৫০ কোটি টাকা হাতানো রাজ্জাকের খোঁজ নেই
ইমন রহমান | ১৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০
ইউনিক এয়ার ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. মুসা মিয়া সাগর। গাজীপুরের টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেটে তার অফিস। অনলাইনে টিকিট কেনার প্ল্যাটফর্ম ‘টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম’ থেকে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের ৭১টি টিকিট কিনে ৪০ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আরেক ভুক্তভোগী ইউনি ফ্লাই ট্রাভেলসের মালিক একেএম মাহাবুব আলম। তিনিও একই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকিট কিনে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পার্ল হলিডেইজ এজেন্সির মালিক রাজিব পাল ৭ লাখ টাকার টিকিট কিনে প্রতারিত হয়েছেন।
মুসা মিয়া সাগর, মাহাবুব আলম ও রাজিব পালের মতো একইভাবে দুই হাজারের বেশি এজেন্টের কাছে বিমানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটের টিকিট অনলাইনে বিক্রির নামে অন্তত ৫০ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুর রাজ্জাকসহ প্রতিষ্ঠানটির অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার (আইএটিএ) অনুমোদিত এজেন্টদের কাছ থেকে বাকিতে টিকিট কিনে খুচরা এজেন্টদের কাছে অনলাইনে নগদে বিক্রি করে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম। খুচরা এজেন্টরা আবার সাধারণ যাত্রীদের কাছে বিক্রি করেছে এসব টিকিট। তবে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম আইএটিএ অনুমদিত এজেন্টদের টাকা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করায় ওইসব এজেন্ট টিকিট রিফান্ড (বাতিল) করেছে। আর ওই টিকিট নিয়ে যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন সেই টিকিট রিফান্ড হয়েছে। ওই টিকিটে বিমানে ওঠা সম্ভব নয়। ফলে এসব যাত্রীকে তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত দামে টিকিট কিনে দিতে হয়েছে খুচরা এজেন্টদের। অনেক যাত্রী টিকিট না পেয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন। ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট খুচরা এজেন্ট ও সাধারণ যাত্রীরা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ভুক্তভোগী এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী এক এজেন্টের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি (সাইবার ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার) কামরুল আহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কম যেসব আইএটিএ এজেন্টের কাছ থেকে টিকিট কিনেছে, তাদের টাকা ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার কথা থাকলেও তারা তিন মাসেও পরিশোধ করেনি। ফলে এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতিতে টিকিট রিফান্ড করেছে ওইসব অনুমোদিত এজেন্টরা। ফলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনলাইনে টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে ৭% কমিশন দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম দ্রুত টিকিটগুলো বিক্রির অসৎ উদ্দেশ্যে ১০% কমিশন ঘোষণা করে। এতে টিকিট বিক্রি করে স্বল্প সময়ে হিউজ ক্যাশ টাকা (প্রচুর নগদ টাকা) কালেকশন করে। আগে থেকেই তাদের প্ল্যান ছিল টাকা আত্মসাতের।’
এ সিআইডি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের ডিসকাউন্ট দেখলে তার কারণ জানার চেষ্টা করতে হবে। আইএটিএর অনুমোদিত এজেন্টদের কাছ থেকে টিকিট কেনা ভালো।’
প্রতারণার শিকার মো. মুসা মিয়া সাগর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফেইসবুকে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের বিভিন্ন অফার দেখে আমি আকৃষ্ট হই। পরে ২০১৮ সাল থেকে তাদের কাছ থেকে টিকিট কেনা শুরু করি। তারা ভালো কমিশন দিত। এসব টিকিট আমি এজেন্টদের কাছেও বিক্রি করতাম। চলতি বছর ২৪ এপ্রিল আমার এক যাত্রী ইতিহাদ এয়ারলাইনসে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে যান। তিনি সেখানে গিয়ে জানতে পারেন টিকিটটি রিফান্ড করা হয়েছে। সেখান থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, আপনি আমাকে যে টিকিট দিয়েছেন সেটি তো রিফান্ড হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও ৭১টি টিকিট রিফান্ড হওয়ার তথ্য আসে। আমি টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি। পরে মামলা করেছি।’
