
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন চার দশকের বেশি সময়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বায়ান্নতে পা দিল বাংলাদেশদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত ৫১ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থান থেকে আমরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কভিড সংকটের সময়েও ৭ শতাংশের ধারেকাছে ছিল। গত দেড় দশক এই উন্নতি দ্রুত হয়েছে, তবে কভিড সংকট এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে বিশাল সংকট সৃষ্টি করেছে তার অভিঘাতে আমরা এখন বিপদে আছি।
উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য প্রকট করেছে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিত্তবানদের লোভ এবং বিদেশে টাকা পাচারের চর্চা। কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ, অথচ তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের এখন তিন বেলা আহার জোটানো কঠিন। এ অবস্থার জন্য দায়ী নীতি ও কৌশলের দুর্বলতা, মন্ত্রণালয়গুলোর এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকান্ডে অস্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব। ব্যাংকের তহবিল লুটে নেওয়ার খবর আমরা শুনি, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেখি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার যদি কঠোর হয়, আইন-আদালত কঠোর অবস্থানে যায়, তাহলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। এটি না হলে সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য মøান হয়ে যাবে।
সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, প্রধানত শিক্ষার বিস্তারের ফলে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। বড় কিছু এনজিও সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব রেখেছে। তাদের কাজে দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। সরকারের অনেক নীতি ও কর্মসূচি বিশেষ করে স্কুল-কলেজের মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। উল্টোপিঠে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি এবং সংঘাত বেড়েছে। উগ্রবাদের প্রসার ঘটেছে। সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চলতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।
রাজনীতিতে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় চিরস্থায়ী হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে যে রাজনীতিচর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বড় দুই দল পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস পোষণ করে, এটি রাজনীতিতে সুস্থতা আনতে পারে না। ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করার, এর প্রধান নায়কদের সম্পূর্ণভাবে আড়ালে ঠেলে ১৯৪৮ সাল থেকে চলা পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চব্বিশ বছরের আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে একটি পক্ষ। এই মানসিকতার অবসান না হলে রাজনীতি কখনো সংঘাতমুক্ত হবে না, একাত্তরে যারা স্বজাতি হত্যা করেছিল, তাদের শক্তিশালী করা হবে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, ১৯৭১ নিয়ে ছড়ানো নানা বিভ্রান্তিও দেশের রাজনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।
দেশ রূপান্তর : আপনাদের বেড়ে ওঠার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধরন কেমন ছিল? এখন কেমন দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি ১৯৬৮ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বুদ্ধিজীবী শব্দটি সমীহ জাগাত। কারণ বুদ্ধিজীবী তাদেরই বলা হতো যারা তাদের চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধির চর্চা দিয়ে কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতেন, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নিরন্তর চেষ্টা করে যেতেন, অনেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও নেমেছেন যেমন সাম্য, মানবাধিকার, দেশের সম্পদে গরিবের ন্যায্য অধিকার, শোষণ-বঞ্চনার অবসান। তাদের প্রায় সবাই পেশাজীবী ছিলেন, কিন্তু নিজস্ব পেশার বাইরে গিয়ে দেশের কল্যাণে তারা নিবেদিত থাকতেন। এরা অবধারিতভাবে ছিলেন এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী অনেকে কারাভোগও করতেন।
আমাদের এই সময়ে বুদ্ধিজীবী যারা আছেন, তারা প্রধানত নিজেদের পেশাতেই নিয়োজিত থাকেন, এবং পেশাজীবী হিসেবে হয়তো সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু পেশার বাইরে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তরুণ এবং পরিবর্তনকামী মানুষের পক্ষে তারা কোনো সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন না। মাত্র কয়েকজনই আছেন, যারা পুরনো ধারার বুদ্ধিজীবী, যারা ক্ষমতাকে ভয় না পেয়ে সত্য কথাটা বলে যান।
দেশ রূপান্তর : ৭০-এর দশকে প্রফেসর রাজ্জাক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন, পরবর্তী সময়ে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। সবশেষ, তরুণদের ভেতর আহমদ ছফার জনপ্রিয়তা দেখা গেছে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? নতুন কেউ আসছেন না কেন, নাকি আমরা দেখতে পারছি না নতুনদের?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এদের দুজনই এস্টাব্লিশমেন্ট যেদিকে চলত, তার বিপরীতে ছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক মানুষের নিজস্বতাকে মূল্য দিতেন, কোনো আদেশ-নির্দেশকে পরোয়া করতেন না, প্রকৃত জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে সবাইকে উৎসাহ দিতেন। ফলে প্রতিবাদী এবং পরিবর্তনকামী তরুণদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। আহমদ ছফা শুধু তার চিন্তাচেতনা নয়, জীবনযাপনেও এক প্রচলবিরোধী মানুষ হিসেবে নন্দিত হয়েছিলেন। তিনিও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সক্রিয়তাকে, পুরনোকে প্রশ্ন করতে এবং হায়ারার্কি অথবা সমাজের মোড়লদের দ্বিমুখী চরিত্র এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর হতে তরুণদের বলতেন। নতুনরা যে আসছেন না, তা নয়, কিন্তু এখন সমাজটাই তো বদলে গেছে। এখন আহমদ ছফার মতো মানুষ যদি দলনির্বিশেষে রাজনীতিকে তার অন্তঃসারশূন্যতার জন্য প্রশ্ন করতে থাকেন, তাকে অনেক তরুণের বাধার সামনে পড়তে হবে।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাসিত গুজব আর মেকি খবর এবং দৃশ্য মাধ্যমের তারল্যের যুগে এবং মুখস্থবিদ্যাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে প্রফেসর রাজ্জাক এবং আহমদ ছফার মতো মানুষকে সহজে গ্রহণ করার মতো তরুণদের সংখ্যাই তো কম।
দেশ রূপান্তর : বলা হয়ে থাকে গত ৫০ বছরে দেশের সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে, এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের দায় কতটুকু বা আদৌ তাদের কোনো দায় আছে কি না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত পঞ্চাশ বছরে সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি সংগঠিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্রবাদ বেড়েছে, সংস্কৃতিকে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে নিতে এরা তৎপর। এখন রাষ্ট্র সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের বিপদ ভাবে। এসব কারণে মুক্তচিন্তার মানুষেরা একদিকে এই সংস্কৃতিবিরোধী শক্তির আঘাত, অন্যদিকে সরকারের সমর্থনের অভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ফলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরাও যেমন সংখ্যায় নিতান্ত কম, সমাজও তাদের আর খোলা মন নিয়ে গ্রহণ করতে রাজি নয়। সংস্কৃতির অবনমনের কারণ যদি হয় সমাজের অবস্থান পরিবর্তন (উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক থেকে চূড়ান্ত রক্ষণশীল, এবং অনেক সময় সংস্কৃতিবিরোধী), দায়টা তো সবার।
দেশ রূপান্তর : একসময় বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার যে চর্চা তার একটা প্রভাব ছিল। এখন সেটা তেমন দেখা যাচ্ছে না। আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কি শেষ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। কিন্তু সমাজের অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন, জাগতিক লোভের কাছে আত্মসমর্পিত অংশটির যেরকম শক্তি বাড়ছে, তাতে আদর্শের কথাটা এখন অচল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। বুদ্ধিজীবীরা তখনই তাদের কাজের প্রভাব দেখেন যখন মানুষ নিজেদের অধিকারের (যার মধ্যে সাংস্কৃতিক অধিকার অন্যতম, যেমন ছিল ৫০-৬০ এর দশকে) জন্য সংগ্রামে নামে। সেই পরিবেশ এখন নেই। সেজন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই প্রথমে করতে হবে, কিন্তু যেখান থেকে এই সংগ্রাম শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারসেখানেই তো দুর্বলতা প্রকট।
দেশ রূপান্তর : ইন্টারনেটের প্রসারে অনলাইনে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দাবি করা হয়। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পশ্চিমা বিশ্বে, এশিয়ার অনেক দেশে, এমনকি ভারতেও ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চার একটা শক্তিশালী ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। কভিডের দুই-আড়াই বছরে আমি পশ্চিমের দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম-আলোচনায় অংশ নিয়েছি, ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও দেখেছি, যেখানে জ্ঞানের নানা অঞ্চলে আলো ফেলে কেউ লেকচার দিয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন অথবা প্রশ্নোত্তরে তাদের কথাগুলো বলেছেন। ইউটিউবে আমাদের দেশের সেরকম ভিডিও আমি খুব কমই পেয়েছি। ইউটিউবে (এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) একবার ঘুরে এলে দেখবেন কীরকম হিংসা, বিদ্বেষ, অসূয়া, নারীকে নিয়ে কটূক্তি, মানুষকে অপমান করার নিরন্তর চর্চা সেখানে হয়। ইন্টারনেটে বুদ্ধিবৃত্তির যে সত্যিকার চর্চা এখানে হয়, তা এতই সীমিত যে আঠারো কোটি মানুষের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা সত্যিই দুঃখজনক।
ইউটিউবে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যদি কোনো বক্তৃতা পান, দেখবেন, সেই বক্তৃতা শুনেছে খুব বেশি হলে ৫ হাজার মানুষ। অথচ গালিগালাজ করা, বিদ্বেষ আর উগ্রতা ছড়ানো হয় যেসব ভিডিওতে, সেগুলো শোনে লাখ লাখ মানুষ।
ইন্টারনেটকে আমরা হয়তো একদিন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের একটা মাধ্যম হিসেবে পাব, কিন্তু সেজন্য অনেক সময় লাগবে। ততদিনে হয়তো ইন্টারনেটই প্রাচীন হয়ে যাবে। নতুন কোনো প্রযুক্তি আসবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। রোবটিক্স বিষয়ক তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিশ্বের সেরা সেরা জার্নালে। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ ও আগ্রহী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' কে তিনি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও সমাজে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
দেশ রূপান্তর: এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
লাফিফা জামাল: এবারের প্রতিপাদ্য খুবই সুন্দর এবং সময়োপযোগী হয়েছে। একদিক দিয়ে আমরা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি, উদ্ভাবনের কথা বলছি।অন্যদিক থেকে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনের কথাও বলছি। তথ্য প্রযুক্তি একটা স্কিল। আমাদের সবাইকে প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। হয়তোবা আমরা সবাই আবিষ্কার করতে পারব না, কিন্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান আমাদের প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আপনি যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর কতদিন ভোক্তা হয়ে থাকব। এখন সময় এসেছে, আমাদের নিজেদের আবিষ্কার করা দরকার। প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠা প্রয়োজন।
দেশ রূপান্তর: আমরা যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি,তাহলে প্রযুক্তি শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেমন?
লাফিফা জামিল: মেয়েদের আগ্রহ অনেক বেশি। সময়ের সাথে সাথে এই আগ্রহ বেড়েছে। প্রযুক্তির বিষয়টা এমন যে, এখানে খুব ডেডিকেটেডলি সময় দিতে হয়। এই জায়গায় মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে নারীর অংশগ্রহণ কেমন?
লাফিফা জামাল: বর্তমানে আমাদের দেশে ৩০ শতাংশ নারীরা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করছে। যদিও পেশাগত জায়গায় ১০ শতাংশের মত নারীদের পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা যাদের পাই, ক্যারিয়ারে গিয়ে তাদের পাই না। এটা যে শুধু প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানে এমন নয়, সব সেক্টরেই নারী শিক্ষার্থীরা ড্রপ আউট হয়। পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয় না, আবার অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হয়েও পরে নানা কারণে ড্রপ আউট হয় বা চাকরি ছেড়ে দেয়।
দেশ রূপান্তর: সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীদের উপস্থিতি কেমন?
লাফিফা জামাল: সাধারণত এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলে আমরা যতটা মেয়েদের পাই, হায়ার লেভেল বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তুলনামূলক ভাবে নারীদের উপস্থিতি কম। যদিও এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনেক সেক্টরেই নারী প্রধান হচ্ছেন। এই জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন কে আরও বেগবান করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে একটা মেয়ে ডাক্তার হওয়ার চিন্তা যতটা সহজে চিন্তা করতে পারে, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হওয়ার চিন্তা ততটা করতে পারে না কেন?
লাফিফা জামাল: আমাদের সমাজে কতজন বাবা-মা চান আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হোক। পরিবার থেকেই মেয়েদের এই সাইকোলজি তৈরি হয়। একটা মেয়ে জন্মের পর থেকে শুনে আসে গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং খুব কঠিন। কঠিন সাব্জেক্ট মেয়েদের জন্য নয়- এই যে সামাজিক ট্যাবু, এটা একটা বড় ব্যারিয়ার। অথচ আপনি যখন গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন এতে আপনার ব্রেইনের চর্চা হয়। ব্রেইন তো নারী পুরুষ উভয়ের ই সমান। এখানে তো শক্তি লাগতেছে না। পেশি শক্তিতে হয়তো মেয়েরা কিছুটা পিছিয়ে থাকে। এই ব্যারিয়ার দূর করতে হবে ।
দেশ রূপান্তর: আপনি একদিক দিয়ে একাডেমিশিয়ান অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে, অভিভাবকদের ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার পরিবর্তে মেয়েকেও কিনে দেব এই চিন্তাটা এসেছে কি?
লাফিফা জামাল: এই উত্তর টা একটু অন্যভাবে দেই। এই চিন্তার কিন্ত পরিবর্তন ঘটেছে। এটা বেশ আশাব্যঞ্জক। আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই ৫০ ভাগ নারী শিক্ষার্থী ১ম বর্ষে ভর্তি হচ্ছে। যাদের একটা বড় অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছে। বর্তমানে স্কুল-কলেজে ঝড়ে পড়া কমেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ডিনস অ্যাওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি থাকে। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ও জিপিএতে মেয়েরাই এগিয়ে থাকছে। ঢাবিসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে নারী ফ্যাকাল্টির সংখ্যা বাড়ছে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে নারীদের একটা বড় অংশ গার্মেন্টসে কাজ করছে, তাদেরকে কীভাবে প্রযুক্তি সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা যায়?
লাফিফা জামাল: এর জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। গার্মেন্টস মালিকদের এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েরা এখন হাতে কাজ করছে। কিছুদিন পর যখন অটো মেশিনে কাজ শুরু হবে, তখন তারা কাজ হারাবে। সেই কাজ হারানোর আগেই তাদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এই মেয়েগুলো যাতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে কাজ করতে পারে, সে জন্য এখন থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: মফস্বলের স্কুল কলেজে ব্যবহারিকের চেয়ে থিওরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে কি শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না?
লাফিফা জামাল: এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া টা জরুরি। হয়তোবা দেখা যাচ্ছে যিনি জীববিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তার ব্যাকগ্রাউন্ডে জীববিজ্ঞান নয় অন্য কোন সাব্জেক্ট রয়েছে। কম্পিউটার বা আইসিটি যিনি পড়াচ্ছেন তিনি হয়তো কম্পিউটারের ব্যবহার ই জানেন না। ফলে ব্যবহারিক বাদ দিয়ে থিওরি পড়াচ্ছেন।
দেশ রূপান্তর: নারীদের দক্ষ করার কাজে যারা যুক্ত তাদের দাবি প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী তারা পাচ্ছেন না।
লাফিফা জামাল: এটা কেবল প্রযুক্তি নয়, সব সেক্টরের চিত্র। স্কুল কলেজের শিক্ষক হিসেবে আমরা মেয়েদের বেশি দেখতে পাই। তবে এখানে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আগে কিন্ত উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের অংশ গ্রহণ কম ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা বাড়ছে। ফলে আমি মনে করি সামনে এই সংখ্যা বাড়বে।
দেশ রূপান্তর: নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু?
লাফিফা জামাল: আমি তো মনে করি পরিবারের সাপোর্টটা খুব বেশি দরকার। পারিবারিক ভাবে যদি কোন মেয়ে বাধার সম্মুখীন হয়, তাহলে শুরুতেই মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাই পরিবারে পিতা মাতা এবং পরবর্তিতে জীবন সঙ্গীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে নারীদের সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি বাড়বে কি না?
লাফিফা জামাল: আমি তা মনে করি না। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে সাইবার বুলিং বাড়বে বিষয়টা এমন নয়। আপনি যদি সচেতন না হন তাহলে একদিন ব্যবহার করেও বিপদে পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুলিং প্রতিরোধ করতে হলে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সমাজেও তো বুলিং হয়, সে জন্য কি আমরা দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। কাজেই বুলিংয়ের ভয়ে প্রযুক্তিতে মেয়েরা আসবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না। যত বেশি প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হতে পারবে, ততই বুলিংয়ের সম্ভাবনা কমবে।
দেশ রূপান্তর: কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপদ পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করা গেছে?
লাফিফা জামাল: আমরা কি গণ পরিবহনে নিরাপদ পরিবেশ দিতে পেরেছি? পারি নি। শুধু গণ পরিবহনে কেন, রাতের বেলা যদি আমি হেঁটেও রাস্তায় বের হই, নিজেকে নিরাপত্তা দিতে পারি না। একইভাবে কর্মক্ষেত্রেও শত ভাগ নিরাপদ পরিবেশ এখনও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই উদ্যোগ প্রয়োজন।'
দেশ রূপান্তর: ধন্যবাদ আপনাকে।
লাফিফা জামাল: দেশ রূপান্তরকেও ধন্যবাদ।
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা এবং দেশকে সংক্রামক রোগমুক্ত করার কাজে নেতৃত্বদান করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে আর এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রবীণ এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : গত ১০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে ব্যক্তির ব্যয়। এখন দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে। এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-ষষ্ঠ রাউন্ড’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। চিকিৎসাব্যয়ের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ের এটা একটা ওভারঅল অবজার্ভেশন। চিকিৎসা ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে যায় আর এক-তৃতীয়াংশের মতো সরকার বহন করে। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা সারা দেশের মানুষের বা জনগণের সব অংশের সম্মিলিত বা গড়পড়তা একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টা অনেকটা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মতো। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এবং জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এই আয় দেশের অতিধনী ও ধনীদের কতটা বাড়ছে আর সাধারণ ও গরিব মানুষদের কতটা বাড়ছে বা আদৌ বাড়ছে কি না সেটা মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় না। তেমনি জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয় বা মানুষের চিকিৎসাব্যয়ের এই পরিসংখ্যান থেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বা গরিব মানুষদের বাস্তবতা বোঝার উপায় নেই। তাই বলা যায়, চিকিৎসা ব্যয়ের এই জাতীয় হিসাবে গরিবদের বাস্তবতা যথাযথভাবে উঠে আসেনি।
দেশ রূপান্তর : এরকম তথ্য কিন্তু পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে মোট খরচের ৫৪ শতাংশই খরচ করেন দেশের শীর্ষ ধনীরা। বাকিটা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রসহ জনসংখ্যার অন্যান্য সব অংশ মিলে। আবার সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য না হলে হাসপাতালে বা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না বলেও উঠে আসছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : আসলে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এমন পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু যেটা বলছিলাম যে, এমন হিসাবে দেশের সব মানুষের ডিটেইল পিকচারটা পাওয়া যাচ্ছে না। ধরুন খুবই প্রান্তিক একটা মানুষ, গ্রামেরও সাধারণ মানুষ তিনি কিন্তু চিকিৎসাব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ কেন এক-তৃতীয়াংশ বহন করার মতো অবস্থাতেও নেই। কারণ খাদ্য কেনার মতো যথেষ্ট টাকাই তার হাতে নেই। তো তিনি কীভাবে চিকিৎসার খরচ মেটাবেন? ধরুন তার ক্যানসার হয়েছে, তিনি তো ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা বা জেলা পর্যায়েও এই চিকিৎসা পাবেন না। আবার ঢাকায় এসে চিকিৎসা করানো মতো আর্থিক ক্ষমতা তো দূরের কথা আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়াই তার কাছে নেই। তাহলে প্রশ্নটা হলো, দেশের কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসায় কতটা ব্যয় করল শুধু সেটা হিসাব করলে হবে না; কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত সেই হিসাবটাও জরুরি। কিন্তু এ ধরনের পরিসংখ্যানে সেসব তথ্য উঠে আসছে না।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে এই গবেষণায়। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির খরচের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ওষুধে, যা মোট চিকিৎসাব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর মেডিকেল ও ডায়াগনস্টিকে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, চিকিৎসক দেখাতে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ইত্যাদি। ওষুধে এত বেশি ব্যয়ের কারণ কী বলে মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এ বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার। কিন্তু এসব কথা বললে অনেকে মাইন্ড করবেন। আমি নিজেও একজন চিকিৎসক। কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক চিকিৎসকই রোগীকে প্রেসক্রিপশনে এমন অনেক ওষুধ লিখে দিচ্ছেন যার হয়তো দরকার নেই। আবার অনেক সময় ওষুধ লেখা না লেখার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কথা ভাবেন।
দেশ রূপান্তর : আপনি যা বলছেন সে বিষয়ে কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার সচিবও অভিযোগ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার প্রশ্ন তুলেছেন যে, দেশে ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং সংক্রান্ত বিধি মানা হচ্ছে কি না। তিনি বলেছেন, অনেক চিকিৎসক শুনি ওমরাহ পালনে যান ওষুধ কোম্পানির টাকায়। অনেকে নাকি ফ্রিজ নেন টেলিভিশন নেন। কেউ আছে ফ্ল্যাট পর্যন্ত কিনে দেয়। আপনার কী মনে হয়?
