খাদ্য মজুদে অশনিসংকেত
আরিফুর রহমান তুহিন | ১১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০
চলতি মৌসুমে দুই মাস আগে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ আমন ধান ও চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৮ লাখ টনের হলেও গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২৯ হাজার ৫৬১ টন চালের সমপরিমাণ ধান-চাল সংগৃহীত হয়েছে। এই সময় পর্যন্ত চাল সংগ্রহের চুক্তি হয়েছে মাত্র দেড় লাখ টনের। চলতি বোরো মৌসুমেও ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম হয়েছিল। টানা দুই মৌসুমে সংগ্রহ কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ায় দিনে দিনে ফাঁকা হচ্ছে সরকারের খাদ্য গুদাম। ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি খাদ্য গুদামে মজুদ ছিল মাত্র ৫ লাখ ৩১ হাজার টন চাল।
এদিকে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত চাল না থাকায় বাজারের এখন একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চালকল মালিকদের হাতে। মোটা চালের কেজিও খুচরায় বিকোচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। এমতাবস্থায় আমদানিতেই একমাত্র সমাধান দেখছে সরকার। ইতিমধ্যে সরকারি পর্যায়ে সাড়ে চার লাখ টন এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমদানিতে শুল্কও ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. আনিসুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বোরো নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। এখন আমরা আমন নিয়ে ভাবছি। বেশকিছু মিল মালিক আমাদের চাল দেওয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহের সময় আছে। এর মধ্যে বাজারে দামটা কিছুটা কমলে হয়তো আরও কিছু চাল কেনার ব্যাপারে আমরা চুক্তিবদ্ধ হতে পারব। দেখা যাক কী হয়। আর সরকারিভাবে যে চাল আমদানি হবে, সেগুলো খাদ্য অধিদপ্তরের যেসব কর্মসূচি আছে সেখানে ব্যবহার করা হবে। বেসরকারিভাবে আমদানিকৃত চাল খুচরা বাজারে বিক্রি হবে।’
চলতি আমন মৌসুমে কেজিপ্রতি ২৬ টাকা দরে সরাসরি কৃষকদের থেকে ২ লাখ টন ধান, ৩৭ টাকা কেজি দরে চালকল মালিকদের ৬ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৬ টাকা কেজিতে ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়। সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারদর বেশি থাকায় কৃষক-চালকলগুলো তেমন আগ্রহ দেখায়নি। ৭ নভেম্বর থেকে ধান ও ১৫ নভেম্বর থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছিল। এখন পর্যন্ত দেড় লাখ টন চাল দেওয়ার বিষয়ে মিল মালিকরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৭ হাজার ৬৮৮ টন আমন সিদ্ধ চাল, ১ হাজার ২৫ টন আতপ চাল এবং ১ হাজার ২৭৬ টন আমন ধান সংগৃহীত হয়েছে, যা চালের আকারে সর্বমোট ২৯ হাজার ৫৬১ টন। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে। এই সময়ের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ দেড় লাখ টন সংগ্রহ সম্ভব হবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।
গত বোরো মৌসুমে খাদ্য মন্ত্রণালয় ২৬ টাকা কেজি দরে বোরো ধান, ৩৬ টাকা কেজিতে সিদ্ধ ও আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম পর্যায়ে মোট ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন বোরো ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে আরও দুই লাখ টন বাড়িয়ে সাড়ে ২১ লাখে উন্নীত করা হয়। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছিল না। পরে সময় বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ ধান-চাল সংগৃহীত হয়েছিল তা চালের আকারে ৬ লাখ ৬৮ হাজার টন সিদ্ধ চাল এবং ১ লাখ টন আতপ চাল হয়েছে।
টানা দুই মৌসুমে চাল সংগ্রহ ব্যর্থ হওয়ায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মজুদ দিনে দিনে কমছে। গত ৭ জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী সরকারের কাছে মাত্র ৫ লাখ ৩১ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। অথচ গত মার্চের শুরুতে সরকারি গুদামে চালের মজুদ ছিল ১৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। মধ্য জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৫৪ হাজার টনে। অথচ ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সরকারে মজুদ ছিল ১২ লাখ ৫৬ হাজার টন। বোরো সংগ্রহ শুরুর পর কিছুটা বেড়ে ৪ জুলাই সাড়ে ৯ লাখ টনে পৌঁছায়। কিন্তু বোরো সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় দিনে দিনে মজুদের পরিমাণ কমে।
