
‘স্মৃতি যেন কোনো অবলুপ্ত স্থাপত্যের জলমগ্ন সিঁড়ি’। কোনো একটি কবিতায় পেয়েছিলাম এই লাইনটা। কোন কবির লেখা, কী নাম কিছুই আর মনে পড়ে না। কিন্তু আজও মাথায় গেঁথে আছে স্মৃতি। গেঁথে আছে লাইনটির গভীর ব্যঞ্জনার অনুরণন। কোথায় কোনো পুরনো পুকুরে নিঃশব্দে জলের সবুজ অতলে ডুবে আছে অসংখ্য সিঁড়ি। সিঁড়িগুলোতে লেগে আছে অসংখ্য গল্প, লেগে আছে হাসি, কথা আনন্দিত সময়ের ঘ্রাণ। এসবের পুরোটা হয়তো বোঝা যায় না, মনেও পড়ে না। তবু কিছু দৃশ্যের টিকে থাকাটুকু টের পাওয়া যায়। স্মৃতি আমার কাছে এমনই। তলিয়ে যাওয়া বহু দৃশ্য, কথা আর মানুষের মুখচ্ছবি মিলেমিশে একটা বড় অস্তিত্ব হয়ে বেঁচে থাকে মনের মধ্যে।
তখন সস্তা সিগ্রেটের প্যাকেট পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াই এই ঢাকা শহরে। লেখালেখি করার চেষ্টা আর সাংবাদিকতা আমাকে ঘুরিয়ে মারছে বিভিন্ন পত্রিকা অফিস আর সাহিত্যিকদের ডেরায়। কাজ করি সাপ্তাহিক বিচিত্রা (এখন লুপ্ত) অফিসে। আমার সাংবাদিকতার জীবনে প্রথম সম্পাদক সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং শিল্পী শাহাদত চৌধুরী। শুধু সাংবাদিকতার তালিম নিয়েছি তার কাছে বললে ভুল বলা হবে। জীবনের বহু বাঁক চিনিয়েছিলেন তিনি আমাকে। মনের মধ্যে সেই বয়সে তৈরি করে দিয়েছিলেন ভিন্নভাবে বেঁচে থাকার স্পর্ধা। বিচিত্রা অফিসে নিয়মিত যেতাম। মতিঝিলের প্রায় কেন্দ্রে সেই অফিসটা সারা দিন মানুষের কলাহলে মুখর থাকত। শাহাদত ভাইকে দেখতাম নিজের দপ্তরে বসে ভাবতে আর কাজ করতে। তার একটা অদ্ভুত মুদ্রাদোষ বা অভ্যাস ছিল। তখন পৃথিবীতে কম্পিউটারের আবির্ভাব ঘটেনি। আমাদের লেখালেখির কাজটা করতে হতো সস্তা, লালচে একধরনের নিউজপ্রিন্ট কাগজের প্যাডে। শাহাদত ভাই যখন কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে যেতেন অথবা পত্রিকার জন্য প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের পরিকল্পনা করতেন, তিনি সেই প্যাডের একটার পর একটা সিøপ গভীর মগ্নতায় ছিঁড়তে থাকতেন। বিস্ময়কর হলো, ছেঁড়া প্যাডের পৃষ্ঠাগুলো প্রায় একই মাপে আড়াআড়িভাবে ছিঁড়ে ফেলতেন তিনি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। দিন শেষে তার চেয়ারের পাশে ছেঁড়া কাগজের স্তূপ জমা হয়ে যেত। মনে আছে, একবার অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের একটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা আনমনে প্যাডের সিøপ ভেবে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন তিনি। আনু মুহাম্মদ আশির দশকে সাপ্তাহিক বিচিত্রার একজন বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করতেন।
প্রখ্যাত দুই সাংবাদিক প্রয়াত নির্মল সেন ছিলেন আদি দৈনিক বাংলা পত্রিকার অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর। একটি রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিকদের নেতাও ছিলেন। কখনো তাকে মাড় দেওয়া সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবির বাইরে অন্য কোনো পোশাক পরিধান করতে দেখিনি। সেই শুভ্র পোশাকের মতো তার জীবনটাও ছিল পরিচ্ছন্ন। শুদ্ধাচারী, অকৃতদার নির্মল সেনের অভ্যাস ছিল গুনগুন করে গান গাওয়া। প্রায়ই দৈনিক বাংলা পত্রিকায় সাব এডিটরদের বসার জায়গাটায় তাকে দেখেছি টেবিলে মৃদু তাল ঠুকে গান গাইতে। বেশির ভাগ সময় যে গানটা তিনি গাইতেন তা ছিল, ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদির নাম...’।
এ রকম গানের সুর গুনগুন করতেন দেশের আরেক প্রখ্যাত প্রয়াত সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খান। আলোচিত উইকলি হলিডে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি। সাধারণত ছুটির দিনে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সকালবেলা আগমন ঘটত এনায়েতুল্লাহ খানের। উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি পরতেন। একা হেঁটে যখন ক্লাবে ঢুকতেন দেখতাম গাড়ির চাবির রিংটা আঙুলে ঘোরাচ্ছেন আর গুনগুন করে গান গাইছেন। সাংবাদিক মহলে একবার গল্প প্রচলিত হয়েছিল, একজন উদীয়মান সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খানের আঙুলে গাড়ির চাবি ঘোরানোর ভঙ্গিটি নকল করতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। তার আঙুল থেকে গাড়ির চাবি ছিটকে পড়ে যায় আশপাশের অন্ধকারে। আর তাতে ঘটেছিল মহা বিপত্তি। এনায়েতুল্লাহ খান ক্লাবে ঢুকে বিখ্যাত ডালপুরি আর চা অর্ডার করতেন। কখনো গভীর মনোযোগে পত্রিকা পড়তেন অথবা আমাদের মতো তরুণ সাংবাদিকদের ডেকে দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলতেন।