ডা. নজরুল ইসলাম : স্বাস্থ্য সচিব এক্ষেত্রে সত্য কথাটাই বলেছেন। সত্য কথা বললে সব দিক নিয়েই বলা দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে সত্য কথা বলতে গেলে এত কথা উঠে আসবে, এত সব সমস্য ও সংকট এখানে আছে যেসব নিয়ে আসলে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা প্রয়োজন। ওই যে, কথায় বলে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা’, স্বাস্থ্য খাতের অবস্থাটাও তেমন।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের সিংহভাগ ওষুধের পেছনে ব্যয় হওয়া থেকে কি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওষুধ নির্ভরতার বিষয়টি সামনে আসছে? বিশ্লেষকরা বলে থাকেন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত ‘প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ার’ নয় ‘কিউরেটিভ হেলথ কেয়ার’-এর ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকে। আপনি কী মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা ঠিকই বলা হয়। এখন কথা হলো প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ারে আপনি কীভাবে যাবেন? সেজন্য পুরো ব্যবস্থাটা পাল্টাতে হবে। আর যেসব ব্যবস্থা আছে, অবকাঠামো ও জনবল আছে সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। যেমন ধরুন আমাদের যে ইপিআই বা এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন আছে সেটা খুবই দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু সেটাও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘হেপাটাইটিস-বি’ পুরোপুরি নির্মূল করবে। অর্থাৎ আমাদের হাতে আছে আর মাত্র ৭ বছর। এখন একজন প্রসূতি-মা যদি ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত থাকে তাহলে ভূমিষ্ঠ সন্তানটিরও ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভ্যাকসিন এবং ইমিউনোগ্লোবিন দেওয়া হলে শিশুটি আর তাতে আক্রান্ত হবে না। এই বিষয়টা আমরা জানি, এমন ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা প্রতিটি হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত প্রসূতির সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি কি? এখন এমন ভ্যাকসিনেশন না হওয়ার কারণে যে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে তারা তো আর ২০৩০ সালের মধ্যেই মারা যাবে না। তাহলে এই সময়ের মধ্যে কীভাবে আমরা হেপাটাইটিস-বি নির্মূল করব। আমি বলতে চাচ্ছি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান সুযোগও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। একই কথা প্রযোজ্য সার্ভিক্যাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে। এখন এর কার্যকর ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা কি ‘এট এন-মাস’ বা সারা দেশের সব নারীদের এই ভ্যাকসিন দিচ্ছি? দিচ্ছি না। তাহলে তো সার্ভিক্যাল ক্যানসারও থেকেই যাবে।
দেশ রূপান্তর : আবার একটু ওষুধ ও প্রেসক্রিপশনের আলোচনায় ফিরে যাই। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে। প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ব্র্যান্ড-নাম না লিখে শুধু ওষুধের জেনরিক-নাম লিখে দেওয়ার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এছাড়া, চিকিৎসকরা দুর্বোধ্য হাতের লেখায় ওষুধের নামসহ প্রেসক্রিপশন দেন এতেও সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছে। আবার অনেকেই বলছেন প্রেসক্রিপশন কেন বাংলায় লেখা হচ্ছে না? অথচ এই বিষয়ের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আপনি বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা নিয়েও তো আদালত একটা নির্দেশনাও দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ওষুধের নাম ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লিখতে। যাতে সবাই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই তো পাল্টায়নি। আমার মনে হয় এখানে দুটো বিষয় আছে। একটা হলো চরম উদাসীনতা আরেকটি হলো দুর্নীতি। এই দুটোই এখন আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই সম্ভবত এ বিষয়ে উদাসীন। আর অনেকেই ওষুধ কোম্পানির সুবিধা নিয়ে জেনরিক-নাম না লিখে ব্র্যান্ড-নাম লিখছে। স্বাস্থ্য প্রশাসনও এসব বিষয় দূর করার ব্যাপারে উদাসীন। ফলে সব মিলিয়েই এই সমস্যাগুলো দূর হচ্ছে না।
দেশ রূপান্তর : সাধারণ মানুষের মানসম্মত চিকিৎসাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসা ব্যয় লাঘব করতে হলে দেশব্যাপী গ্রামাঞ্চলসহ উপজেলা-জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ছে না বললেই চলে। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো সারা দেশে যতটুকুই স্বাস্থ্য-অবকাঠামো আছে সেটা সামগ্রিকভাবে একে-অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্কিত না। একজন রোগী গ্রাম বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা-জেলা হয়ে যে বিভাগীয় বড় হাসপাতাল বা রাজধানীতে আসছেন এমন নয়। এসব কারণে নাগরিকদের ‘হেলথ ডেটা’ বা স্বাস্থ্য তথ্যের কোনো একক ভান্ডার গড়ে উঠছে না। কিন্তু একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার তো উচ্চতর গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণী কাজের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এই বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার খুবই প্রয়োজনীয়। আর আপনি স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর যে কথা বলছেন সেটাকে আমরা বলি ‘রেফারাল সিস্টেম’। একজন রোগী কীভাবে পর্যায়ক্রমে সাধারণ চিকিৎসকের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাবেন এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে চিকিৎসা নেবেন সেই কাঠামো বা চর্চা এখানে গড়েই ওঠেনি। একইভাবে একটা ‘এমআইএস’-ও গড়ে ওঠেনি। আমি যতদূর জানি এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেটা সম্ভবত এখনো কার্যকরভাবে এগোয়নি। আসলে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ না নিলে এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে এমন আয়োজন সফল হওয়ার সুযোগ দেখি না। তবে আমি মনে করি, দুর্নীতিমুক্ত হয়ে উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলে আমাদের দেশেও এগুলো সবই সম্ভব।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. নজরুল ইসলাম : আপনাকে এবং দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
আন্দালিব রাশদী কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। পড়াশোনা ঢাকা, ওয়েলস ও লন্ডনে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন, যা বাংলাদেশে বিরল। উপন্যাস, ছোটগল্পের পাশাপাশি তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কলাম ও প্রবন্ধ লেখেন। বিদায়ী ও নতুন বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বিদায়ী বছরকে কী দিয়ে মূল্যায়ন করবেন মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক লুট নাকি পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল দিয়ে?
আন্দালিব রাশদী : যে কটা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার সবগুলোই বাস্তবতা। সময় সংকট ও সাফল্যের মূলে রয়েছে আর্থিক ক্ষমতা এবং ব্যবস্থাপনা। সঙ্গে যোগ হয় বৈশ্বক পরিস্থিতি। বৈশ্বিক মহামারী কিংবা যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারের যে অস্থিতিশীলতা সেখানে বাংলাদেশের হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। কিন্তু রাষ্ট্র যা ঠেকাতে পারে তা হচ্ছে তহবিল লুণ্ঠন ও পাচার। ক্ষমতার সমর্থন ছাড়া সংগঠিত দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব নয়। ব্যাংক মালিকরা এক সময় রাষ্ট্র গঠনে উদার হাতে অর্থব্যয় করতেন, এখন রাষ্ট্রের অর্থ দুহাতে তুলে নিয়ে ব্যাংক মালিক হওয়া যায়, ব্যাংকের সমুদয় অর্থ লোপাট করে জনগণের সঞ্চয় ফিরিয়ে দেওয়ার দায় সরকারের ঘাড়ে ফেলে হাওয়া খেয়ে বেড়ানো যায়।
কেবল ২০২২ নয়, অনেক বছর ধরেই চলছে প্রতিষ্ঠানের ‘ইন্টেগ্রিটি’ ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়া। যদি প্রশ্ন করি বলুন বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানটির ইন্টেগ্রিটি নিয়ে আপনি গৌরবান্বিত বিশ্ববিদ্যালয়, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ন্যায়বিচার, প্রশাসন, পূর্ত ও নির্মাণ, ব্যাংক, শুল্ক, সংবাদ মাধ্যম আপনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বেন। জোর গলায় কেন, মিনমিন করেও গৌরব প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত হবেন। প্রশংসিত থাকবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী, প্রবাসী ওয়েজ আর্নার প্রমুখ।
অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই প্রশংসনীয় এটাই অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। একই সঙ্গে উন্নয়নের জন্য প্রদেয় মূল্যও পরীক্ষণীয়।
দেশ রূপান্তর : আগামী বছর বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর। একে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন কি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন?
আন্দালিব রাশদী : আমি রাজনীতিবিদ নই, রাজনীতি বিশ্লেষকও নই; গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকার এসব বিভ্রান্তিকর বুলি আমরা যাদের কাছে শিখেছি, মূলত ব্রিটেনের কাছে, আমরা মোটেও তাদের মতো মানুষ নই, তাদের চেয়ে হীনমানের। ২০২২ সালেই তো সেখানে তিন প্রধানমন্ত্রীর শাসন চলেছে, একজন লিজ ট্রাস দেড় মাস অতিক্রম করতে পারেননি। ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা কি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা করেন না? অবশ্যই করেন। রাজনৈতিক কৌশলে তা করেন। আমরা, ক্ষমতায় যারাই অধিষ্ঠিত হই না কেন ক্ষমতা ধরে রাখতে ছল-বল-কৌশলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে থাকি। কোনো কোনো দেশের জন্য ভোটার গুরুত্বপূর্ণ নন, গুরুত্বপূর্ণ যিনি ভোট গণনা করেন। ১৯৭০-এর যে নির্বাচন কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার রায় দিয়েছিল সে নির্বাচনে চিফ ইলেকশন কমিশনার ছিলেন একজন বাঙালি বিচারপতি। সেই বিচারপতি আবদুস সাত্তার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। যে দল যখন বিরোধী পক্ষ হয় তাদের পছন্দ থাকে ভারতের সেই বিখ্যাত টি এন সেমানের মতো ব্যক্তি যেন চিফ ইলেকশন কমিশনার হন। যেন নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের চিরকালীন চাওয়া একজন দলনফর প্রধান নির্বাচক। পরস্পরবিরোধী চাওয়া উত্তেজনা ও টানাপড়েন সৃষ্টি করতে বাধ্য। বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস হাস্যকর গণতন্ত্র সৃষ্টি করেছে। কর্মজীবনে ব্যক্তিগতভাবে একটি নির্বাচন কন্ট্রোলরুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজন রিটার্নিং অফিসারকে আমি অনুরোধ করেছিলাম, প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা একটু কমিয়ে বলুন, প্রায় শতভাগ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আমার আশপাশে কোনো স্ট্যাটিসশিয়ান নেই, যা করার আপনারাই করে নিন। আশির দশকের এক জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী বন্ধ-দরজা বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছিলেন : এই জেলায় অপজিশনকে একটা সিট দিতেই হবে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন তা দুই অতিক্রম না করে। পেশাগত কারণে আমিও বন্ধ দরজা বৈঠকে হাজির ছিলাম। পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টে গেছে। দলমত নির্বিশেষে ‘আমি জিতলেই’ গণতন্ত্রের জয় জয়কার অন্যথায় সব প্রহসন। জর্জ বার্নাড শ প্রায় সোয়া শত বছর আগে বলেছিলেন : নির্বাচন হচ্ছে নৈতিক সন্ত্রাস, যুদ্ধের মতোই তবে রক্তপাতহীন। এর সঙ্গে যুক্ত সবার আত্মাই কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে।’ ২০২৪-এর নির্বাচনী অস্থিরতা ও দ্বন্দ্ব ইন্টার পার্টি এবং ইন্ট্রা পার্টি অতি ভয়ংকর হয়ে উঠলে কথিত গণতন্ত্র চর্চা থেমে যাবে।
দেশ রূপান্তর : বর্তমানে সারা বিশ্বেই আমরা একটা কর্র্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর উত্থান দেখতে পাচ্ছি, এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দালিব রাশদী : কর্তৃত্ববাদ এখন অজেয় বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। গণতন্ত্রের প্রবক্তারা ভাবেননি যে ‘ইললিবারেল ডেমোক্রেসি’ পৃথিবীতে জাঁকিয়ে বসবে। গ্লোবাল ফ্রিডম প্রতিবেদনটি দেখুন। বিভিন্ন সূচক বলে পৃথিবীর ষাটটি দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থান নেমে গেছে। পৃথিবীর কুড়ি শতক মানুষ মোটামুটিভাবে লিবারেল গণতন্ত্রের ছায়াতলে বসবাস করছে। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের দোহাইয়ের আড়ালে গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। একদা জনমুখী বাম হিসেবে সমাদৃত নেতৃবৃন্দের অনেকেই গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় জুনিয়র পার্টনার হয়ে গেছেন। ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক কর্তৃত্ববাদী হলেও পৃথিবীকে ভারসাম্যপূর্ণ দ্বি-মেরু করে রাখতে সক্ষম ছিল। ভাঙনের পর এক মেরুর কথিত গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জেই গণতন্ত্রের লিবারেলিজমকে দেহচ্যুত করতে বিভিন্নমুখী অস্ত্রোপচার চালিয়েছে। গণতন্ত্রায়নের নামে স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসমূহের চর্চাই বেশি হয়েছে। সামরিক অভ্যুথান ঘটাতে সামরিক বাহিনী যতটা না এগিয়ে এসেছে তার চেয়ে কথিত গণতান্ত্রিক শক্তিই তাদের আসার পথ সুগম করে স্বাগত জানিয়েছে। ‘দ্য রাস্ট উইদিন ডেমোক্রেসি’- গণতন্ত্রের ভেতরের পচন চেনার জন্য মার্কিন সাধারণ নির্বাচন-উত্তর ক্যাপিটল হিল অবরোধ, তছনছ ও লুণ্ঠনের দৃশ্যই যথেষ্ট। সাড়ে চারশ বছর আগে অসন্তুষ্ট জনতা নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ইউনান ডি উইট ও তার ক্ষমতাধর ভাইকে শুধু হত্যাই করেনি, তাদের মৃতদেহ নিয়ে গণউল্লাস হয়েছে এবং তাদের বুক ফেঁড়ে ক্ষিপ্ত মানুষ কলজেতে কামড় বসিয়েছে, তাদের চোখ তুলে স্যুভেনির হিসেবে নিয়ে গেছে। ক’বছর পর সেই জনতাই বলেছে, ইউনান ডি উইট-ইতো ভালো ছিলেন। ২০২২-এর অন্যতম দৃষ্টি উন্মোচক শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকারের পতন, পলায়ন, রাজভবনের গণদখল। আমরা অবহিত আছি মাহিন্দা রাজাপাকসে ফিরে এসেছেন, নিরাপদ জীবনযাপন করছেন; আসছে নির্বাচনে গণতন্ত্রের হাত ধরেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন মনে করা হচ্ছে। যে মার্কোসকে ফিলিপাইন গণঅভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশ থেকে তাড়িয়েছিল তার পুত্র বংবং মার্কোস এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট, বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।
দেশ রূপান্তর : বছর শেষের দিকে বিশ্বের নানা দেশে ফের করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর যেমন পেয়েছি, তেমনি সারা বছর আলোচনায় ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সবাই বলছে ২০২৩ সাল অমঙ্গল বার্তা বয়ে আনতে যাচ্ছে। আপনার মতামত কী?
আন্দালিব রাশদী : নস্ত্রাদামুস কিংবা জিন ডিক্সনের পথে না হেঁটেও এক সপ্তাহের খবরের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করলে মোটামুটি সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় : যদিও ১৩ বিলিয়ন শট ড্যাক্সিন এর মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে তারপরও কভিড-১৯ ভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট যে বছরভর অবস্থান করবে তা দ্বিধা ঝেড়ে বলে দেওয়া যায়।
আর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ? যুদ্ধ করিয়েছে গ্লোবাল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। করোনাকালে অনেক অস্ত্র গুদামে জমে গেছে, গুদাম খালি করতে হবে। কভিডের মতোই অস্ত্রের নতুন ভ্যারিয়েন্ট বাজারে ছাড়ার আগে গুদামজাত করতে হবে। আসলে ইউক্রেন-ক্রেমলিন-পেন্টাগন-ন্যাটো-জাতিসংঘ সবই মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ক্রীড়নক। বাংলাদেশি মানি লন্ডারদের কেউ এই কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার হোল্ডার এ কথা কোনোদিন প্রকাশিত হলে আমি অন্তত বিস্মিত হব না। ২০২৩ যতটা না আশার তার চেয়ে বেশি আশঙ্কার।
দেশ রূপান্তর : কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প, সংবাদমাধ্যম একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। আপনার কি মনে হয়, এর প্রভাব আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ওপর কতটুকু পড়বে?
আন্দালিব রাশদী : চলুন একটু উল্টো করে ভাবি- যে দামে আমরা কাগজ কিনব বলে প্রত্যাশা করেছিলাম, বাজারে গিয়ে দেখলাম কাগজ প্রত্যাশিত দামের সিকিভাগ দামে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশক-মুদ্রক সেই টাকায় চারগুণ বেশি পরিমাণ কাগজ কিনে নিয়ে চলে এলেন। এবার এই বাড়তি কাগজ কিংবা সস্তা কাগজ কি আমাদের শিল্পসাহিত্য চেষ্টার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে? কাগজ যদি বিনে পয়সায়ও সরবরাহ করা হয় তাতেও শিল্পসাহিত্য চর্চায় তেমন হেরফের হবে না। মহার্ঘ কাগজ কিংবা পানির দামের কাগজের প্রভাব পড়বে শিল্পসাহিত্য বহির্ভূত অন্যান্য কাগুজে কারবারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সাইবারফোবিক মানুষ, অবশ্যই ব্যাকডেটেড, আমার কোনো ফেইসবুক অ্যাকাউন্টও নেই, কিন্তু আমি মোটেও ফেইসবুক-বিরোধী নই, ব্লগ-বিরোধী নই, সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার বিরোধী নই, কিন্তু আমি তাতে নেই কারণ আমি ফোবিক আমার ধারণা আমি ম্যানেজ করতে পারব না। আমার জীবন ধারণের প্রধান সহায় ছাপা বই এবং ছাপা লেখালেখি। কাগজের দুর্মূল্য এবং আনুমনিক আমদানি দ্রব্যেও মূল্যবৃদ্ধিতে আমার বই ছাপা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে প্রকাশক অবশ্যই মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আমি কি লেখালেখি ছেড়ে দেব? আমি অনলাইন প্রকাশনার দিকে মনোযোগী হব, সাইবারফোরিয়া উতরানোর সবক নেব।
কাগজের দাম বাড়ার আগেই ই-পেপারের কাছে ছাপা পেপার, ই-বুকের কাছে ছাপা বই মার খেয়ে আসছে। বিখ্যাত একটি পত্রিকাসহ যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ হয়েছে ৭০টি দৈনিক এবং ২ হাজারের বেশি সাপ্তাহিক।
দেশ রূপান্তর : এ বছর বেশ রেহানা মরিয়ম নূর, হাওয়া’র মতো কিছু আলোচিত-প্রশংসিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে আশা করছেন, নাকি কয়েকটি ভালো সিনেমা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েই থাকবে?
আন্দালিব রাশদী : ডিসেম্বরের শেষার্ধে এসে জানলাম মুহাম্মদ কাইয়ুম পরিচালিত বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের হাওর-বাঁওড়ের জলকাদার গল্প নিয়ে তৈরি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের মর্যাদা পেয়েছে। অথচ দিনের পর দিন তাকে প্রযোজকের অনুসন্ধান করতে হয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। নিজের জীবনের সমুদয় কামাই লগ্নি করে সিনেমা বানিয়েছেন, নিজের শিল্পসাধ মিটিয়ে মেধা ও শ্রম ঢেলে দিয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ার মতো উঁচু স্থানে একে স্থাপন করতে পেরেছেন। কলকাতাই হোক কি কান-ই হোক কেউ তাকে উত্তম না বলা পর্যন্ত অধমই রয়ে থাকে। রেহানা মরিয়ম নূর কিংবা হাওয়া’র মতো ছবি হতে থাকবে না এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা এ প্রশ্নের জবাবটা কঠিন নয়। সিনেমা হোক কি গান হোক কি সাহিত্য সংস্কৃতির ভালোটার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। সুতরাং প্রতিকূলতা ঠেলে যদি ব্যক্তি মেধা ও সামর্থ্য দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ বের করে আনতে পারেন।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভ নববর্ষ।
আন্দালিব রাশদী : ধন্যবাদ। আপনাকে ও দেশ রূপান্তরের পাঠকদেরও শুভ নববর্ষ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত গবেষক, ঐতিহাসিক, অনুবাদক, সমাজবিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক ও চিন্তাবিদ। তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি দেশের রাজনীতির উন্নতির জন্য চিন্তা ও কাজ করেন, লেখেন এবং মত প্রকাশ করেন। সম্প্রতি ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী।
দেশ রূপান্তর : অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের সংবিধানসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার দরকার বলে অনেকেই বলে আসছেন। যারা ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আছেন তারাও নানা সময়ে এসব বলে এসেছেন। দেখা গেছে মেনিফেস্টোতে যে কথা থাকে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটা ভুলে যান। এরশাদ পতনের আন্দোলনে ‘তিন জোটের রূপরেখা’র কথা সবাই ভুলে গিয়েছে। বিএনপি ‘রূপকল্প ২০৩০’ দিয়েছিল। অন্যদিকে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘রূপকল্প ২০২১’ নামে যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তা সময়ের একটি রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজন নানাভাবে ব্যক্ত হচ্ছে। যেসব দল ক্ষমতায় ছিল এবং আছে, তাদের থেকেও সংবিধানের সংস্কারের কথা বলা হয়। গত অর্ধশতাব্দীতে সংবিধানের সতেরোটি সংশোধন হয়েছে। রাজনীতির উন্নতি হচ্ছে না। জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ অল্পই করা হয়। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলো আন্দোলন করেছে নিতান্তই ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। শেষে অবস্থার চাপে তিন জোটের রূপরেখা প্রণীত হয়। এই রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য কোনো দলেরই কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী দল, শক্তিশালী। বিএনপি সে তুলনায় শক্তিশালী নয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে আন্দোলনকারী সব দলই রাজনৈতিক কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য ঘোষণা না করে কেবল সরকার উৎখাতের ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ব্যাপারটিকে বলা হয়েছে বিরাজনীতিকরণ বা নিঃরাজনীতিকরণ। রাজনৈতিক দলগুলোর এই রাজনীতি-শূন্যতার মধ্যে বিএনপি ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেভাবে বক্তব্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সংশোধন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে সারা দেশে এটি প্রচার করলে বাংলাদেশের গোটা রাজনীতির গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হবে। নেতৃত্বের প্রশ্ন আছে। বিএনপিতে ২৭ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন চালানোর মতো নেতৃত্ব নেই।
দেশ রূপান্তর : এই রূপরেখা তারা ক্ষমতায় এলে বাস্তবায়ন করবে বা করতে পারবে বলে কি মনে করেন? অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের ওপর কি সে আস্থা রাখা যায়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের এবং ২৭ দফা বাস্তবায়নের মতো নেতৃত্ব বিএনপিতে নেই। উত্তরাধিকারভিত্তিক ও পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব দিয়ে সুফল হবে না। সুবিধাবাদী ভোগবাদী নেতৃত্ব বাঞ্ছনীয় নয়। জনগণ রাজনীতিবিমুখ, ঘুমন্ত। গণজাগরণ দরকার। গণজাগরণ কী? গণজাগরণের উপায় কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন যত ভালোভাবেই সম্পন্ন হোক, তা দ্বারা রাজনীতির উন্নতিশীলতা সূচিত হবে না। কেবল নির্বাচন নিয়ে এত আশা কেন?
