
জনপ্রিয় টিভি নাট্যকার, নির্মাতা ও লেখক ফেরদৌস হাসানকে রোমান্টিক গল্পের লেখক হিসেবে চেনেন পাঠক। কিন্তু এবারের বইমেলায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে দেশের সমস্যা নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস। জিনিয়াস পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার উপন্যাস ‘বাতাস পাখির মত’। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে সঠিক নেতৃত্বের অভাবে দেশপ্রেমিক অনেক মেধাবী তরুণের পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার গল্প। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি-সংস্কৃতির বিরূপ দিকগুলোতেও আলোকপাত করেছেন লেখক। এ উপন্যাস নিয়ে ফেরদৌস হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাতাস পাখির মত উপন্যাসটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া বীরদের গল্প বলা হয়েছে। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা চাইতেন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক। যেন এ দেশের সব মানুষ সমান হবে। তবে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সেই চাওয়া দানা বাঁধেনি। উল্টো সমাজ থেকে তারা হারিয়ে গেছেন।’
গল্পের মূল চরিত্র সাদকে নিয়ে লেখক আরও বলেন, ‘উপন্যাসের নায়ক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার মতো অনেক যোদ্ধা চাইতেন যেন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। যেখানে সব মানুষ সমান হবে। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তিনিসহ আরও অনেক বীর হারিয়ে গেছেন ইতিহাস থেকে।’
লেখক হিসেবে এবারের বইমেলায় তরুণ পাঠকদের অংশগ্রহণ নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করব যেন তরুণ পাঠকরা ইতিহাসের গল্প জানুক। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম তৈরি হোক। কেননা বর্তমানের তরুণরা দেশের কথা না ভেবে নিজের কথাই বেশি ভাবেন।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) নতুন ছয়টি আবাসিক হলের নির্মাণকাজ ‘প্রায় শেষ’। বছর দেড়েক ধরে এ কথা বলছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বেশ কয়েকবার হল উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখও ঘোষণা করা হয়েছে। জোর দিয়ে বলা হয়েছে, নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকৃতদের আবাসিক হলে থাকার ব্যবস্থা করা হবে। থাকবে না কোনো গণরুম (গাদাসন)।
জানা গেছে, ৪৯ ও ৫০তম ব্যাচের পর ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদেরও হলে আবাসিত করতে পারেনি প্রশাসন। গত মঙ্গলবার ক্লাস শুরু করা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদেরও জায়গা হয়েছে বিভিন্ন হলের গণরুমে। তবে তিন দিন আগে ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য নির্মিত একটি করে হল চালু করা হয়েছে। অপর্যাপ্ত সুবিধা নিয়ে চালু হওয়া ওই দুটি হলে প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীও থাকার জায়গা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু নতুন হল চালু হলেই আবাসন সংকটের নিরসন হবে না। হলগুলোর আসন নিয়ন্ত্রণ ও বণ্টনের দায়িত্ব যথাযথভাবে হল প্রশাসনকে পালন করতে হবে। হলগুলোতে কোনো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক কনোজ কান্তি রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেই হলগুলোর আসন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পারছে না, কারণ তাদের সদিচ্ছা নেই। এর পেছনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের নকশা রয়েছে। তাই প্রশাসন টেকনিক্যালি ‘গণরুম’ টিকিয়ে রাখতে চায়। অবৈধ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দিয়ে নতুনদের আসন দেওয়া প্রশাসনের জন্য কঠিন কোনো ব্যাপার নয়।
