
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। রোবটিক্স বিষয়ক তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিশ্বের সেরা সেরা জার্নালে। তিনি শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিতে দক্ষ ও আগ্রহী করে গড়ে তোলার পাশাপাশি জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' কে তিনি সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পাশাপাশি প্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ও সমাজে জেন্ডার বৈষম্য নিরসন বিষয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
দেশ রূপান্তর: এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ' ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন' বিষয়ে আপনার অভিমত কি?
লাফিফা জামাল: এবারের প্রতিপাদ্য খুবই সুন্দর এবং সময়োপযোগী হয়েছে। একদিক দিয়ে আমরা প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি, উদ্ভাবনের কথা বলছি।অন্যদিক থেকে জেন্ডার বৈষম্য নিরসনের কথাও বলছি। তথ্য প্রযুক্তি একটা স্কিল। আমাদের সবাইকে প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। হয়তোবা আমরা সবাই আবিষ্কার করতে পারব না, কিন্ত প্রযুক্তিগত জ্ঞান আমাদের প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আপনি যদি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আর কতদিন ভোক্তা হয়ে থাকব। এখন সময় এসেছে, আমাদের নিজেদের আবিষ্কার করা দরকার। প্রযুক্তিতে দক্ষ হয়ে ওঠা প্রয়োজন।
দেশ রূপান্তর: আমরা যদি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি,তাহলে প্রযুক্তি শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কেমন?
লাফিফা জামিল: মেয়েদের আগ্রহ অনেক বেশি। সময়ের সাথে সাথে এই আগ্রহ বেড়েছে। প্রযুক্তির বিষয়টা এমন যে, এখানে খুব ডেডিকেটেডলি সময় দিতে হয়। এই জায়গায় মেয়েরা এগিয়ে রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন খাতে নারীর অংশগ্রহণ কেমন?
লাফিফা জামাল: বর্তমানে আমাদের দেশে ৩০ শতাংশ নারীরা প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করছে। যদিও পেশাগত জায়গায় ১০ শতাংশের মত নারীদের পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা যাদের পাই, ক্যারিয়ারে গিয়ে তাদের পাই না। এটা যে শুধু প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানে এমন নয়, সব সেক্টরেই নারী শিক্ষার্থীরা ড্রপ আউট হয়। পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয় না, আবার অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হয়েও পরে নানা কারণে ড্রপ আউট হয় বা চাকরি ছেড়ে দেয়।
দেশ রূপান্তর: সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীদের উপস্থিতি কেমন?
লাফিফা জামাল: সাধারণত এন্ট্রি লেভেল বা মিড লেভেলে আমরা যতটা মেয়েদের পাই, হায়ার লেভেল বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় তুলনামূলক ভাবে নারীদের উপস্থিতি কম। যদিও এখন পরিবর্তন হচ্ছে। এখন অনেক সেক্টরেই নারী প্রধান হচ্ছেন। এই জায়গায় পরিবর্তন হচ্ছে। তবে এই পরিবর্তন কে আরও বেগবান করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে একটা মেয়ে ডাক্তার হওয়ার চিন্তা যতটা সহজে চিন্তা করতে পারে, ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী হওয়ার চিন্তা ততটা করতে পারে না কেন?
লাফিফা জামাল: আমাদের সমাজে কতজন বাবা-মা চান আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার হোক। পরিবার থেকেই মেয়েদের এই সাইকোলজি তৈরি হয়। একটা মেয়ে জন্মের পর থেকে শুনে আসে গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং খুব কঠিন। কঠিন সাব্জেক্ট মেয়েদের জন্য নয়- এই যে সামাজিক ট্যাবু, এটা একটা বড় ব্যারিয়ার। অথচ আপনি যখন গণিত বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন এতে আপনার ব্রেইনের চর্চা হয়। ব্রেইন তো নারী পুরুষ উভয়ের ই সমান। এখানে তো শক্তি লাগতেছে না। পেশি শক্তিতে হয়তো মেয়েরা কিছুটা পিছিয়ে থাকে। এই ব্যারিয়ার দূর করতে হবে ।
দেশ রূপান্তর: আপনি একদিক দিয়ে একাডেমিশিয়ান অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে, অভিভাবকদের ছেলেকে কম্পিউটার কিনে দেওয়ার পরিবর্তে মেয়েকেও কিনে দেব এই চিন্তাটা এসেছে কি?
লাফিফা জামাল: এই উত্তর টা একটু অন্যভাবে দেই। এই চিন্তার কিন্ত পরিবর্তন ঘটেছে। এটা বেশ আশাব্যঞ্জক। আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই ৫০ ভাগ নারী শিক্ষার্থী ১ম বর্ষে ভর্তি হচ্ছে। যাদের একটা বড় অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসছে। বর্তমানে স্কুল-কলেজে ঝড়ে পড়া কমেছে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ বেড়েছে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখন বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ডিনস অ্যাওয়ার্ডে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি থাকে। এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ও জিপিএতে মেয়েরাই এগিয়ে থাকছে। ঢাবিসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটিতে নারী ফ্যাকাল্টির সংখ্যা বাড়ছে।
দেশ রূপান্তর: আমাদের দেশে নারীদের একটা বড় অংশ গার্মেন্টসে কাজ করছে, তাদেরকে কীভাবে প্রযুক্তি সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা যায়?
লাফিফা জামাল: এর জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। গার্মেন্টস মালিকদের এখানে একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। মেয়েরা এখন হাতে কাজ করছে। কিছুদিন পর যখন অটো মেশিনে কাজ শুরু হবে, তখন তারা কাজ হারাবে। সেই কাজ হারানোর আগেই তাদের প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এই মেয়েগুলো যাতে আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে কাজ করতে পারে, সে জন্য এখন থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: মফস্বলের স্কুল কলেজে ব্যবহারিকের চেয়ে থিওরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এতে কি শুরুতেই শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না?
লাফিফা জামাল: এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া টা জরুরি। হয়তোবা দেখা যাচ্ছে যিনি জীববিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তার ব্যাকগ্রাউন্ডে জীববিজ্ঞান নয় অন্য কোন সাব্জেক্ট রয়েছে। কম্পিউটার বা আইসিটি যিনি পড়াচ্ছেন তিনি হয়তো কম্পিউটারের ব্যবহার ই জানেন না। ফলে ব্যবহারিক বাদ দিয়ে থিওরি পড়াচ্ছেন।
দেশ রূপান্তর: নারীদের দক্ষ করার কাজে যারা যুক্ত তাদের দাবি প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী তারা পাচ্ছেন না।
লাফিফা জামাল: এটা কেবল প্রযুক্তি নয়, সব সেক্টরের চিত্র। স্কুল কলেজের শিক্ষক হিসেবে আমরা মেয়েদের বেশি দেখতে পাই। তবে এখানে আরেকটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আগে কিন্ত উচ্চ শিক্ষায় মেয়েদের অংশ গ্রহণ কম ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা বাড়ছে। ফলে আমি মনে করি সামনে এই সংখ্যা বাড়বে।
দেশ রূপান্তর: নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু?
লাফিফা জামাল: আমি তো মনে করি পরিবারের সাপোর্টটা খুব বেশি দরকার। পারিবারিক ভাবে যদি কোন মেয়ে বাধার সম্মুখীন হয়, তাহলে শুরুতেই মনোবল হারিয়ে ফেলে। তাই পরিবারে পিতা মাতা এবং পরবর্তিতে জীবন সঙ্গীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দেশ রূপান্তর: প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে নারীদের সাইবার বুলিংয়ের ঝুঁকি বাড়বে কি না?
