হবিগঞ্জে লাল সাইনবোর্ড আতঙ্ক
শোয়েব চৌধুরী, হবিগঞ্জ | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০
হবিগঞ্জে মাদক ও চোরাচালান বন্ধে বিজিবির মাধবপুর উপজেলার কিছু বাড়িতে সাইনবোর্ড টানানো নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কোনো কোনো পরিবার মাদক কারবারে জড়িত না থাকলেও তাদের বাড়িতে সাইনবোর্ড দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগানোর ফলে ওই বাড়ির শিশু ও শিক্ষার্থীরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিন মাধবপুর উপজেলার মনতলা ও বহরা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে এসব বাড়ির লোকজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। কৃষ্ণপুর গ্রামের বিলকিস জানান, তার স্বামী বলু মিয়া একজন চাষি। গত ১১ নভেম্বর ধান মাড়াই দেওয়ার সময় সাদা পোশাকের বিজিবি সদস্যরা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন। তার সঙ্গে এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলে তারা স্থানীয় ক্যাম্পে মোবাইল করেন। সাথে সাথে কয়েকজন বিজিবি সদস্য এসে বলু মিয়াকে ক্যাম্পে নিয়ে যান। তার ছেলে লিটন মিয়া (২৫) বলেন, ক্যাম্পে নেওয়ার পর সেখানে গিয়ে দেখি একটি টেবিলে তিন পোঁটলা গাঁজার সামনে বাবাকে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। বলু মিয়া এক ছেলে দুই কন্যার পিতা। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে মারুফা (৭) স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। মারুফা বলে, আমাদের বাড়ির সামনে ‘মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি’ সাইনবোর্ড লাগানোর পর সহপাঠীরাও আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। আমাকে খেলায় নেয় না। স্থানীয় কয়েকজন যুবক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বলু মিয়া মাদক কারবারে জড়িত ছিলেন না। পূর্বে কোনো মামলাও নেই তার বিরুদ্ধে। তাদের ধারণা, বিজিবির কোনো সোর্স তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে ।
গত ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজেন্দ্রপুরের আহাদ মিয়া ও জালুয়াবাদ গ্রামের কবীর মিয়াকে আটক করে বিজিবি। তাদের কাছে ৯৫ পিস ইয়াবা ও দুই কেজি গাঁজা পাওয়া যায় বলে বিজিবির মামলায় উল্লেখ করে। আহাদ মিয়ার স্ত্রী নাজমা বলেন, ওইদিন সন্ধ্যায় চুনারুঘাটের মুড়ারবন্দ মাজার থেকে বাড়ি ফেরার পর আহাদ মিয়াা পার্শ্ববর্তী পুকুরে গোসল করতে যান। সেখান থেকেই বিজিবি তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আহাদ কৃষিকাজ ও বন থেকে মধু সংগ্রহ করেন। ওই গ্রামের টুক্কু মিয়া বলেন, আহাদকে নিয়ে যাওয়ার সময় আমিসহ কয়েকজন তাদের কাছে কারণ জানতে চাই। এসময় বিজিবির সদস্যরা বলে, এখান থেকে সরে যাও নইলে গুলি করে মেরে ফেলব। আমাদের সামনে একজন বিজিবি সদস্য পকেট থেকে পলিথিনের প্যাকেট বের করে মাটিতে ফেলে বলে, ‘এই তো আহাদের কাছে ইয়াবা পাওয়া গেছে’। এলাকার সর্দার ও স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ফুল মিয়াও (৬০) ঘটনা সম্পর্কে একই কথা জানান। আহাদের বড় ছেলে ইমন সরোয়ার মনতলা কলেজের এইচএসসি ১ম বর্ষের ছাত্র। ছোট ছেলে রিমন দশম শ্রেণিতে পড়ে। ইমন জানান, কিছুদিন আগে বাড়ির সামনে বিজিবির সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়। এরপর থেকে ঘর থেকে বের হই না। শুক্রবার সকালে কে বা কারা ওই সাইনবোর্ড তুলে নিয়ে গেছে। এখন নতুন শঙ্কায় মধ্যে আছি, আমাকে আমার মা ভাইকে বিজিবি ধরে নিয়ে যায় কি না। কারণ তারা আগেই বলে গেছে, সাইনবোর্ড সরালে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে।
রামনগর গ্রামের ধনু মিয়া (৫০) কয়েক বছর হল মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন দাবি করে বলেন, তিনটি মামলা থাকলেও কোনোটিরই রায় হয়নি। ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার পরও সাইনবোর্ড টানানোয় পরিবার ও সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। চোরাচালানকারী ও মাদক ব্যবসার গডফাদারদের বিজিবি ধরে না। এরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
বহরা ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান বলেন, সাইনবোর্ড লাগানো বাড়িগুলোর মধ্যে কেউ কেউ এসব কর্মকা-ে জড়িত নয় বলে শুনেছি। আগে শুধু চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি লেখা ছিল। এখন নুতন সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। এতে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হচ্ছে।
৫৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল সামিউন্নবী চৌধুরী বলেন, বিজিবির দায়ের করা মামলায় আসামিদের বাড়িতে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। গত বছর ৭১ জন আত্মসমর্পণ করে। কিছুদিন পর ১৫-১৬ জন পুনরায় চোরাচালান ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে, যাতে তারা এ পথ থেকে সরে আসে।
শেয়ার করুন