আরেক ভুক্তভোগী ইউনি ফ্লাই ট্রাভেলসের মালিক একেএম মাহাবুব আলম তার প্রতারিত হওয়ার কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছ থেকে অনলাইনে অস্ট্রেলিয়ার বিজনেস ক্লাসের একটি, দুবাইয়ের ট্যুরিস্ট ভিসার রিটার্ন টিকিট পাঁচটি এবং মালদ্বীপের একটি টিকিট কিনেছিলাম। যার দাম ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। টিকিটগুলো আমি বিক্রি করার পর যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন যে টিকিটগুলো রিফান্ড হয়েছে। আমি টিকিট রি-ইস্যু করতে গেলে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম কর্র্তৃপক্ষ টালবাহানা শুরু করে। এ সময় যাত্রীরা আমার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করে। যাত্রীদের ফের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। এতে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মধ্যে পড়েছি। আমি তাদের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় একটি প্রতারণা মামলা করেছি।’
পার্ল হলিডেইজ এজেন্সির মালিক রাজিব পাল জানান, রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় তার প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সাল থেকে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। কিন্তু টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। গত ১৯ এপ্রিল ওমান যাওয়ার উদ্দেশ্যে তার কাছ থেকে এক যাত্রী টিকিট কেনেন। কিন্তু বিমানবন্দরে গেলে ওই যাত্রী জানতে পারেন যে তার টিকিট রিফান্ড হয়েছে। একইভাবে সাতটি টিকিট থেকে ইতিমধ্যে ৭ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন রাজিব পাল।
তিনি বলেন, ‘আমার মতো আরও ৪০০-৫০০ এজেন্ট টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের প্রতারণার শিকার হয়েছে। আর এসব এজেন্টের কাছ থেকে টিকিট কিনে ভোগান্তিতে পড়েছেন ২০ হাজারের বেশি সাধারণ যাত্রী।’
ফাজার ট্রাভেলসের মালিক গোলাম সরোয়ার, ফিউচার প্লেস লিমিটেডের মালিক শামিম হোসেন, এশিয়া ওভারসিসের মালিক জোবায়েদ, এক্সপ্রেস হলিডের মালিক জাকির হোসেন, ওশান এয়ার ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক সাইফুদ্দিন এবং দ্য মোভ অন ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের সৈকত বড়ুয়াসহ অসংখ্য ভুক্তভোগী টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছ থেকে টিকিট কিনে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
এসব ভুক্তভোগী বলছেন, টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছে যারা বাকিতে কোটি কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করেছে, তারা কিসের ভিত্তিতে বিক্রি করেছে। আর টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম টাকা পরিশোধ না করায় তারা যেভাবে টিকিট রিফান্ড করেছে তা কতটা আইনসম্মত। এর পেছনে বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের এমডি আবদুর রাজ্জাক ও অন্যরা মিলে পরিকল্পিতভাবে টাকা মেরে গা-ঢাকা দিয়েছে। অনলাইনে টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭% কমিশন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তারা ১০% কমিশনে টিকিট বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। ফলে আইএটিএর তালিকাভুক্ত অনেক এজেন্টও টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছ থেকে নগদে টিকিট কিনে প্রতারিত হয়েছেন। টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম টিকিট কেনার ১৫ দিনের মধ্যে আইএটিএ এজেন্টকে টাকা পরিশোধের নিয়ম থাকলেও তিন মাসেও তারা টাকা পরিশোধ করেনি। ফলে আইএটিএ এজেন্টগুলো তিন ভাগের দুই ভাগ টাকায় টিকিট রিফান্ড করেছে। এমন পরিস্থিতিতে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের প্রতারণায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন আইএটিএভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও খুচরা এজেন্টরা।
সিআইডি কর্মকর্তারা আরও বলছেন, টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম আইএটিএ অনুমোদিত এজেন্ট হওয়ায় ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয় ছিল। কিন্তু তারা নিজেরা এয়ারলাইনসের কাছ থেকে টিকিট না কিনে কৌশলে অন্য অনুমোদিত এজেন্টদের কাছ থেকে টিকিট কিনেছে। টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম থেকে ৪০ লাখ টাকার টিকিট কিনে প্রতারিত হয়ে থানায় মামলা করেন ইউনিক এয়ার ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. মুসা মিয়া সাগর। এরপরই বিষয়টি সামনে আসে। এখন অসংখ্য ভুক্তভোগী সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
মুসা মিয়া সাগর গত ৩ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের পরিচালক আবদুর রাজ্জাকসহ (৩২) ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন প্রদ্যোত বরণ চৌধুরী (২৮), মো. রাকিবুল হাসান (৩৫), আসাদুল ইসলাম (৩২), এম মিজানুর রহমান সোহেল (৩২) ও মোছা. নাসরিন সুলতানা (৩৩)। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাকিবুল হাসান ও মিজানুর রহমান সোহেলকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