লাফিফা জামাল: আমি তা মনে করি না। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে সাইবার বুলিং বাড়বে বিষয়টা এমন নয়। আপনি যদি সচেতন না হন তাহলে একদিন ব্যবহার করেও বিপদে পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে বুলিং প্রতিরোধ করতে হলে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সমাজেও তো বুলিং হয়, সে জন্য কি আমরা দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকি। কাজেই বুলিংয়ের ভয়ে প্রযুক্তিতে মেয়েরা আসবে না, আমি তা বিশ্বাস করি না। যত বেশি প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ হতে পারবে, ততই বুলিংয়ের সম্ভাবনা কমবে।
দেশ রূপান্তর: কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপদ পরিবেশ কতটা নিশ্চিত করা গেছে?
লাফিফা জামাল: আমরা কি গণ পরিবহনে নিরাপদ পরিবেশ দিতে পেরেছি? পারি নি। শুধু গণ পরিবহনে কেন, রাতের বেলা যদি আমি হেঁটেও রাস্তায় বের হই, নিজেকে নিরাপত্তা দিতে পারি না। একইভাবে কর্মক্ষেত্রেও শত ভাগ নিরাপদ পরিবেশ এখনও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে কর্মক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়েই উদ্যোগ প্রয়োজন।'
দেশ রূপান্তর: ধন্যবাদ আপনাকে।
লাফিফা জামাল: দেশ রূপান্তরকেও ধন্যবাদ।
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা এবং দেশকে সংক্রামক রোগমুক্ত করার কাজে নেতৃত্বদান করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং ভাইরোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে আর এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রবীণ এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সহকারী সম্পাদক আহমেদ মুনীরুদ্দিন
দেশ রূপান্তর : গত ১০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে ব্যক্তির ব্যয়। এখন দেশে স্বাস্থ্যব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ অর্থ যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে। এক্ষেত্রে সরকার ব্যয় করছে মাত্র ২৩ শতাংশের মতো অর্থ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-ষষ্ঠ রাউন্ড’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। চিকিৎসাব্যয়ের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ের এটা একটা ওভারঅল অবজার্ভেশন। চিকিৎসা ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে যায় আর এক-তৃতীয়াংশের মতো সরকার বহন করে। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়ে আমরা সারা দেশের মানুষের বা জনগণের সব অংশের সম্মিলিত বা গড়পড়তা একটা চিত্র দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টা অনেকটা আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির মতো। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে এবং জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়ছে। কিন্তু এই আয় দেশের অতিধনী ও ধনীদের কতটা বাড়ছে আর সাধারণ ও গরিব মানুষদের কতটা বাড়ছে বা আদৌ বাড়ছে কি না সেটা মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় না। তেমনি জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয় বা মানুষের চিকিৎসাব্যয়ের এই পরিসংখ্যান থেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বা গরিব মানুষদের বাস্তবতা বোঝার উপায় নেই। তাই বলা যায়, চিকিৎসা ব্যয়ের এই জাতীয় হিসাবে গরিবদের বাস্তবতা যথাযথভাবে উঠে আসেনি।
দেশ রূপান্তর : এরকম তথ্য কিন্তু পরিসংখ্যানেও দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জাতীয় স্বাস্থ্যব্যয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে মোট খরচের ৫৪ শতাংশই খরচ করেন দেশের শীর্ষ ধনীরা। বাকিটা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রসহ জনসংখ্যার অন্যান্য সব অংশ মিলে। আবার সাধারণ মানুষের আয় কমে যাওয়ায় অনেকেই বাধ্য না হলে হাসপাতালে বা চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না বলেও উঠে আসছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : আসলে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ের হিসাব নিয়ে এমন পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অনেক। কিন্তু যেটা বলছিলাম যে, এমন হিসাবে দেশের সব মানুষের ডিটেইল পিকচারটা পাওয়া যাচ্ছে না। ধরুন খুবই প্রান্তিক একটা মানুষ, গ্রামেরও সাধারণ মানুষ তিনি কিন্তু চিকিৎসাব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ কেন এক-তৃতীয়াংশ বহন করার মতো অবস্থাতেও নেই। কারণ খাদ্য কেনার মতো যথেষ্ট টাকাই তার হাতে নেই। তো তিনি কীভাবে চিকিৎসার খরচ মেটাবেন? ধরুন তার ক্যানসার হয়েছে, তিনি তো ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা বা জেলা পর্যায়েও এই চিকিৎসা পাবেন না। আবার ঢাকায় এসে চিকিৎসা করানো মতো আর্থিক ক্ষমতা তো দূরের কথা আসা-যাওয়ার গাড়ি ভাড়াই তার কাছে নেই। তাহলে প্রশ্নটা হলো, দেশের কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসায় কতটা ব্যয় করল শুধু সেটা হিসাব করলে হবে না; কত শতাংশ মানুষ চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত সেই হিসাবটাও জরুরি। কিন্তু এ ধরনের পরিসংখ্যানে সেসব তথ্য উঠে আসছে না।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে এই গবেষণায়। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির খরচের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় ওষুধে, যা মোট চিকিৎসাব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এরপর মেডিকেল ও ডায়াগনস্টিকে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, চিকিৎসক দেখাতে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ ইত্যাদি। ওষুধে এত বেশি ব্যয়ের কারণ কী বলে মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এ বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার। কিন্তু এসব কথা বললে অনেকে মাইন্ড করবেন। আমি নিজেও একজন চিকিৎসক। কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক চিকিৎসকই রোগীকে প্রেসক্রিপশনে এমন অনেক ওষুধ লিখে দিচ্ছেন যার হয়তো দরকার নেই। আবার অনেক সময় ওষুধ লেখা না লেখার ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানির কথা ভাবেন।
দেশ রূপান্তর : আপনি যা বলছেন সে বিষয়ে কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার সচিবও অভিযোগ করেছেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার প্রশ্ন তুলেছেন যে, দেশে ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং সংক্রান্ত বিধি মানা হচ্ছে কি না। তিনি বলেছেন, অনেক চিকিৎসক শুনি ওমরাহ পালনে যান ওষুধ কোম্পানির টাকায়। অনেকে নাকি ফ্রিজ নেন টেলিভিশন নেন। কেউ আছে ফ্ল্যাট পর্যন্ত কিনে দেয়। আপনার কী মনে হয়?
