
ভেতরে দল গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন বাতিল হলেও একাদশ সংসদের মতো আগামী নির্বাচনেও অংশ নেবে দলটি। যদিও জামায়াতের নেতারা বলছেন, তাদের দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।
জামায়াতের জোরেশোরে নির্বাচন প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে দলটির নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, জামায়াত নির্বাচনমুখী একটি রাজনৈতিক দল। সব সময়ই মাঠপর্যায়ে প্রার্থী যাচাই-বাছাই চলে। ইতিমধ্যে তারা ১২০টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।
জামায়াত আগামীতে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মতো কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবে না দাবি করে ওই নেতারা বলেন, একক নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে জামায়াত অংশ নেবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় থাকবে।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়।’ তিনি বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলনকে সফল করার পর নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃণমূলে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে বেশি ব্যস্ত রয়েছেন দলটির নেতারা। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে তা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়। কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে বিগত দিনে যে দুটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে তাতে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হলে সে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবে না। সে জন্য আমরা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না।’
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির দুটিতে অংশ নিলেও পরে জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে নেই। বিএনপিও আপাতত জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত বগুড়ার সাতটি আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। অন্য দুটিতেও প্রস্তুতি শুরু করেছে জামায়াত। প্রার্থী চূড়ান্ত করার আগে বিভিন্ন আসনে জরিপ পরিচালনা করছে দলটি। জরিপের রিপোর্ট অনুযায়ী দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি দেশের বিভিন্ন আসনে প্রার্থী নির্বাচন করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলায় আসন এবং প্রার্থীর নাম নির্বাচন করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের মাঠে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ ইজ্জত উল্লাহ। আরও রয়েছেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ ও সাবেক শিবির সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত। যেসব উপজেলায় দলটির চেয়ারম্যান কিংবা ভাইস চেয়ারম্যান আছে সেসব নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৭৬টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল। ওই নির্বাচনে দলটি ১০টি আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে দলটি ২২২ জন প্রার্থী দিয়েছিল।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত তিনটি আসনে জয়ী হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে জামায়াত ১৭টি আসন পায়। মহিলা আসনগুলো থেকে চারটি আসনে জয়ী হয় তারা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসনে বিজয়ী হয়। ওই নির্বাচনে দলটি জোটগতভাবে ৩৯টি ও চারটিতে এককভাবে নির্বাচন করে।
২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বরে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা রিট মামলার রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। সে কারণে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, নতুন নামে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াত। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে একটি দলের নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করা হয়েছে, যার সব নেতাই জামায়াতের। নতুন এ দলের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন ডেমরা থানা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চান এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার কর্মপরিষদ সদস্য ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মো. কাজী নিজামুল হক। আনোয়ারুল ইসলাম চান নির্বাচন কমিশনে আবেদন জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
নতুন দলের নামে নিবন্ধন চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান আকন্দ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। জামায়াতবিরোধী শক্তি এ ধরনের খবর প্রচার করছে।’
শেষ হয়ে আসছে প্রাণের বইমেলা। গতকাল ছিল মেলার শেষ শুক্রবার। বৃহস্পতিবার রাতে উড়ো চিঠিতে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বইমেলায় হামলার হুমকি ছিল। তবে সবকিছু তোয়াক্কা না করেই গতকাল শুক্রবার বইমেলায় ছিল পাঠক-লেখকের উপচেপড়া ভিড় ছিল। এদিন পাঠকদের নতুন নতুন বই কিনতে দেখা গেছে। বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা মেলার চলমান ছয় ঘণ্টার পুরোটা জুড়েই ছিল বই বিক্রি। বেশিরভাগ পাঠকের হাতে ছিল এতদিন সংগ্রহ করা বিভিন্ন প্রকাশনীর নতুন বইয়ের ক্যাটালগ। আগেভাগে সংগ্রহ করে রাখা সেসব ক্যাটালগ থেকে বেছে তৈরি করা তালিকা ধরে কেনাকাটা শুরু করেছেন বইপ্রেমীরা। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় মেলা শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত বইপ্রেমী পাঠকদের এ ভিড় ও বিক্রি থাকবে।
এদিকে অমর একুশে বইমেলায় বোমা হামলার হুমকির পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নূরুল হুদা গতকাল গণমাধ্যমে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব বিষয় বন্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করেছি। শাহবাগ থানায় জিডি করা হয়েছে।
গতকাল মেলায় কথা হয় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জুনায়েদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি মেলায় এসে সংগ্রহ করেছেন বইয়ের ক্যাটালগ। সেখান থেকে বাছাইকৃত বই কিনতে ছুটে এসেছেন শুক্রবার ছুটির দিন। তিনি বলেন, আমি একটু বেছে বই কিনি। যেসব বইকে মানুষ ‘সিরিয়াস’ বই বলে, সেগুলোর প্রতি আমার ঝোঁক বেশি।
অবসর প্রকাশনা সংস্থার ব্যবস্থাপক মো. মাসুদ রানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজ (গতকাল) বইমেলার শেষ শুক্রবার। বইমেলায় লোকসমাগম অনেক বেশি। বিক্রিও সন্তোষজনক। এখন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত চলবে এমন বই বিক্রি, এমনটা আশা করছি।
বইমেলায় বোমা হামলার শঙ্কায় পাঠক মনে ভয় দেখা গিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বোমা হামলার শঙ্কার বিষয়ে পাঠকদের মনে বিন্দুমাত্র আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়নি। বরং শেষ মুহূর্তে পাঠকরা তালিকা ধরে ধরে বই কিনতে এসেছে। আজ (গতকাল) সকালে শুরুর দিকে এমন কয়েকজন পাঠককে দেখতে পেয়েছি। এমন পাঠকরা একটু নিরিবিলিতে বই কিনতে পছন্দ করে।
