
শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ও মানবাধিকারকর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে বেলারুশের আদালত। গতকাল শুক্রবার দেশটির একটি আদালত বিক্ষোভকারীদেরকে অর্থায়ন ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে এ দণ্ড দিয়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বিয়ালিয়াৎস্কির বিরুদ্ধে এই মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছে।
বিবিসি বলছে বিয়ালিয়াৎস্কি আদালতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। অন্যদিকে, কৌঁসুলিরা মিনস্ক আদালতকে তাকে ১২ বছরের দণ্ড দিতে বলেছিলেন। তিনি এবং আরও তিনজনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অর্থায়ন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিবিসি জানাচ্ছে, অ্যালেস এই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন। অ্যালেস ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে বন্দি রাজনৈতিক কর্মীদের আর্থিক ও আইনি সহায়তা দিয়েছেন।
বেলারুশের সরকারবিরোধী আন্দোলনের নেতা সভিয়াতলানা সিখানোস্কায়া বিচারের নামে অ্যালেসকে কারাদণ্ড দেওয়ার নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি টুইটারে লিখেছেন, এই ‘লজ্জাজনক অবিচারের’ বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং তাদের মুক্ত করতে অবশ্যই সব করা হবে।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভের জের ধরে পরের বছর অ্যালেস ও তার কয়েকজন সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসেন আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো। লুকাশেঙ্কো ১৯৯৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কয়েক দফায় দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, তখন থেকেই তিনি বিরোধী দলের ওপর দমনপীড়ন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার খর্ব করে আসছেন।
দেশে উৎপাদন হয় না ইয়াবা ট্যাবলেট, অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সারা দেশ থেকে প্রতিদিন উদ্ধার হচ্ছে গড়ে প্রায় সোয়া লাখ পিস। সর্বোচ্চসংখ্যক ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে ২০২১ সালে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় লাখ। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে উদ্ধার হওয়া মাদকের পরিসংখ্যান ঘেঁটে এমন ভীতিকর তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ছয় বছরে সারা দেশে উদ্ধার হয়েছে ২৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫৭০ ইয়াবা ট্যাবলেট।
অভিযানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সীমান্ত দিয়ে দেশে যে পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকছে তার অল্পসংখ্যকই ধরা পড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে। আটক ইয়াবার বেশিরভাগই কক্সবাজার-মিয়ানমার সীমান্ত থেকে আসা। পাচারকারীদের নিত্যনতুন কৌশলের কাছে একপ্রকার ধরাশায়ী হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দেশে ইয়াবার মতো মাদকদ্রব্য ব্যাপক হারে পাচার হয়ে আসা নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনী থেকে শুরু করে দেশের অভ্যন্তরে মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা বাহিনীগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশ বলছে, তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করছে নিয়ন্ত্রণ করার। কারবারিদের ওপর তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাহফুজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যারা মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ইতিমধ্যে জামিনে গেছে বা সাজা খেটে বের হয়ে গেছে তাদের ওপর নজরদারি রেখেছি যাতে ফের এ পেশায় জড়িয়ে না যায়। এর বাইরে আমাদের গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চেষ্টা করছি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার।’