দেশ রূপান্তর : বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফা দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে বিএনপি সেখান থেকে সরে এসেছিল। এবারের ২৭ দফা রূপরেখা দেওয়ার মধ্যে কি তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের বার্তা দেখতে পান।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেখা যাক, কোন দল কী করে। প্রত্যেক দলেরই রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়। উত্থান-পতন আছে। রাজনৈতিক দলগুলো ভালোর দিকে অগ্রসর হোক এটাই কাম্য। শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ঘুমিয়ে থাকলে সুফল হবে না। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : বিএনপি একদিকে বলছে আওয়ামী লীগ সরকার কর্র্তৃক গৃহীত সব অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী সংশোধন বা রহিত করবে। অন্যদিকে বলছে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করবে। এর আগে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কেউই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, সামনে কী হবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : হিংসা-প্রতিহিংসা চলছে। খুন-খারাপি চলছে। এ থেকে মুক্তি দরকার। বিবেক ও যুক্তির প্রাধান্য চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবেক ও যুক্তি প্রাধান্য পেলে ক্রমে সব কিছু ভালোর দিকে চলবে। রাজনৈতিক দলকে গুরুত্ব দিতে হবে। দল গঠন নিয়ে চিন্তা ও কাজ করা দরকার। দল উন্নত চরিত্রের না হলে সরকার ভালো হবে কী করে? চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনীতির চরিত্র উন্নত হবে না।
দেশ রূপান্তর : প্রতি পাঁচ বছর পর পর ‘একটি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারই কি একমাত্র সমাধান?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ বা রাজনীতি নিরপেক্ষ, বা অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধাযক সরকার দিয়ে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, হচ্ছে না, হবে না। দেশের রাজনীতিকে, রাজনৈতিক দলগুলোকে এত নিকৃষ্ট অবস্থায় রেখে, জনমননকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে, জাতীয় রাজনীতির সমস্যার সমাধান হতে পারে না। উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনে নিরন্তন প্রয়াসপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই, উৎকৃষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি চাই, সর্বোপরি চাই উন্নতিশীল জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা চাই। এসবের কোনোটাই রাতারাতি অর্জন করা যাবে না। রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার প্রত্যেক জাতি ও জনজীবনের জন্য। রাজনীতিবিদদের ও সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ব্যাপার। ‘আটাশ দফা : আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’ নামে আমার একটি লেখা আছে। তাতে আমি বাংলাদেশে আমাদের সংকটের স্বরূপ এবং মুক্তি ও উন্নতির উপায় সম্পর্কে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছি।
দেশ রূপান্তর : মোটা দাগে আপনার প্রস্তাব আমাদের সংকট ও রাষ্ট্র নিয়ে কী বলছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমি মনে করি, ওই প্রস্তাবে যে পথ নির্দেশিত হয়েছে, কেবলমাত্র সেই পথে অগ্রসর হয়েই সমস্যার সমাধান হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সর্বজনীন কল্যাণে চিন্তা ও কাজ করতে হবে, দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মেয়াদি সরকার গঠন করে এগোতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন লাগবে। গোটা পৃথিবীর সব নেশনের বা জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন দরকার। জাতিসংঘ দিয়ে কাজ অল্পই হচ্ছে। এই জাতিসংঘকে সংস্কার করে বিশ্বব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন করতে হবে। সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে, পুনর্গঠিত নতুন রাষ্ট্রসংঘের পরিচালনায় একটিমাত্র সেনাবাহিনী রাখতে হবে। মানব প্রজাতি চাইলে, চেষ্টা করলে পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারবে। মানুষের অন্তরে আশা ও সাহস চাই। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষকেই গড়ে তুলতে হবে অভিপ্রেত নেতৃত্ব। মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনা বিকাশমান। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ঞৎঁঃয ংযধষষ ঢ়ৎবাধরষ. মিথ্যাকে পরাজিত অবস্থায় রাখতে হবে, বিলুপ্ত করা যাবে কীভাবে।
দেশ রূপান্তর : ‘পরপর দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না’। বিএনপি কি তাহলে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েই চিন্তা করছে? এটা কি রাজনীতিতে একটা পালাবদলের ইঙ্গিত?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : বাংলাদেশে চলছে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার-ভিত্তিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র। গণতন্ত্রকে পর্যবসিত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। বাংলাদেশ নির্বাচনের মাধ্যেমে সরকার গঠনের যোগ্যতাও অর্জন করেনি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিকে পর্যবসিত করেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসমুখী ও ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক-অভিমুখী। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কী করবে, কী করতে পারবে, জনসাধারণের দিক থেকে তার বিচার করে দেখা দরকার। আমার মনে হয় গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মের দ্বারা সমাধান হবে না, সংকটের সমাধানের জন্য নতুন ধারার চিন্তা ও কাজ লাগবে। আমি আটাশ দফা কর্মসূচিতে যে পথনির্দেশ করেছি একমাত্র সেই প্রশ্ন ধরে চিন্তা ও কাজ করতে হবে। আমার মতে আমাদের রাজনীতির ও সার্বিক উন্নতির পথ সেটাই। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী সেটাও বিচার করে দেখা দরকার। যারা আগে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে আত্মপরিচয় দিতেন, তারা এখন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে আত্মপরিচয় দেন। কেন এই পরিবর্তন?
দেশ রূপান্তর : ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা নিয়ে আপনার অন্য পর্যবেক্ষণগুলো কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে তাতে বিএনপি যদি তার ২৭ দফা কর্মসূচির কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে দেশব্যাপী প্রচার করে, তাহলে তার ফল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এবং জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে। সব দলের নেতাকর্মীদের এবং বুদ্ধিজীবীদের থেকেই উন্নতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্ম আশা করি। জনচরিত্রকেও উন্নত করতে হবে। জনসাধারণকে বিচারকের ভূমিকায় রাখতে হবে। চিন্তা ও কর্মের নবউত্থান চাই।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও গবেষক। সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষা ও শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে নিয়মিত লিখছেন তিনি। সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলে পাসের হার, জিপিএ ৫ প্রাপ্তির আধিক্যসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ‘করোনা ব্যাচ’ বলে অভিহিত করেছেন কেউ কেউ। ২০২০ সালে নবম শ্রেণিতে লেখাপড়া শুরুর মাত্র আড়াই মাসের মাথায় করোনা মহামারীর কারণে শ্রেণিকক্ষে তাদের সশরীরে ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। ২০২১ সালে দশম শ্রেণি শেষ করা পর্যন্ত সরাসরি ক্লাস করার সুযোগ তারা খুব কমই পেয়েছে। অনলাইন আর অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক লেখাপড়াই ছিল তাদের প্রধান অবলম্বন। তারপরও এবার পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়ার হার বেশির কারণ কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : যদি আমরা বছর হিসেবে পাসের হারের গ্রাফ আঁকি, গ্রাফটা হবে নম্বর অব জিপিএ ৫ এর। প্রথম বছর ২০০১-এ দেখা যাবে ৭৬ জন। তারপরের বছর ৩০০-এর কিছু বেশি, এরকম ভাবে ২০০৮-এ বোধ হয় ৪১ হাজার। এভাবে ২০২২ সালে দুই লাখ ৭০ হাজার। গ্রাফটায় দেখা যাবে প্রচন্ড রেইটে জিপিএ ৫ বাড়ছিল। তো বৃদ্ধির এই হার যদি ঠিক রাখতে হয় তাহলে সংখ্যাটা এরকমই হয়। তারপরও এবারের সংখ্যাটা একটু বেশি মনে হয়। আমার ধারণা করোনাকালে যেহেতু পড়াশোনা হয়নি, সরকার মনে করেছে সবাইকে একটু খুশিটুশি করি। তো সবাইকে খুশি করা তো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য না। পড়াশোনা তো ভালো হয়নি, তাই ওটা নিয়ে মানুষ যেন খোঁটা না দেয়, তাই একটু সেফ সাইডে থাকার জন্য হয়তো বা ইচ্ছে করেই জিপিএ ৫ একটু বেশি দেওয়া হয়েছে। তবে এ কারণেই যে বেশি হয়েছে তা না। কারণ আমরা তো জানি গত কয়েক বছর ধরেই জিপিএ ৫ বেশি দেওয়ার জন্য স্কুলের শিক্ষকদের চাপ দেওয়া হয়েছে। এমনও হয়েছে বলে আমি শুনেছি যে, ভালো নম্বর না দেওয়া হলে শিক্ষককে শোকজ করা হয়। তো পরীক্ষক যিনি, যিনি মূল্যায়ন করবেন, তাকে যদি এরকম চাপে রাখা হয়, তিনি তো ভাববেন যে আমি কার জন্য সঠিক মূল্যায়ন করব, আমি বরং বেশি নম্বর দিয়ে দেব, যাই লিখুক না কেন আমি পাঁচের মধ্যে পাঁচ দিয়ে দেব, পারলে ছয় দেব! তবে করোনার কারণে কম পড়ানো হলো, তারপরও এত বেশি জিপিএ ৫ পেল, এর মধ্য দিয়ে পরীক্ষা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের কাছে একটা ভুল বার্তা গেল। পড়াশোনা নিয়েও ভুল বার্তা গেল যে, ‘আরে পড়াশোনা কোনো ব্যাপার নাকি! জিপিএ ৫, গোল্ডেন এ... এগুলো কোনো ব্যাপার নাকি! এই যে ব্যাপার না, এটা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে মারাত্মক একটা খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
দেশ রূপান্তর : প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার পরেই একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। সেটি হচ্ছে কত শতাংশ পরীক্ষার্থী পাস করেছে আর কত শতাংশ পরীক্ষার্থী জিপিএ ৫ পেয়েছে। এই দুটো মানদন্ড কি আসলেই শিক্ষার কাক্সিক্ষত মানের কথা বলে?
ড. কামরুল হাসান মামুন : পাস আর জিপিএ’র সংখ্যার রেশিওটা আসলে কী? এই যে এবারের পরীক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর ১৫ শতাংশ জিপিএ ৫ পেল, তার মানে বাকি ৮৫ ভাগ যে জিপিএ ৫ পায়নি, আসলে এই ৮৫ ভাগ ফেল করেছে। কারণ এখন এমন ফল দেওয়া হচ্ছে যে, মনে হয় জিপিএ ৫ না পেলে জীবনটা ষোলো আনাই মিছে। জিপিএ ৫ না পেলে বাবা-মাও মুখ লুকান। শিক্ষার্থী, তার বাবা-মা সবাই লজ্জায় কেউ কাউকে ফলের কথা বলেন না। আমরা আসলে রেজাল্টকে তরলীকরণ করতে করতে এমন করেছি যে, ধরেন এক গ্লাস পানির মধ্যে যদি আমি লেবু, চিনি মিশিয়ে একজনের জন্য শরবত বানাই, তারপর গেস্ট বেড়ে গেলে ওই এক গ্লাস শরবতেই অনবরত কেবল পানি মিশিয়ে অতিথিদের শরবত খাওয়ানো শুরু করি... তো এটা এক পর্যায়ে আর শরবত থাকবে না। আমাদের শিক্ষা এবং পরীক্ষার ব্যাপারটাও ওই রকম হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষা সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাও নাই। পরীক্ষা মানে কী? পরীক্ষা মানে হলো এক ধরনের ফিল্টারিং প্রসেস, চালুনির মতো। অনেক মিশ্রণের থেকে সবচেয়ে ভালো কে, মধ্যম মানের কে, খুব ভালো মানের কে, বেশ ভালো কে কিংবা খারাপ কে... এগুলো যেন আমি আলাদা করতে পারি। এই বিভাজন করতে পারাটা পরীক্ষার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। কেননা, যারা ব্যতিক্রমভাবে ভালো, তাদেরও যদি আমি খারাপদের সঙ্গে মূল্যায়ন করি তাহলে সেই দেশে ব্যতিক্রমী মানুষ তৈরি হবে না। সবার গুরুত্ব একরকম না, ব্যতিক্রমী ভালো খুবই কম এক বা দুই ভাগ। গুরুত্ব কম যাদের তারা না থাকলে আবার গুরুত্ববানেরও মূল্য থাকে না। পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা এই বিভাজনটা পাই। একসময় আমরা যখন পরীক্ষা দিতাম, ২০ জন করে চার বোর্ডে ৮০ জন স্ট্যান্ড করত। তাদের ছবি পত্রিকায় আসত। তাদের বাবা-মায়ের ছবি আসত। তাদের স্কুল ও শিক্ষকদের ছবি আসত। তাদের সাফল্যের গল্প ছাপা হতো। এই ৮০ জন ছাত্রের মধ্যে একটা আত্মসম্মানবোধ তৈরি হতো। এরপরেও ছিল স্টার মার্কস, ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন। বাংলাদেশে এমন অনেক সফল মানুষ আছেন যারা এসএসসি বা এইচএসসি-তে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছেন। গবেষণা করলে দেখা যাবে, আমাদের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকরা সবাই স্ট্যান্ড করে আসা। তার মানে এই যে ভালো-মন্দের মিশ্রণ থেকে যে আমি সবচেয়ে ভালোগুলো আলাদা করতে পারলাম এটাই তো পরীক্ষার উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যটা এই জিপিএ ৫ এনে, এটাকে তরলীকরণ করা হয়েছে। এই মূল্যায়ন পদ্ধতিকে নষ্ট করে আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতিটাকেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এর অত্যন্ত ক্ষতিকর ফল পাওয়া যাবে আগামী ১০ বছর পরে।
দেশ রূপান্তর : দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজি ও গণিতের মতো বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকই নেই। শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই এ দুটি বিষয়ের দুর্বলতা নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তর পার করে। অথচ পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হারে কোনো এক জাদুর পরশে দেখা যায় এ দুটো বিষয়ে পাসের হার আকাশছোঁয়া। তার মানে কী?
ড. কামরুল হাসান মামুন : এটার মানে হলো, স্কুল এবং স্কুলের শিক্ষকরাও কোনো না কোনোভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের বেশি মার্কস পেতে হেল্প করেন। সেটা অসৎ উপায়ে হোক বা যেকোনো প্রকারেই হোক। আবার সরকারও চায় জিপিএ ৫ বেশি পাক, এতে তার সুনাম বাড়বে। মানুষ বলবে এই সরকারের আমলে ছেলেমেয়েরা বেশি করে পাস করছে, বেশি জিপিএ ৫ পাচ্ছে। এর আরও একটা কারণ আছে, আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে অনেকগুলো, তাদেরও তো ছাত্র দরকার। এখন একটা খারাপ ছাত্রও যখন জিপিএ ৫ পেয়ে যায়, যার সত্যিকার অর্থে যোগ্যতা নেই জিপিএ ৫ পাওয়ার, সে তখন তার বাবা-মাকে চাপ দিতে পারে যে, আমি তো এখন ভালো ছাত্র, আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই! কিন্তু দেখা গেল সে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেল না, তখন সে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। অর্থাৎ এই রেজাল্ট ভালো করার পেছনে হয়তো এর ভূমিকাও রয়েছে। মানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিক তো সব ক্ষমতাবানরাই। তো এরাও হয়তো সরকারকে বেশি করে জিপিএ ৫ এর জন্য চাপ দেয়। জিপিএ ৫ বেশি হলে তাদের ছাত্রসংখ্যাও বেশি হবে।
সত্যি বলতে গেলে আমাদের স্কুল লেভেলে তো ভালো শিক্ষকই নেই। যে মানের শিক্ষক দেওয়ার কথা, শুধু গণিত কেন, বাংলার গুরুত্ব কি নেই? ভাষা তো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা ছাড়া আমি তো কমিউনিকেটই করতে পারি না। আমাদের ক্লাস নাইনের এক ছাত্র ও ইউরোপের সমশ্রেণির এক ছাত্রের সঙ্গে মিলালে বোঝা যায় আমরা ভাষাতে কত দুর্বল। আমরা যেদিন থেকে অ, আ, ক, খ পড়ি আমরা তো সেদিন থেকেই এ, বি, সি, ডি’ও পড়ি। কিন্তু দেখা যায়, আমরা একটা লাইনও ইংরেজি বলতে পারি না। কারণ, আমাদের এ বি সি ডির পর আর ইংরেজির শিক্ষক নেই। যে শিক্ষক ইংরেজি পড়ান, তিনি নিজেই ইংরেজি জানেন না। যে শিক্ষক গণিত শেখান, তিনি নিজেই জানেন না গণিত। যিনি বাংলা পড়ান, তিনি জানেন না বাংলা। কারণ আমরা স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের যে বেতন দিই, সেই বেতনে ভালো মানের কোনো শিক্ষক পাওয়া যাবে না। মানসম্পন্ন কেউ ওখানে চাকরি করতে যাবেন না। আর কেউ কেউ গেলেও, এত কম আর খারাপ বেতন দেখে প্রাইভেট পড়ানোর ধান্দাবাজি করতে বাধ্য হবেন। তিনি দেখবেন কীভাবে কোচিং করানো যায়। কয়েকদিন আগে গ্রামে গিয়েছিলাম, সেখানে আমার এক ভাগনির কাছে শুনলাম যে, স্কুলের ক্লাসে তাদের শিক্ষক ঠিকমতো পড়ান না, যাতে তার কাছে প্রাইভেট পড়ার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। কাজেই, একজন ছাত্র যখন জেনে যায় শিক্ষক ইচ্ছে করে ক্লাসে ভালো করে পড়ান না, তখন শিক্ষকের ওপরই বা কীভাবে তার রেসপেক্ট থাকবে!