কাগজে-কলমে দেশের একমাত্র আবাসিক এই বিশ^বিদ্যালয়ে চালু থাকা ১৭টি হলে আসন রয়েছে ১০ হাজারের বেশি। বৈধ শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১২ হাজার। প্রথম বর্ষ তো বটেই, হলগুলোতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও গণরুম ও মিনি গণরুমে থাকছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের হলগুলোতে ৪৩, ৪৪ ও ৪৫তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ৪১ ও ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও হলে থাকছেন। যার ফলে এখনো আসন পাননি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এ কারণে দুদিন আগে দুই হাজার শিক্ষার্থীর নতুন হলে আবাসন হলেও পুরনো হলগুলোতে একটি আসনও নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। সেগুলোতে আবেদনের ভিত্তিতে পুরনো হলের শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পুরনো হলের ফাঁকা আসনগুলোতে ‘মিনি গণরুমে’ থাকা ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা উঠছেন। আর গণরুমে থাকা ৫০তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা উঠছেন ‘মিনি গণরুমে’। সেখানে দুজনের কক্ষে ছয় থেকে আটজন ও চার জনের কক্ষে ১৪ থেকে ১৬ জন থাকছেন। বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায়, ৫১তম ব্যাচের নবীন শিক্ষার্থীরা হলের কমন রুম, ডাইনিং রুম, রিডিং রুম, সংসদ রুম, নামাজের কক্ষ প্রভৃতি স্থানে উঠেছেন। গাদাগাদি করে থাকছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য বাকি চারটি হল চালু করা গেলে আবাসন সংকটের সুরাহা করা যাবে।
নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরুর আগেই অপর্যাপ্ত সুবিধায় কেন হল চালু করা হয়েছে এ প্রশ্নের জবাবে প্রাধ্যক্ষ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহিল কাফী দেশ রূপান্তরকে বলেন, হল দুটিতে ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের আসন দেওয়া হয়নি। যেসব শিক্ষার্থীকে নতুন হলে আসন দেওয়া হয়েছে, তাদের আগের হলের খালি হওয়া আসনে শিগগির নতুনদের বরাদ্দ দেওয়া হবে। সব কটি হল চালু হলে আর আবাসন সংকট থাকবে না।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এবার ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনেই শুরু হয়েছে বইমেলা। গতকাল বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশে বইমেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ‘পড় বই গড় দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে পুরো ভাষার মাস ধরে চলবে এ মেলা।
গতকাল বেলা ৩টায় বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মোহাম্মদ নুরুল হুদা অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
এদিন বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২’ বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রী যে সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন সেগুলো হলো শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলি, অসমাপ্ত আত্মজীবনী-পাঠ বিশ্লেষণ, আমার দেখা নয়াচীন-পাঠ বিশ্লেষণ, কারাগারের রোজনামচা-পাঠ বিশ্লেষণ, হাসান আজিজুল হকের ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’-এর ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য লেটার অব সাবিত্রী’। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আত্মজীবনী ‘আমার জীবননীতি, আমার রাজনীতি’ বইয়ের প্রথম খণ্ডের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তিনি বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি-লেখকদের হাতে তুলে দেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।
বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ১১টি বিভাগে ১৫ জনকে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০২২’ দেওয়া হয়। এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবিতায় ফারুক মাহমুদ ও তারিক সুজাত, কথাসাহিত্যে তাপস মজুমদার ও পারভেজ হোসেন, প্রবন্ধ ও গবেষণায় মাসুদুজ্জামান, অনুবাদে আলম খোরশেদ, নাটকে মিলন কান্তি দে ও ফরিদ আহমদ দুলাল, শিশুসাহিত্যে ধ্রুব এষ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় মুহাম্মদ শামসুল হক, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় সুভাষ সিংহ রায়, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশ বিজ্ঞানে মোকারম হোসেন, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনীতে ইকতিয়ার চৌধুরী, ফোকলোরে আবদুল খালেক ও মুহম্মদ আবদুল জলিল।
প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিকতা শেষে মেলা প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সবার জন্য। প্রথম দিনেই দর্শনার্থী পাঠকের ঢল নামলেও মেলার মাঠ ছিল অনেকটাই অগোছালো। অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তাদের স্টল বা প্যাভিলিয়ন গোছানোর কাজ শেষ করতে পারেনি। এখনো স্টলে তুলতে পারেনি নতুন বই। গতকাল তাই বই বিক্রি হয়েছে খুবই কম।
