সাইয়্যেদ উসমান মনসুরপুরী
মহৎপ্রাণ এক ধর্মতাত্ত্বিকের বিদায়
মাওলানা ফখরুল ইসলাম | ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০
২০২০ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে দেওবন্দ মাদ্রাসার মজলিসে শুরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাহী মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব নেন মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ উসমান মনসুরপুরী। দায়িত্ব গ্রহণের সাত মাসের মাথায় তিনি ইন্তেকাল করেন। দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই বিশ্ব করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত ছিল, মারণঘাতী এই ভাইরাসের কবল থেকে পৃথিবী মুক্তি পেলে তার সুদক্ষ, সুচিন্তিত ও সুকৌশলী নেতৃত্বে দেওবন্দিধারার মাদ্রাসাগুলো আরও বহুদূর এগিয়ে যেত।
উসমান মনসুরপুরী (রহ.) ছিলেন বিশ্বের একজন প্রখ্যাত আলেম, হাদিস বিশারদ ও বুজুর্গ। শুধু ভারত নয়, বহির্বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশের আলেমসমাজে তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ও সুখ্যাতি ছিল। চিন্তায় উদার, ঐতিহ্য রক্ষায় শতভাগ সচেতন ও ধর্মের প্রশ্নে আপোষহীন এই আলেমের ইন্তেকালে বিশ্ব হাদিসশাস্ত্রের একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বকে হারালো, তার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। শুক্রবার রাতেই তাকে মাকবারায়ে কাসিমিতে দাফন করা হয়েছে। তার জানাজার নামাজের ইমামতি করেন সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানি।
সাইয়্যেদ উসমান মনসুরপুরী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও সংগঠক শায়খুল ইসলাম সাইয়্যেদ হোসাইন আহমাদ মাদানি (রহ.)-এর মেয়ের জামাই ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি নির্বাচিত হন, সেই সময় থেকে তিনি আমিরুল হিন্দ পদেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। অল ইন্ডিয়া মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়তের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ইন্তেকালে দেওবন্দিধারার আলেমদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। উসমান মনসুরপুরীর ইন্তেকালে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা এক মহৎপ্রাণ দরদি অভিভাবককে হারালো। ভারতীয় মুসলমানদের স্বকীয় রক্ষা এবং তাদের যাবতীয় উন্নয়নকল্পে তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।
১৯৪৪ সালের ১২ আগস্ট মুজাফফরনগরের মনসুরপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দেওবন্দে শিক্ষা অর্জন শেষে তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেন। প্রায় ৪০ বছর যাবৎ দেওবন্দে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি দেওবন্দের নির্বাহী মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
ভারতের রাজনীতিতে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের অনন্য নজির সৃষ্টি করে আছে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। যার স্বীকৃতি ও সম্মান গোটা ইসলামি বিশ্বজুড়ে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় দুই শ কিলোমিটার দূরে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে অবস্থিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন।
বিশ্বের বহু দেশের মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বিভিন্ন দিক-নির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকেন দেওবন্দের দিকে। ১৮৬৬ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশভাগের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোল বদলে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে দেওবন্দের সম্পর্ক এখনো ছেঁড়েনি, তা সহজে ছেঁড়ারও নয়!
মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে এই দেওবন্দিধারার আলেমরা বাংলাদেশকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে এ দেশের নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ-পুরুষ সাইয়্যেদ হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর ছেলে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল, রাজ্যসভার সাবেক সদস্য সাইয়্যেদ আসআদ মাদানি (রহ.)।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করেন তিনি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার অপরিসীম সহযোগিতা ও দেখাশোনা, গণনির্যাতন বন্ধ করার জন্য তার বিরামহীন দুঃসাহসী ভূমিকা এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার প্রাপ্তিতে তার অবদান স্বাভাবিকভাবে তাকে স্বাধীনতার অন্যতম কাণ্ডারি দূতের মহিমা দিয়েছে। ১ অক্টোবর ২০১৩ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রাখায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) পদক প্রদান করে বিরল সম্মানে ভূষিত করে। তার পক্ষে এ সম্মান গ্রহণ করেন তার মেজ ছেলে মাওলানা মওদুদ মাদানি। সেই মাদানি পরিবারের একজন হারিয়ে বাংলাদেশের আলেমসমাজ শোকাহত।
শেয়ার করুন
মাওলানা ফখরুল ইসলাম | ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০

২০২০ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝিতে দেওবন্দ মাদ্রাসার মজলিসে শুরার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাহী মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব নেন মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ উসমান মনসুরপুরী। দায়িত্ব গ্রহণের সাত মাসের মাথায় তিনি ইন্তেকাল করেন। দায়িত্ব নেওয়ার আগে থেকেই বিশ্ব করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত ছিল, মারণঘাতী এই ভাইরাসের কবল থেকে পৃথিবী মুক্তি পেলে তার সুদক্ষ, সুচিন্তিত ও সুকৌশলী নেতৃত্বে দেওবন্দিধারার মাদ্রাসাগুলো আরও বহুদূর এগিয়ে যেত।
উসমান মনসুরপুরী (রহ.) ছিলেন বিশ্বের একজন প্রখ্যাত আলেম, হাদিস বিশারদ ও বুজুর্গ। শুধু ভারত নয়, বহির্বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশের আলেমসমাজে তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ও সুখ্যাতি ছিল। চিন্তায় উদার, ঐতিহ্য রক্ষায় শতভাগ সচেতন ও ধর্মের প্রশ্নে আপোষহীন এই আলেমের ইন্তেকালে বিশ্ব হাদিসশাস্ত্রের একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বকে হারালো, তার এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।
গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। শুক্রবার রাতেই তাকে মাকবারায়ে কাসিমিতে দাফন করা হয়েছে। তার জানাজার নামাজের ইমামতি করেন সাইয়্যেদ আরশাদ মাদানি।
সাইয়্যেদ উসমান মনসুরপুরী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও সংগঠক শায়খুল ইসলাম সাইয়্যেদ হোসাইন আহমাদ মাদানি (রহ.)-এর মেয়ের জামাই ছিলেন। ২০০৬ সালে তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি নির্বাচিত হন, সেই সময় থেকে তিনি আমিরুল হিন্দ পদেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। অল ইন্ডিয়া মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়তের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ইন্তেকালে দেওবন্দিধারার আলেমদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। উসমান মনসুরপুরীর ইন্তেকালে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা এক মহৎপ্রাণ দরদি অভিভাবককে হারালো। ভারতীয় মুসলমানদের স্বকীয় রক্ষা এবং তাদের যাবতীয় উন্নয়নকল্পে তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।
১৯৪৪ সালের ১২ আগস্ট মুজাফফরনগরের মনসুরপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। দেওবন্দে শিক্ষা অর্জন শেষে তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেন। প্রায় ৪০ বছর যাবৎ দেওবন্দে শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। সর্বশেষ তিনি দেওবন্দের নির্বাহী মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন।
ভারতের রাজনীতিতে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের অনন্য নজির সৃষ্টি করে আছে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। যার স্বীকৃতি ও সম্মান গোটা ইসলামি বিশ্বজুড়ে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রায় দুই শ কিলোমিটার দূরে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে অবস্থিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন।
বিশ্বের বহু দেশের মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় বিভিন্ন দিক-নির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকেন দেওবন্দের দিকে। ১৮৬৬ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশভাগের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূগোল বদলে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমানদের সঙ্গে দেওবন্দের সম্পর্ক এখনো ছেঁড়েনি, তা সহজে ছেঁড়ারও নয়!
মহান স্বাধীনতার যুদ্ধে এই দেওবন্দিধারার আলেমরা বাংলাদেশকে অকুণ্ঠভাবে সমর্থন দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে এ দেশের নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর পাক বাহিনীর জুলুম-নির্যাতনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ-পুরুষ সাইয়্যেদ হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর ছেলে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল, রাজ্যসভার সাবেক সদস্য সাইয়্যেদ আসআদ মাদানি (রহ.)।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মুসলমান সমাজে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করেন তিনি। শরণার্থী শিবিরগুলোতে তার অপরিসীম সহযোগিতা ও দেখাশোনা, গণনির্যাতন বন্ধ করার জন্য তার বিরামহীন দুঃসাহসী ভূমিকা এবং বাংলাদেশের জনগণের স্বাধিকার প্রাপ্তিতে তার অবদান স্বাভাবিকভাবে তাকে স্বাধীনতার অন্যতম কাণ্ডারি দূতের মহিমা দিয়েছে। ১ অক্টোবর ২০১৩ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশাল অবদান রাখায় বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা (মরণোত্তর) পদক প্রদান করে বিরল সম্মানে ভূষিত করে। তার পক্ষে এ সম্মান গ্রহণ করেন তার মেজ ছেলে মাওলানা মওদুদ মাদানি। সেই মাদানি পরিবারের একজন হারিয়ে বাংলাদেশের আলেমসমাজ শোকাহত।