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় বছরে সারা দেশে পুলিশ, র্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে উদ্ধার হয়েছে ২৫ কোটি ৮৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫৭০ ইয়াবা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ১৮ হাজার ২১৪ ইয়াবা ধরা পড়েছে। ২০১৭ সালে ৪ কোটি ৭৯ হাজার ৪৪৩, ২০১৮ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার ৫৪৮, ২০১৯ সালে ৩ কোটি ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩২৮, ২০২০ সালে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭, ২০২১ সালে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৫ ও ২০২২ সালে ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৫৬৯ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। গত ছয় বছরে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৬ লাখ ২৯ হাজার ৭৫১টি আর আসামি ৮ লাখ ১৭ হাজার ৫৩৩ জন।
২০০০ সালের পর টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসতে শুরু করে। তারপর এটি খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। তবে দেশে প্রথম ইয়াবার চালান ধরা পড়ে ২০০৩ সালে রাজধানীর গুলশানে।
পাশর্^বর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদী দিয়ে বছরের পর বছর ধরে দেদার দেশে ঢুকছে মরণ নেশা ইয়াবা। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের ওপর মহলও অবগত রয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে সরকার ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে। কিন্তু কাজে আসছে না কোনো পদক্ষেপই।
অভিযানসংশ্লিষ্ট শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা মনে করেন, সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ করা না গেলে দেশের ভেতরে অভিযান চালিয়ে কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থার তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি জানান, সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকছে তার ১০-২০ ভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরতে পারছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ইয়াবা মূলত মিয়ানমার থেকে আসছে। ইয়াবা চোরাচালান রোধে কক্সবাজারে আমরা একটি বিশেষ টাস্কফোর্স করেছি। কীভাবে মাদক প্রতিরোধ করা যায় সে বিষয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছি। আমরা তৎপর আছি, ইয়াবা যা আসছে তা আমরা উদ্ধার করছি।’
গ্রেপ্তারের পরও কেন ইয়াবার বিস্তার থামছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা মাদক চোরাচালান করে তারা মেধা খাটিয়েই কাজগুলো করে, তারা অনেক দুষ্ট হয়।’ অন্যদিকে ইয়াবায় আসক্তি থেকে বের হয়ে আসা অনেক কঠিন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা চিকিৎসার বিষয়ে সোচ্চার রয়েছি। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছি।’
যে পথে আসে ইয়াবা : কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে নাফ নদী। নদীটির ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। ইয়াবার চালানের অধিকাংশই এই নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যে ইয়াবার বাহকরা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতারা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে টেকনাফের বেশ কয়েকজন মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করলেও ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই। বরং নতুন করে ইয়াবার রুটে দেশে ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস নামের মাদকদ্রব্য।
গত বছর মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসে প্রকাশিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজার ও বান্দরবান দিয়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের ১৫টি রুট দুর্গম হওয়ায় চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মিয়ানমারের শান ও কোচিন প্রদেশে কারখানা স্থাপন করে ইয়াবা উৎপাদন করা হচ্ছে। এই ১৫টি পয়েন্টের মধ্যে ১০টি কক্সবাজার আর ৫টি বান্দরবান সীমান্তে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তল্লাশি থাকায় সম্প্রতি রুটও বদল করেছে ইয়াবার কারবারিরা। কৌশল পরিবর্তন করে তারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে বেছে নিয়েছে সাতটি নতুন রুট। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের মিজোরাম, আসাম ও মণিপুর হয়ে ত্রিপুরার দুটি রুট আর বান্দরবান, কক্সবাজার, বরিশাল, যশোর ও সাতক্ষীরার পাঁচটি রুট।
