
কংগ্রেসের চেম্বারে প্রথমবারের মতো পাঠ করা হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) লেখা বক্তব্য। গত বুধবার কংগ্রেসের চেম্বারে দুই অনুচ্ছেদের এই বক্তব্য পাঠ করেন প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাটিক সদস্য জ্যাক অকিনক্লস। চ্যাটজিপিটি নামের এআই প্রযুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল যৌথ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কেন্দ্র স্থাপনবিষয়ক বিল নিয়ে বক্তব্যটি তৈরি করে।
প্রযুক্তিবিষয়ক সংবাদমাধ্যম দ্য ভার্জের খবরে বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লেখা বক্তব্য পাঠের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রথম। অকিনক্লস জানান, এআই সিস্টেমটিকে তিনি আইন সম্পর্কিত তথ্যাবলি দিয়ে কংগ্রেসে পাঠ করার মতো ১০০ শব্দের বক্তব্য তৈরির আদেশ দেন। অবশ্য প্রস্তুতকৃত বক্তব্য চেম্বারে পাঠের আগে তাকে বেশ কয়েকবার সংশোধন করতে হয়েছে। তবে তিনি বলেন, ডেমোক্র্যাটিক ককাসে আমি কনিষ্ঠ অভিভাবক। এআই আমার জীবনের অংশ হতে চলেছে।
৩৪ বছর বয়সী অকিনক্লস বলেছেন, চ্যাটজিপিটির প্রস্তুতকৃত বক্তব্য তিনি পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যাতে করে এআই বিতর্কে সহযোগিতা হয়। তিনি চান না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আবির্ভাবের পুনরাবৃত্তি, যা ছোট আকারে শুরু হয়ে এত দ্রুত বিস্তৃত ও ব্যাপক হয় যে কংগ্রেস প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সময় পায়নি।
চ্যাটজিপিটিসহ ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে এমন এআই প্রোগ্রাম ইতিমধ্যে শিক্ষকদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অনেক শিক্ষককে মাথায় রাখতে হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এআই প্রস্তুতকৃত প্রবন্ধ জমা দিতে পারে।
গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, এআই চ্যাটবট ভুয়া তথ্য ও প্রপাগান্ডা তুফানের মতো ছড়িয়ে দিতে সহযোগিতা করতে পারে।
চ্যাটজিপিটির উদ্ভাবক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই তাদের ওয়েবসাইটে স্বীকার করেছে, চ্যাটজিপিটি মাঝেমধ্যে ভুল জবাব দিতে পারে এবং এর উত্তর অনেক সময় বিপথগামী করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবহারকারীদের জবাবগুলো সঠিক কি না যাচাই করার পরামর্শ দিয়েছে।
করোনায় সাধারণ মানুষের তুলনায় কিডনি রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি ১০ গুণ বেশি। ডায়ালাইসিসের রোগীদের ৫০ শতাংশ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি শতকরা ৫০ শতংশ। ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগীদের করোনা হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি। এমনকি এ ভাইরাসে আক্রান্তদের ১২ শতাংশ হতাশায় ভুগছেন। করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) পরিচালিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল সোমবার বিএসএমএমইউয়ে আয়োজিত এক সিম্পোজিয়ামে এ গবেষণার ফল উপস্থাপন করা হয়। এ সময় জানানো হয়, ২০২২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ৮৪০ জন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর এ গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার টিকার কার্যকারিতা কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক কম। ডায়ালাইসিস রোগীদের ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা শতকরা ৮৭ ভাগ। করোনার টিকা নেফ্রাইটিস রোগের পুনরাগম ঘটাতে পারে।
এ ব্যাপারে গবেষণাদলের প্রধান ও বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে পেশাজীবীদের মধ্যে করোনায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি মৃত্যুবরণ করেছেন। আক্রান্ত চিকিৎসকদের ৪০ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ নার্স লং কভিডে ভুগেছেন। যাদের ডায়াবেটিস ছিল না করোনায় তাদের ডায়াবেটিস হয়েছে। করোনায় অনেকের মায়োপ্যাথি হয়েছে। এছাড়া করোনায় আক্রান্তদের ১২ শতাংশ ডিপ্রেশনে ভুগছেন। তাদের এ অবস্থা থেকে চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব চিকিৎসকদের গবেষণার কাজ করতে হবে। একবার গবেষণার কাজ করলেই হবে না। ধারাবাহিকভাবে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