গত আগস্ট মাসে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমানারা খানুম বলেছিলেন, ‘এখন আমাদের চাল ও গম মিলিয়ে এখন ১২ লাখ ৪৮ হাজার টন মজুদ রয়েছে। তা দিয়ে আমাদের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে। কিন্তু এরপর আমাদের গুদাম খালি হয়ে যাবে। তখন আমাদের আরও ১০ লাখ টনের মতো ঘাটতি দেখা যাবে। সে ঘাটতি পূরণের জন্য আমাদের ১৫ লাখ টনের মতো আমদানি করতে হবে।’ এমন আশঙ্কার পরেও সময়মতো মজুদ বাড়াতে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাজারে চালের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকে। পরে ডিসেম্বরে এসে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই চাল এখনো দেশে আসতে পারেনি। ফলে বাজার কার্যত নিয়ন্ত্রণহীনই রয়ে গেছে। যদিও মন্ত্রণালয় আশা করছে, এ মাসের মধ্যেই আমদানির বড় একটি অংশ চলে আসলে বাজার ও মজুদ পরিস্থিতি দুটোরই উন্নতি হবে।
সরকারের আমদানি পরিস্থিতি : সরকারের মজুদ কমা ও বাজারে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পর অবশেষে চাল আমদানিতে মনোযোগী হয়েছে সরকার। কমানো হয়েছে শুল্ক। ভারত থেকে সরকার টু সরকার (জিটুজি) প্রক্রিয়ায় দেড় লাখ টন ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে আরও তিন লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
ইতিমধ্যে ১০ হাজার টন চাল দেশে প্রবেশ করেছে দেশ রূপান্তরকে এমন তথ্য দিয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘জানুয়ারির মধ্যেই আরও অন্তত এক লাখ টন চাল দেশে প্রবেশ করবে। বাকিগুলোও ফেব্রুয়ারিতে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ এছাড়া বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ভারত থেকে দুই লাখ টন এবং সিঙ্গাপুর থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন মিলেছে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে।
৫ শর্তে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি : এদিকে আমনের দামে প্রভাব পড়বে এমন যুক্তিতে সরকার এতদিন খুচরা বাজারের জন্য চাল আমদানির অনুমোদন দিচ্ছিল না। তবে চালের দামের লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ৩ জানুয়ারি থেকে বেসরকারিভাবে খুচরা বাজারের জন্য চাল আমদানির অনুমোদন শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ৩ জানুয়ারি ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৫ হাজার টন, ৪ জানুয়ারি ১২টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন এবং ৫ জানুয়ারি ৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৭ জানুয়ারি ২০ হাজার টন চাল দিনাজপুরের হিলি বন্দর হয়ে ভারত থেকে প্রবেশ করেছে। তবে বন্দর থেকে তা এখনো ছাড় পায়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বেসরকারিভাবে চাল আমদানির ক্ষেত্রে সরকার কয়েকটি শর্ত আরোপ করেছে। আমদানিকৃত চাল অবশ্যই সিদ্ধ হতে হবে। এগুলো সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাংগাদানা নন-বাসমতি হতে হবে। বরাদ্দপত্র ইস্যুর ৭ দিনের মধ্যে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য (পোর্ট অব এন্ট্রিসহ) খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করতে হবে। ৫ হাজার টন বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খোলার ১০ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ২০ দিনের মধ্যে সমুদয় চাল দেশের বাজারজাত করতে হবে। ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টন বরাদ্দপ্রাপ্তরা ঋণপত্র খোলার ১৫ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে সমুদয় চাল বাজারজাত করতে হবে।
তবে আমদানির অনুমোদনে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কিছুটা শিথিল চেয়েছে আমদানিকারকরা। বিশেষ করে আমদানির পুরো প্রক্রিয়া মাত্র এক মাসে শেষ করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারক মামুনুর রশীদ বলেন, চাল আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক লিমিটসহ সরকার অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে। এতে ছোট আমদানিকারকদের অনেকেই আমদানি করতে পারবে না। এছাড়া আমদানিকারকদের আবেদনপত্রে ফ্রুডগ্রেইন লাইসেন্স চাওয়া হয়েছে। এটি সাধারণত চালকল মালিকদের থাকে। যাদের জন্য বাজারে এমন অস্থিরতা তারাই আবার আমদানির অনুমোদন পাচ্ছে। তাই সরকারের উচিত বাজারের স্বার্থে আমদানির জন্য প্রদত্ত শর্ত প্রত্যাহার করা। একই সঙ্গে শুধু বড় বড় আমদানিকারকদের অনুমোদন না দিয়ে সবার জন্য চাল আমদানির পথ উন্মুক্ত করা।