ইয়াবার বহনের যত কৌশল : ডিএনসি, পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের সুযোগ নিচ্ছে কারবারিরা। ইয়াবা ট্যাবলেট সহজেই বহনযোগ্য। মূলত কাট-আউট পদ্ধতিতে দেশের ভেতরে চলছে কারবার। বাহক প্রাথমিক অবস্থায় জানে না কে গ্রহণ করবে। বর্তমানে বাহকের পেটের ভেতর পাকস্থলীতে করে ইয়াবা বহন বেড়েছে। এ ছাড়া পেঁয়াজ, বেগুন, আসবাব, গাছের গুঁড়িসহ বিভিন্ন মালামালের সঙ্গে বহন করা হয় ইয়াবা। আগে থেকে সোর্সের মাধ্যমে তথ্য না পেলে পরিবহনের সময় সাধারণ তল্লাশি চালিয়ে তাদের শনাক্ত করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার পেটে ইয়াবা বহনকারীদের গ্রেপ্তারের পরও পড়তে হচ্ছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। পেটের মধ্য থেকে ইয়াবা বের করা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। গত বছর আগস্ট মাসে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অসুস্থ হয়ে একজন মারা যান। পরে ময়নাতদন্তে তার পেটে অর্ধগলিত ইয়াবা পাওয়া গেছে। ইয়াবা ট্যাবলেটের অন্যতম খুচরা বাজার রাজধানী। সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ঢাকাকে ট্রানজিট হিসেবেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্ল্যাহ কাজল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেখা গেছে পাঁচ হাজার পর্যন্ত ইয়াবা বিশেষ কায়দায় পেটের মধ্যে নিয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। যানবাহনে চলাচলকারী কতজনকে আমরা চেক করব। তথ্য ছাড়া তো বের করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া এদের আটকের পর পেট থেকে ইয়াবা বের করতে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে যা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জের।’
ননীবাবুর আমাদের বাড়িতে আসার সময়টা ছিল সকালবেলা। ঘামে ভেজা সাদা হাফ হাতা হাওয়াই শার্ট পরনে, হাতে একটা ছোট ব্যাগ। গালে কয়েক দিনের না-কামানো দাড়ি। তিনি আসতেন বাবার কাছে। তখন আমি স্কুলের গন্ডি ছাড়াইনি। ভদ্রলোকের আসাটা ছিল অনিয়মিত। দরজা খুলে দিলে বসার ঘরে বসতেন। খুব মৃদু স্বরে প্রতিবার একই প্রশ্ন করতেন, ‘তোমার বাবা আছেন বাড়িতে?’ খুব বেশিক্ষণ বসতেন না। বাবাকে দেখতাম কয়েকটা দশ টাকার নোট তাকে দিতেন। তারপর কিছুক্ষণ নিচু গলায় কথা বলে মধ্যবয়সী ননীবাবু বিদায় নিতেন। যাওয়ার সময় বাবার হাতে লালচে নিউজপ্রিন্টে ছাপা মলিন একটি পুস্তিকা ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতেন।
অল্প বয়সে দেখতাম সেই পাতলা নিউজপ্রিন্টে ছাপা পুস্তিকার ওপর কয়কজন মানুষের মুখের ছাপ দেওয়া। কৌতূহল হতো ননীবাবুর পরিচয় জানার। কিন্তু প্রশ্ন করেও তখন বাবার কাছে সন্তোষজনক উত্তর পাইনি। ননীবাবুর আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ হয়নি আরও অনেক বছর। আমার বয়স বাড়ে। সেই পুস্তিকার মলাটে ছাপ দেওয়া মানুষের মাথাগুলোর পরিচয় ধীরে ধীরে জানতে পারি কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, মাও জে দং। তখন এটাও জানতে পারি, ননীবাবু আসলে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া একটি চরমপন্থি বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী। বাবার একদা রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার সূত্র ধরে ননীবাবু পার্টির জন্য চাঁদা নিতে আসেন।
একবার হঠাৎ করেই ননীবাবু বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিলেন। আমি একটু অবাক হয়ে একদিন বাবার কাছে কারণ জানতে চেয়ে শুনলাম, তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন পুলিশের নজর এড়াতে। গা-ঢাকা দেওয়া শব্দটা নতুন ছিল আমার কাছে। রাজনীতি করার জন্য যে পুলিশ খুঁজতে পারে তা জেনে কেমন একটা অচেনা শিহরণ তৈরি হলো মনে! আর পুলিশের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটাকেও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল তখন। গা-ঢাকা দেওয়া বিষয়টা মনের মধ্যে অনেক দিন নতুন হাওয়ার কম্পন তৈরি করেছিল।
