নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা
হদিস মেলে না দিনে রাতে করেন অফিস
কমল খান, নারায়ণগঞ্জ | ২৭ মে, ২০২২ ০০:০০
নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা কার্যালয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানের পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন তথ্য। অভিযানের পর থেকে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামকে খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, তাকে প্রতিদিন কোনো না কোনো উপজেলায় তদন্তে যেতে হয়, যে কারণে সাধারণত দিনে না করে রাতে অফিস করেন। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নারায়ণগঞ্জে নতুন নিয়োগ পাওয়া ৪১৪ জন শিক্ষকের এমপিওভুক্তির (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার-এমপিও) ফাইল প্রসেসের (প্রক্রিয়াকরণ) প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা শিক্ষা কার্যালয়ে অভিযান চালায়। আর এর পর থেকে শিক্ষা কর্মকর্তাকে তার কার্যালয়ে অফিস সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকরা তাদের ফাইল প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রতিদিন শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। কিন্তু তাকে অফিসে না পেয়ে ফাইলে স্বাক্ষর করাতে পারছেন না শিক্ষকরা।
জানা গেছে, সরকারের শিক্ষা বিভাগের অধীনে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্র্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ৪১৪ জন শিক্ষক সরাসরি সরকারি বিধি মোতাবেক এমপিও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে জেলার ১৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। যোগদানের পর ওই শিক্ষকদের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বেতন-ভাতা প্রাপ্তির জন্য জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। আর এই আবেদন প্রক্রিয়াকরণের জন্য নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রত্যেক শিক্ষককে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রথমে ১৫ হাজার করে এবং পরে আরও ৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে।
আড়াইহাজার উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক সালেহা আকতার জানান, তিনি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পিয়ন আবুল হোসেনের মাধ্যমে দুই দফায় ২০ হাজার টাকা দেওয়ার পর তার ফাইল প্রক্রিয়াকরণের কাজ শেষ হয়েছে। তিনি আরও জানান, তার মতো আরও অনেক শিক্ষককে প্রতিদিন টাকা নিয়ে পিয়ন আবুল হোসেনের কাছে বসে থাকতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিয়ন আবুল হোসেন ৬ বছর আগে অবসর গ্রহণের পর এখনো শিক্ষা অফিসে বহাল আছেন। তিনিই শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা আদায় করে শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামকে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও অনেক অভিযোগ। শহরের গণবিদ্যা নিকেতন উচ্চবিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, গত এক বছর ধরে তাদের বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি (ব্যবস্থাপনা কমিটি) না থাকায় শরিফুল ইসলাম সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি স্কুলে না এলেও বেতনের চেক সই করতে তাকে জনপ্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। ওই শিক্ষক আরও জানান, করোনাকালীন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি না হওয়ায় ১৭টি বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শরিফুল ইসলাম। এর প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ভুক্তভোগী এক শিক্ষক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনি (শরিফুল ইসলাম) কাজ না বুঝলেও টাকাটা ঠিকই বুঝেন। টাকা ছাড়া কিছুই করেন না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম নিজেই নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিও ফাইল প্রসেস করে শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাচ্ছেন।
জেলার ৪১৪ জন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম শুরুতেই বলেন, ‘মাশআল্লাহ’। এরপর তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আল্লাহই ভালো জানেন। যারা লিখছেন তারা কীভাবে লিখছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি অবাক হচ্ছি। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, পুরো বিষয়টিই মিথ্যা। একজন শিক্ষা অফিসার তার রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কাজ করতে পারেন না। যারা এ সমস্ত কথা বলছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন কোনো না কোনো উপজেলায় আমাকে তদন্তে যেতে হয়। সে কারণে সাধারণত রাতে অফিস করি।’
শেয়ার করুন
কমল খান, নারায়ণগঞ্জ | ২৭ মে, ২০২২ ০০:০০

নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা কার্যালয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানের পর বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন তথ্য। অভিযানের পর থেকে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামকে খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, তাকে প্রতিদিন কোনো না কোনো উপজেলায় তদন্তে যেতে হয়, যে কারণে সাধারণত দিনে না করে রাতে অফিস করেন। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নারায়ণগঞ্জে নতুন নিয়োগ পাওয়া ৪১৪ জন শিক্ষকের এমপিওভুক্তির (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার-এমপিও) ফাইল প্রসেসের (প্রক্রিয়াকরণ) প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন জেলা শিক্ষা কার্যালয়ে অভিযান চালায়। আর এর পর থেকে শিক্ষা কর্মকর্তাকে তার কার্যালয়ে অফিস সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকরা তাদের ফাইল প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রতিদিন শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। কিন্তু তাকে অফিসে না পেয়ে ফাইলে স্বাক্ষর করাতে পারছেন না শিক্ষকরা।
জানা গেছে, সরকারের শিক্ষা বিভাগের অধীনে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্র্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ৪১৪ জন শিক্ষক সরাসরি সরকারি বিধি মোতাবেক এমপিও শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে জেলার ১৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। যোগদানের পর ওই শিক্ষকদের সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বেতন-ভাতা প্রাপ্তির জন্য জেলা শিক্ষা কার্যালয়ের মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। আর এই আবেদন প্রক্রিয়াকরণের জন্য নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রত্যেক শিক্ষককে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রথমে ১৫ হাজার করে এবং পরে আরও ৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে।
আড়াইহাজার উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক সালেহা আকতার জানান, তিনি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পিয়ন আবুল হোসেনের মাধ্যমে দুই দফায় ২০ হাজার টাকা দেওয়ার পর তার ফাইল প্রক্রিয়াকরণের কাজ শেষ হয়েছে। তিনি আরও জানান, তার মতো আরও অনেক শিক্ষককে প্রতিদিন টাকা নিয়ে পিয়ন আবুল হোসেনের কাছে বসে থাকতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পিয়ন আবুল হোসেন ৬ বছর আগে অবসর গ্রহণের পর এখনো শিক্ষা অফিসে বহাল আছেন। তিনিই শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষের টাকা আদায় করে শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামকে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও অনেক অভিযোগ। শহরের গণবিদ্যা নিকেতন উচ্চবিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, গত এক বছর ধরে তাদের বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি (ব্যবস্থাপনা কমিটি) না থাকায় শরিফুল ইসলাম সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি স্কুলে না এলেও বেতনের চেক সই করতে তাকে জনপ্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। ওই শিক্ষক আরও জানান, করোনাকালীন বিভিন্ন বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি না হওয়ায় ১৭টি বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শরিফুল ইসলাম। এর প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে ভুক্তভোগী এক শিক্ষক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তিনি (শরিফুল ইসলাম) কাজ না বুঝলেও টাকাটা ঠিকই বুঝেন। টাকা ছাড়া কিছুই করেন না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম নিজেই নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিও ফাইল প্রসেস করে শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাচ্ছেন।
জেলার ৪১৪ জন শিক্ষকের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম শুরুতেই বলেন, ‘মাশআল্লাহ’। এরপর তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। আল্লাহই ভালো জানেন। যারা লিখছেন তারা কীভাবে লিখছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি অবাক হচ্ছি। এ বিষয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, পুরো বিষয়টিই মিথ্যা। একজন শিক্ষা অফিসার তার রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কাজ করতে পারেন না। যারা এ সমস্ত কথা বলছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন কোনো না কোনো উপজেলায় আমাকে তদন্তে যেতে হয়। সে কারণে সাধারণত রাতে অফিস করি।’