সমান শ্রম দিয়েও অর্ধেক বেতন
আবদুল আজিজ, কক্সবাজার | ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০
দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকিপল্লী গড়ে উঠেছে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের নাজিরারটেকে। যেখানে ছোট-বড় ৯৫০টি মহালে শুঁটকি উৎপাদনকাজে জড়িত অন্তত ২০ হাজার শ্রমিক। তাদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার, যারা শুধু সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পুরুষ শ্রমিকের সমান এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি শ্রম দিয়েও শুঁটকিপল্লীর নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকের পারিশ্রমিকের অর্ধেকেরও কম টাকা মজুরি পাচ্ছেন। সারা দিন কাজের জন্য একজন পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
বেতনবৈষম্য নিয়ে নারী শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, তারা বিষয়টি নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পান। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, পেটের দায়ে শুঁটকিপল্লীতে কাজ করছেন। ন্যায্য বেতনের দাবি জানালে মালিকপক্ষের লোকজন তাদের কাজ থেকে তাড়িয়ে দেন বা হুমকি দেন। আর এই চাকরি ছাড়া সংসার চালানো তাদের জন্য অসম্ভব।
স্বামী পরিত্যক্তা হারেছা বেগম (৩০) দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লীতে। এই নারী তার তিন শিশুসন্তানের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে সেখানে শ্রমিকের কাজ নেন। সারা দিন কাজ করে বেতন পান ২৫০/৩০০ টাকা। সামান্য এই উপার্জনে হারেছার সংসার চলে খুব টানাপড়েনে।
হারেছা শুধু একাই নন, তার মতো একই দশা কক্সবাজার শুঁটকিপল্লীতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা প্রায় ১২ হাজার নারী শ্রমিকের সবারই। তাদের বেতন কারও ২০০ আবার কারও ২৫০/৩০০ টাকা। সামান্য এই আয়ে চলে না তাদের সংসার। অথচ তারা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে বেশি কাজ করেন।
হারেছা বেগমের ভাষ্যমতে, স্বামীর সঙ্গে থাকতেন কক্সবাজারের মহেশখালীর ঘোরকঘাটা এলাকায়। স্বামীর পরকীয়ার জেরে তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় ২০২০ সালে। তখন বিচারের আশায় নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করেও কোনো ফল পাননি। পরে কক্সবাজার শহরে এসে কাজ নেন শুঁটকিপল্লীতে। সেই থেকে তিন শিশুসন্তান নিয়ে শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। সংসারের খরচ জোগাতে বাধ্য হয়েই শুঁটকিমহালে দিনমজুরের কাজ করেন। প্রতিদিন ভোর ৬টায় কাজে আসেন, ফেরেন সন্ধ্যা ৭টায়। দৈনিক ১১ ঘণ্টা কাজ শেষে মজুরি পান ৩০০ টাকা। এই টাকায় তার সংসার চলে না। অথচ একই জায়গায় একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিক সামশুল আলম (৩৫) মজুরি পান ৫০০ টাকা।
এমন বৈষম্যের চিত্র দেখা যায় পার্শ্ববর্তী মোহাম্মদ আলমের মাছ খোলায়ও। সেখানে কাজ করে ১৬ বছর বয়সী সাইমা। সে জানায়, তার বাবা রফিক উল্লাহ এক বছর আগে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। অসুস্থ মা ও দুই ভাইবোনের সংসারের খরচ জোগাতে সে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। পায় মাত্র ২০০ টাকা। এখানেও পুরুষদের বেতন বরাবরই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
বেতনের এমন বৈষম্য কেন? এমন প্রশ্নে তেমন কেউই কথা বলতে না চাইলেও তৈয়বা বেগম নামে এক নারী জানান, এই বৈষম্য নাজিরারটেক শুঁটকিমহালের শুরু থেকে। এটাই এখানকার নিয়ম। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে। নতুন লোক নির্বাচন করবে। তাই কিছুই করার নেই। পেট চালানোর জন্য এই অন্যায় মেনে নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে।