বেশ কিছুদিন পর ননীবাবু আবার আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতে শুরু করলেন। তখন মনে হতো, গোপন বামপন্থি রাজনৈতিক দলের কর্মী বোধ হয় এমনই হয়। একটু ঢিলেঢালা, নিরীহ চেহারা। মানুষের ভিড়ে সহজে মিশে যাওয়া। কিন্তু সত্তরের দশকের প্রথম ভাগে বিদেশি পত্রিকায় চে গুয়েভারার ছবি দেখে আমার ভাবনা পাল্টে যায়। ছবিতে দাড়িপূর্ণ মুখের ওই তেজস্বী মানুষটাকে দেখে মনে মনে নিজেকেও বলিভিয়ার জঙ্গলে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়ানো বিপ্লবী তরুণ বলে ভাবতাম। ওই সময়ে আরেকজন বিপ্লবী তরুণ আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতে শুরু করলেন। আরেকটি নিষিদ্ধঘোষিত বাম রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন। তবে তিনি দেখতে একেবারেই ননীবাবুর অবয়বের মানুষ ছিলেন না। রাতেরবেলা সঙ্গোপনে আসতেন তিনি। তখন বাবার মুখে শুনে আন্ডারগ্রাউন্ড আর মুক্তাঞ্চল শব্দ দুটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি। সেই বিপ্লবী মানুষটির দৈহিক গড়ন ছিল লম্বা। মাথায় ঘন চুল। মনে আছে, প্রচুর সিগারেট খেতেন। তার সস্তা সিগারেটের কটু গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত ঘর। কয়েকবার তাকে দেখেছি রাত গভীর হলে কোনো কোনো দিন আমাদের বাড়িতে ভাত খেয়ে যেতে। তিনিও বেশ অনেক বছর ধরেই অন্ডারগ্রাউন্ড জীবন যাপন করছিলেন। বছরখানেক বাদে হঠাৎ একদিন শুনলাম সেই তরুণ খুন হয়েছেন অন্তর্দলীয় সংঘাতে। বাবার মুখে খবরটা শুনে বেদনাবোধ আমার সঙ্গী হয়ে ছিল অনেক দিন। ননীবাবুর সঙ্গে ঢাকা শহরে আমার আবারও দেখা হয়েছে। তখন বাবাও আর বেঁচে নেই। ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখাচোখি হতে তিনি হাত নেড়ে আবার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছেন।
আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, রাজনীতির তীব্র তরঙ্গে সাঁতার কাটতে কাটতে গা-ঢাকা দেওয়া মানুষগুলোর জীবনটা এভাবেই একদিন ফুরিয়ে যায়? তরুণ বয়সে আমিও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছিলাম। তখন স্বৈারাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কাল চলছে। বহু তরুণ সশস্ত্র সংঘাতের পথ বেছে নিয়েছে। রাজনৈতিক সূত্রে তখন তাদের দেখতাম রাতেরবেলা পুলিশের চোখ এড়াতে বিভিন্ন বাড়িতে গা-ঢাকা দিতে। তাদের কেউ কেউ আমার বাড়িতেও আশ্রয় নিত। কোমরে পিস্তল গুঁজে তারা ঘুমাতে আসত। তখন উদ্বাস্তু সেই রাতগুলো আমরা পার করতাম গল্প করে। একটু একটু করে গোপনীয়তার বাদাম ভেঙে প্রকাশিত হতো এই শহরের নিচের তলায় আরেকটা শহর যেখানে সতর্ক অস্ত্রের ট্রিগারই বেঁচে থাকার একমাত্র পথ ছিল।
গা-ঢাকা দেওয়ার ব্যাপারটার সঙ্গে পুলিশের গন্ধ জড়িয়ে থাকে। অপরাধী ভাঙতে থাকে রাস্তা, গলি। টপকাতে থাকে বাধা। খুঁজতে থাকে আড়াল। গোপন রাজনীতি আর পুলিশের তাড়া খাওয়া সেই সব মানুষ কিন্তু অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল না। রাজনৈতিক আনুগত্য তাদের দিনের পর দিন পলাতক জীবনে ঠেলে দিয়েছিল। ননীবাবুর সংসার কীভাবে চলত, আমি আজও জানি না। সেই খুন হয়ে যাওয়া তরুণ হয়তো সত্তরের দশকে খুন হওয়া হাজার তরুণের মিছিলে একটি সংখ্যা হয়ে আছেন। তার ইতিকথার পরের কথা আর জানা হয়নি, জানা সম্ভবও না। যে তরুণরা কোমরে অস্ত্র নিয়েই মেঝেতে পেতে দেওয়া চাদরের উপুড় শুয়ে থাকত, তাদের মনের মধ্যে বয়ে যাওয়া ঝড়ের গল্পটা রয়ে গেছে আজও অজানা। শুধু হারানো এক শহরজুড়ে পুলিশের ওয়াকিটকি কাশির শব্দের মতো জেগে থাকে মাঝে মাঝে অবচেতনে। পলায়নপর পায়ের শব্দ, ছায়া আর পলাতক জীবন ম্যাজিকের মতো মনের পর্দায় ঝলসে উঠে হারিয়ে যায়।
দেশে মোট প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ১৮-২৪ শতাংশ দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনে ভুগছে। তবে সংখ্যার চেয়ে বেশি উদ্বেগজনক হলো, দেশে নতুন করে মানুষের মধ্যে দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন বাড়ছে। বিশেষ করে গত ২০ বছরে অপ্রাপ্ত বয়স্ক অর্থাৎ শিশু-কিশোরদের মধ্যে দৈহিক স্থূলতা বেড়েছে তিনগুণের বেশি। আগে যেখানে ৪-৫ শতাংশ শিশু-কিশোরের দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন ছিল, এখন সেটা বেড়ে ১৪-১৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ এ সময়ে দৈহিক স্থূলকায় শিশুদের সংখ্যা তিনগুণ বেড়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ ও শিশু বিভাগ এসব তথ্য জানিয়েছে। এ দুই বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, এ দুই শ্রেণির মানুষের মধ্যে দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের সংখ্যা দেশের সামগ্রিক বিবেচনায় বেশি। কোনো কোনো দেশে ৫০-৫৫ শতাংশ পর্যন্ত দৈহিক স্থূলতার মানুষ আছে। সেখানে বহু বছর ধরে একই হার রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে মানুষের দৈহিক স্থূলতা অনেক কম ছিল। সে তুলনায় ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে।