উত্তরা পশ্চিম থানায় করা মামলার এজাহারে মুসা মিয়া সাগর বলেন, ‘অনলাইন ট্রাভেল এজেন্ট টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক লিংকের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের বিমানের টিকিট কিনতাম। তাদের ফেইসবুক পেজে বিভিন্ন সময় লোভনীয় অফার থাকত। টিকিট কেনার টাকা বিকাশ, রকেট, অনলাইন ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে পরিশোধ করতাম। গত ২৫ এপ্রিল থেকে ১ অক্টোবর আমার কাছ থেকে টিকিট কেনা ব্যক্তিরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন টিকিটগুলো ভুয়া এবং কিছু কিছু টিকিট আগেই বাতিল করে এয়ারলাইনস কর্র্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকা ফেরত নিয়েছে।’
মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, মুসা মিয়া পরবর্তী সময়ে পরিচিত অন্য এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন যে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের কাছ থেকে টিকিট কিনে একইভাবে আরও অসংখ্য এজেন্ট প্রতারিত হয়েছেন। গত ৩ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা-দুবাই-ঢাকা রুটের প্রায় ১০০টি টিকিট ইস্যু করা হয় এবং বিকাশ, রকেট ও অনলাইন ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে মুসা টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমকে এ বাবদ ৪০ লাখ ১৪ হাজার ১০৫ টাকা পরিশোধ করেন। পরে যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন তাদের কেনা টিকিট রিফান্ড হয়ে গেছে। মুসা তাৎক্ষণিক টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কম কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা প্রথমে জানায়, তাদের সার্ভারে ত্রুটির কারণে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু পরে জানতে পারেন টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কম কর্র্তৃপক্ষ অসৎ উদ্দেশ্যে আইএটিএ এজেন্ট ভেন্ডারের মাধ্যমে সব টিকিট রিফান্ড করে নিয়েছে। পরে বহু চেষ্টা করেও আর তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেননি।
টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস) এসএম আশরাফুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চক্রটি পরিকল্পিতভাবে অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদের প্রধান টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের এমডি আবদুর রাজ্জাক। সে পলাতক। রাজ্জাকের বড় ভাই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রাকিবুলসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।’
শেয়ার করুন
ইমন রহমান | ১৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০

ইউনিক এয়ার ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. মুসা মিয়া সাগর। গাজীপুরের টঙ্গীর চেরাগ আলী মার্কেটে তার অফিস। অনলাইনে টিকিট কেনার প্ল্যাটফর্ম ‘টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম’ থেকে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের ৭১টি টিকিট কিনে ৪০ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আরেক ভুক্তভোগী ইউনি ফ্লাই ট্রাভেলসের মালিক একেএম মাহাবুব আলম। তিনিও একই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে টিকিট কিনে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পার্ল হলিডেইজ এজেন্সির মালিক রাজিব পাল ৭ লাখ টাকার টিকিট কিনে প্রতারিত হয়েছেন।
মুসা মিয়া সাগর, মাহাবুব আলম ও রাজিব পালের মতো একইভাবে দুই হাজারের বেশি এজেন্টের কাছে বিমানের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটের টিকিট অনলাইনে বিক্রির নামে অন্তত ৫০ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুর রাজ্জাকসহ প্রতিষ্ঠানটির অন্য শীর্ষ কর্মকর্তারা।
আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার (আইএটিএ) অনুমোদিত এজেন্টদের কাছ থেকে বাকিতে টিকিট কিনে খুচরা এজেন্টদের কাছে অনলাইনে নগদে বিক্রি করে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম। খুচরা এজেন্টরা আবার সাধারণ যাত্রীদের কাছে বিক্রি করেছে এসব টিকিট। তবে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম আইএটিএ অনুমদিত এজেন্টদের টাকা নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করায় ওইসব এজেন্ট টিকিট রিফান্ড (বাতিল) করেছে। আর ওই টিকিট নিয়ে যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন সেই টিকিট রিফান্ড হয়েছে। ওই টিকিটে বিমানে ওঠা সম্ভব নয়। ফলে এসব যাত্রীকে তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত দামে টিকিট কিনে দিতে হয়েছে খুচরা এজেন্টদের। অনেক যাত্রী টিকিট না পেয়ে বাড়িতে ফিরে গেছেন। ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট খুচরা এজেন্ট ও সাধারণ যাত্রীরা। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ভুক্তভোগী এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী এক এজেন্টের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পেয়েছে সিআইডি।