কবি রফিক আজাদ ছিলেন ভীষণ আড্ডাপ্রিয় মানুষ। আশির দশকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় সম্পাদকের দপ্তরে বা নগরীর চেনা পানশালায় অথবা সাহিত্যিকদের তুমুল আড্ডায় তাকে দেখা যেত অন্যমনস্ক মুহূর্তে আঙুল দিয়ে নিজের গোঁফ টানতে। সেটাই ছিল রফিক ভাইয়ের একটি মুদ্রাদোষ বা বিশেষ স্বভাব। দুই প্রান্ত থেকে অনেকটা থার্ড ব্রাকেটের মতো নেমে আসা গোঁফ টানতে টানতে তাকে বহুদিন দেখেছি নির্জন পানশালার চেয়ারে একা বসে ভাবছেন। কী ভাবতেন রফিক ভাই তখন? হয়তো কবিতার কোনো চরণ।
ছোটখাটো দৈহিক আকৃতির মানুষ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস। আমি তার সরাসরি ছাত্র ছিলাম। ছন্দ আর অলংকার শেখানোর ক্লাসে লেকচার দেওয়ার সময় কথার মাঝখানে গুঁজে দিতেন একটি প্রশ্ন, ‘তোমরা বুঝতে পেরেছ তো?’ কেমন সুরেলা ভঙ্গিতে একটু টেনে কথাটা বলতেন। তখন তার মুখ রসস্থ হয়ে থাকত পানের নির্যাসে। কিছুদিন পরে বুঝেছিলাম সেটা ছিল স্যারের মুদ্রাদোষ। অসংখ্য বাংলা কবিতা ও ছড়া তার কণ্ঠস্থ ছিল। প্রতিটি বর্ণের ওপর বাড়তি জোর দিয়ে ক্লাসে দরাজ গলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি। আর ছন্দের বারান্দায় হারিয়ে যেতে যেতে আমাদের উদ্দেশে ছুড়ে দিতেন সেই প্রশ্নটা।
বাংলাদেশের সাহিত্যে দুই কৃতী কথাশিল্পী মাহমুদুল হক আর বুলবুল চৌধুরী। দুজনই আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছেন চিরকালের মতো। তারা ব্যক্তিগত জীবনে একে অপরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সময়টা ছিল আশির দশকের মাঝামাঝি। মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’ অথবা ‘পাতালপুরী’ উপন্যাস পাঠ-পরবর্তী মুগ্ধতায় ভুগি। এই অনন্য কথাশিল্পীর ডাক নাম ছিল বটু। সবাই তাকে এ নামেই সম্বোধন করতেন। হঠাৎ একদিন অগ্রজ বন্ধু ও সাংবাদিক সৈয়দ শহীদ পরিচয় করিয়ে দেন বটু ভাইয়ের সঙ্গে। দেখি লেখালেখি থেকে প্রায় নির্বাসিত বটু ভাই বায়তুল মোকাররমের একটি জুয়েলারি দোকানে বসে আছেন। তিনি সেখানে বসে আংটির পাথরের ব্যবসা করেন। খুব অবাক হয়েছিলাম বটু ভাইয়ের হাতে বিভিন্ন ধরনের পাথর বসানো আংটি দেখে। ওই আংটিগুলোই একদা বটু ভাইয়ের সিগনেচার হয়ে ওঠে। বুলবুল চৌধুরীর যেমন ছিলেন দেখা হলেই বলা, ‘হ মিয়া, বহেন।’ কোনো আড্ডায় দেখা হলেই বুলবুল ভাই প্রথমেই এ কথাটা বলতেন। তার পর সময় গড়ালে কথার মাঝখানে অপ্রাসঙ্গিকভাবেও তিনি ‘হ মিয়া’ কথাটা বলতেন।
এই কৃতী মানুষদের কথার চলন বা বিশেষ অভ্যাসগুলোই ছিল তাদের মুদ্রাদোষ। সেই মুদ্রাদোষগুলো একটা সময়ে আমাদের জীবনকে ঋদ্ধ করেছিল বলেই মনে হয় এখন। কত আড্ডা আর আলোচনায় এ প্রসঙ্গগুলো ঘুরেফিরে আসে আজও। অন্য রকম এক হাওয়া তোলে মনের মধ্যে। এই শহরের জীবন প্রবাহ এখন সেই মুদ্রাদোষগুলোকেই হারিয়ে ফেলেছে যেন।
ভেতরে দল গোছানোর পাশাপাশি নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নিবন্ধন বাতিল হলেও একাদশ সংসদের মতো আগামী নির্বাচনেও অংশ নেবে দলটি। যদিও জামায়াতের নেতারা বলছেন, তাদের দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না।
জামায়াতের জোরেশোরে নির্বাচন প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে দলটির নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, জামায়াত নির্বাচনমুখী একটি রাজনৈতিক দল। সব সময়ই মাঠপর্যায়ে প্রার্থী যাচাই-বাছাই চলে। ইতিমধ্যে তারা ১২০টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।
