
লিওনেল মেসির স্ত্রী আন্তোনেল্লা রোকুজ্জোর পরিবারের মালিকানাধীন একটি সুপারমার্কেটে গুলি চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। হামলা শেষে চলে যাওয়ার আগে এক টুকরো কাগজ ফেলে গেছে তারা, যেখানে তারকা ফুটবলার মেসিকে হুমকি দিয়ে বার্তা লেখা হয়েছে। আর্জেন্টিনার স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে রোসারিও শহরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে ক্রীড়াবিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএনের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
মেসি ও রোকুজ্জো দুজনেই এই শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ৩৫ বছর বয়সী মেসি শৈশবে খেলেছেন রোসারিওর ক্লাব নিউয়েলস ওল্ড বয়েজে।
ইউনিকো নামের সুপারমার্কেটটির শাটার ও সামনের দরজায় এলোপাতাড়ি ১৪টি গুলি ছোড়া হয়েছে। মোটরসাইকেলে চড়ে আসা দুই দুর্বৃত্ত এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সুপারমার্কেটটির ক্ষয়ক্ষতি হলেও কেউ হতাহত হয়নি।
শহরটির পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্ধ থাকা সুপারমার্কেটে গুলি চালিয়ে চলে যাওয়ার আগে এক টুকরো কার্ডবোর্ড (এক ধরনের পুরু ও শক্ত কাগজ) ফেলে গেছে মোটরসাইকেল আরোহীরা। সেখানে আর্জেন্টিনার হয়ে গত বছর বিশ্বকাপ জেতা মেসিকে হুমকি দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘মেসি, আমরা তোমার অপেক্ষায় আছি। ইয়াভকিন (রোসারিওর মেয়র পাবলো) একজন মাদক চোরাচালানকারী। সে তোমাকে দেখে রাখতে পারবে না।’
গুলি ছোড়া ও হুমকি দেওয়ার এ ঘটনায় ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। এ ছাড়া রোসারিওতে অপরাধ বৃদ্ধি, পুলিশের ঘাটতি ও সুরক্ষার অভাব নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন মেয়র ইয়াভকিন। চলতি সপ্তাহের শুরুতেও একই বিষয়গুলো নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি জানিয়েছিলেন, শহরটিতে আরও পুলিশ সদস্যের প্রয়োজন।
রেকর্ড সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ী পিএসজি ফরোয়ার্ড মেসি বা তার স্ত্রী রোকুজ্জোর কেউই হামলার এই ঘটনায় তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেননি।
নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে ঘরছাড়া ৫৫ তরুণের মধ্যে ৩৩ জনকে শনাক্ত করেছেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। শনাক্ত হওয়া ৩৩ জনের মধ্যে ১২ জনকে ইতিমধ্যে র্যাব আটক করেছে। বাকি ২১ জন এখনো পলাতক। সংগঠনটির আমির আনিছুর রহমান ওরফে মাহমুদ এবং দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মাইমুনের সদস্য ও অর্থ সংগ্রহবিষয়ক উগ্রবাদী বক্তব্য সংবলিত ভিডিও কনটেন্ট উদ্ধারের পর র্যাব এসব তথ্য জানতে পেরেছে।
পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে যৌথ অভিযানের মুখে পালিয়ে আসার সময় গত মঙ্গলবার চট্টগ্রামে আরও চারজনকে আটক করেছে র্যাব। এদের মধ্যে আটক আল-আমিন ওরফে মিলদুকের কাছ থেকে নতুন ওই ভিডিওটি উদ্ধার করা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ভিডিওটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানায় র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এ সময় তিনি বলেন, গত ২২ জানুয়ারি জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রণবীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন তার মুঠোফোন থেকে ৮ মিনিটের একটি ভিডিও উদ্ধার করা হয়। ভিডিওতে ২৯ জঙ্গিকে শনাক্ত করা হয়। এবার পাওয়া ৭ মিনিটের ভিডিওতে ২৩ জঙ্গিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের ১৯ জন আগের ভিডিওতেও ছিলেন। অর্থাৎ এই ভিডিওতে নতুন চার জঙ্গির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তারা হলেন শেখ আহমেদ মামুন ওরফে রমেশ, শামীম মিয়া ওরফে বাকলাই ওরফে রাজান, নিজাম উদ্দিন হিরন ও ডা. জহিরুল ইসলাম ওরফে আহমেদ। ভিডিওর তথ্য অনুযায়ী, জহিরুল (চিকিৎসক) গত বছর ৬ জুন মারা গেছেন। তার নামে জঙ্গিরা একটি ক্যাম্পও করেছে। দুটি ভিডিওতে শনাক্ত জঙ্গিদের মধ্যে র্যাব এ পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এনেছে। বাকি জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, নতুন ভিডিওটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থ ও সদস্য সংগ্রহের জন্য এই ভিডিও তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে দেশে বড় কোনো নাশকতার পর নিজেদের অস্তিত্ব দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে জানান দেওয়ার উদ্দেশ্যেও এ ভিডিও তৈরি করে রাখা হতে পারে। সংগঠনটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, অর্থাৎ আমির আনিছুর রহমান, অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান রাকিব, দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মাইমুনকে গ্রেপ্তার করা গেলে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত জানা গেছে, দুটি ভিডিওর নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন আল-আমিন ওরফে বাহাই। তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে নিখোঁজ শিক্ষার্থী রিয়াসাত রায়হান ওরফে আবু বক্করের প্রাইভেট টিউটর। আর ভিডিও সম্পাদনা করেছেন পাভেল নামের আরেক জঙ্গি।
ধর্মান্তরিত তরুণের জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, পার্থ কুমার দাস ২০১৮ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ঢাকার কাকরাইলে চাকরি করার সময় পলাতক জঙ্গি সিরাজের মাধ্যমে তিনি উদ্বুদ্ধ হন। পরে তাকে বলা হয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চাকরিসহ দাওয়াতি কার্যক্রমে তাকে নেওয়া হবে। সেই কথা অনুযায়ী, তিনি পাহাড়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিলেন।
পাহাড় থেকে জঙ্গিদের সমতলে চলে আসার প্রসঙ্গে আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বলছে, আমিরের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আপাতত তারা আত্মগোপনে থাকছে। এখন তারা শুধু আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে সমতলে এসেছে না অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে, তা পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যাবে। সর্বশেষ গ্রেপ্তার চারজনের সঙ্গে আরও চার-পাঁচজনের একটি দল ছিল। তারা বান্দরবানের দুর্গম এলাকা থেকে চার দিন হেঁটে শহরে আসেন। ভেঙে ভেঙে তারা চট্টগ্রামের দিকে আসছিলেন।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখা এবং অন্যান্য ব্যাটালিয়ন গত বছর ২৩ আগস্ট কুমিল্লা ও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আট তরুণ নিখোঁজের সূত্র ধরে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। একপর্যায়ে নতুন এ জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পাওয়া যায়। এ সংগঠনের ৫৫ জন সদস্য পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) ছত্রছায়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩ অক্টোবর থেকে র্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলছে। র্যাবের অভিযানে এ পর্যন্ত ৫৯ জন জঙ্গি এবং জঙ্গি প্রশিক্ষণে সহায়তার অভিযোগে ১৭ জন কেএনএফ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া র্যাব এ সংগঠনের দুই সদস্যকে জঙ্গিবাদের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে।
দেশে ভোক্তাপর্যায়ে বেসরকারি খাতের ১২ কেজি ওজনের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ১ কাজার ৪৯৮ থেকে ৭৬ টাকা কমিয়ে ১ হাজার ৪২২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে গত জানুয়ারি মাসে দাম ছিল ১ হাজার ২৩২ টাকা।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নতুন এ দর ঘোষণা করে, যা গতকাল সন্ধ্যা থেকেই কার্যকর হয়েছে। তবে সরকারিপর্যায়ে সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডারের দামের পরিবর্তন হয়নি। সেটি আগের দাম ৫৯১ টাকাই রয়েছে। যদিও সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই এলপিজি বাজারে সোনার হরিণের মতো।
কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, ভোক্তাপর্যায়ে বেসরকারি খাতের প্রতি কেজি এলপিজির মূল্য সংযোজন করসহ (মূসক/ভ্যাটসহ) দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ১১৯ টাকা, যা আগের মাসে ছিল প্রায় ১২৫ টাকা। পাশাপাশি ৫.৫ থেকে ৪৫ কেজি পর্যন্ত বোতলজাত সব এলপিজির দাম একই হারে সমন্বয় করা হয়েছে। গাড়িতে ব্যবহৃত এলপিজির (অটো গ্যাস) নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে লিটারপ্রতি ৬৬.২২ টাকা, যা আগে ছিল ৬৯.৭১ টাকা। আর জানুয়ারিতে ছিল ৫৭.৪১ টাকা।
একইভাবে বাসাবাড়িতে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবহারকারীদের জন্য প্রতি কেজি এলপিজির দাম ১১৫.৩১ টাকা এবং রেটিকুলেটেড এলপিজি গ্যাসীয় অবস্থায় প্রতি লিটারের দাম শূন্য দশমিক ২৫৬৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিইআরসি জানায়, মার্চ মাসের জন্য সৌদি আরামকোর প্রোপেন ও বিউটেনের ঘোষিত সৌদি সিপি (কন্ট্রাক্ট প্রাইস) যথাক্রমে প্রতি টন ৭২০ মার্কিন ডলার এবং ৬৪০ মার্কিন ডলার। প্রোপেন ও বিউটেনের অনুপাত ৩৫:৬৫ অনুযায়ী গড় সৌদি সিপি প্রতি টন ৭৩৩ মার্কিন ডলার বিবেচনায় মার্চ মাসের জন্য বেসরকারি এলপিজি ও অটো গ্যাসের দাম ভোক্তাপর্যায়ে সমন্বয় করা হলো।
দীর্ঘদিন ধরে আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসলাইনের সংযোগ বন্ধ থাকায় রাজধানীর পাশাপাশি বিভিন্ন শহর ও গ্রামে বিপুলসংখ্যক মানুষ এলপিজির ওপর নির্ভরশীল।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে প্রতি মাসে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে আসছে বিইআরসি। এলপিজি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। প্রতি মাসে এলপিজির এ দুই উপাদানের মূল্য প্রকাশ করে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান আরামকো। এই মূল্য বিবেচনায় নিয়ে দেশে এলপিজির দাম সমন্বয় করে বিইআরসি। যদিও কমিশন নির্ধারিত দামে বাজারে এলপিজি পাওয়া যায় না। দাম বৃদ্ধি-হ্রাস যাই হোক না কেন বিক্রেতারা তাদের ইচ্ছেমতো দাম আদায় করেন ক্রেতার কাছ থেকে।
