পশুর হাটে ক্রেতা কম
রূপান্তর ডেস্ক | ৭ জুলাই, ২০২২ ০০:০০
ঈদুল আজহার আর তিন দিন বাকি। সারা দেশে কোরবানির পশুর হাটে কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলার পশু কেনাবেচার বড় বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে গোখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে এবার গরু লালন-পালনে বেশি খরচ হয়েছে। তার ওপর দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার প্রভাব পড়েছে ওইসব হাটে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল বুধবার পশুর হাটে ক্রেতা কমই ছিল। বন্যায় বিপর্যস্ত এলাকাগুলোর হাটে পশু যেমন কম আসছে, তেমনি ক্রেতাও কম।
এদিকে গরু বিক্রি করে খরচ উঠবে কিনা তা নিয়ে খামারিরা দুশ্চিন্তায় আছেন। সীমান্তের জেলাগুলোতে খামারি ও বেপারিদের আরেক দুশ্চিন্তা শেষ মুহূর্তে ভারতীয় গরু আসে কিনা তা নিয়ে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবারের ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানিযোগ্য পশু আছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। এর মধ্যে প্রশিক্ষিত খামারিদের কাছ থেকেই আসবে ৭৫ লাখ ৯০ হাজার ৪৪২টি। বাকি ৪৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৭টি কোরবানিযোগ্য উৎপাদিত পশু গৃহপালিত। পশুর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩। আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭। এ ছাড়া দেশে উট, দুম্বা ও গাড়লের সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯।
গত মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে প্রায় ২ হাজার ৪০০ হাটে পশু কেনাবেচা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে বসেছে ২১টি হাট।
রাজধানীতে হাটের চিত্র : ‘গরু কিনলে খাসি ফ্রি’ এমন আকর্ষণীয় অফার দিয়েও ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না বসিলা হাটের বিক্রেতারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ঈদের দুই দিন আগে থেকে জমজমাট হবে হাট। এজন্য ক্রেতা না এলেও হতাশ হচ্ছেন না তারা।
অন্যান্যবার বসিলা বাসস্ট্যান্ডের পাশে হাট বসলেও এবার একটু ভেতরে বসিলা গার্ডেন সিটির খালি জায়গায় নদীর পাড়ে বসানো হয়েছে হাট। সরেজমিনে দেখা যায়, মূল সড়ক থেকে ভেতরে নদীর পাড়ে হওয়ায় গাড়ি পার্কিংসহ নিরাপদে ঘুরে বেড়ানোর পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ থেকে ‘নবাব বাহাদুর’, ‘লাল বাহাদুর’ ‘বিশাল’, ‘সম্রাট’, ‘সুলতান’ ও ‘ঈশা খাঁ’ নামের গরু নিয়ে হাটে এসেছেন সালাম। তিনি জানান, ‘নবাব বাহাদুর’ ও ‘লাল বাহাদুর’ কিনলে সঙ্গে খাসি ফ্রি দেওয়া হবে। প্রতিটি গরুর দাম ১১ লাখ টাকা।
বেপারি ও হাটে আসা বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার পশুর দাম একটু বেশি। ক্রেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, বেপারিরা ইচ্ছা করে হাটে গরু কম এনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছেন। বসিলা হাটে ৪০ হাজার থেকে শুরু করে ১৬ লাখ টাকা মূল্যের গরু এসেছে। এ ছাড়া ছাগলের দাম গড়ে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্তও রয়েছে।
হাটের ইজারাদারদের পক্ষ থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাইক দিয়ে হাটের বিভিন্ন তথ্য জানানো হচ্ছে। বসিলা গার্ডেন সিটির বাসিন্দা শামীম সরকার বলেন, ‘সারা দিনই মাইকে ঘোষণা দেওয়া তো বিরক্তিকর।’
