স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে একে অন্যকে দুষছে যাত্রী-শ্রমিক
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টা। রাজধানীর ফার্মগেট মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল আয়াত পরিবহনের একটি বাস। উচ্চৈঃস্বরে ডাকাডাকি করে বাসটিতে যাত্রী তুলছিল চালকের সহকারী। যদিও এ বাসে উঠে প্রতিটি আসনই যাত্রীতে পরিপূর্ণ থাকতে দেখা যায়। ফার্মগেটে যাদের ওঠানো হয় তাদের সবাইকেই দাঁড়িয়ে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর বাসটি যখন বাংলা মোটর মোড়ে গিয়ে পৌঁছায় তখন যাত্রীর ভিড়ে বাসে পা রাখারও জায়গা নেই। তবুও হাঁকডাক করে যাত্রী তোলার জন্য পাঁচ মিনিটের বেশি সময় সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বাসটি। এ সময় যাত্রীরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ‘যত সিট তত যাত্রী’ নিয়মে বাস না চালানোর প্রতিবাদ করলে তেড়ে আসেন চালকের সহকারী। কর্কশ স্বরে যেতে না চাইলে বাস থেকে নেমে যেতে বলেন প্রতিবাদকারীদের।
শুধু আয়াত পরিবহন নয়, একইরকম বিশৃঙ্খল চিত্র রাজধানীর অধিকাংশ গণপরিবহনের। যদিও দেশে নতুন করে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে যত আসন, তত যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে রাজধানীর চিত্র দেখে মনে হয় ওই সিদ্ধান্ত যেন শুধু কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না অনেক যাত্রী এবং পরিবহন চালক-শ্রমিকরা। গতকাল রাজধানীর একাধিক রুট ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাসে গাদাগাদি করে যাত্রীদের চলাচল করতে হচ্ছে। যাদের অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক। এছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধির অন্যান্য শর্ত পালনেও অনীহা দেখা গেছে পরিবহন চালক-কর্মীদের মধ্যে। সকালের দিকে বাসগুলো কিছুটা ফাঁকা থাকলেও বেলা বাড়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাসগুলোতে একই অবস্থা দেখা গেছে।
আয়াত পরিবহনের যে বাসটির কথা বলা হচ্ছিল তার চালক ও সহকারীকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। বাসে থাকা যাত্রীদের মধ্যেও অনেকের মাস্ক ছিল না। মাস্ক ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে বাসটির চালক বলেন, ‘দিনে ৮-১০ ঘণ্টার বেশি সময় বাস চালাতে হয়। এত সময় মাস্ক পরে থাকা যায় না। যাত্রীরা না পরলে আমরা কী করব।’
বাসটির চালকের সহকারী শাকিলের কাছে সরকারি নির্দেশনা ভেঙে গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠানোর কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনার কাছে কৈফিয়ত দিতে পারব না। বাস না ভরা পর্যন্ত যাত্রী তোলা হবে।’ আর একই প্রশ্নের উত্তরে চালক বলেন, ‘যাত্রীরা নিজ থেকে উঠে। আমরা তো জোর করে তুলছি না। আর আজকে (গতকাল) বাস কম তাই যাত্রী বেশি মনে হচ্ছে।’
একই চিত্র দেখা যায় লাব্বাইক, এসএম লাভলী, বলাকা, সায়মা, গাবতলী এক্সপ্রেস, অনাবিল ও বিহঙ্গসহ বেশিরভাগ গণপরিবহনে। এসব বাসে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী তোলা হয়েছে। বেশিরভাগ বাসের চালকসহ অন্য কর্মীদেরও মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। বাসগুলোতে যাত্রীদের জন্য ছিল না স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও।
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর পল্টন, শাহবাগ, বাংলা মোটর ও ফার্মগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাসে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে। বিকেল ৫টায় বাংলা মোটর এলাকায় দাঁড়িয়ে লাব্বাইক পরিবহনের সব বাসে অতিরিক্ত যাত্রীতে ঠাসা দেখা যায়। এসব বাসের চালক-সহকারীদের মুখে দেখা যায়নি মাস্ক।
এই পরিবহন কোম্পানিটির একটি বাসের সহকারী মঞ্জুর সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের। ইচ্ছে করে নয়, যাত্রীরাই জোর করে বাসে উঠে পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থেকে আসার সময় মাত্র ১০ জন যাত্রী পাইছি। মৌচাক আসার পর চাকরির পরীক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে বাসে উঠছে। আমাদের কিছু করার নাই।’ নিজের মুখে মাস্ক না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের হুড়োহুড়িতে মাস্ক পড়ে গেছে।’
নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণ জানতে চাইলে শাহবাগ মোড়ে গাবতলী এক্সপ্রেস পরিবহনের এক চালক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সকালে এক ট্রিপ দিয়ে ভাতের টাকা জোগাড় হয়নি। শুক্রবার যাত্রী কম। বিকেলে কিছু যাত্রী পেয়েছি। সরকারি নির্দেশ মানলে তো পেট চলবে না।’ মুখে মাস্ক না থাকার কারণ জানতে চাইলে বাসটির এক যাত্রী বলেন, ‘বাসে এত যাত্রী যে দম নিতে কষ্ট হয়। তাই মাস্ক খুলে পকেটে রেখে দিয়েছি।’ একই বাসের চালকের সহকারী নজরুলের মুখেও ছিল না মাস্ক। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাস্ক পরে কথা বললে যাত্রীরা শুনতে পায় না।’
পরিবহন মালিকদের দাবি মেনে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ‘যত সিট তত যাত্রী’ নিয়মে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। তবে কোনোভাবেই বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া বাসে যাত্রীদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা এবং চালক-তার সহকারী ও যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে এসবের কোনো কিছুই মানছে না বেশিরভাগ গণপরিবহন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘সকালে অফিস চলাকালে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। যে পরিমাণ যাত্রী থাকে সে পরিমাণ গণপরিবহন নেই। যে কারণে আসনের চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করতে হয়। যাত্রীরাও বাধ্য হয়ে পরিবহনে উঠে পড়েন।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতিরিক্ত যাত্রী যাতে পরিবহন করা না হয় সেজন্য সব মালিক ও শ্রমিকদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তদারকি করছে।’
শেয়ার করুন
নিজস্ব প্রতিবেদক | ২২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

গতকাল শুক্রবার বিকেল ৪টা। রাজধানীর ফার্মগেট মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিল আয়াত পরিবহনের একটি বাস। উচ্চৈঃস্বরে ডাকাডাকি করে বাসটিতে যাত্রী তুলছিল চালকের সহকারী। যদিও এ বাসে উঠে প্রতিটি আসনই যাত্রীতে পরিপূর্ণ থাকতে দেখা যায়। ফার্মগেটে যাদের ওঠানো হয় তাদের সবাইকেই দাঁড়িয়ে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর বাসটি যখন বাংলা মোটর মোড়ে গিয়ে পৌঁছায় তখন যাত্রীর ভিড়ে বাসে পা রাখারও জায়গা নেই। তবুও হাঁকডাক করে যাত্রী তোলার জন্য পাঁচ মিনিটের বেশি সময় সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বাসটি। এ সময় যাত্রীরা সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ‘যত সিট তত যাত্রী’ নিয়মে বাস না চালানোর প্রতিবাদ করলে তেড়ে আসেন চালকের সহকারী। কর্কশ স্বরে যেতে না চাইলে বাস থেকে নেমে যেতে বলেন প্রতিবাদকারীদের।
শুধু আয়াত পরিবহন নয়, একইরকম বিশৃঙ্খল চিত্র রাজধানীর অধিকাংশ গণপরিবহনের। যদিও দেশে নতুন করে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে যত আসন, তত যাত্রী নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচলের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। তবে রাজধানীর চিত্র দেখে মনে হয় ওই সিদ্ধান্ত যেন শুধু কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না অনেক যাত্রী এবং পরিবহন চালক-শ্রমিকরা। গতকাল রাজধানীর একাধিক রুট ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাসে গাদাগাদি করে যাত্রীদের চলাচল করতে হচ্ছে। যাদের অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক। এছাড়া সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধির অন্যান্য শর্ত পালনেও অনীহা দেখা গেছে পরিবহন চালক-কর্মীদের মধ্যে। সকালের দিকে বাসগুলো কিছুটা ফাঁকা থাকলেও বেলা বাড়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন রুটের বাসগুলোতে একই অবস্থা দেখা গেছে।
