ইমানের স্বাদ
শায়খ ড. সালেহ বিন হুমাইদ | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
সহজ ও হালকা কাজের প্রতি মানুষের অন্তর সদা ধাবমান। অন্যদিকে শরিয়ত আরোপিত বিধানাবলি এবং কঠিন আমলের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ ও অবহেলা বেশি। তবে কল্যাণ আশ্রয়ী ব্যক্তি নিজেকে সেরা ও শ্রেষ্ঠ আমলের প্রতি ধাবিত করে। ফলে সাফল্যের চূড়ান্ত সীমায় উন্নীত হতে প্রত্যাশী হয়। এভাবে নফস যখন মর্যাদার নাগাল পেয়ে যায়, তখন হীন ও অপমানিত বিষয়ের প্রতি তার অবজ্ঞা তৈরি হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আর যে ব্যক্তি আখেরাত (এর লাভ) চায় এবং তা অর্জনের জন্য যথোচিত প্রচেষ্টা করে যাওয়ার সঙ্গে সে যদি (প্রকৃত) মুমিন হয়, তবে এরূপ লোকের চেষ্টার পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হবে।’ সুরা ইসরা : ১৯
অভ্যাসবশত মানুষের জবান চুপ থাকার নয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো স্থির থাকে না; চিন্তাও এক গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাই এসবকে ভালো ও সেরা সেরা কাজ দিয়ে ব্যস্ত না রাখা হলে স্বভাবতই তখন অতিশয় তুচ্ছ ও অপকারী কর্মগুলো সে স্থান দখল করে নেয়। পুণ্যের কাজে দেহ-মন-মস্তিষ্ক না খাটালে তা মন্দের দিকেই পরিচালিত হয়। জ্ঞানীদের মতে, প্রকৃত সুখ পায়ে মাড়িয়ে দৈহিক সুখ লাভে ব্যস্ত থাকা ব্যক্তি আর দেহকে কষ্ট দিয়ে আত্মিক সুখ লাভের প্রচেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তির মাঝে ফারাক রয়েছে। মনে রাখতে হবে, কষ্টকর বস্তু দিয়ে জান্নাতকে আর প্রবৃত্তির নিকৃষ্ট বাসনা দিয়ে জাহান্নামকে বেষ্টন করে রাখা হয়েছে।
আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরে অন্যরকম এক আনন্দ ও উপভোগের উপলব্ধি, আল্লাহ ও তার রাসুলের সন্তুষ্টি লাভের আশায় যাবতীয় কষ্ট ও দুঃখ সয়ে যাওয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় কিছুর ওপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেওয়ার নামই হলো ইমানি স্বাদ হাসিল করা। ইমানি উপলব্ধি এবং ইবাদতে আনন্দ লাভ। এসব অন্তরের প্রশান্তির বার্তাবাহক।
ইমানের স্বাদ এটি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর অটল থাকার চাবিস্বরূপ। ফেতনার সম্মুখে অবিচল থাকার রহস্যের ভেতর ইবাদতের স্বাদ নিহিত। ইমানি স্বাদ ও ইবাদতের প্রকৃত মজা লাভের স্বীকৃত উপায়ের অন্যতম হলো, অন্তরের পবিত্রকরণ এবং পরিশুদ্ধতা। ময়লা পাত্র থেকে পানি পান করা ব্যক্তি কখনো তার কাক্সিক্ষত স্বাদ পায় না, যার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে। তার হৃদয়কে ধুয়ে-মুছে পবিত্র করে এরপর তাতে স্বচ্ছ পানি ঢালে; তো শিগগিরই সে ইমানের পূর্ণ স্বাদ ফিরে পাবে। গোনাহের কদর্যতা, ভুলে ভরা আবর্জনা এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দাগ দিয়ে যে অন্তর পূর্ণ, সে ব্যক্তির ইমানি উপলব্ধি লাভ আকাশকুসুম স্বপ্নই শুধু। বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে, তিনটি কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তিই ইমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করল। এক. যে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে এও স্বীকার করে নিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। দুই. পূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে নিজ সম্পদের জাকাত আদায় করল এবং তিন. নিজের আত্মশুদ্ধি করল। সুনানে আবু দাউদ
