
দেশে মোট প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ১৮-২৪ শতাংশ দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনে ভুগছে। তবে সংখ্যার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক হলো, দেশে নতুন করে মানুষের মধ্যে দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন বাড়ছে। বিশেষ করে গত ২০ বছরে অপ্রাপ্ত বয়স্ক অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যে দৈহিক স্থূলতা বেড়েছে তিনগুণের বেশি। আগে যেখানে ৪-৫ শতাংশ শিশু-কিশোরের দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন ছিল, এখন সেটা বেড়ে ১৪-১৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ এ সময়ে দৈহিক স্থূলকায় শিশুদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ ও শিশু বিভাগ এসব তথ্য জানিয়েছে। এ দুই বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, এ দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের সংখ্যা দেশের সামগ্রিক বিবেচনায় বেশি। কোনো কোনো দেশে ৫০-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত দৈহিক স্থূলতার মানুষ আছে। সেখানে বহু বছর ধরে একই হার রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে মানুষের দৈহিক স্থূলতা অনেক কম ছিল। সে তুলনায় ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে।
তারা বলেন, দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের শিকার মানুষ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব দৈহিক স্থূলতা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে ওয়ার্ল্ড ওবিসিটি ফেডারেশন গতকাল শুক্রবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে সামনের এক যুগে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যায় পড়বে; অর্থাৎ তাদের ওজন হবে উচ্চতা অনুযায়ী স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি। ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৪০০ কোটি মানুষ অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগবে। সবচেয়ে দ্রুত এ সমস্যা বৃদ্ধি পাবে শিশুদের মধ্যে।
শহরে বেশি, গ্রামে কম : বিএসএমএমইউয়ের শিশু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বিভাগে ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসা ১ হাজার ৪৪ জন শিশু-কিশোরের মধ্যে দৈহিক স্থূলতার শিকার ৪০ শতাংশ। এদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন ছিল ২৭ দশমিক ৫৯ শতাংশের, দৈহিক স্থূলতা ছিল ৫৯ দশমিক ০৬ শতাংশের, গুরুতর স্থূলতা ছিল ১২ দশমিক ৭২ শতাংশের ও রোগাক্রান্ত স্থূলতা ছিল শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ শিশু-কিশোরের।
বিএসএমএমইউ ২০১৪ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বলেছে, তখন ৬-১৫ বছর বয়সী স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে দৈহিক স্থূলতার ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশের ও অতিরিক্ত ওজন ছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশের। গ্রামে এই হার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ ও শহরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ছেলে শিশুরা বেশি স্থূলতায় ভুগছে অর্থাৎ ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়ে শিশুদের মধ্যে এ হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সুরাইয়া বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাধারণত দেখা যায় মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ শিশু-কিশোরের অতিরিক্ত ওজন। কিন্তু মা অথবা বাবার যদি ওজন বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ শিশু-কিশোরের ওজন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর যদি দুজনেরই ওজন বেশি থাকে, তাহলে ৭০ শতাংশ শিশু-কিশোরের ওজন বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
‘কেন দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএসএমএমইউর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষ যে পরিমাণ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে, সারা দিনে যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ করে, তাতে দেখা যায় দিন শেষে বেশ পরিমাণ ক্যালরি অব্যবহৃত হিসেবে থেকে যায়। বাংলাদেশের মানুষের যে সামগ্রিক জীবনযাপন পদ্ধতি, তাতে তার বয়সের সাপেক্ষে যে পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম করার কথা, তার চেয়ে কম করেন। এর মধ্যে যার যেটুকু খাওয়া দরকার, সে সেটুকু খায়, আবার কেউ কেউ বেশি খায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেকোনো বিল দিতে মোবাইল বা ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করছি। সামাজিক কাঠামোগুলো আস্তে আস্তে কমছে। প্রতিদিন স্কুল-কলেজে আবশ্যিক হওয়ার কথা ছিল খেলার মাঠ। ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করবে। কিন্তু খেলার মাঠ কমছে। তাই আমরা এখন বলছি, খেলার মাঠ থাকুক বা না থাকুক, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপরের ক্লাসে যেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ শারীরিক শ্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে।’
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে দৈহিক স্থূলতা অন্য দেশের তুলনায় কম হওয়ার কারণ হলো এখানে চর্বিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার প্রবণতা বহু দেশের তুলনায় কম। তারা আমাদের চেয়ে প্রোটিন ও চর্বি বেশি খায়। কিন্তু আমাদের খাদ্যাভ্যাস একদিক থেকে ওদের চেয়ে মারাত্মক। সেটা হলো আমরা প্রোটিন মারাত্মক কম খাই। চর্বি মোটামুটি খাই। কিন্তু কার্বোহাইড্রেট খুব বেশি খাই। গত বছরের এক গবেষণায় আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে মানুষ প্রতিদিনের খাবার থেকে যে ক্যালরি পায় তার ৮০-৯০ শতাংশ আসে শর্করা থেকে। অথচ একজন সুস্থ মানুষের শরীরে শর্করা থেকে ৪০-৫০ শতাংশ ক্যালরি আসার কথা। এ শর্করা খাওয়ার পর যখন হজম হয়, শরীরে যদি সে পরিমাণ ব্যবহার না করা হয়, তাহলে চর্বি হয়ে জমা হয়।’
কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে জানতে চাইলে ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের কারণে এসব মানুষ দ্রুত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ব্যথা বেড়ে যাবে। যাদের ওজন অনেক বেশি, তাদের ব্যথাও অনেক বেশি। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট। নাক ডাকা। হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গেও হার্ট অ্যাটাক সম্পৃক্ত। অতিরিক্ত ওজনের মানুষ বেশি কাজ করতে পারবে না। কর্মক্ষমতা হারাবে। পুরুষ ও নারী দুজনের ক্ষেতেই প্রজনন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের মানুষ বেশিদিন বাঁচবে না। তাদের আয়ু কমে যাবে।’
চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, এ ধরনের মানুষ এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের চিকিৎসকদের কাছে যাবে। এন্ডোক্রাইনোলজি বা হরমোন বিভাগের চিকিৎসকের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি টিম থাকতে হবে। টিমে অবশ্যই পুষ্টিবিদ থাকবেন। এসব মানুষকে স্বাস্থ্যশিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে পুষ্টিবিদের সংখ্যা কম। বিএসএমএমইউতে মাত্র দুজন পুষ্টিবিদ আছেন। এখানে থাকার কথা কমপক্ষে ১০০ জন। বারডেমে ১৮ জন পুষ্টিবিদ আছেন। সারা দেশে এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলে এন্ডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ৩০৮ জন।
কী ধরনের সতর্কতা প্রয়োজন এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. সুরাইয়া বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাধারণ স্থূলতার কারণ আমাদের অস্বাভাবিক জীবনযাপন, খাদ্যগ্রহণে সমস্যা রয়েছে। জাঙ্কফুড বেশি খাচ্ছি। শারীরিক কর্মকান্ড কম। মোবাইল ও টিভি বেশি দেখছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় মা-বাবার যদি ওজন বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে শিশুর ওজন বেশি হয়। সুতরাং এ ধরনের স্থূলতা আমরা নিজেরাই তৈরি করি।’
এ ব্যাপারে ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট ওজন থাকা দরকার। গড়ে কারও যদি উচ্চতা ১৩৪ সেন্টিমিটার হয় তাহলে তার দৈহিক ওজন ৭০ কেজির কম হবে। এটা গড় হিসাব। যদি নারী হয় তাহলে তার ওজন আরও ৫ কেজি কম হবে। এটা থেকে যত বেশি ওজন হবে, তত বেশি উদ্যোগ নিতে হবে ওজন কমানোর।’
দেশে উৎপাদন হয় না ইয়াবা ট্যাবলেট, অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সারা দেশ থেকে প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে গড়ে প্রায় সোয়া লাখ পিস। সর্বোচ্চসংখ্যক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে ২০২১ সালে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় লাখ। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে উদ্ধার হওয়া মাদকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে এমন ভীতিকর তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ছয় বছরে সারা দেশে উদ্ধার হয়েছে ২৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫৭০ ইয়াবা ট্যাবলেট।
অভিযানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে দেশে যে পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকছে তার অল্পসংখ্যকই ধরা পড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে। আটক ইয়াবার বেশিরভাগই কক্সবাজার-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আসা। পাচারকারীদের নিত্যনতুন কৌশলের কাছে একপ্রকার ধরাশায়ী হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশে ইয়াবার মতো মাদকদ্রব্য ব্যাপক হারে পাচার হয়ে আসা নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে শুরু করে দেশের অভ্যন্তরে মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা বাহিনীগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ বলছে, তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রণ করার। কারবারিদের ওপর তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাহফুজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যারা মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ইতিমধ্যে জামিনে গেছে বা সাজা খেটে বের হয়ে গেছে তাদের ওপর নজরদারি রেখেছি যাতে ফের এ পেশায় জড়িয়ে না যায়। এর বাইরে আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চেষ্টা করছি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় বছরে সারা দেশে পুলিশ, র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ২৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫৭০ ইয়াবা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ২১৪ ইয়াবা ধরা পড়েছে। ২০১৭ সালে ৪ কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩, ২০১৮ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮, ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮, ২০২০ সালে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭, ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫ ও ২০২২ সালে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। গত ছয় বছরে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬ লাখ ২৯ হাজার ৭৫১টি আর আসামি ৮ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৩ জন।