ডা. নজরুল ইসলাম : স্বাস্থ্য সচিব এক্ষেত্রে সত্য কথাটাই বলেছেন। সত্য কথা বললে সব দিক নিয়েই বলা দরকার। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের বিষয়ে সত্য কথা বলতে গেলে এত কথা উঠে আসবে, এত সব সমস্য ও সংকট এখানে আছে যেসব নিয়ে আসলে বিস্তারিত আলোচনা-পর্যালোচনা প্রয়োজন। ওই যে, কথায় বলে ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা’, স্বাস্থ্য খাতের অবস্থাটাও তেমন।
দেশ রূপান্তর : চিকিৎসাব্যয়ের সিংহভাগ ওষুধের পেছনে ব্যয় হওয়া থেকে কি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওষুধ নির্ভরতার বিষয়টি সামনে আসছে? বিশ্লেষকরা বলে থাকেন আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাত ‘প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ার’ নয় ‘কিউরেটিভ হেলথ কেয়ার’-এর ওপর বেশি জোর দিয়ে থাকে। আপনি কী মনে করেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা ঠিকই বলা হয়। এখন কথা হলো প্রিভেন্টিভ হেলথ কেয়ারে আপনি কীভাবে যাবেন? সেজন্য পুরো ব্যবস্থাটা পাল্টাতে হবে। আর যেসব ব্যবস্থা আছে, অবকাঠামো ও জনবল আছে সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। যেমন ধরুন আমাদের যে ইপিআই বা এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমিউনাইজেশন আছে সেটা খুবই দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু সেটাও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে ২০৩০ সালের মধ্যে ‘হেপাটাইটিস-বি’ পুরোপুরি নির্মূল করবে। অর্থাৎ আমাদের হাতে আছে আর মাত্র ৭ বছর। এখন একজন প্রসূতি-মা যদি ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত থাকে তাহলে ভূমিষ্ঠ সন্তানটিরও ‘হেপাটাইটিস-বি’ তে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভ্যাকসিন এবং ইমিউনোগ্লোবিন দেওয়া হলে শিশুটি আর তাতে আক্রান্ত হবে না। এই বিষয়টা আমরা জানি, এমন ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা প্রতিটি হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত প্রসূতির সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করছি কি? এখন এমন ভ্যাকসিনেশন না হওয়ার কারণে যে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে তারা তো আর ২০৩০ সালের মধ্যেই মারা যাবে না। তাহলে এই সময়ের মধ্যে কীভাবে আমরা হেপাটাইটিস-বি নির্মূল করব। আমি বলতে চাচ্ছি প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান সুযোগও আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। একই কথা প্রযোজ্য সার্ভিক্যাল ক্যানসারের ক্ষেত্রে। এখন এর কার্যকর ভ্যাকসিন আছে। কিন্তু আমরা কি ‘এট এন-মাস’ বা সারা দেশের সব নারীদের এই ভ্যাকসিন দিচ্ছি? দিচ্ছি না। তাহলে তো সার্ভিক্যাল ক্যানসারও থেকেই যাবে।
দেশ রূপান্তর : আবার একটু ওষুধ ও প্রেসক্রিপশনের আলোচনায় ফিরে যাই। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে প্রেসক্রিপশন লেখা নিয়ে। প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের ব্র্যান্ড-নাম না লিখে শুধু ওষুধের জেনরিক-নাম লিখে দেওয়ার কথা বলা হলেও তা মানা হচ্ছে না। এছাড়া, চিকিৎসকরা দুর্বোধ্য হাতের লেখায় ওষুধের নামসহ প্রেসক্রিপশন দেন এতেও সাধারণ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ছে। আবার অনেকেই বলছেন প্রেসক্রিপশন কেন বাংলায় লেখা হচ্ছে না? অথচ এই বিষয়ের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। আপনি বিষয়গুলোকে কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা নিয়েও তো আদালত একটা নির্দেশনাও দিয়েছিল। বলা হয়েছিল ওষুধের নাম ইংরেজি ক্যাপিটাল লেটারে লিখতে। যাতে সবাই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই তো পাল্টায়নি। আমার মনে হয় এখানে দুটো বিষয় আছে। একটা হলো চরম উদাসীনতা আরেকটি হলো দুর্নীতি। এই দুটোই এখন আমাদের জাতীয় চরিত্র হয়ে উঠেছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকই সম্ভবত এ বিষয়ে উদাসীন। আর অনেকেই ওষুধ কোম্পানির সুবিধা নিয়ে জেনরিক-নাম না লিখে ব্র্যান্ড-নাম লিখছে। স্বাস্থ্য প্রশাসনও এসব বিষয় দূর করার ব্যাপারে উদাসীন। ফলে সব মিলিয়েই এই সমস্যাগুলো দূর হচ্ছে না।
দেশ রূপান্তর : সাধারণ মানুষের মানসম্মত চিকিৎসাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসা ব্যয় লাঘব করতে হলে দেশব্যাপী গ্রামাঞ্চলসহ উপজেলা-জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ছে না বললেই চলে। এক্ষেত্রে আরেকটি বড় সমস্যা হলো সারা দেশে যতটুকুই স্বাস্থ্য-অবকাঠামো আছে সেটা সামগ্রিকভাবে একে-অন্যের সঙ্গে সুসম্পর্কিত না। একজন রোগী গ্রাম বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা-জেলা হয়ে যে বিভাগীয় বড় হাসপাতাল বা রাজধানীতে আসছেন এমন নয়। এসব কারণে নাগরিকদের ‘হেলথ ডেটা’ বা স্বাস্থ্য তথ্যের কোনো একক ভান্ডার গড়ে উঠছে না। কিন্তু একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার তো উচ্চতর গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণী কাজের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এই বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?
ডা. নজরুল ইসলাম : এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। একটা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ভান্ডার খুবই প্রয়োজনীয়। আর আপনি স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর যে কথা বলছেন সেটাকে আমরা বলি ‘রেফারাল সিস্টেম’। একজন রোগী কীভাবে পর্যায়ক্রমে সাধারণ চিকিৎসকের কাছ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাবেন এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে চিকিৎসা নেবেন সেই কাঠামো বা চর্চা এখানে গড়েই ওঠেনি। একইভাবে একটা ‘এমআইএস’-ও গড়ে ওঠেনি। আমি যতদূর জানি এমন একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেটা সম্ভবত এখনো কার্যকরভাবে এগোয়নি। আসলে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ না নিলে এবং স্বাস্থ্য প্রশাসন এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিলে এমন আয়োজন সফল হওয়ার সুযোগ দেখি না। তবে আমি মনে করি, দুর্নীতিমুক্ত হয়ে উদাসীনতা ঝেড়ে ফেলে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলে আমাদের দেশেও এগুলো সবই সম্ভব।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ডা. নজরুল ইসলাম : আপনাকে এবং দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
আন্দালিব রাশদী কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। পড়াশোনা ঢাকা, ওয়েলস ও লন্ডনে। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন, যা বাংলাদেশে বিরল। উপন্যাস, ছোটগল্পের পাশাপাশি তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কলাম ও প্রবন্ধ লেখেন। বিদায়ী ও নতুন বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ রূপান্তরের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বিদায়ী বছরকে কী দিয়ে মূল্যায়ন করবেন মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক লুট নাকি পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল দিয়ে?
