
ডাকাতের উৎপাত বেড়ে যাওয়ায় চিন্তায় পড়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। সম্প্রতি ঢাকাসহ সারা দেশেই ডাকাতি বেড়েছে। প্রায় দিনেই বাসাবাড়ি ও যানবাহনে ডাকাতি হচ্ছে। বিশেষ করে যাত্রীবাহী বাসে। তারা যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে নিচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাসের চালকরা ও হেলপাররা এ কাজে জড়িত বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
ডাকাতদের কোনো তালিকা নেই পুলিশের কাছে। তালিকা করার জন্য পুলিশ সদর দপ্তর বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ছবিসহ ডাকাত দলের সদস্যদের ডেটাবেজ করতে পুলিশের সবকটি ইউনিট ও জেলা পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কাজও শুরু করে দিয়েছে বলে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
পুলিশসংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানায়, বিভিন্ন সময়ে ডাকাতির কারণে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদেরই ডেটাবেজের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এ জন্য মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, জেলা পুলিশ সুপার ও হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। ঢাকা রেঞ্জ পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ এ বিষয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। ঢাকা রেঞ্জেই ডাকাতির ঘটনা বেশি ঘটে। এরপর রয়েছে খুলনা ও সিলেট রেঞ্জ। পিছিয়ে নেই চট্টগ্রাম রেঞ্জও।
গত ১৩ মাসে ঢাকা জেলায় ৪৬টি ডাকাতির মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছে ২৩২ জন। তাদের ৯২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। গতকাল ডিএমপির ক্রাইম কনফারেন্সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মল্লিক ফখরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে জনগণের চলাচল ও জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নতি করার পাশাপাশি সারা দেশে ৮০টি বিশেষ প্যাট্রল ডিউটির ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে ছিনতাই, দস্যুতা ও ডাকাতি প্রতিরোধে যৌথ অভিযান অব্যাহত আছে। এটা আরও জোরালো করা হবে।
তিনি বলেন, হাইওয়ে পুলিশের পাঁচটি রিজিয়নের ৫৪টি স্থানে পুলিশ যাত্রীবাহী বাসের ভিডিও ধারণ করছে। চালক ও হেলপারদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ ও মহাসড়কসংলগ্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মহাসড়কে যারা ডাকাতিতে সম্পৃক্ত তাদের তালিকা করার পাশাপাশি পেশাদার ডাকাতদের ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা হাইওয়েতেই ঘটছে।
সূত্র জানায়, সারা দেশে হাইওয়ে পুলিশের ৭৩টি থানা ও ফাঁড়ির মাধ্যমে একটি প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। গোপনে ডাকাতদের অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে তাদের বাড়িতেও। ইনকোয়ারি সিøপের মাধ্যমে ডাকাতদের তথ্য জানার চেষ্টা চলছে। তাদের ছবিও জোগাড় করা হচ্ছে। ডাকাতরা কারাগারে না বাইরে তাও থাকবে ডেটাবেজে। ডাকাতি রোধে বাসের মালিক ও শ্রমিকদের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। স্টপেজের বাইরে যাতে যাত্রী তোলা না হয় সে জন্য কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত রুটের বাইরে যাতে কোনো বাস চলাচল না করে তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে বলা হয়েছে। কারণ জামিনে বেরিয়ে আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে ডাকাত দলের সদস্যরা।
সূত্র জানায়, দূরপাল্লার গাড়িতে ডেস্ক ক্যামেরা স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ওই ক্যামেরার মাধ্যমে গাড়ির যাত্রীদের মনিটরিং করা হবে। সেখানে একটি বিশেষ ডিভাইস থাকবে যেটি ৯৯৯ নম্বরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। গাড়িটি কোনো বিপদে পড়লে ওই ডিভাইসে চাপ দিলেই সংকেত চলে যাবে ৯৯৯-এ। তখন স্থানীয় থানা বিপদেপড়া গাড়ির বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে। ওই ডিভাইসের মাধ্যমে গাড়ির অবস্থানও নির্ণয় করা যাবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি মেট্রোপলিটান ও রেঞ্জে ডাকাতদের সচিত্র ডেটাবেজ সংরক্ষণ করা হবে। কোনো ডাকাত জামিনে মুক্তি পেলে তার বিষয়ে সব ইউনিটকে বার্তা পাঠানো হবে। ডাকাতদের গতিবিধি নজরে রাখা হবেও সূত্র জানিয়েছে।
ডাকাতরা কখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে আবার কখনো সরাসরি ডাকাতির ঘটনা ঘটাচ্ছে। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই থানায় মামলা করে না। বিপুল অঙ্কের টাকা বা স্বর্ণালংকার ডাকাতির ঘটনায় শুধু মামলা হয়। আর ডাকাতির শিকার বেশিরভাগ লোক ছিনিয়ে নেওয়া মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ হারানোর জিডি করে। ফলে ডাকাতির প্রকৃত সংখ্যা জানা যায় না। সর্বশেষ গত রবিবার রাতে গাজীপুর-খুলনা রুটের রিসাত পরিবহনের একটি বাসে নৃশংস ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর আশুলিয়া থানার নবীনগর পুলিশ ফাঁড়িতে জিডি করে পরিবহন কর্তৃপক্ষ। আর কয়েকজন মোবাইল ফোন হারানোর জিডি করেছেন।
ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মাশরুকুর রহমান বলেন, ‘পেশাদার ডাকাতদের একটা ডেটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৬১ ও ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদের তথ্য যাচাই করে ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এতে মহাসড়ক ও বাসাবাড়িতে ডাকাতি রোধ করা সম্ভব হবে। স্পর্শকাতর বা ডাকাতিপ্রবণ এলাকায় বসানো হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা।’
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডাকাতি বেশি হচ্ছে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায়। আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই, নবাবগঞ্জ ও দোহার থানায়ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ঢাকা রেঞ্জের শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা জেলা ও টাঙ্গাইলে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সিলেট রেঞ্জের হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার কিছু এলাকায় ডাকাতি হয় বলে পুলিশের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। খুলনা রেঞ্জের ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের পিরোজপুর, মেহেরপুরের কিছু এলাকা ও খুলনার ফুলতলা এলাকা ডাকাতিপ্রবণ। চট্টগ্রাম রেঞ্জের মধ্যে রয়েছে চকরিয়া ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন গ্রাম যেখানে মহাসড়কে গাছ ফেলে ডাকাতির ঘটনা রয়েছে। এসব এলাকায় বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার ডাকাতদের নাম ডেটাবেজে রাখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঢাকা রেঞ্জের ধামরাই, আশুলিয়া এবং শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলার কিছু এলাকায় ডাকাতরা নৌপথে ডাকাতি করে। এ কারণে নৌপুলিশকে আরও সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে। ডাকাতির ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমাদের কাছে পেশাদার ডাকাতদের তালিকা নেই। এ জন্য সম্প্রতি সব মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনার, হাইওয়ে পুলিশপ্রধান ও জেলা এসপিদের তালিকা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সব তালিকা পাওয়ার পর ডেটাবেজ করা হবে। পুলিশ সদর দপ্তর বিষয়গুলোর সার্বিক মনিটরিং করবে। বাসচালক ও হেলপাররা ডাকাতির কাজে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে তাদের তালিকা হয়েছে। পরিবহন নেতাদের সঙ্গে আমরা কথা বলব।
ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস কোড বা আইএমডিজি কোড ঠিকমতো অনুসরণ না করা, ফায়ার লাইসেন্স হালনাগাদ না করা প্রভৃতি ত্রুটির কারণে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলোতে (অফডক) বিপজ্জনক পণ্য ও রাসায়নিক পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বা অক্সিডল বা পারহাইড্রল বা সুপারঅক্সল (এইচটুওটু) রপ্তানি নিয়ে বিপাকে পড়েছে ছয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সচিব রুহুল আমিন সিকদার বিপ্লব দেশ রূপান্তরকে জানান, একসময় ছয়-সাতটি ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড হ্যান্ডলিং ও প্রক্রিয়াকরণ করা হতো। গত বছর ৪ জুন রাতে সীতাকু-ে বিএম কনটেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের কনটেইনারে বিস্ফোরণ ও আগুনের ঘটনার পর অন্য ডিপোগুলোতেও এ জাতীয় পণ্যের হ্যান্ডলিং বন্ধ থাকে। পরে সিসিটিএল নামের ডিপোকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড হ্যান্ডলিংয়ের অনুমতি দেওয়া হলেও কয়েক দিন আগে তা স্থগিত করে কাস্টম হাউজ। এখন কোনো অফডকেই হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে না।
কাস্টমস সূত্র জানায়, বিপজ্জনক পণ্য (ডেঞ্জারাস গুডস) ও রাসায়নিক পণ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনের ক্ষেত্রে আইএমডিজি নীতিমালা অনুসরণ না করা, ফায়ার লাইসেন্স হালনাগাদ না থাকা, আমদানি-রপ্তানির জন্য প্রক্রিয়াকৃত কনটেইনার একসঙ্গে সংরক্ষণের কারণে ঝুঁকি বিবেচনা করে চিটাগাং কনটেইনার ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিটিএল) বিপজ্জনক ও রাসায়নিক পণ্য সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ স্থগিত করেছে।
সিসিটিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে পাঠানো কাস্টমসের চিঠিতে বলা হয়, ওই ডিপোতে ডিজি কার্গো হ্যান্ডলিং সংক্রান্ত অনুশাসন ঠিকমতো মানা হচ্ছে না। সেখানে নির্দিষ্ট ডিজি জোন বা শেড নির্দিষ্ট করা নেই। আমদানি-রপ্তানির পণ্যের কনটেইনার ও রাসায়নিকের কনটেইনার যত্রতত্র একসঙ্গে রাখা হচ্ছে। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, লিকুইড ক্লোরিন, কস্টিক সোডা ও ব্যাটারি জাতীয় বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে না। যথাযথ ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার না করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে শ্রমিক দিয়ে কনটেইনার লোড করা হচ্ছে। এটা বিপজ্জনক ও বিধিবদ্ধ অনুশাসনের পরিপন্থী কাজ। ডিপোতে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে তা মোকাবিলার প্রস্তুতি ও সক্ষমতা কোনোটাই নেই। ফায়ার লাইসেন্সের মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
সিসিটিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু বক্কর কাস্টমসের চিঠির কথা নিশ্চিত করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমতির ভিত্তিতে আমরা এতদিন ডেঞ্জারাস গুডস ও রাসায়নিক পণ্য হ্যান্ডলিং করেছি। এখন কাস্টমসই বলছে ডিজি গুডস ও রাসায়নিক সংরক্ষণ কার্যক্রম স্থগিত রাখতে। চিঠি পাওয়ার পর আমরা এসব পণ্য হ্যান্ডলিং করছি না।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানি করে থাকে। এগুলো হচ্ছে আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, এসএম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড, ইনফেনিয়া কেমিক্যাল ও তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স। তারা উৎপাদিত পণ্য ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করে। সিসিটিএলে বিপজ্জনক পণ্য হ্যান্ডলিং স্থগিত করার পর বিপাকে পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।
আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের নির্বাহী পরিচালক মাইনুল আহসান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাছে দুই হাজার টন পণ্যের রপ্তানি-আদেশ রয়েছে। ৮০ টন পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ শেষে কনটেইনার ভর্তি করা হয়েছে। এসব পণ্যের রপ্তানিমূল্য প্রায় ৩০ হাজার ডলার। এ অবস্থায় ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রাখা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমাদের রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে। যথাসময়ে রপ্তানি করা না গেলে আমরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ব।’
সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্সের মহাব্যবস্থাপক আকরাম উজ জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানিতে আমরা ভালো অবস্থান তৈরি করতে পেরেছি। ২০২২ সালে আমরা ৩৮ হাজার টন পণ্য রপ্তানি করেছি। আমাদের হাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রপ্তানি-আদেশ আছে। কিন্তু অফডকগুলোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড হ্যান্ডলিং বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব পণ্যের রপ্তানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’
বেসরকারি কনটেইনার ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার চেয়ারম্যান নুরুল কাইয়ূম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ডিপোগুলোতে ডেঞ্জারাস গুডস হ্যান্ডলিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যে যার মতো কাস্টমসের অনুমতি নিয়ে এ জাতীয় পণ্য হ্যান্ডলিং করছিল। বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তার প্রশ্ন সামনে আসায় কোনো কোনো ডিপো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড হ্যান্ডলিং বন্ধ করে দিয়েছে। সিসিটিএলে এতদিন এ কার্যক্রম চললেও কাস্টমস তা স্থগিত রাখার নির্দেশ দিয়েছে। ফলে একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হুমকির মুখে পড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে দ্রুত নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন। ওই নীতিমালা মেনে যারা ডিজি কার্গো হ্যান্ডলিং করতে চায়, তাদের সুযোগ দেওয়া উচিত।’
এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগি ও মুরগির ডিমের দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আর এক মাসের হিসাবে ভোক্তা পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে কেজিতে ৭০ টাকা। সোনালি মুরগির দাম বেড়েছে ৯০ টাকা। ফার্মের মুরগির প্রতি হালি লাল ডিম বেড়েছে ৬ থেকে ৮ টাকা।
শীতকালীন সবজির দাম কিছুটা ওঠা-নামা করছে। এক মাসের ব্যবধানে শীতকালীন সবজির দাম পাইকারি বাজারে কেজিতে ৭-২০ টাকা কমলেও ভোক্তা পর্যায়ে কমেছে ৫-১০ টাকা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, নিউ ইস্কাটন, ইস্কাটন গার্ডেন, শান্তিনগর, হাতিরপুল বাজার এলাকার পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ী, মুদি দোকানি ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতি, মহানগর হাঁস-মুরগি বাজারজাতকরণ সমবায় সমিতি লিমিটেড ও কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা দাবি করেন, মুরগি ও মুরগির ডিমের দাম বৃদ্ধিতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাত নেই। দেশের বড় ব্যবসায়ীরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের সারা দেশে প্রতিনিধি আছে। তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। চাহিদা বাড়লেই দাম বাড়িয়ে দেয়। চাহিদা কম থাকলে দাম কমিয়ে ডিম-মুরগি বিক্রি করে। তাদের নির্ধারিত দাম ক্ষুদ্র খামারিরা ডিলারের মাধ্যমে জেনে যায়।
খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে
বাজারভেদে ১৫০-১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এসে বিক্রি হয় কেজিপ্রতি ২০০-২৪০ টাকায়। ২৬০ টাকার সোনালি মুরগি বিক্রি হয় ৩৫০ টাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৫ জানুয়ারি পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতি ১০০ মুরগির ডিম ৯১০ টাকায় খামারিদের থেকে সংগ্রহ করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে ৯৩০ টাকা বিক্রি করেন। এক মাসের ব্যবধানে সেটা গতকাল ১ হাজার ৫০ টাকায় কিনে ১ হাজার ৭০ টাকায় বিক্রি করেছেন। প্রতি ১০০ ডিমে পাইকারিতে দাম বেড়েছে ১৪০ টাকা। খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতি পিস ডিম ১০ টাকা ৭০ পয়সা দিয়ে কিনে ভোক্তার কাছে ১২ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করছে। অর্থাৎ ১ হালি ডিম ভোক্তার ৫০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে, যা এক মাস আগেও তারা ৪২ থেকে ৪৪ টাকায় কিনেছেন।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী আল আমিন ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আল আমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিমের দাম কমে গেলে আমাদেরও মাঝেমধ্যে লস (লোকসান) দিতে হয়। কিছু নির্দিষ্ট কাস্টমার আছে যাদের ডিম বাকিতে দিয়ে থাকি, তারা কিছু বেশি টাকায় ডিম কিনে নিয়ে যায়। বাকিতে ডিম নিয়ে তারাও ক্রেতাদের কাছে ডিম বেশি দরে বিক্রি করেন। যারা ভোক্তাদের কাছে ডিম বিক্রি করছেন তাদের যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে ডিমের দাম আরও কমে পেত ভোক্তারা।’