রাজধানীর বাজারে হঠাৎ বেড়েছে সবজির দাম। জ¦ালানি, সার ও বীজের দাম বাড়ায় সবজির উৎপাদন ও পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ফলে প্রায় সব সবজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। যদিও এ সময়ে শীতকালীন সবজির শেষ সময় হওয়ায় দাম কম থাকার কথা।
গ্রামের হাটবাজারে পাইকারিতে এসব সবজির দাম কম থাকলেও শহরে কয়েকগুণ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। শুধু সবজি নয়, ডিম, মাছ ও সব ধরনের মাংসের দামও বেড়েছে। ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে খাদ্য-চাহিদা মেটাতে আরও বেশি চাপে পড়েছে সাধারণ মানুষ।
অতিরিক্ত দাম বাড়ায় সবজি কিনতেও হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। দুই সপ্তাহ ধরে লতি ও করলা বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ১০০ টাকার বেশিতে। দেশে উৎপাদিত এ দুটি পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি না থাকলেও এর মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানেন না কেউ। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে এ দুই সবজি। শুধু লতি ও করলাই নয়, শিম, টমেটো, বেগুনের মতো সবজিও এখন হিসাব করে কিনতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। এসব সবজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৮০ টাকা দিয়ে। সব ধরনের সবজির দাম বাড়ায় আলুই এখন ভরসা।
সরেজমিনে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফার্মগেট, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান ও মোহাম্মদপুর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ৪০ টাকার নিচে কোনো সবজিই বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা। একটু ভালো মানের টমেটো ও গাজর কেজিপ্রতি ৪০-৪৫ টাকা। প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকায়। কপি (ফুল বা বাঁধা) ৩৫-৪০, কাঁচকলা হালি ৩৫-৪০, মান বিবেচনায় কাঁচা মরিচ ও করলা ১২০-১৪০ টাকা এবং ৩৫ টাকার পেঁয়াজের কেজি ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দরে।
রাজধানীর একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন শামসুল আলম। তিনি কারওয়ান বাজারে এসেছেন বাজার করতে। অনেক ঘোরাঘুরির পর শিম, লাউ ও টমেটো কিনেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব সবজির দাম দিন দিন বাড়ছে। সবজি কিনতে এসেও চিন্তা করতে হচ্ছে। কম দামে শিম, লাউ কিনেছি। অল্প বেতনে চাকরি করি। লতি ও করলা কেনার চিন্তাও করতে পারি না।
ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তির দিকে। টাটকা কোনো সবজি পাইকারি কিনতে হলেও ৩০-৩৫ টাকা কেজির নিচে পাওয়া যায় না। বেশি দাম পড়ায় দুই-তিন দিন আগের সবজি কিনতেও ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে বেশি দাম।
হাতিরপুল বাজারের শামীম নামে এক সবজি বিক্রেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে সবকিছুর দাম যেন আরও বেশি বাড়ছে। যে দাম দিয়ে কিনতে হয় তার বিবেচনা করলে নতুন কোনো সবজি ৪০ টাকার নিচে বেচা যায় না।’
শুধু সবজির বাজারই নয়, দাম বেশি থাকায় কেজিতে মাছ, মাংস কেনা কমিয়েছেন ক্রেতারা। ভাগে মাছ কিনছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। বাজারে সর্বনিম্ন ১৮০ টাকায় এক কেজি তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি (বড়) রুই মাছ ৩২০-৩৮০, টেংরা মাছ ৫০০-৫৫০, দেশি (ছোট) ফলি ৪৫০-৫০০, মাঝারি আকারের চিংড়ি ৬২০-৬৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
ফার্মগেট বাজারে সানাউল্লাহ নামে এক ক্রেতাকে রুই মাছের ভাগা কিনতে দেখা যায়। জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সবকিছুর দাম বেড়েছে। যে পরিমাণে ব্যয় বেড়েছে সে পরিমাণে আয় বাড়েনি। আগে কিনতাম এক-দুই কেজি করে মাছ। এখন ভাগে কিনতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে সংসার চালাতে গেলে মাছের ভাগা কেনা ছাড়া উপায় দেখছি না।’
ডিম ও মাংসের বাজারেও একই অবস্থা। প্রতি ডজন লাল ডিম ১৪০ ও খুচরায় এক হালি ডিম ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি পোলট্রি মুরগি ২৪০-২৪৫, দেশি মুরগি ৬০০, কক মুরগি ৩৫০-৩৬০ ও গরুর মাংস ৭৩০-৭৫০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে ব্যবসায়ীদের।
সবজির বাজারের মতো মুদি পণ্যেরও একই অবস্থা। প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৭২-৭৫, বিআর আটাশ ৫০-৫৫, চিনি ১২৫-১৩০, প্যাকেট আটা দুই কেজি ১৩৫, মসুর ডাল দেশি ১৪০, ছোলা ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ১০ টাকা কমেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
কারওয়ান বাজারের মুদি দোকানি বাসার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ওমর ফারুক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভোজ্য তেল ছাড়া কোনো পণ্যের স্বস্তির খবর নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে আমাদের বেচা-বিক্রিও কমেছে কয়েকগুণ।’
লোকসাহিত্য যেকোনো জাতির জিয়নকাঠি; সম্পদ ও সম্পত্তি। লোকসাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের কৃষ্টি ও সভ্যতা এবং ইতিহাস ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল রূপের সন্ধান পেতে পারি। ফিরে পেতে পারি সোনালি অতীতকে, যার মধ্যে মূর্ত আছে আমাদের লোকায়ত জীবনের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশের লোকসাহিত্য দর্পণের মতো স্বচ্ছ। এতে প্রতিফলিত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আশা-আকাক্সক্ষা, ধ্যান-ধারণা, লোকমানস, বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান ও লোকজ শিল্পকলা। এতে বিধৃত হয়েছে বাংলাদেশের সামগ্রিক লোকায়ত মানস।
লোকসাহিত্যে ও লোকজ শিল্পকলায় নকশিকাঁথার গুরুত্ব অপরিসীম। নকশিকাঁথা বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ। গ্রামের মেয়েরা এর রূপকার। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কাঁথার ব্যবহার আছে। সূক্ষ্ম নকশিকাঁথা বুননে বাংলাদেশের নারীদের আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে। বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এর ভিন্নতা দেখা যায়। নকশিকাঁথা লোকজ শিল্পকলা ও লোকসাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তাতে অঞ্চলবিশেষের সজীব প্রাণের সরল ও জীবন্ত উৎসকে দেখতে পাওয়া যায়।
‘লোকায়ত বাংলা’ সিরিজে আমরা এবার নিবেদন করছি বাংলাদেশের নকশিকাথা।
নকশিকাঁথার রূপকার গ্রামের মেয়েরা। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে কাঁথার ব্যবহার রয়েছে। সূক্ষ্ম নকশার কাজে বাংলাদেশে পল্লী রমণীরা অধিক পারদর্শী।
কাঁথা সংস্কৃত ‘কন্থা’ শব্দজাত। এর অর্থ জীর্ণ, ছিন্ন বস্ত্র। প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধু-সন্ত, যোগী-সন্ন্যাসী, আউল-বাউল, পীর-ফকিরদের পরিধেয় প্রধানত এই ছিন্ন কন্থা। কন্থা বা কাঁথা ত্যাগ, বৈরাগ্য, নম্রতা ও নিরাসক্তির প্রতীক। সাধারণের দৈনন্দিন ব্যবহারের অথবা শিশুশয্যা হিসেবে ব্যবহৃত কাঁথা আক্ষরিক অর্থেই কাঁথা বা কন্থা।
বাংলাদেশের রমণীদের ধৈর্য ও নিষ্ঠায় আর নৈপুণ্যে নিত্যপ্রয়োজনের কাঁথাই যখন প্রয়োজনের প্রাত্যহিকতাকে ছাপিয়ে শিল্পে উত্তীর্ণ হয় তখন তাকে বলে নকশিকাঁথা। উভয় ক্ষেত্রে উপকরণ মূলত একই পুরনো পরিত্যক্ত বস্ত্র এবং ছিন্ন শাড়ির পাড়ের সুতা।
পুরাতন পরিধেয় কাপড়ের মাপমতো কয়েক ফালি সাজিয়ে কাঁথার ‘জমিন’ তৈরি করা হয়। শাড়ির পাড়ের সুতা বা তাঁতির সুতা চার-পাঁচ ‘লরি’ একসঙ্গে পাকিয়ে সেলাই করা হয়। নকশার কাজে সুচের এক একটি ‘ফোঁড়’ই মূলশক্তি। কাঁথার জমিনে প্রয়োজনীয় দূরত্বে ছোট-বড় ফোঁড়ের বিন্যাসে অভীষ্ট ছবি বা নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। এদিক থেকে দেখলে কাঁথা সূচিকর্মের অন্তর্ভুক্ত।
উপকরণ ও আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে কাঁথা যেমন সূচিশিল্পভুক্ত, তেমনি ফর্ম, মোটিফ, চিত্রকল্পসহ অন্যতর বৈশিষ্ট্যে কাঁথা আলপনা গোত্রীয়। আলপনার মতোই কাঁথায়ও ঐতিহ্যবাহী, রীতিসিদ্ধ ও সমতলভিত্তিক চিত্র বা নকশা বা প্রতীক বা সংকেত থাকে; ধর্মীয় অভিব্যক্তি থাকে। শাড়ির পাড় থেকে সুতা তোলা, সুইয়ের ঘাই বা ফোঁড় তোলা থেকে অলংকরণের জন্য নির্বাচিত চিত্রকলা এবং সেসবের বিন্যাসপদ্ধতি সবই ঐতিহ্য ও পরম্পরাপ্রসূত। তাই চিত্র বা নকশা স্বভাবতই বৈচিত্র্যহীন ও গতানুগতিক। চিত্রগুলো স্থির, নিশ্চল; উড়ন্ত পাখি বা ধাবমান পশুও তা-ই। তবে চিত্র বা নকশা প্রণয়নের সাবলীলতা ও রৈখিক নৈপুণ্য এক ধরনের সজীবতার আবেশ তৈরি করে।
কাঁথার চিত্র বা নকশার স্বরূপ বিচার করলে আলপনাচিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য লক্ষিত হয়। তরঙ্গিত বা পুষ্পিত লতা কাঁথায় গোলাকার বা আয়তকার ক্ষেত্রের বেষ্টনী হিসেবে ব্যবহৃত। আলপনার মতোই কাঁথায় লতা বলতে শঙ্খলতা, কলমিলতা, কলসিলতা, খুন্তিলতা, মোচালতা, শীষলতা প্রভৃতি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাঁথা অলংকরণের কেন্দ্রবিন্দু থাকে কেন্দ্রস্থ চিত্রটি। কেন্দ্রে সচরাচর বিভিন্ন পদ্ম, শাখা, বিস্তারিত কদম বা অন্যতর বৃক্ষ, পূর্ণকুম্ভ, মন্ডল প্রভৃতি। পদ্ম সূর্যের, গাছ বা বৃক্ষ জ্ঞানের এবং কুম্ভ পৃথিবী ও পূর্ণতার প্রতীক। আর কেন্দ্রস্থ চিত্রের চতুর্দিকে বৃত্তাকারে লতাম-ল করা হলে তাকে বলে মন্ডল।
বাস্তবের প্রচ্ছায়ায় লোকশিল্পীর মানসপ্রসূত ডিজাইন বা নকশা বলে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন পদ্ম ম-লকে বলেছেন ‘মানসপদ্ম’।