জামায়াত আগামীতে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মতো কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবে না দাবি করে ওই নেতারা বলেন, একক নির্বাচন করলেও আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে জামায়াত অংশ নেবে না। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে সক্রিয় থাকবে।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়।’ তিনি বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন। এ আন্দোলনকে সফল করার পর নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃণমূলে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিয়ে বেশি ব্যস্ত রয়েছেন দলটির নেতারা। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে তা আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নয়। কারণ বর্তমান সরকারের অধীনে বিগত দিনে যে দুটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে তাতে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। আগামী নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হলে সে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারবে না। সে জন্য আমরা এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না।’
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির দুটিতে অংশ নিলেও পরে জামায়াত আর বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে নেই। বিএনপিও আপাতত জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত বগুড়ার সাতটি আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। অন্য দুটিতেও প্রস্তুতি শুরু করেছে জামায়াত। প্রার্থী চূড়ান্ত করার আগে বিভিন্ন আসনে জরিপ পরিচালনা করছে দলটি। জরিপের রিপোর্ট অনুযায়ী দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি দেশের বিভিন্ন আসনে প্রার্থী নির্বাচন করতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি জেলায় আসন এবং প্রার্থীর নাম নির্বাচন করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের মাঠে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহাম্মাদ ইজ্জত উল্লাহ। আরও রয়েছেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, হামিদুর রহমান আজাদ ও সাবেক শিবির সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত। যেসব উপজেলায় দলটির চেয়ারম্যান কিংবা ভাইস চেয়ারম্যান আছে সেসব নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী ৭৬টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল। ওই নির্বাচনে দলটি ১০টি আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসনে বিজয়ী হয়। এই নির্বাচনে দলটি ২২২ জন প্রার্থী দিয়েছিল।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত তিনটি আসনে জয়ী হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনে জামায়াত ১৭টি আসন পায়। মহিলা আসনগুলো থেকে চারটি আসনে জয়ী হয় তারা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসনে বিজয়ী হয়। ওই নির্বাচনে দলটি জোটগতভাবে ৩৯টি ও চারটিতে এককভাবে নির্বাচন করে।
২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন (ইসি) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বরে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা রিট মামলার রায়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। সে কারণে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।
এদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, নতুন নামে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াত। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে একটি দলের নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করা হয়েছে, যার সব নেতাই জামায়াতের। নতুন এ দলের চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন ডেমরা থানা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম চান এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার কর্মপরিষদ সদস্য ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মো. কাজী নিজামুল হক। আনোয়ারুল ইসলাম চান নির্বাচন কমিশনে আবেদন জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, জামায়াতের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
নতুন দলের নামে নিবন্ধন চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান আকন্দ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। জামায়াতবিরোধী শক্তি এ ধরনের খবর প্রচার করছে।’