সিম্পোজিয়ামে জানানো হয়, ডায়াবেটিস, ওজনাধিক্য, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ। অন্যদিকে কভিড নিউমোনিয়া একটি সংক্রামক রোগ। কভিড হলে এই দুই ধরনের রোগের কিছু জটিলতা দেখা যায় এবং একটি রোগের দ্বারা অন্যটি প্রভাবিত হয়। তাই কভিড নিউমোনিয়া হলে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে যাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের কভিড জটিলতাও বেশি হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সব কভিড আক্রান্ত রোগীর মাঝে ১০ শতাংশ রোগীর ডায়াবেটিস আছে এবং তাদের ১৫ শতাংশের চিকিৎসাধীন থাকার প্রয়োজন হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিআইসি’র মতে, যাদের ওজনাধিক্য, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের কভিডের টিকা নিতে হবে। তবে অবশ্যই টিকা গ্রহণের সময় রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে। তবেই টিকা দেওয়ার পর একজন ব্যক্তি কভিড থেকে সুরক্ষা পাবে। কভিডপরবর্তী কিছু জটিলতা নিয়েও কিছু রোগী আমাদের কাছে আসছেন। তাকে পোস্ট-কভিড অথবা লং কভিড সিনড্রোম বলা হয়। দুর্বলতা, গায়ে ব্যথা, মাথাধরা, ঘুম কম হওয়া ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে রোগীরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে টিকা গ্রহণের মাধ্যমে কভিড-জটিলতা প্রতিরোধ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
ইউজিসি অধ্যাপক ডা. সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জি বলেন, কভিড শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বের অনেক দেশেই কভিড রয়েছে। কভিডের সংক্রমণের জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।
সিম্পোজিয়ামে ঢাকা মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু সালেহ আহমেদ, বারডেমের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারিয়া আফসানা, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের কনসালট্যান্ট ডা. মীর ইসারাকুজ্জামান একটি করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ করা বগুড়া-৬ (সদর) আসনে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট হাশেম আলী খান জাহেদী জয় পেয়েছিলেন। এরপর থেকে ৪৩ বছর ধরে আওয়ামী লীগের কাছে অধরা বগুড়া সদর আসনটি। এ কারণে উপনির্বাচনে জয় পেতে মরিয়া আওয়ামী লীগ ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপুকে ছাড় দিতে নারাজ জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম ওমর (লাঙ্গল প্রতীক), স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান আকন্দ (ট্রাক প্রতীক), স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার বাদল (কুড়াল প্রতীক)। ফলে এবারও আওয়ামী লীগের কাছে কঠিন হয়ে রইল এ আসনটি।
অপরদিকে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনে মাঠে ছুটে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। সেখানে ১৪ দলের পক্ষে মশাল প্রতীকে ভোট করছেন জেলা জাসদের সভাপতি রেজাউল করিম তানসেন। এ আসনে তাকে ছাড় দিতে নারাজ স্বতন্ত্র প্রার্থী নন্দীগ্রাম পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুল হাসান সিদ্দিকী জুয়েল (কুড়াল প্রতীক), জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তফা কামাল ফারুক। তবে বগুড়া-৪ ও ৬ আসনে উপনির্বাচনে ভোটের আলোচনায় সর্বদা এগিয়ে রয়েছেন আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম (একতারা প্রতীক)। তিনি দুই আসন থেকে ভোট করছেন। বর্তমান সরকারের মেয়াদে বগুড়া-৬ সদর আসনে তৃতীয়বার আর বগুড়া-৪ আসনে ভোট হচ্ছে দ্বিতীয়বার।
এদিকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী রাগেবুল আহসান রিপুর জয় নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় নেতারা ভিড় করছেন বগুড়ায়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বগুড়ায় আসছেন এবং বিভিন্ন জনসভা ও প্রতিনিধি সভায় সরকারেরে উন্নয়ন বার্তা সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, শেখ হাসিনাকে সদর আসন উপহার দিয়ে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার। এ আসনটিতে নৌকার প্রার্থী রিপুর বিপরীতে আছেন আরও ১১ প্রার্থী।