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি আমান উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রমজান মাসের আগে ডিমের দাম কমার সুযোগ নেই। রোজা শুরু হলে ডিমের চাহিদা কম থাকবে। তখন ডিমের দাম কমবে। রোজার ঈদ শেষ হলে আবারও ডিমের বাজার বাড়বে।’
মুরগি ব্যবসায়ী হেলাল মিয়া বলেন, ‘গত ১৫ দিনে সোনালি মুরগির দাম বেড়েছে ৭০-৮০ টাকা। দেশি মুরগির দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০০ টাকার বেশি। এখন তেজগাঁও বাজারে মুরগিও আসছে কম। আমাদের কাছে থেকে কিনে যারা বিক্রি করছে তারা কেজিপ্রতি ৫০-৬০ টাকা লাভে বিক্রি করছে।’
কারওয়ান বাজারে গতকাল মানভেদে প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হয়েছে ১৫-৪০, লম্বা বেগুন ২০-৪০, ফুলকপি ও বাঁধাকপি আকারে ছোট একটি ১০-১৫, বড় আকারের কপি ১৫-২৫, আলু প্রতি কেজি ২০-৩০, মিষ্টিকুমড়া একটি ৪০-৫০, লাউ আকারভেদে প্রতিটি ৪০-৬৫, প্রতি কেজি মুলা ২০-৩০, জাতভেদে শিম ২০-৩৫, কাঁচকলা প্রতি হালি ১৫-২০, শসা কেজি ৩০-৫০ টাকা। গরুর মাংস ৭০০, খাসির মাংস ৮০০-১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কারওয়ান বাজারে কথা হয় শেখ ফরিদ নামে এক ক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাজারে মুরগি, মুরগির ডিম ও মাছের দাম বাড়তি। শাক-সবজির দাম বিছুটা কম। দেড় কেজি গরু মাংস কিনেছি ৭০০ টাকা দরে। ১৫ দিন আগেও সেটা ২০ টাকা কম ছিল।’
আমির হোসেন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘নিউ ইস্কাটন বাজারে সোনালি মুরগি ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এভাবে যদি মুরগির দামও বাড়তে থাকে, তাহলে মাংস কিনে খাওয়া খুবই কঠিন হয়ে যাবে।’
তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের আঘাতে মৃত্যু ৪২ হাজার ছুঁইছুঁই করছে। গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তুরস্কে মারা গেছে ৩৬ হাজার ১৮৭ জন। আর সিরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ জনের। লাখো আহতের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি অনেকের অবস্থাই সংকটাপন্ন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে এখনো অনেকে। তবে উদ্ধার কাজ গুটিয়ে আসছে। বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব উদ্ধারকর্মীরা তুরস্কে গিয়েছিলেন তারা নিজ নিজ দেশে ফিরতে শুরু করেছেন।
আল-জাজিরা বলছে, যারা বেঁচে গেছেন তাদের প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে গৃহহীন অবস্থা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। তবে তুরস্ক সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো ভেঙে ফেলে পুনর্নির্মাণকাজ শুরু করা হবে। তবে সিরিয়ায় ত্রাণ পাঠাতে আন্তর্জাতিক মহল দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ায় সেখানে নতুন করে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। সেখানে আগে মানুষের জন্য খাদ্য ও ওষুধপথ্য জরুরি।
তুরস্কের দক্ষিণের হাতাই প্রদেশের প্রায় অর্ধেক ভবন হয় ভূমিকম্পে ধসে গেছে অথবা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে সেগুলো আর বসবাসের উপযোগী নেই। তুরস্ক সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ওই ভবনগুলো দ্রুত ভেঙে ফেলে পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু করার কথা বলেছে। দেশটির পরিবেশ ও নগরায়ণমন্ত্রী মুরাত কুরুম এক টুইটে বলেন, যেসব ভবন ভাঙা প্রয়োজনে আমরা দ্রুতই সেগুলো ভেঙে ফেলে নিরাপদ বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করব। এদিকে তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকেও নিজ নিজ বাড়িতে ফিরতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। তবে কর্র্তৃপক্ষ তাদের বাড়িকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করে সেক্ষেত্রে তারা বাড়ি ফিরতে পারবেন।
তুরস্কের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে প্রতিবেশী সিরিয়ায়। দীর্ঘ ১১ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটি আগেই ধ্বংস হয়েছিল। এখন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে ভূমিকম্প। গৃহযুদ্ধে দেশটি দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিরিয়ার বেশির ভাগ অংশ প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বাহিনীর দখলে থাকলেও একটি অংশ এখনো বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে আন্তর্জাতিক মহলকে সেখানে ত্রাণ পাঠাতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে তুরস্কের সঙ্গে একটিমাত্র সীমান্ত দিয়ে সিরিয়ায় ত্রাণ যাচ্ছিল। কিন্তু ত্রাণ কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না অভিযোগ তুলে কয়েক দিন ধরে জাতিসংঘ সেখানে ত্রাণ পাঠানো বন্ধ রেখেছে।
রয়টার্স জানায়, ভূমিকম্পের আট দিন পর মঙ্গলবার ত্রাণ প্রবেশে দ্বিতীয় আরেকটি সীমান্ত খোলার অনুমতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আসাদ।
সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অংশে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছে দাতব্য সংস্থা হোয়াইট হেলমেট। সেখানকার প্রধান রাইদ সালেহ বলেন, আমাদের সঙ্গে কী ঘটছে ... বিশ্বে এই প্রথম এমনটা হচ্ছে। কোথাও ভয়ংকর ভূমিকম্প হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘ সেখানে কোনো ধরনের সহায়তা পাঠাচ্ছে না। আমরা হাত দিয়ে একের পর এক পাথর সরিয়ে সেগুলো নিচে কিছুই পাচ্ছি না। অথচ, কংক্রিটের নিচে চাপা পড়া লোকজন আমাদের বের করুন! আমাদের বের করুন! বলে চিৎকার করছে। কিন্তু আমরা সেখান থেকে খালি হাতে ফিরছি। এ ক্ষেত্রে শুধু আপনার হাতই যথেষ্ট নয়।
বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিচরণ নেই। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ অথবা উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন প্রেম, দ্রোহ ও বিদ্রোহের কথা। মানুষের মনের ক্ষুধা মিটিয়েছেন বিদ্রোহী ও সাম্যবাদীর মতো কবিতা দিয়ে। শব্দের ঝঙ্কারে তিনি মোহ গড়ে তুলতেন পাঠকের মনে। মৃত্যুর বহু বছর পরও বাংলাদেশের জাতীয় এ কবির ভক্তের ভাটা পড়েনি। নজরুল এখনো তার ভক্তদের কাছে চিরতরুণ। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিকতায়ও যুক্ত ছিলেন। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো ‘ধূমকেতু’ নামের পত্রিকা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বইমেলায় নজরুল ইনস্টিটিউটের স্টলে গিয়ে দেখা যায়, অনেক পাঠক-দর্শনার্থীর ভিড়। নজরুলের বিভিন্ন বই দেখার পাশাপাশি সেগুলো কিনছেনও অনেকেই। তবে বেশিরভাগ পাঠক কিনছেন ‘নজরুল সমগ্র’। এ ছাড়াও স্টলে পাওয়া যাচ্ছে আদি গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে ধারণকৃত নজরুলের গাওয়া সংগীতের অডিও অ্যালবাম এবং বিখ্যাত নজরুল সংগীতশিল্পীদের অডিও অ্যালবাম। পাওয়া যাচ্ছে নজরুল-আবৃত্তির অ্যালবামও।
মেলায় আসা ঢাকা কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মির্জা আশিক ইলাহী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নজরুল বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার বাতিঘর। তার লেখা আমাদের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিপ্লবী চেতনাকে উজ্জীবিত করে। তাই নজরুল বাঙালির জন্য আজও প্রাসঙ্গিক। প্রতিবারের মতো এবারও তার কয়েকটি বই কিনলাম।’
গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স শিক্ষার্থী মাহবুবা তানু বলেন, ‘নজরুলের সাম্যবাদী চেতনা আমাদের অহংকারমুক্ত করে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে নজরুলের লেখনী। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে তিনি এখনো চিরতরুণ।’
স্টলের বিক্রয়কর্মীরা জানান, প্রতিদিন প্রচুর পাঠক আসছেন, বইও কিনছেন। অনেক তরুণ নজরুলের বই কিনছেন।
নতুন বই : গতকাল ছিল অমর একুশে বইমেলার ১৬তম দিন। মেলা শুরু হয় বেলা ৩টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ৮৩টি।
আলোচনা অনুষ্ঠান : বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হয় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফরিদ আহমদ দুলাল। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মাহমুদ কামাল, নজিবুল ইসলাম এবং সাজ্জাদ আহসান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অনীক মাহমুদ।
প্রাবন্ধিক বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নকে অর্থবহ করে তোলা যেমন জরুরি, তেমনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের জীবনে সাংস্কৃতিক মুক্তি নিশ্চিত করাটাও অপরিহার্য। সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের সব স্তরে সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে সমন্বয় করতে হবে। দেশের মাঠপর্যায় থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়, কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে মাঠপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে চিন্তা ও আকাক্সক্ষার স্বপ্নটি এবং সেখানেই বাংলা, ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণের সৌন্দর্য লুক্কায়িত। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীকরণ তখনই অর্থবহ হবে, যখন লোকবাংলার শুভ প্রবণতার চেতনা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে লোকমানস থেকে নীতিনির্ধারকদের কাছে।
আলোচকরা বলেন, বিকেন্দ্রীকরণের একটি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক দিক আছে। ভাষাগত দ্বান্দ্বিকতার মতো বিষয়গুলো সমাধা করার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগে সাংস্কৃতিক নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকেন্দ্রীকরণের জন্য দেশব্যাপী বিদ্যমান সাংস্কৃতিক অবকাঠামোগুলোকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সামাজিক বিভেদের বদলে সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা ভাষা ও সংস্কৃতি বিকেন্দ্রীকরণের অন্যতম পূর্বশর্ত।
সভাপতির বক্তব্যে অনীক মাহমুদ বলেন, ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে জাতির মূলশক্তিকে জাগ্রত করতে হবে। ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিই একটি জাতির মূলশক্তি। সাংস্কৃতিক চর্চাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্রের সঙ্গে প্রান্তের মানুষদের সম্পৃক্ত করা সম্ভব।’
‘আজ লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন ইসরাইল খান, মাসুম রেজা, রিপন আহসান ঋতু এবং জুনান নাশিত। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন আমিনুর রহমান সুলতান, আয়শা ঝর্না, শিহাব শাহরিয়ার, অংকিতা আহমেদ রুবি, ফরিদুজ্জামান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সৈয়দ শহীদুল ইসলাম, জেসমিন বন্যা, নূরুননবী শান্ত। এ ছাড়া ছিল সিরাজুল মোস্তফার পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মাইজভাণ্ডারী মরমী গোষ্ঠী’ এবং মো. আনোয়ার হোসেনের পরিচালনায় ‘আরশিনগর বাউল সংঘ’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন ফরিদা পারভীন, সেলিম চৌধুরী, সাধিকা সৃজনী তানিয়া, শ্যামল কুমার পাল, সনৎ কুমার বিশ্বাস, মেহেরুন আশরাফ, বাবু সরকার এবং মো. আরিফুর রহমান। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন চন্দন দত্ত (তবলা), রবিন্স চৌধুরী (কি-বোর্ড), গাজী আব্দুল হাকিম (বাঁশি), শেখ জালাল উদ্দীন (সেতার)।
আজকের বইমেলা : আজ ১৭ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার। অমর একুশে বইমেলার ১৭তম দিন। মেলা শুরু হবে বেলা ১১টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
শিশুপ্রহর : আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে।
শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা : আজ সকাল ১০টায় বইমেলার মূলমঞ্চে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব অনুষ্ঠিত হবে।
আলোচনা অনুষ্ঠান : বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে হবে জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন মহীবুল আজিজ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন অনিরুদ্ধ কাহালি ও মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সৈয়দ আকরম হোসেন।
রাজধানীর বাড্ডা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বইমেলায় এসেছেন সাইফুল বারী। এরই মধ্যে গীতিকার হিসেবে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ সাড়া ফেলেছেন। তার পছন্দের লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ, দীপু মাহমুদ, শাহআলম সাজু, রকিবুল আমিনসহ আরও কয়েকজন রয়েছেন বলে জানান। তার মতে, গল্প-উপন্যাস সাহিত্যপ্রেমীদের মনের খোরাক।
গতকাল বৃহস্পতিবার বইমেলার ১৬তম দিনে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হলে এসব কথা বলেন সাইফুল বারী। তিনি বলেন, সমাজ পরিবর্তনকারী লেখকের লেখা পড়তে চাই। যাদের লেখা পড়ে পথহারা পথিক সত্য পথ চিনতে পেরেছেন। এবারের মেলা কেমন লাগছে জানতে চাইলে সাইফুল সমাজ পরিবর্তনকারী বই চাই বলেন, মেলার সার্বিক পরিস্থিতি দারুণ লাগছে। বন্ধুদের সঙ্গে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখছি।
মেলায় কোন বিষয় যুক্ত হওয়া জরুরি এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বইমেলা মানে হার্ডকপির বইয়ের ছড়াছড়ি। তবে এর থেকে বেরিয়ে অ্যাপ আকারে বইগুলো প্রকাশ করলে আরও বেশি ভালো হতো।
পড়ার ক্ষেত্রে কোন বইকে বেশি প্রাধান্য দিতে চান জানতে চাইলে বারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী পড়া হয়। এর মধ্যে উপন্যাসকে বেশি প্রাধান্য দেব।
মেলার নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে এ পাঠক বলেন, মেলার প্রবেশমুখে নিরাপত্তা বলয় বেশ ভালো। তবে প্রবেশদ্বারের ধুলোবালি কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলেছে।
বইয়ের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্যবারের চেয়ে এবারে বইয়ের দাম অনেক বেশি। কর্র্তৃপক্ষের এই ব্যাপারটায় নজর দেওয়া খুবই দরকার বলে মনে করি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে এরা নীতিনির্ধারকও হয়ে ওঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে! ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা?
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছেন, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পাল্টিয়ে ইতিমধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন? কী সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে-আবডালে এরা নানাভাবে কলকাঠি নাড়ে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির নানারকম কর্মকা- চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায়, আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী এদের কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকা- নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দরিদ্রতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়েও এরা তৎপর হয়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়্গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন সপরিবারে নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভী রহমানসহ যারা নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়ান আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনো এদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকল, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না!
একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্যরূপে আবির্ভূত হয়। গত এক যুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন ‘জয়বাংলা’ বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও এ মাসগুলোতেই যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচন্ড প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূরপ্রসারী হীন প্রচেষ্টা। এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ আগস্ট।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩ নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২-এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারোজন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্বব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাত-দিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। এতসবের পরও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মাবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও উন্নয়ন গবেষক
ক্যালগেরি, কানাডা
ভারতীয় পারিবারিক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘অভিমান’। ১৯৭৩ সালের সাড়া জাগানো এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি। অর্ধশত বছর পার করলেও অভিমানের আবেদন এখনো অটুট। লিখেছেন নাসরিন শওকত
অমিতাভ-জয়া জুটি
১৯৬৯ সালে ‘সাত হিন্দুস্থানি’ চলচ্চিত্র দিয়ে বলিউডে অভিষেক হয় অমিতাভ বচ্চনের। তখন একের পর এক চলচ্চিত্র মুখ থুবড়ে পড়ায় বলিউডে অস্তিত্ব¡ সংকটের মুখে পড়েন অভিনেতা। ঠিক তখনই মুক্তি পায় ‘দিওয়ার’। অমিতাভের সেই ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজে মজেন ভারতীয়রা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বলিউডের আজকের ‘শাহেনশাহ’ এবং মেগাসুপারস্টার বিগ বি’কে। অন্যদিকে নায়িকা হিসেবে জয়ার ক্যারিয়ার শুরু হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘গুড্ডি’ (১৯৭১ সালে) চলচ্চিত্র দিয়ে। অমিতাভের সঙ্গে একাধিক ছবিতে কাজ করেছেন তিনি, যার মধ্যে অন্যতম ‘জাঞ্জির’, ‘চুপকে চুপকে’, ‘অভিমান’, ‘মিলি’, ‘শোলে’, ‘সিলসিলা’।
একসময় বলিউডের চলচ্চিত্রশিল্পে অমিতাভ-জয়ার প্রেম ছিল চর্চিত বিষয়। অমিতাভ বচ্চন যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন, ততদিনে জয়া ভাদুড়ি প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। ১৯৭১ সালে যখন ‘গুড্ডি’ মুক্তি পায়, তখন থেকেই অমিতাভের সঙ্গে জয়ার প্রেমের সূত্রপাত। শোনা যায়, ওই চলচ্চিত্রের সেট থেকেই জয়ার প্রতি অনুরাগের শুরু তার। এরপর ‘এক নজর’ চলচ্চিত্রে কাজ করতে গিয়ে জয়াতে নিজেকে হারান অমিতাভ। পরে ‘জঞ্জির’ বক্স অফিসে সাফল্য পেলে লন্ডন বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন এই জুটি। পরিকল্পনা অনুযায়ী লন্ডনের টিকিট কেটে ফেলেন অমিতাভ ও জয়া। কিন্তু তাদের লন্ডন ভ্রমণে বাধা হয়ে দাঁড়ান স্বয়ং অমিতাভের বাবা হরিবংশ রাই বচ্চন। ছেলেকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বিয়ে না করে একসঙ্গে বিদেশে বেড়াতে যাওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
বাবার নির্দেশ অনুয়ায়ী, পরদিন সকালে পরিবার ও বন্ধুদের খবর দেওয়া হয়। ডেকে আনা হয় পুরোহিতকে। রাতে লন্ডনের বিমানে ওঠার কথা ছিল দুজনের। তাই ওই দিন সকালে একেবারে সাদাসিদেভাবে অমিতাভ-জয়ার বিয়ের আসর বসে। বরের পোশাক পরেই অমিতাভ গাড়ি চালিয়ে গিয়ে মালাবার হিলস থেকে তুলে আনেন জয়াকে। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই (১৯৭৩ সালের ৩ জুন ) বিয়ে হয়ে যায় তাদের। বিয়ের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নবদম্পতি রাতে লন্ডনের বিমানে ওঠেন। বিয়ের ১ বছর পর (১৯৭৪ সালে) প্রথম সন্তানের মা হন জয়া বচ্চন। মেয়ের নাম রাখেন শে^তা। এর দুবছর পর জন্ম হয় ছেলে অভিষেকের। বিয়ের পর একেবারে সংসারী হয়ে ওঠেন জয়া। অভিনয় জীবন থেকে লম্বা বিরতি নেন। মন দেন দুই সন্তান শ্বেতা ও অভিষেককে বড় করার দিকে।
অমিতাভ-জয়াকে বলিউডের অন্যতম আদর্শ দম্পতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেখতে দেখতে দাম্পত্যেরও অর্ধশত বছর পার করেছেন তারা। বর্তমানে ৩ নাতি-নাতনি নিয়ে সুখের সংসার তাদের। অভিষেক-ঐশ্বর্যের মেয়ে আরাধ্য। অন্যদিকে শে^তা বচ্চন নন্দার দুই ছেলেমেয়ে অগাস্ত্য ও নভ্যা নভেলি নন্দা। দীর্ঘ এই দাম্পত্য জীবনে বহু চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী থেকেছেন অমিতাভ-জয়া। তারপরও শক্ত করে ধরে রেখেছেন একে অপরের হাত ।
সুপারহিট ‘অভিমান’
বাঙালি পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অভিমান’ নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি। পরিচালক হৃষিকেশ অমিতাভকে তার স্ত্রী জয়ার সঙ্গে জুটি বাঁধিয়েছিলেন, যে জুটি চুটিয়ে প্রেম করছেন তখন । অভিমান মুক্তির এক মাস আগেই বিয়ে করেন তারা। কিন্তু এরই মধ্যে রুপালি পর্দার নবদম্পতির ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাস্তব জীবনে সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তবে জয়া উমা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন।
‘অভিমান’-এর বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা হয়তো পরিচালক হৃষিকেশের মাথায় আগে থেকেই ছিল (বাস্তবের অভিমান সব শ্রেণির দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়)। কিন্তু চলচ্চিত্রটিতে ঠুনকো অহংকার ও ভঙ্গুর মানসিকতার কারণে সৃষ্টি হয় দাম্পত্য কলহ, যার সহজাত কিন্তু গভীর উপলব্ধির পুঙ্খানুপঙ্খ চিত্রায়নের মধ্যেই মূলত লুকিয়ে ছিল এর স্থায়ী আবেদন ।
অভিমানে অমিতাভ ‘সুবির’ নামের এক গায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন, যিনি পপগানের জন্য সবার কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। স্টেজে তাকে বিখ্যাত গায়ক কিশোর কুমার ও মোহাম্মদ রফির কণ্ঠে গাওয়া নানা সুপারহিট গান গাইতে দেখা যায়। মাঝরাতে উন্মত্ত নারী অনুরাগীদের টেলিফোন কলের জ¦ালাতন এবং চিত্রার মতো ধনী ও অভিজাত বান্ধবীর তার প্রতি গভীর অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও ওই গানের নিঃসঙ্গতার মতোই সুবীর নিজেকে বড্ড একা অনুভব করে। এমন একসময়েই সুবীর তার প্রিয় মাসি দুর্গা মৌসির (দুর্গা খোটে) দূরের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যায়। যেখানে ঘটনাচক্রে এক শাস্ত্রীয় সংগীতকারের মেয়ে উমার (জয়া ভাদুরী) সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সুবীর প্রথমে উমার শিববন্দনার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং একসময় সে উমার প্রতিও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
মজার বিয়ষ হলো, এই দম্পতি যে তখন বাস্তব জীবনেও একে অপরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, পরিচালক হৃষিকেশ সূক্ষ্মভাবে অভিমানের মধ্য দিয়েই ভিন্ন আঙ্গিকে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সুবীরের পরামর্শে উমা মঞ্চে তার সঙ্গে একটি দ্বৈত গান গাইতে রাজি হয়। পরে সে একক গানের প্রস্তাব পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাচক্রে উমা যখন জনপ্রিয়তায় তাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সুবীর মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ও স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে। এই কয়েক দৃশ্যে পরিচালক হৃষিকেশ এই দম্পতির মধ্যকার বৈপরীত্যকে গভীর মমতায় সেলুলয়েডে তুলে আনেন।
চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃশ্যে অন্তজর্¦ালায় জ¦লতে থাকা সুবীরকে (যে কিনা এরই মধ্যে চিত্রার বাড়িতে সময় কাটানো শুরু করেছে) বলতে শোনা যায়, ‘প্রথমেও একাই ছিলাম, আজও একাই আছি।’ তখন চিত্রা উপলব্ধি করে, একাকিত্ব হলো নিজের সৃষ্ট এক ব্যথা, যার জন্ম ছোট ছোট অভিমান আর অহংকার থেকে।
এ সময় উমা স্বেচ্ছায় গান গাওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এরই মধ্যে সুবীরের ক্ষতবিক্ষত মন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমনই এক চরম মুহূর্তে উমাকে সে বলে বসে, তাকে আর তার প্রয়োজন নেই। সুবীরের সন্তানকে গর্ভে নিয়ে উমা তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে। চরম এক বিপর্যয়ের মুহূর্তে উমা তার সন্তানকে হারায়। একপর্যায়ে অনুতপ্ত হয়ে উমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে সুবীর। কিন্তু শোকে কাতর উমা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন উমার নীরবতা ভাঙার জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে সুবীর। শেষ পর্যন্ত স্টেজ শো করে তাদের দুজনের প্রিয় গান গায় (তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না), যা উমাকে স্বামীর ভালোবাসায় ফিরিয়ে আনে আবার। সুবীর উমাকে আবার গান গাইতে অনুরোধ করে।
অমিতাভ-জয়ার দুর্দান্ত অভিনয়ই অভিমানের প্রাণশক্তি। প্রাথমিক অবস্থায় চলচ্চিত্রটির নাম রাখা হয় ‘রাগ রাগিনী’। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিচালক হৃষিকেশ এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘অভিমান’। চলচ্চিত্রটি মুক্তির মাত্র এক মাস আগে অমিতাভ বচ্চন ও জয়া ভাদুড়ি বিয়ে করেন। তাই এর প্রথম দিকের দৃশ্যগুলোতে এই দম্পতিকে বিয়ের প্রাথমিক ঘনিষ্ঠতা উপভোগ করতে দেখা যায়, যা ছিল জীবনঘনিষ্ঠ। এর সংগীত পরিচালক ছিলেন এস ডি বর্মণ।
অভিমান-এর পোস্টমর্টেম
১৯৮০-র দশকের শুরুর দিককার কথা। তখন বলিউডে বারবার অ্যাকশন হিরোর চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সফলতা পাওয়ায় ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ইমেজ গড়ে ওঠে অমিতাভের। তখন ‘দিওয়ার’, ‘শোলে’ ও ‘জাঞ্জির’-এর মতো ব্যবসাসফল অ্যাকশন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, সে সময়ের সংগীতের নাটকীয়তাকে ঘিরে এক নবদম্পতির ঈর্ষাপরায়ণতা, ভালোবাসা ও মান-অভিমানের কাহিনি নিয়ে নির্মিত ‘অভিমান’ ছিল অমিতাভ অভিনীত সবচেয়ে ভালো চরিত্রগুলোর মধ্যে একটি।
‘অভিমান’ এবছর অর্ধশত বছর পূর্ণ করেছে। ১৯৭৩ সালে অমিতাভের কমপক্ষে অর্ধ ডজন চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, যার মধ্যে ‘অভিমান’ একটি। এই তালিকায় রয়েছে ‘সওদাগর’, যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে সে বছর ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে অস্কারে যায় এবং আরেকটি ছিল ‘জাঞ্জির’, ব্লকবাস্টার এই চলচ্চিত্রটি অমিতাভকে ভারতের শীর্ষ ‘অ্যাকশন হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। কিন্তু চলচ্চিত্র সমালোচক ও লেখক শৈবাল চট্টোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ‘‘অভিমান’ ছিল ওই বছরের সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র এবং সে বছরে তার (অমিতাভ) সবচেয়ে বড় হিট চলচ্চিত্রও’’। ‘অভিমান’ দেখতে ভক্তরা দলে দলে ছুটে যান সিনেমা হলগুলোতে। বাবা-মা এবং ছোট বাচ্চাসহ পুরো পরিবারে ভরে যায় থিয়েটারগুলো। সমান তালে ভিড় থাকে ম্যাটিনি ও সান্ধ্য শোতে।
বছরের পর বছর ধরে চলচ্চিত্র শিল্পের ভক্ত, সমালোচক এবং বচ্চন দম্পতির সহকর্মীদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে ‘অভিমান’। অমিতাভ বচ্চন নিজেও সুযোগ পেলেই ‘অভিমান’-এর প্রতি তার ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেন। একবার তিনি বলেছিলেন, ‘এটি সেই চলচ্চিত্র, যা আমাদের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় সৃজনশীল কাজ করাতে জয়া ও আমাকে একত্রিত করেছে এবং এর গানগুলো কোনোভাবেই ভোলার নয়। অনেকের কাছেই এখনো তা স্বপ্নের মতোই।’
লেখক শৈবাল চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘ ‘অভিমান’কে সব সময় বচ্চনের ক্যারিয়ারের ‘একটি শীর্ষ সময়’ হিসেবে আলোচনা করতে হবে। কারণ এটি ছিল এমন একটি চলচ্চিত্র, যেখানে তাকে গতানুগতিক পৌরুষদীপ্ত, তেজী বা রাগী যুবক হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। এটি এমন একটি চরিত্র ছিল, যেখানে তার ভিন্ন এক রূপ দেখানো হয়েছে। সেখানে তিনি একজন সত্যিকারের নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, একজন সত্যিকারের মানুষ যিনি নিরাপত্তাহীনতায় ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠেন এবং এখানেই তিনি একজন বহুমুখী অভিনেতার পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হন। প্রমাণ করেন যে, পরিচালক তার জন্য যে চরিত্রই লেখেন না কেন, তিনি তাতে পারদর্শী।’ ”
সময় যত গড়িয়েছে, ‘অভিমান’-এর কাহিনিকে ঘিরে অনুমানের চর্চাও তত বেড়েছে। তখন ধারণা করা হতো যে, চলচ্চিত্রটি তার দুই প্রধান তারকার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই নির্মাণ করা হয়েছিল। কেননা অমিতাভ তখন বলিউডে একজন নবাগত হলেও জয়া এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত একজন অভিনেত্রী ছিলেন। আবার কখনো সেতারবাদক রবিশঙ্কর ও তার প্রথম স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর জীবনের সঙ্গেও এর তুলনা করা হয়েছে, যিনি নিজেও একজন প্রতিভাবান সেতারবাদক ছিলেন। কিন্তু পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় এসব তুলনা প্রত্যাখ্যান করেন।
এ ছাড়াও ‘অভিমান’কে হলিউডের চলচ্চিত্র ‘এ স্টার ইজ বর্ন’-এর সঙ্গেও তুলনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই একই কাহিনি নিয়ে হলিউডে মোট চারটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। প্রথমটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে এবং এর সবশেষ সংস্করণটি ২০১৮ সালে নির্মাণ হয়। যেখানে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন বিশ্ববিখ্যাত গায়িকা লেডি গাগা ও অভিনেতা ব্রাডলি কুপার। যদিও এই তুলনাকে কখনোই স্বীকার করেননি ‘অভিমান’-র পরিচালক হৃষিকেশ। এর পরিবর্তে তিনি বলেছিলেন, তার চলচ্চিত্রটি বলিউডের কিংবদন্তি গায়ক কিশোর কুমার ও তার প্রথম স্ত্রী রুমা দেবীর জীবনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল, যিনি বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের একজন সফল অভিনেত্রী ও গায়িকা। এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক হৃষিকেশ বলেন, ‘অভিনেত্রী রুমা কম প্রতিভাবান ছিলেন না। যেহেতু কিশোর তার ক্যারিয়ারের শুরুতে কিছুটা সংগ্রাম করছিলেন, তাই অভিনয়শিল্পী হিসেবে রুমার প্রতিভার বিষয়ে সব সময় সতর্ক থাকতেন তিনি।’
তবে আজকাল কিছু নারীবাদী ‘অভিমান’-এ জয়াকে নম্র ও পতিব্রতা স্ত্রী হিসেবে চিত্রিত করার জন্য চলচ্চিত্রটির সমালোচনা করেন। যিনি কখনোই নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করেননি, যার কাছে তার স্বামীই মুখ্য।