ডিজিটাল বুথে দেখা যায় অলস সময় কাটাচ্ছেন কর্মীরা। ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হননি বেপারি এবং ক্রেতারা। অন্যদিকে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের অস্থায়ী বুথে গিয়ে পাওয়া যায়নি চিকিৎসককে। তার সহকারী মাকসুদুল আলম জানান, ‘একজন চিকিৎসককে দুইটা হাটে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যার জন্য ডাক্তার সাহেব বুথে নেই।’ গাবতলী হাটের বিক্রেতারা জানান, এখনো বিক্রি জমে ওঠেনি। এখনো ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি। বৃহস্পতিবারের পর থেকে বিক্রি বাড়বে বলেও মনে করছেন তারা।
বিভিন্ন জেলার চিত্র : গত মঙ্গলবার ফেনীর বিভিন্ন হাটে দেখা গেছে গত বছরের তুলনায় গরুর দাম বেশি হাঁকছেন বিক্রেতারা। জেলার ৬ উপজেলা ও পৌরসভায় স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ১২৯টি পশুর হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে। জেলায় দুটি এলাকার সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে। ভারত থেকে যদি গরু-ছাগল না আসে তাহলে লাভবান হবেন বলে জানিয়েছেন খামারিরা। এ ব্যাপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সতর্ক রয়েছে বলে জানান বাহিনীর ৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার এ কে এম আরিফুল ইসলাম।
গত সোমবার সিরাজগঞ্জের এনায়েতবাজার হাটে আসা কয়েকজন খামারি দেশ রূপান্তরকে জানান, গত দুই বছর করোনার কারণে তারা লোকসান দিয়েছেন। করোনার প্রকোপ কম দেখে তারা আশা করেছিলেন এবার গরুর ভালো দাম পাবেন এবং পুষিয়ে নিতে পারবেন। তারা বলেন খইল, ভুসি ও দানাদার খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় গরু পালনের খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণে গরুর দামও বেশি। কয়েকজন ক্রেতা জানান, তাদের পছন্দ অনুযায়ী গরু কিনতে এবার হিমশিম খাচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জের অন্যান্য এলাকার হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাটগুলোতে প্রচুর পশু আমদানি হলেও প্রত্যাশার চেয়ে বেচাকেনা কম। জেলার ৯ উপজেলায় এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৩ লাখ ৯২ হাজার পশু প্রস্তুত করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার খামারি ও চাষিরা বলছেন, হাওরাঞ্চলে বন্যার প্রভাব পড়েছে জেলার কোরবানির পশুর বাজারে।
কুষ্টিয়া হাটের ইজারাদার কামাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্যান্য বারের মতো এ বছর সিলেট ও চট্টগ্রামের বেপারিদের আগমন কম। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো হাওরাঞ্চলে বন্যার কারণে ওই অঞ্চলের গরু ঢাকার বেপারিরা খুব কম দামে নিয়ে এসেছেন।’
ভেড়ামারা উপজেলার খামারি সলক ম-ল বলেন ‘গুড় তো গুড়, গুড়ের বাটিসুদ্ধ গায়েব হওয়ার দশা। গত বছর কোরবানির ঈদের পর ৬ডা গরু কিনিচি সাড়ে ৪ লাখ টাকায়। প্রতিটা গরুর জন্যি দিনে খাওয়া খরচ হয় ৩৫০-৪০০ টাকা। বছরে একটা গরু বড় করতি খরচই হয়ে যায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সমিতির ঋণের টাকা সুদসহ দিতি হবি, এখন এই গরুর দাম ১ লাখ বা ৯০ হাজার কয়; তালি তো ঘরবাড়ি বেচি সব টাকা শোধ করা লাগবিনি।’
কৃষি ব্যাংকের কুষ্টিয়া অঞ্চলের মুখ্য আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মুনসুরুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পশু মোটাতাজাকরণ খাতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা খামারিদের ঋণ দেওয়া আছে। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক, এনজিও এবং অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানও ঋণ দিয়েছে।’
সম্প্রতি বগুড়ার ধাপের হাট ও মহাস্থান হাট ঘুরে জানা গেল বন্যা হওয়ায় এবার বগুড়ার কোরবানি পশুর হাটগুলোতে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামের গরুর বেপারি বা পাইকারদের দেখা মিলছে হাতেগোনা।
বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানান, পছন্দের গরু-ছাগল থাকলেও তাদের বাজেট অনুযায়ী এবার দাম বেশি মনে হচ্ছে। মহাস্থান হাটেই কথা হয় রাজধানীর গাবতলী এলাকার পাইকার রফিকুল, চট্টগ্রামের পাইকার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ কয়েকজন পাইকারের সঙ্গে। তাদের বেশিরভাগই বলছেন, গরুর দাম আগের বছরের তুলনায় বেশি।
বন্যাকবলিত এলাকায় ভিন্ন চিত্র : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট। গত ১৬ জুন থেকে শুরু হওয়া বন্যায় জেলায় প্রায় অর্ধলাখ বাড়িঘর ভেঙে গেছে। ফসলহানিসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। এই অবস্থায় আসন্ন ঈদুল আজহায় সিলেটে কোরবানির সংখ্যা কিছুটা হলেও কম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত সোমবার নগরীর কাজিরবাজারসহ একাধিক হাটে গিয়ে দেখা গেছে, হাট এখনো ফাঁকা। বিক্রেতারা গরু-ছাগল খুঁটিতে বেঁধে রেখে অলস সময় কাটাচ্ছেন।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার এলাকার খামারি আবদুস সাত্তার জানান, প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তিনি খামার গড়েছেন। কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য উপযুক্ত ৩০টি গরু রয়েছে তার খামারে। কয়েকটি ইতিমধ্যে হাটেও তুলেছেন, তবে এখনো বেচতে পারেননি। ক্রেতারা যে দাম হাঁকাচ্ছেন সেই দামে বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে।
ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের চার জেলার ৩৪টি উপজেলায় ১২০ কোটি ৮৯ লাখ ৫৯ হাজার ৩৫০ টাকার পশুসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় বানের পানিতে সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় ৪২২টি গরু, ৩৭টি মহিষ, ৬৬৯টি ছাগল, ৫১৪টি ভেড়া মারা গেছে। বন্যার পানি কিছুটা কমলেও এখনো পানির নিচে অনেক কোরবানির পশুর হাট।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মঙ্গলকাটা পশুর হাটের ইজারাদার জানালেন গত সোমবার হাট বসেছে। বন্যার কারণে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি কম।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পাঠানবাড়ি গ্রামের খামার ব্যবসায়ী আমিনুর রশিদ রনক জানান, ১৮টি অস্ট্রেলিয়ান ফিজিয়ান জাতের গরু দীর্ঘদিন ধরেই পালন করেছিলেন। ঈদুল আজহায় হাটে তুলবেন। কিন্তু বানের পানিতে বড় ৯টি গরুই মারা গেছে।
নেত্রকোনায় বন্যার কারণে রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী থাকায় বাইর থেকে গ্রামীণ এলাকায় গবাদিপশুর হাটে ক্রেতা, বিক্রেতা ও বেপারি তুলনামুলকভাবে অনেক কম।
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী পাঁচগাঁও পশুর হাট। পাঁচগাঁও বাজারটি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার হাটের দিন থাকলেও শুধু সোমবারই গবাদিপশু কেনাবেচা হয়। উপজেলার ৮টি ইউনিয়নসহ পাশর্^বর্তী সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর, বাগলীসহ প্রায় ১২-১৫টি গ্রাম এবং মধ্যনগরের উত্তর ও দক্ষিণ বংশিকু-া, মহেষখোলাসহ ২০-২৫টি গ্রাম এবং জেলা শহর থেকে লোকজন কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য এ হাটে আসেন। কিন্তু বন্যায় সড়ক ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের বেপারিরা এ হাটে আসতে পারছেন না।
(প্রতিবেদনের জন্য তথ্য দিয়েছেন ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেদক পাভেল রহমান, সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক ফখরুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি এ আর জুয়েল, নেত্রকোনার কে এম সাখাওয়াত হোসেন, সিরাজগঞ্জের মো. মুমীদুজ্জামান জাহান, ফেনীর মো. শফি উল্লাহ রিপন, কুষ্টিয়ার হাসান আলী ও বগুড়ার সংবাদদাতা সাখাওয়াত হোসেন জনি)