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি (সাইবার ক্রাইম কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার) কামরুল আহসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কম যেসব আইএটিএ এজেন্টের কাছ থেকে টিকিট কিনেছে, তাদের টাকা ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ করার কথা থাকলেও তারা তিন মাসেও পরিশোধ করেনি। ফলে এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতিতে টিকিট রিফান্ড করেছে ওইসব অনুমোদিত এজেন্টরা। ফলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অনলাইনে টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে ৭% কমিশন দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম দ্রুত টিকিটগুলো বিক্রির অসৎ উদ্দেশ্যে ১০% কমিশন ঘোষণা করে। এতে টিকিট বিক্রি করে স্বল্প সময়ে হিউজ ক্যাশ টাকা (প্রচুর নগদ টাকা) কালেকশন করে। আগে থেকেই তাদের প্ল্যান ছিল টাকা আত্মসাতের।’
এ সিআইডি কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এ ধরনের ডিসকাউন্ট দেখলে তার কারণ জানার চেষ্টা করতে হবে। আইএটিএর অনুমোদিত এজেন্টদের কাছ থেকে টিকিট কেনা ভালো।’
প্রতারণার শিকার মো. মুসা মিয়া সাগর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফেইসবুকে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের বিভিন্ন অফার দেখে আমি আকৃষ্ট হই। পরে ২০১৮ সাল থেকে তাদের কাছ থেকে টিকিট কেনা শুরু করি। তারা ভালো কমিশন দিত। এসব টিকিট আমি এজেন্টদের কাছেও বিক্রি করতাম। চলতি বছর ২৪ এপ্রিল আমার এক যাত্রী ইতিহাদ এয়ারলাইনসে দুবাই যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে যান। তিনি সেখানে গিয়ে জানতে পারেন টিকিটটি রিফান্ড করা হয়েছে। সেখান থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, আপনি আমাকে যে টিকিট দিয়েছেন সেটি তো রিফান্ড হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে আরও ৭১টি টিকিট রিফান্ড হওয়ার তথ্য আসে। আমি টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো লাভ হয়নি। পরে মামলা করেছি।’
আরেক ভুক্তভোগী ইউনি ফ্লাই ট্রাভেলসের মালিক একেএম মাহাবুব আলম তার প্রতারিত হওয়ার কাহিনী তুলে ধরতে গিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছ থেকে অনলাইনে অস্ট্রেলিয়ার বিজনেস ক্লাসের একটি, দুবাইয়ের ট্যুরিস্ট ভিসার রিটার্ন টিকিট পাঁচটি এবং মালদ্বীপের একটি টিকিট কিনেছিলাম। যার দাম ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। টিকিটগুলো আমি বিক্রি করার পর যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন যে টিকিটগুলো রিফান্ড হয়েছে। আমি টিকিট রি-ইস্যু করতে গেলে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম কর্র্তৃপক্ষ টালবাহানা শুরু করে। এ সময় যাত্রীরা আমার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করে। যাত্রীদের ফের টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। এতে আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মধ্যে পড়েছি। আমি তাদের বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় একটি প্রতারণা মামলা করেছি।’
পার্ল হলিডেইজ এজেন্সির মালিক রাজিব পাল জানান, রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় তার প্রতিষ্ঠান। ২০১৭ সাল থেকে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। কিন্তু টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। গত ১৯ এপ্রিল ওমান যাওয়ার উদ্দেশ্যে তার কাছ থেকে এক যাত্রী টিকিট কেনেন। কিন্তু বিমানবন্দরে গেলে ওই যাত্রী জানতে পারেন যে তার টিকিট রিফান্ড হয়েছে। একইভাবে সাতটি টিকিট থেকে ইতিমধ্যে ৭ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছেন রাজিব পাল।
তিনি বলেন, ‘আমার মতো আরও ৪০০-৫০০ এজেন্ট টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের প্রতারণার শিকার হয়েছে। আর এসব এজেন্টের কাছ থেকে টিকিট কিনে ভোগান্তিতে পড়েছেন ২০ হাজারের বেশি সাধারণ যাত্রী।’
ফাজার ট্রাভেলসের মালিক গোলাম সরোয়ার, ফিউচার প্লেস লিমিটেডের মালিক শামিম হোসেন, এশিয়া ওভারসিসের মালিক জোবায়েদ, এক্সপ্রেস হলিডের মালিক জাকির হোসেন, ওশান এয়ার ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক সাইফুদ্দিন এবং দ্য মোভ অন ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের সৈকত বড়ুয়াসহ অসংখ্য ভুক্তভোগী টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছ থেকে টিকিট কিনে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