শেয়ার করুন
আরিফুর রহমান তুহিন | ১১ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০

চলতি মৌসুমে দুই মাস আগে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ আমন ধান ও চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৮ লাখ টনের হলেও গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২৯ হাজার ৫৬১ টন চালের সমপরিমাণ ধান-চাল সংগৃহীত হয়েছে। এই সময় পর্যন্ত চাল সংগ্রহের চুক্তি হয়েছে মাত্র দেড় লাখ টনের। চলতি বোরো মৌসুমেও ধান-চাল সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম হয়েছিল। টানা দুই মৌসুমে সংগ্রহ কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ায় দিনে দিনে ফাঁকা হচ্ছে সরকারের খাদ্য গুদাম। ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারি খাদ্য গুদামে মজুদ ছিল মাত্র ৫ লাখ ৩১ হাজার টন চাল।
এদিকে সরকারের কাছে পর্যাপ্ত চাল না থাকায় বাজারের এখন একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ চালকল মালিকদের হাতে। মোটা চালের কেজিও খুচরায় বিকোচ্ছে ৫০-৫২ টাকায়। এমতাবস্থায় আমদানিতেই একমাত্র সমাধান দেখছে সরকার। ইতিমধ্যে সরকারি পর্যায়ে সাড়ে চার লাখ টন এবং বেসরকারি পর্যায়ে ৩ লাখ ৩০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আমদানিতে শুল্কও ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. আনিসুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বোরো নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। এখন আমরা আমন নিয়ে ভাবছি। বেশকিছু মিল মালিক আমাদের চাল দেওয়ার বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহের সময় আছে। এর মধ্যে বাজারে দামটা কিছুটা কমলে হয়তো আরও কিছু চাল কেনার ব্যাপারে আমরা চুক্তিবদ্ধ হতে পারব। দেখা যাক কী হয়। আর সরকারিভাবে যে চাল আমদানি হবে, সেগুলো খাদ্য অধিদপ্তরের যেসব কর্মসূচি আছে সেখানে ব্যবহার করা হবে। বেসরকারিভাবে আমদানিকৃত চাল খুচরা বাজারে বিক্রি হবে।’
চলতি আমন মৌসুমে কেজিপ্রতি ২৬ টাকা দরে সরাসরি কৃষকদের থেকে ২ লাখ টন ধান, ৩৭ টাকা কেজি দরে চালকল মালিকদের ৬ লাখ টন সিদ্ধ চাল এবং ৩৬ টাকা কেজিতে ৫০ হাজার টন আতপ চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়। সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে বাজারদর বেশি থাকায় কৃষক-চালকলগুলো তেমন আগ্রহ দেখায়নি। ৭ নভেম্বর থেকে ধান ও ১৫ নভেম্বর থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছিল। এখন পর্যন্ত দেড় লাখ টন চাল দেওয়ার বিষয়ে মিল মালিকরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এর মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৭ হাজার ৬৮৮ টন আমন সিদ্ধ চাল, ১ হাজার ২৫ টন আতপ চাল এবং ১ হাজার ২৭৬ টন আমন ধান সংগৃহীত হয়েছে, যা চালের আকারে সর্বমোট ২৯ হাজার ৫৬১ টন। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে। এই সময়ের মধ্যে চুক্তিবদ্ধ দেড় লাখ টন সংগ্রহ সম্ভব হবে কি না তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।
গত বোরো মৌসুমে খাদ্য মন্ত্রণালয় ২৬ টাকা কেজি দরে বোরো ধান, ৩৬ টাকা কেজিতে সিদ্ধ ও আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম পর্যায়ে মোট ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন বোরো ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে আরও দুই লাখ টন বাড়িয়ে সাড়ে ২১ লাখে উন্নীত করা হয়। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনার কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ হচ্ছিল না। পরে সময় বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ ধান-চাল সংগৃহীত হয়েছিল তা চালের আকারে ৬ লাখ ৬৮ হাজার টন সিদ্ধ চাল এবং ১ লাখ টন আতপ চাল হয়েছে।
টানা দুই মৌসুমে চাল সংগ্রহ ব্যর্থ হওয়ায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মজুদ দিনে দিনে কমছে। গত ৭ জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী সরকারের কাছে মাত্র ৫ লাখ ৩১ হাজার টন চাল মজুদ রয়েছে। অথচ গত মার্চের শুরুতে সরকারি গুদামে চালের মজুদ ছিল ১৪ লাখ ৩৪ হাজার টন। মধ্য জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৮ লাখ ৫৪ হাজার টনে। অথচ ২০১৯ সালের জুলাইয়ে সরকারে মজুদ ছিল ১২ লাখ ৫৬ হাজার টন। বোরো সংগ্রহ শুরুর পর কিছুটা বেড়ে ৪ জুলাই সাড়ে ৯ লাখ টনে পৌঁছায়। কিন্তু বোরো সংগ্রহে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় দিনে দিনে মজুদের পরিমাণ কমে।
