
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দিন তারিখ ঘোষণা করে সরকারবিরোধী আন্দোলন হয় না। সময় হলে আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করা হবে।’ এদিকে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেছেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে সংগ্রাম, সেটা আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। এই সংগ্রামে দেশের জনগণই জয়ী হবে।’
গতকাল রবিবার দুপুরে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে কল্যাণ পার্টির নেতাদের সঙ্গে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তারা। দুপুর ২টার কিছুক্ষণ পর শুরু হয়ে আড়াই ঘণ্টাব্যাপী সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সরকার পতনে যুগপৎ আন্দোলন করতে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্য হয়েছে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নির্দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিশ্চিত করা, নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন, বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি আলেম-ওলামাদের মুক্ত করতে আন্দোলনের বিষয়েও আমরা একমত হয়েছি।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রথম দফা সংলাপে জাতীয় ঐক্য করার বিষয়ে নীতিগত ঐকমত্য ছিল, এখন দ্বিতীয় দফায় সুনির্দিষ্ট দাবি আদায়ের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে । যে ২৩ দলের সঙ্গে প্রথম দফায় সংলাপ হয়েছিল, তারা ছাড়াও অন্য যেকোনো দল এ দফায় সংলাপে আসতে পারে।’
দ্বিতীয় দফা সংলাপের পরই যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা আসবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আপনারা জানতে পারবেন।’
এ সময় কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের দিন-তারিখ প্রকাশ না করতে অনুরোধ করা হয়েছে, চমক আছে, অপেক্ষা করুন। এবার বিজয়ের কোনো বিকল্প নেই। বিজয় আমাদের হবেই। রাজপথে আমাদের দেখতে পাবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মনে করি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে সংগ্রামÑসেটা আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ। আমরা সবাই মিলে এই যুদ্ধে লড়ব এবং জয়ী হব। এখানে জয় ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই।’
বিএনপির পক্ষে সংলাপে আরও অংশ নেন ২০-দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। আর কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আবদুল আউয়াল মামুন, অতিরিক্ত মহাসচিব নুরুল কবির পিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব সোহেল মোল্লা, আব্দুল্লাহ আল হাসান সাকিব, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মাহবুবুর রহমান শামিম, উত্তরের সেক্রেটারি জামাল হোসেন, মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু হানিফ ও উত্তরের সেক্রেটারি আবু ইউসুফ।
বসতিতে হারিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাহাড়গুলো। বৃষ্টির পানি ধারণের জায়গাগুলো ভরাট করে গড়ে ওঠা এসব বসতির কারণে নগরীতে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এতে নগরী এখন বসবাসের অনুপযোগী। পাহাড় কেটে ও জলাধার ভরাট করে গত ২০ বছরে ১০টি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সিডিএ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। যদিও সিডিএর দাবি, পাহাড় কাটা হয়নি, নিচু জমি ভরাট করে আবাসন করা হয়েছে। নগরবিদরা একে ‘দুষ্ট পরিকল্পনা’ ও স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্য হাসিলের পরিকল্পনা বলে উল্লেখ করেছেন।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অনন্যা আবাসিক এলাকা। চান্দগাঁও ও কুয়াইশ এলাকার প্রায় ৬২ একর নিচু ভূমি ভরাট করে ১ হাজার ৭০০টি প্লটের বিশাল এক আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও শেষ হয় ২০১৮ সালের দিকে। আর শেষ হওয়ার পরপরই অক্সিজেন, বালুচরাসহ আশপাশ এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
