
জাতি আজ সংকটে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সরকারের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নেতৃত্বে গোটা জাতি জেগে উঠেছে। তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইনশাআল্লাহ, আমরা সেই লড়াই-সংগ্রামে জয়ী হব।’
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে জিয়ার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে মোনাজাতে অংশ নেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জিয়াউর রহমান একজন ক্ষণজন্মা মানুষ। ৭ নভেম্বর তিনি জাতির ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরেছিলেন। হতাশাগ্রস্ত জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তিনি একদলীয় শাসন থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। মুক্তবাজার অর্থনীতি উপহার দিয়েছেন। আজ আধুনিক বাংলাদেশের উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করেছিলেন জিয়াউর রহমান।’
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু; ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান; বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, আমানউল্লাহ আমানসহ বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
এদিকে এ উপলক্ষে সকালে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিকেলে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। নয়াপল্টনে ড্যাবের সহযোগিতায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুস্থদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণের আয়োজন করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। এর আগে জিয়াউর রহমানের ৮৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো।
বইমেলা সরকার বা একক দলের নয় : বইমেলা কোনো সরকার বা একক দলের নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাংলা একাডেমি আয়োজিত আসন্ন একুশের বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর স্টল স্থগিত করায় প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা মুক্তবুদ্ধি চর্চার উপযুক্ত স্থান হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে। সরকারবিরোধী ও ভিন্নমতের বই প্রকাশের অভিযোগে আদর্শ প্রকাশনীকে আসন্ন বইমেলায় স্টল স্থগিত করা খুবই উদ্বেগজনক এবং নিন্দনীয়। এ ঘটনা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ।’
তিনি আরও বলেন, ‘বইমেলা কোনো সরকার বা একক দলের নয়। বরং দলমত নির্বিশেষে সবার প্রাণের মেলা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছিল। কিন্তু তিনটি ভিন্নমতের বইয়ের জন্য ছয় শতাধিক বই প্রকাশকারী সংস্থা আদর্শ প্রকাশনীর স্টল স্থগিত করার মাধ্যমে বাংলা একাডেমি ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হলো।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এর আগেও কয়েকবার বাংলা একাডেমি একুশের বইমেলায় ভিন্নমতের বই প্রকাশের কারণে প্রকাশনা সংস্থার স্টল স্থগিত বা বাতিল করেছে। গণবিরোধী আওয়ামী সরকার গণতন্ত্র হরণ করে কর্র্তৃত্ববাদী দুঃশাসন দীর্ঘায়িত করতে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগ্ন দলীয়করণ ও দখল করে দেশকে ভঙ্গুর করে দিয়েছে। জনগণের অর্থে পরিচালিত বাংলা একাডেমির মতো সৃজনশীল এবং মেধা ও মননের প্রতিষ্ঠানকেও এরা ঘৃণ্য দলীয়করণ করেছে।’
বাংলা একাডেমি কর্র্তৃপক্ষের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আসন্ন বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীসহ ভিন্নমতের বই প্রকাশকারী অন্যান্য প্রকাশনীর স্টল বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে তাদের স্টল বরাদ্দের আহ্বান জানাই, যাতে বইমেলা দলমত নির্বিশেষে সবার প্রাণের মেলা হিসেবে পুনর্বিবেচিত হতে পারে।’
দেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা যে কয়টি খাতের ওপর নির্ভরশীল তার মধ্যে অন্যতম রেমিট্যান্স প্রবাহ (প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা)। কিন্তু সেই প্রবাসীরাই বিদেশ গমনের সময় বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নথি নোটারি বা নোটারি পাবলিক করে আইনজীবী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিল দিয়ে সত্যায়িত করাতে হয়। সরকারি এসব কার্যক্রম বিনামূল্যে হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় সময়ই প্রবাসীরা তাদের নথি সত্যায়িত করাতে গিয়ে দালালদের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী বিদেশগামী প্রবাসীদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার সেবা ও আইনজীবী কর্র্তৃক নথি সত্যায়িতের সিল বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। কিন্তু এ দুটি সিল নিতে যেখানে কোনো টাকা প্রদানের কথা নয়, সেখানে দাপ্তরিক নানা জটিলতার ভয় দেখিয়ে মন্ত্রণালয়ের আশপাশে ওত পেতে থাকা দালালরা সত্যায়িত প্রার্থীদের কাছ থেকে মাথাপিছু ২৫০০-৩০০০ টাকা আদায় করে থাকে। আর শুধু দালালই নয়, এর সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার ও ওয়েলফেয়ার অনুবিভাগ এবং আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন বিচার শাখা-৬-এর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অনেক পুলিশ সদস্য জড়িত বলে অভিযোগ সেবাপ্রার্থীদের। গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার ও ওয়েলফেয়ার অনুবিভাগ, পরিবহন পুল ভবনে অবস্থিত আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৬-এ আসা বিদেশগামী প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তাদেরই একজন বরিশালের ইব্রাহিম হাওলাদার। থাকেন ইতালিতে। জন্মনিবন্ধনের কাগজ সত্যায়িত করতে ঢাকায় এসে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হন তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার ও ওয়েলফেয়ার অনুবিভাগের সেবাকক্ষে বসে ইব্রাহিম হাওলাদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জন্মনিবন্ধনে ভুল তথ্য থাকায় অনলাইন প্রক্রিয়া মেনে তা আবার ঠিক করাতে হয়েছে। এরপর ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় এসেছি আমার জন্মনিবন্ধন সত্যায়িত করাতে। কিন্তু এ কাজে এসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আশপাশে থাকা দালাল ও পুলিশ সদস্যদের হাতে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। তারা নানা জটিলতার ভয় দেখিয়ে আমার কাছে ৩ হাজার টাকা দাবি করে। যেহেতু আমারও জরুরি ভিত্তিতে সত্যায়িত নিবন্ধনের দরকার ছিল, তাই রিস্ক (ঝুঁকি) না নিয়ে তাদের টাকা দিয়ে কাজটি করাতে বাধ্য হয়েছি। যদিও পরে জানতে পেরেছি নথি সত্যায়িত করতে কোনো টাকার দরকার হয় না।’