নতুন বই : গতকাল ছিল অমর একুশে বইমেলার ২৪তম দিন। মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। নতুন বই এসেছে ২৩৯টি। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশুপ্রহর।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান : সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় ওয়াকিয়া নূর (প্রথম), আফফান আল হাসনাইন (দ্বিতীয়), রুজাইনাহ মারিফা (তৃতীয়); খ-শাখায় প্রত্যয় পাল রাজ (প্রথম), তাসনিয়াহ সিদ্দিক (দ্বিতীয়), শাফিন উদ্দিন আহম্মেদ (তৃতীয়); গ-শাখায় অর্নিলা ভৌমিক (প্রথম), আল মুমিনুর (দ্বিতীয়), জায়ীফা তাসনীম (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় আরোহী বর্ণমালা (প্রথম), অংকিতা সাহা রুদ্র ((দ্বিতীয়), জুমানা হোসেন (তৃতীয়); খ-শাখায় সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্গ (প্রথম), আনিশা আমিন (দ্বিতীয়), অদ্রিতা ভদ্র (তৃতীয়) এবং গ-শাখায় আদিবা সুলতানা (প্রথম), তাজকিয়া তাহরীম শাশা (দ্বিতীয়), সিমরিন শাহিন রূপকথা (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির (প্রথম), অন্বেষা মজুমদার (দ্বিতীয়), সার্থক সাহা (তৃতীয়); খ-শাখায় রোদোসী নূর সিদ্দিকী (প্রথম), তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় (দ্বিতীয়), মৈত্রেয়ী ঘোষ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্ব শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নিরঞ্জন অধিকারী, এজাজ ইউসুফী, বিপ্লব মোস্তাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাশিদ আসকারী।
প্রাবন্ধিক বলেন, বিশ্বে সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে রচিত গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল। এর কারণ তত্ত্ব সম্পর্কে পৃথিবীর সব প্রান্তেই লেখক, পাঠক ও সমালোচকদের রয়েছে অনিঃশেষ আগ্রহ। মানবিক কর্মকান্ড যত বাড়ছে, নতুন নতুন বিষয়ের আবির্ভাব ঘটছে, তত্ত্বের পরিসরও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তত্ত্বচর্চার মধ্য দিয়েই আত্মপরিচয়ের বিনির্মাণ, লৈঙ্গিক পার্থক্যের অপসারণ, নিম্নবর্গের মানুষকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা চলছে। বৈশ্বিকভাবে আজ অবধি যত তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে তার মধ্যে আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ খুবই শক্তিশালী প্রভাব বজায় রেখেছে।
আলোচকবৃন্দ বলেন, আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা এবং পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্বের পটভূমি অনেক বিস্তৃত। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষার সাহিত্যে এসব তত্ত্ব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তা, সামাজিক চিন্তা ও সাহিত্যিক চিন্তা থেকেই মানবতাবাদী চিন্তক ও তাত্ত্বিকরা সময়োপযোগী তত্ত্বের বিকাশ ঘটান। আজ তত্ত্ব, তাত্ত্বিক বয়ান ও তাত্ত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে গেছে সাহিত্য ও সংস্কৃতি। সেই কারণে শুধু সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই উদ্ভব ঘটেছে বিভিন্ন তত্ত্বের।
সভাপতির বক্তব্যে রাশিদ আসকারী বলেন, একুশ শতকে শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো সমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী মানসিকতা সৃষ্টি। এ জন্য গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ এসব তত্ত্বকে বিদ্যায়তনিক সীমার বাইরে এনে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি বিষয়কেই তাত্ত্বিক চিন্তার আলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ করতে হবে।
আজকের অনুষ্ঠানসূচি : আজ শনিবার, অমর একুশে বইমেলা ২৫তম দিন। মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
শিশুপ্রহর : আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে কভিড-১৯ : ভাষার বৈশ্বিকতা ও বাংলাদেশের সাহিত্য এবং কভিড-১৯ : সংস্কৃতির সংকট ও রূপান্তর শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাকিম আরিফ এবং মোহাম্মদ শেখ সাদী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন পারভেজ হোসেন, হামীম কামরুল হক, কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং আবুল হাসান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রফিকউল্লাহ খান।
বইয়ের টানে রাজধানীর মহাখালী থেকে অমর একুশে বইমেলায় এসেছেন ইতি আক্তার। তার প্রিয় লেখকদের তালিকায় রয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ ছফা ও ড. আকবর আলি খান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন বইয়ের খোঁজে মেলায় ছুটে এসেছি।
গতকাল অমর একুশে বইমেলার শেষ শুক্রবারে মেলা প্রাঙ্গণে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে পাঠক ইতির আলাপ হলে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেই বইমেলা নিয়ে একটি জঙ্গি সংগঠনের হুমকির কথা জানতে পেরেছি। এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কেমন বই চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, মননশীল সৃজনশীল মানসম্মত বই চাই। মেলায় এ ধরনের বই তুলনামূলক কম বলে আমি মনে করি।
বইমেলা নিয়ে তিনি বলেন, মেলায় লেখকদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য একটা আলাদা অটোগ্রাফ চত্বর থাকলে ভালো হতো। সবাই সেখানে লাইন ধরে প্রিয় লেখকের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিতে পারত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক রায়হান রাইন কবিতা, গবেষণা, গল্প-উপন্যাস লেখায় সমান সক্রিয়। এবার বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে তার ৭৬ গল্প নিয়ে ‘কয়েকটি সাদা কাঠগোলাপ’। প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। ‘বাংলার সুফিয়ানা ও সহজিয়ানা’ নামে গবেষণার বই প্রকাশ করেছে বাতিঘর।
আপনার বইয়ের পাঠক কারা জনাতে চাইলে রায়হান রাইন বলেন, ‘আমার বই পড়েছেন এমন যাদের চিনি, তাদের প্রায় সবাই নিজেরাও লেখক। তবে গবেষণাধর্মী লেখাগুলো, বিশেষ করে বাংলার দর্শন নিয়ে বইগুলো অনেকেই পড়েন।যাদের মধ্যে শিক্ষক, গবেষক বা শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। এর বাইরেও নিশ্চয়ই পড়েন কেউ কেউ।’
বাংলাদেশের সাহিত্যের পাঠক নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে লেখক বলেন, ‘জেলা শহরগুলোর পাবলিক লাইব্রেরি এবং সৃজনশীল বইয়ের দোকানগুলোর অবস্থা দেখে মনে হয়, সাহিত্যের পাঠকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সূত্রে দেখতে পাই, পাঠ্যপুস্তক পড়েন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও খুব কম। বেশির ভাগই নোটবই বা হাতে লেখা নোট পড়ে পরীক্ষা দেন। সামনে একটা নোটবই পড়া প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। তারা সাহিত্যিকদের নাম মুখস্থ করেন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তু‘তি হিসেবে।’
রায়হান রাইন পাঠকের ওপর নিজের লেখার প্রভাব খেয়াল করে দেখেননি জানিয়ে বলেন, ‘পাঠকের ওপর লেখার কী প্রভাব পড়ছে, সেটা দেখতে পাওয়াও সহজ ব্যাপার না।’
পাঠকের সঙ্গে লেখক হিসেবে কোনো স্মৃতি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম উপন্যাস একটা ঈদসংখ্যায় বেরিয়েছিল মিথুনের রাশিফল নামে, বছর দশেক আগে। সেটা পড়ে এক পাঠক ধরে নিয়েছিলেন, এর লেখক একজন বুড়ো মানুষ। আমার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার পর তিনি সেটা বললেন। ভাবলাম, তার সঙ্গে দেখা না হয়ে গেলে, তার মনের ভেতর সেই সময় থেকেই আমাকে থাকতে হতো একজন বুড়ো মানুষ হয়ে। এই উপন্যাসের প্রুফ দেখা শেষ করে একজন প্রুফ রিডার ফোন করেছিলেন। পরে ফোন করেছেন অনেকেই। কিন্তু প্রুফ রিডারের কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যেটা আমার মনে থেকে গেছে। ‘কথাপুষ্প: প্রজ্ঞাবানদের বলা গল্প’ নামের বইটা পড়ে এক পাঠক আমাকে খুঁজে বের করে বললেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ, আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’