শুধু এ আবাসিক এলাকার মাধ্যমে সিডিএ নগর দুর্ভোগ ডেকে আনেনি, পাহাড় কেটে ও জলাধার ভরাট করে সীতাকুন্ডের সিলিমপুর আবাসিক এলাকায় ২০১৩ সালে আংশিক প্লট বরাদ্দ দিয়েছে সিডিএ। বাকলিয়া এলাকার জলাধার ভরাট করে কল্পলোক আবাসিক এলাকা প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় (১ হাজার ৭০০ প্লট) গড়ে তোলা হয়েছে ২০০৫ থেকে ’০৭ সালে। এখন এই এলাকায় বাড়িঘর গড়ে উঠছে এবং পানির কারণে ভবনগুলোর নিচতলা রাস্তা থেকে উঁচু করে নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রকৃতি বিনাশ করে শুধু সিডিএই আবাসিক এলাকা গড়ে তুলছে না, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ২০০০ সালের দিকে ৪ হাজার ১৪৪ প্লটের কৈবল্যধাম বিশ্বব্যাংক কলোনি আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে পাহাড় কেটে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০০৪ সালের দিকে দক্ষিণ খুলশী এলাকায় পাহাড় কেটে ৬৫টি প্লটের সিটি করপোরেশন ভিআইপি আবাসিক এলাকা করেছে, আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কেটে ৫২০টি প্লটের লেকসিটি হাউজিং, বাকলিয়ায় নিচু এলাকা ভরাট করে ২৬টি প্লটের বগারবিল ও সৈয়দশাহ হাউজিং গড়ে তোলা হয়েছে।
বিশ^ বসতি দিবস আজ। এবারের বসতি দিবসের প্রতিবাদ্য ‘মাইন্ড দ্য গ্যাপ। লিভ অন ওয়ান অ্যান্ড প্লেস বিহাইন্ড’। এ উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে গৃহায়ন অধিদপ্তর।
প্রকৃতি বিনাশে পিছিয়ে নেই প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানও : সরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে যেখানে প্রকৃতি বিনাশ করে বসতি গড়ে তুলেছে, সেখানে ব্যক্তিগত ও প্রাইভেট অনেক প্রতিষ্ঠানও বসতি গড়ে তুলেছে। এদের মধ্যে অন্যতম জাকির হোসেন রোডে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা নাসিরাবাদ হাউজিং প্রপার্টিজ। পুরো এলাকায় একসময় সুউচ্চ পাহাড় ছিল, এখন পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাশে হয়েছে এয়াকুব ফিউচার পার্ক। এ স্থানে ২০০০ সালেও পাহাড় ও ইটভাটা ছিল। ইটভাটার মাধ্যমে পাহাড় সাবাড় করার পর ইটভাটা বন্ধ করে এখন সিডিএর অনুমোদনে গড়ে তোলা হয়েছে এয়াকুব ফিউচার পার্ক নামে আবাসন প্রকল্প। এ ছাড়া পশ্চিম খুলশীর উত্তরে কৃষ্ণচূড়া আবাসিক এলাকা, গোল্ডেন ভিউসহ কয়েকটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে পাহাড় কেটে। একই সঙ্গে আকবরশাহ এলাকায় শাপলা হাউজিং, বায়েজিদে হিলভিউ আবাসিক এলাকা, চন্দ্রনগর সোসাইটি, জালালাবাদ হাউজিং, দক্ষিণ খুলশী পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা, রহমান নগর আবাসিক এলাকা ও কসমোপলিটনসহ অনেক আবাসিক এলাকা পাহাড় কেটে কিংবা নিচু ভূমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে।
আইনে যা আছে : বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-তে পাহাড় কাটা সম্পর্কে বাধা-নিষেধ (৬খ) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন ও/বা মোচন করা যাইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে কোনো পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইতে পারে।
নগরবিদদের বক্তব্য : দেশের নগরগুলো নিয়ে গবেষণা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর গবেষণা কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বিশিষ্ট ভূগোলবিদ প্রফেসর নজরুল ইসলাম সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরের ভৌগোলিক সমীক্ষা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছেন। চট্টগ্রামে বসতি নিয়ে কথা হয় এ নগরবিদের কাছে। তিনি বলেন, ‘পাহাড় কেটে ও জলাধার ভরাট করে বসতির নামে যে পরিকল্পনা হচ্ছে তা হলো দুষ্ট পরিকল্পনা। একে অপরিকল্পনা না বলে বলতে হবে ভুল পরিকল্পনা এবং স্বার্থান্বেষী মহলের উদ্দেশ্য হাসিলের পরিকল্পনা। আর তাদের এ দুষ্ট পরিকল্পনার কারণে নগর দুর্যোগ শুরু হয়েছে।’
কিন্তু সিডিএ বলছে চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা, তাই পাহাড় না কেটে ও নিচু ভূমি ভরাট না করে বসতি সম্ভব নয়। এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশে পাহাড় কাটে না। আমরাই পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তুলছি। পাহাড়ই সৌন্দর্য। পাহাড় রেখে যেমন পরিকল্পনা করা যায় তেমনি নিচু ভূমি এলাকা রক্ষা করেও পরিকল্পনা করে বসতি নির্মাণ করা যায়।’