আরেক ভুক্তভোগী শারমিন আক্তার। রংপুর থেকে আসা এ নারী পরিবহন পুল ভবনের বিচার শাখা-৬-এ আইনজীবীর সিল সেবা নিতে এসে পুলিশ সদস্যদের হয়রানির শিকার হন। শারমিনের স্বামী বেলায়েত হোসেন থাকেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। শারমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমিও স্বামীর কাছে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে তার আগে আমাদের বিয়ের কাবিন সত্যায়িত করাতে হবে। এর জন্য ঢাকায় এসেছিলাম। এসব কাগজ কীভাবে সত্যায়িত করাতে হয় তা না জানার কারণে চার দিন ধরেও কাবিন সত্যায়িত করতে পারিনি। যেখানেই গিয়েছি সেখানেই আমাকে সাহায্য করার কথা বলে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা দাবি করে দালালরা। অ্যাডভোকেটের সিল পেতে পরিবহন পুল ভবনের প্রবেশমুখে বাধা ও টাকার বিনিময়ে সিল পাইয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য।’
এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন পুল ভবনে প্রবেশদ্বারে ডিউটিরত পুলিশ কনস্টেবল নাজমুল হক বলেন, ‘কোনো পুলিশ সদস্য টাকা নেন বলে আমার জানা নেই। বরং এখানে আসা প্রত্যেক সেবাপ্রার্থীকে আমরা সাহায্য করে থাকি। তবে কেউ যদি বাইরের দালাল দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে আসা প্রতিটি মানুষকে আমরা অবজার্ভ (পর্যবেক্ষণ) করে থাকি। যাকে সন্দেহ হয় তাকেই আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকি। এ কারণে কোনো দালাল বিচার শাখা-৬-এ যেতে পারে না।’
এ প্রসঙ্গে বিচার শাখা-৬-এর অফিস সহকারী শেখ বাবুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম সকাল থেকে শুরু হয়ে বিকেলে পর্যন্ত চলে। তবে একই ভবনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থাকায় কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয় সেবাগ্রহীতাদের।’
সেবাপ্রার্থীদের হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব (কনস্যুলার) মো. তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কনস্যুলার সেবা দেশের সব মানুষের জন্য। এ সেবাগ্রহণের জন্য কোনোরকমের ফি দিতে হয় না। তবে মাঝেমধ্যে মন্ত্রণালয়ের বাইরে থাকা দালালদের কাছে সেবাগ্রহীতাদের অনেকেই প্রতারিত হয় বলে খবর পাওয়া যায়। নির্দিষ্টভাবে এখনো কোনো ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ দেয়নি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা দালালদের পাকড়াও করতে পারব।’
আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক (কনস্যুলার ও এমআরপি) মো. মোনয়ার মুকাররম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কনস্যুলার সেবা আমরা যেখানে দিয়ে থাকি, সেখানে অনেক বোর্ড স্থাপন করেছি যেন সেবাপ্রার্থীরা এসে প্রতারণার শিকার না হন। এরপরও কনস্যুলার সেবার জন্য একজন সেবাপ্রার্থীর কোন কোন কাগজগুলো দরকার হবে তা আমাদের ওয়েবসাইটে ক্লিয়ার (পরিষ্কার) করে দিয়ে রেখেছি। এর থেকে আরও বেশি সুবিধা পেতে আমরা আমাদের নাম্বারগুলো দিয়েছি। যে কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সেবার বিষয়ে জেনে নিতে পারবেন। এরপরও কেউ প্রতারিত হলে যেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অভিযোগ দেয়। তাহলে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার সেবা তথ্য অনুযায়ী, বিদেশগামীদের জন্মসনদ, নিকাহনামা, অবিবাহিত সনদপত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট তাদের নিজ নিজ কার্যালয় থেকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রধানের সিল ও স্বাক্ষর সংবলিত সনদকে বিচার শাখা-৬-এর আওতায় নটারাইজ ও আইনজীবী দিয়ে সত্যায়িত করাতে হবে। আইনজীবী দিয়ে সত্যায়িতের জন্য তোপখানা রোডের পরিবহন কমিশন কার্যালয় ভবনের দশমতলায় বিচার শাখা-৬-এ সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে উপস্থিত থাকতে হয়। একইদিনে আইনজীবী দিয়ে সত্যায়িতের নথি নিয়ে দুপুর ১২টা থেকে ১টার মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার সেবাকক্ষে উপস্থিত থেকে নথি জমা দিতে হয়। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্র্তৃক প্রত্যয়নপূর্বক বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে বিদেশগামীরা তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে পাবেন। অর্থাৎ এক কর্মদিবসের মধ্যেই সত্যায়িত নথির কপি পাওয়ার কথা সেবাপ্রার্থীদের।
লোকসাহিত্য বাংলাদেশের সোনালি সম্পদ বাংলা লোকসাহিত্য আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের সন্ধান দেয়। বাঙালির সঙ্গে বাংলা লোকসাহিত্যের রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক। বাংলাদেশের লোকসাহিত্য আমাদের জাতীয় কৃষ্টি, চিন্তাধারা, শিক্ষা, সভ্যতা, উন্নতি ও ঐশ্বর্যের আধার।
গ্রামবাংলার মাঠে-ঘাটে-বাটে, আলো-বাতাসে মিশে আছে বাংলা লোকসাহিত্যের অবয়ব। আমাদের লোকসাহিত্যের নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকস্মৃতি বা লোকইতিহাসে। এসব লোকস্মৃতির একাংশকে কিংবদন্তি বলা হয়। স্থান ও নামের ইতিহাসে বিধৃত থাকে কিংবদন্তি।