আয়াত পরিবহনের যে বাসটির কথা বলা হচ্ছিল তার চালক ও সহকারীকে মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। বাসে থাকা যাত্রীদের মধ্যেও অনেকের মাস্ক ছিল না। মাস্ক ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে বাসটির চালক বলেন, ‘দিনে ৮-১০ ঘণ্টার বেশি সময় বাস চালাতে হয়। এত সময় মাস্ক পরে থাকা যায় না। যাত্রীরা না পরলে আমরা কী করব।’
বাসটির চালকের সহকারী শাকিলের কাছে সরকারি নির্দেশনা ভেঙে গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠানোর কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনার কাছে কৈফিয়ত দিতে পারব না। বাস না ভরা পর্যন্ত যাত্রী তোলা হবে।’ আর একই প্রশ্নের উত্তরে চালক বলেন, ‘যাত্রীরা নিজ থেকে উঠে। আমরা তো জোর করে তুলছি না। আর আজকে (গতকাল) বাস কম তাই যাত্রী বেশি মনে হচ্ছে।’
একই চিত্র দেখা যায় লাব্বাইক, এসএম লাভলী, বলাকা, সায়মা, গাবতলী এক্সপ্রেস, অনাবিল ও বিহঙ্গসহ বেশিরভাগ গণপরিবহনে। এসব বাসে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী তোলা হয়েছে। বেশিরভাগ বাসের চালকসহ অন্য কর্মীদেরও মাস্ক পরতে দেখা যায়নি। বাসগুলোতে যাত্রীদের জন্য ছিল না স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও।
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর পল্টন, শাহবাগ, বাংলা মোটর ও ফার্মগেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ বাসে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করা হচ্ছে। বিকেল ৫টায় বাংলা মোটর এলাকায় দাঁড়িয়ে লাব্বাইক পরিবহনের সব বাসে অতিরিক্ত যাত্রীতে ঠাসা দেখা যায়। এসব বাসের চালক-সহকারীদের মুখে দেখা যায়নি মাস্ক।
এই পরিবহন কোম্পানিটির একটি বাসের সহকারী মঞ্জুর সঙ্গে কথা হয় দেশ রূপান্তরের। ইচ্ছে করে নয়, যাত্রীরাই জোর করে বাসে উঠে পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থেকে আসার সময় মাত্র ১০ জন যাত্রী পাইছি। মৌচাক আসার পর চাকরির পরীক্ষার্থীরা গাদাগাদি করে বাসে উঠছে। আমাদের কিছু করার নাই।’ নিজের মুখে মাস্ক না থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাত্রীদের হুড়োহুড়িতে মাস্ক পড়ে গেছে।’
নিয়ম ভেঙে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণ জানতে চাইলে শাহবাগ মোড়ে গাবতলী এক্সপ্রেস পরিবহনের এক চালক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সকালে এক ট্রিপ দিয়ে ভাতের টাকা জোগাড় হয়নি। শুক্রবার যাত্রী কম। বিকেলে কিছু যাত্রী পেয়েছি। সরকারি নির্দেশ মানলে তো পেট চলবে না।’ মুখে মাস্ক না থাকার কারণ জানতে চাইলে বাসটির এক যাত্রী বলেন, ‘বাসে এত যাত্রী যে দম নিতে কষ্ট হয়। তাই মাস্ক খুলে পকেটে রেখে দিয়েছি।’ একই বাসের চালকের সহকারী নজরুলের মুখেও ছিল না মাস্ক। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাস্ক পরে কথা বললে যাত্রীরা শুনতে পায় না।’
পরিবহন মালিকদের দাবি মেনে গত ১৫ জানুয়ারি থেকে ‘যত সিট তত যাত্রী’ নিয়মে বাস চলাচলের সিদ্ধান্ত দেয় সরকার। তবে কোনোভাবেই বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী বহন করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া বাসে যাত্রীদের জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা এবং চালক-তার সহকারী ও যাত্রীদের মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে এসবের কোনো কিছুই মানছে না বেশিরভাগ গণপরিবহন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘সকালে অফিস চলাকালে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে। যে পরিমাণ যাত্রী থাকে সে পরিমাণ গণপরিবহন নেই। যে কারণে আসনের চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করতে হয়। যাত্রীরাও বাধ্য হয়ে পরিবহনে উঠে পড়েন।’ তিনি আরও বলেন, ‘অতিরিক্ত যাত্রী যাতে পরিবহন করা না হয় সেজন্য সব মালিক ও শ্রমিকদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তদারকি করছে।’