তা ছাড়া নবীজির দোয়াও ছিল, হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে তাকওয়া ঢেলে দিন এবং অন্তরকে পরিশুদ্ধ করুন। কারণ আপনিই এর শ্রেষ্ঠ পরিশুদ্ধকারী। আর অন্তরের অভিভাবক এবং তার একমাত্র রব আপনিই। বিশর বিন হারেস (রহ.) বলেন, নিজের ও প্রবৃত্তির মধ্যে লৌহ-প্রাচীর নির্মাণ ব্যতিরেকে বান্দার পক্ষে ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ লাভ করা সম্ভব নয়। আমলের মাধ্যমে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ফরজ বিধানের বাস্তবায়ন এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই অন্তরের শুদ্ধতা লাভ হয়। এসবের প্রারম্ভেই হলো, তাওহিদ তথা আল্লাহর একাত্মবাদকে ধারণ, তার জন্য একনিষ্ঠ হওয়া, তার প্রতি পূর্ণ ভরসা ও নির্ভরতার সঙ্গে তার কাছে সাহায্য চাওয়া। আপন রবকে ভালোবাসা, তার স্মরণ, তার প্রতি আস্থা রাখা এবং তার সুশীতল রহমতের ছায়ায় শান্তি খোঁজা। ভালোবাসা ও ভয় এবং আশা ও ভরসা একমাত্র তার জন্য বরাদ্দ করা। তখনই মহান আল্লাহ বান্দার যাবতীয় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি এবং তার যাবতীয় পুণ্য ও ভালো কাজের সংকল্প ও ইচ্ছাপূরণের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। যার অন্তর আল্লাহ পানে যুক্ত থাকে, রবের আনুগত্য এবং তার আদেশ ও নির্দেশাবলি মেনে চলায় অন্যরকম সুখ ও অদৃশ্য স্বাদ লাভে করে সে।
আত্মশুদ্ধির অন্যতম একটি হলো, তওবার মাধ্যমে গোনাহমুক্ত হতে নফসের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। অধিক পরিমাণে তওবা ও ইস্তেগফার করা। রবের কাছে খাঁটি ইমান, ভালো কাজের তওফিক ও তাতে অটল-অবিচলতা কামনা করা। আল্লাহর প্রতি বান্দার দাসত্ব ও অসহায়ত্ব যত বেশি বৃদ্ধি পাবে, ততই নিজেকে হেয়জ্ঞানের বিষয়টি বাড়তে থাকে। তখন তো তার কলবের সম্পর্ক একমাত্র আল্লাহর সঙ্গেই হয়ে যায়।
আগের নেককার ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে মুনাফেকির ভয় করতেন বেশি। হজরত মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ আশ-শিখখির বলেন, সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে গর্বের সঙ্গে সকাল করার চেয়ে পুরোরাত ঘুমিয়ে সকালটা অনুতপ্ত অবস্থায় অতিবাহিত করা আমার কাছে অধিক পছন্দের। যার ভেতরে নিজ আমলের প্রতি সন্তুষ্টি ভাব থাকে, তার আমল আসমানে পৌঁছে না। আমলকারী ও তাসবিহ পাঠকারীর হইচই আওয়াজ থেকে অপরাধীদের কান্না ও ভগ্নহৃদয় আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দের। এরূপ ব্যক্তি সদা আল্লাহর সম্মুখে মস্তক অবনতকারী। লজ্জা ও অনুশোচনায় সে তার মাথা আসমানের দিকে ওঠাতে পারে না।
ইমানি স্বাদ ও সুখ লাভের অন্যতম ও শ্রেষ্ঠ একটি মাধ্যম হলো দোয়া। এটি এরূপ এক অস্ত্র, যা কখনো তেজহীন হয় না। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেন, আর আমি আপনার কাছে এরূপ নেয়ামত চাই যা কখনো ফুরিয়ে যাবে না। চোখ শীতলকারী এরূপ জিনিস চাই, যা কখনো নাই হবে না। আহমাদ