কিংবদন্তি হলো ইতিহাস ও কল্পনার সংমিশ্রণ; লোককথা বিশেষ যার মধ্যে থাকতে পারে অলৌকিক ঘটনা, যা সত্যিই ঘটেছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। সময়ে সময়ে এটি পরিবর্তিত হতে পারে বিশ্বাসটিকে তাজা, জীবন্ত এবং বাস্তবসম্মত রাখার উদ্দেশ্যে। গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয় ঐতিহাসিক পটভূমিতে স্থাপিত লোককথাকে কিংবদন্তি বলেছেন।
লোকস্মৃতি বা কিংবদন্তির ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের বা বাংলাদেশের কোনো কোনো জেলার বিভিন্ন স্থানের নামকরণ করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে লোকায়ত বাংলাদেশ সিরিজে আমরা নিবেদন করছি ‘কুমিল্লা অঞ্চলের কিংবদন্তি’। কুমিল্লা অঞ্চলে অসংখ্য গ্রাম, গঞ্জ, অঞ্চল, শহর বা দীঘি আছে যেসবের নাম কিংবদন্তি বা কল্পকথাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
কুমিল্লা জেলার নামও কিংবদন্তি-আশ্রিত। কুমিল্লায় কিংবদন্তি আছে যে, হজরত শাহজালাল (র.) চতুর্দশ শতকের শুরুর দিকে তার মাতুল আহমদ কবীরের দেওয়া এক মুঠো মাটি নিয়ে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। মাতুল কবীরের নির্দেশ ছিল এরকম: ‘যে স্থানের মাটির সঙ্গে এই মাটির রং, গন্ধ ও স্বাদ মিলে যাবে, সেই স্থান হবে তোমার সাধনার স্থল ও ধর্মপ্রচারের কেন্দ্র।’ হজরত শাহজালাল (র.) পাহাড়-পর্বত, দুস্তর মরুপথ পাড়ি দিয়ে দেশের পর দেশ পেরিয়ে একদিন কুমিল্লা শহরের পূর্বদিকে গাজীপুর মহল্লার খিলাতলীতে হাজির হন এবং রাত্রিযাপনের জন্য উঁচু একটি টিলায় তাঁবু ফেলেন। হঠাৎ কী মনে করে তাঁর ভূতত্ত্ববিদ চাশনী পীর এ স্থানের মাটি পরীক্ষা করে তাদের বয়ে আনা মাটির সঙ্গে মেলাতে গিয়ে ‘কোহমিলা’ বলে উল্লাসে চিৎকার করে ওঠেন।
কোহমিলা অর্থাৎ অভীষ্ট পাহাড় পাওয়া গেছে শাহজালাল! এ অঞ্চলের কিংবদন্তি এই যে, এই ‘কোহমিলা’ শব্দই পরে ‘কুমিল্লা’য় পরিবর্তিত হয়েছে।
আরেক কিংবদন্তি বলে এখানে ‘কমলাঙ্ক’ নামে এক রাজা ছিলেন। সেই রাজার নামে তার শাসনাধীন এলাকার নাম হয় ‘কমলাঙ্ক নগর’, যে নাম থেকে উদ্ভূত হয়েছে ‘কুমিল্লা’। ‘রাজমালা’ ও ‘ইসলামাবাদ’ নামের গ্রন্থদ্বয়ে এ বিবরণের সমর্থন পাওয়া যায়।
কুমিল্লা অঞ্চলের নানা স্থানের নামকরণেও কিংবদন্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। কুমিল্লার কয়েকটি দীঘি এবং স্থানের নামকরণে কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কুমিল্লার অনেক দীঘি ও পুকুরের কথা আমাদের কাব্যসাহিত্যেও পাওয়া যায়।
কবি শেখ ফয়জুল্লার ‘গোরক্ষ বিজয়’ কাব্যে বর্ণনা করা হয়েছে:
‘নাথে বোলে এই রাজ্য বড় হএ ভালা।
চারি কড়াকড়ি বিকাএ চন্দনের তোলা।।
লোকের পিধঁন দেখে পাটের পাছড়া।
প্রতি ঘর চালে দেখে সোনার কোমড়া।।
কার পখরির পানি কেহ নাহি খাএ।
মণিমাণিক্য তারা রৌদ্রতে শুকাএ।।
ধন্য ধন্য রাজনগর করি এ বাখানি।
সুবর্ণের কলসে সর্বলোকে খাএ পানি।।’
কিংবদন্তি আছেÑ কুমিল্লার ময়নামতীর নামকরণও রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী রানী ময়নামতীর নামানুসারে হয়েছে। ‘রোহিতগিরি’ নাম থেকে হয়েছে লালমাই পাহাড়। রাজা শালিবাহনের নামানুসারে হয়েছে শালবন বিহার, শালবানপুর গ্রাম, শালবান রাজার দীঘি প্রভৃতি। তেমনি আনন্দ রাজার নামানুসারে হয়েছে আনন্দ বিহার, আনন্দসার ও আনন্দপুর গ্রাম এবং আনন্দ রাজার দীঘি।
কুমিল্লার ‘কোটবাড়ী’র নামকরণও কিংবদন্তিবহুল। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্তমান কোটবাড়ী এলাকা ছিল তখনকার গুপ্ত, খড়গ, পাল, চন্দ্র, দেব প্রভৃতি রাজ-রাজড়ার রাজধানী। কেউ কেউ বলেন, এটি ছিল তখনকার রাজাদের দরবারবাড়ি। আবার কেউ বলেন, এটি ছিল তাদের ‘দুর্গ-বাটি’ অর্থাৎ কোটবাড়ী। শব্দের ব্যুৎপত্তি বিবেচনায় নিলে দেখা যায় : কোট একটি সংস্কৃত শব্দ। এর অর্থ দুর্গ, অন্য অর্থ পাহাড় বা পর্বতের চূড়া। এজন্যই পরবর্তীকালে এ স্থানটি ‘কোটবাড়ী’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
কুমিল্লা শহরের পুবদিকে ‘বজ্রপুর’ নামে একটি গ্রাম আছে। কিংবদন্তি আছে, এখানে এককালে বজরা ভিড়ত। এখানে বজরাঘাট ছিল। এখান থেকে মানুষ বজরায় চড়ে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া-আসা করত। ‘বজরা’ থেকেই ‘বজ্রপুর’ নামের উৎপত্তি। আবার কেউ কেউ মনে করেন, একবার এখানে প্রচন্ড বজ্রপাত হয়েছিল, সে কারণেই জায়গাটির নামকরণ করা হয়েছে বজ্রপুর। ‘বজ্র’ নামের কোনো ব্যক্তির নামানুসারে ‘বজ্রপুর’ হওয়াও বিচিত্র কিছু নয়।
নদীকেন্দ্রিক কিংবদন্তি কুমিল্লা অঞ্চলে প্রচলিত আছে। যেমন
‘গোমতী নদীর কুলে মজিদ স্থাপিয়া।
সুজা বাদসার নামে মজিদ করিয়া।।
সুজা নামে এক গঞ্জ রাজা বসাইল।
সুজাগঞ্জ নাম বলি তাহার রাখিল।।’
সুজাগঞ্জ মানে গোমতীবিধৌত কুমিল্লা। গোমতী নদীর কূলেই সুজা মসজিদ। এর পাশ ঘেঁষেই সুজাগঞ্জ। মোগল শাসনকর্তা শাহ সুজার নাম অনুসারে সুজাগঞ্জ এবং সুজা মসজিদ। আজও টিকে আছে ‘সুজা মসজিদ’ এবং ‘সুজাগঞ্জ’ নাম।
কুমিল্লা অঞ্চল কিংবদন্তিসমৃদ্ধ। কিংবদন্তিবহুল এ অঞ্চলের কৃষ্টি, সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যা লোকায়ত বাংলার সম্পদ। এ অঞ্চলের স্থান বা নামের লোকস্মৃতি বা কিংবদন্তি বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন, তাদের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার, সংস্কার-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, অভিজ্ঞতা-অভিজ্ঞান, বুদ্ধি-প্রজ্ঞা, ধর্মীয় ও লৌকিক কার্যকলাপের প্রতিচ্ছবি, যাতে পরিস্ফুটিত লোকায়ত বাংলার মুখ।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক
পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলার ২২ বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। ২০০১ সালের এই দিনে পল্টন ময়দানে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান চারজন। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী।