বিএনপির ছেড়ে দেওয়া বগুড়ার দুটি আসনে উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে ১ ফেব্রুয়ারি। ইতিমধ্যে ভোটের প্রচারণা শেষ করেছেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। শহরের আশপাশের চা স্টলগুলোতে এখন ভোটের কথা চলছে সাধারণ ভোটারদের মাঝে। বিএনপি মাঠে না থাকায় আওয়ামী লীগ জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। তবে এবারের ভোট নিয়ে সাধারণ ভোটারদের মাঝে কোনো আগ্রহ নেই। একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করে বলেছেন, ভোটার উপস্থিতি কম হলে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ কারণে তারা চাইছে উপস্থিতি কম হোক। এদিকে রবিবার আচরণবিধি ভেঙে দেড় হাজার মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা করেছে জেলা যুবলীগ। ফলে সাধারণ ভোটারদের মাঝে কিছুটা হলেও ভীতির সঞ্চার হয়েছে। অনেকে বলেছেন, বগুড়া সদর আসনে আওয়ামী লীগের যত ভোটার রয়েছে তাদের কেন্দ্রে আনা গেলে জয় নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আনা না গেলে জয় নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এতে এগিয়ে থাকবেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাগেবুল আহসান রিপু বলেন, শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বগুড়ার সাধারণ মানুষ ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবেন। সঠিকভাবে তারা তাদের ভোট প্রয়োগ করবেন। এটি বগুড়ার উন্নয়নের ভোট। নৌকায় ভোট দিয়ে ভোটার তাকে নির্বাচিত করবেন।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী নুরুল ইসলাম ওমর জয়ের বিষয়ে আশাবাদী। তিনি বলেন, এর আগে আমি সদর আসনের সংসদ সদস্য ছিলাম। এবারও ভোটাররা ভোট দিয়ে আমাকে নির্বাচিত করবেন থেমে থাকা উন্নয়নগুলোর সমাপ্তির জন্য।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান আকন্দ (ট্রাক প্রতীক) ও সরকার বাদল (কুড়াল প্রতীক) জানান, ভোটারদের মাঝে ভীতি তৈরি করা হয়েছে। এই ভীতি কাটিয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট প্রদান করবেন।
অপরদিকে বগুড়া-৪ আসনের ১৪ দলীয় প্রার্থী রেজাউল করিম তানসেন (মশাল প্রতীক) জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেন, এবারও মানুষ তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে এবং এই আসনের অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাপ্ত করতে চান।
স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল জুয়েল বলেন, ভোটের মাঠে পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল। সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে কেন্দ্রে আসবেন। তবে ভোটারদের মাঝে ভীতি রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বগুড়া-৪ ও ৬ আসনে আলোচিত একতারা প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম বলেন, ভোটের মাঠে ভীতি তৈরি করা হয়েছে। এই ভীতি দূর করতে হবে ভোটারদের কাছ থেকে। তাহলে ভোটাররা তাকে ভোট দিতে আসবেন। ভোটে জয়লাভ করে ভোটারদের জন্য কাজ করে যেতে চান এই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
বগুড়ার পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত পুলিশ রয়েছে। এ ছাড়া কোনো ভোটার বা প্রার্থীকে ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়ার ঘটনার সত্যতা মিললে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার তালিকা পর্যালোচনা সূত্রে জানা যায়, বগুড়ার দুটি আসনের ২৫৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১৫৮টিকেই ঝুঁকিপূর্ণ (অধিক গুরুত্বপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়া-৬ সদর আসনে ১৪৩টির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৭৯টি এবং বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনেও মোট ১১২টির মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র ৭৯টি।