শেষ হয়ে আসছে প্রাণের বইমেলা। গতকাল ছিল মেলার শেষ শুক্রবার। বৃহস্পতিবার রাতে উড়ো চিঠিতে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বইমেলায় হামলার হুমকি ছিল। তবে সবকিছু তোয়াক্কা না করেই গতকাল শুক্রবার বইমেলায় ছিল পাঠক-লেখকের উপচেপড়া ভিড় ছিল। এদিন পাঠকদের নতুন নতুন বই কিনতে দেখা গেছে। বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা মেলার চলমান ছয় ঘণ্টার পুরোটা জুড়েই ছিল বই বিক্রি। বেশিরভাগ পাঠকের হাতে ছিল এতদিন সংগ্রহ করা বিভিন্ন প্রকাশনীর নতুন বইয়ের ক্যাটালগ। আগেভাগে সংগ্রহ করে রাখা সেসব ক্যাটালগ থেকে বেছে তৈরি করা তালিকা ধরে কেনাকাটা শুরু করেছেন বইপ্রেমীরা। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় মেলা শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত বইপ্রেমী পাঠকদের এ ভিড় ও বিক্রি থাকবে।
এদিকে অমর একুশে বইমেলায় বোমা হামলার হুমকির পর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক নূরুল হুদা গতকাল গণমাধ্যমে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এসব বিষয় বন্ধের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা নিরাপত্তার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করেছি। শাহবাগ থানায় জিডি করা হয়েছে।
গতকাল মেলায় কথা হয় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জুনায়েদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি মেলায় এসে সংগ্রহ করেছেন বইয়ের ক্যাটালগ। সেখান থেকে বাছাইকৃত বই কিনতে ছুটে এসেছেন শুক্রবার ছুটির দিন। তিনি বলেন, আমি একটু বেছে বই কিনি। যেসব বইকে মানুষ ‘সিরিয়াস’ বই বলে, সেগুলোর প্রতি আমার ঝোঁক বেশি।
অবসর প্রকাশনা সংস্থার ব্যবস্থাপক মো. মাসুদ রানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আজ (গতকাল) বইমেলার শেষ শুক্রবার। বইমেলায় লোকসমাগম অনেক বেশি। বিক্রিও সন্তোষজনক। এখন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত চলবে এমন বই বিক্রি, এমনটা আশা করছি।
বইমেলায় বোমা হামলার শঙ্কায় পাঠক মনে ভয় দেখা গিয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বোমা হামলার শঙ্কার বিষয়ে পাঠকদের মনে বিন্দুমাত্র আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়নি। বরং শেষ মুহূর্তে পাঠকরা তালিকা ধরে ধরে বই কিনতে এসেছে। আজ (গতকাল) সকালে শুরুর দিকে এমন কয়েকজন পাঠককে দেখতে পেয়েছি। এমন পাঠকরা একটু নিরিবিলিতে বই কিনতে পছন্দ করে।
নতুন বই : গতকাল ছিল অমর একুশে বইমেলার ২৪তম দিন। মেলা শুরু হয় বেলা ১১টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। নতুন বই এসেছে ২৩৯টি। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশুপ্রহর।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার পুরস্কার প্রদান : সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় ওয়াকিয়া নূর (প্রথম), আফফান আল হাসনাইন (দ্বিতীয়), রুজাইনাহ মারিফা (তৃতীয়); খ-শাখায় প্রত্যয় পাল রাজ (প্রথম), তাসনিয়াহ সিদ্দিক (দ্বিতীয়), শাফিন উদ্দিন আহম্মেদ (তৃতীয়); গ-শাখায় অর্নিলা ভৌমিক (প্রথম), আল মুমিনুর (দ্বিতীয়), জায়ীফা তাসনীম (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় আরোহী বর্ণমালা (প্রথম), অংকিতা সাহা রুদ্র ((দ্বিতীয়), জুমানা হোসেন (তৃতীয়); খ-শাখায় সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্গ (প্রথম), আনিশা আমিন (দ্বিতীয়), অদ্রিতা ভদ্র (তৃতীয়) এবং গ-শাখায় আদিবা সুলতানা (প্রথম), তাজকিয়া তাহরীম শাশা (দ্বিতীয়), সিমরিন শাহিন রূপকথা (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতায় ক-শাখায় নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির (প্রথম), অন্বেষা মজুমদার (দ্বিতীয়), সার্থক সাহা (তৃতীয়); খ-শাখায় রোদোসী নূর সিদ্দিকী (প্রথম), তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় (দ্বিতীয়), মৈত্রেয়ী ঘোষ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্ব শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন নিরঞ্জন অধিকারী, এজাজ ইউসুফী, বিপ্লব মোস্তাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাশিদ আসকারী।