কেন্দ্রীয় এই চিত্র বা নকশাকে ঘিরে থাকে নানা লতাপাতা, ফুল, ধানের ছড়া, চাঁদ, তারা, মাছ, প্রাণী প্রভৃতি। এমনকি, কুলা, পাখা, আয়না, কাঁকই, সরতা প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সরঞ্জাম এক একটি পর্যায়ে বিন্যস্ত থাকে। পর্যায়ক্রমিকতা কাঁথা শিল্পের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পর্যায়ক্রমিকতার মধ্যে জ্যামিতিক ছক বিন্যাসের মতো একটি পদ্ধতি অনুসৃত হয়, যাতে মাছের সারিতে কেবল মাছ, লতার সারিতে থাকে কেবল লতা।
কাঁথার শিল্পায়নে নিপুণতা বা দক্ষতা শেষ কথা নয়; ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও ধৈর্যেরও প্রয়োজন। আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায় ‘মাতা যে কাঁথাখানি রচনা করিতে শুরু করিয়াছেন, স্বজীবনে তাহা শেষ করিতে পারেন নাই; সেই অসমাপ্ত কাঁথা লইয়া তাহার কন্যা বসিয়া গিয়াছেন, তিনিও উহা শেষ করিয়া যাইতে পারেন নাই; তাহার কন্যা হয়ত উহা শেষ করিয়াছেন এরূপ উদাহরণ বিরল নয়।’
বাস্তবিক অর্থে তা-ই। একান্ত ধৈর্য আর নিষ্ঠায় বাঙালি মহিলারা অব্যবহার্য পুরনো কাপড়ে নির্মিত কাঁথাকে এক অপরূপ শিল্পকলায় ম-িত করেন। তাদেরই জীবন, মন, সংস্কার ও ঐতিহ্যের পূর্ণ প্রতিবিম্ব নকশিকাঁথা। কাঁথাশিল্পের সঙ্গে তাদের কর্ম, বিশ্রাম ও অবসর একসূত্রে গাঁথা।
কাঁথা মূলত দুই প্রকার এক. লেপ-কাঁথা (গাত্রাবরণী) ও সুজনি-কাঁথা (শয্যাবরণী)। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ঢাকনা বা ওশার আছে, এগুলোও নকশিকাঁথার অন্তর্ভুক্ত। প্রয়োজন ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা অনুযায়ী এগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন আরশিলতা (আয়নার আবরণী), ওয়ার বা বেটন (বালিশের ঢাকনা), সারিন্দার আবরণী, নকশি আসন, জায়নামাজ, দস্তরখানা, পানসুপারির ‘খিচা’, তসবি অথবা জপমালার থলে, কোরআন শরিফ প্রভৃতি পবিত্র গ্রন্থাদির ঝোলা, বস্তনী, গাঁটরি, বোঁচকা প্রভৃতি।
যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, নরসিংদী অঞ্চলের রমণীরা নকশিকাঁথা তৈরিতে অধিকতর সাফল্য দেখিয়ে থাকেন, সারা দুনিয়া জুড়ে যার খ্যাতি।
বাংলাদেশের নকশিকাঁথা শিল্পে বিধৃত হয়েছে বাংলাদেশের কৃষ্টি, সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য, যা লোকায়ত বাংলার সম্পদ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, লোকসংস্কৃতির গবেষক
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পঞ্চম জাতিসংঘ সম্মেলনের দ্বিতীয় পর্বে (এলডিসি-৫) যোগ দিতে আগামীকাল শনিবার কাতার যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাতারের রাজধানী দোহায় ৫-৯ মার্চ হবে এ সম্মেলন। সরকারপ্রধানের এ সফরে কাতারের আমিরের সঙ্গে অনুষ্ঠেয় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে জ্বালানি খাতে সহযোগিতার বিষয়টি তুলবে ঢাকা।
প্রধানমন্ত্রীর সফর উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক সেহেলী সাবরীন। তিনি বলেন, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ বিন খলিফা আল থানি এবং জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল যাচ্ছে। প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি থাকছেন।
সফরের প্রথম দিন রবিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী এলডিসি-৫ সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেবেন। ওই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব, সাধারণ পরিষদের সভাপতি ও এলডিসি গ্রুপের বর্তমান চেয়ার মালাউইয়ের প্রেসিডেন্ট বক্তব্য দেবেন। এরপর দুপুরে শেখ হাসিনা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে থাকা তিন এশীয় দেশবাংলাদেশ, নেপাল ও লাওস আয়োজিত ‘সাসটেইনবেল অ্যান্ড স্মুথ ট্রানজিশন ফর দ্য গ্র্যাজুয়েটিং কোহরট অব ২০২১’ শীর্ষক সাইড ইভেন্টে বক্তৃতা দেবেন।
পরদিন ৬ মার্চ সকালে প্রধানমন্ত্রী সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘দ্য রাইজ অব বেঙ্গল টাইগার : পোটেনশিয়ালস অব ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিজনেস সামিটে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। একই দিন দুপুরে সরকারপ্রধান বাংলাদেশ আয়োজিত সাইড ইভেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ইন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইন এলডিসি’স ফর স্মার্ট অ্যান্ড ইনোভেটিভ সোসাইটিস’-এ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ওই সাইড ইভেন্টে মিশর, সিঙ্গাপুর, এস্তোনিয়ার মন্ত্রিপর্যায়ের প্রতিনিধি এবং ডব্লিউটিও, ইউএন, টেক ব্যাংক ফর এলডিসিসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। এদিন সন্ধ্যায় শেখ হাসিনা জিসিসিভুক্ত দেশ ইরাক, জর্ডান, লেবানন ও তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে আয়োজিত আঞ্চলিক দূত সম্মেলনে অংশ নেবেন।
পরদিন ৭ মার্চ মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রীর ‘এনহ্যান্সিং দ্য পার্টিসিপেশন অব লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ (এলডিসি’স) ইন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড অ্যান্ড রিজিয়নাল ইন্টিগ্রেশন’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে কো-চেয়ার হিসেবে অংশগ্রহণ করার কথা রয়েছে। ওইদিন বিকেলে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ আয়োজিত সাইড ইভেন্ট ‘গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর স্মুথ অ্যান্ড সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন : মার্চিং টুওয়ার্ডস স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ওই সাইড ইভেন্টে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী, আঙ্কটাডের মহাসচিব এবং ডব্লিউটিও, ইউএনআইডিও এবং ওইসিডিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। একই দিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী কাতারপ্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক আয়োজিত কমিউনিটি ইভেন্টে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
প্রধানমন্ত্রী ৮ মার্চ দেশের উদ্দেশে কাতার ত্যাগ করবেন।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে এবং স্বল্পোন্নত দেশের সম্মেলনে এটি বাংলাদেশের শেষ অংশগ্রহণ। ২০২১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে চূড়ান্ত উত্তরণের ঐতিহাসিক প্রস্তাব গৃহীত হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক অনুবিভাগের পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রতি ১০ বছর পরপর স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘ সম্মেলন হয়। এর আগের সম্মেলন হয়েছিল ২০১১ সালে। এই সম্মেলনে ২০২২-৩১ পর্যন্ত একটি প্ল্যান অব অ্যাকশন গ্রহণ করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি। মসৃণ ও টেকসই উত্তরণের জন্য কভিডসহ অন্য যে চ্যালেঞ্জগুলোর আমরা মুখোমুখি হচ্ছি, সেসব তুলে ধরা হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
রোজার মাসে খাবারের জন্য শরীফুল আলমের বাজেট ১২ হাজার টাকা। পাঁচ দিনের বাজার করতে গিয়ে তিনি দেখেন, মাছ কিনলে মুরগি কেনা যায় না, মুরগি কিনলে মাছ বাদ দিতে হয়। গরুর মাংস তো বিলাসী খাবার, তাই সে দোকানে নজরই দেননি তিনি। পাঁচ দিনের মধ্যে তিন দিনই তার পরিবারকে মাছ-মাংসের মতো প্রোটিন খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। আর ইফতারিতে উচ্চ মূল্যের বিদেশি ফল বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি আগেই নিয়েছেন। শুধু শরিফুলই নন, বাজার করতে আসা নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন আয়ের সব ভোক্তারই একই গল্প। তারা বলছেন, এবারের রমজানে কম খেয়েই রোজা রাখতে হবে।
গত এক বছরে ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশের বেশি। প্রায় একই হারে বেড়েছে পাকিস্তানি ককসহ অন্যান্য মুরগির দাম। সব ধরনের মাছের দাম গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
একটু সাধারণ হিসাব করা যাক। চারজনের একটি পরিবার যদি মাছ, মাংস বাদ দিয়ে সাহরিতে গড়ে ২০০ টাকা, সন্ধ্যা রাতের খাবারে যদি গড়ে ১৫০ টাকা আর ইফতারিতে ফল যোগ না করে গড়ে যদি ১০০ টাকা খরচ করেন তবে মাসে ব্যয় হবে প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি মাছ-মাংস যোগ হয় তাহলে সাহরিতে ন্যূনতম ৩০০, রাতের খাবারে ৩০০ ও ইফতারিতে ফল যোগ করলে গড়ে ২০০ টাকা খরচ করলে মাসে খরচ হবে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। এ হিসাব চারজনের একটি পরিবারের সর্বনিম্ন হিসাব। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত অক্টোবরের হিসাবে বলা হয়েছে, চারজনের একটি পরিবারে খাবার তালিকায় মাছ-মাংস যোগ করলে মাসে খরচ হবে ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি শুধু খাবারের খরচ। যদি কোনো পরিবার মাছ-মাংস যোগ না করেন তাতে মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৯ টাকা।
সিপিডির গবেষণা সেলের কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, চলতি মাসে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে। পরিবারপ্রতি এ মাসে খরচ আরও বেড়ে গেছে। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর পরামর্শ দিচ্ছি আমরা। কিছু ক্ষেত্রে ট্যাক্স ভ্যাট পুরোপুরি উঠিয়ে দিলে সেখানে সবাই উপকৃত হবে।
সিপিডির অক্টোবরের হিসাবই যদি ধরা হয়, তাহলে এবারের রোজায় খাবারের তালিকা ছোট করা ছাড়া উপায় নেই ভোক্তাদের। ২২ হাজার টাকার সঙ্গে যদি বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ভাড়াসহ গড়ে ১৫ হাজার টাকা ধরলে চারজনের একটি পরিবারের খরচ দাঁড়ায় ৩৭ হাজার টাকা।