প্রফেসর নজরুল ইসলামের সঙ্গে একমত পোষণ করে রাশিয়া থেকে স্থাপত্য বিদ্যায় এবং নগর পরিকল্পনা বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়া স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ‘পাহাড় কাটা ও নিচু ভূমি ভরাটের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তা কার্যকর হয়নি। আর এতে নগরীর বিকাশ হয়েছে অপরিকল্পিত। এই মুহূর্তে নগরীর প্রান্তিক এলাকা ও উপজেলা পর্যায় নিয়ে পরিকল্পনা জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্যথায় উপজেলা সদরগুলোর বিকাশও অপরিকল্পিত হবে।’
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় গবেষণারত ও সিডিএর সাবেক ঊর্ধ্বতন স্থপতি মাহারিনা জাফরিন বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর অপরিকল্পিত বসতির কারণ হলো সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। ওয়াসা যেসব নিচু এলাকা চিহ্নিত করেছে সেসব এলাকায় আবাসন না করাই উত্তম ছিল। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো তা মানেনি। আর এতেই নগরীতে আজ দুর্ভোগ।’
সিডিএর বক্তব্য : সিডিএ পাহাড় কেটে কোনো আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেনি উল্লেখ করে সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘আমরা কিছু নিচু জায়গা ভরাট করে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছি, তবে সেগুলোতে যাতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো থাকে সে জন্য খাল ও ড্রেন নির্মাণের প্রস্তাবনা ছিল। বর্তমানে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় তা করা হচ্ছে।’
কিন্তু নগরজুড়ে আবাসিক এলাকার অনুমোদন দিয়ে থাকে সিডিএ। পাহাড় কেটে ও নিচু এলাকা ভরাট করে গড়ে ওঠা বসতির কারণে আজ নগর জীবন দুর্বিষহ। এ প্রশ্নের জবাবে কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘অন্যান্য সরকারি সংস্থা সিডিএ থেকে অনাপত্তিপত্র না নিয়ে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আবাসিক এলাকা গড়ে তুলেছে এবং সিডিএ সেসব এলাকায় ভবনের অনুমোদনও দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটু ব্যত্যয় হয়েছে।’
সমাধান কোথায়? : সিডিএর সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘সিডিএর প্রায় সব আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট করে। তাই আজ জলাবদ্ধতা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। সিডিএ যদি আবাসিক এলাকা গড়ে তুলতে পারে তাহলে জলাধারও তৈরি করতে হবে অথবা রক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় গুলশান ও ধানমন্ডি লেকের মাধ্যমে পানি ধারণের জায়গা করা হয়েছে। চট্টগ্রামেও এমন জলাধার তৈরি করতে হবে।’
এ বিষয়ে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় জলাধার নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া খাল ও ড্রেনও নির্মাণ করা হচ্ছে।’
প্রাকৃতিক জলাধার ছাড়া অতিরিক্ত পানি ধারণের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে বিশিষ্ট স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, ‘এ কাজটি সিডিএকে করতে হবে। কোন কোন এলাকায় প্রাকৃতিক জলাধার নির্মাণ করবে তা আগে থেকে নির্ধারণ করে সেই এলাকায় ঘরবাড়ি নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না।’
কয়েক বছর ধরেই দুর্গাপূজার সময় দেশের পরিবেশ কিছুটা থমথমে হয়ে ওঠে। পূজামণ্ডপগুলোতে সাম্প্রদায়িক হামলার শঙ্কায় থাকে উৎকণ্ঠা। নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে নেওয়া হয় বাড়তি ব্যবস্থা। তবে লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়ি এলাকার পুরান বাজারের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। সেখানে একই প্রাঙ্গণে হচ্ছে আজান, হচ্ছে উলুধ্বনি। মসজিদের আগরবাতি বা আতরের গন্ধ একাকার হয়ে যায় মন্দিরের ধূপের গন্ধে। দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে পাশাপাশি চলছে পৃথক দুটি ধর্মের উপাসনালয়।