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে টানা পার্টির সদস্যরা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক সময় ছিঁচকে চোর ছিল। বেশি লাভের আশায় তারা পেশা বদল করে নাম লেখায় টানা পার্টিতে। বিশেষ করে তারা ঢাকায় বেশি সক্রিয়। পুলিশের তালিকায় তারা ‘কুতুব’ হিসেবেই পরিচিত। ৭২টি গ্রুপ সক্রিয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। একেকটি গ্রুপে ৮ থেকে ১০ জন করে সদস্য কাজ করছে। তারা আবার বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। টার্গেট করা লোকদের সহজেই কাবু করে ফেলতে পারছে সদস্যরা। চলন্ত যানবাহন থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান জিনিসপত্র। তবে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী পুলিশকে অবহিত করছেন না। ফলে পুলিশ থাকে অনেকটা অন্ধকারে। তবে পুলিশই নানা সোর্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে অভিযান চালায়। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে হতবাক তদন্তকারী সংস্থাও। প্রায় প্রতিদিনই লোকজনই হেনস্তার শিকার হচ্ছেন টানা পার্টির হাতে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ জোনের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, মানুষ যেমন পেশা বদল করে, ঠিক অপরাধীরাও তাদের পেশা বদল করে। ছিঁচকে চোর থেকে এখন অনেকে টানা পার্টি, বমি ও মলম পার্টিতে নাম লেখিয়েছেন। এরা সাধারণত যানজটের সময়কে বেছে নিয়ে অপকর্ম করে থাকে। বিশেষ করে যানজটে পড়া ব্যক্তিরা এ সময় বাস অথবা প্রাইভেট কারে বসে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এ সুযোগে হঠাৎ জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল নিয়ে যায়। আবার অনেক সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশার ছাদের প্লাস্টিক কেটেও গুরুত্বপূর্র্ণ মালামাল নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তারে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশ। আশা করা যাচ্ছে দ্রুতই তাদের নির্মূল করা সম্ভব হবে। একই কথা বলেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার পাশাপাশি সবকটি জেলাতেই টানা পার্টি সক্রিয় আছে। টার্মিনাল ও রেলস্টেশনকেন্দ্রিক তৎপরতা বেশি এসব চক্রের। সারা দেশে ৭২টি চক্র জড়িত। তাদের মধ্যে নাটের গুরু আছে ২৫ জন। যারা চক্রের সদস্যদের লালনপালন করে এবং কমিশন পায়। বিপদে পড়লে তারাই এদের জেল থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব নেয়। নাটের গুরুদের নামের তালিকাও উদঘাটন হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই তা প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, দুই ধরনের টানা পার্টির সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে একটি গ্রুপ ভোররাতে তৎপর থাকে। তারা প্রাইভেট কার অথবা মোটরসাইকেলে এসে রিকশা আরোহী যাত্রীদের ব্যাগ টান দিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে। আবার অন্য একটি গ্রুপ রয়েছে যারা কর্মস্থলে যাওয়া এবং বাসায় ফেরার সময়কে টার্গেট করে। যানজটের সময়ে তারা জানালা দিয়ে ছোঁ মেরে মোবাইল ও ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে যায়। এই গ্রুপটির সদস্যরাও আবার অবসর সময়ে টার্মিনাল ও স্টেশনে তৎপর থাকে। তাদের রক্ষা করার জন্য আলাদা একটি গ্রুপ সক্রিয় থাকে। কোনো কারণে বিপদের আঁচ টের পেলে তারাই সামনে হাজির হয়ে যায়। এরপর লোক দেখানো ধাওয়া দেয় টানা পার্টির সদস্যদের। আর এই ফাঁকে নিরাপদ স্থানে চলে যায় অপরাধে যুক্ত ব্যক্তিটি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ঢাকার কারওয়ান বাজার এলাকার গাড়ি চোরচক্রের সদস্য আল হাদিস ওরফে মামুন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে ছিল। কিন্তু মুক্তি পেয়ে গাড়ি চুরি ছেড়ে দিয়ে ছিনতাই আর টানা পার্টির কাজ শুরু করে। প্রতিদিন ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটে টানা পার্টির সদস্যরা নারীদের ব্যাগ, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী বাসে ওঠার মুহূর্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা পার্টির ৯৮ শতাংশ সদস্য মাদকাসক্ত। এক সময় তাদের কোনো সংঘবদ্ধ চক্র ছিল না। এলাকাভেদে কয়েকজন মিলে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে থাকত। কিন্তু সম্প্রতি চক্রের আবার দলনেতা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, গত বছর ৩১ আগস্ট রাত ১১টার দিকে উত্তরার বাসায় যাচ্ছিলেন জাপা চেয়ারম্যান গোলাম মুহাম্মদ (জিএম) কাদের। পথে বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের সামনে যানজটে পড়ে তাকে