তারা বলেন, দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের শিকার মানুষ উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
এমন অবস্থায় আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব দৈহিক স্থূলতা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে ওয়ার্ল্ড ওবিসিটি ফেডারেশন গতকাল শুক্রবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে সামনের এক যুগে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ মুটিয়ে যাওয়ার সমস্যায় পড়বে; অর্থাৎ তাদের ওজন হবে উচ্চতা অনুযায়ী স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি। ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৪০০ কোটি মানুষ অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগবে। সবচেয়ে দ্রুত এ সমস্যা বৃদ্ধি পাবে শিশুদের মধ্যে।
শহরে বেশি, গ্রামে কম : বিএসএমএমইউয়ের শিশু বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এ বিভাগে ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসা ১ হাজার ৪৪ জন শিশু-কিশোরের মধ্যে দৈহিক স্থূলতার শিকার ৪০ শতাংশ। এদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন ছিল ২৭ দশমিক ৫৯ শতাংশের, দৈহিক স্থূলতা ছিল ৫৯ দশমিক ০৬ শতাংশের, গুরুতর স্থূলতা ছিল ১২ দশমিক ৭২ শতাংশের ও রোগাক্রান্ত স্থূলতা ছিল শূন্য দশমিক ৬৩ শতাংশ শিশু-কিশোরের।
বিএসএমএমইউ ২০১৪ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী বলেছে, তখন ৬-১৫ বছর বয়সী স্কুলগামী শিশু-কিশোরদের মধ্যে দৈহিক স্থূলতার ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশের ও অতিরিক্ত ওজন ছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশের। গ্রামে এই হার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ ও শহরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। ছেলে শিশুরা বেশি স্থূলতায় ভুগছে অর্থাৎ ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়ে শিশুদের মধ্যে এ হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
এ ব্যাপারে বিএসএমএমইউর শিশু বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সুরাইয়া বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাধারণত দেখা যায় মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ শিশু-কিশোরের অতিরিক্ত ওজন। কিন্তু মা অথবা বাবার যদি ওজন বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ শিশু-কিশোরের ওজন বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর যদি দুজনেরই ওজন বেশি থাকে, তাহলে ৭০ শতাংশ শিশু-কিশোরের ওজন বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’
‘কেন দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএসএমএমইউর এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মানুষ যে পরিমাণ ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে, সারা দিনে যে পরিমাণ ক্যালরি খরচ করে, তাতে দেখা যায় দিন শেষে বেশ পরিমাণ ক্যালরি অব্যবহৃত হিসেবে থেকে যায়। বাংলাদেশের মানুষের যে সামগ্রিক জীবনযাপন পদ্ধতি, তাতে তার বয়সের সাপেক্ষে যে পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম করার কথা, তার চেয়ে কম করেন। এর মধ্যে যার যেটুকু খাওয়া দরকার, সে সেটুকু খায়, আবার কেউ কেউ বেশি খায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেকোনো বিল দিতে মোবাইল বা ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করছি। সামাজিক কাঠামোগুলো আস্তে আস্তে কমছে। প্রতিদিন স্কুল-কলেজে আবশ্যিক হওয়ার কথা ছিল খেলার মাঠ। ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করবে। কিন্তু খেলার মাঠ কমছে। তাই আমরা এখন বলছি, খেলার মাঠ থাকুক বা না থাকুক, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপরের ক্লাসে যেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ শারীরিক শ্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে।’
এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে দৈহিক স্থূলতা অন্য দেশের তুলনায় কম হওয়ার কারণ হলো এখানে চর্বিসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার প্রবণতা বহু দেশের তুলনায় কম। তারা আমাদের চেয়ে প্রোটিন ও চর্বি বেশি খায়। কিন্তু আমাদের খাদ্যাভ্যাস একদিক থেকে ওদের চেয়ে মারাত্মক। সেটা হলো আমরা প্রোটিন মারাত্মক কম খাই। চর্বি মোটামুটি খাই। কিন্তু কার্বোহাইড্রেট খুব বেশি খাই। গত বছরের এক গবেষণায় আমরা দেখেছি, বাংলাদেশে মানুষ প্রতিদিনের খাবার থেকে যে ক্যালরি পায় তার ৮০-৯০ শতাংশ আসে শর্করা থেকে। অথচ একজন সুস্থ মানুষের শরীরে শর্করা থেকে ৪০-৫০ শতাংশ ক্যালরি আসার কথা। এ শর্করা খাওয়ার পর যখন হজম হয়, শরীরে যদি সে পরিমাণ ব্যবহার না করা হয়, তাহলে চর্বি হয়ে জমা হয়।’
কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে জানতে চাইলে ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘দৈহিক স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজনের কারণে এসব মানুষ দ্রুত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে। উচ্চ রক্তচাপ, ব্যথা বেড়ে যাবে। যাদের ওজন অনেক বেশি, তাদের ব্যথাও অনেক বেশি। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট। নাক ডাকা। হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গেও হার্ট অ্যাটাক সম্পৃক্ত। অতিরিক্ত ওজনের মানুষ বেশি কাজ করতে পারবে না। কর্মক্ষমতা হারাবে। পুরুষ ও নারী দুজনের ক্ষেতেই প্রজনন ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধরনের মানুষ বেশিদিন বাঁচবে না। তাদের আয়ু কমে যাবে।’
চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, এ ধরনের মানুষ এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের চিকিৎসকদের কাছে যাবে। এন্ডোক্রাইনোলজি বা হরমোন বিভাগের চিকিৎসকের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি টিম থাকতে হবে। টিমে অবশ্যই পুষ্টিবিদ থাকবেন। এসব মানুষকে স্বাস্থ্যশিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে পুষ্টিবিদের সংখ্যা কম। বিএসএমএমইউতে মাত্র দুজন পুষ্টিবিদ আছেন। এখানে থাকার কথা কমপক্ষে ১০০ জন। বারডেমে ১৮ জন পুষ্টিবিদ আছেন। সারা দেশে এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলে এন্ডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ৩০৮ জন।
কী ধরনের সতর্কতা প্রয়োজন এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. সুরাইয়া বেগম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাধারণ স্থূলতার কারণ আমাদের অস্বাভাবিক জীবনযাপন, খাদ্যগ্রহণে সমস্যা রয়েছে। জাঙ্কফুড বেশি খাচ্ছি। শারীরিক কর্মকান্ড কম। মোবাইল ও টিভি বেশি দেখছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় মা-বাবার যদি ওজন বেশি থাকে, সে ক্ষেত্রে শিশুর ওজন বেশি হয়। সুতরাং এ ধরনের স্থূলতা আমরা নিজেরাই তৈরি করি।’
এ ব্যাপারে ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট ওজন থাকা দরকার। গড়ে কারও যদি উচ্চতা ১৩৪ সেন্টিমিটার হয় তাহলে তার দৈহিক ওজন ৭০ কেজির কম হবে। এটা গড় হিসাব। যদি নারী হয় তাহলে তার ওজন আরও ৫ কেজি কম হবে। এটা থেকে যত বেশি ওজন হবে, তত বেশি উদ্যোগ নিতে হবে ওজন কমানোর।’
জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিশি নামের ২৮ দিনের এক কন্যাসন্তানকে ফেলে বাবা-মা উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার তিন দিন পার হলেও খোঁজ মেলেনি বাবা-মা বা কোনো অভিভাবকের। এ নিয়ে গতকাল রাত থেকে জেলাজুড়ে চলছে আলোচনা।
গত বুধবার বিকেল ৪টার দিকে হাসপাতালে শিশু নিশিকে ফেলে যাওয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তির তথ্য মতে, নিশি জেলার মাদারগঞ্জ উপজেলার পাটাদহ ইউনিয়নের কয়রার রকিব ও রোকসানা দম্পতির সন্তান।