শহরের বাসিন্দারা জানান, ১৮৩৬ সালে কালীমন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। ওই সময় লালমনিরহাট শহরে কালীবাড়ির পুরান বাজার এলাকায় আসা ধর্মপ্রাণ মুসলমান ব্যবসায়ীরা নামাজ আদায়ের জন্য তার পাশেই একটি ছোট ঘর তোলেন। সেটির নামকরণ করা হয় পুরান বাজার জামে মসজিদ। সেই থেকে এক উঠানেই চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের কাজ।
স্থানীয়রা জানান, পূজা শুরুর আগে মসজিদ ও মন্দির কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেয় নামাজ ও পূজার অনুষ্ঠানে সূচি নির্ধারণ করে। ফলে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে না। আজান থেকে নামাজের জামাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত মন্দিরের মাইক, ঢাকঢোলসহ যাবতীয় শব্দযন্ত্র বন্ধ থাকে। নামাজ শেষ হলে মন্দিরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়। এখানে কোনো বিশৃঙ্খলাও হয় না। শালীনতা বজায় রেখে একই উঠানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে আসছেন উভয় ধর্মের ধর্মাবলম্বীরা।
তারা জানান, গায়ে গায়ে লেগে থাকা মন্দির ও মসজিদ দেখতে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে আসে সাধারণ মানুষ। কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতও এই মন্দির ও মসজিদ পরিদর্শন করেছেন।
কালীবাড়ি এলাকার হাসানুল ইসলাম বলন, দীর্ঘ দিন ধরে এখানে দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিন্দুসম্প্রদায়ের লোকজন চালিয়ে আসছে। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনও মসজিদে নামাজ আদায় করে আসছেন। কিন্তু কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এটি সামাজিক সম্প্রীতির এক বড় উদাহরণ।
পুরান বাজার জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, মসজিদের আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবুও এখানে জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ স্বাধীনভাবে ঘুরতে আসে। আমরা তাদের সব কাজে সহযোগিতা করি। তারাও আমাদের সহযোগিতা করে। নামাজের সময় মন্দিরের ঢাকঢোল বন্ধ রাখা হয়। কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই যুগ যুগ ধরে চলছে এই সম্প্রীতির বন্ধন।
কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি মন্দিরের সভাপতি ও প্রধান পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী জানান, ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এলাকার নামকরণও করা হয় কালীবাড়ি। পরে এখানে বাজার গড়ে উঠলে বাজারের ব্যবসায়ী ও শহরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের পাশেই প্রতিষ্ঠা করেন পুরান বাজার জামে মসজিদ। সেই থেকে এক উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের কার্যক্রম।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, এখানকার মানুষ সব ধর্মের সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। যার প্রমাণ এক উঠানে কেন্দ্রীয় কালীবাড়ি মন্দির ও পুরান বাজার জামে মসজিদ।
কুয়েতপ্রবাসী এক বাংলাদেশি গত ২ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। পরে বগুড়া যাওয়ার উদ্দেশে বিমানবন্দর থেকে প্রাইভেট কারে প্রথমে উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে যান। সেখানে উত্তরবঙ্গগামী বাসের টিকিট কিনতে কাউন্টারে যাওয়ার সময় আরেক ব্যক্তি নিজেকে প্রবাসী পরিচয় দিয়ে জানান, তার কাছে বগুড়ার একটি অতিরিক্ত টিকিট আছে। তিনিও চাইলে সেটি নিতে পারেন। ওই ব্যক্তির কাছে ব্যাগপত্র ও বিদেশি মুদ্রা দেখে কুয়েতপ্রবাসী তাকে বিশ্বাস করেন ও টিকিট কিনে নেন। পরে তারা বাসে বসেন পাশাপাশি আসনেই। বাস ছাড়ার পর ওই ব্যক্তির দেওয়া বিস্কুট খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। পরে তার পরিবারের সদস্যরা যখন তাকে উদ্ধার করেন তখন তার সঙ্গে আনা কোনো জিনিসপত্রই ছিল না। বাসের শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তার পাশের আসনে বসা যাত্রীই সব নিয়ে সিরাজগঞ্জে নেমে গেছেন।