রায়হান রাইনের জন্ম ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ, সিরাজগঞ্জে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করেছেন। তার আরও উপন্যাস: ‘আগুন ও ছায়া’; গল্পের বই: ‘আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু’, ‘পাতানো মায়ের পাহাড়’, ‘স্বপ্নের আমি ও অন্যরা’; কবিতার বই: ‘তুমি ও সবুজ ঘোড়া’, ‘একদিন সুবচনী হাঁস’। অনুবাদ করেছেন মনসুর আল-হাল্লাজের ‘কিতাব আল-তাওয়াসিন’ (২০১০), পাবলো নেরুদার ‘প্রশ্নপুস্তক’। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন ‘বাংলার ধর্ম ও দর্শন’।
তার ‘আগুন ও ছায়া’ উপন্যাসটি ২০১৪ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
‘স্মৃতি যেন কোনো অবলুপ্ত স্থাপত্যের জলমগ্ন সিঁড়ি’। কোনো একটি কবিতায় পেয়েছিলাম এই লাইনটা। কোন কবির লেখা, কী নাম কিছুই আর মনে পড়ে না। কিন্তু আজও মাথায় গেঁথে আছে স্মৃতি। গেঁথে আছে লাইনটির গভীর ব্যঞ্জনার অনুরণন। কোথায় কোনো পুরনো পুকুরে নিঃশব্দে জলের সবুজ অতলে ডুবে আছে অসংখ্য সিঁড়ি। সিঁড়িগুলোতে লেগে আছে অসংখ্য গল্প, লেগে আছে হাসি, কথা আনন্দিত সময়ের ঘ্রাণ। এসবের পুরোটা হয়তো বোঝা যায় না, মনেও পড়ে না। তবু কিছু দৃশ্যের টিকে থাকাটুকু টের পাওয়া যায়। স্মৃতি আমার কাছে এমনই। তলিয়ে যাওয়া বহু দৃশ্য, কথা আর মানুষের মুখচ্ছবি মিলেমিশে একটা বড় অস্তিত্ব হয়ে বেঁচে থাকে মনের মধ্যে।
তখন সস্তা সিগ্রেটের প্যাকেট পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াই এই ঢাকা শহরে। লেখালেখি করার চেষ্টা আর সাংবাদিকতা আমাকে ঘুরিয়ে মারছে বিভিন্ন পত্রিকা অফিস আর সাহিত্যিকদের ডেরায়। কাজ করি সাপ্তাহিক বিচিত্রা (এখন লুপ্ত) অফিসে। আমার সাংবাদিকতার জীবনে প্রথম সম্পাদক সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং শিল্পী শাহাদত চৌধুরী। শুধু সাংবাদিকতার তালিম নিয়েছি তার কাছে বললে ভুল বলা হবে। জীবনের বহু বাঁক চিনিয়েছিলেন তিনি আমাকে। মনের মধ্যে সেই বয়সে তৈরি করে দিয়েছিলেন ভিন্নভাবে বেঁচে থাকার স্পর্ধা। বিচিত্রা অফিসে নিয়মিত যেতাম। মতিঝিলের প্রায় কেন্দ্রে সেই অফিসটা সারা দিন মানুষের কলাহলে মুখর থাকত। শাহাদত ভাইকে দেখতাম নিজের দপ্তরে বসে ভাবতে আর কাজ করতে। তার একটা অদ্ভুত মুদ্রাদোষ বা অভ্যাস ছিল। তখন পৃথিবীতে কম্পিউটারের আবির্ভাব ঘটেনি। আমাদের লেখালেখির কাজটা করতে হতো সস্তা, লালচে একধরনের নিউজপ্রিন্ট কাগজের প্যাডে। শাহাদত ভাই যখন কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে যেতেন অথবা পত্রিকার জন্য প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের পরিকল্পনা করতেন, তিনি সেই প্যাডের একটার পর একটা সিøপ গভীর মগ্নতায় ছিঁড়তে থাকতেন। বিস্ময়কর হলো, ছেঁড়া প্যাডের পৃষ্ঠাগুলো প্রায় একই মাপে আড়াআড়িভাবে ছিঁড়ে ফেলতেন তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। দিন শেষে তার চেয়ারের পাশে ছেঁড়া কাগজের স্তূপ জমা হয়ে যেত। মনে আছে, একবার অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা আনমনে প্যাডের সিøপ ভেবে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তিনি। আনু মুহাম্মদ আশির দশকে সাপ্তাহিক বিচিত্রার একজন বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করতেন।
প্রখ্যাত দুই সাংবাদিক প্রয়াত নির্মল সেন ছিলেন আদি দৈনিক বাংলা পত্রিকার অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর। একটি রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিকদের নেতাও ছিলেন। কখনো তাকে মাড় দেওয়া সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবির বাইরে অন্য কোনো পোশাক পরিধান করতে দেখিনি। সেই শুভ্র পোশাকের মতো তার জীবনটাও ছিল পরিচ্ছন্ন। শুদ্ধাচারী, অকৃতদার নির্মল সেনের অভ্যাস ছিল গুনগুন করে গান গাওয়া। প্রায়ই দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সাব এডিটরদের বসার জায়গাটায় তাকে দেখেছি টেবিলে মৃদু তাল ঠুকে গান গাইতে। বেশির ভাগ সময় যে গানটা তিনি গাইতেন তা ছিল, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম...’।
এ রকম গানের সুর গুনগুন করতেন দেশের আরেক প্রখ্যাত প্রয়াত সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান। আলোচিত উইকলি হলিডে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। সাধারণত ছুটির দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সকালবেলা আগমন ঘটত এনায়েতুল্লাহ খানের। উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি পরতেন। একা হেঁটে যখন ক্লাবে ঢুকতেন দেখতাম গাড়ির চাবির রিংটা আঙুলে ঘোরাচ্ছেন আর গুনগুন করে গান গাইছেন। সাংবাদিক মহলে একবার গল্প প্রচলিত হয়েছিল, একজন উদীয়মান সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খানের আঙুলে গাড়ির চাবি ঘোরানোর ভঙ্গিটি নকল করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। তার আঙুল থেকে গাড়ির চাবি ছিটকে পড়ে যায় আশপাশের অন্ধকারে। আর তাতে ঘটেছিল মহা বিপত্তি। এনায়েতুল্লাহ খান ক্লাবে ঢুকে বিখ্যাত ডালপুরি আর চা অর্ডার করতেন। কখনো গভীর মনোযোগে পত্রিকা পড়তেন অথবা আমাদের মতো তরুণ সাংবাদিকদের ডেকে দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলতেন।
কবি রফিক আজাদ ছিলেন ভীষণ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। আশির দশকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় সম্পাদকের দপ্তরে বা নগরীর চেনা পানশালায় অথবা সাহিত্যিকদের তুমুল আড্ডায় তাকে দেখা যেত অন্যমনস্ক মুহূর্তে আঙুল দিয়ে নিজের গোঁফ টানতে। সেটাই ছিল রফিক ভাইয়ের একটি মুদ্রাদোষ বা বিশেষ স্বভাব। দুই প্রান্ত থেকে অনেকটা থার্ড ব্রাকেটের মতো নেমে আসা গোঁফ টানতে টানতে তাকে বহুদিন দেখেছি নির্জন পানশালার চেয়ারে একা বসে ভাবছেন। কী ভাবতেন রফিক ভাই তখন? হয়তো কবিতার কোনো চরণ।
ছোটখাটো দৈহিক আকৃতির মানুষ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। আমি তার সরাসরি ছাত্র ছিলাম। ছন্দ আর অলংকার শেখানোর ক্লাসে লেকচার দেওয়ার সময় কথার মাঝখানে গুঁজে দিতেন একটি প্রশ্ন, ‘তোমরা বুঝতে পেরেছ তো?’ কেমন সুরেলা ভঙ্গিতে একটু টেনে কথাটা বলতেন। তখন তার মুখ রসস্থ হয়ে থাকত পানের নির্যাসে। কিছুদিন পরে বুঝেছিলাম সেটা ছিল স্যারের মুদ্রাদোষ। অসংখ্য বাংলা কবিতা ও ছড়া তার কণ্ঠস্থ ছিল। প্রতিটি বর্ণের ওপর বাড়তি জোর দিয়ে ক্লাসে দরাজ গলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি। আর ছন্দের বারান্দায় হারিয়ে যেতে যেতে আমাদের উদ্দেশে ছুড়ে দিতেন সেই প্রশ্নটা।
বাংলাদেশের সাহিত্যে দুই কৃতী কথাশিল্পী মাহমুদুল হক আর বুলবুল চৌধুরী। দুজনই আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন চিরকালের মতো। তারা ব্যক্তিগত জীবনে একে অপরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সময়টা ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি। মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ অথবা ‘পাতালপুরী’ উপন্যাস পাঠ-পরবর্তী মুগ্ধতায় ভুগি। এই অনন্য কথাশিল্পীর ডাক নাম ছিল বটু। সবাই তাকে এ নামেই সম্বোধন করতেন। হঠাৎ একদিন অগ্রজ বন্ধু ও সাংবাদিক সৈয়দ শহীদ পরিচয় করিয়ে দেন বটু ভাইয়ের সঙ্গে। দেখি লেখালেখি থেকে প্রায় নির্বাসিত বটু ভাই বায়তুল মোকাররমের একটি জুয়েলারি দোকানে বসে আছেন। তিনি সেখানে বসে আংটির পাথরের ব্যবসা করেন। খুব অবাক হয়েছিলাম বটু ভাইয়ের হাতে বিভিন্ন ধরনের পাথর বসানো আংটি দেখে। ওই আংটিগুলোই একদা বটু ভাইয়ের সিগনেচার হয়ে ওঠে। বুলবুল চৌধুরীর যেমন ছিলেন দেখা হলেই বলা, ‘হ মিয়া, বহেন।’ কোনো আড্ডায় দেখা হলেই বুলবুল ভাই প্রথমেই এ কথাটা বলতেন। তার পর সময় গড়ালে কথার মাঝখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবেও তিনি ‘হ মিয়া’ কথাটা বলতেন।