হাসপাতাল ও দর্শনার্থী সূত্রে জানা যায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে হাসপাতালের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ২৬ দিন বয়সী নিশিকে কম ওজন ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি করান রকিব-রোকসানা দম্পতি। ১ মার্চ নিশিকে হাসপাতালের চারতলায় শিশু ওয়ার্ডের করিডরে অপেক্ষমাণ রোগীর এক স্বজনের কাছে দেন নিশির নানি। নিশির মাকে নিচ থেকে আনবেন বলে হাসপাতালের নিচতলায় চলে যান নিশির নানি। আর ফিরে আসেনি কেউ। তাদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেন রোগীর ওই স্বজন। নিশির কোনো অভিভাবক খুঁজে না পেয়ে বিষয়টি নার্সদের জানান ওই স্বজন। হাসপাতালে ভর্তির ফরমে দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে শেখ রাসেল বিশেষায়িত শিশু সেবাকেন্দ্রের দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্স নিশির কম ওজন এবং শ্বাসকষ্ট দেখে তাকে সেখানে ভর্তি করেন। নিশি হাসপাতালের তত্ত্বাবধানে শেখ রাসেল বিশেষায়িত নবজাতক সেবাকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
জামালপুর সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নের হাজিপুরের সেলিনা বলেন, ‘চার দিন হয় আমার নাতি হাসপাতালে ভর্তি। এ সময় জানতে পারলাম, একটা বাচ্চাকে তার মা ফেলে চলে গেছে। এ কেমন মা! নিজের সন্তানকে ফেলে যায়। বাবা-মাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া উচিত।’
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার মো. শরিফ মিয়া, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে তার বাচ্চাকে ভর্তি করেছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ সন্তানের জন্য সবকিছু বিসর্জন দেয়। নিজের জীবন বাজি রেখে বাবা -মা তার সন্তানকে লালন-পালন করে। এ কেমন বাবা-মা! নিজের সন্তানকে ফেলে পালিয়ে যায়?’ বাবা-মাকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তিনি।
জেনারেল হাসপাতালের শেখ রাসেল বিশেষায়িত নবজাতক সেবাকেন্দ্রের আয়া কোহিনূর বেগম বলেন, ‘বিকেল ৪টার দিকে এক মহিলার কাছে বাচ্চাটাকে রেখে ওর নানি নিচে মাকে আনতে যান। পরে তিনি আর ফিরে আসেননি। পরে বাচ্চাটাকে ভেতরে নিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে।’
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স মাফিয়া সুলতানা বলেন, ‘বুধবার বিকেলে হাসপাতালের করিডরে অপেক্ষমাণ রোগীর স্বজনের কাছে বাচ্চাটাকে রেখে ওর অভিভাবক পালিয়ে যায়। ভর্তির সময় যে মোবাইল নম্বর বা ঠিকানা আমরা পেয়েছিলাম, ওই ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কেউ মোবাইল ধরে না।’
জামালপুর জেনারেল হাসপাতালের শেখ রাসেল বিশেষায়িত হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসক জান্নাত আরা মিলি বলেন, ‘কম ওজন এবংশ্বাসকষ্ট নিয়ে শিশুটিকে ভর্তি করা হয়েছে। তার চিকিৎসা চলছে। নবজাতকটি সুস্থ রয়েছে। তবে অভিভাবককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের সহকারী পরিচালককে বিষয়টি জানানো হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে বাচ্চাটার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নবীনগর থেকে বাস ছিনিয়ে নিয়ে রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে ঘুরে যাত্রী তুলে ডাকাতির সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আজ শনিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে ডিবি।
গতকাল শুক্রবার ডিএমপির মিডিয়া শাখা থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় জানানো হয়েছে, রাজধানীতে গভীর রাতে বাসে যাত্রী তুলে বাস ডাকাতি মামলার আসামি গ্রেপ্তার ও আলামত উদ্ধারের ঘটনায় শনিবার বেলা ১১টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টার সংবাদ সম্মেলন করবেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ বাস ডাকাতির ঘটনা নিয়ে ‘রাতভর মৃত্যুর বিভীষিকা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে দেশ রূপান্তর। ওই ডাকাতির ঘটনায় ভুক্তভোগীদের কেউ মামলা না করায় বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অগোচরে ছিল। দেশ রূপান্তরে সংবাদ প্রকাশের পর তদন্তে নামে ডিবি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গ্রেপ্তাররা দুর্ধর্ষ ডাকাত। তাদের দলনেতা খুবই ভয়ংকর। রাজধানী ও এর আশপাশে খুবই হিংস্রভাবে ডাকাতি করে থাকে দলটি। চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আগেও ডাকাতির মামলা রয়েছে। সেসব মামলায় গ্রেপ্তারের পর জামিনে মুক্তি পেয়ে ঘটনার রাতে ফের ডাকাতি করে তারা। এ চক্রে রয়েছে দক্ষ চালকও।