গত আগস্ট মাসে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমানারা খানুম বলেছিলেন, ‘এখন আমাদের চাল ও গম মিলিয়ে এখন ১২ লাখ ৪৮ হাজার টন মজুদ রয়েছে। তা দিয়ে আমাদের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে। কিন্তু এরপর আমাদের গুদাম খালি হয়ে যাবে। তখন আমাদের আরও ১০ লাখ টনের মতো ঘাটতি দেখা যাবে। সে ঘাটতি পূরণের জন্য আমাদের ১৫ লাখ টনের মতো আমদানি করতে হবে।’ এমন আশঙ্কার পরেও সময়মতো মজুদ বাড়াতে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাজারে চালের দাম ক্রমেই বাড়তে থাকে। পরে ডিসেম্বরে এসে সরকার চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই চাল এখনো দেশে আসতে পারেনি। ফলে বাজার কার্যত নিয়ন্ত্রণহীনই রয়ে গেছে। যদিও মন্ত্রণালয় আশা করছে, এ মাসের মধ্যেই আমদানির বড় একটি অংশ চলে আসলে বাজার ও মজুদ পরিস্থিতি দুটোরই উন্নতি হবে।
সরকারের আমদানি পরিস্থিতি : সরকারের মজুদ কমা ও বাজারে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পর অবশেষে চাল আমদানিতে মনোযোগী হয়েছে সরকার। কমানো হয়েছে শুল্ক। ভারত থেকে সরকার টু সরকার (জিটুজি) প্রক্রিয়ায় দেড় লাখ টন ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে আরও তিন লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
ইতিমধ্যে ১০ হাজার টন চাল দেশে প্রবেশ করেছে দেশ রূপান্তরকে এমন তথ্য দিয়েছেন খাদ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘জানুয়ারির মধ্যেই আরও অন্তত এক লাখ টন চাল দেশে প্রবেশ করবে। বাকিগুলোও ফেব্রুয়ারিতে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ এছাড়া বুধবার সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ভারত থেকে দুই লাখ টন এবং সিঙ্গাপুর থেকে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন মিলেছে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে।
৫ শর্তে বেসরকারিভাবে চাল আমদানি : এদিকে আমনের দামে প্রভাব পড়বে এমন যুক্তিতে সরকার এতদিন খুচরা বাজারের জন্য চাল আমদানির অনুমোদন দিচ্ছিল না। তবে চালের দামের লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়ায় গত ৩ জানুয়ারি থেকে বেসরকারিভাবে খুচরা বাজারের জন্য চাল আমদানির অনুমোদন শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ৩ জানুয়ারি ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৫ হাজার টন, ৪ জানুয়ারি ১২টি প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৬০ হাজার টন এবং ৫ জানুয়ারি ৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৭ জানুয়ারি ২০ হাজার টন চাল দিনাজপুরের হিলি বন্দর হয়ে ভারত থেকে প্রবেশ করেছে। তবে বন্দর থেকে তা এখনো ছাড় পায়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বেসরকারিভাবে চাল আমদানির ক্ষেত্রে সরকার কয়েকটি শর্ত আরোপ করেছে। আমদানিকৃত চাল অবশ্যই সিদ্ধ হতে হবে। এগুলো সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ভাংগাদানা নন-বাসমতি হতে হবে। বরাদ্দপত্র ইস্যুর ৭ দিনের মধ্যে আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য (পোর্ট অব এন্ট্রিসহ) খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত করতে হবে। ৫ হাজার টন বরাদ্দপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খোলার ১০ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ২০ দিনের মধ্যে সমুদয় চাল দেশের বাজারজাত করতে হবে। ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টন বরাদ্দপ্রাপ্তরা ঋণপত্র খোলার ১৫ দিনের মধ্যে ৫০ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে সমুদয় চাল বাজারজাত করতে হবে।
তবে আমদানির অনুমোদনে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো কিছুটা শিথিল চেয়েছে আমদানিকারকরা। বিশেষ করে আমদানির পুরো প্রক্রিয়া মাত্র এক মাসে শেষ করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা।
হিলি স্থলবন্দরের আমদানিকারক মামুনুর রশীদ বলেন, চাল আমদানির ক্ষেত্রে ব্যাংক লিমিটসহ সরকার অনেকগুলো শর্ত দিয়েছে। এতে ছোট আমদানিকারকদের অনেকেই আমদানি করতে পারবে না। এছাড়া আমদানিকারকদের আবেদনপত্রে ফ্রুডগ্রেইন লাইসেন্স চাওয়া হয়েছে। এটি সাধারণত চালকল মালিকদের থাকে। যাদের জন্য বাজারে এমন অস্থিরতা তারাই আবার আমদানির অনুমোদন পাচ্ছে। তাই সরকারের উচিত বাজারের স্বার্থে আমদানির জন্য প্রদত্ত শর্ত প্রত্যাহার করা। একই সঙ্গে শুধু বড় বড় আমদানিকারকদের অনুমোদন না দিয়ে সবার জন্য চাল আমদানির পথ উন্মুক্ত করা।