এ ঘটনায় খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সিপিবি নেতা হিমাংশু মণ্ডল, রূপসা উপজেলার সিপিবি নেতা ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা আবদুল মজিদ, ঢাকার ডেমরার লতিফ বাওয়ানি জুটমিলের শ্রমিক নেতা আবুল হাসেম ও মাদারীপুরের কর্মী মোক্তার হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ দিন পর মারা যান খুলনা বিএল কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা বিপ্রদাস রায়। আহত হয় শতাধিক নেতাকর্মী। ওই ঘটনায় সিপিবির তৎকালীন সভাপতি মনজুরুল আহসান খান মতিঝিল থানায় মামলা করেন।
পল্টনে সিপিবির সমাবেশে তিন শক্তির যৌথ আক্রমণ করেছিল বলে মনে করেন দলটির নেতারা। তাদের মতে, সেদিন কমিউনিস্টদের স্তব্ধ করার জন্যই বোমা হামলা চালানো হয়েছিল, যাতে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স দেশ রূপান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘২০০১ সালে পল্টন ময়দানে সিপিবির আহ্বানে লাখো মানুষের সমাবেশ হয়। সমাবেশটি ছিল ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক. ক্ষেতমজুর, বুদ্ধিজীবীÑ সবার সমাবেশ। তারা জড়ো হয়েছিলেন যারা যার দাবিতে। আমাদের দাবি ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করা, লুটপাটতন্ত্র ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় এগিয়ে নিতে গণতন্ত্রের সংগ্রামকে বেগবান করা।’
তিনি বলেন, ‘বোমা হামলার ঘটনায় আমাদের মনে হয়েছে, ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি যে লড়াই করছিল, তা ছিল দ্বিদলীয় ব্যবস্থার বাইরে একটি বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা। সেটা দেখে শাসকগোষ্ঠী ভয় পেয়ে যায়। সেই সঙ্গে বুর্জোয়া গোষ্ঠী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিও ভীত ছিল। তাদের যৌথ আক্রমণ আমাদের ওপর পরিচালিত হয়েছিল। এ দেশে যাতে বামপন্থি শক্তির উত্থান না ঘটে। আমরা ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, বামপন্থি শক্তিকে ধ্বংস করা যায়নি। কমিউনিস্ট পার্টি নীতি আদর্শের লড়াই অব্যাহত রেখেছে এবং জনগণের সঙ্গে তাদের দাবি আদায়ের লড়াই করে যাচ্ছে।’
সিপিবির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আমাদের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের তৎকালীন সভাপতি বাদী হয়ে মামলা করেন। দীর্ঘদিন এ মামলা ঝুলে ছিল। দুই বছর আগে মামলায় রায় হয়েছে। তাতে কয়েকজন উগ্রবাদী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তারা উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। এখন পর্যন্ত মামলার রায় কার্যকর হয়নি।’
২০২০ সালে ২০ জানুয়ারি পল্টনে সিপিবি সমাবেশে বোমা হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। ১০ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়। ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রবিউল আলম এ রায় ঘোষণা করেন। মামলার জীবিত ১২ আসামির মধ্যে দুজনকে খালাস দেন তিনি।
হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানও এ মামলায় অভিযুক্ত আসামি ছিলেন। অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ মামলার অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১০ আসামির মধ্যে মুফতি মঈন উদ্দিন শেখ, আরিফ হাসান সুমন, সাব্বির আহমেদ, শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন। আর জাহাঙ্গীর আলম বদর, মহিবুল মুত্তাকিন, আমিনুল মুরসালিন, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান ও নুর ইসলাম পলাতক।
এ ১০ আসামিকে সর্বোচ্চ সাজার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে রায়ে। এ ছাড়া পলাতক দুই আসামি মো. মশিউর রহমান ও রফিকুল আলম মিরাজকে খালাস দিয়েছেন বিচারক।
দ্রুত রায় কার্যকর করার দাবি জানিয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘এটা ছিল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এর পেছনে কী ঘটনা ছিল এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ খুঁজে বের করতে পারেনি বলে মনে করছি আমরা। আমরা এখন দাবি করছি ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা হোক এবং জনগণের সামনে উপস্থিত করা হোক।’
প্রতি বছরের মতো এবারও পল্টন শহীদদের স্মরণে আজ (২০ জানুয়ারি, শুক্রবার) সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুক্তি ভবনের সামনে শহীদ স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হবে। বেলা ৩টায় শাহবাগ চত্বরে সমাবেশ ও লাল পতাকার মিছিল করবে দলটি।
ফেনীর দক্ষিণ সহদেবপুরের বাসিন্দা পলাশ চন্দ্র দাস (৩৯) গত বছর ১২ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার জন্য সাক্ষাৎকার দিতে রাজধানীর গুলশানে দেশটির দূতাবাসে পাসপোর্টসহ উপস্থিত হন। দূতাবাস কর্তৃপক্ষ পলাশের পাসপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখতে পায়, ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় মালদ্বীপ ভ্রমণ এবং ২০ নম্বর পৃষ্ঠায় মালয়েশিয়া ভ্রমণের ভিসার জাল সিল।