এদিকে এবার বইমেলা সুবিশাল বিস্তৃতি নিয়ে হলেও আঙ্গিকগত কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। বইয়ের সব প্যাভিলিয়ন ও স্টল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমির মূল অংশেই থাকছে। আর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অংশে থাকছে সব খাবারের দোকান, নামাজের স্থান, টয়লেট।
এবারের মেলায় ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৯০১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি মাঠে ১১২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬৫টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৮৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৩৬টি স্টল বরাদ্দ দিয়েছে কর্র্তৃপক্ষ। তাছাড়া এ বছর মোট ৩৮টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছর ৫৩৪টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৭৪টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
এ ছাড়া লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে ১৫৩টি স্টল রয়েছে, যা ২০২২ সালে ছিল ১২৭টি, ২০২১ সালে ১৪০টি এবং ২০২০ সালে ১৫৫টি। অন্যদিকে যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বইমেলার ভেন্যু ও এর আশপাশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মেলার ১১ লাখ বর্গফুটের প্রতিটি জায়গা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় রাখা হয়েছে।
বাংলা একাডেমির পরিচালক এবং অমর একুশে বইমেলা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। তবে দর্শক, ক্রেতা ও পাঠকরা রাত সাড়ে ৮টার পর মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতে পারবেন না। সরকারি ছুটির দিনে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। দুপুরে খাবার ও নামাজের জন্য এক ঘণ্টা বিরতি থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ঋদিতা রহমান। থাকেন শামসুন্নাহার হলে। বন্ধুদের নিয়ে এসেছেন বইমেলার প্রথম দিনেই। বন্ধুদের সঙ্গে অবশ্য ছেলেবন্ধুও আছেন।
ঋদিতা ও তার দল এসেছে প্রিয় লেখকদের বইয়ের খোঁজ নিতে। তিনি জানান, লেখক হিসেবে ছোটবেলা থেকেই জাফর ইকবাল ও হুমায়ূন আহমেদের লেখা পছন্দ করেন তিনি। এই দুই লেখকের সব বই একাধিকবার করে পড়েছেন। প্রথম দিনের মেলা কেমন লাগল জানতে চাইলে ঋদিতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এবারের বইমেলা অনেকটা অগোছালো মনে হচ্ছে। মেলা শুরু হলেও এখনো আবর্জনায় চারদিকটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তবে আমার প্রত্যাশা থাকবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন পরিবেশবান্ধব পাঠক-লেখকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় মেলা।’
পাঠক হিসেবে পছন্দের লেখকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছোট থেকে জাফর ইকবালকে অনেক বেশি পছন্দ করতাম। কারণ, তিনি ছোটদের জন্য বই লিখতেন। উল্লেখযোগ্যভাবে টুনটুনি, আমিও তপু সিরিজগুলো পড়ে বড় হয়েছি। এ ছাড়া হুমায়ূন আহমেদের যে প্রেমের গল্পগুলো ছিল, সেগুলো অনেক ভালো লাগত।’
ঋদিতা আরও বলেন, ‘সমাজ পরিবর্তন করার জন্য বই হতে পারে আমাদের প্রধান অনুষঙ্গ। করোনার পরবর্তী সময়ে এবার পূর্ণাঙ্গ বইমেলায় আমার খুব ভালো লাগছে। আমি চাইব সমাজ থেকে মাদক দূর করতে। এ ক্ষেত্রে বই হতে পারে প্রধান হাতিয়ার। মাদকাক্তরা যদি বইয়ের প্রেমে পড়েন, তাহলে সমাজ তাদের মাদকাসক্ত নয়, বই-আসক্ত বলে নতুন জীবন উপহার দেবে।’
ঋদিতা জানান, মেলায় টয়লেট সেবা আরও উন্নত করা দরকার, টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হলে তার ও তার বন্ধুদের আরও ভালো লাগত।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ একটি উচ্চ রেমিট্যান্সপ্রাপ্ত দেশ। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারীর পরও ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এ ছাড়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে প্রায় ১০ হাজার ৪৯৩ দশমিক ২৬ মিলিয়ন (১০.৪৯২ বি.) ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।
গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রী টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তরে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য (এমপি) রুস্তম আলী ফরাজীর প্রশ্নের লিখিত জবাবে এ তথ্য জানান।