এসব ভুক্তভোগী বলছেন, টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছে যারা বাকিতে কোটি কোটি টাকার টিকিট বিক্রি করেছে, তারা কিসের ভিত্তিতে বিক্রি করেছে। আর টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম টাকা পরিশোধ না করায় তারা যেভাবে টিকিট রিফান্ড করেছে তা কতটা আইনসম্মত। এর পেছনে বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের এমডি আবদুর রাজ্জাক ও অন্যরা মিলে পরিকল্পিতভাবে টাকা মেরে গা-ঢাকা দিয়েছে। অনলাইনে টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭% কমিশন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তারা ১০% কমিশনে টিকিট বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। ফলে আইএটিএর তালিকাভুক্ত অনেক এজেন্টও টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের কাছ থেকে নগদে টিকিট কিনে প্রতারিত হয়েছেন। টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম টিকিট কেনার ১৫ দিনের মধ্যে আইএটিএ এজেন্টকে টাকা পরিশোধের নিয়ম থাকলেও তিন মাসেও তারা টাকা পরিশোধ করেনি। ফলে আইএটিএ এজেন্টগুলো তিন ভাগের দুই ভাগ টাকায় টিকিট রিফান্ড করেছে। এমন পরিস্থিতিতে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের প্রতারণায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন আইএটিএভুক্ত প্রতিষ্ঠান ও খুচরা এজেন্টরা।
সিআইডি কর্মকর্তারা আরও বলছেন, টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম আইএটিএ অনুমোদিত এজেন্ট হওয়ায় ব্যাংক গ্যারান্টির বিষয় ছিল। কিন্তু তারা নিজেরা এয়ারলাইনসের কাছ থেকে টিকিট না কিনে কৌশলে অন্য অনুমোদিত এজেন্টদের কাছ থেকে টিকিট কিনেছে। টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকম থেকে ৪০ লাখ টাকার টিকিট কিনে প্রতারিত হয়ে থানায় মামলা করেন ইউনিক এয়ার ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. মুসা মিয়া সাগর। এরপরই বিষয়টি সামনে আসে। এখন অসংখ্য ভুক্তভোগী সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
মুসা মিয়া সাগর গত ৩ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমের পরিচালক আবদুর রাজ্জাকসহ (৩২) ছয়জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন প্রদ্যোত বরণ চৌধুরী (২৮), মো. রাকিবুল হাসান (৩৫), আসাদুল ইসলাম (৩২), এম মিজানুর রহমান সোহেল (৩২) ও মোছা. নাসরিন সুলতানা (৩৩)। এ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাকিবুল হাসান ও মিজানুর রহমান সোহেলকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি।
উত্তরা পশ্চিম থানায় করা মামলার এজাহারে মুসা মিয়া সাগর বলেন, ‘অনলাইন ট্রাভেল এজেন্ট টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক লিংকের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের বিমানের টিকিট কিনতাম। তাদের ফেইসবুক পেজে বিভিন্ন সময় লোভনীয় অফার থাকত। টিকিট কেনার টাকা বিকাশ, রকেট, অনলাইন ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে পরিশোধ করতাম। গত ২৫ এপ্রিল থেকে ১ অক্টোবর আমার কাছ থেকে টিকিট কেনা ব্যক্তিরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন টিকিটগুলো ভুয়া এবং কিছু কিছু টিকিট আগেই বাতিল করে এয়ারলাইনস কর্র্তৃপক্ষের কাছ থেকে টাকা ফেরত নিয়েছে।’
মামলার অভিযোগে আরও বলা হয়, মুসা মিয়া পরবর্তী সময়ে পরিচিত অন্য এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন যে টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের কাছ থেকে টিকিট কিনে একইভাবে আরও অসংখ্য এজেন্ট প্রতারিত হয়েছেন। গত ৩ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা-দুবাই-ঢাকা রুটের প্রায় ১০০টি টিকিট ইস্যু করা হয় এবং বিকাশ, রকেট ও অনলাইন ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে মুসা টোয়েন্টিফোর টিকিট ডটকমকে এ বাবদ ৪০ লাখ ১৪ হাজার ১০৫ টাকা পরিশোধ করেন। পরে যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন তাদের কেনা টিকিট রিফান্ড হয়ে গেছে। মুসা তাৎক্ষণিক টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কম কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা প্রথমে জানায়, তাদের সার্ভারে ত্রুটির কারণে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু পরে জানতে পারেন টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কম কর্র্তৃপক্ষ অসৎ উদ্দেশ্যে আইএটিএ এজেন্ট ভেন্ডারের মাধ্যমে সব টিকিট রিফান্ড করে নিয়েছে। পরে বহু চেষ্টা করেও আর তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেননি।
টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের প্রতারণার বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (সাইবার ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশনস) এসএম আশরাফুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চক্রটি পরিকল্পিতভাবে অন্তত ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এদের প্রধান টোয়েন্টিফোর টিকিট ডট কমের এমডি আবদুর রাজ্জাক। সে পলাতক। রাজ্জাকের বড় ভাই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রাকিবুলসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।’