আন্দালিব রাশদী : যে কটা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তার সবগুলোই বাস্তবতা। সময় সংকট ও সাফল্যের মূলে রয়েছে আর্থিক ক্ষমতা এবং ব্যবস্থাপনা। সঙ্গে যোগ হয় বৈশ্বক পরিস্থিতি। বৈশ্বিক মহামারী কিংবা যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারের যে অস্থিতিশীলতা সেখানে বাংলাদেশের হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। কিন্তু রাষ্ট্র যা ঠেকাতে পারে তা হচ্ছে তহবিল লুণ্ঠন ও পাচার। ক্ষমতার সমর্থন ছাড়া সংগঠিত দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব নয়। ব্যাংক মালিকরা এক সময় রাষ্ট্র গঠনে উদার হাতে অর্থব্যয় করতেন, এখন রাষ্ট্রের অর্থ দুহাতে তুলে নিয়ে ব্যাংক মালিক হওয়া যায়, ব্যাংকের সমুদয় অর্থ লোপাট করে জনগণের সঞ্চয় ফিরিয়ে দেওয়ার দায় সরকারের ঘাড়ে ফেলে হাওয়া খেয়ে বেড়ানো যায়।
কেবল ২০২২ নয়, অনেক বছর ধরেই চলছে প্রতিষ্ঠানের ‘ইন্টেগ্রিটি’ ভেঙে দেওয়ার প্রক্রিয়া। যদি প্রশ্ন করি বলুন বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠানটির ইন্টেগ্রিটি নিয়ে আপনি গৌরবান্বিত বিশ্ববিদ্যালয়, আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ন্যায়বিচার, প্রশাসন, পূর্ত ও নির্মাণ, ব্যাংক, শুল্ক, সংবাদ মাধ্যম আপনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়বেন। জোর গলায় কেন, মিনমিন করেও গৌরব প্রকাশ করতে দ্বিধান্বিত হবেন। প্রশংসিত থাকবেন এ দেশের সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, গার্মেন্টস কর্মী, প্রবাসী ওয়েজ আর্নার প্রমুখ।
অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই প্রশংসনীয় এটাই অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। একই সঙ্গে উন্নয়নের জন্য প্রদেয় মূল্যও পরীক্ষণীয়।
দেশ রূপান্তর : আগামী বছর বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর। একে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক টানাপড়েন কি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন?
আন্দালিব রাশদী : আমি রাজনীতিবিদ নই, রাজনীতি বিশ্লেষকও নই; গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকার এসব বিভ্রান্তিকর বুলি আমরা যাদের কাছে শিখেছি, মূলত ব্রিটেনের কাছে, আমরা মোটেও তাদের মতো মানুষ নই, তাদের চেয়ে হীনমানের। ২০২২ সালেই তো সেখানে তিন প্রধানমন্ত্রীর শাসন চলেছে, একজন লিজ ট্রাস দেড় মাস অতিক্রম করতে পারেননি। ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা কি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা করেন না? অবশ্যই করেন। রাজনৈতিক কৌশলে তা করেন। আমরা, ক্ষমতায় যারাই অধিষ্ঠিত হই না কেন ক্ষমতা ধরে রাখতে ছল-বল-কৌশলের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে থাকি। কোনো কোনো দেশের জন্য ভোটার গুরুত্বপূর্ণ নন, গুরুত্বপূর্ণ যিনি ভোট গণনা করেন। ১৯৭০-এর যে নির্বাচন কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতার রায় দিয়েছিল সে নির্বাচনে চিফ ইলেকশন কমিশনার ছিলেন একজন বাঙালি বিচারপতি। সেই বিচারপতি আবদুস সাত্তার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। যে দল যখন বিরোধী পক্ষ হয় তাদের পছন্দ থাকে ভারতের সেই বিখ্যাত টি এন সেমানের মতো ব্যক্তি যেন চিফ ইলেকশন কমিশনার হন। যেন নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের চিরকালীন চাওয়া একজন দলনফর প্রধান নির্বাচক। পরস্পরবিরোধী চাওয়া উত্তেজনা ও টানাপড়েন সৃষ্টি করতে বাধ্য। বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাস হাস্যকর গণতন্ত্র সৃষ্টি করেছে। কর্মজীবনে ব্যক্তিগতভাবে একটি নির্বাচন কন্ট্রোলরুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে একজন রিটার্নিং অফিসারকে আমি অনুরোধ করেছিলাম, প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা একটু কমিয়ে বলুন, প্রায় শতভাগ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আমার আশপাশে কোনো স্ট্যাটিসশিয়ান নেই, যা করার আপনারাই করে নিন। আশির দশকের এক জাতীয় নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী বন্ধ-দরজা বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছিলেন : এই জেলায় অপজিশনকে একটা সিট দিতেই হবে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন তা দুই অতিক্রম না করে। পেশাগত কারণে আমিও বন্ধ দরজা বৈঠকে হাজির ছিলাম। পরিস্থিতি এখন অনেক পাল্টে গেছে। দলমত নির্বিশেষে ‘আমি জিতলেই’ গণতন্ত্রের জয় জয়কার অন্যথায় সব প্রহসন। জর্জ বার্নাড শ প্রায় সোয়া শত বছর আগে বলেছিলেন : নির্বাচন হচ্ছে নৈতিক সন্ত্রাস, যুদ্ধের মতোই তবে রক্তপাতহীন। এর সঙ্গে যুক্ত সবার আত্মাই কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে।’ ২০২৪-এর নির্বাচনী অস্থিরতা ও দ্বন্দ্ব ইন্টার পার্টি এবং ইন্ট্রা পার্টি অতি ভয়ংকর হয়ে উঠলে কথিত গণতন্ত্র চর্চা থেমে যাবে।
দেশ রূপান্তর : বর্তমানে সারা বিশ্বেই আমরা একটা কর্র্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর উত্থান দেখতে পাচ্ছি, এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
আন্দালিব রাশদী : কর্তৃত্ববাদ এখন অজেয় বৈশ্বিক প্রপঞ্চ। গণতন্ত্রের প্রবক্তারা ভাবেননি যে ‘ইললিবারেল ডেমোক্রেসি’ পৃথিবীতে জাঁকিয়ে বসবে। গ্লোবাল ফ্রিডম প্রতিবেদনটি দেখুন। বিভিন্ন সূচক বলে পৃথিবীর ষাটটি দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থান নেমে গেছে। পৃথিবীর কুড়ি শতক মানুষ মোটামুটিভাবে লিবারেল গণতন্ত্রের ছায়াতলে বসবাস করছে। প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের দোহাইয়ের আড়ালে গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। একদা জনমুখী বাম হিসেবে সমাদৃত নেতৃবৃন্দের অনেকেই গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় জুনিয়র পার্টনার হয়ে গেছেন। ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক কর্তৃত্ববাদী হলেও পৃথিবীকে ভারসাম্যপূর্ণ দ্বি-মেরু করে রাখতে সক্ষম ছিল। ভাঙনের পর এক মেরুর কথিত গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জেই গণতন্ত্রের লিবারেলিজমকে দেহচ্যুত করতে বিভিন্নমুখী অস্ত্রোপচার চালিয়েছে। গণতন্ত্রায়নের নামে স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়াসমূহের চর্চাই বেশি হয়েছে। সামরিক অভ্যুথান ঘটাতে সামরিক বাহিনী যতটা না এগিয়ে এসেছে তার চেয়ে কথিত গণতান্ত্রিক শক্তিই তাদের আসার পথ সুগম করে স্বাগত জানিয়েছে। ‘দ্য রাস্ট উইদিন ডেমোক্রেসি’- গণতন্ত্রের ভেতরের পচন চেনার জন্য মার্কিন সাধারণ নির্বাচন-উত্তর ক্যাপিটল হিল অবরোধ, তছনছ ও লুণ্ঠনের দৃশ্যই যথেষ্ট। সাড়ে চারশ বছর আগে অসন্তুষ্ট জনতা নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ইউনান ডি উইট ও তার ক্ষমতাধর ভাইকে শুধু হত্যাই করেনি, তাদের মৃতদেহ নিয়ে গণউল্লাস হয়েছে এবং তাদের বুক ফেঁড়ে ক্ষিপ্ত মানুষ কলজেতে কামড় বসিয়েছে, তাদের চোখ তুলে স্যুভেনির হিসেবে নিয়ে গেছে। ক’বছর পর সেই জনতাই বলেছে, ইউনান ডি উইট-ইতো ভালো ছিলেন। ২০২২-এর অন্যতম দৃষ্টি উন্মোচক শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকারের পতন, পলায়ন, রাজভবনের গণদখল। আমরা অবহিত আছি মাহিন্দা রাজাপাকসে ফিরে এসেছেন, নিরাপদ জীবনযাপন করছেন; আসছে নির্বাচনে গণতন্ত্রের হাত ধরেই তিনি আবারও নির্বাচিত হবেন মনে করা হচ্ছে। যে মার্কোসকে ফিলিপাইন গণঅভ্যুথানে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশ থেকে তাড়িয়েছিল তার পুত্র বংবং মার্কোস এখন সে দেশের প্রেসিডেন্ট, বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।
দেশ রূপান্তর : বছর শেষের দিকে বিশ্বের নানা দেশে ফের করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর যেমন পেয়েছি, তেমনি সারা বছর আলোচনায় ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে সবাই বলছে ২০২৩ সাল অমঙ্গল বার্তা বয়ে আনতে যাচ্ছে। আপনার মতামত কী?