দেশ রূপান্তর : প্রশ্নফাঁসের পাশাপাশি আমাদের দেশে প্রশ্ন কমন পড়ানোর মতো একটি পান্ডিত্য জাহির করার চর্চা আছে... দেখা গেছে যে শিক্ষকের যত বেশি প্রশ্ন পরীক্ষায় কমন পড়ে তার তত চাহিদা। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. কামরুল হাসান মামুন : ওই যে প্রাইভেট ও কোচিংয়ের কথা বললাম। এখন, শিক্ষা তো কারোর বাণিজ্যের মুখ্য বিষয় হতে পারে না। রাষ্ট্র শিক্ষককে এমন বেতন দেবে যে তার মধ্যে কোনো লোভ-লালসা থাকবে না। সে একটা আদর্শ, উদাহরণীয় মানুষ হবে। এখন আমরা তো সেভাবে ও সেই ধরনের শিক্ষক নিয়োগ দিই না। এই যে কয়েকদিন আগে ফুটবল বিশ^কাপে জাপানের দর্শকরা খেলা দেখা শেষে স্টেডিয়ামের গ্যালারি পরিষ্কার করে মাঠ ত্যাগ করল, খেলোয়াড়রাও তাদের রেস্টরুম ব্যবহারের পর খেলা শেষে সেটা পরিষ্কার করে বের হলোকেন? কারণ, তাদের প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুলে এমন শিক্ষক দেওয়া হয় যে তারা এইসব নিয়মকানুন, এইসব সততা সেখান থেকে সেই শিক্ষকদের কাছ থেকেই শিখে বের হয়। তারা সেখান থেকেই এভাবে ভাবতে শেখে। আমাদের দেশের মানুষ যে আজ এত অসৎ হয়ে গেছে কেন? কারণ আমাদের শিক্ষক আর শিক্ষাব্যবস্থাটাই তো অসৎ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সম্প্রতি জাতিসংঘের ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২৭) অংশ নিয়ে মিসর থেকে দেশে ফিরলেন তিনি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এই সম্মেলনের বৈশ্বিক এবং বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বাংলাদেশের একজন পরিবেশ আন্দোলনকর্মী হিসেবে সদ্যসমাপ্ত কপ-২৭ নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : কপ ২৭ বেশ উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। কারণ পৃথিবীব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা, ব্যাপকতা, ভয়াবহতা বেড়ে গিয়েছে। আমাদের দেশেই ঘূর্ণিঝড়, বন্যা দেখেছি; পাশের দেশ পাকিস্তানে আমরা ভয়াবহ বন্যা দেখেছি। একই সঙ্গে আবার ইন্টার-গভার্নমেন্টাল প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) তাদের ৬ষ্ঠ প্রতিবেদনে দেখিয়েছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা এই শতাব্দীর শেষে ১.৫ এ বৃদ্ধি আটকে দেওয়ার যে পরিকল্পনা বিশ্বসম্প্রদায় গ্রহণ করেছে জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ মোটেও কমছে না, বরং বাড়ছে। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বারবার ফেরত আসছে। আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য বাড়তি সাহায্য ছাড়া এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আসলে যে ক্ষতি হয়ে যাবে, যেমন বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলা হয় এক-তৃতীয়াংশ ভূখন্ড সমুদ্রের নিচে চলে যাবে, যদি আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে আটকে দিতে না পারি। এক-তৃতীয়াংশ ভূখন্ড পানির নিচে চলে গেলে কত টাকা দিলে আপনার ক্ষতিপূরণকে যথার্থ মনে হবে সে প্রশ্নটা রয়েই যায়! তো সেটা একটা লম্বা সময়ের ব্যাপার, আপাত যে দুর্যোগের মুখে আমরা পড়ছি সেগুলো মোকাবিলার সামর্থ্যও তো আমাদের নেই। ফলে এই কপে উন্নয়নশীল এবং ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলো তাৎক্ষণিকভাবে যাতে অর্থ সহায়তা পায় সেজন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ একটা তহবিলের দাবি জানিয়ে আসছিল। এটা ৩০ বছর আগে একবার আলোচিত হয়েছিল, তারপর কপ ২৫, কপ ২৬ এ-ও আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু উন্নত বিশে^র বিরোধিতার মুখে কখনো এটা কর্মসূচিতে ঠাঁই পায়নি। এবার অনুষ্ঠানসূচিতে এটার জায়গা পাওয়াটা একটা প্রাথমিক বিজয়।
এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা যখন শুরু হয়, তখন উন্নত বিশ্ব একটা দৃঢ় অবস্থানে যায় তারা কোনোভাবেই এই তহবিল গঠনের ঘোষণা আনতে দেবে না। আর উন্নয়নশীল এবং ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলো ছিল জি ৭৭ এবং চায়না এই মোর্চার অধীনে। তারা অবস্থান নেয় যে, অবশ্যই এই সম্মেলনে এটার ঘোষণা দিতে হবে। এটাতে টাকা কেমন করে আসবে, কে দেবে, টাকা কী নীতিতে বিতরণ হবে, ব্যবস্থাপনা কাঠামো কী হবে সেটা তারা পরে ঠিক করবে। ফলে এটা নিয়ে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। উন্নত বিশ্ব একটা কৌশল নিয়েছিল নিঃসরণ কমানোর এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি আটকে রাখার বিষয়ে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল বিশ^ বলছে, এসবের সঙ্গে এবার তহবিলেরও ঘোষণা দিতে হবে। এই সম্মেলন ১৮ তারিখে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও উভয় পক্ষের সমঝোতায় পৌঁছাতে বাড়তি দুদিন সময় লেগেছে। আশার কথা হচ্ছে, উন্নত বিশ্ব যে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলের বিরোধিতা করেছিল, তারা সেটা মেনে নিয়েছে। মনে রাখতে হবে, তহবিলটা কিন্তু এখনো শূন্য কলস, এখানে এখনো কোনো টাকা আসেনি। তবে আপনার যা প্রত্যাশা, নিঃসরণ কমানোর দিকে, প্রশমনের দিকে, খাপ খাইয়ে নেওয়ার দিকে, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দিকে সে প্রত্যাশাগুলো যত দ্রুততার সঙ্গে, যত আন্তরিকতার সঙ্গে হওয়ার দরকার; তা ততটা দ্রুত, ততটা আন্তরিকতার সঙ্গে এবারও হয়নি।
দেশ রূপান্তর : অতীতে এসব সম্মেলন থেকে জলবায়ু পরিবর্তন রোধের যেসব প্রতিশ্রুতি এসেছে, বাংলাদেশ তার কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক যে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিশ্রুতি এসেছে তাতে বাংলাদেশের বাস্তবায়নের খুব একটা বিষয় নেই। বাংলাদেশের বিষয় হচ্ছে, ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে, সেটা বাংলাদেশ করেছে। কতটুকু করেছে বা আমরা কতটা খুশি, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের মতামত সেখানে কতটা প্রতিফলিত হয়েছে; সেগুলো ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু এই প্ল্যান বাংলাদেশ করেছে, মুজিব প্রসপারিটি প্ল্যানেও এটার কথা বলা হয়েছে, ডেলটা প্ল্যানেও জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। আবার এই মুহূর্তে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিষয়ে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যে তহবিলগুলো আছে সেগুলো বাংলাদেশ যে খুব একটা আনতে পেরেছে বা পাচ্ছে, তা নয়। এগুলোর একটা কারিগরি দক্ষতাও লাগে, সেটাতে বাংলাদেশের যথেষ্ট পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে। ওই তহবিলে যথেষ্ট পরিমাণ টাকাও আসছে না। আরেকটি বিষয়, যেটাকে আমরা প্রশমন বলি, যেই গ্যাসগুলোর জন্য জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, ওই গ্যাসগুলোর নিঃসরণ কমিয়ে আনা। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বলছে যেভাবে সবকিছু চলছে, সেভাবে চললে সে ৫ শতাংশ কমাবে এবং তাকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিলে সে চেষ্টা করবে দেশের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ১৫ ভাগ কমিয়ে আনতে।
দেশ রূপান্তর : মহামারী, যুদ্ধ এবং সম্প্রতি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে এবারের জলবায়ু সম্মেলন থেকে নতুন কী সমস্যা আলোচনায় এলো আর তার সমাধানে কি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলো? ‘প্যারিস চুক্তিকে’ অনেকেই ব্যর্থ বলছেন, সে প্রেক্ষিতে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিলকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : উন্নত বিশ্ব এবার বলেছিল কার্বন নিঃসরণের মাত্রা যদি আমরা ১.৫ এ রাখতে চাই, এক্ষেত্রে অন্য যারা মেজর ইমিটরস যেমন ভারত, মেক্সিকো, ব্রাজিল, সাউথ আফ্রিকা এদেরও কমিট করতে হবে যে, তারা কীভাবে কার্বন কমাবে। অন্যদিকে আবার কিছু কিছু শব্দ তারা আইনি দলিলে ঢুকিয়ে দেয়। যেমন আনঅ্যাবেইটেড মানে হচ্ছে যেসব ফসিল ফুয়েল প্রকল্প সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এবং প্রচুর পরিমাণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছে সেগুলোকে ফেইজ ডাউন করতে হবে। আসলে একধরনের ব্রেইন ওয়াশিং করা হয়... এসব শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে। কিন্তু ফসিল ফুয়েলকে কমিয়ে কার্বন নিঃসরণ মাত্রা কমানোর যে প্রতিশ্রুতি, তার বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এখানে কোম্পানিগুলোর স্বার্থ আছে। উন্নয়নশীল বলেন আর উন্নত বিশ্ব বলেন সব জায়গাতে আবার কোম্পানিগুলো রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আগামী বছর তো সম্মেলনটাই হবে দোহাতে। অর্থাৎ একটা বড় তেল রপ্তানিকারক দেশে সেটা নিয়ে অলরেডি বিতর্ক শুরু হয়েছে।
প্যারিস চুক্তি খুব একটা কার্যকর হয়নি, তবে এখনো ব্যর্থ বলার সময় আসেনি। কারণ হচ্ছে, সমষ্টিগতভাবে উন্নত বিশ্ব হয়তো প্রশমনের দিকে যেভাবে যাওয়ার কথা সেভাবে যাচ্ছে না, কিন্তু উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ বা সেসব দেশের কিছু কিছু প্রদেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে সরে আসার ঘোষণা দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা প্যারিস চুক্তিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা বলছে। কিন্তু যেভাবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে কাজ করার কথা, সেভাবে এখনো কাজ হচ্ছে না। তবে একটা কথা আমাদের মানতে হবে ১৯৩টি দেশ যখন একসঙ্গে দরকষাকষি করে, সেখানে কিছুটা বিলম্ব হবে। মুশকিল হচ্ছে প্যারিস চুক্তিতেও এমন কিছু কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর নীতি থেকে হুট করে সরে আসার পথকেও সুগম রাখেনি। তবে আইপিসিসির ৬ষ্ঠ রিপোর্টের ভিত্তিতে বিজ্ঞানকে সঙ্গে নিয়ে, মানবাধিকারের কথা বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রগুলো যদি এখনো কপ ২৭-এর যে সিদ্ধান্ত ‘২০৩০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমিয়ে ২০১৯-এর মাত্রায় আনতে হবে’, সেই লক্ষ্যমাত্রা ধরে এগোলেও; আমরা পৃথিবীকে বাঁচাতে, অনেক দেশকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে, আগামীর জন্য পৃথিবীটাকে মোটামুটি বাসযোগ্য রেখে যেতে সক্ষম হব।
দেশ রূপান্তর : আমাদের মতো দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের বিষয়গুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার চাইতে অনেক গুরুত্ব পায়। সরকারগুলোর অবস্থান পরিবেশ ও উন্নয়নকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, এক্ষেত্রে করণীয় কী?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : এটা একটা আশ্চর্য বৈপরীত্য। আমরা বিদেশে গিয়ে বলি তোমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাও আর নিজের দেশে, মানে বাংলাদেশে যেখানে ১২ মাস সূর্য থাকে, সেখানে সৌরবিদ্যুতের দিকে মনোনিবেশ করছি না। আমাদের জ্বালানি খাতকে আমরা আমদানিনির্ভর করে ফেলছি। আমার ইচ্ছে করেই পরিবেশকে ও উন্নয়নকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলছি। এ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ভাবটা এমন উন্নয়ন করতে গেলে পরিবেশের ধ্বংস অপরিহার্য, কিন্তু এটা মোটেও সঠিক নয়। উন্নত বিশ্ব যখন উন্নয়ন করেছে, তখন তাদের কাছে বিকল্প ছিল না। তাদের কয়লা পোড়াতে হতো, তারা সৌরবিদ্যুতের কথা জানত না। কয়লা বিদ্যুতের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্ব তখন জানত না। কিন্তু আমরা জেনে এবং বিকল্প থাকা সত্ত্বেও কেন সেই আত্মহত্যার পথকেই বেছে নিচ্ছি! এখানে আসলে কিছু গোষ্ঠীর, কিছু মানুষের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত। দেখুন, আপনি যখন ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন, তখন মশাকে সঙ্গে নিয়ে মিটিং করেন না। কিন্তু উন্নত বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তনের মিটিংয়ে যায়, তখন তারা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ায় এমন কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে যায়। একটা হিসাবে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবারও গত বছরের চেয়ে ২৫ ভাগ বেশি প্রতিনিধি নিয়ে গিয়েছিল; যারা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর সঙ্গে জড়িত। কাজেই উন্নয়নের জন্য যে আমরা পরিবেশ ধ্বংস করছি, তা নয়। উন্নয়নটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক, গোষ্ঠীকেন্দ্রিক।
দেশ রূপান্তর : পরিবেশ আইন, নদী সুরক্ষা, বন সুরক্ষা আইন থাকার পরও বন, নদী, গাছ, পাহাড় সব উজাড় হচ্ছে। একদিকে আইন অন্যদিকে পরিবেশের ক্ষতি। সমস্যা কোথায়?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান : এর জন্য অনেকেই জনসংখ্যাকে দায়ী করে, কিন্তু এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আসলে পাহাড় কাটে না, বন উজাড়, নদী দখল করে না এটা করে মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী। ওই প্রভাবশালীদের স্বার্থকে বাইরে রেখে পরিবেশ সংরক্ষণে কোনো সরকারই মনোনিবেশ করতে পারেনি। আমাদের দেশের যে আইনগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু বেশ জলবায়ুবান্ধব। তারপরও আপনারা দেখবেন জলাশয় ভরাটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এশিয়া প্যাসিফিকে সর্বোচ্চ স্থানে, যদিও আমাদের দেশে জলাশয় ভরাটের বিরুদ্ধে আইন আছে। এবার কিন্তু কপ ২৭-এ জলাশয় ভরাটের বিষয়ে নতুন করে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। যে প্রক্রিয়া মানলে উন্নয়নকে আপনি টেকসই করতে পারবেন; আপনি সেটা মানবেন না। আবার না মেনে ত্বড়িৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে যাবেন এবং জনমতকে একেবারে অগ্রাহ্য করবেন, তারপর বলবেন পরিবেশ ও উন্নয়ন হচ্ছে সাংঘর্ষিক এটা কোনো গ্রহণযোগ্য অবস্থান হতে পারে না। এটা আসলে একটা অর্থনৈতিক কৌশল; যার বেশিরভাগ দেশ যেগুলোতে দুর্নীতি বেশি বিস্তৃত থাকে, সেসব দেশেই এমন হয়ে থাকে। আমাদের নদীগুলো দেখলে মনে হবে সেগুলো হলো বর্জ্যরে ভাগাড়। এমনভাবে উন্নয়নের দাপাদাপি করা হয়, যেন ট্যানারির কারণে ধলেশ্বরীকে বিসর্জন দেওয়াই যায়! কিন্তু আপনি ১০০টি ট্যানারি সৃষ্টি করতে পারবেন, একটা ধলেশ্বরী সৃষ্টি করতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে সরকার কী করে এগুলো স্যাক্রিফাইস করে, কোন আইন, কোন সংবিধানের আলোকে তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। মুশকিল হচ্ছে, যারা এসব ধ্বংস করে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের খুব কাছাকাছি থাকে। এই অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর প্রভাব আছে রাজনীতির ওপর। রাজনীতিকে আমরা সেই দুর্বৃত্তায়ন থেকে রক্ষা করতে পারিনি। পাশাপাশি জবাবদিহি না-থাকা, গণতন্ত্র না-থাকা, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা না-থাকাকেই আমি সবকিছু ধ্বংসের জন্য দায়ী করছি।
ড. জাহিদ হোসেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি দীর্ঘদিন সাউথ এশিয়া ফাইনান্স অ্যান্ড পোভার্টি গ্রুপের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেন। তিনি প্রায় ১৪ বছর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনীতির চাপ সামলাতে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশের ঋণ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে শর্তসাপেক্ষে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ড. জাহিদ হোসেন : বর্তমানে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি একটা চাপের মধ্যে আছে। চাপটা দুটো জায়গায় বেশি। একটা হলো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, মানে ডলারের অভাব। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে, চলতি খাতের অ্যাকাউন্ট ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট ডেফিসিট বেড়ে গিয়েছে। আরেকটা হলো মূল্যস্ফীতি, যদিও গত দু’মাসে সামান্য কমেছে, তারপরেও এটা অনেক বেশি। এই ধরনের চাপের মধ্যে আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়া। আমরা যে শ্রীলঙ্কার মতো অবস্থায় পড়েছি, তা না। আমরা খাদে পড়ার আগে, শ্রীলঙ্কা তো খাদের ভেতর থেকে গেছে। তো খাদে পড়ার আগে সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তিতে যারা ম্যাক্রো ব্যবস্থাপনায় আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে, সেটা আইএমএফ। কাজেই তাদের সঙ্গে ৪২ মাস মেয়াদি একটা কর্মসূচির দিকে যাওয়া, এটা ম্যাক্রো ম্যানেজমেন্টের জন্য সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়। আগামী ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে; প্রতি বছরে যদি অন্তত দুটো কিস্তি পাওয়া যায়, তাহলে প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলারের মতো একটা অর্থের জোগানের জায়গা এখান থেকে তৈরি হচ্ছে। যদিও আমাদের সার্বিক ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি অনেক বেশি, সে তুলনায় এটা মোটা কোনো অঙ্ক না। তবে শূন্যের চেয়ে তো ভালো। সেদিক থেকে একটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখলাম যে বিভিন্ন ঋণদাতার কিস্তির অর্থ পাওয়া নিয়ে শর্তপূরণ হাওয়া-না হওয়ার কারণে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল। যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে। সেখানে আমরাও আইএমএফের কিস্তির টাকা পেতে একই সমস্যায় পড়তে পারি কিনা?
ড. জাহিদ হোসেন : শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে চায়না, জাপান থেকে ঋণ পাওয়া নিয়ে এ সমস্যা হয়েছিল। বন্ডেজ ঋণের ক্ষেত্রে হয়েছিল। তো আমাদের ক্ষেত্রে আইএমফের শর্তটা হলো সংস্কারের। এক্ষেত্রে আপনার সমস্যার গোড়ার কারণটা অ্যাড্রেস করতে হবে। আপনি আইএমএফ থেকে যে অর্থটা পাবেন সেটা সাময়িক ক্রাইসিস মোকাবিলা করার জন্য। এটা অনেকটা সময় কেনার মতো। মানে ওই সময়ের মধ্যে আমি গোড়ার সমস্যাগুলোর সমাধান করব, সংস্কারের মাধ্যমে। আমি ধরে নিচ্ছি তর্কের খাতিরে আইএমএফের শর্তগুলো গোড়ার সমস্যাগুলোর সমাধানযোগ্য শর্ত। এটাকেই সংস্কার বলা হচ্ছে। তো এটা যদি আপনি না করেন, তাহলে তো আপনি আসল সমস্যাকে অ্যাড্রেস করলেন না। মানে যে ওষুধটা আপনার খাওয়া দরকার সেটা যদি আপনি না খেয়ে কেবল প্যারাসিটামল খান তাহলে জ¦র কমলেও অসুখ তো সারবে না।
দেশ রূপান্তর : সংস্থাটি জানিয়েছে, কর্মসূচির উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং দেশের সংহতি, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে সহায়তা করা। এ জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যে কী কী পড়ছে?
ড. জাহিদ হোসেন : এইখানেই হলো তথ্যের ঘাটতি। কারণ, আমরা জানি না আসলে আইএমএফের এই কর্মসূচিতে কী ধরনের সুনির্দিষ্ট সংস্কারকাজ করতে হবে। এখানে কিছু এরিয়া তারা চিহ্নিত করেছে। প্রেস রিলিজে যেমন বলেছে, রাজস্ব আদায়ে উন্নতি করতে হবে, সরকারি ব্যয় যৌক্তিকরণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, মুদ্রানীতি আধুনিকায়ন করতে হবে। অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি কমাতে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ যাতে আসতে পারে সেজন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তারপর জলবায়ু সহিষ্ণুতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এখন এগুলো সবই তো আকাক্সক্ষা।
দেশ রূপান্তর : এগুলো তো অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা আগে থেকেই বলছেন। বাস্তবায়ন তো দেখা যায়নি।
ড. জাহিদ হোসেন : আইএমএফের কর্মসূচিতে আসলে কী আছে, সেটা পরিষ্কার না। আইএমএফ এসে এনবিআরের সঙ্গে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করেছে। তাদের সঙ্গে সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপই হয়েছে, সেখানে তারা পরামর্শও দিয়ে গেছে। কিন্তু পরামর্শগুলোর মধ্যে কী এবং কোনগুলো তাদের তিন বছরের কর্মসূচিতে বাস্তবায়িত হবে, সেটা তো আমরা জানি না। আমরা কেবল জেনারেল কিছু আকাক্সক্ষার কথা জানি। সংবাদ সম্মেলনে যেটা বলেছে, গত চার বছরে বাজেটে অর্থমন্ত্রী যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন ওইখান থেকে একটা মানদ- তৈরি করে আইএমএফের কর্মসূচির জন্য আমরা একটা রিফর্ম প্যাকেজ তৈরি করব। আইএমএফের প্রেস রিলিজে যেসব আকাক্সক্ষার কথা বলা হয়েছে তার সবই প্রতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় পাবেন। ওখানেও তো সুর্নিদিষ্ট করে কিছু বলা নেই। প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় সুশাসন এবং সংস্কার বলে একটা চ্যাপ্টার থাকে। ব্যাংকিং সেক্টরে, এনার্জি খাতে, এনবিআরের জন্য, জলবায়ুর জন্য এই এই করব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভর্তুকি, সামাজিক সুরক্ষা... মানে অনেক কিছু বলা থাকে; এখানে এটা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা কী? একটা উদাহরণ দিই, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করার কথা বলছে। তার মানে কী? মন্দ ঋণের স্বীকৃতির জন্য এখন ১৮০ দিন অপেক্ষা করে। আগে তো এটা ৯০ দিন ছিল, আন্তর্জাতিক মানদ-ও ৯০ দিনের। একটা সুপারিশ ছিল যে এটাকে ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনে নিয়ে আসা হোক। এটা তো একটা সুর্নিদিষ্ট পদক্ষেপ। তো এটা কি আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচিতে আছে? সেটা তো জানি না। এরকম সুর্নিদিষ্ট কথা না জানলে আপনি, আমি কীভাবে বলব কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ বা কোনটা সম্ভব হবে, কোনটা অসম্ভব।
দেশ রূপান্তর : রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য আইএমএফ পরামর্শ দিয়েছে। সাধারণ ভোক্তাদের ওপর চাপ না দিয়ে রাজস্ব বাড়াতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : এখানে তো অনেক লম্বা এজেন্ডা। পলিসির ব্যাপার আছে, অ্যাডমিনিস্ট্রিশনের ব্যাপার আছে। তারপরে সুশাসনের বিষয় আছে। পলিসির ক্ষেত্রে আইএমএফ ৬ মাস আগে নিয়মিত ভিজিটে দুই পৃষ্ঠার একটা নোট দিয়ে গিয়েছিল। সেখানে করের ক্ষেত্রে তারা ভ্যাট রেইটের কথা বলেছিল। বর্তমানে ভ্যাটের চারটা রেইট আছে। তারা বলেছিল এটাকে সরলীকরণ করে একটা রেইটের দিকে যেতে। এখনই যে করতে হবে তা না, কিন্তু সেদিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে বলেছে। কাস্টমসে, ইনকাম ট্যাক্সে, করপোরেট ট্যাক্সে সব ক্ষেত্রেই তো পলিসি রিফর্মেও প্রয়োজন আছে। আইএমএফের কর্মসূচিতে ট্যাক্স কালেকশন বাড়াতে কোন পলিসি তারা নিচ্ছে, যেটা আগামী ৩ বছরের মধ্যে করা সম্ভব, এটা হয়তো আমরা ফেব্রুয়ারিতে জানতে পারব।
দেশ রূপান্তর : রিজার্ভের কথা সরকার যেটা বলত, জানা গেল আইএমএফের হিসাবে সেটা অনেক কম। এতে একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড. জাহিদ হোসেন : এখানে প্রথম কথা হলো সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো। ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কত আছে, হিসাবটা তো আপনাকে ঠিক মতো করতে হবে। এটা তো কারোর ব্যক্তিগত সম্পদ না। এটার প্রকাশটাও স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। আমরা যদি বলি আমার ৩৪ বিলিয়ন ডলার আছে, কিন্তু আসলে তো সেটা নেই। আইএমএফ বলার পর জানা গেল ২৬ বিলিয়ন। সঠিক হিসাব জানা সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতি নির্ধারকদেরও দরকার। খাদ্যমন্ত্রী যদি ভাবেন যে আমার তো ৩৬ বিলিয়ন রিজার্ভ আছে, কাজেই খাদ্য আমদানিতে সমস্যা হবে না। কিন্তু রিজার্ভ তো আছে ২৬ বিলিয়ন। যে টাকা আপনার ক্যাশ ফর্মে নেই, সেটা আপনি কেন বলবেন যে আছে। আপনার এক লাখ টাকা আছে, আমাকে ১০ হাজার দিলেন ধার। এখন যদি জানতে চাই আপনার হাতে কত টাকা আছে, আপনি কি বলবেন যে আপনার কাছে এক লাখ আছে, আপনার কাছে তো আছে ৯০ হাজার। শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলার ধার দিয়ে সেটাও হিসাবে দেখাচ্ছে যে তার আছে, এটা বলতে পারেন, কিন্তু সেটা তো সঠিক না।
দেশ রূপান্তর : অনেকে বলছেন ব্যাংকে টাকা রাখলে তা ফেরত পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ রয়েছে। পরিস্থিতি কি এতটাই খারাপ? ‘ব্যাংক রান’-এর সম্ভাবনা দেখছেন কি?