প্রাবন্ধিক বলেন, বিশ্বে সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে রচিত গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল। এর কারণ তত্ত্ব সম্পর্কে পৃথিবীর সব প্রান্তেই লেখক, পাঠক ও সমালোচকদের রয়েছে অনিঃশেষ আগ্রহ। মানবিক কর্মকান্ড যত বাড়ছে, নতুন নতুন বিষয়ের আবির্ভাব ঘটছে, তত্ত্বের পরিসরও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তত্ত্বচর্চার মধ্য দিয়েই আত্মপরিচয়ের বিনির্মাণ, লৈঙ্গিক পার্থক্যের অপসারণ, নিম্নবর্গের মানুষকে আরও ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা চলছে। বৈশ্বিকভাবে আজ অবধি যত তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটেছে তার মধ্যে আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা, উত্তর-উপনিবেশবাদ খুবই শক্তিশালী প্রভাব বজায় রেখেছে।
আলোচকবৃন্দ বলেন, আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা এবং পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্বের পটভূমি অনেক বিস্তৃত। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষার সাহিত্যে এসব তত্ত্ব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তা, সামাজিক চিন্তা ও সাহিত্যিক চিন্তা থেকেই মানবতাবাদী চিন্তক ও তাত্ত্বিকরা সময়োপযোগী তত্ত্বের বিকাশ ঘটান। আজ তত্ত্ব, তাত্ত্বিক বয়ান ও তাত্ত্বিক বিতর্কের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে গেছে সাহিত্য ও সংস্কৃতি। সেই কারণে শুধু সাহিত্যকে কেন্দ্র করেই উদ্ভব ঘটেছে বিভিন্ন তত্ত্বের।
সভাপতির বক্তব্যে রাশিদ আসকারী বলেন, একুশ শতকে শিক্ষার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো সমালোচনামূলক ও বিশ্লেষণধর্মী মানসিকতা সৃষ্টি। এ জন্য গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ এসব তত্ত্বকে বিদ্যায়তনিক সীমার বাইরে এনে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিটি বিষয়কেই তাত্ত্বিক চিন্তার আলোকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গ্রহণ করতে হবে।
আজকের অনুষ্ঠানসূচি : আজ শনিবার, অমর একুশে বইমেলা ২৫তম দিন। মেলা চলবে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
শিশুপ্রহর : আজ বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় শিশুপ্রহর চলবে।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে কভিড-১৯ : ভাষার বৈশ্বিকতা ও বাংলাদেশের সাহিত্য এবং কভিড-১৯ : সংস্কৃতির সংকট ও রূপান্তর শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাকিম আরিফ এবং মোহাম্মদ শেখ সাদী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন পারভেজ হোসেন, হামীম কামরুল হক, কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী এবং আবুল হাসান চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন রফিকউল্লাহ খান।
বইয়ের টানে রাজধানীর মহাখালী থেকে অমর একুশে বইমেলায় এসেছেন ইতি আক্তার। তার প্রিয় লেখকদের তালিকায় রয়েছেন সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ ছফা ও ড. আকবর আলি খান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন বইয়ের খোঁজে মেলায় ছুটে এসেছি।
গতকাল অমর একুশে বইমেলার শেষ শুক্রবারে মেলা প্রাঙ্গণে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে পাঠক ইতির আলাপ হলে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেই বইমেলা নিয়ে একটি জঙ্গি সংগঠনের হুমকির কথা জানতে পেরেছি। এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কেমন বই চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, মননশীল সৃজনশীল মানসম্মত বই চাই। মেলায় এ ধরনের বই তুলনামূলক কম বলে আমি মনে করি।
বইমেলা নিয়ে তিনি বলেন, মেলায় লেখকদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য একটা আলাদা অটোগ্রাফ চত্বর থাকলে ভালো হতো। সবাই সেখানে লাইন ধরে প্রিয় লেখকের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিতে পারত।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক রায়হান রাইন কবিতা, গবেষণা, গল্প-উপন্যাস লেখায় সমান সক্রিয়। এবার বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে তার ৭৬ গল্প নিয়ে ‘কয়েকটি সাদা কাঠগোলাপ’। প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। ‘বাংলার সুফিয়ানা ও সহজিয়ানা’ নামে গবেষণার বই প্রকাশ করেছে বাতিঘর।