অবশ্য সিপিডির এ তথ্য যখন প্রকাশ করা হয়, তখন মুরগির মাংসের কেজি ছিল ১৫০ টাকা, এখন তা ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে। গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকায়, এখন তা ৭৫০ টাকায়। চিনির দাম ছিল ৯৮ টাকায় এখন তা ১২২ টাকায়। অর্থাৎ সব পণ্যেরই দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় কয়েকজন ভোক্তার। বেসরকারি স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিন থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। থাকেন ৩ কামরা একটি ফ্ল্যাটে। তার মাসিক খরচ ৩১-৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে শুধু মাত্র বাসা ভাড়ায় খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা। একমাত্র সন্তানের পড়া ও পরিবারের ভরণ-পোষণে খরচ হয় আরও ১৩-১৫ হাজার টাকা। বাদ বাকি খরচ আরও ২ হাজার। তবে এই শিক্ষক মাসে আয় করেন ২৮-৩০ হাজার টাকা। মাসিক আয় হিসেবে তার অতিরিক্ত খরচ হয় ২-৩ হাজার টাকা।
এ শিক্ষক খরচের সমন্বয় করতে সঞ্চয়ও ভেঙেছেন ইতিমধ্যে। তাতেও তার বাড়তি খরচের টাকা প্রতি মাসে ঋণের খাতায় যোগ হয়। উপায়ান্তর না দেখে পরিচয় গোপন করে মাঝেমধ্যে রাইড শেয়ার দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগত কাজে এসেছিলাম মহাখালীতে। ভাবলাম একই সঙ্গে রোজার বাজার করে বাসাই ফিরি। তবে বাজারে প্রবেশ করে চিন্তায় পড়ে গেলাম। ব্যাগ দেখিয়ে বলেন, ১ কেজি করে মুরগি, মাছ ও ছোলাসহ আরও দুএকটি পণ্য কিনতেই ১ হাজার টাকা শেষ। দামের অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে চাহিদা মতো বাকি সদাইগুলো বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আর নয়তো অর্ধেকের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শুধু স্কুল শিক্ষক শিহাবউদ্দিনই নন, গেল কয়েক মাসে দ্রব্যমূল্যের ভয়াবহ অবস্থার কারণে মধ্য ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। মাছ-মাংস থেকে শুরু করে সব ধরনের সবজির দামও মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিবের মাছ বলে খ্যাত পাঙ্গাস, তেলাপিয়াও এখন বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়। গত ৩-৪ মাস আগেও পাঙ্গাস ১৪০-১৪৫ টাকা ও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি হয়েছিল ১৩৫-৪০ টাকা করে। এছাড়া অন্যান্য মাছের মধ্যে মান ভেদে রুই মাছ ২৯০-৩৮০ টাকা, সরপুঁটি ২০০-৪০০ টাকা, চাষের মাগুর ৬০০ টাকা, শোল মাছ ৮০০ টাকা, গলদা চিংড়ি ১ হাজার টাকা করে বিক্রি করছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
দ্রব্যমূল্য যে সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে, তা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও বলছেন। গত বুধবার শিল্প মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরা বাজারের কোনো মিল নেই। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করছে। ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই দেখা যায়, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। যদিও গত মঙ্গলবার একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানিয়েছেন, চলতি মার্চে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে। চৈত্রের খরা ও রোজায় মানুষের অতিরিক্ত মজুদের কারণে এ মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে বলে শঙ্কার কথা বলেছেন তিনি।
বিবিএসের চিত্রেই আবার ফেরা যাক। গত বছর চিনির কেজি ছিল ৮২ টাকা, সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে ১২২ টাকায়। যদিও বাজারের চিত্র ব্যতিক্রম। গরুর মাংস গত বছরের মার্চে কেজি ছিল ৬১০ টাকা, কিন্তু বছর ঘুরতেই এ পণ্যের দাম এখন ৭৫০ টাকা। মানুষ বেশি দামে গরুর মাংস কিনতে না পেরে কিছুদিন আগেও ভরসা করত ব্রয়লার মুরগির ওপর, যার দাম এখন ২৬০ থেকে ২৮০ টাকার মধ্যে।
রমজানের ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে ফলের ওপর। কিন্তু সেই ফলের দামও লাগামছাড়া। ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ফলের ওপর শুল্কারোপ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ফলে গত কয়েক মাস ধরেই ফলের দাম অনেক বেশি।
সাহরিতে রোজাদারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর অন্যতম উপাদান দুধ। গত বছরের মার্চে দুধের লিটার কিনতে হয়েছিল ৭০ টাকায়, এ বছর তা ৯০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।
ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম শফিকুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে করোনার ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের একটা প্রভাব রয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি বলেন, রমজানের ভোক্তা পর্যায়ে ভোগান্তি কমাতে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছি। মাঠ পর্যায়ে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেখানে অনিয়ম পাচ্ছি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিছুটা দায়ী। কিন্তু পুরোপুরি না। সম্পূর্ণ দায় এ যুদ্ধের ওপর চাপানো ঠিক না। ভোক্তাদের দায় বেড়েছে, তাদের ওপর চাপও বেড়েছে।
সিন্ডিকেশন করে মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে মাত্র ৫২ দিনে বড় উৎপাদকদের একটি চক্র ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পোলট্রি খাতের উদ্যোক্তাদের অন্য একটি সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন গতকাল বৃহস্পতিবার এ অভিযোগ করে। এদিকে মুরগির দাম নিয়ে ‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। অন্য এক মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম না কমালে তা তারা বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবেন। রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে পোলট্রি সেক্টরে। প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম ও প্রান্তিক খামারি পর্যায়ে উৎপাদন কমায় এখন দুই থেকে আড়াই হাজার টন সরবরাহ হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ আগে কম থাকলেও এখন প্রতি কেজিতে ১৬০-১৬৫ টাকা এবং করপোরেট কোম্পানিদের উৎপাদন খরচ ১৩০-১৪০ টাকা। কিন্তু পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত।
সংগঠনটি জানিয়েছে, ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজিতে যদি অতিরিক্ত ৬০ টাকা মুনাফা ধরা হয় তবে প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার টনে ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৫২ দিনে শুধু ব্রয়লার মুরগি থেকে ৬২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ সিন্ডিকেট। এ ছাড়া এক দিনের মুরগির বাচ্চা প্রতিদিন উৎপাদন হয় ২০ লাখ। একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। যা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ১০-১৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত সেই বাচ্চা ৬২ থেকে ৬৮ টাকা মেসেজ করলেও প্রকৃতপক্ষে তা বিক্রয় হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা। প্রতি বাচ্চায় ৩০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা ধরা হলে আলোচ্য সময়ে মুরগির বাচ্চা বিক্রি থেকে ৩১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা বিক্রি থেকেই ৫২ দিনে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শীর্ষ কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান।
পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড ও মুরগির বাচ্চা শতভাগ উৎপাদন করে করপোরেট গ্রুপ। তারাই আবার আংশিক ডিম ও মুরগি উৎপাদন করে এবং চুক্তিভিক্তিক খামার করেন। এতে বাজার এসব প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে যাচ্ছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম কমল ৪০ টাকা : ব্রয়লার মুরগির বাজার নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ উৎপাদনকারী ফার্মগুলো নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোজার মাসে ভোক্তা পর্যায়ে অস্বস্তি কমাতে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি খামারি পর্যায়ে ১৯০-১৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে বলে জানিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় চারটি মুরগি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। যা গেল কয়েক সপ্তাহে ২২০-২৩০ টাকায় বিক্রি হয়ে আসছে। হাতবদল হয়ে এসব মুরগি ভোক্তাপর্যায়ে এসে বিক্রি হচ্ছে ২৭০-২৮০ টাকায়।
‘বিগ ফোর’ হিসেবে পরিচিত এই চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল তলব করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। আলোচনার পর ওই চার কোম্পানি ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ৪০ টাকা কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকারের কনফারেন্স কক্ষে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক হয়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, গতকাল আমরা ২৭০-২৮০ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হতে দেখেছি। এ দাম অযৌক্তিক। এটা ২০০ টাকার বেশি হতে পারে না। ফার্ম পর্যায়ে ২২০-২৩০ টাকা দরে ব্রয়লারের কেজি বিক্রি হচ্ছে। হাতবদল হয়ে ভোক্তাপর্যায়ে এ অবস্থা। ব্রয়লার মুরগি এসএমএসের মাধ্যমে নিলাম হচ্ছে। আমি তাদের আহ্বান করেছি, আপনারা এ রমজান মাসে একটু কম লাভ করেন। তারা একমত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, খামার থেকে আসা ব্রয়লার মুরগি হাতবদলে যেন দাম খুব বেশি না বাড়ে, সে বিষয়ে সংস্থাটি নজর রাখবে। ব্রয়লারের দাম কমাতে প্রয়োজনে বর্ডার উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এ সময় কাজী ফার্ম কর্তৃপক্ষ জানান, তারা রমজানে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ব্রয়লার বিক্রি করবেন ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায়। এ বিষয়ে একমত পোষণ করছে আফতাব, প্যারাগন ও সিপি কোম্পানি।
রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে : মুরগি ও গরুর মাংসের দাম বাড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারকে আগামী দুই-তিন মাসের জন্য মুরগি ও গরুর মাংস বিদেশ থেকে আমদানি করার সুপারিশ করবে সংগঠনটি। গতকাল এফবিসিসিআই বোর্ডরুমে ‘রমজান উপলক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুদ, সরবরাহ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় সভায়’ এ কথা জানানো হয়। এ সময় সংগঠনটির সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, রমজানের নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশীয় উৎপাদক, ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখার জন্য সরকার কিছু পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ ও কিছু পণ্য আমদানি বন্ধ রেখেছে। এ সুযোগে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ালে হবে না। ভোক্তার ওপর এত চাপ দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বাজারে চাহিদার তুলনায় বেশি খেজুর আছে। পর্যাপ্ত রয়েছে ছোলা, পামঅয়েল, সয়াবিনসহ অন্যান্য পণ্য। আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুদ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
জসিম উদ্দিন বলেন, এখন গরু ও পোলট্রির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। দেশীয় এ খাত বাঁচাতে এতদিন মাংস আমদানি বন্ধ ছিল। এখন তারা যদি সঠিক মূল্যে গরুর মাংস ও ব্রয়লার মুরগি দিতে না পারে তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলব, বাজার ঠিক রাখতে আমদানির অনুমতি দেওয়ার জন্য। আমদানি করলে যদি বাজারে দাম কমে যায়, তাহলে আমদানি করতে হবে। মানুষ যদি ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির কথা চিন্তা করে লাভ নেই।
এফবিসিসিআই সভাপতি ব্যবসায়ীদের বলেন, এবার সরকার বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে কঠোরভাবে। কোনো বাজারে বেশি মূল্য রাখা হলেই সেই বাজার কমিটি বাতিল করবে সরকার। একই সঙ্গে দাম বেশি নেওয়া প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সও বাতিল করা হবে। আমরা চাই না, রোজায় কোনো ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল হোক, কাউকে আটক করা হোক।
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের সমস্যা থাকতে পারে। সমস্যাটি আমাদের জানাবেন। আমরা কথা বলব। আমাদের টিমও বাজার মনিটরিংয়ে থাকবে। আশা করব আপনারা কেউ বেশি মুনাফা করবেন না।
জনগণের জানার অধিকার রয়েছে কাকে কোনো প্রকল্পের কাজ দেওয়া হচ্ছে, কার সঙ্গে কী চুক্তি হচ্ছে এবং তা কীভাবে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতির কোনো কিছুই প্রকাশ করা হচ্ছে না। অদক্ষভাবে বিদ্যুৎ চুক্তির কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়ে থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে আয়োজিত ‘নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ (খসড়া) : এটি কি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে?’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কোনো একটি পক্ষকে সুবিধা দিয়ে কাজ দেওয়ায় দুর্নীতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
বিদ্যুতের বড় ঘাটতি মেটাতে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের প্রয়োজন ছিল। তবে বর্তমানে আইনটি অদক্ষতার জায়গা তৈরি করছে বলে মনে করে সিপিডি। সংস্থাটির মতে, জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণ বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে। কোনো কোনো পক্ষ পাচ্ছে বাড়তি সুবিধাও। অবিলম্বে আইনটি বাতিল করার দাবি জানিয়ে সিপিডি বলছে, নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- এমন চুক্তিতে গেলে বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরকার সরে আসতে পারবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৯ সালে জরুরি বিদ্যুৎ আইনের প্রয়োজন ছিল। ওই সময় বড় রকমের বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, সেটা মেটানোর জন্য চুক্তির দরকার ছিল। এরপর চারবার নবায়ন হয়েছে ওই আইন। আমরা মনে করি, এখন যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, এরকম চুক্তির আর প্রয়োজন নেই।
দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই আইন থেকে সরকারের সরে আসা দরকার। এই আইন বিভিন্নভাবে সমস্যা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি নিয়ে যেসব চুক্তি হয়েছে, এর আগেও যেগুলো হয়েছে- সেগুলো এখন সরকারের জন্য বড় রকমের মাথাব্যথার কারণ। এর মূল কারণ এই দ্রুত জ্বালানি সরবরাহ আইন।
সিপিডির এ গবেষণা পরিচালক বলেন, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি সমন্বয় নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কাজ করছে সরকার। বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির সমন্বয় করা হচ্ছে ভোক্তার ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে। ভুল পলিসির কারণে এমনটি হচ্ছে। এর ফলে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে, ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে ব্যাপক হারে। সেটির দায় ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি সমন্বয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনটি যদি অবলোপন করে নো ইলেকট্রিসিটি, নো পে- চুক্তির দিকে যদি যাওয়া যায়, তাহলে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বাড়তি ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে। ফসিল ফুয়েল থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে গেলে বড় রকমের ভর্তুকির চাপ থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমরা শুনে এসেছি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের মূল্য সবচেয়ে কম। অথচ নতুন চুক্তির অধীনে আমরা যে ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আনা শুরু করলাম, সেটার মূল্য তো ১৫ টাকা। এটা তো বোধগম্য না কী করে এরকম মূল্য, এরকম জায়গায় আমরা চুক্তি করতে পারি।
জ্বালানি চুক্তি খোলামেলা হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, কোনো চুক্তির ডকুমেন্টস আমরা পাই না। কী রেটে চুক্তিগুলো করা হচ্ছে- জনগণের সেটা জানার অধিকার রয়েছে।
নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২২ এর খুঁটিনাটি তুলে ধরে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এতে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেসব চুক্তি হচ্ছে, সেগুলো কতটা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে করা হচ্ছে, তা আলোচনা হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি আহরণ, তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। ২০০৮ সালে গৃহীত পলিসির আওতায় সামগ্রিক উৎপাদনের ৮ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এটা পলিসির ব্যর্থতা।
তিনি আরও বলেন, নতুন নীতিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের কথা বলা হয়েছে। শুধু সোলার বলেই ছেড়ে দেওয়া হয়নি। রুফটফ সোলার, নেট মিটারিং, মিনি গ্রিড, ন্যানো গ্রিড, সোলার ইরিগেশন, চার্জিং স্টেশন, স্ট্রিট লাইটে রিনিউয়েবল এনার্জি, ফ্লোটিং সোলার সিস্টেম- এরকমভাবে ডিটেইল বলা আছে। একইভাবে উইন্ড এনার্জি, বায়োমাস এনার্জি, বায়ো ফুয়েলের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির কিছু নতুন উৎসের কথাও এখানে বলা হয়েছে। এর ভিত্তিতে আগামীতে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কথা বলা হয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। এতে কিছু টার্গেটের কথা বলা হয়েছে। রিনিউয়েবল এনার্জির ক্ষেত্রে কিছু টার্গেট দেওয়া হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কথা এতে উল্লেখ রয়েছে জানিয়ে এই গবেষণা পরিচালক বলেন, স্রেডাকে এখানে নোডাল এজেন্সি বলা হয়েছে। আমরাও তাই মনে করি। কিন্তু স্রেডাকে সব ধরনের ক্যাপাসিটি দিতে হবে। বড় পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রস্তাবনা দেখভাল করার ও অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা স্রেডাকে দেওয়া উচিত। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সংস্কার দরকার আছে। তবে এই সংস্কার আবার খসড়া প্রস্তাবে অনুপস্থিত।
তিনি বলেন, নুতন নীতিতে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকারের আবার নীতি সংস্কার হয়েছে। মন্ত্রণালয় তার হাতে কর্তৃত্ব নিয়ে ফেলছে। এর ফলে রেগুলেটরি কমিশনের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে জ্বালানি নীতিতে যে গাইডলাইন দেওয়া আছে, আর সরকার এখন যেভাবে দাম নির্ধারণ করেছে, তাতে এটা এখন উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করছে।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসি-২০২২ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান বিদ্যুৎ খাতে যে সংকট রয়েছে তা অনেকটাই কমে যাবে।
সকাল
‘বড় ভাই, গাবতলী কোন দিকে?’ কিছুটা দৌড়ে এসে জানতে চায় এক ছেলে। হাতের ইশারায় বাম দিকের রাস্তা দেখিয়ে বলি, ‘এখান থেকেই বাসে উঠতে হবে।’ ছেলেটি ফের জানতে চায়, ‘আমার কাছে টাকা নাই। গাবতলীতে হাঁইটা যাইতে কতক্ষণ লাগবে?’ বলি, ‘সে তো অনেক টাইম লাগবে। ঘণ্টাখানেক তো লাগবেই।’
ছেলেটি সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে নেয়। তারপর দেখানো রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে। তার পায়ের দিকে আমার চোখ যায়। দুটি পা-ই খালি। ডান পায়ের তালু আবার গামছার কিছু অংশ দিয়ে বাঁধা। মনে হচ্ছে সেখানে কোনো ঘা রয়েছে বা কেটে গেছে। পরনে পুরনো একটা জিন্সের প্যান্ট; নিচের দিকটা ছেঁড়া ও কাদামাখা। গায়ে চেক ফুলশার্ট। মুখভরা ব্রণ। গোঁফ গজাচ্ছে। হাতে একটি লুঙ্গি!