অবশ্য বেতনবৈষম্যের বিষয়ে শুঁটকিমহাল মালিকদের দাবি ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে একটি মাছ খোলার মালিক জাফর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব জায়গাতে একই রেট। এ ছাড়া নাজিরারটেকে নারী শ্রমিক যেভাবে পাওয়া যায়, ঠিক সেভাবে পুরুষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। আবার পুরুদের কাজ নারীদের চেয়ে এগিয়ে। তাই তাদের বাড়তি বেতন দেওয়া হয়।’ একই ধরনের কথা বলেন আরও কয়েকজন মাছ খোলার মালিক।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক উপকূলের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, নুনিয়াছটা, সিসিডিবি ও পানিরকূপপাড়াসহ মোট ২১টি গ্রাম নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকিমহালটি গড়ে উঠেছে। এসব গ্রামে বাস করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।
শুঁটকিমহাল নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’। তাদের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ১১৭। সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ বলেন, বর্তমানে ছোট-বড় ৯৫০টি শুঁটকিমহালে কাজ করছেন ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ১২ হাজার। পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কারণ জানতে চাইলে আতিক উল্লাহ বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। তা ছাড়া পুরুষের মতো নারীরা ভারী কাজ করতে পারেন না। শারীরিকভাবেও তারা ফিট নন।’
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান জানান, গত মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল। এবার শুঁটকির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীর অবদান উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
শেয়ার করুন
আবদুল আজিজ, কক্সবাজার | ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০

দেশের সবচেয়ে বড় শুঁটকিপল্লী গড়ে উঠেছে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের নাজিরারটেকে। যেখানে ছোট-বড় ৯৫০টি মহালে শুঁটকি উৎপাদনকাজে জড়িত অন্তত ২০ হাজার শ্রমিক। তাদের মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার, যারা শুধু সন্তানের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে বছরের পর বছর শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু পুরুষ শ্রমিকের সমান এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি শ্রম দিয়েও শুঁটকিপল্লীর নারী শ্রমিক পুরুষ শ্রমিকের পারিশ্রমিকের অর্ধেকেরও কম টাকা মজুরি পাচ্ছেন। সারা দিন কাজের জন্য একজন পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।
বেতনবৈষম্য নিয়ে নারী শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, তারা বিষয়টি নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতেও ভয় পান। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, পেটের দায়ে শুঁটকিপল্লীতে কাজ করছেন। ন্যায্য বেতনের দাবি জানালে মালিকপক্ষের লোকজন তাদের কাজ থেকে তাড়িয়ে দেন বা হুমকি দেন। আর এই চাকরি ছাড়া সংসার চালানো তাদের জন্য অসম্ভব।
স্বামী পরিত্যক্তা হারেছা বেগম (৩০) দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন নাজিরারটেক শুঁটকিপল্লীতে। এই নারী তার তিন শিশুসন্তানের ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে সেখানে শ্রমিকের কাজ নেন। সারা দিন কাজ করে বেতন পান ২৫০/৩০০ টাকা। সামান্য এই উপার্জনে হারেছার সংসার চলে খুব টানাপড়েনে।
হারেছা শুধু একাই নন, তার মতো একই দশা কক্সবাজার শুঁটকিপল্লীতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা প্রায় ১২ হাজার নারী শ্রমিকের সবারই। তাদের বেতন কারও ২০০ আবার কারও ২৫০/৩০০ টাকা। সামান্য এই আয়ে চলে না তাদের সংসার। অথচ তারা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে বেশি কাজ করেন।