আন্দালিব রাশদী : নস্ত্রাদামুস কিংবা জিন ডিক্সনের পথে না হেঁটেও এক সপ্তাহের খবরের কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করলে মোটামুটি সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় : যদিও ১৩ বিলিয়ন শট ড্যাক্সিন এর মধ্যেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে তারপরও কভিড-১৯ ভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট যে বছরভর অবস্থান করবে তা দ্বিধা ঝেড়ে বলে দেওয়া যায়।
আর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ? যুদ্ধ করিয়েছে গ্লোবাল মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। করোনাকালে অনেক অস্ত্র গুদামে জমে গেছে, গুদাম খালি করতে হবে। কভিডের মতোই অস্ত্রের নতুন ভ্যারিয়েন্ট বাজারে ছাড়ার আগে গুদামজাত করতে হবে। আসলে ইউক্রেন-ক্রেমলিন-পেন্টাগন-ন্যাটো-জাতিসংঘ সবই মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ক্রীড়নক। বাংলাদেশি মানি লন্ডারদের কেউ এই কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার হোল্ডার এ কথা কোনোদিন প্রকাশিত হলে আমি অন্তত বিস্মিত হব না। ২০২৩ যতটা না আশার তার চেয়ে বেশি আশঙ্কার।
দেশ রূপান্তর : কাগজের মূল্যবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প, সংবাদমাধ্যম একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। আপনার কি মনে হয়, এর প্রভাব আমাদের শিল্প-সাহিত্যের ওপর কতটুকু পড়বে?
আন্দালিব রাশদী : চলুন একটু উল্টো করে ভাবি- যে দামে আমরা কাগজ কিনব বলে প্রত্যাশা করেছিলাম, বাজারে গিয়ে দেখলাম কাগজ প্রত্যাশিত দামের সিকিভাগ দামে পাওয়া যাচ্ছে। প্রকাশক-মুদ্রক সেই টাকায় চারগুণ বেশি পরিমাণ কাগজ কিনে নিয়ে চলে এলেন। এবার এই বাড়তি কাগজ কিংবা সস্তা কাগজ কি আমাদের শিল্পসাহিত্য চেষ্টার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে সক্ষম হবে? কাগজ যদি বিনে পয়সায়ও সরবরাহ করা হয় তাতেও শিল্পসাহিত্য চর্চায় তেমন হেরফের হবে না। মহার্ঘ কাগজ কিংবা পানির দামের কাগজের প্রভাব পড়বে শিল্পসাহিত্য বহির্ভূত অন্যান্য কাগুজে কারবারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সাইবারফোবিক মানুষ, অবশ্যই ব্যাকডেটেড, আমার কোনো ফেইসবুক অ্যাকাউন্টও নেই, কিন্তু আমি মোটেও ফেইসবুক-বিরোধী নই, ব্লগ-বিরোধী নই, সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার বিরোধী নই, কিন্তু আমি তাতে নেই কারণ আমি ফোবিক আমার ধারণা আমি ম্যানেজ করতে পারব না। আমার জীবন ধারণের প্রধান সহায় ছাপা বই এবং ছাপা লেখালেখি। কাগজের দুর্মূল্য এবং আনুমনিক আমদানি দ্রব্যেও মূল্যবৃদ্ধিতে আমার বই ছাপা ঝুঁকিপূর্ণ মনে হলে প্রকাশক অবশ্যই মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আমি কি লেখালেখি ছেড়ে দেব? আমি অনলাইন প্রকাশনার দিকে মনোযোগী হব, সাইবারফোরিয়া উতরানোর সবক নেব।
কাগজের দাম বাড়ার আগেই ই-পেপারের কাছে ছাপা পেপার, ই-বুকের কাছে ছাপা বই মার খেয়ে আসছে। বিখ্যাত একটি পত্রিকাসহ যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ হয়েছে ৭০টি দৈনিক এবং ২ হাজারের বেশি সাপ্তাহিক।
দেশ রূপান্তর : এ বছর বেশ রেহানা মরিয়ম নূর, হাওয়া’র মতো কিছু আলোচিত-প্রশংসিত চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে বলে আশা করছেন, নাকি কয়েকটি ভালো সিনেমা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েই থাকবে?
