
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাছে বারবার হোঁচট খাওয়া কংগ্রেসকে কিছুটা স্বস্তি দিল হিমাচল। বিধানসভা নির্বাচনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে বিজেপির কাছ থেকে হিমাচল ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, রাজ্যে বিধানসভার মোট ৬৮ আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে ৩৯টি, যা গতবারের তুলনায় ১৮টি বেশি এবং বিজেপি পেয়েছি ২৬ আসন।
হিমাচল রাজ্যের ক্ষমতার আশায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আক্রমণাত্মক প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রতি পাঁচ বছর পরপর শাসক দল বদলের যে ঐতিহ্য রাজ্যটি ধরে রেখেছে, প্রবল চেষ্টাতেও তা বদলাতে পারেননি মোদি। ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকা বিজেপি নেতা জয়রাম ঠাকুর গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরেই জানিয়ে দেন জনতার রায় মেনে পদত্যাগ করছেন তিনি। এখন কংগ্রেসের কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে চলছে জোর জল্পনা। তবে কংগ্রেস হিমাচল প্রদেশে সরকার গড়লেও পুরো মেয়াদ টিকতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, অতীতে দেখা গেছে মণিপুর, গোয়া, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে গণদলত্যাগ ঘটিয়ে প্রাদেশিক সরকারের দখল নিয়ে নেয় বিজেপি।
এদিকে হিমাচলে অল্প ব্যবধানে হারলেও গুজরাট দুর্গ হাতছাড়া হয়নি বিজেপির বরং এই রাজ্যের বিধানসভায় গড়েছে আসন জয়ের নয়া রেকর্ড। মোট ১৮২ আসনের মধ্যে ১৫৬টিতে জিতে টানা সপ্তমবারের মতো গুজরাটের ক্ষমতায় পাকাপোক্ত বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচনে এর আগে এত আসনে কেউ জয় পায়নি। বিজেপির শক্ত ঘাঁটি গুজরাটে বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস পেয়েছে ১৭ আসন, আম আদমি পার্টি পেয়েছে ৫টি আসন। তবে গুজরাটে মাত্র এই কটি আসনে জিতেও ভারতের জাতীয় পর্যায়ের দলের তকমা জুটিয়ে নিল কেজরিওয়ালের আম আদমি।
গুজরাট ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ বলছে দলিত, আদিবাসী ও দুর্গম গ্রাম যেগুলো কংগ্রেসের আশার জায়গা, সেখানেও ভোট কুড়িয়ে নিয়েছে বিজেপি। সব মিলিয়ে হিমাচলের হারকে ঢাকতে তাই গুজরাটের বিশাল বিজয়ের ঢাক বাজানো শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। রাজ্যের নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদি হাজির থাকবেন বলে জানিয়েছেন।
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গত বুধবার পুলিশের সঙ্গে সংষর্ঘ, হতাহত ও আটকের ঘটনায় নিন্দা-প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপির শরিক ও সমমনা দলগুলো। বিবৃতি দিয়ে তারা প্রতিবাদ জানায়। ঘটনার প্রতিবাদে বিএনপি গতকাল বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। তবে সমমনা বা শরিক দলগুলো কোনো কর্মসূচি দেয়নি। অন্যদিকে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মুখোমুখি অবস্থান নিলেও ক্ষমতাসীনদের শরিকদেরও কোনো কর্মসূচি নেই।
১৪ দলীয় জোট : আওয়ামী লীগের মিত্রশক্তি ১৪ দলীয় জোটের শরিক বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা চুপ থাকবেন। শুধু ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিই নয়, সরকারবিরোধী সামনের কোনো কর্মসূচিতেও সেভাবে থাকার কোনো পরিকল্পনা নেই তাদের।
কেন এ সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে শরিক দলের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে আদর্শিক জোট ১৪ দল গঠন করা হয়েছিল তার অনেক কিছুই খসে পড়েছে। আওয়ামী লীগ ভুলে যেতে বসেছে জোটের সঙ্গে করা অঙ্গীকার। ক্ষমতায় মোহাবিষ্ট থাকলে জোটের শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ খুব কম। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে জোটের অবমূল্যায়ন করেছে। ১৪ দলীয় জোট নেতাদের সরকারের বাইরে রেখে অবমূল্যায়নের শুরু। শরিক দলের অনেক নেতা বলেন, ২০০৫ সাল থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অবদান আওয়ামী লীগ এখন স্বীকার করে না। এসব ছোট ছোট ঘটনা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। দলগুলোর বড় নেতারা নিষ্ক্রিয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনাও করতে দেখা যায় দলগুলোকে।
১৪ দলের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা জোটে আছি; কিন্তু এ আন্দোলন মোকাবিলা করার কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের নেই।’ কেন এ অবস্থান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন নেই, তাই।’ তবে কি জোট নেই এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘টানাপড়েন নিয়ে জোট আছে। তবে ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচি ঘিরে গত বুধবারের ঘটনায় বিএনপির দায় রয়েছে। বুধবার বিএনপির কি কোনো কর্মসূচি ছিল? তাহলে কেন তারা নয়াপল্টনে বসতে গেল?’