প্রকৃত ভালোবাসা হৃদয়ে আগ্রহ ও উদ্দীপনার উন্মেষ ঘটায়। দুনিয়ার সবচেয়ে মজার একটি কাজ হলো, একেকটি ইস্তেগফার। যেমন আখেরাতের শ্রেষ্ঠ ও সেরা আনন্দ হলো আল্লাহর দর্শন। নবী করিম (সা.) এই দুটোকে দোয়ার মধ্যে একীভূত করে বলেন, হে আল্লাহ! আমরা আপনার দর্শন লাভে সেই স্বাদ পাওয়ার প্রার্থনা করছি। কামনা করছি আপনার সাক্ষাতের সেই তুমুল আগ্রহ।
এই যখন আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমানি স্বাদ ও সুখ লাভের নানা আয়োজন। কিন্তু এসব থেকে বঞ্চিত থাকার কিছু মাধ্যমও রয়েছে। প্রতিবন্ধক ওই বিষয় হলো গোনাহ ও অপরাধ। গোনাহ ব্যক্তির অন্তরকে কঠোর ও নির্দয় করে তোলে। কোনো মানুষ যখন নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি তার চোখ ফেরায়, এতে তার চোখের নূর কেড়ে নেওয়া হয়। অন্যায় কাজে জবানকে ব্যবহার করে, তখন তার হৃদয়ের স্বচ্ছতা কমে যায়। লোভে পড়ে সন্দেহপূর্ণ কিছুকে প্রাধান্য দিলে, তার ভেতর আঁধারে ছেয়ে যায়। এ কারণে সে রাতের তাহাজ্জুদ এবং মোনাজাতের সেই সে স্বাদ থেকে মাহরুম হয়।
মহান আল্লাহকে ভয় করুন। জেনে রাখুন, দুশ্চিন্তা, দুর্দশা, হতাশা, সংকট আর অভাব কখনো কখনো কারও জন্য দুনিয়ার নগদ শাস্তি। আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, তার দিকে প্রত্যাবর্তন, তার প্রতি সন্তুষ্টি জ্ঞাপন, তার ভালোবাসায় অন্তর পূর্ণ থাকা, তার স্মরণে সদা জবান জারি থাকা এবং তার পরিচয় লাভে আনন্দ ও খুশির প্রকাশ বান্দার জন্য দুনিয়ায় অগ্রিম পুরস্কার। এসব তার জন্য যেন নগদ জান্নাত এবং সুখময় জীবনের অংশবিশেষ। যে জীবনের সঙ্গে অন্য কোনো জীবনের তুলনা হতে পারে না। গোনাহ ও অন্যায়কে পরিত্যাগের মাধ্যমে অন্তর প্রকৃত জীবন লাভ করে। আর জীবন্ত অন্তরের মাধ্যমে বান্দা ইমান ও আমলের প্রকৃত স্বাদ লাভ করে।
১৪ জানুয়ারি মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবা।
অনুবাদ করেছেন নাজমুল হুদা
শেয়ার করুন
শায়খ ড. সালেহ বিন হুমাইদ | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

সহজ ও হালকা কাজের প্রতি মানুষের অন্তর সদা ধাবমান। অন্যদিকে শরিয়ত আরোপিত বিধানাবলি এবং কঠিন আমলের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ ও অবহেলা বেশি। তবে কল্যাণ আশ্রয়ী ব্যক্তি নিজেকে সেরা ও শ্রেষ্ঠ আমলের প্রতি ধাবিত করে। ফলে সাফল্যের চূড়ান্ত সীমায় উন্নীত হতে প্রত্যাশী হয়। এভাবে নফস যখন মর্যাদার নাগাল পেয়ে যায়, তখন হীন ও অপমানিত বিষয়ের প্রতি তার অবজ্ঞা তৈরি হয়। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘আর যে ব্যক্তি আখেরাত (এর লাভ) চায় এবং তা অর্জনের জন্য যথোচিত প্রচেষ্টা করে যাওয়ার সঙ্গে সে যদি (প্রকৃত) মুমিন হয়, তবে এরূপ লোকের চেষ্টার পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হবে।’ সুরা ইসরা : ১৯
অভ্যাসবশত মানুষের জবান চুপ থাকার নয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো স্থির থাকে না; চিন্তাও এক গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। তাই এসবকে ভালো ও সেরা সেরা কাজ দিয়ে ব্যস্ত না রাখা হলে স্বভাবতই তখন অতিশয় তুচ্ছ ও অপকারী কর্মগুলো সে স্থান দখল করে নেয়। পুণ্যের কাজে দেহ-মন-মস্তিষ্ক না খাটালে তা মন্দের দিকেই পরিচালিত হয়। জ্ঞানীদের মতে, প্রকৃত সুখ পায়ে মাড়িয়ে দৈহিক সুখ লাভে ব্যস্ত থাকা ব্যক্তি আর দেহকে কষ্ট দিয়ে আত্মিক সুখ লাভের প্রচেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তির মাঝে ফারাক রয়েছে। মনে রাখতে হবে, কষ্টকর বস্তু দিয়ে জান্নাতকে আর প্রবৃত্তির নিকৃষ্ট বাসনা দিয়ে জাহান্নামকে বেষ্টন করে রাখা হয়েছে।