এই কৃতী মানুষদের কথার চলন বা বিশেষ অভ্যাসগুলোই ছিল তাদের মুদ্রাদোষ। সেই মুদ্রাদোষগুলো একটা সময়ে আমাদের জীবনকে ঋদ্ধ করেছিল বলেই মনে হয় এখন। কত আড্ডা আর আলোচনায় এ প্রসঙ্গগুলো ঘুরেফিরে আসে আজও। অন্য রকম এক হাওয়া তোলে মনের মধ্যে। এই শহরের জীবন প্রবাহ এখন সেই মুদ্রাদোষগুলোকেই হারিয়ে ফেলেছে যেন।
ছুটির সকালে মর্নিংওয়াক করতে বের হন সালাম সাহেব। বাসা ফার্মগেট। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সেচ ভবনের কাছে। হাঁটা শেষে ফুটপাতে টাটকা সবজির বাজারে চোখ আটকায় তার। অন্যান্য বাজারের চেয়ে সবজিগুলো বেশ তরতাজা। তাই মর্নিংওয়াক থেকেই শুক্রবারের বাজারটা সেরে ফেলেন এখান থেকেই।
এটা কোনো স্থায়ী বাজার নয়। সপ্তাহের এক দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য বসে ‘কৃষকের বাজার’ নামে পরিচিত এ বাজার। এ বাজারের বিশেষত্ব এখানেই। এ বাজারে কৃষক সরাসরি তার পণ্য বিক্রি করতে আনতে পারেন। বাজারে পণ্য আনতে কাউকে কোনো খাজনা দিতে হয় না। উপরন্তু হাটে পণ্য আনতে এবং সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার বাবদ ১ হাজার করে টাকাও দেয় বাজার কর্র্তৃপক্ষ।
রাজধানীতে জনপ্রিয় হচ্ছে কৃষকের বাজার। দিন দিন বাড়ছে ক্রেতাদের আনাগোনা। প্রতিটি বাজারে বিক্রি বাড়ছে। বাড়ছে কৃষকের সংখ্যাও। এ বাজারগুলোতে গড়ে ৬০০-৮০০ ক্রেতা তাদের পছন্দ অনুযায়ী মাছ, মাংস, সবজিসহ অন্যান্য পণ্য কিনছেন।
কৃষকরা জানান, কয়েক ঘণ্টায় ১০-১২ লাখ টাকার লেনদেনও হচ্ছে এ বাজারে।
কৃষকরা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, প্রতি শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে কৃষকের বাজার শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিটি বাজারে কৃষক নিজেদের উৎপাদিত ফসল বৃহস্পতিবার রাত ৪টার আগেই নিজেদের নির্ধারিত জায়গায় বসে যান। ফজরের নামাজের পর ভোরে আলো পড়তে থাকলে বেচাবিক্রি শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে দেদার। তারপর কেনাবেচা কমতে থাকে। কৃষকের আনা পণ্যও কমতে থাকে। বেলা ৩টার মধ্যে সব পণ্য শেষ করে কৃষক বাড়ি ফেরেন। তারা বলেছেন, এ বাজার কর্র্তৃপক্ষ কৃষকের কাছ থেকে খাজনাবাবদ কোনো টাকা নেয় না। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও মালামাল পরিবহনের জন্য ১ হাজার করে টাকাও দেয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, এমবাসি অব দ্য কিংডম অব দ্য নেদারল্যান্ডস, সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের সম্মিলিত উদ্যোগে রাজধানীর ২০২১ সালের জুন মাসে প্রথম কৃষকের বাজার কর্মসূচি শুরু হয়েছিল মিরপুর ৬ নম্বরে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে বাজারের সংখ্যা। বর্তমানে ইস্কাটন গার্ডেন রোড রূপনগর, পল্লবী, কামরাঙ্গীরচর, টিকাটুলী, খিলগাঁও, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুরের আদাবর ও মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, আজিমপুর ও হাজারীবাগসহ ঢাকায় ১২টি, নারায়ণগঞ্জে দুটি ও গাজীপুরে দুটিসহ ১৬টি জায়গায় কৃষকের ও কৃষকের বাজার রয়েছে। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও হরটেক্স ফাউন্ডেশন এ বাজার পরিচালনা করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বাজার চালু হয়।
জাতীয় সংসদ ভবনের উল্টো দিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সেচ ভবনের পাশ ঘেঁষে বসা কৃষকের বাজারে কথা হয় জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত হবিগঞ্জ মাধবপুরে কৃষক আবদুল বাসেত বদু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার সবজি শতভাগ নিরাপদ। জৈব সার ছাড়া অন্য কোনা সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এখানে আমার বিক্রিও ভালো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমার সবজি খেয়েছেন।’
মুন্সীগঞ্জের কৃষক নুর ইসলাম বলেন, ‘এ বাজারে ৩০ জন কৃষক বসেন। সবাই সবার সেরাটাই এখানে নিয়ে আসে। কেউ ২০ হাজার টাকার সবজি নিয়ে এলে ২৫ হাজার বিক্রি হয়। কেউ আরও বেশি টাকার সবজি নিয়ে আসে। কারও সবজির সঙ্গে দামি ফলও থাকে। তাদের বিক্রি হয় আরও বেশি। সব মিলিয়ে গড়ে প্রতি কৃষক ৩০-৪০ হাজার বিক্রি হয়। সে হিসাবে এ বাজারে ১০-১২ লাখ টাকা লেনদেন হয়।’
ইস্কাটন গার্ডেনের কৃষকের বাজার ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, লাউ, বেগুন, বথুয়াশাক, লালশাক, মরিচ, পেঁপে, শিমসহ প্রায় ৫০ ধরনের সবজি পাওয়া যায়। এ ছাড়া দেশি মুরগি, দুধ, ডিমও আছে। এ বাজারের সাভারের হেমায়েতপুরের কৃষক শাজাহান মিয়া বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহ করি। এমনকি গ্রামের অন্য কৃষকের বিক্রিযোগ্য সবজি ন্যায্য দাম দিয়ে নিয়ে আসি। বিক্রি ভালো হয়। বাজার এখানে ভালোই চলছে। লাভও হয় মোটামুটি। এখানে বসার জন্য টাকা লাগে না, সবজি পরিবহনের কোনো খরচ দিতে হয়। সকালের নাশতা এমনকি দুপুরের খাবারের জন্য ১০০০ টাকা দেয় বাজার কর্র্তৃপক্ষ। সেটাই আমাদের লাভ। আমাদের এখানে ন্যায্য দামে সবকিছু পাওয়া যায়।’
বাজার করতে আসা ক্রেতা আসিফা সুলতানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শুরুতে ৮ থেকে ১০ জন কৃষকের দোকান ছিল। এখন ২৫ থেকে ৩০ জন আসেন। এখানে সবজি থেকে শুরু করে নানা জাতের দেশি ফলও পাওয়া যায়। মৎস্য অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ মাছের দোকানও আছে। আগে কখনো বাজারে যায়নি। বাসার কাছে বাজার পেয়ে আসা। এখানে ন্যায্যমূল্যে সবকিছু পাওয়া যায়।’ মগবাজারের তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারের সবজির মান ভালো।’
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ রকম কৃষকের বাজার যত বাড়বে, তত ভালো। যদি প্রতিদিন বসে তাহলে আরও ভালো। তবে বাজারে প্রকৃত কৃষক তার সবজি নিয়ে আসছে কি না সেটা নজরদারিতে রাখতে হবে। ক্রেতারা যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য পায় তাহলে কোনো কথাই থাকে না। এরকম বাজার বাড়লে অন্য বাজারে কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ আরিফ মো. মোজাক্কের দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কৃষি বাজারে আমাদের কাজ শুধু প্রকৃত কৃষক নির্বাচন করে দেওয়া। সবার সবজির মান খুবই ভালো। এর বাইরে আমরা কোনো কাজ করি না। তবে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠান যুক্ত তারা বাজার বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে।’
রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল বাশার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইস্কাটন গার্ডেনের বাজারে সাভারের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকের উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল, দুধ-ডিম, হাঁস-মুরগি, মাছ আনা হয়। এ বাজার আমার এলাকায় সাড়া ফেলেছে। এখানে কৃষক ফ্রিতে সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও মালামাল পরিবহনের ব্যবস্থা করে থাকে বাজার কর্তৃপক্ষ।’
দুর্নীতি দমন কমিশনার (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ বলেছেন, নির্বাচনের বছরে দুদক চোখ-কান খোলা রাখবে। আইন অনুসারে আমাদের যেটুকু অংশ, আমরা তা নিরপেক্ষভাবে পালনের চেষ্টা করব। আমরা সাধ্যমতো কাজ করছি।
