‘এক দিনের জন্য আমাদের কদর বাড়ে’
জান্নাতুল ফেরদৌসী | ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০
‘গতবারের নির্বাচনের আগে এসে এমপি সাহেব (মহাজোটের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ) বলেছিলেন, সব সমস্যা দেখবেন তিনি। এরপর আর কোনো খবর নেননি আমাদের। সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা। এবার এসেও একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আসলে এক দিনের জন্য আমাদের কাছে আসেন তারা। এক দিনের জন্যই আমাদের কদর বাড়ে।’
কথাগুলো বলছিলেন চঞ্চল রবিদাস। ঢাকা-৬ আসনের এলাকা ওয়ারীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের রবিদাসপাড়ায় বসবাস তার। এবারের ভোটে প্রার্থীদের কাছে দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে এভাবেই ক্ষোভের কথা জানান তিনি।
চঞ্চল জানান, চার বছর আগে বর্তমান সংসদ সদস্য ফিরোজ রশীদকে অনেক টাকা দিয়ে এলাকায় গ্যাস-সংযোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার ভাষ্য, ‘বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঠ-বাঁশ সংগ্রহ করে আমরা রান্না করি। সেটা যে কতটা কষ্টের, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সরকারের কাছে আমার দাবি একটাই, এই এলাকায় গ্যাস-সংযোগ চাই। অন্তত পেটের ক্ষুধা তো মেটাতে পারব।’
শুধু চঞ্চল নয়, রবিদাসপাড়ার আরো অনেকের অভিযোগ একই ধরনের। তাদের ভাষ্য, নির্বাচনের পর কেউই খবর রাখে না তাদের। তারা চামড়ার কাজ, ঝাড়– দেওয়া কিংবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করায় স্কুল-কলেজ-কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। নিজস্ব এলাকার বাইরে তাদের বসবাসের সুযোগ নেই। এমনকি জায়গা-জমি পর্যন্ত কিনতে দেওয়া হয় না। বসতবাড়ি উচ্ছেদ, জমি বেহাত কিংবা ভয়ভীতির সঙ্গে তাদের নিত্য বসবাস।
ওই পাড়ার বাসিন্দা রতন রবিদাস অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচন আসছে। এখন এমপি এসে আমাদের বলছেন, দুই বিঘা জমিতে বিল্ডিং করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু আমরা তো অন্য জায়গায় যেতে চাই না। ৭৬ বছর ধরে এখানে আছি। আমরা এখানেই থাকতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ভোট দিলেও নৌকায় দিব, না দিলেও নৌকায় দিব। কষ্ট হলো প্রধানমন্ত্রী কখনো আমাদের এলাকায় আসেন নাই। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই। আমাদের সমস্ত অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই।’
ওয়ারী এলাকা জুতার কাজ করেন চানমোহন রবিদাস। তিনি বলেন, ‘৭৬ বছর ধরে আমরা এখানে আছি। এখনো এই জায়গা আমাদের নামে করে দেওয়া হয়নি। আমরা নিম্ন শ্রেণির, লেখাপড়া কম। আমরা অতশত বুঝি না। এইটুকু বুঝি যে এই বসতভিটা ছেড়ে কোথাও যাব না। আমরা চাই এই বসতভিটা আমাদের চিরস্থায়ী করা হোক।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্যাস-সংযোগ নিতে গিয়ে আমরা অনেক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আবার ফিরোজ রশীদ বলছেন, কেরানীগঞ্জে আমাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আমরা ফ্ল্যাট চাই না।’
ওই পাড়ায় একটা মন্দির নির্মাণের দাবি জানান আরেক বাসিন্দা সুমন রবিদাস। তিনি বলেন, ‘কয়েকবার নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু অর্থসংকটের কারণে মন্দির নির্মাণ করতে পারিনি। এর আগের এমপি মিজানুর রহমান খান দীপু আমাদের বলেছিলেন যে, তিনি কিছু অনুদান দেবেন। কিন্তু নির্বাচনের পরে তিনি মারা গেছেন। মন্দির নির্মাণ আর হয়নি।’
এবার ফিরোজ রশীদের প্রচার কেমন জানতে চাইলে সুমন বলেন, ‘প্রচারণায় এসে আমাদের মহল্লায় ঢোকেননি। পাশের বড় রোডে দাঁড়িয়ে বলেছেন, এবার জিতলে সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। কতটুকু করবেন কে জানে!’