আনুগত্যের মাধ্যমে অন্তরে অন্যরকম এক আনন্দ ও উপভোগের উপলব্ধি, আল্লাহ ও তার রাসুলের সন্তুষ্টি লাভের আশায় যাবতীয় কষ্ট ও দুঃখ সয়ে যাওয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় কিছুর ওপর আখেরাতকে প্রাধান্য দেওয়ার নামই হলো ইমানি স্বাদ হাসিল করা। ইমানি উপলব্ধি এবং ইবাদতে আনন্দ লাভ। এসব অন্তরের প্রশান্তির বার্তাবাহক।
ইমানের স্বাদ এটি আল্লাহর আনুগত্যের ওপর অটল থাকার চাবিস্বরূপ। ফেতনার সম্মুখে অবিচল থাকার রহস্যের ভেতর ইবাদতের স্বাদ নিহিত। ইমানি স্বাদ ও ইবাদতের প্রকৃত মজা লাভের স্বীকৃত উপায়ের অন্যতম হলো, অন্তরের পবিত্রকরণ এবং পরিশুদ্ধতা। ময়লা পাত্র থেকে পানি পান করা ব্যক্তি কখনো তার কাক্সিক্ষত স্বাদ পায় না, যার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে সে। তার হৃদয়কে ধুয়ে-মুছে পবিত্র করে এরপর তাতে স্বচ্ছ পানি ঢালে; তো শিগগিরই সে ইমানের পূর্ণ স্বাদ ফিরে পাবে। গোনাহের কদর্যতা, ভুলে ভরা আবর্জনা এবং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার দাগ দিয়ে যে অন্তর পূর্ণ, সে ব্যক্তির ইমানি উপলব্ধি লাভ আকাশকুসুম স্বপ্নই শুধু। বিশুদ্ধ হাদিসে এসেছে, তিনটি কাজ সম্পাদনকারী ব্যক্তিই ইমানের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করল। এক. যে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে এও স্বীকার করে নিল যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। দুই. পূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে নিজ সম্পদের জাকাত আদায় করল এবং তিন. নিজের আত্মশুদ্ধি করল। সুনানে আবু দাউদ
তা ছাড়া নবীজির দোয়াও ছিল, হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে তাকওয়া ঢেলে দিন এবং অন্তরকে পরিশুদ্ধ করুন। কারণ আপনিই এর শ্রেষ্ঠ পরিশুদ্ধকারী। আর অন্তরের অভিভাবক এবং তার একমাত্র রব আপনিই। বিশর বিন হারেস (রহ.) বলেন, নিজের ও প্রবৃত্তির মধ্যে লৌহ-প্রাচীর নির্মাণ ব্যতিরেকে বান্দার পক্ষে ইবাদতের প্রকৃত স্বাদ লাভ করা সম্ভব নয়। আমলের মাধ্যমে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ফরজ বিধানের বাস্তবায়ন এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই অন্তরের শুদ্ধতা লাভ হয়। এসবের প্রারম্ভেই হলো, তাওহিদ তথা আল্লাহর একাত্মবাদকে ধারণ, তার জন্য একনিষ্ঠ হওয়া, তার প্রতি পূর্ণ ভরসা ও নির্ভরতার সঙ্গে তার কাছে সাহায্য চাওয়া। আপন রবকে ভালোবাসা, তার স্মরণ, তার প্রতি আস্থা রাখা এবং তার সুশীতল রহমতের ছায়ায় শান্তি খোঁজা। ভালোবাসা ও ভয় এবং আশা ও ভরসা একমাত্র তার জন্য বরাদ্দ করা। তখনই মহান আল্লাহ বান্দার যাবতীয় দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি এবং তার যাবতীয় পুণ্য ও ভালো কাজের সংকল্প ও ইচ্ছাপূরণের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবেন। যার অন্তর আল্লাহ পানে যুক্ত থাকে, রবের আনুগত্য এবং তার আদেশ ও নির্দেশাবলি মেনে চলায় অন্যরকম সুখ ও অদৃশ্য স্বাদ লাভে করে সে।