ড. জাহিদ হোসেন : বাংলাদেশের অবস্থা ওই পর্যায়ে গেছে বা যেতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তার মানে এই না যে আপনার সমস্যা নেই। আসলে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিটের দুর্বলতার মাত্রা কতটুকু সেটা জানার জন্য আপনার দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের হিসাবটা ঠিক মতো করতে হবে। ছয় মাস আগের আইএমএফের যে ভিজিটের কথা বললাম, তখন তারা এটাও বলেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটির যে রিপোর্ট করে সেটাতে আগে দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের একটা সংখ্যা দিত। ২০১৮ সালের পর থেকে এটা আর দেওয়া হয় না। তাদের পরামর্শ ছিল, এই সংখ্যাটা সঠিকভাবে ক্যালকুলেট করা হোক এবং রিপোর্টে সেটা উল্লেখ করা হোক। তাহলেই তো আপনি যে প্রশ্নটা করেছেন, যে কোন ব্যাংকে টাকা রাখলে সেটা পেতে সমস্যা হবে জানা যেত। সব ব্যাংক তো খারাপ না। তথ্যের অস্বচ্ছতা থাকলে, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য থাকলে গুজবের জায়গা তৈরি হবে। স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করা হলে গুজবের সুযোগ থাকবে না।
দেশ রূপান্তর : দেশের ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাবে বিশেষ সুবিধায় অনেকেই ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। পর্ষদ সদস্যরা প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় ঋণ অনুমোদন করাচ্ছেন। সমঝোতার ভিত্তিতে এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে আইএমএফ। আপনার অভিমত কী?
ড. জাহিদ হোসেন : ব্যাংকের বোর্ডে যে পরিচালক নিয়োগ করা হয় সেখানে আমাদের ব্যাংকিং কোম্পানি আইনেই একটা প্রপার ক্রাইটেরিয়া বলে দেওয়া আছে। কোন ধরনের লোক, কোন ধরনের অভিজ্ঞতা, অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড, তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিবেচনায় এনেই তো আপনাকে নিয়োগ দিতে হবে। যাতে স্বার্থের সংঘাত তৈরি না হয়। অযোগ্য লোক যেন ওখানে না বসে। এটা রাষ্ট্রায়ত্ত এবং প্রাইভেট সব ব্যাংকের জন্য একটা কনসার্ন। এখানে আইএমএফ সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা মনে করি এই পরামর্শ বা প্রস্তাব আমাদের আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এটা কর্মসূচিতে আছে কি না সেটা দেখতে হবে। আপনি একজন ঋণদাতা, এখন আপনি আমাকে বললেন আপনার পর্ষদটা ঠিক করেন, কিন্তু আপনাকে আমি ঋণ যে কোনো অবস্থাতেই দেব, পর্ষদ ঠিক করেন বা না করেন। আমি কী করব? আপনি ঋণটা নিলেন কিন্তু পর্ষদ ঠিক করলেন না, তাহলে কী হবে? এখানে আইএমএফের সিরিয়াসনেসটা আরও বিশ^াসযোগ্য হবে যদি পরামর্শ ও প্রস্তাবগুলো কর্মসূচির ভেতরে থাকে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও খাদ্যনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. গোলাম রসুল। তিনি বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকার অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। সরকার বলছে আমনের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বাড়ায় বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ; অন্যদিকে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে বিশ^জুড়ে। মন্দা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার মুখে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই বিশেষজ্ঞ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সহ-সম্পাদক সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতি ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়াদির মধ্যেই সুখবর পাওয়া গেল যে, আমনের উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বাড়ায় বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বলা হচ্ছে এবারে গত বছরের চেয়ে ১৩ লাখ টন আমন বেশি হবে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
গোলাম রসুল : আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে যে গত বছরের তুলনায় আমন ১৩ লাখ টন বেশি হবে, এটা আমার কাছে মনে হচ্ছে ইনকনক্লুসিভ। অসম্পূর্ণ, সিদ্ধান্তে আসার মতো কিছু না। এই সেন্সে যে, আমনের হারভেস্ট শুরু হতে যাচ্ছে। আমরা এবার জানি, বাংলাদেশে এবার আমন চাষের সময় সমস্যা ছিল। বৃষ্টি ছিল না, সারের দাম, ডিজেলের দাম বাড়ল, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানল, উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও রিপোর্ট পাচ্ছি যে দেশের নর্থ-ওয়েস্টার্ন এলাকা রাজশাহী, বগুড়া, নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর বেল্টে আমাদের আমন ধানটা ভালো হয়েছে। আমরা আশা করতে পারি যে ফলন আগের বছরের তুলনায় একটু বেশি হবে, কিন্তু কতটুকু বেশি হবে এটা আমার মনে হয় এখনো বলা যাবে না। কারণ আমরা এট দ্য সেইম টাইম দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের কোনো কোনো এলাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লাসহ আরও কোনো কোনো এলাকায় আমন উৎপাদন কম হচ্ছে। যদিও উপকূলীয় এলাকায় আমন ধান কম চাষ হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এবং অন্যান্য সব কিছু মিলিয়ে যে এফেক্ট তাতে নিট প্রোডাকশন কী হবে সেটা বলার জন্য মনে হয় আরেকটু সময় লাগবে। মাত্র তো ফসল তোলা শুরু হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : এ বছর বেশ দীর্ঘ খরা ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পাশাপাশি ছিল বিদ্যুৎ সংকট। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ও আঘাত হেনেছে। সরকার বলছে সেচ ও সেচ পাম্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার সিদ্ধান্তে আমন উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আপনার মত কী?
গোলাম রসুল : এটা ঠিক যে আমাদের ইরিগেশন ও পাম্পিংয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার চেষ্টা করছে এবং অনেক জায়গায় সেটা করেছেও। কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে বিদ্যুতের বাইরেও কিন্তু বিরাট ইরিগেশন এরিয়া রয়েছে। এখনো আমাদের অধিকাংশ এলাকার ইরিগেশন হয় যে শ্যালো টিউবয়েলের মাধ্যমে, সেটা কিন্তু চলে ডিজেলে। যখন জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ে সেটা তাদের এফেক্ট করে। তারা সেচ করছে ডিজেলের মাধ্যমে, লাখ লাখ শ্যালো টিউবয়েল রয়েছে যারা বিদ্যুতের কানেকশন পায়নি। ফলে এখানে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ কতটুকু ভূমিকা রেখেছে তা পরিষ্কার না।
দেশ রূপান্তর : উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে অনেক কৃষক ধান চাষ বাদ দিয়ে অন্য লাভজনক ফসল উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকছে। এছাড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা, অতিবৃষ্টি বন্যা তো রয়েছেই। প্রতি বছর দেশের কৃষিজমিও কমছে। এর মধ্যেও প্রতি বছর ধান উৎপাদন বাড়ছে, এর কারণ কী?
গোলাম রসুল : প্রতি বছর ধান উৎপাদন বাড়ছে এটা ঠিক। কিন্তু কৃষকদের ধান উৎপাদনে আগ্রহটাও কমে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে আশি-নব্বইয়ের দশকে যে সমস্ত জমিতে রবিশস্য হতো, মসুর ডাল হতো, সেগুলোতে ইরিগেশনের ফলে ধান চাষ শুরু হলো। এতে ধানের উৎপাদন বাড়ল। আমরা যখন ইরিগেশন ফ্যাসিলিটিজ দিতে পারলাম, শ্যালো টিউবয়েল স্থাপনের একটা বিপ্লব হলো, তখন অন্যান্য ফসল যেসব জমিতে হতো, সেগুলোতে ধান চাষ বাড়ল, উৎপাদন বেশি হলো। আমাদের ধান উৎপাদন বৃদ্ধির পেছনে মেজর রোল প্লে করছে ইরিগেশন। দেশে ড্রাই সিজনে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চে ধান চাষ করা যেত না পানির অভাবে। ইরিগেশনের ফলে ওইসময়ও ধান চাষ করা গেল। দুই নম্বর কারণ হলো নতুন নতুন উন্নত জাতের ধানের বীজ আমরা উৎপাদন করতে পারছি। এসব উন্নত জাতের ধানের চাষের ফলে ফলন বাড়ছে। কিন্তু আমরা এখন যদি দেখি, যেসব জমিতে বহু বছর ধরে এসব উচ্চফলনশীল ধান চাষ করা হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু প্রোডাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে। তারপর যদি লক্ষ করেন, কৃষকরা প্রতি বছরই আগের বছরের তুলনায় অধিকমাত্রায় সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করছে। যেটা একসময় একটা আনসাসটেইনেবল জায়গায় চলে যাবে। সত্তর এবং আশির দশকে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের ব্যবহার অনেক কম ছিল। কিন্তু এখন আমরা সাউথ এশিয়ার মধ্যে রাসায়নিক সারের ব্যবহারে টপে চলে গেছি মনে হয়। কৃষক এটা ব্যবহার করছে কারণ জমির যে উর্বরতা কমে যাচ্ছে, সেটাকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। এটা আরেকটা ফিউচার কনসার্ন।
দেশ রূপান্তর : চলতি বছর প্রতি কেজি আমন চাল উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৪১ টাকা ৫৮ পয়সা; যা গত বছরের তুলনায় ৫৮ পয়সা বেশি। চলতি আমন মৌসুমে ধানের দাম কেজিতে ১ টাকা এবং চালের দাম ২ টাকা বাড়িয়ে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। সরকার নির্ধারিত এই মূল্য কি ঠিক আছে?
গোলাম রসুল : আমার কাছে, এখন, আমি জানি না, আমাদের কৃষি ডিপার্টমেন্ট এই এসেসমেন্টটা কীভাবে করেছে। তারা হয়তো প্রোডাকশন কস্ট হিসাব করে বের করেছে...। কিন্তু আমরা যখন বিভিন্ন জায়গায় যাই, গ্রাম এলাকায় যাই, কৃষকদের সঙ্গে কথা বলি সেখানে কৃষকদের যে হিসাব তাতে এই দামে তাদের উৎপাদন খরচই কভার করে না। প্রফিট বাদ দেন, খরচই ওঠে না। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে আমরা খরচের যে হিসাবটা করি সেখানে আমরা একটা জিনিস হিসাব করি নাÑ কৃষকদের যে লেবারটা যায়, প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে কৃষকের যে শ্রমটা যায়, সেটার হিসাব আমরা করি না। আমরা কেবল খরচের হিসাব করি। এখন যে সমস্ত ফ্যামিলিতে দুই/তিনজন লোক আছেন তারা হয়তো অন্যদের জমিতে কাজ না করে নিজেদের জমিতে কাজ করছেন এবং তারা তাদের শ্রমের হিসাবটা ধরছেন না, তারা সার্ভাইব করছে। কিন্তু এটাকে আমাদের ধান-চালের প্রোডাকশনকে যদি আপনি কমার্শিয়ালি দেখেন তাহলে দেখবেন এটা তেমন লাভজনক না। বেশি লাভজনক না বলেই কিন্তু দেখবেন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধান ক্ষেতকে কেটে পুকুর বানানো হচ্ছে, মাছ চাষ করছে, অনেকে ফলমূল চাষ করছে, ধান চাষ থেকে সরে যাচ্ছে এসব কারণে। ধান চাষ যদি লাভজনক হতো, কৃষকরা তো অন্যদিকে যেত না। ধানচাষ লাভজনক না হওয়াতে লং রানে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে কিন্তু রিস্ক তৈরি হচ্ছে। আমার মনে হয়, আমরা যখন ধানের দাম নির্ধারণ করি তখন কৃষককে রিজনেবল প্রফিট দিয়ে দামটা ঠিক করা উচিত। এবার এখন পর্যন্ত আমি যা শুনেছি, অলরেডি মার্কেটে ১৩০০/১৪০০ টাকা মণ ধান। এবং সরকারের যে হিসাব প্রায় ১০০০ টাকার মতো, সেটা ৩/৪০০ টাকা আরও কমে যাচ্ছে বাজারদর থেকে। এই দামে কী করে সরকার যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ করতে পারবে বুঝতে পারছি না। কৃষকরা তো মার্কেটের চেয়ে কম দামে তার ধান বিক্রি করবে না। আরেকটা পয়েন্ট যেটা আমি বলতে চাই, এই সময় আমরা যদি প্রকিউরমেন্ট প্রাইসটা একটু হাই না রাখি এবং কৃষকদের যদি আমরা এখন এই সাপোর্টটা না দিই তার নিজস্ব মজুদের জন্য- তাহলে তো হবে না। সরকার মজুদ করছে সরকারের রিজার্ভে রাখার জন্য, কিন্তু আমাদের দেশে যে লাখ লাখ কৃষক আছেন যারা ধান উৎপাদন করেন, তারা আর্থিক অনটনের কারণে, দেনার কারণে তারা ধানটা বিক্রি করে দিচ্ছেন কম দামে। এতে তারা লুজার হচ্ছেন। এটা যদি তারা তিন/চার মাস ধরে রাখতে পারতেন, তারা বেশি দাম পেতেন। এখন সরকার তাদের একটা ঋণ দিতে পারে কয়েক মাসের জন্য। তারা এখন যে ডিপ্রেসড সেল করছেন, কিছু টাকা থাকলে তারা এটা করতেন না। তারা ফসল ধরে রাখতে পারলে একদিকে কৃষক পর্যায়ে স্টোরেজটা বাড়ত, অন্যদিকে সরকারের ওপর চাপ কমত। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিরাট একটা উদ্যোগ হতে পারত। এখন কৃষকরা ধান উৎপাদন করে টাকার অভাবে সেটা কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন কিন্তু তিন/চার মাস পরেই তাকে সেটা বেশি দামে কিনে খেতে হবে। এই যে ডিপ্রেসড সেলিংয়ের যে ক্রাইসিস, এটাকে থামানোর জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার দরকার ছিল।
দেশ রূপান্তর : সরকার দেশের ভেতর থেকে চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করলেও বিদেশ থেকেও চাল আমদানি করা হবে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
গোলাম রসুল : আমার মনে হয় এবার অন্য বছরের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। অন্য সময় হলে আমি হয়তো বলতাম এটা আমদানি করার দরকার নেই। কিন্তু এ বছর আমরা যদি গ্লোবাল মার্কেটটা দেখি, সেটা খুবই আনস্ট্যাবল। আমরা জানি না যে আগামী দুই বা তিন মাস পর মার্কেটটা কী রকম হবে। গত এক/দুই মাস একটু বেটার আছে যদিও। কিন্তু এ বছর বিভিন্ন দেশে শুনছি যে আবহাওয়ার কারণে খাদ্য উৎপাদন কম হয়েছে। শুনছি চীনে, ভারতে, ইউরোপে কম হয়েছে, আমেরিকাতেও কম হয়েছে। কাজেই এটার প্রভাব ২০২৩ সালে পড়তে পারে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার যদি আমদানি করে সেটা ভালো।
দেশ রূপান্তর : সম্প্রতি রুশ নৌবহরের ড্রোন হামলার অভিযোগ তুলে শস্য রপ্তানি চুক্তি স্থগিত করার হুমকি দিয়েছে রাশিয়া। তো সেটা রাশিয়া করুক বা না করুক, প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধাবস্থায় যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ফলে যুদ্ধ-পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে কী করা উচিত?
গোলাম রসুল : রাশিয়া যদি এই চুক্তি থেকে সরে আসে বা অন্য কোনো কারণে যদি কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলো থেকে শস্য রপ্তানি ফের বন্ধ হয়ে যায় সেটা গ্লোবালি খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে। আমরা আশা করি এটা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রিনিউ করা হবে। এটা স্ট্যাবল না থাকলে একদিকে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে, অন্যদিকে আমদানির মাধ্যমে স্টক বাড়াতে হবে। একটা বাফার স্টক তৈরি করতে হবে।
ড. ম তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল অনুষদের ডিন, পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী। সম্প্রতি দেশে গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের বিষয়ে তার সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের মধ্যেই গ্যাস সংকটে অতিষ্ঠ জনজীবন। পরিস্থিতি এমন যে রাজধানীবাসীর রান্নার রুটিনই চেঞ্জ হয়ে গেছে। অন্যদিকে গ্যাস সংকটে দেশজুড়ে শিল্পকারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে ক্ষোভ বাড়ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. ম তামিম : বিষয়টা তো সবার জানা। গ্যাস নেই, গ্যাস কিনতেও পারছে না। মূল সমস্যা হচ্ছে পয়সা নেই, গ্যাস কেনা যাচ্ছে না। নিজস্ব গ্যাসের সরবরাহ নেই। এই মুহূর্তে কিছু করারও নেই, এটা যেভাবে আছে আপাতত সেভাবেই চলবে। শীতকালে তো নরমালি আমাদের আবাসিক এবং শিল্পকারখানায় গ্যাসের চাপ কমে যায়। তবে শীতে বিদ্যুতের পরিস্থিতি অত খারাপ থাকবে না। গত দুই/তিনদিনে একটু ঠান্ডা পড়াতে বিদ্যুতের পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হয়েছে, লোডশেডিং খুবই কম হয়েছে। তো বিদ্যুৎ ঠিক থাকবে কিন্তু শীতকালে আবাসিক এবং কলকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ কমবে। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি দাম কমে এবং যদি সরকার এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করা যাবে। তবে আমি আগামী গরমকালের আগে এটার সম্ভাবনা খুব কম দেখছি।
দেশ রূপান্তর : উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে শিল্পকারখানা অধ্যুষিত এলাকায় গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং লোডশেডিং কম করার কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন শিল্প মালিক। লোডশেডিংয়ের আগাম তথ্য জানানোর কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
ড. ম তামিম : এটা করা খুব মুশকিল। দিতে হলে তো সব জায়গাতে দিতে হবে, আমাদের তো স্পেসিফিকলি শিল্প এলাকা বলে কিছু নেই। তবে বেশি শিল্প অধ্যুষিত এলাকা হলে সেখানে দেওয়া যেতে পারে। তাতে আবার দেশের অন্যান্য স্থানে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় যেসব শিল্প আছে তাদের আবার গ্যাস সরবরাহ কমে যাবে। আমরা যদি একটা জোন করতে পারতাম, যেটা এখন করা হচ্ছে। ইকোনমিক জোনগুলোর মধ্যে যদি শিল্পকে নেওয়া যেত, আমাদের শিল্পের প্রসারটা যদি স্পেসিফিক জায়গায় হতো, যেটা পৃথিবীর সব দেশেই হয়। সব দেশে শিল্প এলাকাটা ভিন্ন থাকে, সেখানে আবাসিক এলাকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা বেকারির বড় কারখানা থাকে না। আমাদের জন্য আসলে এক্সক্লুসিভলি শিল্পকে যে আলাদাভাবে গ্যাস সরবরাহ করবে, টেকনিক্যালি এটা খুবই কঠিন।
আর লোডশেডিংয়ের আগাম তথ্য দিতে পারছে না কারণ প্রথমত যারা লোডশেডিং করে, শিডিউলটা যারা দিচ্ছে, তারা হলো ডিস্ট্রিবিউটর। তারা আগের দিনের সরবরাহ এবং প্রতিশ্রুতি, মানে আগামীকাল তোমাদের এই পরিমাণ বিদ্যুৎ দেওয়া হবে এর ভিত্তিতে তারা একটা শিডিউল করছে। কিন্তু আসলে দেখা যাচ্ছে, তাদের যারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে তারা কম দিচ্ছে। সেজন্য তাদের শিডিউলের বাইরে অনির্ধারিতভাবে লোডশেডিং হচ্ছে।
দেশ রূপান্তর : জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা দেশকে চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ১৯৯৫ সালের জাতীয় জ্বালানি নীতিমালা অনুসরণ করা হলো না কেন?