রাজনৈতিক দলগুলো এবারের নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যাবর্তনসহ বেশ কয়েকটি নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারের ৩.২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বেদে, হরিজন, দলিতসহ সব জনগোষ্ঠীর মানুষকে উন্নত জীবন জীবিকার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হয়।
জাতীয় পার্টির ইশতেহারে সাধারণ নির্বাচনের বাইরেও সংখ্যালঘুদের জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষিত করা, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার অনুসারে তাদের চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তার নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের মানবিক মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির ইশতেহারে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে।
এসব ইশতেহারের বিষয়ে বাংলাদেশ রবিদাস ফোরামের সভাপতি শংকর রবিদাস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি তো প্রতিবারই দেখি। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। তবে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা আশাবাদী। তিনি বিজয়ী হলে আমাদের দিকে চাইবেন নিশ্চয়।’
শেয়ার করুন
জান্নাতুল ফেরদৌসী | ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০

‘গতবারের নির্বাচনের আগে এসে এমপি সাহেব (মহাজোটের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ) বলেছিলেন, সব সমস্যা দেখবেন তিনি। এরপর আর কোনো খবর নেননি আমাদের। সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা। এবার এসেও একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আসলে এক দিনের জন্য আমাদের কাছে আসেন তারা। এক দিনের জন্যই আমাদের কদর বাড়ে।’
কথাগুলো বলছিলেন চঞ্চল রবিদাস। ঢাকা-৬ আসনের এলাকা ওয়ারীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের রবিদাসপাড়ায় বসবাস তার। এবারের ভোটে প্রার্থীদের কাছে দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে এভাবেই ক্ষোভের কথা জানান তিনি। চঞ্চল জানান, চার বছর আগে বর্তমান সংসদ সদস্য ফিরোজ রশীদকে অনেক টাকা দিয়ে এলাকায় গ্যাস-সংযোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তার ভাষ্য, ‘বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঠ-বাঁশ সংগ্রহ করে আমরা রান্না করি। সেটা যে কতটা কষ্টের, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সরকারের কাছে আমার দাবি একটাই, এই এলাকায় গ্যাস-সংযোগ চাই। অন্তত পেটের ক্ষুধা তো মেটাতে পারব।’ শুধু চঞ্চল নয়, রবিদাসপাড়ার আরো অনেকের অভিযোগ একই ধরনের। তাদের ভাষ্য, নির্বাচনের পর কেউই খবর রাখে না তাদের। তারা চামড়ার কাজ, ঝাড়– দেওয়া কিংবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করায় স্কুল-কলেজ-কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। নিজস্ব এলাকার বাইরে তাদের বসবাসের সুযোগ নেই। এমনকি জায়গা-জমি পর্যন্ত কিনতে দেওয়া হয় না। বসতবাড়ি উচ্ছেদ, জমি বেহাত কিংবা ভয়ভীতির সঙ্গে তাদের নিত্য বসবাস। ওই পাড়ার বাসিন্দা রতন রবিদাস অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচন আসছে। এখন এমপি এসে আমাদের বলছেন, দুই বিঘা জমিতে বিল্ডিং করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু আমরা তো অন্য জায়গায় যেতে চাই না। ৭৬ বছর ধরে এখানে আছি। আমরা এখানেই থাকতে চাই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ভোট দিলেও নৌকায় দিব, না দিলেও নৌকায় দিব। কষ্ট হলো প্রধানমন্ত্রী কখনো আমাদের এলাকায় আসেন নাই। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই। আমাদের সমস্ত অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই।’ ওয়ারী এলাকা জুতার কাজ করেন চানমোহন রবিদাস। তিনি বলেন, ‘৭৬ বছর ধরে আমরা এখানে আছি। এখনো এই জায়গা আমাদের নামে করে দেওয়া হয়নি। আমরা নিম্ন শ্রেণির, লেখাপড়া কম। আমরা অতশত বুঝি না। এইটুকু বুঝি যে এই বসতভিটা ছেড়ে কোথাও যাব না। আমরা চাই এই বসতভিটা আমাদের চিরস্থায়ী করা হোক।’ তিনি আরো বলেন, ‘গ্যাস-সংযোগ নিতে গিয়ে আমরা অনেক টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন আবার ফিরোজ রশীদ বলছেন, কেরানীগঞ্জে আমাদের ফ্ল্যাট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু আমরা ফ্ল্যাট চাই না।’ ওই পাড়ায় একটা মন্দির নির্মাণের দাবি জানান আরেক বাসিন্দা সুমন রবিদাস। তিনি বলেন, ‘কয়েকবার নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু অর্থসংকটের কারণে মন্দির নির্মাণ করতে পারিনি। এর আগের এমপি মিজানুর রহমান খান দীপু আমাদের বলেছিলেন যে, তিনি কিছু অনুদান দেবেন। কিন্তু নির্বাচনের পরে তিনি মারা গেছেন। মন্দির নির্মাণ আর হয়নি।’ এবার ফিরোজ রশীদের প্রচার কেমন জানতে চাইলে সুমন বলেন, ‘প্রচারণায় এসে আমাদের মহল্লায় ঢোকেননি। পাশের বড় রোডে দাঁড়িয়ে বলেছেন, এবার জিতলে সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। কতটুকু করবেন কে জানে!’ রাজনৈতিক দলগুলো এবারের নির্বাচনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যাবর্তনসহ বেশ কয়েকটি নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ইশতেহারের ৩.২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বেদে, হরিজন, দলিতসহ সব জনগোষ্ঠীর মানুষকে উন্নত জীবন জীবিকার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলা হয়।
জাতীয় পার্টির ইশতেহারে সাধারণ নির্বাচনের বাইরেও সংখ্যালঘুদের জন্য ৩০টি আসন সংরক্ষিত করা, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার অনুসারে তাদের চাকরি ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তার নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের মানবিক মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির ইশতেহারে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে।
এসব ইশতেহারের বিষয়ে বাংলাদেশ রবিদাস ফোরামের সভাপতি শংকর রবিদাস দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি তো প্রতিবারই দেখি। কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। তবে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা আশাবাদী। তিনি বিজয়ী হলে আমাদের দিকে চাইবেন নিশ্চয়।’