বহনকারী ব্যক্তিগত গাড়িটি। গাড়ির এসি কাজ না করায় জানালার গ্লাস খুলে রাখেন তিনি। ওই সময় তিনি ফোনে কথা বলছিলেন। আর গাড়ির খোলা জানালার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে জিএম কাদের হাতে থাকা আইফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারী। যদিও পরে ফোনটি উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। গত বছর ২৩ এপ্রিল মিরপুর-১ পাইকপাড়া ছলিমউদ্দিন মার্কেট দিয়ে রিকশা নিয়ে যাচ্ছিলেন সিকদার মোহাম্মদ রেজাউর রহমান রুমেল। রিকশার পেছনে হঠাৎ এক শিশু ওঠে। এর কয়েক মিনিট পরই দেখেন পাঞ্জাবির পকেটে নিজের মোবাইলটি নেই। রুমেল ফিরে গিয়ে তাকে আর খুঁজেও পাননি। মিরপুর মডেল থানায় ডিজি করলেও এখনো পাননি তার মোবাইল। এরকম একাধিক ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন স্থানে।
ডিএমপির একটি সূত্র জানায়, এসব ঘটনা রোধ করতেই রাজধানীতে সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেয় ডিএমপি। বিভিন্ন সময় রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েকশ সিসি ক্যামেরা বসালেও থামানো যাচ্ছে না চুরি, ছিনতাই। রাজধানীতে সম্প্রতি চুরি, ছিনতাইসহ ছোট অপরাধ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ৫০টি থানায় সিসি ক্যামেরা বসানো রয়েছে ৮৫৮টি। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সবুজবাগ, ডেমরা এবং শেরেবাংলা নগর থানায় ৩২টি করে, পল্লবী থানায় ৩০টি ক্যামেরা আছে। সবচেয়ে কম রয়েছে মতিঝিল থানা এলাকায় ১০টি, খিলগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, শাহআলী, বাড্ডা, বিমানবন্দর থানায় সিসি ক্যামেরা রয়েছে ১১টি করে। ট্রাফিক বিভাগের আটটি অঞ্চলে রয়েছে ৬৪টি সিসি ক্যামেরা।
ডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, টানা পার্টির সদস্যদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ এসব মোবাইল ফোন রাজধানীর নামিদামি মার্কেটে কম দামে বেচে দেওয়া হয়। পরে ওইসব মোবাইল ফোনের আইএমইআই পরিবর্তন করে তা আবার বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধে যুক্ত থাকার কারণে অনেক ব্যবসায়ীকেও বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপরও থামানো যাচ্ছে না চোরাই মোবাইল ফোন কেনাবেচা। তারপরও তাদের ধরতে অভিযান চলছে।
কারাবন্দি হাজতি-কয়েদিদের ডান্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরানো নিয়ে নীতিমালা প্রণয়নে কমিটি গঠন প্রশ্নে রুল দিয়েছে উচ্চ আদালত। কেন এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে না রুলে তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কারাবন্দিদের ক্ষেত্রে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরানোসংক্রান্ত কারা আইন, ১৮৯৪-এর সংশ্লিষ্ট ধারা এবং কারাবিধির সংশ্লিষ্ট বিধিগুলোর নির্বিচার ও অকারণ প্রয়োগ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, রুলে সেটিও জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট।
এ-সংক্রান্ত জনস্বার্থে একটি রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে গতকাল সোমবার বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল দেয়। চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, কারা মহাপরিদর্শক, ঢাকার জেলা প্রশাসক, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলারসহ ১০ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলেছে হাইকোর্ট।
সম্প্রতি গাজীপুর ও শরীয়তপুরে মায়ের মৃত্যুর পর বিএনপির দুই নেতাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে জানাজায় হাজির করা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে ২৬ জানুয়ারি এ রিট আবেদনটি করেন বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। আদালতে আবেদনের পক্ষে তিনি নিজেই শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ বি এম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, গত বছরের ২০ ডিসেম্বর মায়ের মৃত্যুর খবরে প্যারোলে মুক্তির পর গাজীপুরের কালিয়াকৈরের বোয়ালী ইউনিয়নের মো. আলী আজম খান ও ১৫ জানুয়ারি শরীয়তপুর সদরের সেলিম রেজাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে মায়ের জানাজায় হাজির করানো অমানবিক, নিষ্ঠুর বিবেচনায় কেন তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হবে না এ মর্মে রুল দিয়েছে আদালত।