শেয়ার করুন
রূপান্তর ডেস্ক | ৭ জুলাই, ২০২২ ০০:০০

ঈদুল আজহার আর তিন দিন বাকি। সারা দেশে কোরবানির পশুর হাটে কেনাবেচা শুরু হয়ে গেছে। সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলার পশু কেনাবেচার বড় বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে গোখাদ্যের দাম বাড়ার কারণে এবার গরু লালন-পালনে বেশি খরচ হয়েছে। তার ওপর দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যার প্রভাব পড়েছে ওইসব হাটে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল বুধবার পশুর হাটে ক্রেতা কমই ছিল। বন্যায় বিপর্যস্ত এলাকাগুলোর হাটে পশু যেমন কম আসছে, তেমনি ক্রেতাও কম।
এদিকে গরু বিক্রি করে খরচ উঠবে কিনা তা নিয়ে খামারিরা দুশ্চিন্তায় আছেন। সীমান্তের জেলাগুলোতে খামারি ও বেপারিদের আরেক দুশ্চিন্তা শেষ মুহূর্তে ভারতীয় গরু আসে কিনা তা নিয়ে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবারের ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানিযোগ্য পশু আছে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি। এর মধ্যে প্রশিক্ষিত খামারিদের কাছ থেকেই আসবে ৭৫ লাখ ৯০ হাজার ৪৪২টি। বাকি ৪৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৭টি কোরবানিযোগ্য উৎপাদিত পশু গৃহপালিত। পশুর মধ্যে গরু-মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩। আর ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭। এ ছাড়া দেশে উট, দুম্বা ও গাড়লের সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯।
গত মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে প্রায় ২ হাজার ৪০০ হাটে পশু কেনাবেচা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে বসেছে ২১টি হাট।
রাজধানীতে হাটের চিত্র : ‘গরু কিনলে খাসি ফ্রি’ এমন আকর্ষণীয় অফার দিয়েও ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না বসিলা হাটের বিক্রেতারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, ঈদের দুই দিন আগে থেকে জমজমাট হবে হাট। এজন্য ক্রেতা না এলেও হতাশ হচ্ছেন না তারা।
অন্যান্যবার বসিলা বাসস্ট্যান্ডের পাশে হাট বসলেও এবার একটু ভেতরে বসিলা গার্ডেন সিটির খালি জায়গায় নদীর পাড়ে বসানো হয়েছে হাট। সরেজমিনে দেখা যায়, মূল সড়ক থেকে ভেতরে নদীর পাড়ে হওয়ায় গাড়ি পার্কিংসহ নিরাপদে ঘুরে বেড়ানোর পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ থেকে ‘নবাব বাহাদুর’, ‘লাল বাহাদুর’ ‘বিশাল’, ‘সম্রাট’, ‘সুলতান’ ও ‘ঈশা খাঁ’ নামের গরু নিয়ে হাটে এসেছেন সালাম। তিনি জানান, ‘নবাব বাহাদুর’ ও ‘লাল বাহাদুর’ কিনলে সঙ্গে খাসি ফ্রি দেওয়া হবে। প্রতিটি গরুর দাম ১১ লাখ টাকা।
বেপারি ও হাটে আসা বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার পশুর দাম একটু বেশি। ক্রেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, বেপারিরা ইচ্ছা করে হাটে গরু কম এনে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছেন। বসিলা হাটে ৪০ হাজার থেকে শুরু করে ১৬ লাখ টাকা মূল্যের গরু এসেছে। এ ছাড়া ছাগলের দাম গড়ে ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্তও রয়েছে।
হাটের ইজারাদারদের পক্ষ থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মাইক দিয়ে হাটের বিভিন্ন তথ্য জানানো হচ্ছে। বসিলা গার্ডেন সিটির বাসিন্দা শামীম সরকার বলেন, ‘সারা দিনই মাইকে ঘোষণা দেওয়া তো বিরক্তিকর।’