একইভাবে মাদারীপুরের হাউজদী দুর্গাবদী গ্রামের বাসিন্দা মাহাবুবুর রহমান খান (৩৬) গত বছর ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার জন্য সাক্ষাৎকার দিতে দূতাবাসে যান। তার পাসপোর্টেও ৯ নম্বর পৃষ্ঠায় কম্বোডিয়া ও ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় মালদ্বীপ ভ্রমণের ভিসার সিল জাল হিসেবে শনাক্ত করে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। ভিসাপ্রত্যাশী নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার বাসিন্দা মো. মিলন (৪০) গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর পাসপোর্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের জন্য যান। তার পাসপোর্টের ২০ ও ২২ নম্বর পৃষ্ঠায় মালদ্বীপ ভ্রমণের জাল ভিসার সিল শনাক্ত করেন দূতাবাসের কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাপ্রত্যাশী আরও কয়েকজন বাংলাদেশির পাসপোর্টে বিভিন্ন দেশের ভিসার সিল জাল হিসেবে শনাক্ত করার পর পুলিশের শরণাপন্ন হয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। দূতাবাসের সহকারী আঞ্চলিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা (ইনভেস্টিগেশন) মাইকেল লি গুলশান থানায় মামলা করেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, পলাশ চন্দ্র দাশ রাজধানীর মতিঝিলের রহমানিয়া ইন্টারন্যাশনাল কমপ্লেক্সে ‘ট্রাভেলার্স ডায়েরি’ নামের একটি এজেন্সির মাধ্যমে তার ভিসা প্রসেসিং করেছেন। মাহাবুবুর রহমান ভিসা প্রসেসিং করেছেন ‘হ্যাপি হলিডেইস’ নামের আরেকটি এজেন্সির মাধ্যমে। অন্য কোনো দেশে ভ্রমণ না করেই পাসপোর্টে সেসব দেশের ভিসার জাল সিল মারা ব্যক্তিদের পাসপোর্ট নম্বর উল্লেখ করে এজাহারে বলা হয়েছে, ‘তারা অসাধু উদ্দেশ্যে আমেরিকার ভিসা পেতে চেয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করা হলো।’
এ অভিযোগের পর তদন্ত শেষে পাসপোর্টে ভিসার জাল সিল মেরে ভিসার আবেদনকারী ও ভিসা প্রসেসিং এজেন্সির অভিযুক্ত ছয়জনকে গত বুধবার রাতে রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। গ্রেপ্তাররা হলেন পলাশ চন্দ্র দাশ, ওয়াহিদ উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম সুমন, মাহাবুবুর রহমান খান, আবু জাফর ও আরিফুর রহমান। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন দেশের ভিসার চারটি জাল সিল ও তিনটি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমেরিকান দূতাবাসের এক কর্মকর্তা আমাদের জানান, তাদের কাছে ভিসার জন্য আবেদনকারীদের অনেক পাসপোর্টে বিভিন্ন দেশের ভিসা ও ইমিগ্রেশনের ইন ও আউটের সিল মারা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তাদের সন্দেহ হয়েছে। এরপরই আমরা তদন্তে নামি। তদন্তে দেখা গেছে এসব ভিসার সিল জাল।’
তিনি বলেন, ‘পাসপোর্টের গুরুত্ব বাড়াতে কিছু এজেন্সি এসব ভিসার জাল সিল মারছে। তারা ভেবেছিল এগুলো কখনো যাচাই করা হবে না। চক্রটি মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে পাঠাতে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তি করছে। তাদের ফাঁদে অনেকেই পা দিচ্ছেন। এসব এজেন্সিই জাল সিল মেরে ভিসা করে দিতে পারে না।
ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশের ভিসা পাওয়া কঠিন সেসব দেশের ভিসা করে দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কিছু ভিসা প্রসেসিং এজেন্সি। ভিসা প্রার্থীদের সম্মতিতেই তারা প্রার্থীর পাসপোর্টের গুরুত্ব বাড়াতে বিভিন্ন দেশের জাল ভিসার সিল এবং ইমিগ্রেশনের ইন (ঢোকা) ও আউটের (বের হওয়া) জাল সিল পাসপোর্টে লাগায়। চক্রটি গত দুই থেকে তিন বছর ধরে এ ধরনের কাজ করে সাধারণ মানুষকে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনা এবং প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, দেখা গেছে ব্যবসায়ী পলাশ চন্দ্র দাস অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার জন্য ট্রাভেলার্স ডায়েরি নামের এজেন্সিটির মালিক ওয়াহিদ উদ্দিন ও তার সহকারী শফিকুল ইসলাম সুমনের মাধ্যমে পাসপোর্টে জাল সিল মারেন। মাহাবুবুর হ্যাপি হলিডেইস এজেন্সির মালিক মো. আরিফুর রহমান ও তার সহকারী মো. আবু ভাবনার সঙ্গে যোগসাজশে বিভিন্ন দেশের জাল ভিসা এবং সিল নিজেরা তৈরি করে পাসপোর্টে ব্যবহার করেন।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিভিন্ন ট্রাভেলস এজেন্সিই ভিসা প্রসেসিং এজেন্সি খুলে বসেছে। এদের মধ্যে কিছু অসাধু এজেন্সি ভিসাপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ভিসা সহজে পেতে পাসপোর্টের গুরুত্ব বাড়াতে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের জাল সিল মারছে পাসপোর্টে।’
এসব ভিসা প্রসেসিং এজেন্সির কোনো বৈধ কাগজ আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে বলে জানান ডিবির এ ডিসি।
প্রতি বছর শীতের মৌসুমে সবজিতে সয়লাব থাকে রাজধানীসহ সারা দেশের হাটবাজার। বাজারে প্রচুর সবজির সরবরাহ ক্রেতাদের স্বস্তি দেয়। কিন্তু এবার শীতের ভরা মৌসুমে পরিস্থিতি উল্টো। বাজারে সবজি থাকলেও দাম তো কমেইনি, বরং কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা করে বেড়েছে। বাজারে এখন সব থেকে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে লাউ ও কাঁচামরিচ।
ক্রেতারা অস্বস্তি প্রকাশ করে বলছেন, সব কিছুর দামই বেড়ে গেছে। আগে শীত শুরু হলে সবজির দাম কমে যেত, কিন্তু এবার উল্টোটা দেখছি।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে রাজধানীর কাঁঠালবাগান ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত সপ্তাহে ৯০-১০৫ টাকায় বিক্রি হওয়া কাঁচামরিচ গতকাল ১১০-১১৫ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। প্রতি পিস লাউ আকার ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা। শসার কেজি ৫০-৫৫ টাকা, মুলা ৩০-৩৫ টাকা, নতুন লাল আলু ৪০-৪৫ টাকা, বেগুন ৫০ টাকা (লম্বা), ফুলকপি প্রতিটি ৩০-৪০ টাকা, পাতাকপি ৩০-৩৫ টাকা। অবশ্য ৫ টাকা কমে প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকায়।
এছাড়া মিষ্টিকুমড়া কেজি ৪০-৫০ টাকা দরে, জাত ভেদে প্রতি কেজি শিম ৩৫-৬০ টাকা, পেঁপে ৩০ টাকা ও লেবুর হালি ৩০-৩৫ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে।