প্রধানমন্ত্রী জানান, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। যার মধ্যে অধিক কর্মী পাঠানো, বৈধভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানো অন্যতম। আর বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। সরকার ইতিমধ্যে প্রণোদনার বিষয়টি ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশে এ উন্নীত করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে রেমিট্যান্সের কোনো বিকল্প নেই এবং তা আনতে হবে বৈধপথে। নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান, বিদ্যমান বাজার সংহত করা এবং সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলো আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
২০২২ সালে বিদেশ গেছে ১১ লাখ ১৩ হাজার ৩৭৪ জন : সরকারি দলের এমপি কাজিম উদ্দিন আহম্মেদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, সরকারের নেওয়া বেশ কিছু পদক্ষেপের ফলে ২০২২ সালে রেকর্ডসংখ্যক ১১ লাখ ১৩ হাজার ৩৭৪ কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে নারীকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৫ হাজার ৪৬৬ জন। এ ছাড়াও সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) মাধ্যমে ২০২২ সালে ৬১৫ জন পেশাজীবী এবং ১৭ হাজার ৯৭৮ জন দক্ষকর্মীসহ ১৮ হাজার ৫৯৩ জন কর্মী বৈদেশিক কর্মসংস্থান লাভ করেছে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ১৬৮টি দেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি করা হচ্ছে। কিন্তু সরকার মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক শ্রমবাজারনির্ভরতা কমাতে চায়। সে জন্য পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার নতুন কিছু দেশে শ্রমিক রপ্তানির চেষ্টা চলছে। আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রতি উপজেলা থেকে গড়ে বছরে এক হাজার কর্মী পাঠানোর জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
সরকারি দলের এমপি বেনজির আহমেদের আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে মোট খাদ্যশস্য উৎপন্ন হতো ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার টন, তা ২০২১-২২ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৯৬ হাজার টন। বর্তমানে ৭০টির বেশি দেশে সবজি ও ফল রপ্তানি হচ্ছে এবং কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আমরা ১০০ কোটি ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে গেছি।
তিনি বলেন, বর্তমান বাংলাদেশ বিশ্ব চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে, সবজি ও পেঁয়াজে তৃতীয় স্থানে, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম স্থানে উন্নীত হয়েছে।
সাগরের পানি থেকে হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা চলছে : সরকারদলীয় এমপি আনোয়ার হোসেন খানের প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, সাগরের পানি থেকে হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। সাগরের পানি থেকে হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ উৎপাদন নতুন ধারণা উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, এ বিষয়ে যেসব কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যদি সম্ভব হয় তাহলে মাতারবাড়ী, মহেশখালী বা বাঁশখালীতে হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বের কোন কোন দেশে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা ব্যয়সাপেক্ষ এবং তা বাণিজ্যিকভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে নেই।
সাগরের পানি থেকে হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ উৎপাদন খুবই ব্যয়সাপেক্ষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের খরচ কমে এলে বঙ্গোপসাগরের জোয়ার-ভাটাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রধানমন্ত্রীর : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় সংসদ ভবনে তার অফিস কক্ষে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাক্ষাৎকালে প্রধানমন্ত্রী দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকারের গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন।
রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, রাষ্ট্রপতি হামিদ একুশে বইমেলায় তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার জীবননীতি, আমার রাজনীতি’-এর মোড়ক উন্মোচন করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। রাষ্ট্রপতির অফিস কক্ষে প্রায় ঘণ্টাখানেক অবস্থান করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় রাষ্ট্রপতির সংশ্লিষ্ট সচিবরা উপস্থিত ছিলেন।
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। প্রিয় নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলাবাসী। মুসলমানদের ভাই ও বোনদের প্রতি রইল সালাম। আসসালামু আলাইকুম। সনাতন ধর্মাবলম্বী দাদা ও দিদিমণিদের প্রতি রইল আদাব। আপনাদের সকলের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি আবদুুল হাই মাস্টার, সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ভূরুঙ্গামারী, আপনাদের সকলকে সেবা দেয়ার লক্ষ্যে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুড়িগ্রাম-১ আসনে নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী নির্বাচনী এলাকায় জাকের পার্টির গোলাপ ফুল মার্কা নিয়ে নির্বাচন করতে যাচ্ছি।’
এখনো প্রায় বছরখানেক বাকি থাকলেও এভাবেই বাইসাইকেলে চেপে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে হ্যান্ড মাইকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে নিজের প্রচারণা চালাচ্ছেন কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই মাস্টার। যিনি এলাকার লোকজনের কাছে ‘ভোটপাগল আবদুল হাই মাস্টার’ নামে পরিচিত।
তার বাইসাইকেলে রয়েছে একটি কাপড়ের ব্যাগ। যে ব্যাগের ভেতর আছে নিজের পরার কাপড়চোপড়সহ প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস। প্রচার করতে করতে যেখানে রাত হচ্ছে সেখানেই কোনো বাড়িতে রাতযাপন করে পরদিন সকালে ফের প্রচারণায় নামছেন।
নির্বাচনপাগল এই আবদুল হাই মাস্টার ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে চারবার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে চারবার এবং জাতীয় সংসদ সদস্য পদে আরও চারবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এর মধ্যে একবার তিনি বঙ্গসোনাহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং ২০০৯ সালে ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন এলাকার সাধারণ মানুষ নগদ টাকা এবং বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল-মুড়ি তুলে তা তাকে দিয়ে সহায়তা করেছিল। আর নির্বাচিত হওয়ার পর বেশিরভাগ সময় নিজের নির্বাচনী এলাকার নর্দমা পরিষ্কার ও রাস্তাঘাট ঝাড়– দেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন হাই মাস্টার। উপজেলা চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নর্দমার ভেতরে নেমে তার ময়লা পরিষ্কার করার খবর পেয়ে দেশের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি টিম হাজির হয় ভূরুঙ্গামারীতে। তখন তাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচারিত হয় ইত্যাদিতে।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হাই মাস্টার পেশাগত জীবনে স্কুলশিক্ষক ছিলেন। গত বছর অক্টোবরে তিনি চরভূরুঙ্গামারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসরে যান।
উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে প্রচারণার সময় আবদুল হাই মাস্টারকে হ্যান্ড মাইকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আপনাদের সকলের দোয়া ও সমর্থন কামনা করছি। এবং সেই সাথে আরও অনুরোধ জানাচ্ছি যে, দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আপনারা সকলেই আমার, আমি সবার। এই চেতনায় আমি আবদুল হাই মাস্টার আপনাদের সকলের নিকট গোলাপ ফুল মার্কায় একটি করে ভোট চাই। আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্নেহের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অনুরোধ জানাই মহান জাতীয় সংসদে কথা বলতে চাই আমি আবদুল হাই মাস্টার। সেই জন্য গোলাপ ফুল মার্কায় একটি করে ভোট চাই।’
নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাকের পার্টির প্রার্থী হিসেবে কুড়িগ্রাম-১ আসনে (নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবারও জাকের পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। জাকের পার্টির মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