ড. ম তামিম : ১৯৯৯ সালের পর থেকে সত্যিকার অর্থে দেশে কোনো তেল-গ্যাস অনুসন্ধান হয়নি। আজ প্রায় ২২ বছর হয়ে গেল। যে দু-চারটি অনুসন্ধান হয়েছে, কূপ খনন হয়েছে সেগুলো খুবই নগণ্য। ১৯৯৫ সালের জাতীয় জ¦ালানি নীতির মূল লক্ষ্য ছিল কয়লা উত্তোলন করা। কয়লা উত্তোলন করা হয়নি, কারণ গ্যাস দিয়ে আমাদের তখন চলছিল। পরবর্তী সময়ে গ্যাসের যখন ঘাটতি দেখা দিল তখন কথা উঠল। বিশেষ করে এশিয়া এনার্জি যখন কয়লা উত্তোলন ও স্টোরেজের কথা উঠাল। আমাদের দেশে কয়লার তেমন ব্যবহার ছিল না, সে কারণেই তারা কয়লা স্টোরেজের কথা বলেছিল। পরবর্তী সময়ে তারা কয়লার এক্সপোর্ট থেকে সরে এসে বলেছে, তোমরা যদি কয়লা ব্যবহার করো তোমাদের কাছেই কয়লা বিক্রি করব, যদি পুরোটা নিতে পার তাহলে সবটুকুই নেবে; সেটা না হলে তারা রপ্তানির কথা বলেছে। তবে কয়লার একটা পরিবেশগত রিস্ক আছে। বিদেশি কোম্পানিরা বলেছে এই এনভায়রনমেন্টাল রিস্কটা কঠিন কিছু না। এর ইঞ্জিনিয়ারিং সলিউশন আছে, আমরা এটা ম্যানেজ করতে পারব। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেটা কখনোই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। আগের মানে ২০০১ থেকে ২০০৬ যে সরকার ছিল তারা চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলন হওয়ায় সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তো ২০১০ বা ২০১১ সালে সরকার ঘোষণা দিল যে কয়লা আমরা উত্তোলন করব না। এরপর থেকে তো কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে আছে। আমি মনে করি কয়লা উত্তোলন বন্ধ হওয়ার মূল কারণটা হলো রাজনীতি। অর্থনীতিও আছে। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান যে হয়নি, এর পেছনেও কিছুটা হলেও রাজনীতি আছে। এখানে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে। একটা রাজনৈতিক মহল যাদের জনগণের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই কিন্তু মিশন চালু আছে, তেল-গ্যাসের ক্ষেত্রেও তারা বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতা করেছে। তো তাদের বিরোধিতার কারণেই ১৯৯৯ সালের পর থেকে দেশে আর কোনো বিদেশি কোম্পানি আসেনি। দুই একটা এলেও কাজ করতে পারেনি। অর্থাৎ বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। সরকার তাদের জন্য সহায়ক হয়নি, আর সেই নীতিও গ্রহণ করেনি। যে কারণে নিজস্ব অনুসন্ধান, উৎপাদন, তা কয়লা হোক বা গ্যাস, কোনোটাই আগায়নি। আমরা বেশি মাত্রায় আমদানিনির্ভর হয়ে গেলাম। ঝুঁকি তৈরি করলাম এবং এখন আমরা তার মধ্যে পড়ে গেলাম।
দেশ রূপান্তর : ভোলায় গ্যাস পড়ে আছে, করণীয় কী?
ড. ম তামিম : ভোলায় যে গ্যাস তার তো মজুদের নির্ণয় ঠিকমতো করা হয়নি। পেট্রোবাংলা বা বাপেক্স তারা যে গ্যারান্টি দিয়ে বলবে যে এখানে এতটুকু মজুদ আছে প্রথমত তারা কিছুই বলেনি। দ্বিতীয়ত, একটা মিনিমাম মজুদ না থাকলে কোনো প্রকল্পের জন্য তো গ্যাস তোলা যাবে না। তারপরও ভোলার গ্যাস তো পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে। তো এটা যদি এখন এক/দুই টিসিএফ না হয় তাহলে তো কোনো প্রকল্পেই কাজে দেবে না। প্রকল্পের পুরো যে পরিকল্পনা আছে, তাতে কত মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কত বছরের জন্য সরবরাহ করলে সেই বিনিয়োগ লাভজনক হবে এগুলো তো হিসাব-নিকাশের ব্যাপার, তাই না? বললেই তো হবে না যে দুই মাসের মধ্যে আমরা ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নিয়ে আসব। সেটা আমরা কোথায়, কীভাবে ব্যবহার করব? বলা হচ্ছে, শিল্প মালিকরা সেখানে গিয়ে সিএনজির মাধ্যমে গ্যাস নিয়ে আসবে। কিন্তু, অলরেডি তারা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেই পরিমাণ শিল্প আছে বাংলাদেশে তাতে ওই ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কোথায় রাখবে আর কোথা থেকে সে তা সিএনজি করে নিয়ে যাবে মানে এটা অবাস্তব চিন্তাভাবনা। ওই ৮০ মিলিয়ন গ্যাস যদি এখন পাইপলাইনে নিতে পারে সেটা ঠিক আছে।
দেশ রূপান্তর : বিপুল পরিমাণ এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, এর ইম্প্যাক্ট কী?
ড. ম তামিম : এই নীতি যখন সরকার নিয়েছে সেটা ঠিক ছিল এবং আমি মনে করি সেটা এখনো ঠিক আছে। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে এটা আরও প্রসারণ করা দরকার। আমাদের দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনা আছে, আরও গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে এগুলো সময় সাপেক্ষ, এগুলো প্যারালালি চালিয়ে যেতে হবে। এগুলো দীর্ঘদিন না করে বসে থাকা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। কিন্তু আমদানিও আমাদের করতে হবে। আমদানির ফ্যাসিলিটিজও বাড়াতে হবে। আমাদের যে পরিমাণ গ্যাস লাগে তা আমরা এখন চাইলেও আনতে পারছি না, তার কারণ হলো আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যাইনি। অর্ধেক করলাম দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, আর অর্ধেক করলাম স্পটের চুক্তি। এখন স্পটে আমরা ৩ ডলারে গ্যাস কিনি, আবার ৫০ ডলারেও কিনতে হয়। স্পট থেকে গ্যাস কিনতে প্রথমত সক্ষমতা, দ্বিতীয়ত পারপাসটা ক্লিয়ার থাকতে হবে। ইমার্জেন্সি পিক লোডের জন্য স্পট থেকে গ্যাস কিনতে যাব। যে কোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। ফলে তার ওপর নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদে আমি স্পট থেকে কিনতে থাকব, এটা সম্পূর্ণ ভুল। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি বাড়াতে হবে। দশ থেকে পনেরো পার্সেন্ট ক্যাপাসিটি স্পট থেকে নিতে পারি, দাম বেশি হলে কিনব না।
দেশ রূপান্তর : এই মুহূর্তে গ্যাস সংকটের স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কী?
ড. ম তামিম : পেট্রোবাংলা বলেছে যে তারা আগামী ২৫ সালের মধ্যে বর্তমানে যে ক্ষেত্রগুলো আছে, সেগুলো থেকে ৬০০ মিলিয়ন অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করবে। আমি মনে করি না যে তারা এটা করতে পারবে। তাদের যে অতীত ইতিহাস, তাতে এই তিন বছরে এই পরিমাণ গ্যাস উৎপাদনের ক্ষমতা এককভাবে পেট্রোবাংলার নেই। এই পরিকল্পনা তারা দিয়েছে আইওয়াশের জন্য। করতে হলে তাদের তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিতে হবে। এটা করার জন্য যে টেকনোলজি ও জ্ঞানের দরকার সেটা আমাদের দেশে নেই। দুঃখজনক হলেও দীর্ঘদিন আমরা এই সেক্টরে কাজ করছি কিন্তু সেই জ্ঞান আমাদের এখানে কারোর নেই। এই জ্ঞানটা আহরণ করতে হবে। কোথায় কী করা যেতে পারে এবং বর্তমানের গ্যাসক্ষেত্রগুলো নিয়ে আরও বিপুল স্টাডি করে পরিকল্পনা নিতে হবে। এখানে অর্থায়নেরও ব্যাপার আছে। ডলারের এখন যে অভাব, তাতে আমরা কেন একটা রিস্কের মধ্যে দেশীয় ডলার ইনভেস্ট করতে যাব! আমি মনে করি ফরেন ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে এখান থেকে ডলারের রিস্কটা সরিয়ে নিতে হবে। পুরো ইনভেস্টমেন্টটা তারা করবে, যদি গ্যাস পায় তাহলে সেটা আমরা কিনে নেব, ইনভেস্টমেন্টের পয়সা দেব। জ¦ালানি খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ছাড়া আমাদের উপায় নেই। পাশাপাশি নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আমদানির ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়। যত সময় লাগুক, গ্যাস অনুসন্ধান করতেই হবে। একক জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভর করা যাবে না। সবার মতামত নিয়ে একটি সমন্বিত জ্বালানিনীতি তৈরি করে এগোনো দরকার এখন।
জনস্বাস্থ্য ও মহামারী বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন এখন বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা। সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০৬ জন, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এ পরিস্থিতিতে করণীয়সহ প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. মুশতাক হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটে। এ বছর অক্টোবরের শেষ ভাগে এসেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমার লক্ষণ নেই। বরং কয়েক দিন ধরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কারণ কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : প্রধান কারণ হচ্ছে বৃষ্টিপাত, জলবায়ু পরিবর্তন। বিশ্বব্যাপী এরকম হচ্ছে। বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আসছে। ঘূর্ণিঝড় যদি নাও আঘাত হানে নিম্নচাপের প্রভাবে কিন্তু কমপক্ষে সাতদিন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির পানি জমে থাকা খানাখন্দ মশার প্রজননে খুবই উপযোগী। দ্বিতীয় হচ্ছে মশক নিয়ন্ত্রণ করায় এবং ডেঙ্গু রোগীদের ব্যবস্থাপনায় যে সর্বাত্মক উদ্যোগ, সেটা আমরা নিতে পারছি না। এখানে একজন রোগীর চিকিৎসা করবার জন্য নিয়মকানুন আছে, মানে হাসপাতালে রোগী এলো আর আপনি চিকিৎসা করলেন, কিন্তু যখন কমিউনিটিতে রোগ ছড়িয়ে পড়ে তখন স্থানীয়ভাবে মহামারীর সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য একটা স্থানিক মহামারী। এ পরিস্থিতিতে রোগীর চিকিৎসা এবং ব্যবস্থাপনা ভিন্নভাবে করতে হয়। জনস্বাস্থ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কী হতে পারে?
ডা. মুশতাক হোসেন : কমিউনিটি বা জনগোষ্ঠীভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সিঙ্গেল রোগীর চিকিৎসার যে প্রটোকল সেটা দিয়ে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ হবে না। সিটি করপোরেশন কিছু কিছু এলাকায় করছে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট না। তাদের জনবল নেই, সম্পদ নেই। যে এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী আসছে হাসপাতাল থেকে সেখানকার ঠিকানা নিয়ে তারা সে এলাকায় কীটনাশক ছিটানো, মানুষকে বলা এসব করছে। এটা ঠিক আছে, তবে তা খুবই সীমিত আকারে হচ্ছে। সরকার যদি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে না পড়ে, তাহলে হবে না। এখন তো ঢাকার বাইরে অনেক জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমে ৫০টির বেশি জেলার কথা বলা হয়েছে। এটা উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়েছে। এখন টানা দুই/তিন বছর যদি কমিউনিটি মবিলাইজেশন করে একটা হচ্ছে মশক নিয়ন্ত্রণ, আরেকটা হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের সার্ভিলেন্স, মানে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত করার কাজ করতে পারি তাহলেই এই যে প্রায় বছরই ডেঙ্গুর স্থানিক মহামারী হচ্ছে তা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
দেশ রূপান্তর : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যারা সফল হয়েছে, তারা কীভাবে পেরেছে?
ডা. মুশতাক হোসেন : ডেঙ্গু রোগী কীভাবে শনাক্ত হয়, কীভাবে চিকিৎসা করা হয়, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় সবকিছু কিন্তু জানা। কভিডের মতো অজানা রোগ না। যারা এটি নির্মূলে সফল হয়েছে যেমন কলকাতা, নিকারাগুয়া, কিউবা তারা কমিউনিটিভিত্তিক মবিলাইজেশন করে সফল হয়েছে। আমাদেরও এটা নির্মূলের সক্ষমতা আছে। আমাদের গ্রাসরুট লেভেল পর্যন্ত জনপ্রতিনিধিরা আছেন। ইউপি লেভেলে চেয়ারম্যান, কাউন্সিলররা আছেন। অনেক বেসরকারি সংস্থাও আছে। গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত আছে। শহরাঞ্চলে এমন এলাকাভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিক নেই। এটা অবিলম্বে করা দরকার। কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলে সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে এলাকার জনগণ সেখানে সম্পৃক্ত হয়। কারণ, তারা চোখের সামনে দেখে যে এই এই কাজগুলো করে মাত্র ৪/৫ জন লোক, তো আমরাও হাত লাগাই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবী তারাও এগিয়ে আসেন। সাধারণভাবে ডেঙ্গুকে কেন্দ্র করে আমরা যদি এটা করি তাহলে অন্যান্য রোগ নিয়ন্ত্রণেও এটা ভূমিকা রাখবে।
প্রয়োজন হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া। আমদের যে সম্পদ আছে সেটা যদি সমাবিষ্ট করা যায়, মবিলাইজড করা যায়, জনগণকে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলেই সম্ভব।
দেশ রূপান্তর : চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ১০৬ জন, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিছু সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু ইউনিট খুলেছে। রোগীর অনুপাতে এটা কি পর্যাপ্ত বলে মনে করেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত। অন্যান্য হাসপাতালেও স্বল্প সময়ে সেটা করা যাবে। কিন্তু হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ফাঁকা করে ডেঙ্গু রোগীদের ইউনিট করলে বা তাদের ভর্তি করলে অন্য রোগী মানে সেসব ওয়ার্ডে যারা ছিল, তাদের চিকিৎসা ব্যাহত হবে। কিন্তু কমিউনিটি ভিত্তিক যদি আমি রোগী শনাক্ত করি, তাদের যদি আমি আগে থেকেই বলি যে কী করতে হবে তাহলে তো হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হবে না। তারা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই স্বাস্থ্য পরামর্শ পেয়ে যাবে।
দেশ রূপান্তর : এবার রোগী বাড়ার কারণ কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : কারণ হচ্ছে ডেঙ্গুর ভাইরাস নম্বর ৪ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এটার সংক্রমণ বেশি হয়েছে। যারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে তাদের অবস্থাই গুরুতর হচ্ছে। অনেকে তো জানেই না যে সে আগে আক্রান্ত হয়েছিল। হয়তো প্রথমবার তার জ¦রই হয়নি। মৃদু লক্ষণ ছিল, পরে ভালো হয়ে গেছে। এখন যদি সে ডেঙ্গু নম্বর ৪ দিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়, তাহলে তো তার অবস্থা গুরুতর হয়ে যাবে। এজন্যই আমরা যদি কমিউনিটি ভিত্তিক রোগী খুঁজতে থাকি তাহলে যারা আজ গুরুতর রোগী হয়ে হাসপাতালে আসছেন তাদের অনেকেই হাসপাতালে আসার আগেই চিকিৎসা পেয়ে যাবেন। প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে কমিউনিটি লেভেলে যদি মনিটরিংয়ে আনা যায় গুরুতর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে যাবে বলে মনে করি।
দেশ রূপান্তর : আমরা এডিস মশার জন্ম ঠেকাতে পারলাম না, সিটি করপোরেশন মশা মারতে যে ওষুধ ছিটায়, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ব্যর্থতা কতটুকু? প্রযুক্তিগত কোনো সীমাবদ্ধতা কি আছে?
ডা. মুশতাক হোসেন : আমরা সফলভাবে অভিযান চালাতে পারিনি। কীটতত্ত্ববিদ আমাদের দেশে আছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা থেকেও পরামর্শক এসেছিল। তারা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে গেছে। একটা উদাহরণ দিই তারা বলেছিল, আপনি উড়ন্ত মশাকে মারতে ধোঁয়ার মাধ্যমে কীটনাশক দেন, এখন ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট বাড়ির সংখ্যা কত? ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ জায়গায় কি ধোঁয়াটা পৌঁছে? তো ঘরের মধ্যে ধোঁয়া পৌঁছাতে জনবল থাকতে হবে, ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, তাদের সম্পৃক্ত করে ঘরে যেতে হবে। তারপর আপনি একটা এলাকায় কীটনাশক দিলেন, সেখান থেকে মশা চলে গেল। কিন্তু তিনদিন পর তো পাশের এলাকা থেকে আবার মশা চলে আসবে। ফলে, একযোগে আপনাকে পুরো শহরে এটা করতে হবে। তো হিসাব করেন একযোগে এটা করতে কত জনবল লাগবে, কত কীটনাশক লাগবে, সম্পদ লাগবে। একমাত্র জরুরি পরিস্থিতিতেই এটা করা সম্ভব। সরকার এটা জরুরিভিত্তিতে করতে পারে।
কীটনাশকের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, পরিস্থিতি এখন উন্নত হয়েছে। এখন এদিকে সবার নজর আছে, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি এগুলো পরীক্ষা করে, তারপর অনুমতি পায়। তবে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার জনবল এবং সম্পদের ঘাটতি আছে বলে মনে করি।
আমাদের প্রযুক্তির কোনো ঘাটতি নেই। আমরা জানি মশা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা কীভাবে করতে হয়। ঘাটতি হলো কমিউনিটি মবিলাইজেশনের। কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়ে আপনি কাজ সমাধা করবেন। আপনি পত্রিকায়, টিভিতে প্রচার চালাবেন, বক্তৃতা করলেন এটাতে হবে না। আপনাকে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে মাঠে নামতে হবে।
দেশ রূপান্তর : হাবীবুল্লাহ বাহার যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি এই ঢাকা শহরে মশা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, যা প্রবাদ হয়ে আছে। সে সময় পারলে এখন পারছি না কেন?
ডা. মুশতাক হোসেন : হাবীবুল্লাহ বাহারের সময় যেটা হয়েছে সেটা একেবারে কমিউনিটিকে সন্বিবিষ্ট করে হয়েছে। পাড়ার লোকজন নেমেছে, ছাত্র-যুবকরা নেমেছে। যেটা বললেন, পাকিস্তান আমলে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ এভাবেই হয়েছিল। কয়েক বছর আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের নেতৃত্বে খুব সীমিত আকারে হলেও কমিউনিটি মবিলাইজেশনের কাজটা দেখিয়েছেন। সেটা ছিল উদাহরণ, পাইলট হিসেবে। হাবীবুল্লাহ বাহারের সময় সেটাই করা হয়েছে, তারা কমিউনিটিকে কাজে লাগিয়েছে। সঙ্গে কর্মকর্তারা, এক্সপার্টরা ছিলেন। এক্ষেত্রে উদ্যোগটা সরকার থেকে নিতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে পারেন, সেখানে ডেঙ্গু এখনো আমাদের শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ, আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কেন করতে পারব না!
দেশ রূপান্তর : সরকারের বিভিন্ন ভবনে, প্রকল্পে কাজ চলার সময়ও পানি ও ময়লা আবর্জনা জমে থাকে; যা থেকে এডিসের বংশবিস্তার ঘটে। আবার আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসাধীন ২৫ ভাগ ডেঙ্গু রোগী মশারি ব্যবহার করছেন না। করণীয় কী?
ডা. মুশতাক হোসেন : এখানেও সরকারি অফিসে যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের মবিলাইজড করার বিষয়। হাসপাতালের ছাদে গিয়ে দেখেন, সেখানে বৃষ্টির পানি জমে কি না। সরকারি বহুতল অফিসের কথা বাদই দিলাম, থানার পাশে যেসব সিজ করা গাড়ি পড়ে থাকে, সেসব গাড়ির মধ্যে পানি জমে থাকে। তো কমিউনিটি মবিলাইজেশনের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তো পড়বেন। তার বিল্ডিংয়ের ছাদে, কার্নিশে, এসির নিচে পানি জমছে কি না, মশার বিস্তার হচ্ছে কি না সেসব দেখতে হবে। এটা সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে সম্ভব না, তার দায়িত্ব হতে পারে। সব জায়গায় নজরদারি চালাতে হবে। পাড়ায় কোনো সরকারি অফিস থাকলে সেখানে পানি জমে আছে কি না সেটা স্থানীয়রাও খোঁজ নিতে পারেন। ছাত্রছাত্রীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
আর মশারি তো সবার ব্যবহার করতে হবে। সুস্থ মানুষকেও দিতে হবে, ডেঙ্গু রোগীকেও দিতে হবে। এলাকার জনগণকে সম্পৃক্ত করা গেলে কার মশারি নেই, কাকে দিতে হবে তা বোঝা সহজ হবে। এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মশারি বিতরণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর : জনগণের সচেতনতার ঘাটতি আছে বলে মনে করেন কি?
ডা. মুশতাক হোসেন : সচেতনতা শব্দটি নিয়ে আপত্তি আছে। মবিলাইজড করা। জনগণকে সমাবিষ্ট করে জনগণকে কাজ দেওয়া, তাকে সম্পৃক্ত করে আগাতে হবে। সচেতনতা একটা বায়বীয় শব্দ। জনগণ যথেষ্ট সচেতন, তাদের কাছে টিভি আছে, পত্রিকা পড়ে, তারা জানে। আপনার তাদের সঙ্গে নিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করতে হবে, কেবল টিভিতে বললে হবে না। তাকে গিয়ে বলতে হবে যে চলেন আমরা কাজে হাত লাগাই বা চলেন আপনার বাড়ির ছাদটা দেখে আসি।
১লা কার্তিক ১২৯৭। বাউল সাধক ফকির লালন শাহ'র তিরোধান দিবস। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে ১৩২তম তিরোধান দিবস পালনে আয়োজিত তিনদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম দিন সোমবার (১৭ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে আখড়াবাড়ি সংলগ্ন কালীগঙ্গা নদীর মাঠে।
তবে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক আয়োজনের বাইরে প্রিয় এই মহামানবের ওফাত দিবসকে ঘিরে প্রতি বছরই ভক্ত আশেকান অনুসারীরা ছুটে আসেন সাঁইজির এই তীর্থধামে। পরম গুরুভক্তির আস্বাদনে গানের বানীতে তৃষ্ণার্ত ও অস্থির আত্মার শান্তি পাওয়ার টানে ছুটে এসেছেন তারা। প্রতিক্ষীত এই দিনটিতে সাইজির বাণীর পরশ পাওয়ার ব্যাকুল বাসনায় দুই একদিন আগেই ছেউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন তারা। নিজেদের ঘরানায় ছোট ছোট মজমা করে আত্মস্থ বাণীগুলি একে অন্যের সাথে বিনিময় করে থাকেন গানের মাধ্যমে। ‘হাওয়া দমে দেখনা রে তার আসল ব্যানা, কে বানাইলো এমন রঙমহল খানা’ দোতারা হাতে লালন শাহের মাজার মিলনায়তনে বসে আসর জমিয়েছেন আগত লালন ভক্ত বাউল অনুসারীরা। শতাধিক উৎসুক দর্শক শ্রোতা কেউবা বসে কেউবা দাঁড়িয়ে শুনছেন এসব বাউল গান।
এসময় সেখানে দেখা হয় লালন অনুসারী ফকির মহরম শাহয়ের সাথে। দেশ রূপান্তরকে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের কুষ্টিয়া প্রতিনিধি হাসান আলী।
হাসান আলী: ‘হাওয়া দমে দেখনা রে তার আসল ব্যানা’ সাঁইজির এই বাণীতে কি বলতে চেয়েছেন?