রমজানের পঞ্চম দিনেও রাজধানী ছিল তীব্র যানজটের কবলে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ইফতারের আগ পর্যন্ত নগরীর প্রায় প্রতিটি এলাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। এবার রোজার শুরুতে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে স্বাধীনতা দিবসের ছুটি মিলিয়ে তিন দিন বন্ধ থাকায় রোজার চতুর্থ দিন সোমবার তীব্র যানজটের কবলে পড়েছিল ঢাকা। গতকাল মঙ্গলবার সে তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক থেকে শুরু করে সবরাই অভিযোগ, সেবা সংস্থাগুলো তাদের কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গার রাস্তা কাটায় যান চলাচাল ব্যাহত হচ্ছে, ভোগান্তি বেড়েছে পথাচারীদের।
গতকাল রাজধানীর সদরঘাট, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, রামপুরা ও মিরপুরসহ বেশ কটি এলাকা ঘুরে সকাল থেকে তীব্র যানজট দেখা যায়। যানজটে আটকা পড়ে অনেককে হাঁসফাঁস করতে দেখা যায়। কাউকে কাউকে আবার বাসে দীর্ঘ সময় বসে থেকে পরে গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য হেঁটেই রওনা দিতে দেখা যায়। অনেক জায়গায় শুধু সড়ক নয়, ফ্লাইওভারে দেখা দেয় তীব্র যানজট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগরীর অনেক জায়গায় রাস্তাঘাটের সংস্কারকাজ চলায় বিকল্প পথ ব্যবহারের কারণে যানজটের শিকার বেশি হতে হচ্ছে ওইসব এলাকার যাত্রীদের। বিশেষ করে অফিসের শুরু ও শেষের দিকে যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. জয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, রাস্তাঘাটের যানজট এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো জায়গায় ঠিকমতো যাওয়া যায় না। তাছাড়া কোনো কিছুরই সঠিক পরিকল্পনা নেই। এক রাস্তা কয়েকবার কাটতে দেখা যায়। আর এজন্যই মূলত এত যানজট।’
যানজটের কারণে যাত্রীদের পাশাপাশি ক্ষুব্ধ গণপরিবহনের চালক ও কর্মীরাও। দিশারী পরিবহনের চালক মো. সানোয়ার বলেন, ‘সকাল থেকেই রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট ছিল। সোমবারের থেকে আজ (গতকাল) আরও যানজট বেড়েছে। কোনোভাবেই গাড়ি সামনে যাচ্ছে না।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি শহরের জন্য যতটুকু পরিমাণ রাস্তাঘাট দরকার তার কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না এই নগরীতে। আর প্রতিদিন কী পরিমাণ যানবাহন সড়কে চলছে তার সঠিক সংখ্যাও জানা নেই বিআরটিএর। আর গণপরিবহন ব্যবস্থা খুব খারাপ হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় মানুষের যাতায়াত বাড়ছে। সে জন্য ছোট গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। যার জন্য সড়কে যানজট বাড়ছে।
বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার অনুমতি দিয়ে নতুন একটি আইনের পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব সরকার। নতুন এই আইন পাস হলে বিদেশিরা দেশটিতে যেকোনো এলাকায় সম্পত্তি কিনতে পারবেন। অন্যান্য দেশের নাগরিকদেরমতো বাংলাদেশিরাও এই সুযোগ পাবেন। অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার কৌশলের অংশ হিসেবে আবাসন খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতেই এমন পরিকল্পনা বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো।
সৌদি আরবের রিয়েল এস্টেট জেনারেল অথরিটির (আরইজিএ) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আব্দুল্লাহ আলহাম্মাদদের বরাতে সৌদি গেজেটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশিদের সম্পত্তি কেনা সম্পর্কিত নতুন একটি আইন পর্যালোচনাধীন রয়েছে। এই আইনের আওতায় সৌদি নাগরিক নন, এমন বিদেশিরা মক্কা, মদিনাসহ সৌদি আরবের যেকোনো এলাকায় সম্পত্তি কিনতে পারবেন।
আবদুল্লাহ আলহাম্মাদ বলেন, আইনটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে আইনটির বিষয়ে সবাইকে জানানো হবে।
বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার বিষয়ে ২০২১ সালে একটি নির্দেশনা জারি করেছিল সৌদি আরব। এই নির্দেশনায় সৌদির নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিসহ দেশটিতে থাকা বৈধ বাসিন্দাদের শর্ত সাপেক্ষে একক সম্পত্তি কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
আবদুল্লাহ আলহাম্মাদ বলেন, সৌদিতে রিয়েল এস্টেটের মালিকানার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের চেয়ে নতুন আইনটি আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক হবে। নতুন আইনের অধীন বিদেশিরা সৌদিতে বাণিজ্যিক, আবাসিক, কৃষিসহ যেকোনো ধরনের সম্পত্তি কিনতে পারবেন।
আগের আইনে সৌদির পবিত্র শহরগুলোতে বিদেশিদের সম্পত্তি কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, পবিত্র মক্কা-মদিনাসহ সৌদি আরবের সব জায়গায় বিদেশিরা সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন।
নতুন আইনের মাধ্যমে সৌদি আরব তার আবাসন খাতে একটা রূপান্তর আনতে চাইছে। তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে এ খাতকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চায়। সৌদি কর্র্তৃপক্ষ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান আরও বাড়াতে আগ্রহী।
সৌদির রিয়েল এস্টেট জেনারেল অথরিটি নতুন যে আইনটির কথা বলছে, তা কার্যকর হলে দেশটি প্রবাসী ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন বিনিয়োগের একটি গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।
সংলাপে নয়, আলোচনার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেছেন, ‘মূল জিনিসটা হলো, আমরা কিন্তু সংলাপে আহ্বান করিনি। সংলাপ বিষয়টি আনুষ্ঠানিক। আমরা কোনোভাবেই উনাদের (বিএনপি) সংলাপে ডাকিনি। আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি আনুষ্ঠানিক না হলেও (আনুষ্ঠানিক মানে সংলাপ) অন্তত অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আপনারা আসতে পারেন। অত্যন্ত বিনীতভাবে এ আহ্বানটা করেছি।’
বিএনপিকে চিঠি পাঠানোর পাঁচ দিন পর গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের নিজ কক্ষের সামনে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, “বিএনপিকে চিঠি দেওয়ায় ইসির কোনো ‘কূটকৌশল’ ছিল না, কোনো মহলের ‘চাপও নেই’। অনানুষ্ঠানিকপত্র দিয়েছি বিএনপি মহাসচিবকে। চিঠি বৃহস্পতিবার শেষবেলায় দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় চিঠিটা উনারা পেয়েছেন। আমার কাছে কোনো জবাব আসেনি। ধরে নিচ্ছি উনারা পেয়েছেন। অনেকে বলতে চেয়েছেন এটা সরকারের একটি কূটকৌশল। আমি আপনাদের মাধ্যম পুরো জাতিকে অবহিত করতে চাই, আশ্বস্ত করতে চাই এ পত্রের সঙ্গে সরকারের কোনো সংস্রব নেই, সংশ্লিষ্টতা ছিল না।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি কেউ এটাকে কূটকৌশল হিসেবে মনে করতে চান তাহলে এটা নির্বাচন কমিশনের কূটকৌশল হতে পারে, সরকারের নয়। আর নির্বাচন কমিশন কখনো কূটকৌশল হিসেবে এ কাজটি করেনি।’
সিইসি বলেন, ‘ইসি একেবারে প্রথম থেকেই অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বীমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করে আসছে। আমরা ব্যথিত হই যখন বলা হয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করি। আজ্ঞা বহন করিনি। আমরা নির্বাচন নিয়ে আলাপ করি, আমাদের চিন্তার মধ্যে ফুটে উঠেছে বিএনপির মতো দলকে নির্বাচনে আনতে পারলে ভালো হয়।’
বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় এখনো আগ্রহী জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি আপনাদের (বিএনপির) যদি কোনো কৌশল থাকে তার ওপর ইসির কোনো মন্তব্য থাকবে না। তার পরও আমরা আলোচনা করতে চাই আপনাদের সঙ্গে। ফল ইতিবাচক হতেও পারে, নাও হতে পারে। প্রয়াস থাকবে। প্রয়াস গ্রহণ করতে বাধা থাকা উচিত নয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘আমরা কোনো চিঠি পাইনি। আমি চিঠি দিয়েছি, যেকোনো রেসপন্স আমাদের চিঠির মাধ্যমে দিতে হবে। আমরা আশা করি, যেহেতু বিএনপি মহাসচিব মহোদয়কে চিঠি দিয়েছি। যেকোনো বক্তব্য আমাদের কাছে পত্রের মাধ্যমে আসে সেটাই কাক্সিক্ষত। এরপর আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত নেব। আগাম কোনো মন্তব্য নেই।’
বিএনপি যদি আসে তাদের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা হবে সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘উনারা কী বলবেন, আমরা কী বলব আগাম কোনো বক্তব্য দিতে পারব না। বিএনপি যদি আলোচনার জন্য এজেন্ডা ঠিক করে দেয়, তার পরও বসা বিষয়ে ইতিবাচক’ বলে জানান সিইসি।
কূটনৈতিক মহলে সংলাপ আয়োজনের আলোচনার মধ্যে এমন চিঠি দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘এ ধরনের বিষয় আমাদের নলেজে নেই। আমাদের চিন্তা থেকে, উদ্ভূত সিদ্ধান্ত থেকে এ চিঠি দেওয়া হয়েছে। চাপের কথা যেটা বলেছেন এটা সম্পূর্ণ অমূলক ধারণা। কোনো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চাপে বিএনপিকে ডাকা হয়নি।’
বিএনপির জবাব পেতে কত দিন অপেক্ষা করবে কমিশন এমন প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে যান সিইসি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাইবান্ধা ভোট বন্ধের ইস্যুতে ১৩৪ জনের মধ্যে ৪০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবারও পদক্ষেপ নেবে ইসি।
সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে চার নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর, রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
রাজধানীর মিরপুরের একটি মাধ্যমিক-সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সিফাত। একই এলাকায় বসবাসকারী তার বন্ধু সিয়াম পড়ে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে। সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার থেকে রোজার ছুটি। আর সরকারি প্রাথমিকে ছুটি ১৫ রোজা অর্থাৎ ৭ এপ্রিল থেকে।
এক দেশে একই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন নিয়মে ছুটি পাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে লেখাপড়ায় কেউ এগিয়ে যাবে, আবার কেউ পিছিয়ে পড়বে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সৈয়দ মামুনুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকার বা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিলে ভেবেচিন্তেই নেয়। তবে সব ধরনের স্কুলে একটা কো-অর্ডিনেশন থাকলে ভালো হয়। আমরা ছুটির ব্যাপারে আরও আলাপ-আলোচনা করব।’
জানা গেছে, চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে রমজান মাস। বছরের শুরুতেই স্কুলগুলোর ছুটির তালিকা অনুমোদন করা হয়। সে অনুযায়ী পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস, ইস্টার সানডে, বৈসাবি, নববর্ষ ও ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি, বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি কলেজ, আলিয়া মাদ্রাসা ও টিটি (টিচার্স ট্রেনিং) কলেজেও একই সময়ে ছুটির ঘোষণা রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ছুটির তালিকা ভিন্ন। তারা পবিত্র রমজান, ইস্টার সানডে, চৈত্র-সংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ, ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আগামী ৭ থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রায় ১৫ রমজান পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা থাকবে।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাধ্যমিকের মতোই তাদের ছুটি থাকবে ২৩ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোজার ছুটিও একই। তবে মাদ্রাসায় রোজার ছুটি শুরু এক দিন আগেই অর্থাৎ আজ বুধবার, ২২ মার্চ।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান। তাই বুধবার ক্লাস করে বৃহস্পতিবার রোজার ছুটি শুরু হবে। তবে সব স্কুলে একই ধরনের ছুটি থাকা জরুরি। এতে একই সময়ে সিলেবাস শেষ করা যাবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সন্তুষ্ট থাকবে।’
রমজানে মাধ্যমিকে স্কুল বন্ধ আর প্রাথমিকে খোলা রাখায় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার লাখ শিক্ষকের মধ্যে। তারা বলছেন, যেসব অভিভাবকের সন্তান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্কুলেই পড়ে তাদের সমস্যা হবে। রমজান মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রাথমিকের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাও রোজা রাখেন। তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে মিল রেখে প্রাথমিকের ছুটি নির্ধারণ করা যৌক্তিক হবে।
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাংগাঠনিক সম্পাদক জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সরকারি ছুটি ৭৬ দিন, কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র ৫৪ দিন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিন্ন ছুটি নির্ধারণের যুক্তি তুলে ধরে আমরা ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এখনো সাড়া পাইনি।’
'স্যার নয় আপা ডাকলেই চলবে' রংপুরের জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীনের এমন বক্তব্যের পর রাত ৯ টার দিকে আন্দোলন সমাপ্ত করে ক্যাম্পাসে ফিরে গেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।
এর আগে চিত্রলেখা নাজনীনের বিরুদ্ধে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে বুধবার (২২ মার্চ) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একাই অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন উমর ফারুক। এর পর তার সাথে একাত্মতা জানিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হন বেরোবির বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা।
তুহিন ওয়াদুদ তার ফেসবুক পোস্টে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেরোবির একটা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে উমর ফারুক আমার কাছে এসেছিলেন। এ সময় আমি বাইরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম। তখন ওই শিক্ষক আমাকে দেখে আপা বলে ডাক দেন। আমি তাকে স্যার না বলে আপা কেন ডাকছেন জানতে চাই। আমার জায়গায় একজন পুরুষ দায়িত্বে থাকলেও কি তিনি স্যার না বলে ভাই ডাকতেন?
জেলা প্রশাসক জানান, রাতে তিনি ওই শিক্ষক ও আন্দোলনকারীদের স্যার ডাকতে হবে না, আপা ডাকলেই চলবে বলে জানান। এরপর তারা আন্দোলন বন্ধ করে দেন এবং ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে চলে যান।