মঙ্গলবার সেগুনবাগিচায় প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এক সংবাদ সন্সেলনে দুদক চেয়ারম্যান এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ও মো. জহুরুল হক এবং দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, নির্বাচনের বছরে সব প্রার্থীর হলফনামায় যে সম্পদ বিবরণী থাকে তা খতিয়ে দেখবে দুদক। এ বছর চোখ-কান খোলা রাখবে। সমস্ত প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে। আগামী বছরে দুদকের কাজে আরো গতিশীলতা আনার জন্য কাজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সোমবার রাতে বার্ষিক প্রতিবেদনটি (২০২২) রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে বলেছেন। দুদক স্বচ্ছতার সঙ্গে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবগত করা হয়েছে।
ফাঁদ মামলা কেন কমেছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা যতটুকু তথ্য পেয়েছি, সেই অনুসারে ফাঁদ মামলা হয়েছে। আমরা শতভাগ সফল হতে পারিনি। বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছর সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করেছি। ওই বছর এফআরটি কম হয়েছে। মামলা বেশি হয়েছে, এফআরটি কমেছে। সাজার হার বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে দুদক ঠিকমতো কাজ করছে না, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, মামলা, তদন্ত, অনুসন্ধান সব কিছুই বেড়েছে। আমাদের তথ্য কথা বলবে। তারা তাদের বক্তব্য দিয়েছে। আমরা তথ্য দিলাম, এগুলো সংরক্ষিত আছে। আপনারাই বিবেচনা করবেন।
এ সময় বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মামলাগুলো চলমান। এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি তিনি।
সম্প্রতি আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ খানের ‘অর্থপাচার’ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে দুদক চেয়ারম্যান জানান, এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই, পেলে কাজ করবে দুদক।
এদিকে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, দেশের টাকা বাইরে চলে গেছে। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়তো কাজ করতে পারেনি দুদক। পাচারকৃত অর্থ নিয়ে কাজ করে আরো অনেকগুলো সংস্থা। শুধু দুদকের একার কাজ নয় এটি। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি টাকা ফিরিয়ে আনার।
দুদকের অসন্তুষ্টির জায়গা কোনটি এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক বড় বড় দুর্নীতি বিশেষ করে দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেক দুর্নীতিবাজ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে গেছে। এই বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারিনি। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আমাদের মাত্র একটি অপরাধের এখতিয়ার আছে। বাকি ২৬টি অপরাধের বিষয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের এখতিয়ার। কিন্তু জনগণের মনে এখনো ভ্রান্ত ধারণা দুদক কী কাজ করে। কিন্তু আমাদের অংশে আমরা কাজ করি ও শতভাগ সাফল্য রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশেরে এক পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে দুদক কমিশনার জহুরুল হক বলেন, দেশে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বাড়ে নাই, বরং কমেছে। তবে আভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বন্ধ করতে পারিনি। মামলা পরিচালনা ক্ষমতা কমেছে এটা মিথ্যা কথা। কারণ মানিলন্ডারিং মামলায় ১০০ ভাগ সাফল্য, অন্যান্য মামলায় সাজার পরিমাণ ৬৭ থেকে ৭০ ভাগ আমাদের পক্ষে। আমাদের সক্ষমতা কমেছে কে এটা বলেছে। এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
দুদকের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে দুদকে জমা পড়ে ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগ। এসব যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সংস্থাটি হাতে নিয়েছে ৯০১টি অভিযোগ, যা মোট অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। অর্থাৎ ৯৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অভিযোগই অনুসন্ধানের জন্য আমলে নিতে পারেনি দুদক। ১৯ হাজার ৩৩৮টি অভিযোগের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২টি অভিযোগ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০২২ সালে চার্জশিট অনুমোদন হয়েছে ২২৪টি, মামলা হয়েছে ৪০৬টি, ফাঁদ মামলা হয়েছে মাত্র ৪টি।
২০২১-২২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় সাজা, নিষ্পত্তি ও খালাসের পরিমাণ বেড়েছে। এরমধ্যে গতবছর সংস্থাটির ৩৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এছাড়া এই সময়ে কমিশন আমলের ৬৪ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ব্যুরো আমলের ৩৫ দশমিক ৯০ মামলার আসামির সাজা হয়েছে। ২০২২ সালের দুদকের বার্ষিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। উপস্থাপনকালে এই তথ্য জানানো হয়।
ছেলে ইজহান মালিককে সঙ্গে নিয়ে ওমরাহ পালন করতে সৌদি আরবে রয়েছেন ভারতের সাবেক টেনিস তারকা সানিয়া মির্জা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করেছেন তিনি।
মঙ্গলবার ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে মনিদা শরীফে তোলা নিজের একাধিক ছবি পোস্ট করেন সানিয়া। ভিডিও পোস্ট করেছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা প্রথম ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সানিয়া তাকিয়ে আছেন তার ছেলের দিকে। সানিয়ার পরনে কালো রঙের বোরকা।
ছবিগুলো পোস্ট করে ক্যাপশনে সানিয়া লিখেছেন, ‘আলহামদুল্লিাহ। আল্লাহ আমাদের দোয়া কবুল করুন।’
সানিয়ার পোস্ট করা ছবিগুলোর কয়েকটিতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও রয়েছেন। তবে তার স্বামী পাকিস্তানি ক্রিকেটার শোয়েব মালিককে কোনোটাতেই দেখা যায়নি।
শুরুতেই হোঁচট খেল এক বছরে বিসিএস পরীক্ষা আয়োজনের বর্ষপঞ্জি। প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পিছিয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। প্রিলিমিনারির রেশ ধরে পেছাতে হবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার সূচিও।
অথচ এই বিসিএস দিয়েই বিজ্ঞাপন প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ এক বছরে শেষ করার ছক এঁকেছিল সাংবিধানিক সংস্থাটি। এ অবস্থায় বর্ষপঞ্জিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বর্ষপঞ্জি ৩০ নভেম্বর শুরু না করে ১ জানুয়রি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৪৬তম বিসিএস থেকে পরিবর্তিত এক বর্ষপঞ্জিতেই বিসিএস শেষ করার নতুন পরিকল্পনার খসড়া করা হয়েছে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন এক প্রশ্নের জবাবে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হয়। আমরা ৪৬তম বিসিএস থেকে বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করব।’
২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েই সোহরাব হোসাইন এক বছরের মধ্যে একটি বিসিএস শেষ করার কথা বলেছিলেন। চাকরি জীবনে খ্যাতিমান এই আমলা এগিয়েছিলেনও বহুদূর। তিনি যখন চেয়ারম্যান পদে যোগ দেন, তখন ৪০, ৪১, ৪২ ও ৪৩ বিসিএস চলমান ছিল। এর মধ্যে ৪০-এর সুপারিশ হয়ে গেছে। তারা ইতিমধ্যে চাকরিতে যোগ দিয়ে বিভিন্ন বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে কাজ করছেন। ৪১তম বিসিএসের অর্ধেক মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। মহামারির সময় চিকিৎসক নেওয়ার জন্য ৪২তম বিশেষ বিসিএস আয়োজন করা হয় এবং অল্প সময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। আর ১৫ দিনের মধ্যেই ৪৩তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ শেষ হবে। ৪৪তম বিসিএসের খাতা দেখার কাজ চলছে। বর্তমান চেয়ারম্যানের মূল টার্গেট ছিল এক বছরের মধ্যে ৪৫তম বিসিএস শেষ করা। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞাপনে বলে দেওয়া হয়েছিল মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র ছাপানোর জটিলতায় সূচি অনুযায়ী প্রিলিমিনারি নিতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপাতে না পারার কারণ জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পিএসসি সচরাচর বিজিপ্রেস থেকেই প্রশ্নপত্র ছাপাত।