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বুধবারের ঘটনার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চায়।’ তবে দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘জোটগতভাবে ১০ ডিসেম্বর ধরে আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। আলাদাভাবেও মাঠে থাকার পরিকল্পনা নেই আমাদের দলের।’
আরেক শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘১৪ দলীয় জোটের মাঠে থাকার কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। জাসদ আলাদাভাবেও কোনো অবস্থান নেবে না।’ তিনি বলেন, ‘জোটে কিছু গরমিল আছে। তবে জোট অটুট রয়েছে।’ বিএনপির কর্মসূচি সম্পর্কে ইনু বলেন, ‘বিএনপি নাশকতা-সংঘাত সৃষ্টি করে অস্থিরতা তৈরি করতে চায়।’
অবশ্য গতকাল শরিক দলগুলোকে নিয়ে ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু বৈঠক করেছেন। ইস্কাটনের নিজ বাসায় অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের আমু বলেন, ‘১৪ দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধেই আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়বে। বৈশ্বিক সংকটে সৃষ্ট দেশের সব সমস্যা ১৪ দল একসঙ্গেই মোকাবিলা করবে।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াতের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে শিগগির বৈঠক করবে ১৪ দল। জোটভিত্তিক দলগুলো শিগগির সরব হবে।’
কর্মসূচি নেই বিএনপি মিত্রদের : সরকারবিরোধী অবস্থান থেকে বিএনপির সমমনা সাতটি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নাগরিক ঐক্যের অফিসের পাশে একটি মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেছে। এ ছাড়া আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিদর্শনে যাবেন মঞ্চের নেতারা। এর বাইরে পৃথক কোনো কর্মসূচি নেই দলগুলোর।
গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দলগুলোর মধ্যে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গতকাল রাতে দেশ রূপান্তরকে জানান, আজ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট নাগরিকদের যাওয়ার ইচ্ছা আছে। ১০ ডিসেম্বর শনিবার যেহেতু বিএনপির সমাবেশ, সেহেতু তাদের আর কোনো কর্মসূচি নেই।
নয়াপল্টনের ঘটনায় আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা গণমাধ্যমে বিবৃতি দেন।
একই ঘটনার প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। সেখানে জোটের নেতারা বলেছেন, বিএনপির ১০ তারিখের সমাবেশকে বন্ধ করতে সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। একই সঙ্গে সরকার অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার জন্য দমন-নিপীড়ন করে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘অবৈধ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য বর্তমান সরকার নৃশংসতার সব সীমা অতিক্রম করেছে।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ‘খেলা হবে’ বলে আগ্রাসী এবং আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছেন।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিএনপি অফিসের সামনে পুলিশ হামলা করে একজনকে হত্যা করেছে। আবার টেলিভিশনে মিথ্যাচার করছে, কার গুলিতে মারা গেছে? তারা নাকি শুধু রাবার বুলেট মেরেছে। তাহলে কীভাবে মারা গেল? পুলিশের সঙ্গে প্রাইভেট বাহিনীও যুক্ত হয়ে গুলি করেছে। জার্সি পরে গুলি করেছে, আমরা দেখেছি। গত বুধবার একজন বিএনপির নেত্রী তার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আর্তনাদ করেছেন, সেটা পর্যন্ত তারা শুনছে না। এরকম একটা ভয়াবহ অমানবিক পরিস্থিতি সরকার তৈরি করেছে।’
গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আর যদি পুলিশ দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে চান, তাহলে প্রধানমন্ত্রীকে বলব আপনি পদত্যাগ করে পুলিশপ্রধানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।’
