রেলের বোঝা ডেমু ট্রেন
সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০
রেলে যাত্রী সেবার মান বাড়াতে চীন থেকে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন কেনা হয়েছিল। ২০১৩ সালে কেনা এসব ডেমু ট্রেন এখন রেলওয়ের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ডেমুর ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর নির্ধারিত থাকলেও মাত্র পাঁচ-সাত বছরেই অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ২০ সেট ডেমুর মধ্যে অর্ধেকই চলাচল অনুপযোগী। যদিও দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে এসব ডেমু চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিদেশ থেকে এসব যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রেলওয়ে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে চীনের তাংসাং রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু কেনার জন্য চুক্তি হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শুল্ক ও কর। এছাড়া প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ ও বিদেশ ভ্রমণ-ভাতাসহ ডেমু কেনা বাবদ মোট ব্যয় হয় ৬৫৪ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে এসব ডেমু ট্রেন দেশে আসে। ডেমু কিনতে পুরো টাকা খরচ করা হয় সরকারের রাজস্ব তহবিল থেকে। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমলাপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রথম ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করেন। এরপর একে একে ঢাকা-টঙ্গী (২২ কিলোমিটার), ঢাকা-জয়দেবপুর (দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার), জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ (৯০ কিলোমিটার), সিলেট-আখাউড়া (১৭৬ কিলোমিটার), ঢাকা-আখাউড়া (১২০ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-কুমিল্লা (১৫৫ কিলোমিটার), নোয়াখালী-লাকসাম (৪৮ কিলোমিটার), লাকসাম-চাঁদপুর (৪৯ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-নাজিরহাট (৩৭ কিলোমিটার), পার্বতীপুর-লালমনিরহাট (৭১ কিলোমিটার) এবং পার্বতীপুর-পঞ্চগড় (১৩২ কিলোমিটার) রুটে ২০ সেট ডেমু চলাচল শুরু করে। যদিও এসব ডেমু ট্রেন সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার দূরত্বে চলাচল উপযোগী।
রেলওয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমু ট্রেন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক কর্মকর্তা জানান, চীন থেকে এই ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনার সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এমনকি এসব ডেমু ট্রেন আমদানি করার সময় রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মতামত নেওয়া হয়নি। তাই সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা বাবদ ৬৫৪ কোটি টাকা এখন অনেকটা জলেই যাচ্ছে। এমনকি এসব ডেমু ট্রেন অনেকটা লোকসান দিয়েই গত সাত বছর ধরে চলাচল করছে।
রেলের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে যখন ১০ সেট ডেমু চলাচল করত তখন দুয়েক দিন পরপর একাধিক ট্রেনে ত্রুটি দেখা দিত। তাই পুরোদমে এসব ট্রেন চলাচল করা যেত না। এমনকি এসব ডেমু ট্রেন ২০-৩০ কিলোমিটার দূরত্বে চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ চলত ৬০-১২০ কিলোমিটার দূরত্বে। অতিরিক্ত দূরত্বের কারণে এসব ট্রেনে সহসাই ত্রুটি দেখা দিত। বড় ধরনের ত্রুটি হওয়া বেশ কয়েকটি এখন চলাচল অনুপযোগী। কেননা ডেমু ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে যেসব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম প্রয়োজন, তা দেশে নেই। তাই এসব যন্ত্রপাতির অভাবে মেরামত করতে না পারায় অনেক ডেমু ট্রেন ওয়ার্কশপে অচল হয়ে পড়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অকেজো ১০ সেট ডেমু ট্রেনের মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে আট সেট ও পশ্চিমাঞ্চলে দুই সেট রয়েছে। পূর্বাঞ্চলের আট সেটের মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকো শেডে চারটি এবং ঢাকা লোকো শেডে চারটি রয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী এফএম মহিউদ্দিন জানান, করোনা সংক্রমণের কারণে কয়েকটি রুটে এখন ডেমু ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে লাকসাম-নোয়াখালী, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে দুটি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটে ডেমু ট্রেন চলাচল করছে। এছাড়া শিগগিরই চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটেও ডেমু ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
অর্ধেক ডেমু ট্রেন অকেজো হয়ে পড়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে এ রেল কর্মকর্তা বলেন, ‘পূর্বাঞ্চলের ১৮ সেটের মধ্যে ১০ সেট ডেমু ট্রেন সচল রয়েছে। বিদেশ থেকে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি পেলেই বাকি আট সেট ডেমু ট্রেনও চালু করা হবে।’
ডেমু ট্রেনের বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
পরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক সরদার শাহাদাত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শেয়ার করুন
সুবল বড়ুয়া, চট্টগ্রাম | ২৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০