আন্দালিব রাশদী : ডিসেম্বরের শেষার্ধে এসে জানলাম মুহাম্মদ কাইয়ুম পরিচালিত বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের হাওর-বাঁওড়ের জলকাদার গল্প নিয়ে তৈরি ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের মর্যাদা পেয়েছে। অথচ দিনের পর দিন তাকে প্রযোজকের অনুসন্ধান করতে হয়েছে, প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। নিজের জীবনের সমুদয় কামাই লগ্নি করে সিনেমা বানিয়েছেন, নিজের শিল্পসাধ মিটিয়ে মেধা ও শ্রম ঢেলে দিয়ে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ার মতো উঁচু স্থানে একে স্থাপন করতে পেরেছেন। কলকাতাই হোক কি কান-ই হোক কেউ তাকে উত্তম না বলা পর্যন্ত অধমই রয়ে থাকে। রেহানা মরিয়ম নূর কিংবা হাওয়া’র মতো ছবি হতে থাকবে না এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা এ প্রশ্নের জবাবটা কঠিন নয়। সিনেমা হোক কি গান হোক কি সাহিত্য সংস্কৃতির ভালোটার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি। সুতরাং প্রতিকূলতা ঠেলে যদি ব্যক্তি মেধা ও সামর্থ্য দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ বের করে আনতে পারেন।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভ নববর্ষ।
আন্দালিব রাশদী : ধন্যবাদ। আপনাকে ও দেশ রূপান্তরের পাঠকদেরও শুভ নববর্ষ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত গবেষক, ঐতিহাসিক, অনুবাদক, সমাজবিশ্লেষক, সাহিত্য সমালোচক ও চিন্তাবিদ। তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তিনি দেশের রাজনীতির উন্নতির জন্য চিন্তা ও কাজ করেন, লেখেন এবং মত প্রকাশ করেন। সম্প্রতি ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে। বিষয়টি নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী।
দেশ রূপান্তর : অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের সংবিধানসহ রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার দরকার বলে অনেকেই বলে আসছেন। যারা ঘুরেফিরে ক্ষমতায় আছেন তারাও নানা সময়ে এসব বলে এসেছেন। দেখা গেছে মেনিফেস্টোতে যে কথা থাকে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা সেটা ভুলে যান। এরশাদ পতনের আন্দোলনে ‘তিন জোটের রূপরেখা’র কথা সবাই ভুলে গিয়েছে। বিএনপি ‘রূপকল্প ২০৩০’ দিয়েছিল। অন্যদিকে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’, ‘রূপকল্প ২০২১’ নামে যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল তা সময়ের একটি রাজনৈতিক রূপরেখা হয়ে ওঠে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপির ২৭ দফা রূপরেখাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের প্রয়োজন নানাভাবে ব্যক্ত হচ্ছে। যেসব দল ক্ষমতায় ছিল এবং আছে, তাদের থেকেও সংবিধানের সংস্কারের কথা বলা হয়। গত অর্ধশতাব্দীতে সংবিধানের সতেরোটি সংশোধন হয়েছে। রাজনীতির উন্নতি হচ্ছে না। জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ অল্পই করা হয়। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলো আন্দোলন করেছে নিতান্তই ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। শেষে অবস্থার চাপে তিন জোটের রূপরেখা প্রণীত হয়। এই রূপরেখা বাস্তবায়নের জন্য কোনো দলেরই কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী দল, শক্তিশালী। বিএনপি সে তুলনায় শক্তিশালী নয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এই যে, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে আন্দোলনকারী সব দলই রাজনৈতিক কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য ঘোষণা না করে কেবল সরকার উৎখাতের ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ব্যাপারটিকে বলা হয়েছে বিরাজনীতিকরণ বা নিঃরাজনীতিকরণ। রাজনৈতিক দলগুলোর এই রাজনীতি-শূন্যতার মধ্যে বিএনপি ঘোষিত ২৭ দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যেভাবে বক্তব্যটি উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। সংশোধন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে সারা দেশে এটি প্রচার করলে বাংলাদেশের গোটা রাজনীতির গতিপ্রকৃতি পরিবর্তিত হবে। নেতৃত্বের প্রশ্ন আছে। বিএনপিতে ২৭ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন চালানোর মতো নেতৃত্ব নেই।
দেশ রূপান্তর : এই রূপরেখা তারা ক্ষমতায় এলে বাস্তবায়ন করবে বা করতে পারবে বলে কি মনে করেন? অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের ওপর কি সে আস্থা রাখা যায়?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের এবং ২৭ দফা বাস্তবায়নের মতো নেতৃত্ব বিএনপিতে নেই। উত্তরাধিকারভিত্তিক ও পরিবারতান্ত্রিক নেতৃত্ব দিয়ে সুফল হবে না। সুবিধাবাদী ভোগবাদী নেতৃত্ব বাঞ্ছনীয় নয়। জনগণ রাজনীতিবিমুখ, ঘুমন্ত। গণজাগরণ দরকার। গণজাগরণ কী? গণজাগরণের উপায় কী? এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে। জাতীয় সংসদের আগামী নির্বাচন যত ভালোভাবেই সম্পন্ন হোক, তা দ্বারা রাজনীতির উন্নতিশীলতা সূচিত হবে না। কেবল নির্বাচন নিয়ে এত আশা কেন?
দেশ রূপান্তর : বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে ১৯ দফা দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে বিএনপি সেখান থেকে সরে এসেছিল। এবারের ২৭ দফা রূপরেখা দেওয়ার মধ্যে কি তাদের কোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের বার্তা দেখতে পান।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেখা যাক, কোন দল কী করে। প্রত্যেক দলেরই রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়। উত্থান-পতন আছে। রাজনৈতিক দলগুলো ভালোর দিকে অগ্রসর হোক এটাই কাম্য। শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত ঘুমিয়ে থাকলে সুফল হবে না। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে।
দেশ রূপান্তর : বিএনপি একদিকে বলছে আওয়ামী লীগ সরকার কর্র্তৃক গৃহীত সব অযৌক্তিক, বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংশোধনী সংশোধন বা রহিত করবে। অন্যদিকে বলছে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘রেইনবো নেশন’ প্রতিষ্ঠা করবে। এর আগে বিএনপি-আওয়ামী লীগ কেউই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, সামনে কী হবে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : হিংসা-প্রতিহিংসা চলছে। খুন-খারাপি চলছে। এ থেকে মুক্তি দরকার। বিবেক ও যুক্তির প্রাধান্য চাই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবেক ও যুক্তি প্রাধান্য পেলে ক্রমে সব কিছু ভালোর দিকে চলবে। রাজনৈতিক দলকে গুরুত্ব দিতে হবে। দল গঠন নিয়ে চিন্তা ও কাজ করা দরকার। দল উন্নত চরিত্রের না হলে সরকার ভালো হবে কী করে? চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়া স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনীতির চরিত্র উন্নত হবে না।
দেশ রূপান্তর : প্রতি পাঁচ বছর পর পর ‘একটি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারই কি একমাত্র সমাধান?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ বা রাজনীতি নিরপেক্ষ, বা অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধাযক সরকার দিয়ে সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি, হচ্ছে না, হবে না। দেশের রাজনীতিকে, রাজনৈতিক দলগুলোকে এত নিকৃষ্ট অবস্থায় রেখে, জনমননকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে, জাতীয় রাজনীতির সমস্যার সমাধান হতে পারে না। উন্নত রাজনৈতিক চরিত্র অর্জনে নিরন্তন প্রয়াসপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাই, উৎকৃষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি চাই, সর্বোপরি চাই উন্নতিশীল জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা চাই। এসবের কোনোটাই রাতারাতি অর্জন করা যাবে না। রাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার প্রত্যেক জাতি ও জনজীবনের জন্য। রাজনীতিবিদদের ও সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ব্যাপার। ‘আটাশ দফা : আমাদের মুক্তি ও উন্নতির কর্মসূচি’ নামে আমার একটি লেখা আছে। তাতে আমি বাংলাদেশে আমাদের সংকটের স্বরূপ এবং মুক্তি ও উন্নতির উপায় সম্পর্কে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছি।
দেশ রূপান্তর : মোটা দাগে আপনার প্রস্তাব আমাদের সংকট ও রাষ্ট্র নিয়ে কী বলছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আমি মনে করি, ওই প্রস্তাবে যে পথ নির্দেশিত হয়েছে, কেবলমাত্র সেই পথে অগ্রসর হয়েই সমস্যার সমাধান হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সর্বজনীন কল্যাণে চিন্তা ও কাজ করতে হবে, দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মেয়াদি সরকার গঠন করে এগোতে হবে, রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন লাগবে। গোটা পৃথিবীর সব নেশনের বা জাতির রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন দরকার। জাতিসংঘ দিয়ে কাজ অল্পই হচ্ছে। এই জাতিসংঘকে সংস্কার করে বিশ্বব্যবস্থার আমূল পুনর্গঠন করতে হবে। সব রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে, পুনর্গঠিত নতুন রাষ্ট্রসংঘের পরিচালনায় একটিমাত্র সেনাবাহিনী রাখতে হবে। মানব প্রজাতি চাইলে, চেষ্টা করলে পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারবে। মানুষের অন্তরে আশা ও সাহস চাই। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষকেই গড়ে তুলতে হবে অভিপ্রেত নেতৃত্ব। মানুষের শক্তি ও সম্ভাবনা বিকাশমান। শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ঞৎঁঃয ংযধষষ ঢ়ৎবাধরষ. মিথ্যাকে পরাজিত অবস্থায় রাখতে হবে, বিলুপ্ত করা যাবে কীভাবে।
দেশ রূপান্তর : ‘পরপর দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না’। বিএনপি কি তাহলে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়েই চিন্তা করছে? এটা কি রাজনীতিতে একটা পালাবদলের ইঙ্গিত?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : বাংলাদেশে চলছে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার-ভিত্তিক নেতৃত্ব ও পরিবারতন্ত্র। গণতন্ত্রকে পর্যবসিত করা হয়েছে নির্বাচনতন্ত্রে। বাংলাদেশ নির্বাচনের মাধ্যেমে সরকার গঠনের যোগ্যতাও অর্জন করেনি। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিকে পর্যবসিত করেছে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাসমুখী ও ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্ক-অভিমুখী। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ কী করবে, কী করতে পারবে, জনসাধারণের দিক থেকে তার বিচার করে দেখা দরকার। আমার মনে হয় গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মের দ্বারা সমাধান হবে না, সংকটের সমাধানের জন্য নতুন ধারার চিন্তা ও কাজ লাগবে। আমি আটাশ দফা কর্মসূচিতে যে পথনির্দেশ করেছি একমাত্র সেই প্রশ্ন ধরে চিন্তা ও কাজ করতে হবে। আমার মতে আমাদের রাজনীতির ও সার্বিক উন্নতির পথ সেটাই। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী সেটাও বিচার করে দেখা দরকার। যারা আগে ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে আত্মপরিচয় দিতেন, তারা এখন ‘বিশিষ্ট নাগরিক’ বলে আত্মপরিচয় দেন। কেন এই পরিবর্তন?