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন কি কেবলই একজন ‘নারী লেখক’, কেবলই একজন ‘নারীবাদী চিন্তক’, কেবলই নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটানো সফল ‘শিক্ষা আন্দোলনকারী’, নাকি সমাজে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখানো একজন ভবিষ্যবাদী ‘চিন্তক-সমাজ সংস্কারক’? রোকেয়াকে আমরা কীভাবে স্মরণ করছি, রোকেয়ার কর্ম ও জীবনকে কীভাবে পাঠ করছি আর তাকে কীভাবে উপস্থাপন করছি নতুন প্রজন্মের কাছে? আজ ‘রোকেয়া দিবস’-এ এসব প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজা জরুরি। কারণ এই মীমাংসা ছাড়া আজকের বাংলাদেশ কিংবা বৈশি^ক বাস্তবতায় রোকেয়ার চিন্তা ও সংগ্রামকে আমরা যথাযথভাবে বুঝতে পারব না।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি ছেলেবেলায় পাঠ্যবই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক পরিসরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আমাদের কাছে উঠে এসেছেন প্রথমত শতবর্ষ আগের একজন মুসলিম নারী লেখক হিসেবে, দ্বিতীয়ত মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষার প্রসারে সফল সংগঠক হিসেবে। আরেকটু বড় হয়ে এই দুইয়ের সঙ্গে তৃতীয় যে পরিচয়ে তাকে আমরা জেনেছি তা একজন সংগ্রামী বাঙালি নারীর, যিনি ব্রিটিশ উপনিবেশকালে অবিভক্ত বাংলায় নারী জাগরণের অগ্রদূত। আরও পরে এসে আমরা রোকেয়াকে আলোচিত হতে দেখছি নারীবাদী চিন্তক পরিচয়ে। আসলে এদেশে আমাদের বেড়ে ওঠার কালে কিংবা এখনো সমাজের বিভিন্ন অংশে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়ে যে চর্চা তা এমন বহু পরিচয় আর বহু ব্র্যাকেটে বন্দি হয়ে থাকা রোকেয়ার। সামগ্রিকভাবে রোকেয়ার পাঠ আর রোকেয়ার উপস্থাপন আমরা এখনো করে উঠতে পারিনি।
রোকেয়া সবচেয়ে বেশি আলোচিত নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। আমরা তাকে বাংলায় নারী জাগরণ ও নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে স্মরণ করি। কিন্তু একথা বলি না যে, কেবল বাংলা নয়, অবিভক্ত ভারত কিংবা দক্ষিণ এশিয়ারও নারী শিক্ষা, নারী আন্দোলনের তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। নারীর সার্বিক মুক্তি ও নারী-পুরুষের সমান অধিকার অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই রোকেয়া নারীশিক্ষার বিস্তার চেয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘‘আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রƒপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না।...পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরাণি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী ব্যারিষ্টার, লেডী জজ সবই হইব।’’ খেয়াল করা দরকার রোকেয়া নারীর শিক্ষাকে কেবলই ‘দুই কলম বিদ্যার্জন’ হিসেবে দেখতে চাননি। শিক্ষার প্রশ্নকে তিনি যেমন জ্ঞানার্জনের ভিত্তি হিসেবে দেখেছেন তেমনি জীবিকার প্রশ্ন তথা সমাজ-রাষ্ট্রে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ ও দায়িত্বপালনের ভিত্তি হিসেবেও দেখেছেন।
নারীশিক্ষা বিস্তারে রোকেয়ার সে সংগ্রাম যে বৃথা যায়নি সে কথা আমাদের সবারই জানা। শত বছরের ব্যবধানে শত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আজ রোকেয়ার মাতৃভূমি বাংলাদেশে নারীশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে এখন সার্বিকভাবে শিক্ষায় পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ বেশি। প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫০ দশমিক ৫৪ শতাংশই এখন নারী। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের মতোই উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষায়ও ছাত্রীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু রোকেয়ার সংগ্রাম অব্যাহত রাখা যে এখনো কতটা জরুরি তা নিত্যই এই সমাজে রাষ্ট্রে স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান। নারীর শিক্ষা ও স্বাধীন জীবিকার যে তাগিদ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আমরা সেই লক্ষ্য এখনো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। একালেও সমাজের একটা বড় অংশ লেখাপড়া করে নারীর শিক্ষিত হওয়া মেনে নিলেও বিয়ের পর চাকরি করে স্বাবলম্বী হওয়া মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। বিশেষ করে স্বাধীনভাবে কর্মসংস্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশের নারীদের এখনো পিছিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, শিক্ষা, গবেষণা, সরকারি- বেসরকারি কর্মসংস্থান এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অংশগ্রহণ করলেও নারীর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সমাজ ও রাজনীতিতে তীব্রভাবেই বিদ্যমান। সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীর ‘কাজী’ হওয়া আটকে দেওয়ার অপচেষ্টা কিংবা নারী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ গার্ড অব অনার দিতে বাধা দেওয়ার অপচেষ্টায় রাষ্ট্রীয় পরিসরের বাস্তবতটা বোঝা যায়।
নিজ সময়ে রোকেয়ার শিক্ষাভাবনা ও শিক্ষাবিস্তারের সংগ্রামের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতার একটা তুলনা আমরা দেখলাম বটে। কিন্তু লেখক-চিন্তক-সমাজসংস্কারক হিসেবে রোকেয়ার সামগ্রিক মূল্যায়ন এমন ছোট পরিসরে সম্ভব নয়। তবু নারীবাদী-কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবে রোকেয়ার বিশেষ কৃতিত্বের বিষয়টি আলোচনা জরুরি। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে রোকেয়ার নারীবাদী-কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসটি একদিকে যেমন তার নারীবাদী চিন্তার এক বিশেষ রূপকে সামনে নিয়ে আসে তেমনি কল্পবিজ্ঞানের বিচারেও এই রচনা বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। সরাসরি বলা ভালো, রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ আমাদের জানা মতে, কেবল বাংলা বা ভারত নয় পৃথিবীর প্রথম নারীবাদী-কল্পবিজ্ঞান কাহিনী।
আজ থেকে ১১৭ বছর আগে ১৯০৫ সালে ইন্ডিয়ান লেডিস ম্যাগাজিনে আর এস হোসেন নামে ‘সুলতানাস ড্রিম’ নামে ইংরেজি ভাষায় এই নারীবাদী-কল্পবিজ্ঞান কাহিনী লিখেছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। এরপর ১৯২২ সালে, অর্থাৎ ঠিক একশ বছর আগে রোকেয়া নিজেই কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে উপন্যাসটি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নামে বাংলায় অনুবাদ করেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ পড়লে যে বোঝা যায় সেকালের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমসাময়িক বিজ্ঞান চর্চার বিষয়ে রোকেয়ার একটি স্বচ্ছ ধারণা ছিল। উপন্যাসটি আসলে উচ্চমানের এবং আদর্শ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যা একইসঙ্গে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তার সার্থক রূপায়ণও। সেকালে এবং বহু পরেও এই রচনাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি।
খেয়াল করা দরকার, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানের ছাত্রী না হয়েও তিনি বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎমুখী যে সব উৎকর্ষের চিন্তা করেছিলেন একালে আমরা সেসবই বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। সুলতানার স্বপ্নে বর্ণিত ভবিষ্যবাদী বিজ্ঞানের উপাদানগুলোর মধ্যে কেবল একটির কথাই এখানে উল্লেখ করছি। সেটা উড়োজাহাজ। আমরা জানি, ১৯০৩ সালে আকাশে উড়লেও রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের উড়োজাহাজের কারিগরি বৃত্তান্ত ১৯০৮ সালের আগে বিস্তারিত কোথাও প্রকাশিত হয়নি। কিন্তু রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। এছাড়া রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের বিমানের ইঞ্জিন চালু হয়েছিল শুষ্ক-ব্যাটারি ও চার অশ্বশক্তির তেলের-ইঞ্জিন দিয়ে। আর রোকেয়ার ‘বায়ুযান’ বা উড়োজাহাজ চালু ও চালিত হয়েছিল বিদ্যুৎ দিয়ে। এই বিবেচনায় রোকেয়ার কল্পবিজ্ঞান তখনকার বাস্তবতার চেয়ে নিদেনপক্ষে একশ বছর এগিয়ে ছিল!