২০০০ সালের পর টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করে। তারপর এটি খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। তবে দেশে প্রথম ইয়াবার চালান ধরা পড়ে ২০০৩ সালে রাজধানীর গুলশানে।
পাশর্^বর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদী দিয়ে বছরের পর বছর ধরে দেদার দেশে ঢুকছে মরণ নেশা ইয়াবা। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের ওপর মহলও অবগত রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে। কিন্তু কাজে আসছে না কোনো পদক্ষেপই।
অভিযানসংশ্লিষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা মনে করেন, সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ করা না গেলে দেশের ভেতরে অভিযান চালিয়ে কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থার তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি জানান, সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকছে তার ১০-২০ ভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরতে পারছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইয়াবা মূলত মিয়ানমার থেকে আসছে। ইয়াবা চোরাচালান রোধে কক্সবাজারে আমরা একটি বিশেষ টাস্কফোর্স করেছি। কীভাবে মাদক প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। আমরা তৎপর আছি, ইয়াবা যা আসছে তা আমরা উদ্ধার করছি।’
গ্রেপ্তারের পরও কেন ইয়াবার বিস্তার থামছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা মাদক চোরাচালান করে তারা মেধা খাটিয়েই কাজগুলো করে, তারা অনেক দুষ্ট হয়।’ অন্যদিকে ইয়াবায় আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা চিকিৎসার বিষয়ে সোচ্চার রয়েছি। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছি।’
যে পথে আসে ইয়াবা : কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে নাফ নদী। নদীটির ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। ইয়াবার চালানের অধিকাংশই এই নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যে ইয়াবার বাহকরা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে টেকনাফের বেশ কয়েকজন মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করলেও ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই। বরং নতুন করে ইয়াবার রুটে দেশে ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস নামের মাদকদ্রব্য।
গত বছর মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুট দুর্গম হওয়ায় চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমারের শান ও কোচিন প্রদেশে কারখানা স্থাপন করে ইয়াবা উৎপাদন করা হচ্ছে। এই ১৫টি পয়েন্টের মধ্যে ১০টি কক্সবাজার আর ৫টি বান্দরবান সীমান্তে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তল্লাশি থাকায় সম্প্রতি রুটও বদল করেছে ইয়াবার কারবারিরা। কৌশল পরিবর্তন করে তারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে বেছে নিয়েছে সাতটি নতুন রুট। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের মিজোরাম, আসাম ও মণিপুর হয়ে ত্রিপুরার দুটি রুট আর বান্দরবান, কক্সবাজার, বরিশাল, যশোর ও সাতক্ষীরার পাঁচটি রুট।
ইয়াবার বহনের যত কৌশল : ডিএনসি, পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সুযোগ নিচ্ছে কারবারিরা। ইয়াবা ট্যাবলেট সহজেই বহনযোগ্য। মূলত কাট-আউট পদ্ধতিতে দেশের ভেতরে চলছে কারবার। বাহক প্রাথমিক অবস্থায় জানে না কে গ্রহণ করবে। বর্তমানে বাহকের পেটের ভেতর পাকস্থলীতে করে ইয়াবা বহন বেড়েছে। এ ছাড়া পেঁয়াজ, বেগুন, আসবাব, গাছের গুঁড়িসহ বিভিন্ন মালামালের সঙ্গে বহন করা হয় ইয়াবা। আগে থেকে সোর্সের মাধ্যমে তথ্য না পেলে পরিবহনের সময় সাধারণ তল্লাশি চালিয়ে তাদের শনাক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার পেটে ইয়াবা বহনকারীদের গ্রেপ্তারের পরও পড়তে হচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। পেটের মধ্য থেকে ইয়াবা বের করা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। গত বছর আগস্ট মাসে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অসুস্থ হয়ে একজন মারা যান। পরে ময়নাতদন্তে তার পেটে অর্ধগলিত ইয়াবা পাওয়া গেছে। ইয়াবা ট্যাবলেটের অন্যতম খুচরা বাজার রাজধানী। সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ঢাকাকে ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্ল্যাহ কাজল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেখা গেছে পাঁচ হাজার পর্যন্ত ইয়াবা বিশেষ কায়দায় পেটের মধ্যে নিয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। যানবাহনে চলাচলকারী কতজনকে আমরা চেক করব। তথ্য ছাড়া তো বের করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া এদের আটকের পর পেট থেকে ইয়াবা বের করতে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের।’
ননীবাবুর আমাদের বাড়িতে আসার সময়টা ছিল সকালবেলা। ঘামে ভেজা সাদা হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট পরনে, হাতে একটা ছোট ব্যাগ। গালে কয়েক দিনের না-কামানো দাড়ি। তিনি আসতেন বাবার কাছে। তখন আমি স্কুলের গন্ডি ছাড়াইনি। ভদ্রলোকের আসাটা ছিল অনিয়মিত। দরজা খুলে দিলে বসার ঘরে বসতেন। খুব মৃদু স্বরে প্রতিবার একই প্রশ্ন করতেন, ‘তোমার বাবা আছেন বাড়িতে?’ খুব বেশিক্ষণ বসতেন না। বাবাকে দেখতাম কয়েকটা দশ টাকার নোট তাকে দিতেন। তারপর কিছুক্ষণ নিচু গলায় কথা বলে মধ্যবয়সী ননীবাবু বিদায় নিতেন। যাওয়ার সময় বাবার হাতে লালচে নিউজপ্রিন্টে ছাপা মলিন একটি পুস্তিকা ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতেন।
অল্প বয়সে দেখতাম সেই পাতলা নিউজপ্রিন্টে ছাপা পুস্তিকার ওপর কয়কজন মানুষের মুখের ছাপ দেওয়া। কৌতূহল হতো ননীবাবুর পরিচয় জানার। কিন্তু প্রশ্ন করেও তখন বাবার কাছে সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। ননীবাবুর আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ হয়নি আরও অনেক বছর। আমার বয়স বাড়ে। সেই পুস্তিকার মলাটে ছাপ দেওয়া মানুষের মাথাগুলোর পরিচয় ধীরে ধীরে জানতে পারি কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও জে দং। তখন এটাও জানতে পারি, ননীবাবু আসলে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া একটি চরমপন্থি বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী। বাবার একদা রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার সূত্র ধরে ননীবাবু পার্টির জন্য চাঁদা নিতে আসেন।
একবার হঠাৎ করেই ননীবাবু বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেন। আমি একটু অবাক হয়ে একদিন বাবার কাছে কারণ জানতে চেয়ে শুনলাম, তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন পুলিশের নজর এড়াতে। গা-ঢাকা দেওয়া শব্দটা নতুন ছিল আমার কাছে। রাজনীতি করার জন্য যে পুলিশ খুঁজতে পারে তা জেনে কেমন একটা অচেনা শিহরণ তৈরি হলো মনে! আর পুলিশের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটাকেও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল তখন। গা-ঢাকা দেওয়া বিষয়টা মনের মধ্যে অনেক দিন নতুন হাওয়ার কম্পন তৈরি করেছিল।
বেশ কিছুদিন পর ননীবাবু আবার আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতে শুরু করলেন। তখন মনে হতো, গোপন বামপন্থি রাজনৈতিক দলের কর্মী বোধ হয় এমনই হয়। একটু ঢিলেঢালা, নিরীহ চেহারা। মানুষের ভিড়ে সহজে মিশে যাওয়া। কিন্তু সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে বিদেশি পত্রিকায় চে গুয়েভারার ছবি দেখে আমার ভাবনা পাল্টে যায়। ছবিতে দাড়িপূর্ণ মুখের ওই তেজস্বী মানুষটাকে দেখে মনে মনে নিজেকেও বলিভিয়ার জঙ্গলে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ানো বিপ্লবী তরুণ বলে ভাবতাম। ওই সময়ে আরেকজন বিপ্লবী তরুণ আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতে শুরু করলেন। আরেকটি নিষিদ্ধঘোষিত বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন। তবে তিনি দেখতে একেবারেই ননীবাবুর অবয়বের মানুষ ছিলেন না। রাতেরবেলা সঙ্গোপনে আসতেন তিনি। তখন বাবার মুখে শুনে আন্ডারগ্রাউন্ড আর মুক্তাঞ্চল শব্দ দুটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি। সেই বিপ্লবী মানুষটির দৈহিক গড়ন ছিল লম্বা। মাথায় ঘন চুল। মনে আছে, প্রচুর সিগারেট খেতেন। তার সস্তা সিগারেটের কটু গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত ঘর। কয়েকবার তাকে দেখেছি রাত গভীর হলে কোনো কোনো দিন আমাদের বাড়িতে ভাত খেয়ে যেতে। তিনিও বেশ অনেক বছর ধরেই অন্ডারগ্রাউন্ড জীবন যাপন করছিলেন। বছরখানেক বাদে হঠাৎ একদিন শুনলাম সেই তরুণ খুন হয়েছেন অন্তর্দলীয় সংঘাতে। বাবার মুখে খবরটা শুনে বেদনাবোধ আমার সঙ্গী হয়ে ছিল অনেক দিন। ননীবাবুর সঙ্গে ঢাকা শহরে আমার আবারও দেখা হয়েছে। তখন বাবাও আর বেঁচে নেই। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখাচোখি হতে তিনি হাত নেড়ে আবার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছেন।
আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, রাজনীতির তীব্র তরঙ্গে সাঁতার কাটতে কাটতে গা-ঢাকা দেওয়া মানুষগুলোর জীবনটা এভাবেই একদিন ফুরিয়ে যায়? তরুণ বয়সে আমিও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছিলাম। তখন স্বৈারাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কাল চলছে। বহু তরুণ সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে। রাজনৈতিক সূত্রে তখন তাদের দেখতাম রাতেরবেলা পুলিশের চোখ এড়াতে বিভিন্ন বাড়িতে গা-ঢাকা দিতে। তাদের কেউ কেউ আমার বাড়িতেও আশ্রয় নিত। কোমরে পিস্তল গুঁজে তারা ঘুমাতে আসত। তখন উদ্বাস্তু সেই রাতগুলো আমরা পার করতাম গল্প করে। একটু একটু করে গোপনীয়তার বাদাম ভেঙে প্রকাশিত হতো এই শহরের নিচের তলায় আরেকটা শহর যেখানে সতর্ক অস্ত্রের ট্রিগারই বেঁচে থাকার একমাত্র পথ ছিল।
গা-ঢাকা দেওয়ার ব্যাপারটার সঙ্গে পুলিশের গন্ধ জড়িয়ে থাকে। অপরাধী ভাঙতে থাকে রাস্তা, গলি। টপকাতে থাকে বাধা। খুঁজতে থাকে আড়াল। গোপন রাজনীতি আর পুলিশের তাড়া খাওয়া সেই সব মানুষ কিন্তু অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না। রাজনৈতিক আনুগত্য তাদের দিনের পর দিন পলাতক জীবনে ঠেলে দিয়েছিল। ননীবাবুর সংসার কীভাবে চলত, আমি আজও জানি না। সেই খুন হয়ে যাওয়া তরুণ হয়তো সত্তরের দশকে খুন হওয়া হাজার তরুণের মিছিলে একটি সংখ্যা হয়ে আছেন। তার ইতিকথার পরের কথা আর জানা হয়নি, জানা সম্ভবও না। যে তরুণরা কোমরে অস্ত্র নিয়েই মেঝেতে পেতে দেওয়া চাদরের উপুড় শুয়ে থাকত, তাদের মনের মধ্যে বয়ে যাওয়া ঝড়ের গল্পটা রয়ে গেছে আজও অজানা। শুধু হারানো এক শহরজুড়ে পুলিশের ওয়াকিটকি কাশির শব্দের মতো জেগে থাকে মাঝে মাঝে অবচেতনে। পলায়নপর পায়ের শব্দ, ছায়া আর পলাতক জীবন ম্যাজিকের মতো মনের পর্দায় ঝলসে উঠে হারিয়ে যায়।
জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিশি নামের ২৮ দিনের এক কন্যাসন্তানকে ফেলে বাবা-মা উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার তিন দিন পার হলেও খোঁজ মেলেনি বাবা-মা বা কোনো অভিভাবকের। এ নিয়ে গতকাল রাত থেকে জেলাজুড়ে চলছে আলোচনা।
গত বুধবার বিকেল ৪টার দিকে হাসপাতালে শিশু নিশিকে ফেলে যাওয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তির তথ্য মতে, নিশি জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার পাটাদহ ইউনিয়নের কয়রার রকিব ও রোকসানা দম্পতির সন্তান।
হাসপাতাল ও দর্শনার্থী সূত্রে জানা যায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে হাসপাতালের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ২৬ দিন বয়সী নিশিকে কম ওজন ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি করান রকিব-রোকসানা দম্পতি। ১ মার্চ নিশিকে হাসপাতালের চারতলায় শিশু ওয়ার্ডের করিডরে অপেক্ষমাণ রোগীর এক স্বজনের কাছে দেন নিশির নানি। নিশির মাকে নিচ থেকে আনবেন বলে হাসপাতালের নিচতলায় চলে যান নিশির নানি। আর ফিরে আসেনি কেউ। তাদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেন রোগীর ওই স্বজন। নিশির কোনো অভিভাবক খুঁজে না পেয়ে বিষয়টি নার্সদের জানান ওই স্বজন। হাসপাতালে ভর্তির ফরমে দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে শেখ রাসেল বিশেষায়িত শিশু সেবাকেন্দ্রের দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্স নিশির কম ওজন এবং শ্বাসকষ্ট দেখে তাকে সেখানে ভর্তি করেন। নিশি হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে শেখ রাসেল বিশেষায়িত নবজাতক সেবাকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
জামালপুর সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নের হাজিপুরের সেলিনা বলেন, ‘চার দিন হয় আমার নাতি হাসপাতালে ভর্তি। এ সময় জানতে পারলাম, একটা বাচ্চাকে তার মা ফেলে চলে গেছে। এ কেমন মা! নিজের সন্তানকে ফেলে যায়। বাবা-মাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া উচিত।’
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার মো. শরিফ মিয়া, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে তার বাচ্চাকে ভর্তি করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ সন্তানের জন্য সবকিছু বিসর্জন দেয়। নিজের জীবন বাজি রেখে বাবা -মা তার সন্তানকে লালন-পালন করে। এ কেমন বাবা-মা! নিজের সন্তানকে ফেলে পালিয়ে যায়?’ বাবা-মাকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
জেনারেল হাসপাতালের শেখ রাসেল বিশেষায়িত নবজাতক সেবাকেন্দ্রের আয়া কোহিনূর বেগম বলেন, ‘বিকেল ৪টার দিকে এক মহিলার কাছে বাচ্চাটাকে রেখে ওর নানি নিচে মাকে আনতে যান। পরে তিনি আর ফিরে আসেননি। পরে বাচ্চাটাকে ভেতরে নিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে।’
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মাফিয়া সুলতানা বলেন, ‘বুধবার বিকেলে হাসপাতালের করিডরে অপেক্ষমাণ রোগীর স্বজনের কাছে বাচ্চাটাকে রেখে ওর অভিভাবক পালিয়ে যায়। ভর্তির সময় যে মোবাইল নম্বর বা ঠিকানা আমরা পেয়েছিলাম, ওই ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কেউ মোবাইল ধরে না।’
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের শেখ রাসেল বিশেষায়িত হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক জান্নাত আরা মিলি বলেন, ‘কম ওজন এবংশ্বাসকষ্ট নিয়ে শিশুটিকে ভর্তি করা হয়েছে। তার চিকিৎসা চলছে। নবজাতকটি সুস্থ রয়েছে। তবে অভিভাবককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের সহকারী পরিচালককে বিষয়টি জানানো হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে বাচ্চাটার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নবীনগর থেকে বাস ছিনিয়ে নিয়ে রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে ঘুরে যাত্রী তুলে ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আজ শনিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে ডিবি।
গতকাল শুক্রবার ডিএমপির মিডিয়া শাখা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়েছে, রাজধানীতে গভীর রাতে বাসে যাত্রী তুলে বাস ডাকাতি মামলার আসামি গ্রেপ্তার ও আলামত উদ্ধারের ঘটনায় শনিবার বেলা ১১টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টার সংবাদ সম্মেলন করবেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ বাস ডাকাতির ঘটনা নিয়ে ‘রাতভর মৃত্যুর বিভীষিকা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে দেশ রূপান্তর। ওই ডাকাতির ঘটনায় ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করায় বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অগোচরে ছিল। দেশ রূপান্তরে সংবাদ প্রকাশের পর তদন্তে নামে ডিবি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্রেপ্তাররা দুর্ধর্ষ ডাকাত। তাদের দলনেতা খুবই ভয়ংকর। রাজধানী ও এর আশপাশে খুবই হিংস্রভাবে ডাকাতি করে থাকে দলটি। চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আগেও ডাকাতির মামলা রয়েছে। সেসব মামলায় গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে ঘটনার রাতে ফের ডাকাতি করে তারা। এ চক্রে রয়েছে দক্ষ চালকও।
১২ ফেব্রুয়ারি বাস ডাকাতির ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) ডিএমপির দারুস সালাম থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী মো. নাসরুল (৩২)। মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, নাসরুল রিসাত পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-গ-১৩-০৫৯২ বাসটি গাজীপুর থেকে ছেড়ে কোনাবাড়ী-নবীনগর-গাবতলী-যাত্রাবাড়ী-পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা রুটে চালান। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রী না থাকায় বাস কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দারুস সালাম থানাধীন গাবতলী পর্বতা সিনেমা হলের ডানপাশে রাস্তার ওপরে বাসটি রেখে বাসের দরজা লক করে ভেতরে চালক ও তার সহকারী এবং সুপারভাইজার পেছনের সিটে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ৮-১০ জন লোক গাড়ির দরজা কৌশলে খুলে বাসে অতর্কিতভাবে উঠে তাদের হাত পেছনে বেঁধে লোহার পাইপ দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে ও তাদের মধ্য থেকে একজন চালকের সিটে গিয়ে বাস চালিয়ে শ্যামলীর দিকে যেতে থাকে। এ সময় অন্যরা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উঁচিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের ফোন ও টাকাপয়সা নিয়ে নেয়। পরে তাদের সবার চোখ বেঁধে বাসের পেছনের সিটের ওপর ফেলে রাখে। কোনো কথা বলতে গেলেই ডাকাতরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মারধর করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নীলাফুলা জখম করে ও মেরে ফেলার ভয় দেখায়। বাসটি চলন্ত অবস্থায় তারা মাঝেমধ্যে বাস থামিয়ে যাত্রী তুলে তাদের মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বলে যে, ‘আমরা ডাকাত চুপ করে থাক, যা চাই তা দিয়ে দে নইলে তোদের জীবন শেষ করে দেব’। তারপর ডাকাতরা সাভার থানাধীন কবিরপুরে নেমে যায়। কিছুক্ষণ পর ডাকাতদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একে অন্যের হাতের বাঁধন খুলে দেখেন আরও কয়েকজন যাত্রীকে একইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের নাম ডা. শাওন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের সামনে থেকে তিনি ওঠেন বলে জানান। ডাকাতরা যখন তাদের ছেড়ে চলে যায় তখন সময় ভোর সাড়ে ৬টা।
ভুক্তভোগী রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের চিকিৎসক শাওন চৌধুরী জয় জানান, তার চোখ বেঁধে বাসের পেছনে নিয়ে বসিয়ে রাখে। তার কাছে থাকা ১২ প্রোম্যাক্স আইফোন, ৭ আইফোন, নগদ সাড়ে চার হাজার টাকা, হাতঘড়ি ও ব্যাংকের এটিএম কার্ড নিয়ে গেছে ডাকাত দল। তাকে মারধরও করেছে তারা।
শষ্যভান্ডারখ্যাত দিনাজপুরের হিলিতে এখন চলছে বোরো ধানের চারা রোপণের ভরা মৌসুম। কিন্তু ঠিক তখনই সেচের অভাবে বীজতলা থেকে চারা তুলেও জমিতে রোপণ করতে পারছেন না হিলির সাদুড়িয়া গ্রামের অন্তত ৪০ জন কৃষক। ইতিমধ্যেই পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ায় চিন্তার ভাঁজ এসব কৃষকের কপালে। আর কয়েক দিন পেরিয়ে গেলে সম্ভব হবে না বোরো ধানের চারা রোপণ। তাই দ্রুতই পানির সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তাদের। গেল রবিশস্যের মৌসুমেও পানি না মেলায় মাঠেই শুকিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে তাদের লাখ লাখ টাকার আলু, গম, সরিষাসহ অন্যান্য আবাদ।
সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ায় পানির অভাবে দেড়শ বিঘা জমিতে বোরো ধান রোপণ করতে পারছে না ভুক্তভোগী এ কৃষকরা। তারা বলছেন, পল্লী বিদ্যুতের অফিসে শত ধরনা দিয়েও সেচ পাম্পে মিলছে না বিদ্যুৎ সংযোগ। তাই মাঠ প্রস্তুত করেও পানির অভাবে রোপণ করতে পারছেন না বোরো ধানের চারা। সময় পেরিয়ে যাওয়ায় জমিতে বোরো ধান আর রোপণ করতে পারবেন কি না সেই দুশ্চিন্তা আর হতাশায় দিন কাটছে এসব কৃষকের। অতি দ্রুত সমস্যার সমাধান না হলে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।
তাদের একজন কৃষক আবদুর রাজ্জাক। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ মাঠে আমার তিন একর জমি পড়ে রয়েছে, শুধু পানির অভাবে ধান রোপণ করতে পারছি না। লাইন লাগাচ্ছে, আজ পানি দেবে, কাল দেবে, এভাবে করতে করতে সব শেষ। পানির অভাবে আলু ও ধানের বীজ সব মরে শেষ হয়ে গেছে। আজ হবে, কাল হবে করতে করতে দিন তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। কোনো ফলাফল তো পাওয়া যাচ্ছে না।’
ভুক্তভোগী আরেক কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, এক ইঞ্চি জমিও যেন পড়ে না থাকে আর এখানে আমাদের শত শত বিঘা জমি পড়ে রয়েছে। আমরা বিদ্যুতের সংযোগ পাচ্ছি না, যার কারণে জমিতে পানি পাচ্ছি না।’
দ্রুত বিদ্যুৎ সংযোগ না পেলে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে যাবেন বলেন জানান কৃষক সেলিম হোসেন। তিনি বলেন, ‘সব দপ্তরে ঘুরেছি যে এখানে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হোক, কিন্তু কেউ আমাদের এ দুঃখটা বুঝছে না। কী যে হয়েছে! এখানে অনেক দপ্তরের লোকজন আসছে, দেখে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দিচ্ছে না। যদি দুয়েক দিনের মধ্যে বিদ্যুতের সংযোগ দেয় তাহলেও আমরা জমিগুলোতে ধান লাগাতে পারব। কিন্তু অতি দ্রুত যদি এ সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ না দেওয়া হয় তাহলে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না আমাদের।’
সেচ পাম্পটির মালিক বলাই চন্দ্র বলেন, ‘গ্রামের শত শত বিঘা জমিতে ফসল ফলানোর জন্য এ সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের অভাবে আজকে আমাদের বেহাল অবস্থা। বিদ্যুতের লোকজনের টালবাহানার কারণে দীর্ঘদিন থেকে সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগ পাচ্ছি না। পল্লী বিদ্যুতে গিয়ে দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। আজ যাব, কাল যাব এসব বলে তারা কালক্ষেপণ করছে। তাদের কথামতো সব করছি, কিন্তু তারপরও কেন জানি সংযোগ দিচ্ছে না। এতবার হাত-পা ধরছি যে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, অন্তত সংযোগটা দ্রুত দেন। এখন তারা বলছে, তাদের কাজ সম্পূর্ণ করে সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করতে বলছে। তাহলে আমরা কৃষকরা এখন কোথায় যাব? কার কাছে যাব? আর কার কাছে বিচার চাইব?’
কৃষককের এ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন হাকিমপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ড. মমতাজ সুলতানা। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদ্যুতের সংযোগের অভাবে সাদুড়িয়া গ্রামের কৃষকদের সেচকাজ ব্যাহত হয়েছে। ইতিমধ্যেই আমি জায়গাটি পরিদর্শন করে বিষয়টি পল্লী বিদ্যুতের এজিএমসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়েছি। কীভাবে এটি সমাধান করা যায় ও অতি দ্রুত সেচকাজ শুরু করে জমিগুলোকে যেন বোরো ধান চাষাবাদের আওতায় নিয়ে আসতে পারি সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।’
কৃষকদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দিনাজপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ হিলি সাবজোনাল অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, ‘বলাইচন্দ্র নামে এক ব্যক্তির সেচ পাম্পের সংযোগের জন্য আবেদন পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে সেটি স্টেকিংভুক্ত করে আবেদনটি সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু ৩ পোলের অধিক ৭ পোলের মতো লাইন হওয়ায় সেটি আবারও অনুমোদনের জন্য সদর দপ্তর থেকে ঢাকায় হেড অফিসে পাঠানো হয়েছে। তাদের আদেশসহ মালামাল প্রাপ্তি সাপেক্ষে সংযোগটি প্রদান করা হবে।’
শনিবার ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এ দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে শনিবার রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
এ অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অ·ফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভ‚মি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্তে¡ও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মুহ‚র্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহ‚র্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
কাল ২৬ মার্চ। মহান স্বাধীনতা দিবস। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হতে পুরোপুরি প্রস্তুত সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। দিনটি উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দিনের প্রথম প্রহর থেকে মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় ফুলে ফুলে ভরে উঠবে স্মৃতিসৌধের শহীদ বেদি। দিনটি উপলক্ষে এর মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ধুয়ে-মুছে, ফুল আর রং-তুলির আঁচড়ে প্রস্তুত করেছে গণপূর্ত বিভাগ।
গণপূর্ত বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, দিনটি উপলক্ষে স্মৃতিসৌধের মিনার থেকে শুরু করে পায়ে চলার পথ সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। রং-তুলির আঁচড় পড়েছে ফুলের টপসহ না স্থাপনায়। এর মধ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ধুয়ে-মুছে প্রস্তুত রেখেছে গোটা সৌধ এলাকা।
স্বাধীনতা দিবসে সৌধ এলাকা ছাড়াও পুরো উপজেলায় সেজেছে নতুন সাজে। সড়ক-মহাসড়ক ছাড়াও ভবনগুলো সাজানো হয়েছে লাল-সবুজ বাতিতে।
সাভার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম বলেন, দিবসটি পালন করতে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর উপজেলা চত্বরে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা দেওয়া হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠন আয়োজন করেছে নানা অনুষ্ঠান।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সাদা পোশাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করছেন। গোটা সৌধ এলাকায় বসানো হয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এ ছাড়াও সড়ক-মহাসড়কে বসানো হয়েছে নিরাপত্তাচৌকি। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় রাখা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা।
মানহানির মামলায় দণ্ডিত কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধীকে লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার লোকসভা সচিবালয় তাকে অযোগ্য ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। অযোগ্য ঘোষিত হওয়ায় তার পার্লামেন্টের সদস্যপদও খারিজ হয়ে গেল। কংগ্রেস নেতা রাহুল লোকসভায় কেরালার ওয়েনাড আসনের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন।
এনডিটিভি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রায় ঘোষণার দিন থেকেই রাহুল আর পার্লামেন্টের সদস্য থাকার যোগ্য নন বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কর্ণাটকের কোলারে এক জনসভায় পলাতক ব্যবসায়ী নীরব মোদি ও ললিত মোদির সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির নামের মিল থেকে প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেছিলেন রাহুল। ‘সব চোরের পদবি মোদি হয় কী করে’ রাহুলের এই মন্তব্যের জেরে বিজেপি বিধায়ক ও গুজরাটের সাবেক মন্ত্রী পুরনেশ মোদি মানহানির মামলাটি করেছিলেন। চার বছর আগে করা ওই মানহানির মামলায় গত বৃহস্পতিবার কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় গুজরাটের সুরাটের একটি আদালত। সাজা হলেও রাহুল জামিনে রয়েছেন, তাকে আপিল করার সুযোগ দিতে রায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
গতকাল রায়ের পরদিন স্বল্প সময়ের জন্য লোকসভায় গিয়েছিলেন রাহুল। তিনি সেখানে দলীয় এমপিদের এক বৈঠকেও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে তার মা, কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি দলের প্রধান সোনিয়া গান্ধীও ছিলেন। বেশ কিছু ইস্যুতে হট্টগোলের কারণে শুরুর কয়েক সেকেন্ড পরই লোকসভার অধিবেশন দুপুর ১২টা পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায়, রাহুলও এরপর পার্লামেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে যান।
রাহুল গান্ধীকে কারাদণ্ড দেওয়ার প্রতিবাদে এদিন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর সাংসদরা দিল্লির বিজয় চক থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন অভিমুখে মিছিল শুরু করলেও পুলিশ বাধায় তা গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি।
শুক্রবার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্যেই ‘গণতন্ত্র বিপদে’ লেখা ব্যানার নিয়ে তাদের মিছিল শুরু হয়েছিল। পুলিশ নেতাদের আটক করে বাসে কাছাকাছি একটি থানায় নিয়ে যাওয়ায় মিছিলটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
পুলিশ বলছে, বিরোধী দলীয় এমপিদের মিছিলটির অনুমতি ছিল না। তা ছাড়া প্রেসিডেন্টও বৈঠকের জন্য এমপিদের কোনো সময় দেননি।
আদানি-হিনডেনবার্গ ইস্যু তদন্তে যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটির দাবি জানানো এই বিরোধী দলগুলো প্রেসিডেন্ট দ্রৌপদি মুর্মুর সাক্ষাৎ চেয়েছে। দলগুলো বলছে, ধনী শিল্পপতি গৌতম আদানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কথিত বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতেই ২০১৯ সালে করা একটি মানহানির মামলায় রাহুল গান্ধীকে কারাদণ্ড দিয়ে যে শোরগোল তোলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিশোধমূলক রাজনীতির কারণে রাহুলকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে অভিযোগ তুলে শুক্রবার একাধিক রাজ্যে কংগ্রেস বিক্ষোভও দেখিয়েছে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি।
কংগ্রেসের ভাষ্য, রাহুলকে চুপ করিয়ে দিতেই এই দণ্ড দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের সরকার কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলোকে অপব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করতে চাইছে।