শোয়েব চৌধুরী, হবিগঞ্জ | ২৭ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০

হবিগঞ্জে মাদক ও চোরাচালান বন্ধে বিজিবির মাধবপুর উপজেলার কিছু বাড়িতে সাইনবোর্ড টানানো নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কোনো কোনো পরিবার মাদক কারবারে জড়িত না থাকলেও তাদের বাড়িতে সাইনবোর্ড দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড লাগানোর ফলে ওই বাড়ির শিশু ও শিক্ষার্থীরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে।
গতকাল শুক্রবার সরেজমিন মাধবপুর উপজেলার মনতলা ও বহরা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে এসব বাড়ির লোকজন ও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। কৃষ্ণপুর গ্রামের বিলকিস জানান, তার স্বামী বলু মিয়া একজন চাষি। গত ১১ নভেম্বর ধান মাড়াই দেওয়ার সময় সাদা পোশাকের বিজিবি সদস্যরা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন। তার সঙ্গে এমন আচরণের কারণ জানতে চাইলে তারা স্থানীয় ক্যাম্পে মোবাইল করেন। সাথে সাথে কয়েকজন বিজিবি সদস্য এসে বলু মিয়াকে ক্যাম্পে নিয়ে যান। তার ছেলে লিটন মিয়া (২৫) বলেন, ক্যাম্পে নেওয়ার পর সেখানে গিয়ে দেখি একটি টেবিলে তিন পোঁটলা গাঁজার সামনে বাবাকে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। বলু মিয়া এক ছেলে দুই কন্যার পিতা। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে মারুফা (৭) স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। মারুফা বলে, আমাদের বাড়ির সামনে ‘মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি’ সাইনবোর্ড লাগানোর পর সহপাঠীরাও আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। আমাকে খেলায় নেয় না। স্থানীয় কয়েকজন যুবক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, বলু মিয়া মাদক কারবারে জড়িত ছিলেন না। পূর্বে কোনো মামলাও নেই তার বিরুদ্ধে। তাদের ধারণা, বিজিবির কোনো সোর্স তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে ।
গত ২১ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজেন্দ্রপুরের আহাদ মিয়া ও জালুয়াবাদ গ্রামের কবীর মিয়াকে আটক করে বিজিবি। তাদের কাছে ৯৫ পিস ইয়াবা ও দুই কেজি গাঁজা পাওয়া যায় বলে বিজিবির মামলায় উল্লেখ করে। আহাদ মিয়ার স্ত্রী নাজমা বলেন, ওইদিন সন্ধ্যায় চুনারুঘাটের মুড়ারবন্দ মাজার থেকে বাড়ি ফেরার পর আহাদ মিয়াা পার্শ্ববর্তী পুকুরে গোসল করতে যান। সেখান থেকেই বিজিবি তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আহাদ কৃষিকাজ ও বন থেকে মধু সংগ্রহ করেন। ওই গ্রামের টুক্কু মিয়া বলেন, আহাদকে নিয়ে যাওয়ার সময় আমিসহ কয়েকজন তাদের কাছে কারণ জানতে চাই। এসময় বিজিবির সদস্যরা বলে, এখান থেকে সরে যাও নইলে গুলি করে মেরে ফেলব। আমাদের সামনে একজন বিজিবি সদস্য পকেট থেকে পলিথিনের প্যাকেট বের করে মাটিতে ফেলে বলে, ‘এই তো আহাদের কাছে ইয়াবা পাওয়া গেছে’। এলাকার সর্দার ও স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ফুল মিয়াও (৬০) ঘটনা সম্পর্কে একই কথা জানান। আহাদের বড় ছেলে ইমন সরোয়ার মনতলা কলেজের এইচএসসি ১ম বর্ষের ছাত্র। ছোট ছেলে রিমন দশম শ্রেণিতে পড়ে। ইমন জানান, কিছুদিন আগে বাড়ির সামনে বিজিবির সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়। এরপর থেকে ঘর থেকে বের হই না। শুক্রবার সকালে কে বা কারা ওই সাইনবোর্ড তুলে নিয়ে গেছে। এখন নতুন শঙ্কায় মধ্যে আছি, আমাকে আমার মা ভাইকে বিজিবি ধরে নিয়ে যায় কি না। কারণ তারা আগেই বলে গেছে, সাইনবোর্ড সরালে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে।
রামনগর গ্রামের ধনু মিয়া (৫০) কয়েক বছর হল মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন দাবি করে বলেন, তিনটি মামলা থাকলেও কোনোটিরই রায় হয়নি। ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার পরও সাইনবোর্ড টানানোয় পরিবার ও সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। চোরাচালানকারী ও মাদক ব্যবসার গডফাদারদের বিজিবি ধরে না। এরা সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
বহরা ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান বলেন, সাইনবোর্ড লাগানো বাড়িগুলোর মধ্যে কেউ কেউ এসব কর্মকা-ে জড়িত নয় বলে শুনেছি। আগে শুধু চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ীর বাড়ি লেখা ছিল। এখন নুতন সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। এতে ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হচ্ছে।
৫৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল সামিউন্নবী চৌধুরী বলেন, বিজিবির দায়ের করা মামলায় আসামিদের বাড়িতে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। গত বছর ৭১ জন আত্মসমর্পণ করে। কিছুদিন পর ১৫-১৬ জন পুনরায় চোরাচালান ও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই সাইনবোর্ড লাগানো হচ্ছে, যাতে তারা এ পথ থেকে সরে আসে।