বিসিএস বর্ষপঞ্জি কিন্তু কয়েক বছর আগে সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠায় বিজিপ্রেস থেকে সরে আসে পিএসসি। তারা একটা বিশেষ জায়গা থেকে এ প্রশ্নপত্র ছাপায়। ৪৫তম বিসিএসে ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। ৬ সেট প্রশ্ন ছাপাতে হয়। সেই হিসাবে প্রায় ২১ লাখ প্রশ্নপত্র ছাপানোর প্রক্রিয়া সময়মতোই শুরু করে পিএসসি। দরসহ বিভিন্ন জটিলতায় ছাপার কাজ আটকে যায়। চেষ্টা করেও কিছু বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় প্রশ্নপত্র ছাপাতে পারেনি পিএসসি।
প্রশ্নপত্র ছাপানোর বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতৈক্য হলেও শিগগিরই প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিতে পারছে না। ২৩ বা ২৪ মার্চ রোজা শুরু হবে। রোজায় এ বিশাল পরীক্ষা আয়োজনের কোনো রেওয়াজ নেই। পিএসসিও চায় না নতুন করে এর নজির তৈরি করতে। কাজেই মে মাসের আগে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ নেই। এদিকে মে মাসজুড়ে থাকবে এসএসসি পরীক্ষা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ না হলে প্রিলিমিনরি নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ বিভাগীয় শহরের অনেক স্কুলে উভয় পরীক্ষার সিট পড়ে। সেই হিসেবে জুন মাসের আগে প্রিলিমিনারি নিতে পারছে না পিএসসি। এতে করে চার মাস পিছিয়ে যাবে ৪৫তম বিসিএসের সব ধরনের পরীক্ষা।
এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিএসসি একটি বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করতে দীর্ঘ সময় নিচ্ছে। একটা বিসিএসে আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর লেগে যাচ্ছে। এ থেকে পিএসসিকে বের হয়ে আসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে ছেলেমেয়েরা কাজবিহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ-তরুণী পরিবারের ভরসাস্থল। তাদের দিকে চেয়ে থাকে পুরো পরিবার। বেকারত্বের বিষয়টি পিএসসিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই অল্প সময়ে পরীক্ষা নেওয়া থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করতে পারবে। আগে অল্প দিনের মধ্যে সুপারিশ করতে পারলে এখন কেন পারবে না? আগের চেয়ে পিএসসির সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
এই সংকট থেকে কীভাবে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে জানতে চাইলে কমিশনের একজন সদস্য বলেন, পিএসসি এই সংকট থেকে শিক্ষা নিয়েছে। পরের অর্থাৎ ৪৬তম বিসিএস থেকে যেন এক বছরের মধ্যেই বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ করা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি শেষ করা যায়, সেই চেষ্টা এখনই শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা বিসিএস সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সাধারণত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার এক মাস আগে পিএসসির একজন সদস্যকে ওই বিসিএসটি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্ব এখনই একজন সদস্যকে দেওয়া হয়েছে। ওই বিসিএস সমন্বয় করবেন কমিশনের সদস্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ফয়েজ আহমেদ।
কমিশনের সদস্য ও পিএসসি সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পিএসসির সদস্যরা একমত হয়েছেন ৩০ নভেম্বর বিজ্ঞাপন প্রকাশ না করে ১ জানুয়ারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। এতে প্রচলিত ক্যালেন্ডার ইয়ার ঠিক থাকবে। এখন প্রশ্ন উঠেছে এই বর্ধিত সময়ে যাদের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাবে তাদের কী হবে। সেই সমস্যাটিও আলোচনা করে মোটামুটি সেরে রেখেছেন সদস্যরা। ৪৬তম বিসিএসে যারা বয়সের ফেরে পড়বেন তাদের বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে। খুব শিগগির ওই বিসিএসের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন শুরু হবে। এখন সমস্যা দেখা দিয়েছে সিলেবাস নিয়ে। সিলেবাস পরিবর্তনের জন্য পিএসসি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান থাকলেও সেই কাজ ৪৬ বিসিএসের আগে শেষ হবে না। কাজেই এক বছর আগেই প্রশ্নপত্র ছাপানোর কাজেও কোনো জটিলতা দেখছেন না পিএসসির সদস্যরা।
কিছুদিন ধরে পিএসসি সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিলেবাসে পরিবর্তন আনা সেই সংস্কারেরই অংশ। পিএসসি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে চায়। মুখস্থ বিদ্যাধারীদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যও তারা সিলেবাসে আমূল বদল আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায়ও পরিবর্তন এনেছে। কোনো চাকরি প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষায় তার জেলার নাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম জিজ্ঞেস করা যাবে না। এ ধরনের প্রশ্নে স্বজনপ্রীতি হয় বলে পিএসসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিসিএস পরীক্ষার আবেদন থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পিএসসি। পিএসসির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য পর্যন্ত চাকরি প্রার্থীর কোনো ব্যক্তিগত তথ্য জানতে পারবেন না। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার উভয় পরীক্ষার প্রার্থীদের তথ্য গোপন রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে গত ৫ জানুয়ারি অফিস আদেশ জারি করেছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন সচিবালয়। আদেশে বলা হয়েছে, ক্যাডার ও নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সুপারিশ পর্যন্ত প্রার্থীর সব তথ্য ‘কোডেড ফরম্যাটে’ থাকবে। বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সব তথ্যের কোডিং ও ডি-কোডিংয়ের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করবে। কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য প্রয়োজন হলে কমিশনের চেয়ারম্যানের অনুমোদন নিয়ে ডি-কোডিং করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ওই অফিস আদেশে।
৪৫তম বিসিএসে আবেদন করেছেন ৩ লাখ ৪৬ হাজার প্রার্থী। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পিএসসির ওয়েবসাইটে ৪৫তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ১০ ডিসেম্বর আবেদন শুরু হয়ে শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। এই বিসিএসে মোট ২ হাজার ৩০৯ জন ক্যাডার নেওয়া হবে। নন-ক্যাডারে নেওয়া হবে ১ হাজার ২২ জনকে। ক্যাডারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ হবে চিকিৎসায়। সহকারী ও ডেন্টাল সার্জন মিলিয়ে ৫৩৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে। চিকিৎসার পর সবচেয়ে বেশি শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাবেন ৪৩৭ জন। এরপর পুলিশে ৮০, কাস্টমসে ৫৪, প্রশাসনে ২৭৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্কোর কার্ডে জ্বলজ্বল করছে, বাংলাদেশ ১৬ রানে জয়ী। তবুও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না! বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে ঘরের মাঠে ৩-০ ব্যবধানে হারিয়ে বাংলাওয়াশ, তাও টি-টোয়েন্টিতে। ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে এসে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন, তাদের সুদূরতম কল্পনাতেও ছিল না এই ফল। লক্ষ্য ছিল ভালো ক্রিকেট খেলা, সে তো সবসময়ই থাকে। তবে বিশ্বকাপ জেতা ইংল্যান্ডকে ঠিক পরের টি-টোয়েন্টি সিরিজেই ৩-০-তে হারিয়ে দেওয়াটা যে স্বপ্নেরও সীমানা ছাড়িয়ে।