ওই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় ভুক্তভোগী ওই প্রবাসীর করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব বিমানবন্দর এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। অবশেষে গত শনিবার রাতে চক্রটির হোতা মো. আমির হোসেনসহ (৫২) চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তার অন্যরা হলোÑ লিটন মিয়া ওরফে মিল্টন (৪৮), আবু বক্কর সিদ্দিক ওরফে পারভেজ (৩৫) ও জাকির হোসেন (৪০)। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় মোবাইল, অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জাম, যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণে ব্যবহৃত লাগেজ ও চোরাই স্বর্ণ।
র্যাব জানিয়েছে, চক্রটি সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। তারা গত ১৫ বছরে প্রায় ৩০০ ভুক্তভোগীকে অজ্ঞান করে তাদের কাছ থেকে মূল্যবান মালামাল লুট করেছে। চক্রের মূলহোতা আমিরের বিরুদ্ধে অজ্ঞান ও মলম পার্টিসংক্রান্ত ১৫টিরও বেশি মামলা রয়েছে।
গতকাল রবিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, ব্যাংকপাড়ায় সাধারণ যাত্রীদের, ব্যাংকে আসা গ্রাহকদের টার্গেট করে থাকে। চক্রটি বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের টার্গেট করার লক্ষ্যে বিমানবন্দরের টার্মিনালে হাতে পাসপোর্ট ও লাগেজ নিয়ে প্রবাসফেরত যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করত। এটি মূলত তাদের একটি কৌশল। বিদেশফেরত যেসব ব্যক্তির কোনো স্বজন বিমানবন্দরে আসেন না এবং নিজস্ব গাড়ি নেই তাদের টার্গেট করে চক্রটি। তারা কৌশলে বিদেশফেরত ব্যক্তির সঙ্গে কুশল বিনিময় করে চক্রের অন্য সদস্যদের নিকটাত্মীয় বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরে একই এলাকার বাসিন্দা হিসেবে পরিচিত হয়ে তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য রাজি করাত। তারা একসঙ্গে বাসের টিকিট কেটে যাত্রা শুরু করত। ভ্রমণের সময় চক্রের সদস্যরা কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ মিশ্রিত বিস্কুট খাইয়ে ভুক্তভোগীদের অচেতন করত। এরপর প্রবাসীর সঙ্গে থাকা লাগেজের টোকেনের মাধ্যমে বাস থেকে মালামাল নিয়ে চক্রটি পরবর্তী স্টেশনে নেমে যেত।
গ্রেপ্তারদের বিষয়ে তিনি বলেন, চক্রের হোতা আমির বিমানবন্দর এলাকায় ফাস্টফুডের দোকানে চাকরির আড়ালে গত ১৫ বছর ধরে এসব অপরাধ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, চক্রে আরও ছয়-সাতজন বিভিন্ন সময়ে যুক্ত ছিল। তাদের মধ্যে অনেকে বর্তমানে কারাগারে। এ ছাড়া ১৫টি মামলার আসামি আমির র্যাব ও পুলিশের হাতে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়েছে। পরে জামিনে মুক্ত হয়। মূলত লুট করা টাকার একটি অংশ সে জামিনসংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যয় করে। আমিরের সহযোগী গ্রেপ্তার লিটন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। পরে সে মাইক্রোবাস চালানো শুরু করে। এর আড়ালে তিন-চার বছর ধরে আমিরের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছিল লিটন। সেও একাধিকবার একই ধরনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়। এ ছাড়া গ্রেপ্তার আবু বক্কর আট-নয় বছর বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানে কর্মরত ছিল। পরে গত ছয়-সাত বছর আগে নিজেই রাজধানীর শ্যামপুরে জুয়েলারির দোকান প্রতিষ্ঠা করে। জুয়েলারি দোকানের আড়ালে গত দুই-তিন বছর ধরে এ চক্রের লুট করা স্বর্ণ গ্রহণ, রূপ পরিবর্তন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। গ্রেপ্তার জাকির হোসেন ছাপাখানার ঠিকাদার হিসেবে কর্মরত। গত তিন-চার বছর আগে আমিরের মাধ্যমে চক্রে যোগ দেয়। সে লুট করা স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মালামাল রাজধানীর বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিল।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের খানাখন্দে রবিবার ভোরে বৃষ্টির পানি জমে। এতে গাজীপুর মহানগরীর কুনিয়া তারগাছ থেকে ঢাকার বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এ যানজটে দুর্ভোগে পড়ে ওই মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীরা। দীর্ঘ সময় গাড়ি না পেয়ে ও যানজটে অতিষ্ঠ হয়ে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে চলাচল করেছেন অনেক যাত্রী। এতে গাজীপুর অংশে আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী বাজার, স্টেশন রোড, মিলগেট, কলেজ গেট, কুনিয়া তারগাছা পর্যন্ত তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। বোর্ডবাজার থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্তও যানচলাচল ছিল ধীরগতি।