তিনি আরও বলেন, ‘মায়ের জানাজায় অংশ নিতে দুজনকেই ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজির করা হয়। তারা কোনো তালিকাভুক্ত আসামি কিংবা সন্ত্রাসী নন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিহিংসাবশত ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ দিনের পুরনো কারাবিধি ব্যবহার করে তাদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হচ্ছে। এ ধরনের অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা আদালতে প্রতিকার চেয়েছিলাম। হাইকোর্ট রুল দিয়েছেন।’
‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পালায় না’Ñরাজশাহীতে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিগত ওয়ান-ইলেভেনের উদাহরণ টেনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘কোন দিকে পালাবেন? কোনো দিকে পালাবার পথ নেই; উত্তরে সুউচ্চ পর্বতমালা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। কোন দিকে পালাবেন? তাই বলছিÑএখনো সময় আছে আমাদের ১০ দফা দাবি মেনে নিয়ে পদত্যাগ করুন। সংসদ বাতিল করুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আসুন। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচন দিন।’ গতকাল সোমবার বেলা পৌনে ৩টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে আয়োজিত পদযাত্রার উদ্বোধনপূর্ব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে বেলা ২টা ৫০ মিনিটে যাত্রাবাড়ী থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এ সময় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ১০ দফা দাবি আদায়ে রাজধানীতে চারদিনের পদযাত্রার দ্বিতীয় দিনের পদযাত্রা শ্যামপুরের জুরাইন রেল গেটের কাছাকাছি গিয়ে শেষ হয়।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিগত ওয়ান-ইলেভেনের সময় কারা দেশ থেকে পালিয়েছিল, দেশের মানুষ সব জানে। কিন্তু পালাননি একজন, তিনি হলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সুতরাং এসব কথা বলে লাভ নেই। খালেদা জিয়া তখন পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন, বিদেশে আমার কোনো জায়গা নেই। এ দেশ আমার, এ দেশের মাটি আমার, আমি এ দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না।
এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না। পালাবেন কোন দিকে? কোনো দিকে পালাবার পথ নেই। এখনো সময় আছে, ১০ দফা দাবি মেনে নিয়ে মানে মানে পদত্যাগ করুন।’
মাগুরার দাদা বানানো হয়েছে : ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘জাতীয় সংসদ থেকে আমাদের এমপিরা পদত্যাগ করেছেন। এই আসনের সাবেক এমপি উকিল আব্দুস সাত্তার নির্বাচনে যাওয়ায় দল থেকে বহিষ্কার করেছি। তাকে জয়লাভ করানোর জন্য সমস্ত নীতি-নৈতিকতা বাদ দিয়ে আপনাদের প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। সাত্তারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আসিফকে গত তিনদিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। সমস্ত নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছেন। মাগুরার কথা বলেন। ‘মাগুরার দাদা’ বানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।’
চলমান কর্মসূচির বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আজকের এই পদযাত্রা গণতন্ত্রের জয়যাত্রা, সভ্যতার জয়যাত্রা, অধিকার আদায়ের জয়যাত্রা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার জয়যাত্রা। তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনার জয়যাত্রা।’
এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় বলেন, ‘এটা আমাদের কোনো মরণযাত্রা না। আপনারা মরলে জানাজা পড়ানোর লোক থাকে না। তাই আমরা আগাম আপনাদের জন্য শোক মিছিল করছি। ভবিষ্যতে তো আপনাদের জন্য শোক মিছিল করার কেউ থাকবে না। সুতরাং এ শোক মিছিলের মধ্য দিয়েই এই অবৈধ সরকারকে পতন করব। এই মাফিয়া সরকারের হাত থেকে এ দেশকে জনগণের হাতে তুলে দেব।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে ও রফিকুল আলম মজনুর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না প্রমুখ।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।