আমি বলি, ‘এখানে ওয়েট করো, বিআরটিসি বাস এলে উঠে পড়বে। বলবে, টাকা নাই!’ ছেলেটি বলে, ‘আরে নাহ। টাকা না থাকলে ম্যালা কথা শুনতে হবে।’ সে গায়ে চাদর জড়ানোর মতো করে লুঙ্গিটি জড়িয়ে হাঁটতে থাকে। আমি তাকিয়ে থাকি তার দিকে। ইসিবি-চত্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে বসুমতী কিংবা রবরব পরিবহনে গাবতলীর ভাড়া ৩০ টাকা। বিআরটিসিতে ১০ টাকাতেই হবে। ছেলেটিকে কি আমি টাকাটা দেব? তাকে কি থামতে বলব? আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। ছেলেটি হেঁটে চলছে তো চলছেই! আমার বাস চলে আসে।
বিকেল
রঙিন কাগজে মোড়ানো প্যাকেট হাতে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা অ্যাপ্রন পরা মেয়েটি এসে তার পাশেই দাঁড়ায়। ইসিবি-চত্বরে পৌঁছামাত্র বৃষ্টি ধরে ফেলে আমাকে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে একটি দোকানের সামনে আশ্রয় নিই। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন।
কিছুক্ষণ পর কানে এলো একটি শব্দ। কীসের শব্দ? গাড়ির হর্ন, রিকশার বেল আর বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে যেটি আমাদের কানে এলোÑ গ্লাস ভাঙার শব্দ। ডান পাশে তাকাতেই দেখি ফুটপাতে একটি অর্ধেক লাল রঙের ভাঙা মগ পড়ে আছে, যেখানটায় সাদা অ্যাপ্রন পরা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের সবার চোখ সেদিকে চলে যায়। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে মেয়েটির চেহারা দেখা যায় না। ছেলেটির চেহারা দেখা যাচ্ছে।
শুনতে পেলাম মেয়েটি বলছে, ‘আর কক্ষনো গিফট দিবা না। ছেলেটি বৃষ্টিতে ভিজছে; মেয়েটি ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে। ছেলেটি একেবারে চুপ, মুখটা মলিন।
‘বুঝলা?’ এবার মেয়েটির গলা বেশ চড়া; ধমকের সুর। ততক্ষণে ছেলেটি ফুটপাতে বসে পড়েছে। বৃষ্টির পানি আর তার চোখের পানি একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই দেখছি। ছেলেটি আর মেয়েটিও আমাদের দেখছে। কোনো শব্দ নেই। মেয়েটি অকারণে দাঁড়িয়ে আছে, ছেলেটিও অকারণে বসে আছে। এ দৃশ্যের যেন সমাপ্তি নেই!
ছেলেটি মেয়েটিকে পছন্দ করে; মেয়েটি করে না। গিফট ছুড়ে দিয়েই মেয়েটির হাঁটা দেওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। কৌতূহল বাড়ছে আমাদের।
যাব যমুনা ফিউচার পার্কে। বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তা পার হয়ে ইসিবি-চত্বরের ডান পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জাবালে নূর কিংবা আকিক পরিবহনের জন্য অপেক্ষা করছি আর ওই মেয়ে আর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছি। মিনিট দশেক পর দেখি, মেয়েটি চলে যাচ্ছে মাটিকাটা বাজারের দিকে। কিন্তু ছেলেটি সেখানেই বসে আছে।
আমি ছেলেটির কথা ভাবছি। ভাবছি বৃষ্টির কথাও। কী দারুণ কম্বিনেশন! হয়তো কিছুক্ষণ পর ছেলেটি উঠে চলে যাবে।
জাবালে নূর চলে এসেছে। আমি উঠতে যাব, ঠিক তখনই দেখি মেয়েটি ফিরে আসছে ছেলেটির দিকে। বাসে আর ওঠা হয় না আমার। শেষ দৃশ্য দেখার জন্য বৃষ্টির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকি।
মেয়েটি বেশ দূরে চলে গিয়েছিল; কিন্তু ফিরল কেন? আমার হিসাব মেলে না। মেয়েটি ছেলেটির পায়ের কাছে পড়ে থাকা অর্ধেক ভাঙা মগটি তুলে নিল। ভাবলাম, রাগ কমেছে। ছেলেটির এভাবে বসে থাকা ওর মনে দাগ কেটেছে। কিন্তু নাহ। মেয়েটি অর্ধেক ভাঙা মগটি আবারও ছুড়ে ফেলে দিল ফুটপাতে। এবার মগটি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। লাল রঙের মগটির টুকরো অংশগুলো দেখে মনে হলো, ছেলেটির হৃদয়টাও টুকরো হয়ে ফুটপাতে পড়ে গেল। আমি বাসে উঠে পড়ি।
সন্ধ্যা
সন্ধ্যা ৭টা। সাত-আট বছরের একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইসিবি-চত্বরের একটি দোকানের সামনে। আমাকে দেখেই কী যেন বলে। আমি বুঝতে পারি না। পরের কথাটা ঠিকই বুঝতে পারি। সে আইসক্রিম খাবে। আমাকে বলে, ‘একটা আইচকিরিম কিনে দিবেন?’