স্বপ্ন আর বাস্তবতার ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে মেহেদী হাসান মিরাজের একটা থ্রো। ইংল্যান্ডের ইনিংসের ১৪তম ওভারে বল করছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। আগের বলেই পেয়েছেন ডাভিড মালানের উইকেট। নতুন আসা ব্যাটসম্যান বেন ডাকেট। বলে ব্যাট লাগিয়েই ছুটলেন ডাকেট, অন্যপ্রান্ত থেকে জস বাটলার এসে স্ট্রাইকিং প্রান্তে পৌঁছানোর আগেই পয়েন্ট থেকে মিরাজের অসাধারণ থ্রো ভেঙে দেয় স্টাম্প। পরপর দুই বলে আউট দুই সেট ব্যাটসম্যান। তাতে রঙ বদলে যায় ম্যাচের। ১ উইকেটে ১০০ রান থেকে ৩ উইকেটে ১০০ রানে পরিণত হয় ইংল্যান্ড, দুই প্রান্তে তখন দুই নতুন ব্যাটসম্যান। সেখান থেকে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি টি-টোয়েন্টির চ্যাম্পিয়নরা। পুরস্কার বিতরণ মঞ্চে তাই আক্ষেপ করেই জস বাটলার বললেন, ‘পরপর দুই বলে দুই উইকেট হারানোটা খুব বাজে হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের ম্যাচটা হারিয়েছে। আমি কেন যে ডাইভ দিলাম না এ নিয়ে খুব আফসোস হচ্ছে।’
২৪০ বলের ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ব্যবধান গড়ে দিয়েছে আসলে ওই দুটো বলের ঘটনাই। মালান যেভাবে খেলছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পুনরাবৃত্তিই হবে। ঢাকা লিগ ও বিপিএল খেলে যাওয়া মালান জানেন এই উইকেটে রান তোলার কৌশল, যা দেখিয়েছেন প্রথম ওয়ানডেতে ম্যাচ জেতানো শতরানের ইনিংস খেলে। কালও মনে হচ্ছিল মালানই তীরে তরী ভিড়িয়ে নেবেন, কিন্তু মোস্তাফিজের অল্প একটু বাড়তি লাফিয়ে ওঠা বলে পুল করতে গিয়ে গড়বড় করে ফেললেন এ বাঁহাতি। ক্যাচ দিলেন উইকেটের পেছনে যেটা তালুবন্দি করতে ভুল করেননি লিটন দাস। পরের বলে বাটলারের পড়িমরি করে ছুটেও রান সম্পূর্ণ করতে না পারা, মিরাজের দারুণ থ্রোর কাছে পরাস্ত হওয়া। এ দুটো বলই আসলে জয় ছিনিয়ে নিয়েছে ইংল্যান্ডের। অথচ একটা সময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ছুড়ে দেওয়া ১৫৯ রানের লক্ষ্য ভালোভাবেই উতরে যাবে ইংলিশরা। টস জিতে আগে বোলিং নেন বাটলার। লিটন ও রনি তালুকদারের ৫৫ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন আদিল রশিদ, রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে বোলারের হাতে ক্যাচ দেন ২২ বলে ২৪ রান করা রনি। অবশ্য তার ইনিংসের ইতি ঘটতে পারত আগেই, রনির ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন রেহান আহমেদ। জীবন পেয়েছেন লিটনও, তার ক্যাচ ছেড়েছেন বেন ডাকেট। ১৪তম ওভারের প্রথম বলে লিটন ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন ডিপ-মিডউইকেটে, কিন্তু ডাকেট বলটা হাতে জমাতে পারেননি। দুবারই দুর্ভাগা বোলারটির নাম জোফরা আর্চার।
৫৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলে আউট হন লিটন, নাজমুল হোসেন শান্ত অপরাজিত থাকেন ৩৬ বলে ৪৭ রান করে। শেষ ৫ ওভারে রান তোলার গতিটা কমে আসে বাংলাদেশের। ১৫ ওভার পর যেখানে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ১৩১, সেখানে বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হয় ২ উইকেটে ১৫৮ রানে। শেষ ৩০ বলে ৯ উইকেট হাতে রেখে বাংলাদেশ তোলে মাত্র ২৭ রান তখন মনে হচ্ছিল বেশ ভালো ব্যাটিং উইকেটে অন্তত ২০-২৫টা রান কম হয়েছে বাংলাদেশের।
ব্যাটিংয়ের শেষটা আর বোলিংয়ের শুরুটা, দুটো পক্ষে যায়নি বাংলাদেশের। অভিষিক্ত তানভীর ইসলাম ফিল সল্টকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন শুরুতেই। তাসকিন আহমেদের বলে ডাভিড মালানের বিপক্ষে মাঠের আম্পায়ার এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত দিলেও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান তিনি। বাটলারকে নিয়ে গড়েন ৭৬ বলে ৯৫ রানের জুটি। তাদের ব্যাটে ইংল্যান্ড ছিল জয়ের দিশাতেই কিন্তু পরপর দুই বলে দুই সেট ব্যাটসম্যানের বিদায়ে বিপদে পড়া ইংল্যান্ড আর বেরিয়ে আসতে পারেনি হারের বৃত্ত থেকে। একে একে মইন আলি (৯), বেন ডাকেট (১১) ও স্যাম কারেনের (৪) উইকেট হারিয়ে বাড়তে থাকা রান রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর পারেনি টি-টোয়েন্টির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ২৭ রান, ক্রিস ওকস প্রথম দুই বলে দুটি চার মারলেও পরের বলগুলোতে আর পাননি বাউন্ডারির দেখা। ইংল্যান্ড থেমে যায় ৬ উইকেটে ১৪২ রানে, ১৬ রানের জয়ে সিরিজ ৩-০-তে জিতে নেয় বাংলাদেশ।
দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের, তবে তার সঙ্গে মিশে আছে ঘরের মাঠে পছন্দসই উইকেট বানিয়ে জেতার সমালোচনাও। এবারের সিরিজ জয়ে সেই কালিমা নেই, বরং আছে বিশ্বজয়ীদের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জেতার গর্ব। সাকিব তাই নির্দ্বিধায় বললেন, ‘সিরিজ শুরুর আগে কেউ চিন্তাও করিনি আমাদের ম্যাচ জিততে হবে বা এমন কিছু। আমরা খুব ভালো ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। তিন ম্যাচেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাটিংয়ে যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা, বোলিংয়ে, ফিল্ডিংটা আমাদের তিনটি ম্যাচেই আমার মনে হয় অসাধারণ ফিল্ডিং করেছে।’
ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং তিন বিভাগেই ভালো করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ জিতল বাংলাদেশ। সেটাও টি-টোয়েন্টিতে, যে সংস্করণে বাংলাদেশের সাফল্য খুব একটা নেই। সাকিব এ সাফল্যের কৃতিত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগকে। যেখানে ভালো করা ক্রিকেটাররাই ভালো করেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। তাতেই এসেছে অবিস্মরণীয় এই জয়, যে অর্জন টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশকে চেনাল নতুন করে।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার খরচে আকাশপাতাল পার্থক্য। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সময় একজন শিক্ষার্থীকে শুধু ভর্তি ফি হিসেবে এককালীন গড়ে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। কিন্তু একটি বেসরকারি কলেজে দিতে হবে ২১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ও ইন্টার্নশিপ ফি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ খরচ সরকারি মেডিকেলের চেয়ে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৪২ গুণ বেশি।
একইভাবে এ বছর একজন বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে টিউশন ফি দিতে হবে। এ জন্য তার পাঁচ বছরে খরচ হবে ৬ লাখ টাকা। অথচ সরকারি কলেজে এ ফি বছরে গড়ে ৭ হাজার টাকা করে পাঁচ বছরে মোট ৩৫ হাজার টাকা। সে হিসাবে এ ক্ষেত্রে একজন বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীকে সব মিলে গড়ে পাঁচ বছরে ৫৪ গুণ বেশি টাকা গুনতে হবে।