ডিজিটাল বুথে দেখা যায় অলস সময় কাটাচ্ছেন কর্মীরা। ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হননি বেপারি এবং ক্রেতারা। অন্যদিকে ভেটেরিনারি মেডিকেল টিমের অস্থায়ী বুথে গিয়ে পাওয়া যায়নি চিকিৎসককে। তার সহকারী মাকসুদুল আলম জানান, ‘একজন চিকিৎসককে দুইটা হাটে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। যার জন্য ডাক্তার সাহেব বুথে নেই।’ গাবতলী হাটের বিক্রেতারা জানান, এখনো বিক্রি জমে ওঠেনি। এখনো ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি। বৃহস্পতিবারের পর থেকে বিক্রি বাড়বে বলেও মনে করছেন তারা।
বিভিন্ন জেলার চিত্র : গত মঙ্গলবার ফেনীর বিভিন্ন হাটে দেখা গেছে গত বছরের তুলনায় গরুর দাম বেশি হাঁকছেন বিক্রেতারা। জেলার ৬ উপজেলা ও পৌরসভায় স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে ১২৯টি পশুর হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে। জেলায় দুটি এলাকার সঙ্গে ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে। ভারত থেকে যদি গরু-ছাগল না আসে তাহলে লাভবান হবেন বলে জানিয়েছেন খামারিরা। এ ব্যাপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সতর্ক রয়েছে বলে জানান বাহিনীর ৪ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার এ কে এম আরিফুল ইসলাম।
গত সোমবার সিরাজগঞ্জের এনায়েতবাজার হাটে আসা কয়েকজন খামারি দেশ রূপান্তরকে জানান, গত দুই বছর করোনার কারণে তারা লোকসান দিয়েছেন। করোনার প্রকোপ কম দেখে তারা আশা করেছিলেন এবার গরুর ভালো দাম পাবেন এবং পুষিয়ে নিতে পারবেন। তারা বলেন খইল, ভুসি ও দানাদার খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় গরু পালনের খরচ বেড়ে গেছে। সে কারণে গরুর দামও বেশি। কয়েকজন ক্রেতা জানান, তাদের পছন্দ অনুযায়ী গরু কিনতে এবার হিমশিম খাচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জের অন্যান্য এলাকার হাটে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাটগুলোতে প্রচুর পশু আমদানি হলেও প্রত্যাশার চেয়ে বেচাকেনা কম। জেলার ৯ উপজেলায় এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৩ লাখ ৯২ হাজার পশু প্রস্তুত করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার খামারি ও চাষিরা বলছেন, হাওরাঞ্চলে বন্যার প্রভাব পড়েছে জেলার কোরবানির পশুর বাজারে।
কুষ্টিয়া হাটের ইজারাদার কামাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অন্যান্য বারের মতো এ বছর সিলেট ও চট্টগ্রামের বেপারিদের আগমন কম। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি তা হলো হাওরাঞ্চলে বন্যার কারণে ওই অঞ্চলের গরু ঢাকার বেপারিরা খুব কম দামে নিয়ে এসেছেন।’
ভেড়ামারা উপজেলার খামারি সলক ম-ল বলেন ‘গুড় তো গুড়, গুড়ের বাটিসুদ্ধ গায়েব হওয়ার দশা। গত বছর কোরবানির ঈদের পর ৬ডা গরু কিনিচি সাড়ে ৪ লাখ টাকায়। প্রতিটা গরুর জন্যি দিনে খাওয়া খরচ হয় ৩৫০-৪০০ টাকা। বছরে একটা গরু বড় করতি খরচই হয়ে যায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সমিতির ঋণের টাকা সুদসহ দিতি হবি, এখন এই গরুর দাম ১ লাখ বা ৯০ হাজার কয়; তালি তো ঘরবাড়ি বেচি সব টাকা শোধ করা লাগবিনি।’
কৃষি ব্যাংকের কুষ্টিয়া অঞ্চলের মুখ্য আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মুনসুরুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পশু মোটাতাজাকরণ খাতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা খামারিদের ঋণ দেওয়া আছে। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক, এনজিও এবং অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানও ঋণ দিয়েছে।’
সম্প্রতি বগুড়ার ধাপের হাট ও মহাস্থান হাট ঘুরে জানা গেল বন্যা হওয়ায় এবার বগুড়ার কোরবানি পশুর হাটগুলোতে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামের গরুর বেপারি বা পাইকারদের দেখা মিলছে হাতেগোনা।
বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানান, পছন্দের গরু-ছাগল থাকলেও তাদের বাজেট অনুযায়ী এবার দাম বেশি মনে হচ্ছে। মহাস্থান হাটেই কথা হয় রাজধানীর গাবতলী এলাকার পাইকার রফিকুল, চট্টগ্রামের পাইকার মোয়াজ্জেম হোসেনসহ কয়েকজন পাইকারের সঙ্গে। তাদের বেশিরভাগই বলছেন, গরুর দাম আগের বছরের তুলনায় বেশি।
বন্যাকবলিত এলাকায় ভিন্ন চিত্র : স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত সিলেট। গত ১৬ জুন থেকে শুরু হওয়া বন্যায় জেলায় প্রায় অর্ধলাখ বাড়িঘর ভেঙে গেছে। ফসলহানিসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। এই অবস্থায় আসন্ন ঈদুল আজহায় সিলেটে কোরবানির সংখ্যা কিছুটা হলেও কম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত সোমবার নগরীর কাজিরবাজারসহ একাধিক হাটে গিয়ে দেখা গেছে, হাট এখনো ফাঁকা। বিক্রেতারা গরু-ছাগল খুঁটিতে বেঁধে রেখে অলস সময় কাটাচ্ছেন।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার এলাকার খামারি আবদুস সাত্তার জানান, প্রায় ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে তিনি খামার গড়েছেন। কোরবানির হাটে বিক্রির জন্য উপযুক্ত ৩০টি গরু রয়েছে তার খামারে। কয়েকটি ইতিমধ্যে হাটেও তুলেছেন, তবে এখনো বেচতে পারেননি। ক্রেতারা যে দাম হাঁকাচ্ছেন সেই দামে বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে।
ভয়াবহ বন্যায় সিলেটের চার জেলার ৩৪টি উপজেলায় ১২০ কোটি ৮৯ লাখ ৫৯ হাজার ৩৫০ টাকার পশুসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় বানের পানিতে সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় ৪২২টি গরু, ৩৭টি মহিষ, ৬৬৯টি ছাগল, ৫১৪টি ভেড়া মারা গেছে। বন্যার পানি কিছুটা কমলেও এখনো পানির নিচে অনেক কোরবানির পশুর হাট।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার মঙ্গলকাটা পশুর হাটের ইজারাদার জানালেন গত সোমবার হাট বসেছে। বন্যার কারণে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি কম।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পাঠানবাড়ি গ্রামের খামার ব্যবসায়ী আমিনুর রশিদ রনক জানান, ১৮টি অস্ট্রেলিয়ান ফিজিয়ান জাতের গরু দীর্ঘদিন ধরেই পালন করেছিলেন। ঈদুল আজহায় হাটে তুলবেন। কিন্তু বানের পানিতে বড় ৯টি গরুই মারা গেছে।
নেত্রকোনায় বন্যার কারণে রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী থাকায় বাইর থেকে গ্রামীণ এলাকায় গবাদিপশুর হাটে ক্রেতা, বিক্রেতা ও বেপারি তুলনামুলকভাবে অনেক কম।
কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী পাঁচগাঁও পশুর হাট। পাঁচগাঁও বাজারটি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার হাটের দিন থাকলেও শুধু সোমবারই গবাদিপশু কেনাবেচা হয়। উপজেলার ৮টি ইউনিয়নসহ পাশর্^বর্তী সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর, বাগলীসহ প্রায় ১২-১৫টি গ্রাম এবং মধ্যনগরের উত্তর ও দক্ষিণ বংশিকু-া, মহেষখোলাসহ ২০-২৫টি গ্রাম এবং জেলা শহর থেকে লোকজন কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য এ হাটে আসেন। কিন্তু বন্যায় সড়ক ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানের বেপারিরা এ হাটে আসতে পারছেন না।
(প্রতিবেদনের জন্য তথ্য দিয়েছেন ঢাকার নিজস্ব প্রতিবেদক পাভেল রহমান, সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক ফখরুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি এ আর জুয়েল, নেত্রকোনার কে এম সাখাওয়াত হোসেন, সিরাজগঞ্জের মো. মুমীদুজ্জামান জাহান, ফেনীর মো. শফি উল্লাহ রিপন, কুষ্টিয়ার হাসান আলী ও বগুড়ার সংবাদদাতা সাখাওয়াত হোসেন জনি)