আপনার বইয়ের পাঠক কারা জনাতে চাইলে রায়হান রাইন বলেন, ‘আমার বই পড়েছেন এমন যাদের চিনি, তাদের প্রায় সবাই নিজেরাও লেখক। তবে গবেষণাধর্মী লেখাগুলো, বিশেষ করে বাংলার দর্শন নিয়ে বইগুলো অনেকেই পড়েন।যাদের মধ্যে শিক্ষক, গবেষক বা শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। এর বাইরেও নিশ্চয়ই পড়েন কেউ কেউ।’
বাংলাদেশের সাহিত্যের পাঠক নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে লেখক বলেন, ‘জেলা শহরগুলোর পাবলিক লাইব্রেরি এবং সৃজনশীল বইয়ের দোকানগুলোর অবস্থা দেখে মনে হয়, সাহিত্যের পাঠকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সূত্রে দেখতে পাই, পাঠ্যপুস্তক পড়েন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যাও খুব কম। বেশির ভাগই নোটবই বা হাতে লেখা নোট পড়ে পরীক্ষা দেন। সামনে একটা নোটবই পড়া প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। তারা সাহিত্যিকদের নাম মুখস্থ করেন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তু‘তি হিসেবে।’
রায়হান রাইন পাঠকের ওপর নিজের লেখার প্রভাব খেয়াল করে দেখেননি জানিয়ে বলেন, ‘পাঠকের ওপর লেখার কী প্রভাব পড়ছে, সেটা দেখতে পাওয়াও সহজ ব্যাপার না।’
পাঠকের সঙ্গে লেখক হিসেবে কোনো স্মৃতি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম উপন্যাস একটা ঈদসংখ্যায় বেরিয়েছিল মিথুনের রাশিফল নামে, বছর দশেক আগে। সেটা পড়ে এক পাঠক ধরে নিয়েছিলেন, এর লেখক একজন বুড়ো মানুষ। আমার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার পর তিনি সেটা বললেন। ভাবলাম, তার সঙ্গে দেখা না হয়ে গেলে, তার মনের ভেতর সেই সময় থেকেই আমাকে থাকতে হতো একজন বুড়ো মানুষ হয়ে। এই উপন্যাসের প্রুফ দেখা শেষ করে একজন প্রুফ রিডার ফোন করেছিলেন। পরে ফোন করেছেন অনেকেই। কিন্তু প্রুফ রিডারের কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যেটা আমার মনে থেকে গেছে। ‘কথাপুষ্প: প্রজ্ঞাবানদের বলা গল্প’ নামের বইটা পড়ে এক পাঠক আমাকে খুঁজে বের করে বললেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ, আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।’
রায়হান রাইনের জন্ম ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ, সিরাজগঞ্জে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করেছেন। তার আরও উপন্যাস: ‘আগুন ও ছায়া’; গল্পের বই: ‘আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু’, ‘পাতানো মায়ের পাহাড়’, ‘স্বপ্নের আমি ও অন্যরা’; কবিতার বই: ‘তুমি ও সবুজ ঘোড়া’, ‘একদিন সুবচনী হাঁস’। অনুবাদ করেছেন মনসুর আল-হাল্লাজের ‘কিতাব আল-তাওয়াসিন’ (২০১০), পাবলো নেরুদার ‘প্রশ্নপুস্তক’। এ ছাড়া সম্পাদনা করেছেন ‘বাংলার ধর্ম ও দর্শন’।
তার ‘আগুন ও ছায়া’ উপন্যাসটি ২০১৪ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই’ হিসেবে পুরস্কৃত হয়।
ছুটির সকালে মর্নিংওয়াক করতে বের হন সালাম সাহেব। বাসা ফার্মগেট। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সেচ ভবনের কাছে। হাঁটা শেষে ফুটপাতে টাটকা সবজির বাজারে চোখ আটকায় তার। অন্যান্য বাজারের চেয়ে সবজিগুলো বেশ তরতাজা। তাই মর্নিংওয়াক থেকেই শুক্রবারের বাজারটা সেরে ফেলেন এখান থেকেই।
এটা কোনো স্থায়ী বাজার নয়। সপ্তাহের এক দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য বসে ‘কৃষকের বাজার’ নামে পরিচিত এ বাজার। এ বাজারের বিশেষত্ব এখানেই। এ বাজারে কৃষক সরাসরি তার পণ্য বিক্রি করতে আনতে পারেন। বাজারে পণ্য আনতে কাউকে কোনো খাজনা দিতে হয় না। উপরন্তু হাটে পণ্য আনতে এবং সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার বাবদ ১ হাজার করে টাকাও দেয় বাজার কর্র্তৃপক্ষ।
রাজধানীতে জনপ্রিয় হচ্ছে কৃষকের বাজার। দিন দিন বাড়ছে ক্রেতাদের আনাগোনা। প্রতিটি বাজারে বিক্রি বাড়ছে। বাড়ছে কৃষকের সংখ্যাও। এ বাজারগুলোতে গড়ে ৬০০-৮০০ ক্রেতা তাদের পছন্দ অনুযায়ী মাছ, মাংস, সবজিসহ অন্যান্য পণ্য কিনছেন।
কৃষকরা জানান, কয়েক ঘণ্টায় ১০-১২ লাখ টাকার লেনদেনও হচ্ছে এ বাজারে।