তবে বিজেপি বলছে, ‘চোর’ মন্তব্যে পিছিয়ে পড়া ‘মোদি’ সম্প্রদায়কে অপমান করায় স্বাধীন বিচার বিভাগ রাহুলকে দণ্ড দিয়েছে, এখানে তাদের হাত নেই।
আজ ভয়াল ২৫ মার্চ, গণহত্যা দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে ১৯৭১ সালের এই দিন শেষে এক বিভীষিকাময় ভয়াল রাত নেমে এসেছিল। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে আজ রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১০টা ৩১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাক আউট’ পালন করা হবে।
দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী দিয়েছেন এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিন সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে গণহত্যা দিবসের ওপর আলোচনা সভা হবে। এ ছাড়াও সারা দেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গীতিনাট্য এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মিনিপোলগুলোতে গণহত্যার ওপর দুর্লভ আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করা হবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বাদ জোহর দেশের সব মসজিদে বিশেষ মোনাজাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে সুবিধাজনক সময়ে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা মুছে দেওয়ার চেষ্টায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারপর ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যে সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করে, তারই নাম অপারেশন সার্চলাইট।
এ অভিযানের নির্দেশনামা তৈরি করেন পাকিস্তানের দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। নির্দেশনামার কোনো লিখিত নথি রাখা হয়নি। গণহত্যার সেই পুরো নির্দেশ মুখে মুখে ফরমেশন কমান্ডার বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। অনেক পরে, ২০১২ সালে মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি’ নামে আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত সে আত্মজীবনীতে প্রথমবারের মতো অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়।
অপারেশন সার্চলাইট কীভাবে পরিকল্পিত হয়, ১৯৭১ সালের সেই স্মৃতিচারণ করে রাজা লিখেছেন, ‘১৭ মার্চ, সকাল প্রায় ১০টা বাজে। টিক্কা খান আমাকে ও মেজর জেনারেল ফরমানকে কমান্ড হাউজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে খবর পাঠান। খবর পেয়ে আমরা দুজন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করি। গিয়ে দেখি, সেখানে জেনারেল আবদুল হামিদ খানও রয়েছেন। টিক্কা খান আমাদের বলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে শেখ মুজিবের সমঝোতা আলোচনা ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট চান আমরা যেন সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং সে অনুযায়ী একটা পরিকল্পনা তৈরি করি। এ ছাড়া আর কোনো মৌখিক বা লিখিত নির্দেশনা আমরা পাইনি। আমাদের বলা হয়, পরদিন ১৮ মার্চ বিকেলে আমরা দুজন যেন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি।’ পরদিন সকালেই খাদিম হোসেন রাজা তার কার্যালয়ে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে বসেন। তারাই গণহত্যার এ অভিযানের নাম দেন অপারেশন সার্চলাইট।
যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হলো। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশান ভূমি।’
পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা। এদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। সকাল থেকেই সেনা কর্মকর্তাদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। হেলিকপ্টারযোগে তারা দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস পরিদর্শন করে বিকেলের মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরে আসেন।
ঢাকার ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বালুচ রেজিমেন্টকে পিলখানার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিতে দেখা যায়। মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ, নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজীর জনসংযোগ অফিসারের দায়িত্বে থাকা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থেও এ সংক্রান্ত একটি বিবরণ পাওয়া যায়। সিদ্দিক সালিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনারেল নিয়াজীর পাশেই ছিলেন। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অনুগত পাকিস্তানি হিসেবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চক্রান্ত তিনি খুব কাছে থেকেই দেখেছেন। ২৫ মার্চ, অপারেশন সার্চলাইট শুরুর মুহূর্ত নিয়ে তিনি লিখেন ‘নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সামরিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এমন আঘাত হানার নির্ধারিত মুহূর্ত (এইচ-আওয়ার) পর্যন্ত স্থির থাকার চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেল। নরকের দরজা উন্মুক্ত হয়ে গেল।’
পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব পদক্ষেপ চূড়ান্ত করে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে করাচি চলে যান। সেনা অভিযানের শুরুতেই হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগে ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ মধ্যরাতে) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র লড়াই শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। বাসস
নাম আছে কিন্তু নিবন্ধন নেই। বেশির ভাগেরই কার্যালয় নেই। বছরের পর বছর চলে ইচ্ছেমতো কমিটি দিয়ে। এ নিয়ে আছে কোন্দল। দলাদলিতে সংগঠন ভেঙে একই নামে হয় আরেক সংগঠন। রয়েছে শাখা সংগঠন। ব্যবহার করা হয় মুক্তিযুদ্ধের লোগো। সংগঠনের নেতাদের অনেকে ব্যবহার করেন ভিজিটিং কার্ড। নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনৈতিক কাজের অভিযোগ।
নানা দাবিতে কালেভদ্রে এসব সংগঠনকে কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দেওয়া ছাড়া দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে এমন গুরুত্বহীন ও নামসর্বস্ব অগণিত সংগঠন গড়ে উঠেছে দেশজুড়ে।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলসহ (জামুকা) বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, এমন অবৈধ সংগঠনের সংখ্যা শতাধিকের বেশি। এর মধ্যে কিছু সংগঠন নেতিবাচক নানা কারণে প্রায়ই আলোচনায় আসে।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে জামুকার আড়াইশোর বেশি নিবন্ধিত সংগঠনের বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব নেই। এ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। এখন মুক্তিযুদ্ধের নামে নিবন্ধনহীন এসব সংগঠন চেতনা বাস্তবায়ন তো করছেই না, উল্টো মুক্তিযুদ্ধের সম্মান হচ্ছে ভূলুণ্ঠিত। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ এসব সংগঠনকে আশকারা ও প্রশ্রয় দেন ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও জনপ্রতিনিধি। তবে দীর্ঘ দিন ধরে জামুকার নাম ভাঙিয়ে এসব চললেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, জামুকা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকি নেই।
ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, প্রজন্ম লীগের নামে একাধিক সংগঠন, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা লীগ, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ, শহীদ খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, মুক্তিযুদ্ধ ফ্রন্ট, শহীদ সন্তান ৭১ ফাউন্ডেশন, মুক্তিযোদ্ধা নাতি-নাতনী সংসদ, ৭১-এর সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ এমন নানা নামে সংগঠনের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে এক নামের আদলে একাধিক সংগঠনও রয়েছে।
‘প্রজন্ম লীগ’ নামটি ব্যবহার করে কয়েক বছরে দলাদলি ও কোন্দলে বেশ কয়েকটি সংগঠন হয়েছে। এর মধ্যে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম’ লীগ নামেই রয়েছে একাধিক সংগঠন। এ ছাড়া ‘বাংলাদেশ আওয়ামী প্রজন্ম লীগ’, ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্বা প্রজন্ম লীগ’ নামে রয়েছে কয়েকটি সংগঠন। একসময় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়কেন্দ্রিক এসব সংগঠনের পোস্টার ও তৎপরতা ছিল। এখনো আছে, তবে সমালোচনার মুখে কিছুটা সীমিত। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়কেন্দ্রিক ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন আলোচনায় আসে ২০১৯ সালের শেষদিকে। যদিও বিরোধের জের ধরে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামে পৃথক আরেকটি সংগঠন করেছে একটি পক্ষ। তবে তাদের তৎপরতা এখন আর আগের মতো নেই। ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান’ নামে একটি সংগঠন জামুকা থেকে নিবন্ধন নিয়েছিল কয়েক বছর আগে। জামুকার সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এক নামে দুটি সংগঠন হওয়ায় সংগঠনের নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। আর নানা নেতিবাচক কর্মকা-ে এসব সংগঠন নিয়ে তারাও বিব্রত।
জামুকার মহাপরিচালক মো. জহুরুল ইসলাম রোহেল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সংগঠন চালাতে অবশ্যই জামুকার অনুমোদন লাগবে। ওদের বিষয়ে যতটুকু জানি এদের রেকর্ড ভালো নয়। কিন্তু আমাদের তো কেউ লিখিত বা মৌখিকভাবে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমূল্যায়নের জন্য এ ধরনের সংগঠন করা হয় এবং খুব সচেতনভাবেই এদের প্রশ্রয় দেওয়া হয়। কেননা কিছু লোকের উদ্দেশ্যই হলো মানুষ যেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে। এ সংগঠনগুলো সে কাজটিই করছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর রাজনৈতিক দলগুলোর নাম ভাঙিয়ে যদি কেউ কিছু করে তাহলে সেটি রাজনৈতিক দলগুলো দেখবে।’ তিনি বলেন, ‘এরা যদি অনৈতিক কাজে জড়িত হয় তাহলে এটি ফৌজদারি অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জামুকা এ বিষয়ে শক্ত ভূমিকা নিতে পারে।’