সুলতানার স্বপ্নে রোকেয়া লিখেছিলেন, ‘এখানে আপনি কোনো পুরুষের সামনে পড়বেন না। কারণ এ দেশের নাম নারীস্থান। এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।’ রোকেয়া সেকালে নারী-পুরুষের সমমর্যাদা ও অংশগ্রহণের একটা ভবিষ্যবাদী চিত্রকল্প হাজির করেছিলেন এই রচনায়। আর তিনি সেটা করেছিলেন, পাশার ছক পুরোপুরি উল্টে দিয়ে। অর্থাৎ বাস্তব দুনিয়ায় নারীকে অন্তঃপুরে আটকে রেখে পুরুষের দুনিয়া শাসনের বিপরীত চিত্র তিনি এঁকেছিলেন সুলতানার স্বপ্নে। যে সময়ে তিনি ‘নারীস্থান’-এ পুরুষকে সন্তান আর ঘর-সংসারের দায়িত্ব দিয়ে নারীকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে দিয়েছিলেন সেই পৃথিবীতে তখনো কোনো দেশে-রাষ্ট্রেই নারীদের ভোটাধিকার বলেও কিছু ছিল না। এখনকার সংজ্ঞায় ‘নারী-অধিকার’ বলেও কোনো কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি দেখিয়েছিলেন দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলে কীভাবে নারী ও পুরুষরা মিলে একটা আদর্শ ও কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। কারণ পুরুষরা শাসন করে পেশিশক্তি দিয়ে যার লক্ষ্য থাকে ক্ষমতা; আর নারীরা শাসন করে বুদ্ধি ও মমতা দিয়ে যার লক্ষ্য শান্তি ও কল্যাণ। আর সেটা হতে পারে তখনই যখন ‘নারীস্থানে’ পুরুষরা নারীর মতোই ‘মাতৃত্বের গুণাবলি’ তথা সৃজন ও রক্ষণের গুণাবলি অর্জন করতে পারে। আজকের সহিংসতা-হানাহানিতে জর্জরিত বাংলাদেশ কিংবা আজকের যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে রোকেয়ার স্বপ্নের সেই ‘নারীস্থান’ ভীষণভাবেই প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কি তা মেনে নিতে প্রস্তুত? শান্তি ও কল্যাণে ব্রতী রোকেয়ার সেই নারীস্থান কত দূরে?
লেখক : দেশ রূপান্তরের সহকারী সম্পাদক
তৃণমূলে সাংস্কৃতিকভাবে মেধাবীদের মেধা বিকাশে তার সরকার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব সংস্কৃতিমনা মানুষ আছে তাদের মেধা, মনন, জ্ঞান ও ক্ষমতা বিকশিত করার পদক্ষেপ নিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী গতকাল বৃহস্পতিবার মাসব্যাপী ‘১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ-২০২২’ উদ্বোধনকালে একথা বলেন। তিনি তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় আর্ট গ্যালারিতে ৮ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় প্রদর্শনীতে বাংলাদেশসহ ১১৪টি দেশের প্রায় ৪৯৩ শিল্পীর ৬৪৯টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্প-সংস্কৃতি যেকোনো জাতির আত্মপরিচয় বহন করে। শিল্পীর তুলির আঁচড়েই উঠে আসে একটি দেশ ও জাতির রাজনৈতিক অবস্থান এবং তাদের সাংস্কৃতিক অবস্থান বা প্রাকৃতিক পরিবেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের যে সংগ্রাম, যে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম সে সংগ্রামও প্রাণ পেয়েছিল শিল্পীর আঁচড়ে এবং আমাদের শিল্পীরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে।’
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধিকার আন্দোলন সবকিছুতেই আমাদের শিল্পীরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের শিল্পীদের তুলির আঁচড়েই উঠে এসেছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঋতুবৈচিত্র্য।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যখন আমাদের দেশের মানুষ সংগ্রাম করেছে সেই প্রতিবাদের ভাষাও আরও সমৃদ্ধি লাভ করেছে। মানুষের চেতনাকে শানিত করেছে শিল্পীর তুলির আঁচড়।’
সবসময় শান্তির সপক্ষে তার অবস্থানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সব সময় শান্তি চাই। আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো একদিকে করোনা মহামারী আরেক দিকে হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যে যুদ্ধ আসলে সারা বিশ্বের মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সেখানেও আমি জানি কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকতারাও মানুষের এই ধরনের কষ্ট, মানুষের দুঃখ, যন্ত্রণা এবং যুদ্ধের যে ভয়াবহতা সেটাও শিল্পীর আঁচড়ে উঠে আসবে, যাতে এ ধরনের যুদ্ধ আর না হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের এই সংস্কৃতিসেবা একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাই। একদিকে তাদের যেমন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য আমরা কাজ করছি, পাশাপাশি তাদের শিল্পমনের বিকাশও যাতে হয় সেই পদক্ষেপও আমরা নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ৬৪ জেলায় শিল্পকলা একাডেমির নতুন ভবন তৈরি করে দিয়েছি। ৪৯৩টি উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন করা হয়েছে অর্থাৎ আমরা এই সংস্কৃতিসেবা একদম তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চাই।’