কৃষকরা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, প্রতি শুক্রবার সকাল ৭টা থেকে কৃষকের বাজার শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিটি বাজারে কৃষক নিজেদের উৎপাদিত ফসল বৃহস্পতিবার রাত ৪টার আগেই নিজেদের নির্ধারিত জায়গায় বসে যান। ফজরের নামাজের পর ভোরে আলো পড়তে থাকলে বেচাবিক্রি শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে দেদার। তারপর কেনাবেচা কমতে থাকে। কৃষকের আনা পণ্যও কমতে থাকে। বেলা ৩টার মধ্যে সব পণ্য শেষ করে কৃষক বাড়ি ফেরেন। তারা বলেছেন, এ বাজার কর্র্তৃপক্ষ কৃষকের কাছ থেকে খাজনাবাবদ কোনো টাকা নেয় না। সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও মালামাল পরিবহনের জন্য ১ হাজার করে টাকাও দেয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকল্পের আওতায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, এমবাসি অব দ্য কিংডম অব দ্য নেদারল্যান্ডস, সিটি করপোরেশন এবং ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের সম্মিলিত উদ্যোগে রাজধানীর ২০২১ সালের জুন মাসে প্রথম কৃষকের বাজার কর্মসূচি শুরু হয়েছিল মিরপুর ৬ নম্বরে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে বাজারের সংখ্যা। বর্তমানে ইস্কাটন গার্ডেন রোড রূপনগর, পল্লবী, কামরাঙ্গীরচর, টিকাটুলী, খিলগাঁও, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুরের আদাবর ও মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, আজিমপুর ও হাজারীবাগসহ ঢাকায় ১২টি, নারায়ণগঞ্জে দুটি ও গাজীপুরে দুটিসহ ১৬টি জায়গায় কৃষকের ও কৃষকের বাজার রয়েছে। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ও হরটেক্স ফাউন্ডেশন এ বাজার পরিচালনা করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বাজার চালু হয়।
জাতীয় সংসদ ভবনের উল্টো দিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের সেচ ভবনের পাশ ঘেঁষে বসা কৃষকের বাজারে কথা হয় জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত হবিগঞ্জ মাধবপুরে কৃষক আবদুল বাসেত বদু মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার সবজি শতভাগ নিরাপদ। জৈব সার ছাড়া অন্য কোনা সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এখানে আমার বিক্রিও ভালো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমার সবজি খেয়েছেন।’
মুন্সীগঞ্জের কৃষক নুর ইসলাম বলেন, ‘এ বাজারে ৩০ জন কৃষক বসেন। সবাই সবার সেরাটাই এখানে নিয়ে আসে। কেউ ২০ হাজার টাকার সবজি নিয়ে এলে ২৫ হাজার বিক্রি হয়। কেউ আরও বেশি টাকার সবজি নিয়ে আসে। কারও সবজির সঙ্গে দামি ফলও থাকে। তাদের বিক্রি হয় আরও বেশি। সব মিলিয়ে গড়ে প্রতি কৃষক ৩০-৪০ হাজার বিক্রি হয়। সে হিসাবে এ বাজারে ১০-১২ লাখ টাকা লেনদেন হয়।’
ইস্কাটন গার্ডেনের কৃষকের বাজার ফুলকপি, বাঁধাকপি, আলু, লাউ, বেগুন, বথুয়াশাক, লালশাক, মরিচ, পেঁপে, শিমসহ প্রায় ৫০ ধরনের সবজি পাওয়া যায়। এ ছাড়া দেশি মুরগি, দুধ, ডিমও আছে। এ বাজারের সাভারের হেমায়েতপুরের কৃষক শাজাহান মিয়া বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিকেলে ক্ষেত থেকে সবজি সংগ্রহ করি। এমনকি গ্রামের অন্য কৃষকের বিক্রিযোগ্য সবজি ন্যায্য দাম দিয়ে নিয়ে আসি। বিক্রি ভালো হয়। বাজার এখানে ভালোই চলছে। লাভও হয় মোটামুটি। এখানে বসার জন্য টাকা লাগে না, সবজি পরিবহনের কোনো খরচ দিতে হয়। সকালের নাশতা এমনকি দুপুরের খাবারের জন্য ১০০০ টাকা দেয় বাজার কর্র্তৃপক্ষ। সেটাই আমাদের লাভ। আমাদের এখানে ন্যায্য দামে সবকিছু পাওয়া যায়।’
বাজার করতে আসা ক্রেতা আসিফা সুলতানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শুরুতে ৮ থেকে ১০ জন কৃষকের দোকান ছিল। এখন ২৫ থেকে ৩০ জন আসেন। এখানে সবজি থেকে শুরু করে নানা জাতের দেশি ফলও পাওয়া যায়। মৎস্য অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ মাছের দোকানও আছে। আগে কখনো বাজারে যায়নি। বাসার কাছে বাজার পেয়ে আসা। এখানে ন্যায্যমূল্যে সবকিছু পাওয়া যায়।’ মগবাজারের তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাজারের সবজির মান ভালো।’
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ রকম কৃষকের বাজার যত বাড়বে, তত ভালো। যদি প্রতিদিন বসে তাহলে আরও ভালো। তবে বাজারে প্রকৃত কৃষক তার সবজি নিয়ে আসছে কি না সেটা নজরদারিতে রাখতে হবে। ক্রেতারা যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য পায় তাহলে কোনো কথাই থাকে না। এরকম বাজার বাড়লে অন্য বাজারে কোনো প্রভাব পড়ার কথা নয়।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অতিরিক্ত উপপরিচালক কৃষিবিদ আরিফ মো. মোজাক্কের দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কৃষি বাজারে আমাদের কাজ শুধু প্রকৃত কৃষক নির্বাচন করে দেওয়া। সবার সবজির মান খুবই ভালো। এর বাইরে আমরা কোনো কাজ করি না। তবে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠান যুক্ত তারা বাজার বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে।’
রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল বাশার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইস্কাটন গার্ডেনের বাজারে সাভারের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকের উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল, দুধ-ডিম, হাঁস-মুরগি, মাছ আনা হয়। এ বাজার আমার এলাকায় সাড়া ফেলেছে। এখানে কৃষক ফ্রিতে সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার ও মালামাল পরিবহনের ব্যবস্থা করে থাকে বাজার কর্তৃপক্ষ।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
কয়েক দফা বাড়ার পর রমজানের প্রথম দিন কিছুটা কমেছে মুরগির দাম। শুক্রবার (২৪ মার্চ) রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমনটা দেখা গেছে। এ ছাড়াও গতকাল শীর্ষ চার পোল্ট্রি উৎপাদন প্রতিষ্ঠানকে তলব করে ভোক্তা অধিকার। পরে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় মুরগির দাম।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা কমে ২৪৫-২৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সোনালির দাম ২০ টাকা কমে ৩৬০ টাকায়, আর দেশি মুরগি ৬৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মূলত চাহিদা কমে যাওয়ায় দাম কমেছে। তারা জানান, আগের তুলনায় তাদের বিক্রি কমে গেছে। এ অবস্থায় দাম আরও কমতে পারে বলে জানান তারা।
আর ক্রেতারা বলছেন, এখনও তাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে মুরগি ও ডিম।
এদিকে, বাজার তদারকিতে সকাল থেকে অভিযানে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। রোজার প্রথম দিন শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অভিযানে নামে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। সকাল সাড়ে ১০টায় এ বাজারের কিচেন মার্কেটে অভিযান শুরু করেন সংস্থার সদস্যরা। অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। উপস্থিত আছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিস প্রধান আব্দুল জব্বার মণ্ডলসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা।
এর আগে, গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুরগির দাম সমন্বয়ের জন্য ডাকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সেখানে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, 'মুরগির দাম ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না।'
ব্রাজিলের সমুদ্রতীরবর্তী শহর রিও ডি জেনেইরোর কাছে একটি অপরাধী চক্রের প্রধানের গ্রেপ্তারে অভিযানের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার রিও ডি জেনেইরোর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সাও গনসালো শহরের শ্রমিকদের আবাসিক এলাকা সালগেইরোতে এ ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানায়। পুলিশের দাবি, নিহতরা সবাই সন্দেহভাজন অপরাধী।
ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য পারার মাদক-নেতা অভিযুক্ত লিওনার্দো কোস্তা আরাউজো সালগেইরোতে লুকিয়ে আছে- এমন খবরের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালায় পুলিশ। সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে আরাউজোও আছেন। পারার বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার নিহতের ঘটনায় তার হাত আছে বলেও অভিযোগ।
পুলিশ জানিয়েছে, আরাউজোকে গ্রেপ্তারে বৃহস্পতিবার চালানো এই অভিযানে হেলিকপ্টার ও সাঁজোয়া যান ব্যবহার করা হয়।
রিও শহরের পুলিশ প্রায়ই এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে। শহরটির গভর্নর ক্লডিও কাস্টো সোশালে এক পোস্টে লেখেন, আমরা আমাদের এই শহরকে অন্য কোনো এলাকা থেকে আসা দুর্বৃত্তদের অভয়াশ্রম হতে দেব না।
এ ঘটনায় অপরাধী চক্রের স্থানীয় তিনজন সোর্সও গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।