দেশ রূপান্তর : ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতে’ বিএনপি ২৭ দফা রূপরেখা নিয়ে আপনার অন্য পর্যবেক্ষণগুলো কী?
আবুল কাসেম ফজলুল হক : দেশে যে রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে তাতে বিএনপি যদি তার ২৭ দফা কর্মসূচির কিছুটা পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পুস্তিকা আকারে দেশব্যাপী প্রচার করে, তাহলে তার ফল বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এবং জনগণের জন্য কল্যাণকর হবে। সব দলের নেতাকর্মীদের এবং বুদ্ধিজীবীদের থেকেই উন্নতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্ম আশা করি। জনচরিত্রকেও উন্নত করতে হবে। জনসাধারণকে বিচারকের ভূমিকায় রাখতে হবে। চিন্তা ও কর্মের নবউত্থান চাই।
দেশ রূপান্তর : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক : আপনাকে ও দেশ রূপান্তরকেও অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। শিক্ষাবিদ, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন চার দশকের বেশি সময়। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসে (ইউল্যাব) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিষয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের সাঈদ জুবেরী
দেশ রূপান্তর : বায়ান্নতে পা দিল বাংলাদেশদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত ৫১ বছরে আমাদের অর্থনীতিতে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে। তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থান থেকে আমরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কভিড সংকটের সময়েও ৭ শতাংশের ধারেকাছে ছিল। গত দেড় দশক এই উন্নতি দ্রুত হয়েছে, তবে কভিড সংকট এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী যে বিশাল সংকট সৃষ্টি করেছে তার অভিঘাতে আমরা এখন বিপদে আছি।
উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য প্রকট করেছে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা, বিত্তবানদের লোভ এবং বিদেশে টাকা পাচারের চর্চা। কিছু মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ, অথচ তৃণমূল পর্যায়ে কৃষক-শ্রমিক-খেটে খাওয়া মানুষের এখন তিন বেলা আহার জোটানো কঠিন। এ অবস্থার জন্য দায়ী নীতি ও কৌশলের দুর্বলতা, মন্ত্রণালয়গুলোর এবং বিভিন্ন প্রকল্পের কর্মকান্ডে অস্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির অভাব। ব্যাংকের তহবিল লুটে নেওয়ার খবর আমরা শুনি, কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি পেতে দেখি না। এসব ক্ষেত্রে সরকার যদি কঠোর হয়, আইন-আদালত কঠোর অবস্থানে যায়, তাহলে এই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে। এটি না হলে সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্য মøান হয়ে যাবে।
সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে, প্রধানত শিক্ষার বিস্তারের ফলে, কর্মক্ষেত্রে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং মিডিয়ার ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। বড় কিছু এনজিও সামাজিক উন্নয়নে প্রভাব রেখেছে। তাদের কাজে দারিদ্র্য কমেছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উন্নতি ঘটেছে। সরকারের অনেক নীতি ও কর্মসূচি বিশেষ করে স্কুল-কলেজের মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া, বিনামূল্যে পাঠ্যবই সরবরাহ ইত্যাদি সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। উল্টোপিঠে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতা, হানাহানি এবং সংঘাত বেড়েছে। উগ্রবাদের প্রসার ঘটেছে। সংস্কৃতিচর্চা ক্রমশ অদৃশ্য হচ্ছে। এই নেতিবাচক প্রবণতাগুলো চলতে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে।
রাজনীতিতে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় চিরস্থায়ী হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিয়ে যে রাজনীতিচর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। বড় দুই দল পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস পোষণ করে, এটি রাজনীতিতে সুস্থতা আনতে পারে না। ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করার, এর প্রধান নায়কদের সম্পূর্ণভাবে আড়ালে ঠেলে ১৯৪৮ সাল থেকে চলা পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চব্বিশ বছরের আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে একটি পক্ষ। এই মানসিকতার অবসান না হলে রাজনীতি কখনো সংঘাতমুক্ত হবে না, একাত্তরে যারা স্বজাতি হত্যা করেছিল, তাদের শক্তিশালী করা হবে। দুঃখজনক সত্যটি হলো, ১৯৭১ নিয়ে ছড়ানো নানা বিভ্রান্তিও দেশের রাজনীতিকে দুর্বল করে রেখেছে।
দেশ রূপান্তর : আপনাদের বেড়ে ওঠার সময় বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধরন কেমন ছিল? এখন কেমন দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমি ১৯৬৮ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, তখন বুদ্ধিজীবী শব্দটি সমীহ জাগাত। কারণ বুদ্ধিজীবী তাদেরই বলা হতো যারা তাদের চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধির চর্চা দিয়ে কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে আসতেন, যেগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য তারা নিরন্তর চেষ্টা করে যেতেন, অনেকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামেও নেমেছেন যেমন সাম্য, মানবাধিকার, দেশের সম্পদে গরিবের ন্যায্য অধিকার, শোষণ-বঞ্চনার অবসান। তাদের প্রায় সবাই পেশাজীবী ছিলেন, কিন্তু নিজস্ব পেশার বাইরে গিয়ে দেশের কল্যাণে তারা নিবেদিত থাকতেন। এরা অবধারিতভাবে ছিলেন এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী অনেকে কারাভোগও করতেন।
আমাদের এই সময়ে বুদ্ধিজীবী যারা আছেন, তারা প্রধানত নিজেদের পেশাতেই নিয়োজিত থাকেন, এবং পেশাজীবী হিসেবে হয়তো সুনামও কুড়িয়েছেন। কিন্তু পেশার বাইরে গিয়ে খেটে খাওয়া মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, তরুণ এবং পরিবর্তনকামী মানুষের পক্ষে তারা কোনো সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন না। মাত্র কয়েকজনই আছেন, যারা পুরনো ধারার বুদ্ধিজীবী, যারা ক্ষমতাকে ভয় না পেয়ে সত্য কথাটা বলে যান।
