, জ¦ালানি সংকট সমাধানে যেগুলো ডেফার্ড পেমেন্ট আছে সেগুলো দিতে হবে। সেগুলো দিয়ে যে সাপ্লাই চেইন বন্ধ আছে সেগুলোকে সচল করতে হবে। এটাকে প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে। দরকার হলে অন্য জায়গায় যে প্রকল্পগুলো আছে সেসব প্রকল্পে ধীরে যেতে হবে। প্রকল্পের টাকা এখানে নিয়ে আসতে হবে। কারণ আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে। ডলার খরচের ক্ষেত্রে জ¦ালানিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখন জ¦ালানি না কিনে যদি রিজার্ভ বাড়ানোর চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে রপ্তানিকারকরা রপ্তানি করতে পারছেন না। কারণ তারা উৎপাদন করতে পারছেন না। তখন রপ্তানি আয়ও কমে যাবে। তখন রিজার্ভে অন্য সমস্যা আসবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদ্ধতি কী হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তাফিজ বলেন, বাজারে খুব দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজস্ব নীতি এবং মুদ্রানীতি দুটোই ব্যবহার করতে হবে। এখন টাকার সরবরাহ যা আছে তা কমাতে হবে। সুদহারকে বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। আর যেসব জায়গায় প্রয়োজন আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। পেঁয়াজের বাজারে কী হলো সেটি তো দেখা গেছে। উৎপাদন কত, চাহিদা কত এগুলো ঠিক মতো পর্যালোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সময়মতো আমদানি করলে তো এটি এতটা বাড়ত না।
তিনি আরও বলেন, মূল্যস্ফীতির এমন পরিস্থিতিতে ফ্যামিলি কার্ড বাড়াতে হবে। খোলাবাজারে বিক্রি করে কিছুটা সামাল দিতে হবে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
নিজের বিদায়ী ম্যাচ বলেই কিনা জ্বলে উঠলেন সার্জিও রামোস। শুরুতেই পেয়ে যান গোলের দেখা। কিলিয়ান এমবাপ্পে আছেন তার আগের মতোই। তিনিও ডাবল লিড এনে দেন। তবে বিদায়ী ম্যাচে নিষ্প্রভ রইলেন লিওনেল মেসি। তাতেই কিনা শুরুতেই এগিয়ে যাওয়া ম্যাচটি হার দিয়ে শেষ করেছে পিএসজি।
লিগ ওয়ানের শেষ ম্যাচে ক্লেরমো ফুতের সঙ্গে ৩-২ গোলে হেরে গেছে প্যারিসিয়ানরা। তাতে রাঙানোর বদলে বিষাদভরা বিদায় হলো মেসি-রামোসদের।
আগেই লিগ শিরোপা নিশ্চিত করা পিএসজি মৌসুমে নিজেদের এই শেষ ম্যাচে দুটি পরিবর্তন নিয়ে মাঠে নেমেছিল। হুগো একিতেকে ও আশরাফ হাকিমিকে ফেরান কোচ ক্রিস্তফ গালতিয়ের।
শুরুতে গুছিয়ে উঠতে সময় লেগেছে পিএসজির। প্রথম ১০ মিনিটের পর ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ২১ মিনিটের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল ২-০ গোলে। রামোস ১৬ মিনিটে হেড থেকে এবং তার ৫ মিনিট পর কিলিয়ান এমবাপ্পে পেনাল্টি থেকে গোল করেন।
২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে ক্লেরম ফুতের পাল্টা লড়াই শুরু করতে সময় নিয়েছে মাত্র ৩ মিনিট। ২৪ মিনিটে গোল করেন ক্লেরমঁর গাস্তিয়েন। এর প্রায় ১২ মিনিট পরই পেনাল্টি থেকে গোল করার সুযোগ নষ্ট করেন ক্লেরমঁ স্ট্রাইকার কেয়ি। পরে অবশ্য ৬৩ মিনিটে তাঁর গোলেই জিতেছে ক্লেরমঁ। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে ক্লেরমঁর হয়ে সমতাসূচক গোলটি জেফানের।
বিরতির পর গোলের দারুণ একটি সুযোগ নষ্ট করেন মেসি। ৫৪ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে এমবাপ্পে ঢুকে পড়েন ক্লেরমঁর বিপদসীমায়। তাঁর ক্রস পেয়ে যান ডান প্রান্ত দিয়ে দৌড় বক্সে ঢোকা মেসি। সামনে গোলকিপার একা, কিন্তু মেসি অবিশ্বাস্যভাবে বলটা পোস্টের ওপর দিয়ে মারেন।
সতীর্থ গোলকিপার সের্হিও রিকোর সুস্থতা কামনা করে বিশেষ জার্সি পরে মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন মেসি-এমবাপ্পেরা। ঘোড়ায় চড়তে গিয়ে দূর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন রিকো। ম্যাচে বিশেষ জার্সি পরে খেলেছে পিএসজি। মেসি-রামোসদের জার্সির পেছনে রিকোর নাম লেখা ছিল।
৩৮ ম্যাচে ৮৫ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষে থেকে মৌসুম শেষ করল পিএসজি। ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে লেঁস। তৃতীয় মার্শেইয়ের সংগ্রহ ৭৩ পয়েন্ট। ৬৮ পয়েন্ট নিয়ে চারে ইউরোপা লিগ নিশ্চিত করা রেঁনে।