ফকির মহরম শাহ: মানুষ যে বেঁচে আছে তার প্রমাণ হলো- প্রতিক্ষনে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেন নিতে পারছে এটাই তার প্রাণের অস্তিত্ত্ব। তাহলে এই যে বেঁচে আছে মানুষ কিভাবে? কোন কারিগরি কায়দায় এই দেহঘরি তৈরি হয়েছে? কোন যন্ত্রের সাহায্যে এই ঘড়ি চলছে, কিভাবে চলছে? কতক্ষণ চলবে? এর কারিগরই বা কে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে, জানতে হবে।
হাসান আলী: সাঁইজির কালাম বা বাণীগুলি বোঝার সহজ উপায় কী?
ফকির মহরম শাহ: সাঁইজি বলেছেন, সহজ মানুষ ভইজে দ্যাখ নারে মন দিব্যজ্ঞানে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, দিন রাত, জন্ম-মৃত্যু যেমন শ্বাস্বত: দিবালোকের মতো চিরসত্য। তেমনি মানুষ জন্মগত ভাবেই তার মধ্যে দিব্যজ্ঞান নিয়েই পৃথিবীতে আসে। কিন্তু জগৎ সংসারের নানা জটিলতার মাঝে ডুবে যাওয়ার কারণে তার দিব্যজ্ঞানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এইডা যদি সে বুঝতে পারে যে, ওরে বাবা তার মাঝেও তো আলোর দ্যুতি রয়েছে। তবে কেন অন্ধকারে ঘুইরে মরে? সেই জন্যই বেশী বেশী দরকার সাধুসঙ্গ। সাধু হলেন তিনি যিনি দিব্যজ্ঞানের ভাণ্ডার। ওই যে বলে না, সৎসঙ্গে স্বর্গবাস অসৎসঙ্গে সর্বনাশ
হাসান আলী: সাঁইজির বাণীই কীভাবে আত্মার শান্তি দিতে পারে?
ফকির মহরম শাহ: দেখেন, ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন খাবার খাওয়া তাগিদ বোঝে? ঠিক তেমনি অশান্ত আত্মার যন্ত্রণা যদি কাউকে তাইড়ি বেড়াই তালি সেই জগৎ সংসারের মায়া ছাইরি শান্তির খোঁজে দিক-বিদ্বিক ছুটে বেড়াবে। যে কোথায় গেলে পাবো তারে? তাইতো সাঁইজি বলেছেন, ‘লালন মরল জল পিপাসায় থাকতে নদী মেঘনা, হাতের কাছে ভরা কলস তবু তৃষ্ণা মেটে না’। এই যে ক্ষুধার যন্ত্রণা যার আছে সেই বুঝবে সাঁইজির কালাম হৃদয়ে ধারণ ও তা বৈষয়িক জীবনে পালনের মধ্যদিয়ে কিভাবে আত্মার শান্তি খুঁজে পায়।
হাসান আলী: আরও বেশি মানুষের মাঝে লালনের বাণী কিভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়?
ফকির মহরম শাহ: দেখেন এই ভেগ বা লেবাসধারী নয়; শুধু মুখে বলবেন সাধুর বাণী কিন্তু হৃদয় ভরা অন্ধকার এসব লোকদের দিয়ে তো এসব হবে না। প্রকৃতঅর্থে এই কালাম ধারণ করে নিজের উপলব্ধির উদয় ঘটাতে হবে। তারপর না সে ভক্ত আশেকানদের মাধ্যমে বেশি বেশি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। যতবেশি মানুষ সাঁইজির কালাম মনে প্রাণে ধারণ করতে পারবে ততবেশি মানব সমাজের অস্থিরতার পথ রুদ্ধ হবে। এই যে মানুষে মানুষে, ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, গোত্র ভেদে যে হানাহানি এখান থেকে গুরু বাণীর দীক্ষা হতে পারে মুক্তির নিশানা। আপনেরা দেখতেই পান অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারী শিক্ষিতজনদের মধ্যেও এখন সাঁইজির দর্শন আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। তিনি তো উনাদের মতো এতো বড় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। তবুও কীভাবে তিনি দিন দুনিয়ার দর্শন জগতে ঢুকতে পেরেছিলেন?
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কথা জানিয়ে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ স্থগিত ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এ ঘটনায় জাতীয় নির্বাচনের আগে ফের আলোচনায় আস্থা সংকটে থাকা নির্বাচন কমিশন। এসব নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সহ-সম্পাদক সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : সাম্প্রতিক অতীতে অনিয়ম ও সংঘাতে দুই/একটি ভোট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাতিল হতে দেখেছি। কিন্তু এবার গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার তাৎপর্য কী?
আলী ইমাম মজুমদার : সব কিছুরই একটি প্রথম থাকে তো। আগে হয়নি, আগে তারা করেনি কিন্তু কমিশন এবার করেছে আমি এটার প্রশংসা করি যে তারা এটা পেরেছে। আশা করব যে ভবিষ্যতে তাদের এ ধরনের দৃঢ়তা অব্যাহত থাকবে।
দেশ রূপান্তর : ভোটের সময় গোপন কক্ষে আগে থেকে লোক থাকাসহ অনুপ্রবেশের অভিযোগ পাওয়া গেছে আগেও। কিন্তু এবারই দেখলাম যে এ ধরনের ঘটনা সিসি ক্যামেরায় চাক্ষুষ করে ইসি ভোটগ্রহণ বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত নিল। সিসি ক্যামেরা না থাকলে কী হতো তা আমরা আগে দেখেছি। এ ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনাসহ ইসির পরিকল্পনা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতার কোনো ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন কি?
আলী ইমাম মজুমদার : এখানে দক্ষতা না আমি কমিটমেন্টের ঘাটতি দেখছি। এখানে প্রথম কথা হলো নির্বাচন কমিশন বলে আসছিল যে তাদের কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হলে নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট হবে না। এবার কিন্তু যে রিটার্নিং অফিসার এবং দুজন অ্যাসিসটেন্ট রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারা সবাই নির্বাচন কমিশনের লোক। ভোটকেন্দ্রে যে প্রিসাইডিং অফিসার এবং অ্যাসিসটেন্ট প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার তারা রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশে কাজ করেন। এখন অন্যদের যে আমরা দোষারোপ করব কোনো ভোটকেন্দ্রে প্রথম দায়িত্ব প্রিসাইডিং অফিসারের, কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না সেটা প্রথমত তিনি দেখবেন। তিনি অনিয়মে বাধা দিতে গেলে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলে কেন্দ্রে মোতায়েন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ডাকবেন, তাতেও না হলে রিজার্ভ বা স্ট্রাইকিং ফোর্স ডাকবেন। কিন্তু কোথাও তারা এ ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন সেটা শুনিনি। সুতরাং, এখানে সিস্টেমটাই কাজ করেনি।
দেশ রূপান্তর : প্রধান নির্বাচন কমিশনার নির্বাচন বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পরদিন সাংবাদিকদের বলেছেন, কোনো কোনো প্রিসাইডিং অফিসার ভোটগ্রহণ বন্ধের নির্দেশ মানছিলেন না। এই বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আলী ইমাম মজুমদার : আসলে বহুদিন পর ব্যাপারটা হয়েছে তো, এতদিন তো সব এক সুরে চলছিল। কেন্দ্র থেকে শুরু করে ইসি পর্যন্ত, সব এক সুরে চলছিল। এবারই একটু ভিন্ন সুর এলো। ইসির হাতে তাদের কথা শোনানোর জন্য আইনানুগ যে ক্ষমতা আছে, সে অনুযায়ী তারা পদক্ষেপ নিতে পারে।
দেশ রূপান্তর : কিছুদিন আগে জেলা পরিষদ নির্বাচন উপলক্ষে দেশের ৬১ জেলার ডিসি ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে সভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বাগ্বিত-াকে কীভাবে দেখছেন?
আলী ইমাম মজুমদার : একটা সভার মধ্যে সেখানে সিনিয়র-জুনিয়রের ব্যাপারটা বড় করে দেখা হচ্ছে, আমি সেভাবে দেখি না। এখানে যারা মাঠ পর্যায় থেকে আসছেন তারা তাদের সমস্যাদি এবং চাহিদা কমিশনের কাছে তুলে ধরতে পারেন। সেটা অবশ্যই প্রয়োজন এবং শৃঙ্খলার সঙ্গে হতে হবে। কিন্তু যেটুকু পত্র-পত্রিকায় এসেছে, আমি যতটুকু দেখেছি তাতে আমি মর্মাহত হয়েছি। সেখানে সৌজন্যেরও ঘাটতি হয়েছে, শৃঙ্খলারও ঘাটতি রয়েছে। তবে আমি বিস্মত হইনি। বিস্মিত হইনি এ কারণে যে, এইসব অফিসারদেরই অথবা তাদের সহকর্মীদেরই এতদিন ব্যবহার করা হয়েছে ভোটকেন্দ্রে সিল মারার জন্য। তারা এগুলোই করে আসছে এতদিন। প্রশাসনিক শৃঙ্খলা যেটা বিশেষ করে নির্বাচনভুক্ত, সেটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব... আমরা যখন রিটার্নিং অফিসার ছিলাম, আমরা যখন নির্বাচন করতাম, আমরা নির্বাচন কমিশন নিয়ে আতঙ্কে থাকতাম। তারা আমার কোন ভুল ধরবে আর আমার চাকরি চলে যাবে কিনা, প্রমোশন আটকে যাবে কিনা টেনশনে থাকতাম। কিন্তু এখন কোনো সিরিয়াসনেস নেই। আগেরগুলো বাদ দিলেও এর আগের দুই নির্বাচনে কমিশনের যে আচরণ, ভোট দেওয়ার যে প্রক্রিয়া বা মধ্যরাতে ভোট দেওয়ার কথা যে বলা হয় এগুলো কিন্তু ইসি আগে না জানলেও অন্তত পরদিন জানতে পেরেছে, কিন্তু গাইবান্ধায় যেভাবে নির্বাচন বাতিল করা হলো সেভাবে পরদিন তো ওই নির্বাচনগুলোও বাতিল করা যেতে পারত। তাহলে সবাই ইসিকে সিরিয়াসলি নিত, কিন্তু ইসিকে কেউ সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। কারণ তাদের আচরণই বলে যে ইসিকে সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতিটা গত ১০/১২ বছরে ধীরে ধীরে এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
দেশ রূপান্তর : ওই সভায় পুলিশ কর্মকর্তারাও তো এমপিদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা সামলাতে না পারার কথা বলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
আলী ইমাম মজুমদার : এ ক্ষেত্রে তো ইলেকশন কমিশনকে অগ্রসর হতে হবে। স্থানীয় নির্বাচনে এমপিদের আচরণবিধি ভঙ্গের একাধিক নিউজ আসছে। এমপিদের নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় ইসির আইন আনুযায়ী শাস্তি প্রদানের পদক্ষেপ নিতে হবে। কুমিল্লার ঘটনায় বোধহয় এমপিকে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারপর? এখন রোগ হিসেবে তো ওষুধ দিতে হবে। ছোট জ¦রটর হলে প্যারাসিটামল খাবেন কিন্তু ক্যানসারে তো আর প্যারাসিটামলে হবে না। এখানে ব্যাধি অনেক বড়, সে অনুযায়ী ওষুধ দিতে হবে।
দেশ রূপান্তর : নতুন ইসির অধীনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটছে। অথচ কমিশন যথেষ্ট কঠোর হতে পারেনি। নির্বাচনী আইনেও অনিয়ম ও আচরণবিধি ভঙ্গের ঘটনায় ইসির শান্তি প্রদানের বিষয়টা স্পষ্ট না। করণীয় কী?
আলী ইমাম মজুমদার : নির্বাচনী আচরণবিধি আইনের ভেতরে এটা থাকার কথা। যেহেতু আচরণবিধি আছে সেহেতু আচরণবিধি ভঙ্গের শাস্তির বিধানও থাকার কথা। এই মুহূর্তে নির্বাচনী আচরণবিধি আইন না দেখে বলতে পারছি না। যদি না থাকে তাহলে অসম্পূর্ণ আইন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অগ্রসর হওয়া ঠিক না। সেক্ষেত্রে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা তাদের আছে। আইনে কোনো অসম্পূর্ণতা থাকলে সেটা পূরণ করে নিয়েই ইসিকে আগাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কি দেখতে পাচ্ছেন?
আলী ইমাম মজুমদার : সংবাদমাধ্যমে যতটুকু দেখি তাতে মনে হয় আমাদের বিভিন্ন সহযোগী দেশ বিশেষ করে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলো এ ব্যাপারে খুব কনসার্ন মনে হয়েছে। এদেশে যাতে মানবাধিকার যথাযথভাবে রক্ষিত হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে আন্তর্জাতিক মানের হয়, এগুলো নিয়ে তারা পরিষ্কারভাবে সচেতন। বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। তাদের সঙ্গে আমরা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত, তেমনি তাদের সঙ্গে আমাদের অনেক বাণিজ্যিক সম্পর্কও আছে। বাণিজ্যিক সম্পর্কটা অনেকাংশেই একমুখী। আমরা বিক্রেতা, তারা ক্রেতা। তাছাড়া তারা তো খারাপ কিছু বলছে না। ফলে নির্বাচন নিয়ে তাদের এসব কথাবার্তাকে ইগনোর না করার মতো বাস্তবতাও রয়েছে।
দেশ রূপান্তর : বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের কাছে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঔপনিবেশিক মানসিকতা বলে মন্তব্য করেছেন। আপনার মত কী?
আলী ইমাম মজুমদার : তাদের দল যখন বিরোধী দলে ছিল তখন তারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমনওয়েলথ থেকে দুজন প্রতিনিধি নিয়ে এসেছিলেন। তারাও করেছেন আর এখন যারা বিরোধী দলে আছেন তারা করছেন। কেউ তো বাকি রাখেননি বিদেশিদের কাছে যেতে। আজকের পৃথিবীতে কোনো ব্যাপারই বিচ্ছিন্ন না। সবাই একে অপরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে আমাদের কোনো ব্যাপারে তারা ন্যায়সংগত পরামর্শ দিলে, সেটা শোনা যাবে না আবার পরামর্শ দিলেই তার ষোলো আনাই মেনে নেব এমন কোনো কথা নেই। যেটা ন্যায্য সেটা শুনব না, এটা তো ঠিক না। তাদের সঙ্গে কথা বলব না, এটাও ঠিক না।
দেশ রূপান্তর : গাইবান্ধার ঘটনার শিক্ষা নিয়ে ইসি কি এবার আস্থার সংকট কাটাতে পারবে বলে মনে করেন?
আলী ইমাম মজুমদার : এটা তো সবে মাত্র শুরু। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে কমিশন পর্যবেক্ষণ করেছে একটি আসনে নির্বাচনের কয়েকটি কেন্দ্র। এখন জাতীয় নির্বাচন হবে একই দিনে ৩০০ আসনে। এতগুলো আসনের সবগুলো ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা বসানো সম্ভব কি না আর সেগুলো যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব কি না এটা কমিশনের চিন্তা করতে হবে। আমার বিবেচনায় এটা সম্ভব না। এছাড়া, গাইবান্ধার নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছিল ৩ হাজার। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে একদিনেই যেহেতু ভোট হয়, সেহেতু গোটা দেশের সবগুলো আসনে ৫০০ করে জনবল নিয়োগ দেওয়াও কঠিন। সুতরাং আমি যেটা মনে করি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমরা যখন নির্বাচন করেছি তখন এইভাবে জনবলেরও দরকার হয়নি, ঢাকা থেকে সিসিটিভি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণেরও দরকার হয়নি। কিন্তু সেগুলো কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : ইসির প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
আলী ইমাম মজুমদার : তারা প্রথমত আস্থা অর্জনের চেষ্টা করুক। শুধু ইভিএমে যে সুষ্ঠুভাবে ভোট হয় না, এটা তো গাইবান্ধায় প্রমাণিত; পেছনের মানুষগুলোই গুরুত্বপূর্ণ সিইসিও বারবার এ-কথাটা বলেছেন। সেজন্য ইভিএম মেশিনের প্রজেক্টে ৮/১০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে, এর যৌক্তিকতা কী! এরপর, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অমুক কথা শুনল না, তমুক দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করল না এগুলো সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে, যদি নির্বাচনকালীন এমন একটা সরকার হয় যে সরকার নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না, তাহলে কিন্তু সবার নির্বাচন কমিশনের কথা শুনতে হবে।
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
‘বস্তি এলাকার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। পানি সরবরাহ ও নর্দমা লাইন প্রায়ই এক হয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে দূষিত ও নোংরা পানি পান করছেন তারা।’ এভাবে বলছিলেন ঢাকার বস্তির জীবন মান নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের উন্নয়ন কর্মী বাছেরা আক্তার।
শুধু বস্তি এলাকা নয়, দেশের সব এলাকার সুপেয় পানি সরবরাহের চিত্র এমনই। রাজধানী ঢাকায় সরবরাহ করা পানিই না ফুটিয়ে পান করা যায় না। চট্টগ্রাম শহরের পানি লবণাক্ত। রাজশাহীর পানিতে ময়লা ও দুর্গন্ধ। খুলনায় সরবরাহ করা পানিও না ফুটিয়ে পান করা যায় না। রয়েছে লবণাক্ততাও। গভীর নলকূপের পানিও নিরাপদ নয়, আর্সেনিক ও লবণাক্ততার কারণে ব্যবহার করাও দুষ্কর। পাহাড়ে সুপেয় পানির উৎস সীমিত। পাহাড়ি ছড়া শুকিয়ে যাচ্ছে। উজানে বাঁধ দেওয়ার কারণে নদন্ডনদীর পানিও কমছে। সুপেয় পানি ও সেচের জন্য অত্যধিক মাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতার কারণে পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে দিন দিন।
এ পরিস্থিতিতে আজ ২২ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য : ‘আসুন নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংকট সমাধানে পরিবর্তন ত্বরান্বিত করি।’
সরকারের পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় মিষ্টি পানিসমৃদ্ধ বাংলাদেশেও সুপেয় পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও নিরাপদ পানি মিলছে না। এ ব্যর্থতা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনও হুমকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. তানভীর আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহকৃত পানিকে সুপেয় পানি বলা যায়। তবে সেখানে কোনো ময়লা ঢুকে পড়লে সেই পানিকে আর সুপেয় থাকে না। সুপেয় পানি না ফুটিয়েই পান করা যাবে।’
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ওয়াসার পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাইরে ময়লা ঢুকে পড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা ঘটলে সেই পানিকে নিরাপদ বলা যাবে না। শুধু ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের পানির মান ভালো হলে চলবে না, বাসা পর্যন্ত ভালো পানি পৌঁছে দিতে হবে। কেননা সরবরাহ লাইনের পানি নিরাপদ রাখাও সংস্থার দায়িত্ব।’
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালে এসডিজি অর্জন এবং ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছে। এ জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছি। আশা করি সবাই মিলে কাজ করে পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দূর করে আমরা নির্ধারণ সময়ে লক্ষ্যপূরণ করতে পারব।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ৫৯ ভাগ অর্থাৎ ৯ কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার ২২০ জন মানুষ সুপেয় পানি সুবিধার আওতায় এসেছে। আর সুপেয় পানি সুবিধার বাইরে রয়েছে ৪১ ভাগ অর্থাৎ ৬ কোটি ৭৭ লাখ ১৪ হাজার ৭৮০ জন মানুষ। এখনো দেশের ১০ ভাগ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে বলা হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুপেয় পানি প্রাপ্যতার বিবেচনায় ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চর এলাকা, বন্যাপ্রবণ এলাকা, উপকূলীয় এলাকা, হাওর এলাকা, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা। দেশের এই ছয় শ্রেণির এলাকা বিস্তৃত রয়েছে ১০০টি উপজেলায়। দেশের ১৫৯ সিটি ও পৌরসভায় সরবরাহ করা পানির মানও একই। ওইসব এলাকায় ১৬৮টি পানি শোধনাগার, ১ হাজার ৫০০টি গভীর নলকূপে ১৫ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সরকার চালু রেখেছে। গ্রাম পর্যায়ের ২০ লাখ টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ হওয়ার কথা ছিল। তবে আর্সেনিক ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রন সে পানিও জনজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
২০১৬ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বিশে^র সবচেয়ে বড় ‘গণবিষ’-এর উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের আর্সেনিক পরিস্থিতিকে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বছরে আর্সেনিকে ৪৩ হাজার মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর ২০০৩ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়। আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী শনাক্তে ২০১২ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। তখন ৬৫ হাজার ৯১০ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে ৪২টি জেলার হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ তথ্য সংগ্রহ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর এসব হাসপাতালে ১৮ হাজার ৬৬২ আর্সেনিক আক্রান্ত রোগী সেবা গ্রহণ করে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের সরকারিভাবে স্থাপিত গভীর ও অগভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। সেই হিসাবে জনসংখ্যার বিবেচনায় সরকার ৮৩ জনে একটি পানির উৎস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। সমগ্র জনসংখ্যার বিবেচনায় বর্তমান পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ১১ ভাগ। আর শহর এলাকার জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৮ ভাগ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে সরকারকে সুপেয় পানি সরবরাহে শতভাগ সাফল্য অর্জন করতে হবে। সেটা করতে হলে প্রতি বছর ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। বর্তমান অগ্রগতি প্রায় এক ভাগ। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারণে সামনের দিনগুলোতে পানি সরবরাহ খাতের অর্জন আরও কম হতে পারে। এ জন্য লক্ষ্য পূরণে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে চারগুণ তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা যায়, দেশে বেসরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় দেড় কোটি। আর সরকারি টিউবওয়েল রয়েছে প্রায় ২০ লাখ। এ দুটো ধরে হিসাব করতে দাঁড়ায় প্রতি ১০ জনে একটি পানির উৎস রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে খুলনার উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ, কয়রা, বাগেরহাটের মোংলা, শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনি এলাকায় পানযোগ্য পানি খুবই দুষ্পাপ্য। এসব এলাকার বেশিরভাগ উপজেলায় গভীর নলকূপ কার্যকর নয়। সরকার পানি সরবরাহ সেবার আওতায় আনতে পেরেছে ৯৮ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষকে। এখনো ১ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ পানি সুবিধার আওতার বাইরে রয়েছে।
নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ায় স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানির স্তর নামছে, সে হারে পানির স্তর পূরণ হচ্ছে না। স্বাভাবিক অবস্থা ৬ থেকে ৭ ফুট নিচেই ভূগর্ভস্থ উৎসে পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু সে অবস্থা এখন আর নেই। ঢাকায় পানি পেতে ২৫৫ থেকে ২৬০ মিটার নিচে নামতে হচ্ছে। খুলনায় ভূগর্ভস্থ পানি নেমে গেছে ২৫-৩০ ফুট। রাজশাহী ও বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তর ১২০ থেকে ১৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। খরার মৌসুমে এ অবস্থা থাকে। বর্ষার মৌসুমে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়।
অন্যদিকে দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার নেমে যায়। আর ২৫ ভাগ এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৫-১০ মিটার নেমে যায়। বর্ষার মৌসুমে এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে। তবে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ও দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে আসে না। দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। গ্রাম এলাকায় এ উৎস থেকে ৯৯ শতাংশ ও শহর এলাকায় ৮০ শতাংশ পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা, মধুমতী, আড়িয়াল খাঁ, গড়াই নদীর পানি কমে যাওয়ায় এসব এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পুনঃভরণ হয় না।
ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির উৎসের অভাবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চলে সারা বছর সুপেয় পানির সংকট থাকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যরকম সংকট। খরার মৌসুমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্ষার মৌসুমে দেশের অন্যান্য এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির শূন্য স্তরের ২৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয়। ওইসব এলাকায় ১৬০ ফুটের আগে পানির দেখা মিলছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভূগর্ভস্থ পানি বিভাগের পরিচালক এবং পানি বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ার জাহিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারকে বর্ষায় কৃত্রিমভাবে মাটির নিচে পানি প্রবেশ করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যতে দেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
উপকূলে লবণাক্ততা সমস্যা : ভূতত্ত্ববিদদের মতে, উপকূলীয় এলাকার পানিতে একবার লবণাক্ত পানি প্রবেশ করলে ওখানকার ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নদীতে পানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই অববাহিকা অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচের দিকে নেমে যাবে। একই সঙ্গে সাগরের দিক থেকে লবণ পানি প্রবেশের হার বাড়বে।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরের উপকূলীয় এলকাগুলোতে আমরা গভীর নলকূপ বসাতে পারি না। এই এলাকায় নলকূপে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে।’
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা বলছে ভূতত্ত্ববিদরা। কিন্তু ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৫৬টি যৌথ নদী থেকে ইতিমধ্যে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে এবং শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়েও যাচ্ছে। নদীগুলোর গভীরতা কমে গিয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সারা নওরিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পানির স্তর নিচে। এখন এই হার আরও বেড়েছে।’
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
২০১০ সালে ভোলার চর কুকরিমুকরি বনের ১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চেয়ে লিখেছিলাম। ‘১৫ হাজার গাছের প্রাণভিক্ষা চাই’ শিরোনামে দৈনিকে প্রকাশিত লেখাটি নিয়ে আলাপ ওঠেছিল তখন। চর কুকরিমুকরি বনের উত্তরাংশ বাবুগঞ্জ থেকে পাতিলার বুড়াগৌরাঙ্গ নদ পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২০ ফুট প্রশস্ত পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য কুকরিমুকরি ইউনিয়ন পরিষদ বন বিভাগে আবেদন করে। ১৬ মে ২০১০ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ন্যূনতম গাছ কাটার শর্তে সড়ক নির্মাণের অনুমতি দেয়। সড়কপথে দ্বীপচরে যাতায়াতের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বাঁচাতে প্রাণদন্ড দেয়া হয়েছিল ১৫ হাজার গাছের। কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, পশুরের মতো অবিস্মরণীয় সব ম্যানগ্রোভ বৃক্ষপ্রজাতি।
চর কুকরিমুকরির পর এবার ভোলার ঢালচরের উপকূল বন বিপদে পড়েছে। উপকূল বন নিশ্চিহ্ন করে ঘরবাড়ি, বাণিজ্যিক মাছের ঘের, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ ছাড়া বনের গাছ কেটে ইটভাটায় বিক্রি হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশ, ঢালচরের প্রায় একশ একর বনভূমি উজাড় হয়েছে এভাবেই। মূলত বসতি স্থাপন, বেদখল, মাছের ঘের ও মাছ-ঘাট, এবং ইটভাটার কারণে। ঢালচর ইউনিয়নের চর সত্যেন মৌজার মাঝের চরে প্রায় ৭১ একর অরণ্যভূমি উজাড় করা হয়েছে। পুরো অঞ্চলে নিথর হয়ে পড়ে আছে বহু নিহত গাছের গুঁড়ি। চারধারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই রক্তাক্ত লাশ খ-গুলোই জানান দিচ্ছে কী নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক উপকূল বন। গণমাধ্যম জানায়, দ্রুত গাছ কাটার জন্য এখানে ভেকু মেশিন (যন্ত্রচালিত এক্সকাভেটর) ব্যবহার করা হয়। বন নিধনে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ জড়িত থাকলেও গণমাধ্যমের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
বন কেটে দখল নিয়ে যারা বসত গড়েছেন তাদের সবার ভাষ্য হলো, নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে এই বিরান হওয়া বনভূমিতে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাকৃতিকভাবে তো এই বন বিরান হয়নি, নিষ্ঠুরভাবে একে বিরান করা হয়েছে। ঢালচরসহ ভোলা ও উপকূল অঞ্চলে মূলত প্রাকৃতিকভাবেই বিশেষ ম্যানগ্রোভ বন গড়ে ওঠে। ঢালচর সংরক্ষিত বনের আওতায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর এলাকা আছে। স্থানীয় বন বিভাগের ভাষ্য, ১৯৭৬ সালে ঢালচরের মাঝেরচরে বৃক্ষরোপণ করা হয় এবং নদীভাঙনকবলিত মানুষের আশ্রয়ের নামে ইতিমধ্যে ৭৬ একর বন উজাড় হয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে বন উজাড়ের ঘটনায় বন বিভাগ ৩৫টি মামলা করেও বন বিনাশ রোধ করতে পারেনি। জোয়ার-ভাটা ও ভূমি ভাঙা-গড়ার ভেতর দিয়ে চরফ্যাশনের বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে।
ঢালচর, পূর্বেরচর, ভাসানচর, বয়ারচর, চর আলিম, আন্ডারচর, কলাগাছিয়াচর ও শিবচরের মতো ভূখ-গুলো প্রায় ৮ হাজার একর ভূমি নিয়ে নতুনভাবে জেগেছে। এসব ভূমিতেও জোয়ার-ভাটায় ভেসে আসা বীজ দিনে দিনে নতুন বন-প্রতিবেশ গড়ে তুলবে। ঢালচরসহ পুরো উপকূল অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগ-প্রহরী এই উপকূল বনগুলো। নিয়ত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, তীব্র তাপপ্রবাহ সব আপদ নিজের জীবন দিয়ে সামলিয়ে উপকূলকে নিরাপদ রাখে বনের বৃক্ষকুল। আর উপকূল-প্রহরী এই গাছগুলোকে খুন করে আমরা উপকূলকে বারবার বিপদের দিকে ঠেলছি। বৃক্ষপ্রাচীর ও বন ছাড়া আপদন্ডবিপদ সামাল দেয়া সম্ভব নয়।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়, বিধ্বস্ত মনপুরা কিংবা সিডরের অভিজ্ঞতা কী বলে? সুন্দরবনসহ উপকূল বনভূমি ও বৃক্ষকুল প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি ও মাত্রা নিজের জীবন দিয়ে দুর্বল করেছে। উপকূলে বন না থাকলে সব আপদন্ডবিপদে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি অসহনীয় হয়ে উঠত। কিন্তু আমরা আমাদের উপকূলের বৃক্ষকুল ও বনের কাছে একবিন্দু কৃতজ্ঞতাও জারি রাখিনি। বরং প্রতিদিন উপকূল বনকে ল-ভ- রক্তাক্ত করছি। ঢালচরের উপকূল বন সামগ্রিকভাবে সুরক্ষা করতে হবে। বৃক্ষ ও বন নিধনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। ঢালচরসহ উপকূল বনের সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং করণীয় বিষয়ে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার ও তৎপরতা স্পষ্ট করতে হবে।
আয়তনে ছোট্ট হলেও প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে বাংলাদেশ অনন্য। সমতল, অববাহিকা, বরেন্দ্র, গড়, টিলা, পাহাড়, চর এলাকার পাশাপাশি দেশের নোয়াখালী, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সুন্দরবন অঞ্চলের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো দেশকে দিয়েছে বিশেষ আমেজ ও গতিময়তা। নোয়াখালীর নিঝুপ দ্বীপ, সুখচর, হাতিয়া, তমরুদ্দিন, নলচিরা, চান্দনন্দি, হারনি, চর কিং, বয়রারচর, চরপিয়া; ভোলার মনপুরা, চর মনিকা, চর সাকুচিয়া, চরনিজাম, ঢালচর, চর কুকরিমুকরি, গাজীপুর, ভেদরিয়া, সোনাচর, হাজিরহাট, চর নিউটন, চর পাতিলা, চর লক্ষ্মী, চর আইচা, নীলকমল, মদনপুর, মেদুয়া; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ; কক্সবাজারের মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন বা নারিকেল জিঞ্জিরা, সোনাদিয়া, শাহপরীর দ্বীপ এবং সুন্দরবন অঞ্চলের আন্ডারচর, ডিমেরচর, দিয়ারচর, কালীরচর বা দুবলারচর দেশের গুরুত্বপূর্ণ উপকূল চর ও দ্বীপাঞ্চল। নদীপ্রবাহের বিস্তীর্ণ পলিমাটিতে গড়ে ওঠা এসব চর-দ্বীপ। মহেশখালী শৈল দ্বীপ আর সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপ। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নানা বিন্যাস গড়ে উঠেছে এসব অঞ্চলে। এসব দ্বীপে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে নয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থান। মাছ, পাখি, সরীসৃপ, কাছিমসহ জলজ ও স্থলজ প্রাণবৈচিত্র্যের এক অবিস্মরণীয় আখ্যান তৈরি হয়েছে দেশের দ্বীপগুলোতে।
জলোচ্ছ্বাস ও ঝড় থেকে দেশের ভূগোল বুক আগলে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে এসব দ্বীপাঞ্চল। শত-সহস্র মাছের জোগান দিয়ে তরতাজা রাখছে রাষ্ট্রের অর্থনীতি। কিন্তু নিদারুণভাবে বাংলাদেশের উপকূল-চর ও দ্বীপগুলো এক ‘অচ্ছুত’ এবং বঞ্চিত ভূগোল। এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিরাপত্তা কোনো বিবেচনায় রাখা হয় না। এসব উপকূল চর ও দ্বীপগুলোর পরিবেশবিনাশ কিংবা সামাজিক সংঘাতের খবর খুব একটা প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েও আসে না। দেখা গেছে, একেবারেই স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ, বাণিজ্য ও বিনাশ করে। এমনকি বৃহৎ অবকাঠামো, খনন, বাণিজ্যিক পর্যটন, করপোরেট মনস্তত্ত্বও উপকূল বনের প্রাকৃতিক বিকাশের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিশেষ করে উপকূল চরের বন বাস্তুতন্ত্র এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত। বসতি স্থাপন কিংবা বাসস্থান সম্প্রসারণের নামে সবচেয়ে প্রথম কোপ পড়ে উপকূল বনে। এভাবেই আমরা হারিয়েছি চর কুকরিমুকরি কিংবা ঢালচরের বিশাল অংশ।
ঢেউয়ে ভেসে আসা কেউরগুলা, ছুনে গুলা, শিউলি গুলা, গাকগুলা, কেয়াড়াগুলা, সুগুলা, উন্দুরাগুলা, চরিকগুলা, গুরুপ ফলগুলো মাছের জালে উঠে বা হাতেও ধরা যায়। নানান জাতের ইলিশ, পাতা মাছ, ব্যাঙ মাছ, আটগোড়া মাছ উপকূল চর-দ্বীপের অনন্য প্রাণসত্তা। উপকূলীয় অনেক চর-দ্বীপে বিকশিত হওয়া ম্যানগ্রোভ বাস্তুসংস্থানে শেয়াল, কাঠবিড়ালি, গুইসাপের পাশাপাশি হরিণেরও বংশবিস্তার ঘটছে। বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিতে থাকা চামচঠুঁটো বাটান পাখির বিচরণস্থল ঢালচরসহ আশপাশের উপকূল চরভূমি। যদি ঢালচরের বন সুরক্ষিত না থাকে তবে বহু বন্যপ্রাণ অচিরেই তাদের বিচরণ অঞ্চল ও খাদ্য উৎস হারাবে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য হবে।
সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করবে। সংবিধানের অঙ্গীকার অনুযায়ী ঢালচরের বনভূমি ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নদীভাঙা মানুষের আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করা জরুরি, কিন্তু সেটি প্রাকৃতিক বন উজাড় করে নয়। ঢালচরের বন বিষয়ে রাষ্ট্রকে অঙ্গীকার করতে হবে। বন বিভাগ, স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ঢালচরের বন সুরক্ষায় তৎপর হতে হবে। স্থানীয় মানুষদের ঢালচরের বন ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। কারণ এই বন সব আপদন্ডবিপদ থেকে চরবাসীকে সুরক্ষিত রাখছে। নির্দয়ভাবে বনের বিনাশ বন্ধ করে বনের প্রতি ঢালচরের প্রতিজন নাগরিককে সামাজিক ঢাল হিসেবে দাঁড়াতে হবে। ঢালচরের প্রাকৃতিক ঢাল উপকূল-বন আর বনের ঢাল ঢালচরের জনগণ। প্রাকৃতিক ও সামাজিক ঢালের এই সংহতি সক্রিয় হলেই বিকশিত হবে ঢালচরের বন বাস্তুতন্ত্র।
লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রাজধানীর একটি নামি স্কুলে আগের বছরগুলোর মতো এবারও শিক্ষার্থীদের বর্ষপঞ্জি দেওয়া হয়। তাতে মার্চের মাঝামাঝি তাদের প্রথম শ্রেণি-অভীক্ষা শুরুর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণ পেয়ে শিক্ষকরা জানান, এ বছর শ্রেণি-অভীক্ষা হবে না। ফলে শিথিল অবস্থায় ছিল শিক্ষার্থীরা। প্রথম অভীক্ষার জন্য দেওয়া সিলেবাসও শেষ হয়নি তাদের। এখন হঠাৎ করে প্রচলিত নিয়মে শ্রেণি-অভীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে স্কুলটি। দশ বিষয়েরই। এতে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
শুধু রাজধানীর একটি স্কুলই নয়, দেশের বেশির ভাগ স্কুলেই এ বছর একই অবস্থা। নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে সবাই তালগোলে পড়ে গেছে। এ বছর প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছর প্রাথমিকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণি এ শিক্ষাক্রমের আওতায় আসবে।
সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে প্রচলিত কোনো পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট নেওয়া যাবে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ম্যানুয়াল অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই সারা বছর শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন মূল্যায়ন চলবে। বছর শেষে মাত্র একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু তা না মেনে অনেক স্কুল শ্রেণি-অভীক্ষা বা সিটি পরীক্ষার সূচি প্রকাশ করেছে। কোনো স্কুল পরীক্ষা নিতেও শুরু করেছে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় রয়েছে। এসবের মধ্যে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ ও সামষ্টিক মূল্যায়ন ৪০ শতাংশ। আর জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি এই পাঁচ বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রমে যে বিষয়গুলো আনার পরিকল্পনা ছিল তা সঠিকভাবে আনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু বইপত্র নিয়ে যা হয়েছে, মূল্যায়ন নিয়ে এর চেয়েও বেশি তালগোল অবস্থা তৈরি হবে। যে শিক্ষাক্রম হয়েছে, তা আমাদের শিক্ষকদের সক্ষমতার বাইরে। এই শিক্ষাক্রম অনুসরণ করার মতো শিক্ষক আমাদের নেই। বই যারা লিখেছেন তারাও নিরপেক্ষ থাকেননি।’ আগামী দিনের জন্য পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম আরও সময় নিয়ে ধাপে ধাপে করা উচিত ছিল। আগে যথাযথভাবে বইপত্র তৈরি করতে হবে, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে; তারপর শিক্ষকদের তৈরি করতে হবে। চার-পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষক তৈরি করা সম্ভব নয়। আগামী বছরের জন্য এখন থেকেই এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।’
জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রম চালু করে স্বস্তিতে নেই শিক্ষা প্রশাসন। গত মাসে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের অনুসন্ধানী পাঠ্যবই দুটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী পাঠ ও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান এই তিনটি বই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখনো সংশোধনের কাজ শেষ হয়নি। তিন মাস হতে চলছে বই তিনটি ঠিকমতো পড়াতে পারছেন না শিক্ষকরা। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যান্য বইতেও অসংখ্য ভুল আর অসংগতি ধরা পড়ছে। অথচ দুটি বই প্রত্যাহার করেই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনটি বইয়ের সংশোধন বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে। কাজ এখনো শেষ হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি, যত দ্রুত তা করা যায়। যে দুটি বই প্রত্যাহার করা হয়েছে ওই দুটির আরেকটি করে অংশ রয়েছে, যা পড়লে শিক্ষার্থীরা পুরো পাঠই পাবে। আগামী বছরের বইগুলোর ব্যাপারে আমরা আরও সচেতন থাকব। এ বছরের বইগুলোর যথাযথ পরিমার্জন করা হবে আগামী বছর।’
আগে পাঠ্যবইয়ের কোনো কিছু না বুঝলে সহায়ক বইয়ের সাহায্য নিতেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য প্রকাশনী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সহায়ক বই প্রকাশ করেনি। ফলে শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তারা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে সহায়ক বইয়ের জন্য ধরনা দিচ্ছেন।
এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয় প্রাথমিকের বৃত্তি পরীক্ষার ফল। দুপুরে ফল প্রকাশ হলেও বিকেলেই তা স্থগিত করা হয়। পরদিন ১ মার্চ রাতে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, প্রথমবার প্রকাশিত ফলে যারা বৃত্তি পেয়েছিল, সংশোধিত ফলে তাদের অনেকের নাম নেই। অথচ বৃত্তি পেয়ে আনন্দ-উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ করে ফেলেছিল তারা। তাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা জেনে গিয়েছিল বৃত্তি পাওয়ার খবর। কিন্তু সংশোধিত ফলে যখন ওই শিক্ষার্থীর নাম এলো না তখন তাদের মন ভেঙে যায়।
১৪ বছর ধরে চালু থাকা সৃজনশীল পদ্ধতি শুরুতে বুঝতে হিমশিম খেয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এখন আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু হওয়ায় আবারও হিমশিম খাওয়ার দশায় পড়েছে তারা। অনেকেই তাল মেলাতে পারছে না। পরীক্ষা ও নম্বর বণ্টনের বিষয়টি তারা বুঝে উঠতে পারছে না। পরীক্ষার ওপর চাপ কমানোর ফলে স্কুলেও পড়ালেখার চাপ কমেছে। কোনো রকমে ক্লাস পার করেই দায় সারছেন অনেক শিক্ষক। আর অভিভাবকদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমবিষয়ক মাত্র পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণে শিক্ষকরা কতটা আত্মস্থ হতে পেরেছেন তা নিয়ে অনেকে সন্দিহান। বাস্তবভিত্তিক ও শিখনকালীন মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত নিয়েও জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের বোঝানো একজন শিক্ষকের পক্ষে কষ্টকর। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, বিজ্ঞানাগার ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরণ নেই বেশির ভাগ স্কুলে। এটা বড় সমস্যা। এই শিক্ষকরাই যেহেতু সরাসরি শিখনকালীন মূল্যায়ন করবেন, তারা কতটুকু নির্মোহভাবে তা করতে পারবেন সে ব্যাপারে অভিভাবকরা সন্দিহান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে ধনী-দরিদ্র, গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য তৈরি হবে। কারণ ধনী পরিবারের সন্তানরা এরই মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমে প্রশিক্ষণ পাওয়া একাধিক শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া শুরু করেছেন। এগিয়ে যাচ্ছে তারা। আর প্রাইভেট পড়তে না পেরে পিছিয়ে পড়ছে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা। আবার শহরের স্কুলের চেয়ে গ্রামের স্কুলগুলো আগে থেকেই পিছিয়ে আছে। কারণ শহরের স্কুলগুলোতে বেশি বেতন ও প্রাইভেটে বেশি শিক্ষার্থী পাওয়ায় অপেক্ষাকৃত মেধাবীরা সেখানে শিক্ষকতা করেন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য আরও বাড়বে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব শিক্ষক সমান যোগ্যতাসম্পন্ন নন। ফলে তারা এখনো সেভাবে নতুন শিক্ষাক্রমে অভ্যস্ত হতে পারেননি। একদল শিক্ষার্থী মনে করছে, তাদের পরীক্ষা নেই। তারা রিলাক্স মুডে রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা-সহায়ক সামগ্রী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই। নতুন শিক্ষাক্রমের ওপর এখনো প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি। তারা কীভাবে বিষয়টির তদারকি করবেন, সেটা বড় সমস্যা।’