হারেছা বেগমের ভাষ্যমতে, স্বামীর সঙ্গে থাকতেন কক্সবাজারের মহেশখালীর ঘোরকঘাটা এলাকায়। স্বামীর পরকীয়ার জেরে তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় ২০২০ সালে। তখন বিচারের আশায় নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করেও কোনো ফল পাননি। পরে কক্সবাজার শহরে এসে কাজ নেন শুঁটকিপল্লীতে। সেই থেকে তিন শিশুসন্তান নিয়ে শুরু হয় তার জীবনযুদ্ধ। সংসারের খরচ জোগাতে বাধ্য হয়েই শুঁটকিমহালে দিনমজুরের কাজ করেন। প্রতিদিন ভোর ৬টায় কাজে আসেন, ফেরেন সন্ধ্যা ৭টায়। দৈনিক ১১ ঘণ্টা কাজ শেষে মজুরি পান ৩০০ টাকা। এই টাকায় তার সংসার চলে না। অথচ একই জায়গায় একই কাজ করে পুরুষ শ্রমিক সামশুল আলম (৩৫) মজুরি পান ৫০০ টাকা।
এমন বৈষম্যের চিত্র দেখা যায় পার্শ্ববর্তী মোহাম্মদ আলমের মাছ খোলায়ও। সেখানে কাজ করে ১৬ বছর বয়সী সাইমা। সে জানায়, তার বাবা রফিক উল্লাহ এক বছর আগে আরেকটি বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। অসুস্থ মা ও দুই ভাইবোনের সংসারের খরচ জোগাতে সে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে। পায় মাত্র ২০০ টাকা। এখানেও পুরুষদের বেতন বরাবরই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
বেতনের এমন বৈষম্য কেন? এমন প্রশ্নে তেমন কেউই কথা বলতে না চাইলেও তৈয়বা বেগম নামে এক নারী জানান, এই বৈষম্য নাজিরারটেক শুঁটকিমহালের শুরু থেকে। এটাই এখানকার নিয়ম। এ নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেবে। নতুন লোক নির্বাচন করবে। তাই কিছুই করার নেই। পেট চালানোর জন্য এই অন্যায় মেনে নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে।
অবশ্য বেতনবৈষম্যের বিষয়ে শুঁটকিমহাল মালিকদের দাবি ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে একটি মাছ খোলার মালিক জাফর আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সব জায়গাতে একই রেট। এ ছাড়া নাজিরারটেকে নারী শ্রমিক যেভাবে পাওয়া যায়, ঠিক সেভাবে পুরুষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। আবার পুরুদের কাজ নারীদের চেয়ে এগিয়ে। তাই তাদের বাড়তি বেতন দেওয়া হয়।’ একই ধরনের কথা বলেন আরও কয়েকজন মাছ খোলার মালিক।
কক্সবাজার পৌরসভার ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক উপকূলের কুতুবদিয়াপাড়া, সমিতিপাড়া, ফদনারডেইল, মোস্তাইক্যাপাড়া, বাসিন্যাপাড়া, নুনিয়াছটা, সিসিডিবি ও পানিরকূপপাড়াসহ মোট ২১টি গ্রাম নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকিমহালটি গড়ে উঠেছে। এসব গ্রামে বাস করেন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা অন্তত ৭০ হাজার মানুষ।
শুঁটকিমহাল নিয়ন্ত্রণ করে ‘নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি’। তাদের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ১১৭। সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ বলেন, বর্তমানে ছোট-বড় ৯৫০টি শুঁটকিমহালে কাজ করছেন ২০ হাজারের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে নারী শ্রমিক প্রায় ১২ হাজার। পুরুষের দৈনিক মজুরি ৭০০-৮০০ টাকা হলেও নারীদের দেওয়া হচ্ছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। কারণ জানতে চাইলে আতিক উল্লাহ বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। তা ছাড়া পুরুষের মতো নারীরা ভারী কাজ করতে পারেন না। শারীরিকভাবেও তারা ফিট নন।’
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান জানান, গত মৌসুমে জেলায় ২০ হাজার ৬৩৭ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদিত হয়েছিল। এবার শুঁটকির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার মেট্রিক টন। যার বাজারমূল্য ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নারীর অবদান উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।