এক যুগের ব্যবধানে ঘটা সহিংসতার দুটি ঘটনায় করা তিন শতাধিক মামলা দীর্ঘদিন ঝুলে থাকার পর তদন্ত করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। মামলাগুলো ২০০১ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা এবং ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়ের করা হয়েছিল। পাশাপাশি যেসব মামলা বিচারাধীন আছে সেগুলোও দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে পুলিশের সব ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে।
পুুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনে আসা ‘ভিআইপি অভিযোগগুলো’ আমলে নিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশ ও দুদক সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নতুন করে তদন্ত করার সময় অহেতুক নিরপরাধ লোকজন যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। মামলায় যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে আরও গভীরে গিয়ে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে ২০০১ ও ২০১৩-২০১৫ সালে সহিংসতা মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, রাজনৈতিক কারণে মামলা জিইয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। সব সরকারের আমলেই এসব করা হচ্ছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে তান্ডব চালিয়েছিল এই নিয়ে দেশে বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাসহ অনেকেই আসামি হয়েছেন। ২০১৩-২০১৫ সালে সহিংতার ঘটনা মামলা হয়েছে এসব মামলা দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন ও যেসব মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে সেগুলোর দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দিনের পর দিন ওইসব মামলা আদালতে ঝুলছে। এতে ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই যারা এসব অপকর্ম করেছে তাদের তাদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।
সহিংসতা মামলার পাশাপাশি গত ১০ বছরের ব্যবধানে দুর্নীতি দমন কমিশনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ‘ভিআইপি অভিযোগগুলো’ অনুসন্ধান করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি ও জামায়াত ২০১৩-২০১৫ সালে তান্ডবলীলা চালিয়েছে। ২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ব্যাপক অত্যাচার করা হয়েছিল। ওইসব মামলার বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া আন্দোলনের নামে ঢাকাসহ সারা দেশে তান্ডব চালিয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট। সারা দেশেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব মামলা কী অবস্থায় আছে তাও পর্যবেক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতা করে যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার অপপ্রয়াস চালিয়েছিল, তাদের বিচার করা হবে। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। তবে নিরপরাধ কাউকে আমরা হয়রানি করছি না। ভবিষতেও করব না।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। তাদের দমন করতে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে হবে না। এতে সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। আন্দোলনের নামে তারা জ্বালাও-পোড়াও করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে। এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি যেসব মামলা আদালতে রয়েছে সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।
একই কথা বলেছেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, হামলায় পেশিশক্তি যেমন থাকে, রাজনৈতিক শক্তিও থাকে। সাধারণভাবে এমন একটি ধর্মীয় জিগির তোলা হয় তখন অনেক ক্ষেত্রেই সব দল এক হয়ে হামলা চালায়। বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। যারা এসব অপকর্ম করছে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি যেসব মামলার তদন্ত শেষ হয়নি তা সঠিকভাবে তদন্ত করতে হবে। ঢালাওভাবে রাজনৈতিক নেতাদের দোষারোপ করা যাবে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখনো বেশ কিছু মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তাছাড়া জ্বালাও-পোড়াওয়ের অনেক মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। সবমিলিয়ে অন্তত তিন শতাধিক মামলা হবে। এসব মামলা সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পুুলিশের সব ইউনিটকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার না হওয়ায় আবারও একটি মহল দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, স্পর্শকাতর মামলায় দীর্ঘদিনে বিচারকাজ শেষ না হওয়ার কারণে বাদীপক্ষের মধ্যে