সরেজমিনে পরিবহন চালক ও মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রবিবার সপ্তাহের কর্মদিবসের প্রথম দিন হওয়ায় সকাল থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহনের চাপ অন্য দিনের চেয়ে বেশি ছিল। এ ছাড়া উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় মহাসড়কে খানাখন্দে গাড়িগুলো এমনিতেই ছিল ধীরগতি। অপরদিকে ভোরে বৃষ্টিতে রাজধানীর বিমানবন্দর ও গাজীপুর অংশে মহাসড়কের ওপর পানি জমে খানাখন্দগুলো বড় হয়ে যাওয়ায় চার লেনের মহাসড়ক সংকুচিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী অংশে মিল গেট থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত অসংখ্য খানাখন্দ বৃষ্টিতে বড় হয়ে গাড়ি চলাচলে ধীরগতি তৈরি হয়। আবার কোথাও কোথাও গাড়ি পুরোই আটকে গেছে।
চান্দনা চৌরাস্তা থেকে উত্তরার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম। তিনি জানান, বাসে উঠে কিছুদূর গিয়েই যানজটের মুখে পড়তে হয় তাকে। দীর্ঘসময় গাড়িতে বসে থাকলেও যানজট না কমায় কোথাও হেঁটে ও রিকশায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
অপর এক যাত্রী মেহেদী হাসান জানান, বাসের জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেও বাস না পেয়ে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে পথে সিএনজি অটোরিকশা করেও যানজটের কারণে বেশিদূর এগোতে পারেননি।
গাজীপুর পরিবহনের চালক ইসমাইল হোসেন জানান, সকাল ৮টায় গাড়ি ছেড়ে যানজটের কারণে ওই বাসের প্রায় যাত্রীই নেমে বিকল্প উপায়ে গন্তব্যে গিয়েছেন। ভোর ৫টায় গাজীপুরের শিমুলতলী থেকে ঢাকার উদ্দেশে ফার্স্ট ট্রিপ ছেড়ে গিয়েছে, কিন্তু সেই গাড়ি দুপুর ২টাও গন্তব্যে পৌঁছায়নি।
মহাসড়কে যানজটের অন্যতম কারণ শুধুই খানাখন্দ। এয়ারপোর্ট এলাকায় খানাখন্দে ভরা মহাসড়কে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় এ যানজট তৈরি হয়।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) আবু সায়েম নয়ন জানান, এয়ারপোর্ট এলাকায় উভয়মুখী রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমার কারণে এক লেনে গাড়ি চলাচল করেছে। ফলে ট্রাফিক চেইন সিস্টেমে জিএমপি এরিয়ার ঢাকামুখী রাস্তায় যানবাহনের ধীর গতি হয়। তবে এয়ারপোর্টের রাস্তার সমস্যার কারণে জিএমপির ময়মনসিংহমুখী ইনকামিংয়ে ধীরগতি থাকা সত্ত্বেও জিএমপির অভ্যন্তরে ময়মনসিংহমুখী রাস্তায় যান চলাচল একদম স্বাভাবিক ছিল। এ ক্ষেত্রে মহাসড়কটির ঢাকামুখী রাস্তা ব্যবহারকারীরা সাময়িক অসুবিধায় পড়ে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, মূলত রাজধানীর বিমানবন্দরে সড়কের ওপর পানি জমে থাকায় ঢাকাগামী লেনে যানজট তৈরি হয়। মহাসড়কের টঙ্গীর অংশে যথেষ্ট খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। বিমানবন্দর এলাকায় মহাসড়কে পানি জমে না থাকলে গাজীপুর থেকে গাড়িগুলো রাজধানীতে প্রবেশ সম্ভব ছিল। ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসনে কাজ করছে। বৃষ্টিতে তৈরি হওয়া মহাসড়কের খানাখন্দ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে।
ফরিদপুরে বহুল আলোচিত দুই হাজার কোটি টাকা পাচার মামলার অন্যতম আসামি দুই ভাই মো. ইমতিয়াজ হাসান রুবেল ও সাজ্জাদ হোসেন বরকতের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। গতকাল রবিবার তিন মামলায় রুবেল-বরকতের সহযোগী সাইফুল ইসলামের (৩৫) জামিনের আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় ফরিদপুরের দুই আদালত।
পুলিশ ও আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর শহরতলীর বনগ্রামের বাসিন্দা মাজেদ মল্লিকের ছেলে সাইফুল এক সময় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তবে পরবর্তীতে বহিষ্কার করা হয়। রুবেল-বরকতের নির্দেশে বিভিন্ন ব্যক্তিকে মারধর ও হুমকির মূল নায়ক ছিলেন।