এ বছর ইতিমধ্যেই সরকার বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি, ইন্টার্নশিপ ও মাসিক টিউশন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। সে হিসাবে দেখা গেছে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজে গত বছরের তুলনায় ভর্তি ফি ১৭ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। গত বছর ভর্তি ফি ছিল ১৬ লাখ ২০ হাজার ও মাসিক টিউশন ফি ছিল ৮ হাজার টাকা। এবার ভর্তি ফি ৩ লাখ ২৪ হাজার বাড়িয়ে ১৯ লাখ ৪৪ হাজার এবং মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করেছে। সে হিসাবে এ বছর একজন শিক্ষার্থীকে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে এবং পাঁচ বছরে টিউশন ফি দিতে মোট ব্যয় হবে ২৭ লাখ ২৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের চেয়ে ৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা বেশি। অর্থাৎ মোট ব্যয় ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে শিক্ষা ব্যয়ের এ তারতম্য দেখা গেছে।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সরকারের বেঁধে দেওয়া ভর্তি ফি ‘অত্যধিক’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও চিকিৎসা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. রশিদন্ডই-মাহবুব। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে কোনো শিক্ষাই সস্তা না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এ ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কঠিন। প্রাইভেট সেক্টরে যারা ভর্তি হয়, অর্থনৈতিকভাবে তারা সাধারণ না। আর ৬০ শতাংশ মেধাবী তারা সরকারি মেডিকেলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে তাদের যারা মেডিকেলে পড়তে চায়, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, তাদের জন্য। এই গ্রুপটাকে যদি সরকার নিতে চায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের মতো এখানেও তাদের সরকার থেকে লোন দিতে হবে। এর বিকল্প নেই।’ তবে এ ফি যৌক্তিক বলে মনে করছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখনকার প্রেক্ষাপটে বেসরকারি ফি খুব বেশি না। আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের দেশে এ খরচ অনেক কম। ভারতে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে ১ কোটি থেকে দেড় কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে ৩৫ লাখ টাকা লাগে। সে তুলনায় আমাদের এখানে অনেক কম। তাই বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাপ বেশি। যে ৪৫ শতাংশের কথা বলা হয়, তার বেশিরভাগই ভারতীয় শিক্ষার্থী। এ ছাড়া নেপাল ও ভুটান থেকেও শিক্ষার্থী আসে।’
বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফিতে শৃঙ্খলা আনতে পাঁচ বছর পর এবার ফি বাড়ানো হলো বলে জানান স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি ফি ৩ লাখ টাকার মতো বেড়েছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ ফি বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বেসরকারি মেডিকেলের খরচও বেড়েছে। আমরা চেয়েছি বেসরকারি কলেজগুলো যেন নির্দিষ্ট ফি নেয়। পেছনের তালিকা থেকে ভর্তি করানোর লোভ দেখিয়ে যেন বেশি ফি নিতে না পারে। সে জন্যই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ভর্তিতে যেন গোপন কোনো লেনদেন না হয়, সে জন্য ফি বাড়ানো হয়েছে।’
গত রবিবার এ বছরের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে পারবে ১১ হাজার ১২২ জন। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন ৪ হাজার ৩৫০টি এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২টি। মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন।
সরকারি মেডিকেল কলেজে ২৭ মার্চ থেকে ভর্তি শুরু হয়ে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। এই ভর্তি শেষ হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে।
এবার আয় ২ হাজার কোটি টাকা : এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে মোট আসন ৬ হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ হাজার ৪৭টি আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবে দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে দেখা যায় না। সে হিসাবে এ বছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের ৫ হাজার ২৭২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হবেন। এসব শিক্ষার্থীর প্রত্যেককে ভর্তির সময় এককালীন ভর্তি ফি ও ইন্টার্নশিপ ফি হিসেবে ২১ লাখ ২৪ হাজার এবং প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা হিসেবে পাঁচ বছরে ৬ লাখ টাকা টিউশন ফি দিতে হবে। সে হিসাবে মোট আয় হবে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কলেজ কর্র্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে। এ বছর বড় মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে। সে হিসেবে দেড় হাজার বিদেশি শিক্ষার্থী থেকে আয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই শিক্ষাবর্ষে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী মিলে ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের আয় হবে ২ হাজার ১৮৬ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
বিদেশিদের ফি ৫০ লাখ টাকা : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজ কর্র্তৃপক্ষ ফি নির্ধারণ করে। তবে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এবার ফি খুব একটা বাড়ানো হয়নি। ৩৫ লাখ টাকার মতো ফি নির্ধারণ করা আছে। একটা কলেজ সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ আসনে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে। কিন্তু ৭১টা বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪-৫টা মেডিকেল কলেজে ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। ১৫-২০টাতে কোনো বিদেশি শিক্ষার্থীই নেই।
তবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো একজন বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য মোট ফি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করেছে এবং এই টাকা ভর্তির সময় এককালীন দিতে হবে বলে জানিয়েছেন কলেজের কর্মকর্তারা।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের অফার লেটার দিচ্ছি। তারা টাকা জমা দিচ্ছে। গত বছর ৫০ জন নিয়েছিলাম। এবার এরকম বা কিছু কম নেব। ওদের ফি ৫০ লাখ টাকা সবমিলে।’
আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তি টিউশন ও ইন্টার্নশিপ ফিসহ মোট ফি ৫০ লাখ টাকা।
ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে কলেজগুলো তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভর্তি করায়। আমরা গত বছর ৩৯ জন নিয়েছি। সাধারণত ভর্তি ফি ৩০-৪০ লাখ টাকার মধ্যেই থাকে।’
সরকারি মেডিকেলে ঢাকার বাইরে ফি বেশি : অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল জানান, সরকারি মেডিকেলের ফি খুবই কম। যেসব মেডিকেলে খরচ বেশি, হোস্টেল খরচ বেশি, তারা ১৫ হাজার টাকা নেয়। তবে ঢাকার বাইরের মেডিকেল কলেজে ভর্তি ফি ২০-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয় বলে বেশ কিছু কলেজ থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারি মেডিকেল কলেজে এ বছরের ভর্তি ফি এখনো নির্ধারণ হয়নি। গত বছর ১০-১১ হাজার টাকা ছিল। তবে কোনো কোনো মেডিকেল কলেজ ১৫-২০ হাজার টাকা নেয়। সব মেডিকেল কলেজে একই ফি নির্ধারণের একটা চেষ্টা গত বছর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর করেছিল। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি। ঢাকায় ১০-১৫ হাজার টাকার মধ্যেই থাকে।’
কিশোরগঞ্জের সরকারি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিকেল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিকেলে ৫০-৫২টা সিট ও বড় কলেজে ২৩০টার মতো।’
একই কলেজের এক ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থী বলেন, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার। ছয় মাস পরপর ২১০০ টাকা দিতাম পরীক্ষার ফির জন্য।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।