কারওয়ান বাজারে কথা হয় সুলাইমান আহমেদ নামের এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সব সময় দেখে আসছেন শীতকালে প্রচুর সবজির জোগান থাকে বাজারে। দামও থাকে কম। এখন পরিস্থিতি দেখে তার মনে হচ্ছে না যে তিনি দেশে আছেন। তিনি মনে করেন, কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলেও মধ্যস্বত্বভোগীরা মানুষের পকেট কাটছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশি থাকায় কৃষকরা মাঠ থেকে ফসল তুলছেন না। যার ফলে বাজারে আমদানি কমে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে সবজির বাজারে। কারওয়ান বাজারের সবজি ব্যবসায়ী বেলাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পাইকারি বাজার থেকে আমাদের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। এখান থেকে অন্যান্য বাজারের ব্যবসায়ীরাও কেনেন। আমাদের যাতায়াত খরচটা লাগে না বলে কম দামে সবজি বিক্রি করতে পারি। কিন্তু অন্য এলাকার বাজারগুলোতে আরও বেশি দামে সবজি বিক্রি হয়।
তেজকুনিপাড়া সংলগ্ন কলমীলতা বাজারের কয়েকটি মুদি দোকান ঘুরে জানা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব থেকে বেশি বেড়েছে ডিমের দাম। প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২৫-১৩০ টাকা করে।
প্রতি কেজি স্বর্ণা চাল ৪৬-৫০ টাকা, ব্রি-আটাশ ৫৬-৬০ টাকা, মিনিকেট ৭৬-৮০, নাজিরশাইল ৭০-৯০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
মাছের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আগের মতো চড়া দামে সব ধরনের মাছের বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি বড় আকারের রুই মাছের কেজি ৩০০-৩১০ টাকা, কাতলা মাছ (ছোট) ২৭০-২৮০ টাকা, কার্প জাতীয় মাছের কেজি ২৫০ টাকা, বড় আকারের তেলাপিয়া ২০০, কই ২২০, মৃগেল ২০০-২১০ ও নলা ২৫০-২৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাঁঠালবাগান বাজারের মাছ বিক্রেতা মনির দেশ রূপান্তরকে বলেন, মাছের বাজার কখন ওঠে কখন নামে তা বলা মুশকিল। তবে নতুন বছরের শুরুর দিন থেকে মাছের দাম কিছুটা বাড়তির দিকে রয়েছে। বাজার একবার বাড়লে তা আর কমার কোনো সম্ভাবনা থাকে না বরং বাড়ার একটা প্রতিযোগিতা থাকে।
কাঁঠালবাগান ও তেজকুনিপাড়া সংলগ্ন কলমীলতা বাজারের মাংসের দোকান ঘুরে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগি ১৮০ টাকা বিক্রি হয়েছে। গতকাল বিক্রি হয়েছে ১৫৫-১৬৫ টাকা করে। পাকিস্তানি লাল ২৮০-৩০০ টাকা ও দেশি মুরগি ৫১০-৫৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুরগি ছাড়াও মাংসের মধ্যে গরু ৭০০ টাকা, খাসি ১ হাজার ১০০ টাকা ও বকরির মাংসের কেজি ৯০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
বেলজিয়ামের নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে সম্মানতি বোধ করছেন ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা।
গত বছর বিশ্বকাপের পর রিয়াল মাদ্রিদ তারকা এডেন হ্যাজার্ড জাতীয় দলকে বিদায় জানান। বেলজিয়াম কোচ ডোমেনিকো টেডেসকো প্লেমেকার ডি ব্রুইনাকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দেন। বিশ্বকাপের পর বেলজিয়ামের কোচের পদে রবার্তো মার্টিনেজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন টেডেসকো।
গত জানুয়ারিতে ৩২ বছরে পা রেখেছেন ব্রুইনা। আরটিএল-টিভিআই টেলিভিশনে বেলজিয়ামের নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘এভাবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারা সত্যিই সম্মানের। আমার বয়স প্রায় ৩২ হয়ে গেছে। আমি কখনই আন্তর্জাতিক অবসরের চিন্তা করিনি। আমি বিশ্বাস করি এখনো দলকে কিছু দেবার সক্ষমতা আমার আছে। এই সুযোগে তরুণদেরও সহযোগিতা করতে চাই।’
সুইডেনের বিরুদ্ধে শুক্রবার ইউরো বাছাইপর্বে অধিনায়ক হিসেবে ডি ব্রুইনার অভিষেক হতে যাচ্ছে। মাদ্রিদ গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া ও চেলসি রোমেলু লুকাকু ডি ব্রুইনার সহ-অধিনায়ক হিসেবে কাজ করবেন।
চতুর্থ পর্বে মাস্টারদা সূর্য সেনকে নিয়ে লিখেছেন ইসমত শিল্পী
সূর্য সেনের স্বাধীনতার স্বপ্ন
স্বাধীনতার মাস মার্চেই বিপ্লবী সূর্য সেনের জন্ম। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ তিনি চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের একজন অন্যতম নেতা এবং ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’র প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন কওে সেখানে বিপ্লবী সরকার গঠন করেন। ১৯৩৩ সালে তাকে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়।
বালক বয়সেই সূর্য সেন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ছুটে আসা ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতেই হবে। জাস্টিস কিংসফোর্ডকে হত্যাচেষ্টার জন্য ক্ষুদিরামের ফাঁসি সূর্য সেনের হৃদয় ও মনকে দারুণভাবে আলোড়িত করে। কলেজে পড়ার সময়ই ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য তিনি বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় শিক্ষক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী তাকে বিপ্লবী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করেন। ইংরেজদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করার জন্য সূর্য সেনের হৃদয়-মন তৈরি হয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশ থেকে ইংরেজ তাড়ানোর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন।
সে সময় চট্টগ্রামে একটি গোপন বিপ্লবী দল ছিল। ১৯১৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই বিপ্লবী দলের কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাইকে গ্রেপ্তার করে সরকার জেল দেয়। বিপ্লবের জন্য স্বচ্ছ চিন্তা, জ্ঞান, বুদ্ধি ও মেধা অন্যদের তুলনায় বেশি থাকায় তিনি কিছু দিনের মধ্যেই দলের একজন নেতা হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তার বুদ্ধি-পরামর্শ-নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।