ছাত্রলীগের সাবেক এ নেতার আইনজীবী শফিক মুন্সী বলেন, প্রথমে অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে একটি মামলার শুনানিতে জামিন নাকচ করা হয়। পরে জেলা জজ আদালতে বাকি দুটি মামলার শুনানিতে জামিন নাকচ হয়ে যায়।
তিনি জানান, জেলা ও দায়রা জজ আকবর আলী শেখের আদালতে দুটি এবং অতিরিক্ত জেলা জজ-২ এর শিয়াবুল ইসলামের আদালতে একটিসহ তিনটি মামলায় জামিনের আবেদন করা হয়। তিনটি মামলাতেই তার জামিনের আবেদন নাকচ করে দেয় আদালত।
তিনি জানান, তিন মামলার মধ্যে রয়েছে ফরিদপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম চৌধুরীর ওপর হামলা ও কুপিয়ে জখম করা, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক দীপক মজুমদারের ওপর হামলা ও কুপিয়ে জখম করা এবং বিআরটিসির ম্যানেজার দুলাল লস্করের চাঁদাবাজীর অভিযোগে করা মামলা।
সাইফুল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঢাকার কাফরুল অভিযোগে রুবেল-বরকতের বিরুদ্ধে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের যে মামলা করে সেই মামলারও চার্জশিটভুক্ত আসামি সাইফুল।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে ছোটন হত্যা মামলা, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার মামলাসহ আরও বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে।
২০২০ সালের ১৬ মে শহরের গোয়ালচামট মহল্লার মোল্লাবাড়ি সড়কে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি সুবল চন্দ্র সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে ১৮ মে মামলা করেন সুবল চন্দ্র সাহা।
ওই মামলার সূত্র ধরে ওই বছর ৭ জুন ফরিদপুরে পুলিশের বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। ওই দিন ফরিদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের শহরতলীর বদরপুরস্থ আফসানা মঞ্জিল নামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রুবেল বরকতসহ ১০জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে আত্মগোপনে ছিলেন সাইফুল।
ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সুমন রঞ্জন সরকার জানিয়েছেন, আদালতে জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পর সাইফুলকে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, মানি লন্ডারিং মামলাসহ বাকি মামলাগুলোতেও সাইফুলকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হবে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত বুকার পুরস্কারজয়ী ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি তার ওপর সংঘটিত ছুরি হামলা নিয়ে প্রথমবারের মতো কথা বলেছেন। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসা রুশদি এখনো পুরোপুরি সেরে ওঠেননি। কিন্তু বেঁচে ফেরায় তিনি নিজেকে ‘ভাগ্যবান’ মনে করছেন। পাশাপাশি প্রকাশ করেছেন কৃতজ্ঞতা।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি দ্য নিউইয়র্কারকে দেওয়া রুশদির একটি সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
২০২২ সালের আগস্টে নিউইয়র্কে একটি সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন রুশদি। এ সময় মঞ্চে তার ওপর হামলা চালান ২৪ বছর বয়সী যুবক হাদি মাতার। নিউ জার্সির এই বাসিন্দা সেদিন রুশদিকে ১০ থেকে ১৫ বার ছুরিকাঘাত করেন। এতে নিজের রক্তের ওপর লুটিয়ে পড়েন রুশদি। এর জের ধরে প্রায় ছয় সপ্তাহ হাসপাতালে কাটাতে হয় এই লেখককে। পরে এক চোখের দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে ফেলেন তিনি।
দ্য নিউইয়র্কারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রুশদি বলেন, ‘আমি অনেকটাই ভাল হয়েছি। যা ঘটেছিল তা বিবেচনা করে দেখলে খুব একটা খারাপ নেই। বড় ক্ষতগুলো সেরে গেছে। তবে বুড়ো আঙুল, তর্জনী ও তালুর নিচের অর্ধেকটা অনুভব করছি। আমাকে প্রচুর হাতের থেরাপি নিতে হচ্ছে। যদিও আমাকে বলা হয়েছে শারীরিকভাবে আমি উন্নতি করছি’।