আমি মানিকদি এলাকার দিকে যাব। রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। রিকশা, বাইক, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক যাচ্ছেই। কোনো বিরাম নেই। মেয়েটিকে বলি, ‘তোদের বাসা কোথায়?’ মেয়েটি উত্তর না দিয়ে কয়েক বিল্ডিং পরের একটি বাসা দেখিয়ে বলে, ‘আমার মায় ওই বাসায় কাজ করে।’
রাস্তাঘাটে প্রায়ই সাত-আট বছরের ছেলেমেয়েদের আবদারের পাল্লায় পড়তে হয়। কখনো প্রশ্রয় দিই, আবার কখনো এড়িয়ে যাই। আজকেও বিষয়টি এড়িয়ে রাস্তা পার হতে যাব এমন সময় অজান্তেই পেছন ফিরে তাকাই। দেখি, মেয়েটিও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করি। পারি না। তবে মনে হলো ওর চোখ কী যেন বলতে চায়। আমার পা থেমে যায়। বলি, ‘একটু দাঁড়া, আইসক্রিম কিনে দিচ্ছি।’
মেয়েটিকে দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে ঢুকলাম ভেতরে। একটি ইগলু চকবার কিনলাম। দোকানদারের কাছে ভাংতি না থাকায় তিনি দুটি চকলেটও ধরিয়ে দিলেন। আমি মেয়েটির হাতে চকবারটি ধরিয়ে দিই। মেয়েটি আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়েই দৌড়। দুটো চকলেট আর দেওয়া হয় না। মেয়েটি আইসক্রিম হাতে নিয়েই রাস্তা দ্রুত পার হয়ে মানিকদির দিকেই যাচ্ছে। আমিও ওর পেছন পেছন দ্রুত হাঁটছি।
ইসিবি-চত্বর পার হয়ে মেয়েটি মানিকদির দিকে যেতে লাগল। মেয়েটি আইসক্রিম না খেয়ে কোথায় যাচ্ছে! আমার কৌতূহল বাড়ে। ওকে ফলো করতে থাকি। মেয়েটি কিছুদূর গিয়ে থামে। আমিও থামি। কবরস্থানের দেয়ালের পাশের ফুটপাতে এক বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসে পড়ে। আমি একটু দূরে মোবাইলে কথা বলার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ‘ও দাদি, তোমার লাইগা আইচকিরিম আনছি।’ নিয়নলাইটের আলোয় তার চেহারাটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল না। তবে বয়সের ভারে সে যে ন্যুব্জ সেটা বুঝতে পারছিলাম।
রাত
স্রেফ এক সেকেন্ড। হাইড্রোলিক ব্রেক না থাকলে কী যে ঘটত! তাকিয়ে দেখি, আমার বাইকের সামনে এক নারী দাঁড়িয়ে; তার কোলে এক-দেড় বছরের এক বাচ্চা। ফুটপাত থেকে হুট করে নেমে ওই নারী আমার বাইকের সামনে; আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছেন।
রাত ১১টা। অফিস থেকে বাসায় ফিরছি। বাইকের গতি ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার পার হয়ে শুধুই মাটিকাটা ফুটওভার ব্রিজ পার হয়েছি। ইসিবি-চত্বরে আসামাত্রই ওই নারী সামনে এসে পড়লেন।
বাইক থামিয়ে ধমক দিতে যাব। কিন্তু সড়কবাতির আলোয় চোখ যায় তার কোলে থাকা বাচ্চার দিকে। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাইকটার ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যাই। নারী বলেন, ‘মাইয়াডা না খায়া আছে। কিছু টাকা দেবেন?’ আমার বুকটা ধুক করে ওঠে।
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।
একাত্তরের যুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল, বিশেষ করে নজরুল ছিলেন বাঙালির সংগ্রামী চৈতন্যের অগ্নিস্রোত। কথা না-থাকলেও সেই দুর্বার সময়ে বিষণœতার কবি জীবনানন্দ দাশ ওই অগ্নিবলয়ের ভেতর ঢুকে গেলেন। কেন ঢুকলেন তা বিচার করতে চাইলে বাঙালি সংস্কৃতি এবং মানসচৈতন্যের দিকে তাকাতে হবে। কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ, ভাবুক, দুঃখবাদী, বিষন্ন, প্রকৃতিমুগ্ধ, কৃষিভিত্তিক জীবনবিলাসী বাঙালি রক্তাক্ত বিদ্রোহের ভেতরও ‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক’ আর ‘দু’দণ্ড শান্তি’-এর মতো ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে কেন বারবার স্মরণ করত? এ প্রশ্ন অনিবার্য। আশ্চর্য এই যে, ভাববাদী রোমান্টিকরা তো বটেই, চরম বস্তুবাদী রিয়ালিস্টিক পাঠকও জীবনানন্দকে এড়িয়ে যেতে পারে না। কোন জাদুতে? জীবনানন্দ নিজেই কি ম্যাজিক বা ম্যাজিশিয়ান, তার শব্দ, চিত্রকল্প, উপমা, কাব্যভাব কি ম্যাজিক? জীবনানন্দ মুগ্ধতা কি ক্রমবিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাঙালির বাঙালি হয়ে ওঠার নানা উপাদান অর্থাৎ চারিত্রিক এবং সাংস্কৃতিক নানা দুর্বলতার ফল মাত্র? বাঙালির মানসচেতনার সীমাবদ্ধতার কথা সত্যি জানতেন জীবনানন্দ। তিনি নিজেও যে একই গোত্রের। তার কবিতার শব্দ-প্রযুক্তিবিদ্যা, ধ্বনিমাধুর্য প্রবাহ, রূপকল্পের আবেগী ব্যবহার, অতীন্দ্রিয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যবহার বাঙালিকে বিস্মিত করেছে।
দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা, দীর্ঘ উপনিবেশিক শাসন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘরে ও বাইরে চিরক্লান্ত, আশাশূন্য, বিধ্বস্ত এবং ঘোর অবসাদাক্রান্ত বাঙালিকে জীবনানন্দের কবিতা গভীর আত্মমুখী আঁধারে ডুবিয়ে দেয়। সমকালের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পরিবার এবং ব্যক্তির অন্তর্নিহিত রোগ, অসহায়ত্বকে ধরতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ। নিজের জীবনের ওপর পরীক্ষাও করেছেন। তার অকাল মৃত্যুও ভেতর গোপন অদৃশ্য ব্যাধির ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই।
জীবনানন্দের কবিতার ভেতরই জটিল রহস্য রয়েছে। তার কবিতা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত সমাজ ও ব্যক্তিকে আশ্রয় নিয়ে ‘দু’দণ্ড শান্তি’ নিতে উসকে দেয়। মানুষের মগজে, স্নায়ুতন্ত্রীতে মাদকের মতো ‘প্রশান্তির জগৎ’ তৈরি করে। যে কাব্য সমালোচকরা তার কাব্যে জীবনবিমুখতা, আত্মপলায়নপরতা কিংবা অবক্ষয়ী মূল্যবোধের চর্চার অভিযোগ এনেছেন, তাদের সব যুক্তিকে বাতিল করা যায় না। এ কথাও সত্য যে, তাকে নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গুরুত্ব লঘু করা না। কেন যায় না তা নিয়ে আমরা তর্কে যাব না, কেননা আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়, উদ্দেশ্য বরং একাত্তরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে তাকে নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং চর্চার সীমানাটা খুঁজে দেখা। এ দেখাটা স্বাধীন দেশের বাঙালির জন্য জরুরি।
সাহিত্যের দহলিজে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে, বুদ্ধিজীবী মহলে জীবনানন্দ চর্চা পূর্ববঙ্গে পঞ্চাশের দশকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও চর্চার সঙ্গে জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ চর্চারও একটা যোগসূত্র দেখা যায়। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের কিছু আগে বা পরে জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র রণেশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় বাংলাবাজার থেকে বের হয়। ব্যাপক সাড়াও ফেলে। জীবনানন্দ অনুসন্ধানের আগে আমরা জেনে নিতে চাই তার শিল্পের মননজগৎ তৈরির পেছনের সামাজিক, রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক কার্য-কারণগুলো। জীবনানন্দের কাব্যসাধনা এবং তার বিকাশ ও পরিণতি ঘটে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন, সময়ের সেই প্রভাবেই তিনি আন্দোলিত হয়েছেন।
বাংলায় উপনিবেশিক শাসন-শোষণ, জমিদারতন্ত্র, হিন্দু বর্ণবাদ, হিন্দুধর্ম আর ব্রাহ্মধর্মে সংঘাত, হিন্দুধর্মের শাক্ত আর বৈষ্ণব মতবাদীদের পরস্পর বিদ্বেষ, দেবী কালী আর অবতার কৃষ্ণের বিবাদ সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করে অস্থিরতা। সেই ইতিহাসই পরবর্তীকালে দেখিয়ে দেয় কেমন করে ভাঙন ধরে হিন্দুধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা-বিরোধী নতুন ধর্ম ব্রাহ্মবাদেও। শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে এর বর্ণনা আছে। বরিশালের ব্রাহ্মসন্তান জীবনানন্দ দাশও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ব্রাহ্ম হওয়ার কারণে হিন্দুপ্রধান কলকাতা শহরে জীবনানন্দের জীবন-জীবিকাও সংকটে পড়ে। কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা করতে গিয়ে তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও তিনি শান্তি পাননি। ব্যক্তির এই সামাজিক হতাশা তার কাব্যে সংক্রমিত হয়। একটা কথা উল্লেখ করতেই হয় যে, সাতচল্লিশের আগে ও পরে পূর্ববঙ্গের ‘বাঙাল’ আর দেব-দেবী বিদ্বেষী ব্রাহ্মদের জন্য মহানগর কলকাতা এক দুর্ভোগের স্থান হয়ে ওঠে।