সূর্য সেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড, দুঃসাহসী অভিযান, সঠিক নেতৃত্ব¡ এই উপমহাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল। দেশের তরুণ ও যুবশক্তি তার আত্মাহুতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামে দলে দলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সূর্য সেনের বাহিনী কয়েক দিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনকে চট্টগ্রাম এলাকা থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সূর্য সেনের অন্যতম সাথী বিপ্লবী অনন্ত সিংহের ভাষায়, ‘কে জানত যে আত্মজিজ্ঞাসায় মগ্ন সেই নিরীহ শিক্ষকের স্থির প্রশান্ত চোখ দুটি একদিন জ্বলে উঠে মাতৃভূমির দ্বিশতাব্দীব্যাপী অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হবে? ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্বর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিশোধ, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ! কে জানত সেই শীর্ণ বাহু ও ততোধিক শীর্ণ পদযুগলের অধিকারী একদিন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ রাজশক্তির বৃহত্তম আয়োজনকে ব্যর্থ করে তার সব ক্ষমতাকে উপহাস করে বছরের পর বছর চট্টগ্রামের গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলবে?’
সূর্য সেন পরে ছাত্রদের মাঝে বিপ্লবের মন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেন। চরিত্রের মাধুর্য দিয়ে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দলে দলে যুবকদের তার বিপ্লবী দলে টেনে আনেন। তিনি দেশপ্রেমের শিখাকে প্রত্যেকের অন্তরে জ্বেলে দেন। ছাত্রদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশার কারণে নিজের স্কুল ও শহরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্ররা একান্ত আপনজনের মতো তাকে ‘মাস্টারদা’ বলে ডাকতে শুরু করে।
১৯২৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাস্টারদার স্ত্রী পুষ্পকুন্তলা হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান। এ সময় মাস্টারদা জেলে ছিলেন। পরে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে মাত্র কয়েকজন যুবক রাত সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম পাহাড়ের ওপর অবস্থিত অস্ত্রাগারটি আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে দখল করে নেন এবং সব অস্ত্র লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলেন। সূর্য সেন সেই রাতে ঘোষণা করেন, চট্টগ্রাম এই মুহূর্তে দুইশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করেছে। এই মুহূর্তে চট্টগ্রাম স্বাধীন।
মাস্টারদার নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইংরেজ শাসনমুক্ত ও স্বাধীন ছিল। জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের মুখোমুখি সংঘর্ষ শেষ হওয়ার পরও তারা টানা তিন বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যদের দৃষ্টি থেকে মাস্টারদাকে আড়ালে রাখার উদ্দেশ্যেই বিপ্লবীরা এই যুদ্ধ চালিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসনাধীন পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীরা। সূর্য সেন ছাড়াও এই দলে ছিলেন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, অপূর্ব সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনগুপ্ত, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য, শশাঙ্ক শেখর দত্ত, অর্ধেন্দু দস্তিদার, হরিগোপাল বল, প্রভাসচন্দ্র বল, তারকেশ্বর দস্তিদার, মতিলাল কানুনগো, জীবন ঘোষাল, আনন্দ গুপ্ত, নির্মল লালা, জিতেন দাসগুপ্ত, মধুসূদন দত্ত, পুলিনচন্দ্র ঘোষ, সুবোধ দে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্ত। ছিলেন সুবোধ রায় নামের এক ১৪ বছরের বালক।
বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তারের হাত থেকে অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন মাস্টারদা। চট্টগ্রামের কাছেই গইরালা গ্রামে এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন মাস্টারদা। এক জ্ঞাতির বিশ্বাসঘাতকতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তার সন্ধান পেয়ে যায়। মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। ১৯৩৪ সালে ফাঁসির আগেই স্বাধীনতার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন সূর্য সেন। ১৯৩৪ সালে ১২ জানুয়ারি ভোর ১২.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে সঙ্গীদের উদ্দেশে তিনি লিখে যান, ‘আমি তোমাদের জন্য রেখে গেলাম মাত্র একটি জিনিস, তা হলো আমার একটি সোনালি স্বপ্ন। স্বাধীনতার স্বপ্ন। প্রিয় কমরেডস, এগিয়ে চলো, সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত।’
কোনো জেলায় কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন রয়েছে কি না তা জানতে তালিকা তৈরি করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রত্যেক ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আবাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা আমার সরকারের লক্ষ্য হওয়ায় আমি প্রত্যেককে বাড়ি দেব। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই প্রতিটি মানুষ বাড়ি, আশ্রয় এবং জীবিকার সুযোগ পাবে। তারা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবে না। আমরা চাই প্রত্যেকে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং যথাযথ সম্মানের সঙ্গে বসবাস করবে।’
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের চতুর্থ ধাপে বাড়ি হস্তান্তরের সময় এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি সাতটি জেলা ও ১৫৯টি উপজেলাকে গৃহহীন ও ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, গাজীপুর, নরসিংদী, জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গা।