জামুকা থেকে গত ১৬ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ২৭০টি সংগঠন নিবন্ধন নিয়েছে। কিন্তু দু-একটি ছাড়া বাকিগুলোর তেমন কোনো অস্তিত্ব নেই। নানা অভিযোগে অন্তত ৬টি সংগঠনের নিবন্ধন বাতিল ও স্থগিত করা হয়েছে। এত বেশিসংখ্যক সংগঠনের কাজ ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সচেতন মহলে। এ নিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক দেশ রূপান্তর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর ইতিমধ্যে তদন্ত সাপেক্ষে এসব সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে জামুকা। নানা অভিযোগ ও বিতর্কের মুখে তিন বছর ধরে নিবন্ধন দেওয়া বন্ধ রেখেছে সংস্থাটি।
সরেজমিনে যা জানা গেল : রাজধানীর গুলিস্তান ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউকেন্দ্রিক কয়েকটি সংগঠনের কার্যালয় রয়েছে। সম্প্রতি ঠিকানা অনুযায়ী বেশ কয়েকটি কার্যালয় ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে দেশ রূপান্তর। ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ নামে একটি সংগঠনের দেওয়া ঠিকানায় (১০ গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ) একটি ভবনের দোতলায় দুদিন গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি কার্যালয় থাকলেও সেটি তালাবদ্ধ। ভবনসংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, মাঝেমধ্যে অফিসে কিছু লোকজনকে দেখা গেলেও বেশির ভাগ দিনই এটি বন্ধ থাকে।
একই ভবনে ‘শহীদ সন্তান ৭১ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠনের ঠিকানায় গিয়ে এ ধরনের কোনো কার্যালয়ের অস্তিত্ব মেলেনি। সংগঠনের সাইনবোর্ডে লেখা একটি মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে এর নির্বাহী সভাপতি হিসেবে পরিচয় দেন হাজি মো. এমদাদুল হক নামের এক ব্যক্তি। নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে এই ব্যক্তি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’-এর অফিসটি তারা সংগঠনের নামে ব্যবহার করেন। জামুকার অনুমোদন না থাকলেও আবেদন করা আছে। বিভিন্ন দিবসে তারা নানা কর্মসূচি পালনসহ অসহায় মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কল্যাণে কাজ করেন। তবে এখন সংগঠনের কার্যক্রম কিছুটা কম বলে জানান তিনি।
প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য ভাতা চালুসহ বিভিন্ন দাবিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা নাতি-নাতনী সংসদ’ নামে একটি সংগঠন প্রায়ই কর্মসূচি পালন করে। সামাজিক যোগযোগমাধ্যমেও সক্রিয় দেখা যায়। ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ’ নামে একটি সংগঠনের শাখা সংগঠন এটি। সংগঠনটির সভাপতি পরিচয় দেওয়া মো. জাহাঙ্গীর আলম জয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা বঞ্চিত ও নির্যাতিত হচ্ছেন। তাদের হয়ে আমরা মানবিক কারণে কর্মসূচি পালন করি। কোনো মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে তাদের সন্তানরা ভাতা পান। কিন্তু নাতি-নাতনিরা কেন বঞ্চিত হবেন?’ গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের ছয়তলায় ‘শহীদ খেতাবপ্রাপ্ত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্তান’ নামে একটি সংগঠনের ঠিকানায় সম্প্রতি একাধিকবার গিয়ে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ও জামুকার চেয়ারম্যান আ ক ম মোজাম্মেল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ রকম বহু সংগঠন দেশে আছে। এদের বিষয়ে নানা অভিযোগ শুনি। এগুলোর বিষয়ে একটাই সিদ্ধান্ত এরা অবৈধ ও ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিছু নয়। এদের কোনো সৎ উদ্দেশ্য নেই। এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের নামে উল্টোটা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের মান সম্মানকে এরা ভূলুণ্ঠিত করছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে কেউ এমন করুক এটা মানা যায় না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলেও এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারি না। এটি করতে পারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কিংবা কেউ অভিযোগ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ অভিযোগ করলে এদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে।’
নতুন একটি সাবান বাজারের জনপ্রিয় সব ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সব ব্র্যান্ডের সাবানের বিক্রি নেমে গিয়েছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়। নতুন সেই সাবান এক নম্বরে উঠে এলো শুধু একটি ট্যাগলাইন বা স্লোগানের বদৌলতে। সেই স্লোগানটি ছিল ‘শতভাগ হালাল সাবান’। গোসলে সাবান লাগে, তাতে খাওয়ার বিষয় নেই, কিন্তু বাঙালিকে হালাল সাবানে গোসল করার কথা মাথায় ঢুকিয়ে সাবানের বাজার দখল করে ফেলার এ অভিনব মার্কেটিং আইডিয়া এসেছিল যারা মাথা থেকে, তিনি সৈয়দ আলমগীর। সেই আলোচিত বিপণন-ঘটনা এখন পড়ানো হয় বিপণন শিক্ষার্থীদের, বিখ্যাত বিপণন লেখক ফিলিপ কটলার তার বইয়ে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ আলমগীরের এই ‘হালাল-সাবান কেইস’।
বাংলাদেশের বিপণন জগতের এই সুপারস্টার সৈয়দ আলমগীর তার বিপণন জীবনে শুরু করেছেন এক নতুন যাত্রা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) ভোগ্যপণ্য (এফএমসিজি) বিভাগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। এর আগে তিনি আকিজ ভেঞ্চার্সের গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালে চ্যানেল আই এবং বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম তাকে ‘মার্কেটিং সুপারস্টার’ খেতাব দেয়। দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার পাওয়া এই বিপণন ব্যক্তিত্ব ইউনিসেফের প্রাইভেট সেক্টর অ্যাডভাইজরি বোর্ডেরও সদস্য।
সৈয়দ আলমগীরকে নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্কেটিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দীর্ঘসময় ধরে বিপণন অঙ্গনে অসামান্য সব আইডিয়া নির্ভর কাজ করে যাচ্ছেন আলমগীর। পরবর্তী প্রজন্মের হাজার হাজার বিপণনকর্মী তৈরি করেছেন তিনি, যারা দেশের বিপণন অঙ্গনের চেহারাই বদলে দিচ্ছে। সৈয়দ আলমগীর একই সঙ্গে নানা জায়গায় মার্কেটিং বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ফলে একই সঙ্গে একাডেমিক এবং প্রায়োগিক দুই জায়গায় তিনি দক্ষতার সঙ্গে অসামান্য অবদান রাখছেন।’
নবযাত্রায় দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বিপণন গুরুর সঙ্গে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সময়ে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ ভবনে গিয়ে দেখা গেল, শুভেচ্ছার ফুলে ভরা ঘরে একটি কলি হয়ে বসে আছেন সৈয়দ আলমগীর।
চা খেতে খেতে জানালেন, খুবই সচেতনভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শেষ করে বিপণন পেশায় এসেছিলেন তিনি। বলছিলেন, সব সময় শিখতে উন্মুখ তিনি, এমনকি এখনো সহকর্মীদের থেকে শেখেন।
সফল এই বিপণন ব্যবস্থাপক বলছিলেন, ‘বিপণনে সফল হতে হলে সব সময় শিখতে হবে, চিঠি কীভাবে ভাঁজ করবেন, সেটারও একটা রীতি আমাকে শিখিয়েছে “মে অ্যান্ড বেকার”। বছরের কোন সময় টাই পরতে হবে, সেটাও শেখার ব্যাপার আছে। সবচেয়ে বেশি শিখতে হবে শৃঙ্খলা আর সময়ানুবর্তিতা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে লাগবে নতুন ধারণা, নিউ আইডিয়া।’
সৈয়দ আলমগীরের আইডিয়ার বিশ্বজয়েরই উদাহরণ হালাল সাবানের ঘটনা। এর প্রভাব এখন কীভাবে দেখেন জানতে চাইলে বলছিলেন, ‘হালাল সাবানের ক্যাম্পেইন শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আমরা খেয়াল করেছি দেশে ইউনিলিভারের লাক্সসহ প্রায় সব সাবানের বিক্রি অদ্ভুতভাবে কমে গেছে। সাবানের মার্কেট শেয়ারের অধিকাংশটাই দখল করে ফেলেছে অ্যারোমেটিক হালাল সাবান। ইউনিলিভারের শেয়ার প্রায় ধসে গিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, মার্কেট ডিজাস্টারের জন্য ইউনিলিভারের উচ্চ ও মধ্যপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়। পরে ভারত থেকে উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্ট কমিটি আসে পরস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। তাদেরও বেশ কয়েক বছর লেগে যায় এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে।’
এই সাফল্যের পাশাপাশি সৈয়দ আলমগীর বলছিলেন, ‘আমি যেসব প্রতিষ্ঠানেই কাজ করেছি তাদের আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যমুনায় না গেলে পেগাসাস কেডস ও শতভাগ হালাল সাবান আমি করতে পারতাম না। এসিআইয়ে আসা খুব ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। এর কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস বিভাগ খুব ছোট ছিল। এখন অনেক বড় হয়েছে। এখানে এসে আমি লবণের দেশসেরা ব্র্যান্ডটি তৈরি করেছি। জার্মানিতে একটি বাসায় গিয়ে দেখলাম, লবণ ধবধবে সাদা ও ঝরঝরা। সেখান থেকে মাথায় এলো, বাংলাদেশের লবণ কেন ঝরঝরা নয়। দেশে এসে বিষয়টি নিয়ে এসিআইয়ের চেয়ারম্যান এম আনিস উদ দৌলার সঙ্গে আলাপ করলাম। এরপর এসিআই আনল ধবধবে সাদা ও মিহিদানার ঝরঝরে লবণ। প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ বেশি বলে দাম একটু বেশি ধরতে হলো। তাই বাজার পাওয়া কঠিন হলো। লবণের স্লোগান দিলাম, “মেধা বিকাশে সহায়তা করে”। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘কেডসের একটি তুমুল জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ছিল পেগাসাস। বাংলাদেশে কেডসের ব্র্যান্ড আমার হাতেই তৈরি।’
নতুন যাত্রায় লক্ষ্য কী জানতে চাইলে সৈয়দ আলমগীর বললেন, মেঘনার তো প্রচুর পণ্য। আমি চাইব এ দেশের মানুষ ঘরে ঘরে মেঘনার পণ্য ব্যবহার করুক। সেটাই আপাতত লক্ষ্য।’
সফল বিপণন কর্মী হতে হলে কী করতে হবে, আগ্রহীরা জানতে চাইলে কী বলবেন? জবাবে সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘তরুণরা যখন যে কাজটি করবে, সেটি মনোযোগ দিয়ে করতে হবে। পড়াশোনার সময় পড়াশোনা। চাকরিতে যোগ দিয়ে নিজের কাজটি। নো শর্টকাটস। আর আরেকটি বিষয় হলো, মানুষকে জানতে হবে। ক্রেতার সম্পর্কে না জানলে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না। আকাক্সক্ষাটাও একটু কমিয়ে রাখতে হবে। নিজের কাজ দক্ষতার সঙ্গে করলে সাফল্য আসবেই। মানুষ পারে না এমন কিছুই নেই। শুধু চেষ্টা আর সঠিক স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) দরকার।’
প্রচণ্ড নিয়মানুবর্তী সৈয়দ আলমগীর এরপর দেখালেন অপেক্ষা করে আছে অনেকে দরজার বাইরে, দীর্ঘসময় নিয়ে আলাপ করবেন কথা দিলেন, ঈদসংখ্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য।