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে ছয় শিল্পীকে সম্মানসূচক পুরস্কার এবং অন্য তিনজনকে গ্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের জুরি বোর্ডের সভাপতি শিল্পী রফিকুন নবী পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
কে এম খালিদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর, জুরি বোর্ডের সদস্য এবং বিশিষ্ট পোলিশ শিল্প সমালোচক জারোসøা সুচান, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং ‘১৯তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী বাংলাদেশ-২০২২’-এর প্রধান সমন্বয়কারী লিয়াকত আলী লাকী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিল্পীরা বাংলাদেশে আসায় তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা কষ্ট করে আমাদের এই সুজলা-সুফলা সুন্দর বাংলাদেশে এসেছেন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস যে, আপনারা এখানে আসার ফলে এই যে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের যে সংস্কৃতি বা চিত্রকর্ম অথবা তাদের মানসিক বিকাশের যে সুযোগ, আমাদের দেশের মানুষও এটা থেকে অনেক জ্ঞান আহরণ করতে পারবে। একে অপরকে জানতে পারবে, একে অপরের শিল্পী মনকে জানতে পারবে। তুলির আঁচড়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যে বিকশিত হয় সেটা সম্পর্কে জানতে পারবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি মনে করি এটা আমাদের শিল্পীদের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধিশালী করবে। আরও নতুন নতুন চিন্তা চেতনার ধারা নিয়ে আসবে।’
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। বাংলাদেশে চীনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত লি জিমিং গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দেশ এবং তারা সে দেশের অধিবাসী। কিন্তু তারা এখন খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের জন্য বিশাল বোঝায় পরিণত হয়ে আছে। আমরা মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। এখন তাদের নিজ দেশে চলে যাওয়া উচিত।’
মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেবে বলে প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আগামী বছর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে বলে বৈঠকে চীনা রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেন । তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আগামী বছর নিজ দেশে যাওয়া শুরু করবে।’
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব কে এম শাখাওয়াত মুন সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রধানমন্ত্রী চীনের বিদায়ী রাষ্ট্রদূতকে তার মেয়াদ সম্পন্ন করায় অভিনন্দন জানান এবং তার পরবর্তী দায়িত্ব পালনে সফলতা কামনা করেন। তিনি বাংলাদেশ-চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রাখায় বিদায়ী চীনা দূত লী জিমপিংকে ধন্যবাদ জানান।
চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির জন্য শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, একমাত্র আপনার জন্য এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়নে অব্যাহত সমর্থন ব্যক্ত করায় চীনা প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ী মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বাসস
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে তিন বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। তারা হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে তারা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় আইন ও বিচার শাখা। এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৫ (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারককে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেছেন। এই নিয়োগ শপথগ্রহণের তারিখ হতে কার্যকর হবে।’
বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, বিকেল ৪টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে নবনিযুক্ত তিন বিচারককে শপথবাক্য পাঠ করান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। নিয়োগ পাওয়া তিন বিচারকসহ আপিল বিভাগে এখন বিচারপতি ৯ জন।
প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্যরা হলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী (এখন ছুটিতে), বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি বোরহানউদ্দিন ও বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।