বাংলা তো বিশ্বমানচিত্রের বাইরে নয়, বিশ্বেরই সে অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বের যে কোনো কম্পনই তাকে ছুঁয়ে যাবে। বিশ্বপুঁজির মহাসংকটের নগ্ন প্রকাশ ঘটে প্রথম মহাযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। তথাকথিত উন্নত ইউরোপ তো বটেই, উপনিবেশিক অনুন্নত দেশগুলোতেও মানুষের হতাশা, ভয়ংকর ভীতি ও ধ্বংসস্তূপের ভেতর মৃত্যুর প্রেতছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। এর কম্পন-প্রকম্পন থামতে না থামতেই এসে যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। আরও জটিল, আরও বহুমাত্রিক বিভীষিকা নেমে আসে বিশ্বে। বঙ্গ-ভারতের গণমানসে মুক্তির স্পৃহা জেগে ওঠে। উপনিবেশিক শোষণ আর দেশীয় উৎপীড়ন থেকে মানুষ মুক্তি চায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং সশস্ত্র লড়াই সামনে এসে দাঁড়ায়। শাসকরা দেশীয় বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটায় স্বাধীনতা, আজাদী, স্বরাজের নামে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ব্যাপক ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া মানবসভ্যতা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিশ্ব সমাজতন্ত্র গড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেটা বুঝতে পেরে পুঁজিবাদী শক্তি ইউরোপের দেশে দেশে ব্যক্তির মুক্তি, সামাজিক মুক্তি এবং জাতীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে নানারকম নতুন নতুন দর্শনের উদ্ভব ঘটানোর জন্য একদল দার্শনিককে কাজে নামিয়ে দেয়। জীবনবিমুখ অতীন্দ্রিয়বাদী দর্শনকে কবর থেকে টেনে তুলে আনে। ফরাসি বিপ্লবের দার্শনিক ভলতেয়ারের ভাবশিষ্যরাই বিস্ময়করভাবে আত্মসমর্পণ করে সোরেন কিয়ের্কগার্ড-এর বাতিল অস্তিত্ববাদের প্রেতের কাছে। তারা উচ্চকণ্ঠ হলেন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে। ঘোষণা করলেন যে, হতাশা, বিষন্নতা, বিষাদ, দুঃখবাদ আর আত্মবিচ্ছিন্নতার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে মানব জীবনের সুখ-আনন্দ-পরম শান্তি।
দর্শনচর্চাকারী মাত্রই জানেন যে, কিয়ের্কগার্ড দর্শনের মৌল উপাদান হলো এই ধারণা যে, মানব অস্তিত্বের প্রকৃত রূপ নিঃসঙ্গতা, কোনো মানুষই এই নিঃসঙ্গতাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে না। হেগেলের যুক্তিবাদকে খণ্ডন করে কিয়ের্কগার্ড দাবি করেন ঈশ্বরই হচ্ছে একমাত্র পথ। ব্যক্তিমানুষকে ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হবে পাপবোধ, আত্মগ্লানি, অনুতাপ, নৈরাশ্য, যন্ত্রণা, সামাজিক শোষণ-উৎপীড়ন, হিংসা, হিংস্রতা থেকে মুক্তির জন্য। ব্যক্তির দুঃখ ভোগ যত বৃদ্ধি পাবে, ততই ব্যক্তির চেতনায় ধর্ম ও ঈশ্বরভাব জাগ্রত হবে। এতেই তার আত্মার মুক্তি ঘটবে।
কিয়ের্কগার্ডের জন্য দর্শনচর্চার উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা এবং মানুষের অবসাদ-নৈরাশ্য। সেই ব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে। জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। সেই ভাষাই তার সংযোগ ঘটায় কিয়ের্কগার্ড দর্শনের সঙ্গে। রুশ বিপ্লব এবং বস্তুবাদী দর্শন তাকে আন্দোলিত করে না। তার বিশ্বাসের সাক্ষ্য রেখে গেছেন তিনি নিজের লেখায়। ‘আধুনিক কবিতা : কবিতার কথা’ তার দলিল। দ্বিধাশূন্য জীবনানন্দ বলছেন, ‘কিয়ের্কগার্ড প্রভৃতি দার্শনিকের অস্তিত্ববাদ যা প্রমাণ করেছে সেটা মানুষের প্রাণধর্মে টিকে থাকার... দার্শনিক তথ্য হিসেবে মানুষকে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন... তার সাহিত্যিক শিষ্যদের রীতির চেয়ে আরও নিপুণ ও নির্ভুল প্রয়োগে, মানুষের জীবনের এই অন্তর্নিঃসহায়তার কথা ফুটে উঠেছে...।’ সহজ কথায়, এটা নির্মম সত্য যে, জীবনানন্দ বাঙালি পাঠকদের ঘাড়ে তার নিজস্ব অন্তর্নিঃসহায়তার বোঝা চাপিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।
কেবল কিয়ের্কগার্ড নয়, ফ্রেডারিখ নিটসে, পাস্কাল, মনোবিজ্ঞানী অ্যালফ্রেড অ্যাডলার এবং আরও অনেকে বিজ্ঞানবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন যুদ্ধবিধ্বস্ত নৈরাশ্যবাদী ক্লান্ত মানুষের সামনে তুলে রেখে গেছেন। আশ্চর্যজনকভাবে তারা বিশ্বাস করতেন বুদ্ধি, মুক্তি, বিজ্ঞান নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস, তার অনুভূতিই জীবন বাস্তবতার আসল সত্য। জীবনানন্দ যখন এসব চর্চা শুরু করেন তার আগেই সারা ইউরোপে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাদকে মরণসংকট থেকে রক্ষা করা।
যুদ্ধ, ধ্বংস, চূড়ান্ত শোষণ, মানবতার মহাবিপর্যয় না ঘটিয়ে ব্যাধিতে আক্রান্ত যে পুঁজিবাদ টিকতে পারে না, এই বাস্তবতার ভেতর দার্শনিক রুশোর দর্শনে কথিত সেই ‘ঘধঃঁৎধষ গধহ’ সার্ত্রে-এর বিশ্বাসে কোনো রূপ নেয়? সার্ত্রে ব্যক্তিমানুষকে তার বাস্তব স্থান আর সময়কালের সূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে মুক্ত ব্যক্তিসত্তার কল্পনার দিকে টেনে নেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিমানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের বন্ধন থেকে কোনোভাবেই মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না। সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদও ব্যক্তিমানুষকে তার প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। ব্যক্তিমানুষ চূড়ান্তভাবেই নিঃসঙ্গ; পৃথিবীর বিপক্ষেও সে। একেবারেই একা।
সার্ত্রের ভাববাদী দর্শন ব্যক্তিমানবসত্তা সম্পর্কে কী বলে? অতলান্তিক কালস্রোতে ভাসমান মানুষ মুহূর্তকালের ভেতরই শূন্যতায় আক্রান্ত হয়। এই শূন্যতা তাকে আতঙ্কের ভেতর ঠেলে দেয় এবং দাঁড় করিয়ে দেয় বিমূর্ত এক সত্তার সামনে। সেই সত্তাটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, বরং অতীন্দ্রিয়। স্বাধীনতা যেহেতু অসীম এবং নিরঙ্কুশ তাই প্রতিকূল সমাজে ব্যক্তিমানুষ এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমন বিশ্বাসের ভেতর সার্ত্রে মনে করতেন উৎকণ্ঠা থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ব্যক্তিমানুষ কখনো সমষ্টি বা সঙ্ঘের সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, মিলিত হওয়ার চেষ্টাটা কেবলই দুঃস্বপ্ন। সার্ত্রের ভাবশিষ্যরা তো এই দর্শনই তাদের সাহিত্যের নানা শাখায় প্রয়োগ করেছেন।
সার্ত্রে কেবল ইউরোপ নয়, ইংরেজি ভাষাকে বাহন করে বঙ্গভারতে শিক্ষিত শ্রেণির একাংশের চেতনায় প্রবেশ করেন। জীবনানন্দ কিন্তু তাদেরই দলে। সার্ত্রে চিরন্তন সত্যবাদ, ঐতিহ্যবাদ, ধর্মবাদ এবং বুর্জোয়া নৈতিকতাবাদের বিরোধিতা করে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের পক্ষ নিলেও সামাজিক শ্রেণি ও শ্রেণি দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে সম্মত হননি। বস্তুজগৎ এবং মানবমনের দ্বন্দ্বের বাস্তবতাকে তিনি অবজ্ঞা করেছেন। তার দাবি ছিল, ‘No general ethics can shwo you what is to be done’ এবং ‘ও I have got to limit myself to what I see’
মানব অস্তিত্বরক্ষার সুনির্ধারিত কোনো অর্থ বা কারণ সার্ত্রের বিশ্বাসের দর্শনে নেই। তিনি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন যে, চরম অস্তিত্ব সংকটে নিপতিত মানুষ অন্ধের মতো আশ্রয় সন্ধানে আবর্তিত হবে। নিঃসঙ্গতা, আতঙ্ক, উদ্বেগ তার নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জগৎ তার কাছে অনিয়ন্ত্রিত অন্ধকার হেঁয়ালি এবং যুক্তিশূন্য। তার গল্পের নায়ককে তাই উচ্চারণ করতে হয়, ‘The nausea is not inside me, I feel it out There... I am the one who is within it......’
বিস্ময়কর এটাই যে, অস্তিত্ববাদী এই দর্শনকে মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত মানুষদের একাংশ বরণ করে নেয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ভয়াবহ যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত মানবতা, অবক্ষয়ী নৈতিকতার ভেতর মনোলোকের এই অন্তঃসারশূন্যতা ব্যক্তিমানুষকে মহাশূন্যে ভাসমান মৃত গ্রহের ভগ্ন অণুর মতো ঘিরে ধরে। সে সময়ের কবিরা তো মানবচেতনার আশা-প্রত্যাশা আর নতুন স্বপ্নের বদলে দেখতে পেলেন চরাচরের চারদিকে কেবলই নির্জন শূন্যতা আর মৃত্যু। কাফ্কার মতো সংবেদনশীল শিল্পীও লিখলেন, ‘ÔI am separated from all things by a hollwo space...’। আলবেয়ার কামুও একই পথের পথিক। স্যামুয়েল বেকেট তো বলেই ফেললেন, ‘...I was born or not, have lived or not, am dead or merely dying...’। ইউরোপের অনেক কবি-সাহিত্যিক আত্মনিমগ্নতার ওই অন্ধকারে ডুব দেন।
আর ওই যে অস্তিত্ববাদী দর্শনের অভিঘাতে ইউরোপে জন্মাল Sur-realism, Dadaism, Futurism, বিশেষ করে পরাবাস্তববাদ। এর প্রভাব বাঙালি মননেও পড়ে। কলকাতার অনেক পরে, কবরে ভূত হয়ে যাওয়ার পর পরাবাস্তববাদ ঢাকাতেও উঁকি মারে। বাঙালি যখন গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে লড়াই করছে, তখনই এই ভূত ঢাকায় এসে হাজির। বাংলাদেশের কাব্যদর্শনের এই দেউলিয়াপনার বাইরে মনুষ্যত্বের পক্ষে, মুক্তির প্রশ্নে একদল কবির আবির্ভাব ওই পরাবাস্তব প্রেতাত্মাকে পরাভূত করেছিল। ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র-গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের যুদ্ধবিষয়ক কবিতার দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও লেখক