ধন্যবাদ দিয়ে চলে আসতে আসতেও মাথায় ঘুরছিল সৈয়দ আলমগীর আর তার কথা- মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। নো শর্টকাটস টু সাকসেস।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ‘সততার বুলি’ আওড়ান। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরে কোনো বদলি হয় না এ কথাই জোর দিয়ে বলেন তারা।
দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির বিষয়ে জানা গেছে ভয়ংকর তথ্য। ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর অনলাইন-বদলির সুযোগ না থাকলেও, টাকা হলেই বদলি হওয়া যায়। আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে জারি করা হচ্ছে আদেশ। এসব আদেশ অবশ্য ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত হয় না। নিয়মিত রাজধানীসহ সারা দেশে শিক্ষক বদলি করা হচ্ছে। তারা যোগদানও করেছেন। অনলাইন প্রক্রিয়ার বাইরেই এসব হচ্ছে।
গত তিন মাসে অনলাইন-ছাড়াই শতাধিক শিক্ষক বদলি হয়েছেন। এমন আটটি বদলির আদেশের কপি দেশ রূপান্তরের হাতে রয়েছে। কয়েকজনের যোগদানপত্রও দেশ রূপান্তরের কাছে আছে। বদলির এসব আদেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। কোনো কারণে তার ছুটিতে থাকার সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালক মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত কিছু আদেশও রয়েছে।
যেহেতু অনলাইন ছাড়া শিক্ষক বদলি বন্ধ, তাই আগের কোনো তারিখে বদলির অনুমোদন দেখিয়ে এখন শুধু আদেশ জারি করা হচ্ছে। বদলির আদেশ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। গত তিন মাসের কোনো বদলির আদেশ ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যারা বদলি হচ্ছেন তারা সশরীরে অধিদপ্তরে এসে আদেশপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। সরাসরি বদলির আদেশ জারির বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছেও কিছু আদেশের কপি এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আমাকে জানিয়েছেন, এসব বদলির আদেশ গত বছর ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারির আগেই অনুমোদন করানো ছিল। পরে বদলির আদেশ জারি হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে, আদেশের সংখ্যা বেশি নয়। ১০-২০টি হতে পারে। সংশোধিত নির্দেশিকা জারির পর সরাসরি নতুন কোনো বদলির ফাইল অনুমোদনের সুযোগ নেই। এখন বদলি করতে হলে অনলাইন আদেশের মাধ্যমেই করতে হবে।’
সচিব বলেন, ‘অনলাইনে গত ১৫ সেপ্টেম্বর বদলি শুরু হলেও তাতে কিছু সমস্যা ছিল। সমস্যা কাটিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর সংশোধিত বদলির নির্দেশিকা জারি হয়েছে। এরপর আর অনলাইনের বাইরে বদলির সুযোগ নেই।’
গাজীপুরের কাপাসিয়ার ঝাউয়াদী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদের বদলির আদেশ জারি হয় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি একই উপজেলার উত্তর পেলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়েছেন। তার বদলির আদেশটি মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত। ২৮ ফেব্রুয়ারি যোগদানও করেছেন তিনি। আগে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মূলাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন। গত ৮ ডিসেম্বর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে সব সংযুক্তির আদেশ বাতিল হয়। তিনি অনলাইন-ছাড়াই বদলির আদেশ করিয়ে নিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ফরহাদ গাজীপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অন্যতম সহযোগী। স্কুলে তেমন ক্লাস নেন না। সারাক্ষণ ডিপিইওর অফিসে থাকেন। শিক্ষক নেতার পরিচয়ে তদবিরবাণিজ্য করেন। জেলার আট-নয় হাজার শিক্ষকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায়ই চাঁদা আদায় করেন। সহকারী শিক্ষক হয়েও মাসে তার আয় কয়েক লাখ টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাই পরিচয়দানকারী হাসান আলীর মাধ্যমে তার বদলির আদেশ করিয়েছেন বলে গল্প করেন। এ কাজে তিন-চার লাখ টাকার লেনদেনের কথাও বলেন। হাসান আলীকে প্রায়ই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেখা যায়। তিনি মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরের আশপাশেই থাকেন।
গত ১৩ মার্চ চাঁদপুরের কচুয়ার নোয়ার্দ্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানীর সূত্রাপুরের শহীদ নবী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন সহকারী শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌসী। তার সরাসরি বদলির আদেশে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা। সম্প্রতি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের দিগচাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফাতেমা বেগমও রাজধানীর মিরপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে এসেছেন।
গত ১৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বোররচর বনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক খাদিজা আক্তার। তার বদলির আদেশে স্বাক্ষর রয়েছে মো. হামিদুল হকের।
সানকিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘খাদিজা আক্তার আমার স্কুলে ১৯ মার্চ যোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, অনলাইনে আগে আবেদন করা ছিল। পরে অধিদপ্তর থেকে সরাসরি বদলির আদেশ করিয়ে নিয়ে এসেছেন।’
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার তিলকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোসাফিকুর রহমান গত ১০ মার্চ বদলি হয়ে যান একই জেলার সদর উপজেলার সেনপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তার আদেশটিও মনীষ চাকমা স্বাক্ষরিত।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদরের আজমতপুর পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন সহকারী শিক্ষক তাসমিনা নার্গিস। একই তারিখে স্বাক্ষরিত আরেকটি আদেশে সহকারী শিক্ষক জেসমিন আক্তার ময়মনসিংহের নান্দাইলের গলগ-া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চকনজু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। এসব বদলির আদেশ মো. হামিদুল হক স্বাক্ষরিত।
গত ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহ সদরের কুঠুরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একই উপজেলার গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন সহকারী শিক্ষক আবিদা সুলতানা। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেছেন মনীষ চাকমা।
গাঙ্গিনার পাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাকলী গোস্বামী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে বলতে পারব না। তবে আবিদা সুলতানা বলেছে, অনলাইনে হয়েছে। আমার স্কুলে তিনি ২ জানুয়ারি যোগ দিয়েছেন।’
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার রাজাগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে গত ২৮ ডিসেম্বর সহকারী শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন একই উপজেলার বড় বিলারপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হন। আদেশটিতে স্বাক্ষর করেন মনীষ চাকমা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কুমার ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কীভাবে বদলি হয়েছে, তা বলতে পারব না। তবে সাবিনা ইয়াসমিন যোগ দিয়েছেন।’
দেশের কোনো জায়গা থেকে রাজধানীতে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি খুবই কঠিন। রাজধানীতে বদলির জন্য শিক্ষকরা ছয়-সাত লাখ টাকা খরচ করতেও দ্বিধা করেন না। আর অনলাইন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর দেশের অন্য জায়গায়ও বদলির রেট বেড়ে গেছে। এ জন্য তিন-চার লাখ টাকার লেনদেন হয় বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ রাখা হয় সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলিও। এরপর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির জন্য অনলাইনে আবেদন গ্রহণ শুরু করে। ঘোষণা দেওয়া হয়, অনলাইনের বাইরে কোনো ধরনের বদলি কার্যক্রম চলবে না। ওই সময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই অক্টোবরের মধ্যে বদলিকৃত স্কুলে যোগদান শেষ করেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম দফায় বদলি হওয়া শিক্ষকদের সবাই যেহেতু অক্টোবরের মধ্যে যোগদান শেষ করেছেন, অতঃপর গত ফেব্রুয়ারির আগে আর কোনো বদলির আবেদনের সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয় দফায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত একই জেলার মধ্যে বদলির আবেদন নেওয়া হয়। কারা বদলি হলেন তা প্রকাশ করা হয় ৯ মার্চ। গত ১৪ ও ১৫ মার্চ একই বিভাগের মধ্যে বদলির জন্য অনলাইন আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আর এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগে অনলাইনে বদলির আবেদন গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। মন্ত্রণালয় বলেছে, শিগগির তা শুরু হবে। ফলে এসবের বাইরে যে বদলি হয়েছে সেসব কোনোভাবেই অনলাইন বদলির মধ্যে পড়ে না।
অনলাইন বদলির আদেশের একাধিক কপিও দেশ রূপান্তরের কাছে রয়েছে। একই উপজেলার মধ্যে বদলির আদেশ উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। আর একই জেলার মধ্যে বদলির আদেশ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার স্বাক্ষরিত। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে যেসব বদলির আদেশ জারি হয়েছে সেসব ‘অনলাইন বদলি’ নয়। মন্ত্রণালয় নির্দেশিকা জারি করে অনলাইনের বাইরে বদলি বন্ধ করেছে।
এ ব্যাপারে জানার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত ও পরিচালক (পলিসি অ্যান্ড অপারেশন) মনীষ চাকমাকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দিয়ে এবং এসএমএস করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির কাজ হবে পুরোপুরি অনলাইনে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষক অনলাইনে আবেদন করার পর সেটি প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে যাচাই করে আবেদনটি পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। এরপর সফটওয়্যারের মাধ্যমে বদলি নির্ধারণ করা হবে। এরপর আবার ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি তখন বদলির আদেশ জারি করবেন এবং শিক্ষক সেটি অনলাইনেই জেনে যাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় উপজেলাভিত্তিক। তাই সাধারণ নিয়মে উপজেলার মধ্যেই শিক্ষকদের বদলি হতে হবে। বিশেষ কারণে উপজেলা বা জেলা পরিবর্তনেরও সুযোগ আছে।