১৯৫৯ সালের ১৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন মো. আশফাকুল ইসলাম। এলএলবি ও এলএলএম ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯৮৩ সালে জেলা ও দায়রা আদালতে এবং ১৯৮৫ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এরপর ২০০৩ সালের ২৭ আগস্ট হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক এবং এর দুই বছর পর একই বিভাগে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান আশফাকুল ইসলাম।
১৯৫৯ সালের ২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আবু জাফর সিদ্দিকী। এলএলবি ও এলএলএম ডিগ্রি লাভের পর ১৯৮৫ সালে জেলা ও দায়রা আদালতে এবং ১৯৯৪ সালে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল তিনি হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে এবং দুই বছর পর একই বিভাগে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন জাহাঙ্গীর হোসেন। এলএলবি ডিগ্রি লাভের পর ১৯৮৬ সালে জেলা ও দায়রা আদালতে এবং ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে এবং দুই বছর পর হাইকোর্টে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, রাজধানীর নয়াপল্টনে বুধবারের ঘটনার জন্য বিএনপি এবং দলটির নেতারাই দায়ী। তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ কথা বলেন।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বহু আগে থেকেই বলছিলাম যে বিএনপি সমাবেশ নয়, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। বিএনপি সমাবেশের ডাক দিয়েছে ১০ ডিসেম্বর, অথচ ৭ ডিসেম্বরেই নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে পুলিশের ওপর কীভাবে হামলা পরিচালনা করা হয়েছে, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে এবং মঙ্গলবার রাতে বিআরটিসি বাসে ও আরও গাড়ি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন স্থানে তারা আগুন দিয়েছে, আপনারা দেখেছেন। বিএনপি কার্যালয়ের ভেতরে অবিস্ফোরিত ১৫টি ককটেল, ২ লাখ পানির বোতল, ১৬০ বস্তা চাল, রান্না করা খিচুড়ি, হাঁড়ি-পাতিল এবং ২ লাখ নগদ টাকাও পেয়েছে পুলিশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘দুপুর থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে জমায়েত হতে থাকে এবং যখন সেখানে একটি রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়, তখন দয়া করে অন্তত একটি লেন চালু থাকার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ তাদের বারবার অনুরোধ জানায়। কিন্তু সেই অনুরোধ তারা উপেক্ষা করে। এরপর মতিঝিল-রমনা এলাকার ডেপুটি কমিশনার হায়াৎ সেখানে নিজে গিয়ে আবারও অনুরোধ জানান। যখন তিনি অনুরোধ জানাচ্ছিলেন তখন তাকে পেছন থেকে লাঠি দিয়ে আঘাত হানা হয় এবং তার বডিগার্ডকে দায়ের কোপ দেওয়া হয়। সেখান থেকেই শুরু এবং এরপর পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ হামলা পরিচালনা করা হয়। আটজন পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়াসহ ৩৫ জন পুলিশ আহত হয়। তখন পুলিশ টিয়ার শেল ছুড়তে বাধ্য হয়। একজন সাধারণ নাগরিক সেখানে মৃত্যুবরণ করেছেন।’
হাছান মাহমুদ বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা বিএনপিকে আমরা কখনো দিইনি এবং সেটির প্রমাণ হচ্ছে সারা দেশে তারা সফলভাবে ৯টি বড় সমাবেশ করেছে, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে সরকার সর্বোতভাবে সহায়তা করেছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করতে পারে, এ জন্য আমাদের দলীয় নেতাকর্মীদের আমরা নির্দেশ দিয়েছিলাম, যাতে তাদের উসকানির মুখেও ধৈর্য ধরে। কিন্তু আসলে তারা দেশে শান্তি চায় না বিধায় গতকাল (বুধবার) বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে, তাণ্ডব ঘটিয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর দেশের সাম্প্রতিক বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে ড. হাছান বলেন, ‘মার্কিন সরকার কোনো বিবৃতি দেয়নি। সেখানে নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বিএনপি ঘরানার একজন সাংবাদিক যিনি আগে খালেদা জিয়ার প্রেস উইংয়ে কাজ করতেন তিনিই সেখানে প্রশ্ন করেছেন এবং সেই প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে। এটি কোনোভাবেই মার্কিন সরকারের কোনো বিবৃতি নয়।’
১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্রগুলো আমরা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে পাঠাব। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তারা যে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, ২০১৩-১৪-১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস করেছে এবং এখন বাস-ট্রাকে আগুন দিয়ে আবার মানুষের অধিকার হরণ করছে, সেগুলো আমরা বিশ্ব সম্প্রদায়কে জানাব।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।