দেশ রূপান্তর : ৭০-এর দশকে প্রফেসর রাজ্জাক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক প্রভাব রাখতেন, পরবর্তী সময়ে তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি। সবশেষ, তরুণদের ভেতর আহমদ ছফার জনপ্রিয়তা দেখা গেছে। তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? নতুন কেউ আসছেন না কেন, নাকি আমরা দেখতে পারছি না নতুনদের?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : এদের দুজনই এস্টাব্লিশমেন্ট যেদিকে চলত, তার বিপরীতে ছিলেন। প্রফেসর রাজ্জাক মানুষের নিজস্বতাকে মূল্য দিতেন, কোনো আদেশ-নির্দেশকে পরোয়া করতেন না, প্রকৃত জ্ঞানকে আত্মস্থ করতে সবাইকে উৎসাহ দিতেন। ফলে প্রতিবাদী এবং পরিবর্তনকামী তরুণদের কাছে তিনি প্রিয় ছিলেন। আহমদ ছফা শুধু তার চিন্তাচেতনা নয়, জীবনযাপনেও এক প্রচলবিরোধী মানুষ হিসেবে নন্দিত হয়েছিলেন। তিনিও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সক্রিয়তাকে, পুরনোকে প্রশ্ন করতে এবং হায়ারার্কি অথবা সমাজের মোড়লদের দ্বিমুখী চরিত্র এসবের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর হতে তরুণদের বলতেন। নতুনরা যে আসছেন না, তা নয়, কিন্তু এখন সমাজটাই তো বদলে গেছে। এখন আহমদ ছফার মতো মানুষ যদি দলনির্বিশেষে রাজনীতিকে তার অন্তঃসারশূন্যতার জন্য প্রশ্ন করতে থাকেন, তাকে অনেক তরুণের বাধার সামনে পড়তে হবে।
এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শাসিত গুজব আর মেকি খবর এবং দৃশ্য মাধ্যমের তারল্যের যুগে এবং মুখস্থবিদ্যাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার সময়ে প্রফেসর রাজ্জাক এবং আহমদ ছফার মতো মানুষকে সহজে গ্রহণ করার মতো তরুণদের সংখ্যাই তো কম।
দেশ রূপান্তর : বলা হয়ে থাকে গত ৫০ বছরে দেশের সাংস্কৃতিক অবনমন ঘটেছে, এক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের দায় কতটুকু বা আদৌ তাদের কোনো দায় আছে কি না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : গত পঞ্চাশ বছরে সংস্কৃতিবিরোধী শক্তি সংগঠিত হয়েছে, দীর্ঘদিন তারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়েছে। সাম্প্রদায়িকতা এবং উগ্রবাদ বেড়েছে, সংস্কৃতিকে একেবারে প্রান্তিক অবস্থানে নিতে এরা তৎপর। এখন রাষ্ট্র সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের বিপদ ভাবে। এসব কারণে মুক্তচিন্তার মানুষেরা একদিকে এই সংস্কৃতিবিরোধী শক্তির আঘাত, অন্যদিকে সরকারের সমর্থনের অভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ফলে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরাও যেমন সংখ্যায় নিতান্ত কম, সমাজও তাদের আর খোলা মন নিয়ে গ্রহণ করতে রাজি নয়। সংস্কৃতির অবনমনের কারণ যদি হয় সমাজের অবস্থান পরিবর্তন (উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক থেকে চূড়ান্ত রক্ষণশীল, এবং অনেক সময় সংস্কৃতিবিরোধী), দায়টা তো সবার।
দেশ রূপান্তর : একসময় বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীদের আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার যে চর্চা তার একটা প্রভাব ছিল। এখন সেটা তেমন দেখা যাচ্ছে না। আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কি শেষ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আদর্শিক বুদ্ধিজীবিতার প্রয়োজন কখনো শেষ হয় না। কিন্তু সমাজের অসহিষ্ণু, সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আচ্ছন্ন, জাগতিক লোভের কাছে আত্মসমর্পিত অংশটির যেরকম শক্তি বাড়ছে, তাতে আদর্শের কথাটা এখন অচল হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। বুদ্ধিজীবীরা তখনই তাদের কাজের প্রভাব দেখেন যখন মানুষ নিজেদের অধিকারের (যার মধ্যে সাংস্কৃতিক অধিকার অন্যতম, যেমন ছিল ৫০-৬০ এর দশকে) জন্য সংগ্রামে নামে। সেই পরিবেশ এখন নেই। সেজন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটাই প্রথমে করতে হবে, কিন্তু যেখান থেকে এই সংগ্রাম শুরু হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরিবারসেখানেই তো দুর্বলতা প্রকট।
দেশ রূপান্তর : ইন্টারনেটের প্রসারে অনলাইনে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দাবি করা হয়। এ নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : পশ্চিমা বিশ্বে, এশিয়ার অনেক দেশে, এমনকি ভারতেও ইন্টারনেটে জ্ঞানচর্চার একটা শক্তিশালী ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে। কভিডের দুই-আড়াই বছরে আমি পশ্চিমের দু’তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জুম-আলোচনায় অংশ নিয়েছি, ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও দেখেছি, যেখানে জ্ঞানের নানা অঞ্চলে আলো ফেলে কেউ লেকচার দিয়েছেন, বক্তব্য দিয়েছেন অথবা প্রশ্নোত্তরে তাদের কথাগুলো বলেছেন। ইউটিউবে আমাদের দেশের সেরকম ভিডিও আমি খুব কমই পেয়েছি। ইউটিউবে (এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) একবার ঘুরে এলে দেখবেন কীরকম হিংসা, বিদ্বেষ, অসূয়া, নারীকে নিয়ে কটূক্তি, মানুষকে অপমান করার নিরন্তর চর্চা সেখানে হয়। ইন্টারনেটে বুদ্ধিবৃত্তির যে সত্যিকার চর্চা এখানে হয়, তা এতই সীমিত যে আঠারো কোটি মানুষের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে তা সত্যিই দুঃখজনক।
ইউটিউবে ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর যদি কোনো বক্তৃতা পান, দেখবেন, সেই বক্তৃতা শুনেছে খুব বেশি হলে ৫ হাজার মানুষ। অথচ গালিগালাজ করা, বিদ্বেষ আর উগ্রতা ছড়ানো হয় যেসব ভিডিওতে, সেগুলো শোনে লাখ লাখ মানুষ।
ইন্টারনেটকে আমরা হয়তো একদিন জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের একটা মাধ্যম হিসেবে পাব, কিন্তু সেজন্য অনেক সময় লাগবে। ততদিনে হয়তো ইন্টারনেটই প্রাচীন হয়ে যাবে। নতুন কোনো প্রযুক্তি আসবে।
দেশ রূপান্তর : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।