রুশদি জানান, আঙ্গুলের কিছু অংশে অনুভূতি না থাকায় লিখতে অসুবিধা হচ্ছে তার। তিনি বলেন, ‘আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি। হাঁটতে পারছি চারপাশে। তবে আমার শরীরে এমন কিছু অংশ আছে যেগুলো নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। এটা ছিল একটি মারাত্মক আক্রমণ’। তিনি জানান, ছুরি হামলার ঘটনায় মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছেন। এর ফলে তাকে নিরাপত্তার বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
১৯৮১ সালে ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাস দিয়ে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন রুশদি। শুধু যুক্তরাজ্যেই বইটির ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ উপন্যাস ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার পর থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আসছিলেন এই লেখক। এই উপন্যাস লেখার জন্য রুশদিকে ৯ বছর আত্মগোপনে থাকতে হয়। উপন্যাসটিতে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করা হয়েছে বলে মনে করেন মুসলিমরা।
উপন্যাসটি প্রকাশের এক বছর পর ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেন। সেই সঙ্গে তার মাথার দাম হিসেবে ঘোষণা করেন ৩ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার। রুশদি ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। মঙ্গলবার (০৭ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত হচ্ছে তার লেখা নতুন উপন্যাস ‘ভিক্টরি সিটি’। পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বকে উপেক্ষা করে এই নারী কীভাবে একটি শহরকে পরিচালনা করেছেন, সে গল্পই উঠে এসেছে বইটিতে।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের উপনির্বাচনে বেসরকারিভাবে ১১২ কেন্দ্রের ফলাফলে ৯৫১ ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন বহুল আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন আলম ওরফে হিরো আলম। একতারা প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ১৯ হাজার ৪৮৬ ভোট। এ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম তানসেন। মশাল প্রতীক নিয়ে তিনি পেয়েছেন ২০ হাজার ৪৩৭ ভোট।
বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে বগুড়ার দুইটিসহ মোট ৬ আসনে উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হয়। ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিএনপির এমপিরা পদত্যাগের ঘোষণা দিলে এ আসনগুলো শূন্য হয়।
তখন, বগুড়া-৬ (সদর) এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেন হিরো আলম। নির্বাচন কমিশন একদফা তার প্রার্থিতা বাতিল করলেও পরে আদালতে গিয়ে প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া-৬ (সদর) আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আশরাফুল হোসেন হিরো আলম বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘সদরের কেন্দ্র সব দখল হয়্যা গ্যাছে। ডিসি-এসপিক কয়্যাও কোনো কাম হচ্চে না। সদরের আশা সব শ্যাষ। কাহালু-নন্দীগামের অনেক কেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেকছি। ভোট খুব সুষ্ঠু হচ্চে। মাঠের অবস্থা ভালো। কাহালু-নন্দীগ্রামে নিশ্চিত এমপি হচ্চি।’
এর আগে, সকালে সদর উপজেলার এরুলিয়া উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান তিনি। ভোট দেওয়ার পর হিরো আলম বলেন, ‘বগুড়া-৬ আসনে আগে থেকেই গোলযোগের আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই সত্যি হয়েছে। নির্বাচনি এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে বগুড়া-৪ আসনে ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে। এভাবে সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমিই বিজয়ী হবো।’
এদিকে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে কয়েকটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট বাদে অন্য এজেন্টদের ভোটকক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ সকালে হিরো আলমসহ তিনজন প্রার্থী এ অভিযোগ করেন। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাদের এজেন্টদের বের করে দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করা হয়।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।