এক ধরনের হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আসামিপক্ষ ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করে। আর এসব কারণে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঝুলে থাকা মামলাগুলো সক্রিয় করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তবে অহেতুক কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে বলা হয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার কারণ উদঘাটন এবং জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ‘হিউম্যান রাইট ফর পিস’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ২০০৯ সালের ৬ মে এসব নির্যাতনের অভিযোগ তদন্তের জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয় আদালত। ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ মো. সাহাবুদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যর বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন দীর্ঘ সময় তদন্ত করে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে একটি প্রতিবেদন দেয়। তদন্তকালে কমিশন ৫ হাজার ৫৭১টি অভিযোগ পেয়েছিল। বিএনপি ও জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্তত ১৮ হাজার নেতাকর্মী জড়িত ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। সহিংসতার পর বরিশাল বিভাগে ২ হাজার ১৮৯টি, ঢাকায় ১৮৪টি, চট্টগ্রামে ৩৫০টি, রাজশাহীতে ১১৭টি এবং খুলনায় ৪০৫টি হামলার ঘটনা ঘটে। তাছাড়া হামলায় খুলনা বিভাগে ৭৩, ঢাকা বিভাগে ৯২, রাজশাহী বিভাগে ৫৩, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯৭, বরিশাল বিভাগে ৩৮ এবং সিলেট বিভাগে ২ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। তারমধ্যে ভোলা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, যশোর, নাটোর, রাজবাড়ী, পাবনা, ফেনী, রাজশাহী, ঝিনাইদহ, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, দৌলতখান, চরফ্যাশন, লালমোহন, বোরহানউদ্দিন, কুষ্টিয়া, গাজীপুর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা এবং মৌলভীবাজার জেলায় হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড বেশি ঘটে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২২১টি। এর মধ্যে ৫৭টি মামলা তদন্তাধীন। বাকিগুলোতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র আরও জানায়, ২০১৩-১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে পেট্রলবোমা হামলায় দেশজুড়ে মারা গেছে শতাধিক নিরীহ মানুষ। তারমধ্যে আগুনেই পুড়ে মারা গেছে ৪০ জনের মতো। এ সময় রেললাইন পর্যন্ত উপড়ে ফেলাসহ সরকারি সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। ওই সময় মামলা হয়েছে প্রায় ৩ হাজার। বেশির ভাগ মামলার তদন্ত হয়েছে। ৪৫০টি মামলা বিচারধীন। এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা আসামি। তারা কৌশলে বারবার শুনানির তারিখ নেয়, যে কারণে মামলা পিছিয়ে যায়। এখন সিদ্ধান্ত হয়েছে, কয়েকটি তারিখ দেওয়ার পর মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা হবে।
এছাড়া ৩১২টি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ করে দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে নাশকতা মামলার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বেশিরভাগ মামলার আসামি এলাকায় থাকেন না। তাদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করে অভিযোগপত্র দেওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে খুব কঠিন হয়ে যায়। আর যেসব মামলায় আদালতে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোরও বিচার কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। তাছাড়া পলাতক আসামিদের বিষয়ে কিছু আইনি জটিলতার কারণেই দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুনরায় নাশকতা ঘটানো হতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না তারা। এই নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। তার জানামতে, মামলাগুলো নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা একাধিক সভা করেছেন।
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, গত দশ বছরে দুদকে ‘অনেক ভিআইপির’ বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। ওইসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। অনুসন্ধানের জন্য আলাদা কমিটি করে দেওয়া হয়েছে।