আবদুল হাই মাস্টার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইউপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সাধ্যমতো মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ পদে ক্ষমতা সীমিত। তাই সংসদ সদস্য হিসেবে এলাকার উন্নয়ন করতে চাই। নির্বাচিত হলে এলাকার নদী ভাঙন রোধ, বেকারত্ব সমস্যার সমাধান এবং বেসরকারি শিক্ষকরা যাতে সহজে পেনশনের টাকা উত্তোলন করতে পারেন সে ব্যাপারে অগ্রাধিকার দেব।’
গত ১৮ জানুয়ারি থেকে প্রচারণার কাজ শুরু করেছেন এবং প্রতিটি এলাকায় সাধারণ মানুষের বিপুল সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে আবদুল হাই মাস্টার বলেন, ‘আমি লক্ষণ দেখতে পেয়েছি, আল্লাহ এবার আমাকে এমপি বানাবে।’
তার প্রচারণার বক্তব্য শুনতে জড়ো হওয়া সাইফুর রহমান, বিপ্লব, শহিদুল ও রাসেল বলেন, ‘হাই মাস্টার অত্যন্ত সহজ-সরল ভালো মানুষ। এলাকার লোক হিসেবে আমরা তাকে ভোট দেব।’
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) হলের আসন দখল করে রাখার বিরুদ্ধে অনশনরত ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম প্রত্যয়সহ তাকে সমর্থন দেওয়া কয়েকজনের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।তারা বলেন, ওই স্থানে গত বুধবার রাত থেকে অনশনে ছিলেন প্রত্যয়। তাকে মারধরের পর অ্যাম্বুলেন্সে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায় হামলায় জড়িতরা। এ সময় প্রত্যয়ের দাবির সঙ্গে সংহতি জানানো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের ওপরও হামলা হয়।
জানা গেছে, তিন দাবিতে গত বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনের খেলার মাঠে অনশনে বসেন প্রত্যয়। তিনি ওই হলের আবাসিক ছাত্র। তার অন্য দুটি দাবি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করা ও হলের গণরুমে অবস্থান করা বৈধ ছাত্রদের আসন নিশ্চিত করা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর মোশাররফ হোসেন হলের সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং নবীন শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছিলেন। ওই সময় ক্যাম্পাসে লোডশেডিং চলছিল। হঠাৎ করেই প্রত্যয়সহ তার সঙ্গে থাকা অন্যদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
হামলায় জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী, মার্কেটিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের সৃষ্টি, চারুকলা বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের মনিকা, বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৪৮তম ব্যাচের সুরসহ আরও কয়েকজন আহত হন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, হামলায় ৩০ থেকে ৪০ জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। অভিযুক্তদের কয়েকজন হলেন ছাত্রলীগ নেতা ও রসায়ন বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী গৌতম কুমার দাস, তুষার, ফেরদৌস, নোবেল, গোলাম রাব্বি, মুরসালিন, মুরাদ, সোহেল, তানভীর, রায়হান, রাহাত, সৌমিক, তারেক মীর, সজীব ও নাফিস।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, আমরা যারা প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিলাম তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর প্রত্যয়কে দেখতে চিকিৎসক এসেছিলেন। তখন তারা অ্যাম্বুলেন্সের ওপর হামলা করে সেটি ফিরিয়ে দেয়। প্রক্টরকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি আসেননি। একাধিক ছাত্রীর দিকেও চড়াও হয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থী অসুস্থ এমন একটি ফোনকল পেয়ে তারা অ্যাম্বুলেন্স পাঠায়। তবে কে কল দিয়েছিল সে সম্পর্কে চিকিৎসা কেন্দ্রের কেউ বলতে পারেননি।
তবে যে ফোন নাম্বার থেকে কল দেওয়া হয়েছিল সেটিতে যোগাযোগ করে দেখা যায় নাম্বারটি শাখা ছাত্রলীগের নেতা গৌতম কুমার দাসের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ১৫ হাজার শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। দরকার হলে আমি পদত্যাগ করব।
এদিকে হামলার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মিছিল নিয়ে তারা এ রাত পৌনে ১টায় প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান করছেন।
তবে অনশনরত শিক্ষার্থী সামিউলের ওপর হামলারে পেছনে ছাত্রলীগের কোনো হাত নেই বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেলের। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা হয়েছে। তবে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করেছে। সেখানে ছাত্রলীগের একজনও জড়িত নয়।’
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।