আত্মশুদ্ধির অন্যতম একটি হলো, তওবার মাধ্যমে গোনাহমুক্ত হতে নফসের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। অধিক পরিমাণে তওবা ও ইস্তেগফার করা। রবের কাছে খাঁটি ইমান, ভালো কাজের তওফিক ও তাতে অটল-অবিচলতা কামনা করা। আল্লাহর প্রতি বান্দার দাসত্ব ও অসহায়ত্ব যত বেশি বৃদ্ধি পাবে, ততই নিজেকে হেয়জ্ঞানের বিষয়টি বাড়তে থাকে। তখন তো তার কলবের সম্পর্ক একমাত্র আল্লাহর সঙ্গেই হয়ে যায়।
আগের নেককার ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে মুনাফেকির ভয় করতেন বেশি। হজরত মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ আশ-শিখখির বলেন, সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে গর্বের সঙ্গে সকাল করার চেয়ে পুরোরাত ঘুমিয়ে সকালটা অনুতপ্ত অবস্থায় অতিবাহিত করা আমার কাছে অধিক পছন্দের। যার ভেতরে নিজ আমলের প্রতি সন্তুষ্টি ভাব থাকে, তার আমল আসমানে পৌঁছে না। আমলকারী ও তাসবিহ পাঠকারীর হইচই আওয়াজ থেকে অপরাধীদের কান্না ও ভগ্নহৃদয় আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দের। এরূপ ব্যক্তি সদা আল্লাহর সম্মুখে মস্তক অবনতকারী। লজ্জা ও অনুশোচনায় সে তার মাথা আসমানের দিকে ওঠাতে পারে না।
ইমানি স্বাদ ও সুখ লাভের অন্যতম ও শ্রেষ্ঠ একটি মাধ্যম হলো দোয়া। এটি এরূপ এক অস্ত্র, যা কখনো তেজহীন হয় না। হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেন, আর আমি আপনার কাছে এরূপ নেয়ামত চাই যা কখনো ফুরিয়ে যাবে না। চোখ শীতলকারী এরূপ জিনিস চাই, যা কখনো নাই হবে না। আহমাদ
প্রকৃত ভালোবাসা হৃদয়ে আগ্রহ ও উদ্দীপনার উন্মেষ ঘটায়। দুনিয়ার সবচেয়ে মজার একটি কাজ হলো, একেকটি ইস্তেগফার। যেমন আখেরাতের শ্রেষ্ঠ ও সেরা আনন্দ হলো আল্লাহর দর্শন। নবী করিম (সা.) এই দুটোকে দোয়ার মধ্যে একীভূত করে বলেন, হে আল্লাহ! আমরা আপনার দর্শন লাভে সেই স্বাদ পাওয়ার প্রার্থনা করছি। কামনা করছি আপনার সাক্ষাতের সেই তুমুল আগ্রহ।
এই যখন আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমানি স্বাদ ও সুখ লাভের নানা আয়োজন। কিন্তু এসব থেকে বঞ্চিত থাকার কিছু মাধ্যমও রয়েছে। প্রতিবন্ধক ওই বিষয় হলো গোনাহ ও অপরাধ। গোনাহ ব্যক্তির অন্তরকে কঠোর ও নির্দয় করে তোলে। কোনো মানুষ যখন নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি তার চোখ ফেরায়, এতে তার চোখের নূর কেড়ে নেওয়া হয়। অন্যায় কাজে জবানকে ব্যবহার করে, তখন তার হৃদয়ের স্বচ্ছতা কমে যায়। লোভে পড়ে সন্দেহপূর্ণ কিছুকে প্রাধান্য দিলে, তার ভেতর আঁধারে ছেয়ে যায়। এ কারণে সে রাতের তাহাজ্জুদ এবং মোনাজাতের সেই সে স্বাদ থেকে মাহরুম হয়।
মহান আল্লাহকে ভয় করুন। জেনে রাখুন, দুশ্চিন্তা, দুর্দশা, হতাশা, সংকট আর অভাব কখনো কখনো কারও জন্য দুনিয়ার নগদ শাস্তি। আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া, তার দিকে প্রত্যাবর্তন, তার প্রতি সন্তুষ্টি জ্ঞাপন, তার ভালোবাসায় অন্তর পূর্ণ থাকা, তার স্মরণে সদা জবান জারি থাকা এবং তার পরিচয় লাভে আনন্দ ও খুশির প্রকাশ বান্দার জন্য দুনিয়ায় অগ্রিম পুরস্কার। এসব তার জন্য যেন নগদ জান্নাত এবং সুখময় জীবনের অংশবিশেষ। যে জীবনের সঙ্গে অন্য কোনো জীবনের তুলনা হতে পারে না। গোনাহ ও অন্যায়কে পরিত্যাগের মাধ্যমে অন্তর প্রকৃত জীবন লাভ করে। আর জীবন্ত অন্তরের মাধ্যমে বান্দা ইমান ও আমলের প্রকৃত স্বাদ লাভ করে।
১৪ জানুয়ারি মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবা।
অনুবাদ করেছেন নাজমুল হুদা