প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহকারী অধ্যাপক। হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্যে এসে পরিচিত হন প্রফেসর হজরত হিসেবে। প্রফেসর মানে অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক কেমন করে হজরত (নামের আগে সম্মানার্থে ব্যবহৃত শব্দবিশেষ, সম্মানসূচক সম্বোধন) হয়ে ওঠেন- এ এক অবিশ্বাস্য গল্প। লিখেছেন মুহাম্মাদ আদম আলী
একজন মানুষের দুনিয়াবিমুখতা, ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ঐকান্তিক পরিশ্রম, আলেমদের প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা, শরিয়ত ও সুন্নতের ওপর সার্বক্ষণিক আমলের আপ্রাণ চেষ্টা কতটা নিবিড় ও আন্তরিক হতে পারে তা প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমানকে না দেখলে, তার সম্পর্কে না জানলে, তার সান্নিধ্যে না গেলে বলে কিংবা লিখে বোঝানো যাবে না। তার উদাহরণ বর্তমান সমাজে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত। আলেমদের সোহবত তাকে এমন উচ্চতায় আসীন করেছে, অনেক আলেমদের জন্যও তিনি পরিণত হয়েছেন এক বাস্তব আদর্শে। অসংখ্য আলেম তাকে আধ্যাত্মিক রাহবার (পথপ্রদর্শক ও পীর) হিসেবে মানেন, তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেছেন। তাকে দেখে অনেক বুজুর্গ এমনও মন্তব্য করেছেন, তার সান্নিধ্যে সাহাবিদের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
প্রফেসর হজরত ৯ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে মুন্সীগঞ্জের নয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছেন। এ সময় মক্তবে গিয়েছেন। গ্রামের বাড়ির কাছেই ছিল মক্তব। মক্তবের উস্তাদ মরহুম মাওলানা মাকবুল হুসাইন (রহ.)-এর কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শৈশব থেকেই তার পিতা ইয়াসিন (রহ.) তাকে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মক্তবের উস্তাদদের খেদমতে নিয়োজিত করেছিলেন। তাদের সান্নিধ্যেই হজরতের মনে দ্বীনি অনুভূতি সঞ্চার হতে থাকে। এমনিতে তার বাবা ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করতেন রেলওয়ে বিভাগে। কিন্তু কোরআন মাজিদের আশেক ছিলেন। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। বাসায় ফিরে বিকেলেও কোরআন পড়তেন। কোরআনের প্রতি পিতার এই ভালোবাসা সন্তানের মনেও আসন গেড়ে বসে।
ইসলামিয়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হতেই বাবাকে হারান। তারপর হজরতের জীবন কঠিন হয়ে ওঠে। সংসারে বাবাই ছিলেন একমাত্র আয়ের উৎস। তার ইন্তেকালে সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটনের বোঝা। ঢাকার নিমতলীতে যে বাসায় মা এবং তার আরও দুই ভাইকে নিয়ে থাকতেন, সেখানেও বেশিদিন থাকতে পারেননি। গ্রামে চলে যেতে হয়।
১৯৫৭ সালে কলেজ পাস করে ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)। এ সময় হজরতের সংসার চলত বাবার পেনশনের টাকায়। অনেক কষ্টে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। তারপর শুরু করেন কর্মজীবন। প্রথমে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এবং পরে ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। এ সময় বাসা ভাড়া নেন আজিমপুরে। আর তখনই পরিচয় হয় হজরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.)-এর সঙ্গে। তিনি অনেক বড় আলেম ছিলেন। তার কাছে নানা বিষয়ের জ্ঞান লাভ করেন। বিশেষ করে কোরআন মাজিদের ক্ষেত্রে হজরতের পারদর্শিতা মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের সঙ্গে থাকার বরকতে অর্জিত হয়েছে।
১৯৬৫ সালে হজরত কোম্পানি থেকে ট্রেনিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড যান। প্রায় ৯ মাস সেখানে ছিলেন। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে হজরতের দ্বীনি অনুভূতি অনেক বেড়ে যায়, তিনি দাড়ি রেখে দেন। হজরতের মা খুব পরহেজগার নারী ছিলেন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে দিন-রাত পড়ে থাকতেন, তাহাজ্জুদ পড়তেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক। ছেলেরা সবাই হাফেজ ও আলেম।
ইংলিশ ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে হজরতের ব্যাপক পরিচিতি ছিল, সুনাম ছিল। বছর না ঘুরতেই তিনি কোম্পানির জন্য একটা সম্পদ হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের শুরুর দিকে কোম্পানির প্রোডাক্ট সেলের জন্য ঘুষের প্রচলন শুরু হলে তিনি এর বিরোধিতা করেন। এক পর্যায়ে লোভনীয় চাকরিটি ছেড়ে দেন।
পরে অনেক কম বেতনে ১৯৬৯ সালে তিনি বুয়েটে যোগ দেন। পদবি সহকারী অধ্যাপক। তিনি মাস্টার্স ও পিএইচডি করেননি। সুতরাং তার প্রমোশন হয়নি। এ সময় তিনি তাবলিগে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। ইতিমধ্যে বড় ছেলেকে মাওলানা আবদুল্লাহ হুজুরের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা ছিল। কারণ, আল্লাহ তাকে যে কাজের জন্য দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, সেটি যেন এখনো হাতের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। শিগগিরই সেটিও পূর্ণ হয়ে যায়। তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সোহবত লাভে ধন্য হন।
প্রফেসর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন ১৯৭৪ সালে। বায়াতের পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) অপূর্ব একটি নসিহত করেন। তাহলো- ‘চোখের গোনাহ থেকে বাঁচেন।’ এই এক কথায় হজরতের আমল শুরু হয়ে যায়। এর আগে তাবলিগে সময় লাগানোর কারণে কথাটি বহুবার শুনেছেন। কিন্তু আমলের সুযোগ হয়নি। হাফেজ্জী হুজুরের নসিহতের পর এ আমল শুরু করেন। বায়াত হওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত লাভ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর সঙ্গে হজের সফর করেন। মদিনায় একদিন ভোররাতে তাহাজ্জুদের নামাজের সময় হয়েছে। যথারীতি হাফেজ্জী হুজুর অজু করে প্রস্তুতি নিয়েছেন মসজিদে যাওয়ার। হাফেজ্জী হুজুরের একটা লাঠি ছিল, ওই সময় লাঠিটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এদিকে তাহাজ্জুদের সময় প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। একটু খোঁজ করেই হাফেজ্জী হুজুর হজরতকে বললেন- ‘থাক, লাগব না লাঠি। আপনিই আমার জিন্দা লাঠি।’ দেশে ফিরেও এই কথা বলেছেন, ‘হামীদুর রহমান আমার জিন্দা লাঠি।’ তখন থেকেই হজরতের নাম হয়ে যায়- ‘জিন্দা লাঠি।’
প্রফেসর হজরত ১৯৮৫ সালে হাফেজ্জী হুজুরের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফর করেন। এ সফরে যাওয়ার আগে তিনি ছুটি পাননি। অনেক অনুরোধের পরও বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে ছুটি দেয়নি। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। ইংল্যান্ড সফরের শেষ দিকে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) হজরতকে বললেন, ‘আপনি আমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিলেন? দেশে গিয়ে কী করবেন?’ হজরত বললেন, ‘হুজুর! আমি আল্লাহর খুশির জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো কোনো ভয় লাগে না।’ কথার জবাব দেওয়া হয়ে গেল। এখন একটুখানি থেমে হাফেজ্জী হুজুর বললেন, ‘এবার দরসিয়াতের (কওমি নেসাবে) কিতাবগুলো পড়ে ফেলেন। নিজে আলেম হন। নিজে মাদ্রাসা করে পড়ান।’ চিন্তা করলে অবাক হতে হয়, আল্লাহর অলি কী জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সমাধান দিলেন?
প্রফেসর হজরত আপন পীর ও শায়খের এই নসিহত পুরোপুরি আদায় করতে পারেননি বলে আফসোস করেন। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন ঠিকই, কিন্তু দরসিয়াতের কিতাবগুলো পড়তে পারেননি। এজন্য এখনো এই বৃদ্ধ বয়সে সময়-সুযোগ হলে কারও কাছে দরসিয়াতের কিতাব পড়ার চেষ্টা করেন।
প্রফেসর হজরত প্রফেশনালি খুব খ্যাতি অর্জন করেছেন। সরকারি পর্যায়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। তবে বৈষয়িকভাবে আর ব্যস্ত হতে চাননি। তিনি দুনিয়ার যশ-খ্যাতির তুলনায় আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি সফলও হয়েছেন। দুনিয়াতে এর নমুনাও প্রকাশ পেয়েছে। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা মুহিউস সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক (রহ.)-এর কাছে বায়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
২০১২ সালে তিনি আমেরিকায় দীর্ঘ সফর করেন। এ সময় নিউইয়র্ক, বাফেলো, নায়াগ্রা, মিশিগান, আটলান্টা, ফ্লোরিডা, লস এঞ্জেলেস, সান ফ্রান্সিসকো, ডালাস, হিউস্টন এবং অস্টিনে হজরতের প্রোগ্রাম হয়। এসব প্রোগ্রামে তিনি ইংরেজিতে বয়ান করেন। তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অসাধারণ। পরে ২০১৪ সালে নিউজিল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে কানাডা সফর করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য এরপরে আর বিদেশ সফর করতে পারেননি। তার বিদেশ সফর নিয়ে মাকতাবাতুল ফুরকান থেকে তিনটি সফরনামা বের করা হয়েছে। এ ছাড়া একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার অপূর্ব জীবনী, বয়ান, মালফুযাত ও অন্যান্য বিষয়ে আরও ১৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে।
হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন কোরআনের মানুষ। তার জিহ্বা সর্বদা নড়ত, জিকির না হলে কোরআন তেলাওয়াত। গ্রামে-গঞ্জে মক্তব প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন। প্রফেসর হজরত এটা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। তিনিও মক্তব প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াচ্ছেন। এখন যখন দুই জনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে দাঁড়াতে হয়, তখনো তিনি ছুটে চলছেন। গাড়িতে শুয়ে শুয়ে সফর করেন। মুখে কথা বলতে কষ্ট হয়। শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু হাফেজ্জী হুজুরের সান্নিধ্য তার অন্তরে কোরআনের যে মহব্বত আসন গেড়েছে, তাতে বিন্দুমাত্র দুর্বলতা আসেনি। এক অপার্থিব রুহানি শক্তিতে তিনি পথ চলেন। এ পথ তিনি আমৃত্যু চলবেন, তার ছায়া আমাদের ওপর আরও দীর্ঘ হোক- দয়াময় আল্লাহর কাছে এই প্রাথর্না করি।
রংপুরের জেলা প্রশাসককে 'স্যার ডাকতে বাধ্য করার' অভিযোগ এনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক।
বুধবার (২২ মার্চ) রাত ৮টা থেকে তিনি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে অবস্থান শুরু করেন বলে জানা গেছে।