এর আগে তিনি পঞ্চগড় ও মাগুরার সব উপজেলাসহ ৫২টি উপজেলাকে গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। তিনি গতকাল ৯টি জেলা এবং ২১১টি উপজেলা গৃহহীন-ভূমিহীনমুক্ত ঘোষণা করেন। খবর বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভূমিহীনদের ঘর দেওয়ার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জাতির পিতা দেশকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত করে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে একটি উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন দিতে চেয়েছিলেন। যার জন্য তার সরকার অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশে কেউ গৃহহীন ও ভূমিহীন থাকবে না বলে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে গৃহহীনদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে তিনি বলেন, তার সরকার ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীন ও ভূমিহীনদের বাড়িঘর ও জমির মালিকানা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মোহাম্মদ তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া। অনুষ্ঠানে বাড়িপ্রাপ্তদের পরিবর্তিত জীবনযাত্রার ওপর একটি ভিডিও-প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ ঠিকানা ছাড়া থাকবে না। আমরা তাদের শুধু ঘরই দিইনি, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছি। তাদের জীবিকার জন্য ঋণও দিয়েছি। তারা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।’ তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা ঘোষণা করেছিলেন, একজন ব্যক্তি ১০০ বিঘা জমির অধিকারী হতে পারবে এবং এর অতিরিক্ত পরিমাণ জমি কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র গড়তে রোডম্যাপ জরুরি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভৌগোলিক-কৌশলগত সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। গতকাল ঢাকায় প্রথম অ্যাভিয়েশন সামিটের উদ্বোধন অধিবেশনে দেওয়া এক ভিডিও ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিয়েশন সামিট-২০২৩’-এর আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী এই শীর্ষ সম্মেলনকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। কারণ, দেশটির এই অঞ্চলে একটি বিমান যোগাযোগের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাক্সক্ষা রয়েছে।
বাংলাদেশকে বিমান যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা যাত্রী ও মালামাল উভয়ের জন্যই একটি উন্নত ও টেকসই বাজার সৃষ্টির পাশাপাশি সহায়ক পরিবেশ তৈরির জন্য সরকারি সংস্থা, এয়ারলাইনস ও সংশ্লিষ্ট অন্য সব পক্ষকে যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সরকার ই-ভিসা সিস্টেম চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে ও পর্যটনে আসা যাত্রীদের সুবিধা দেবে ও ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের যুবকদের অবশ্যই পাইলট, বিমান প্রকৌশলী, মেকানিক, ক্রু ও আরও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ থাকতে হবে।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, তার সরকারের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ইউনিভার্সিটি দেশের বিমানশিল্পে লোকবলের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, এই বিমানশিল্প এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে নেতৃত্ব দিতে হবে।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী বক্তব্য দেন।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে ট্রেনের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষের ঘটনায় ২ ঘণ্টা পর চালু হয়েছে রেল যোগাযোগ।
ইঞ্জিন পরীক্ষার পর পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাত ১১টার দিকে ছেড়ে যায়। এতে সড়কের ২ পাশের যান চলাচলও স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে।
বুধবার রাত ৯টার পর মালিবাগ লেভেল ক্রসিংয়ে পঞ্চগড়গামী দ্রুতযান এক্সপ্রেস ট্রেনটি সোহাগ পরিবহনের একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাসে ধাক্কা দেয়। এতে বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ ঘটনায় তিন জন আহত হন। দুর্ঘটনার সময় বাসটিতে কোনো যাত্রী ছিল না। ট্রেনের গতিও কম ছিল।
মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনার কামরুজ্জামান ফকির (৩৫) নামে এক পল্লি চিকিৎসক নিহত হয়েছেন। এ সময় জাহিদ (২৮) নামে আরেকজন আহত হন। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে উপজেলার শেখপুর বাজারসংলগ্ন মির্জারচর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত কামরুজ্জামান মাদারীপুর সদর উপজেলার আদিত্যপুর গ্রামের আবদুর রব ফকিরের ছেলে।
হাসপাতালে, ফায়ার সার্ভিস ও নিহতের আত্মীয় সূত্রে জানা যায়, ভোরে কামরুজ্জামান তার আপন ভায়রা জাহিদকে নিয়ে তাবলিগ জামাতে অংশ নিতে গাজীপুরের টঙ্গী যাওয়ার উদ্দেশে শিবচরের পাঁচ্চর বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা হন। পাঁচ্চর থেকে বাসযোগে টঙ্গী যাওয়ার কথা ছিল তার। এ সময় তার মোটরসাইকেলটি শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কে শিবচরের শেখপুর মির্জারচর নামক স্থানে আসলে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে মোটরসাইকেল থাকা দুজন গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা কামরুজ্জামানকে শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আহত জাহিদকে উদ্ধার করে মাদারীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়।
শিবচর ফায়ার সার্ভিসের লিডার তরুনুর রশিদ খান বলেন, ভোরে আমরা খবর পেয় ঘটনাস্থলে যাই। সেখান থেকে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরে ডাক্তার তাকে মৃত্যু ঘোষণা করেন।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সর কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সকালে রোগীকে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন উদ্ধার করে এখানে নিয়ে আসে। পরে আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পাই হাসপাতালে আসার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।