রেলে যাত্রী সেবার মান বাড়াতে চীন থেকে ৬৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন কেনা হয়েছিল। ২০১৩ সালে কেনা এসব ডেমু ট্রেন এখন রেলওয়ের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ডেমুর ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর নির্ধারিত থাকলেও মাত্র পাঁচ-সাত বছরেই অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ২০ সেট ডেমুর মধ্যে অর্ধেকই চলাচল অনুপযোগী। যদিও দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট রেল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে এসব ডেমু চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিদেশ থেকে এসব যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
রেলওয়ে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে চীনের তাংসাং রেলওয়ে ভেহিকেল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু কেনার জন্য চুক্তি হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় শুল্ক ও কর। এছাড়া প্রায় ৩০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ ও বিদেশ ভ্রমণ-ভাতাসহ ডেমু কেনা বাবদ মোট ব্যয় হয় ৬৫৪ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে এসব ডেমু ট্রেন দেশে আসে। ডেমু কিনতে পুরো টাকা খরচ করা হয় সরকারের রাজস্ব তহবিল থেকে। পরবর্তীকালে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমলাপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে প্রথম ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করেন। এরপর একে একে ঢাকা-টঙ্গী (২২ কিলোমিটার), ঢাকা-জয়দেবপুর (দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার), জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ (৯০ কিলোমিটার), সিলেট-আখাউড়া (১৭৬ কিলোমিটার), ঢাকা-আখাউড়া (১২০ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-কুমিল্লা (১৫৫ কিলোমিটার), নোয়াখালী-লাকসাম (৪৮ কিলোমিটার), লাকসাম-চাঁদপুর (৪৯ কিলোমিটার), চট্টগ্রাম-নাজিরহাট (৩৭ কিলোমিটার), পার্বতীপুর-লালমনিরহাট (৭১ কিলোমিটার) এবং পার্বতীপুর-পঞ্চগড় (১৩২ কিলোমিটার) রুটে ২০ সেট ডেমু চলাচল শুরু করে। যদিও এসব ডেমু ট্রেন সর্বোচ্চ ২০ কিলোমিটার দূরত্বে চলাচল উপযোগী।
রেলওয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমু ট্রেন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক কর্মকর্তা জানান, চীন থেকে এই ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনার সময় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। এমনকি এসব ডেমু ট্রেন আমদানি করার সময় রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মতামত নেওয়া হয়নি। তাই সরকারের রাজস্ব খাত থেকে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কেনা বাবদ ৬৫৪ কোটি টাকা এখন অনেকটা জলেই যাচ্ছে। এমনকি এসব ডেমু ট্রেন অনেকটা লোকসান দিয়েই গত সাত বছর ধরে চলাচল করছে।
রেলের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে যখন ১০ সেট ডেমু চলাচল করত তখন দুয়েক দিন পরপর একাধিক ট্রেনে ত্রুটি দেখা দিত। তাই পুরোদমে এসব ট্রেন চলাচল করা যেত না। এমনকি এসব ডেমু ট্রেন ২০-৩০ কিলোমিটার দূরত্বে চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ চলত ৬০-১২০ কিলোমিটার দূরত্বে। অতিরিক্ত দূরত্বের কারণে এসব ট্রেনে সহসাই ত্রুটি দেখা দিত। বড় ধরনের ত্রুটি হওয়া বেশ কয়েকটি এখন চলাচল অনুপযোগী। কেননা ডেমু ট্রেন রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে যেসব যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম প্রয়োজন, তা দেশে নেই। তাই এসব যন্ত্রপাতির অভাবে মেরামত করতে না পারায় অনেক ডেমু ট্রেন ওয়ার্কশপে অচল হয়ে পড়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অকেজো ১০ সেট ডেমু ট্রেনের মধ্যে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে আট সেট ও পশ্চিমাঞ্চলে দুই সেট রয়েছে। পূর্বাঞ্চলের আট সেটের মধ্যে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী লোকো শেডে চারটি এবং ঢাকা লোকো শেডে চারটি রয়েছে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী এফএম মহিউদ্দিন জানান, করোনা সংক্রমণের কারণে কয়েকটি রুটে এখন ডেমু ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে লাকসাম-নোয়াখালী, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে দুটি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটে ডেমু ট্রেন চলাচল করছে। এছাড়া শিগগিরই চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটেও ডেমু ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
অর্ধেক ডেমু ট্রেন অকেজো হয়ে পড়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে এ রেল কর্মকর্তা বলেন, ‘পূর্বাঞ্চলের ১৮ সেটের মধ্যে ১০ সেট ডেমু ট্রেন সচল রয়েছে। বিদেশ থেকে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি পেলেই বাকি আট সেট ডেমু ট্রেনও চালু করা হবে।’
ডেমু ট্রেনের বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
পরে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক সরদার শাহাদাত আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।