১২ ফেব্রুয়ারি বাস ডাকাতির ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার (২ মার্চ) ডিএমপির দারুস সালাম থানায় মামলা করেছেন ভুক্তভোগী মো. নাসরুল (৩২)। মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, নাসরুল রিসাত পরিবহনের ঢাকা মেট্রো-গ-১৩-০৫৯২ বাসটি গাজীপুর থেকে ছেড়ে কোনাবাড়ী-নবীনগর-গাবতলী-যাত্রাবাড়ী-পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা রুটে চালান। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে যাত্রী না থাকায় বাস কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দারুস সালাম থানাধীন গাবতলী পর্বতা সিনেমা হলের ডানপাশে রাস্তার ওপরে বাসটি রেখে বাসের দরজা লক করে ভেতরে চালক ও তার সহকারী এবং সুপারভাইজার পেছনের সিটে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ৮-১০ জন লোক গাড়ির দরজা কৌশলে খুলে বাসে অতর্কিতভাবে উঠে তাদের হাত পেছনে বেঁধে লোহার পাইপ দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করতে থাকে ও তাদের মধ্য থেকে একজন চালকের সিটে গিয়ে বাস চালিয়ে শ্যামলীর দিকে যেতে থাকে। এ সময় অন্যরা বিভিন্ন ধরনের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র উঁচিয়ে প্রাণে মেরে ফেলার ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের ফোন ও টাকাপয়সা নিয়ে নেয়। পরে তাদের সবার চোখ বেঁধে বাসের পেছনের সিটের ওপর ফেলে রাখে। কোনো কথা বলতে গেলেই ডাকাতরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মারধর করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় নীলাফুলা জখম করে ও মেরে ফেলার ভয় দেখায়। বাসটি চলন্ত অবস্থায় তারা মাঝেমধ্যে বাস থামিয়ে যাত্রী তুলে তাদের মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে বলে যে, ‘আমরা ডাকাত চুপ করে থাক, যা চাই তা দিয়ে দে নইলে তোদের জীবন শেষ করে দেব’। তারপর ডাকাতরা সাভার থানাধীন কবিরপুরে নেমে যায়। কিছুক্ষণ পর ডাকাতদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একে অন্যের হাতের বাঁধন খুলে দেখেন আরও কয়েকজন যাত্রীকে একইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের নাম ডা. শাওন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের সামনে থেকে তিনি ওঠেন বলে জানান। ডাকাতরা যখন তাদের ছেড়ে চলে যায় তখন সময় ভোর সাড়ে ৬টা।
ভুক্তভোগী রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের চিকিৎসক শাওন চৌধুরী জয় জানান, তার চোখ বেঁধে বাসের পেছনে নিয়ে বসিয়ে রাখে। তার কাছে থাকা ১২ প্রোম্যাক্স আইফোন, ৭ আইফোন, নগদ সাড়ে চার হাজার টাকা, হাতঘড়ি ও ব্যাংকের এটিএম কার্ড নিয়ে গেছে ডাকাত দল। তাকে মারধরও করেছে তারা।
রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলের আলো ঝলমলে অডিটোরিয়ামে দেশি-বিদেশী মডেল ভাড়া করে এনে সাড়ম্বরে ঘোষণা করা হয়েছিল প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক নারী ফুটবল আসর ওমেন্স সুপার লিগের। সিনে জগতের তারকাদের সঙ্গে মঞ্চে র্যাম্প করতে করতে প্রত্যাশার ঘুড়িটা দূর আকাশে উড়িয়েছিলেন সাবিনা-সানজিদারা। দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন এখন তারা। ফুটবলপ্রেমীদের তাদের নিয়ে অসীম আগ্রহকে পুঁজি করে কে-স্পোর্টস আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট করে ফায়দা লুটতে। তবে দিন যত গড়িয়েছে, মেয়েদের স্বপ্ন ধূসর হয়েছে। এখন তো তা মিলিয়ে গেছে বহুদূরে।
কে-স্পোর্টস-বাফুফের কর্তারা বুঝেছেন, তাদের লেখা চিত্রনাট্য আর বাস্তবতায় বড্ড ফাঁরাক। তাই তারা বারবার টুর্নামেন্ট শুরুর তারিখ দিয়েও আলোচিত টুর্নামেন্টকে মাঠে নিয়ে যেতে পারেননি। সর্বশেষ ১০ জুন আসর শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন খোদ বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। সেটাও মিথ্যে হয়ে গেছে। তাই হতাশা ছাঁপিয়ে নারী ফুটবলারদের মনে ভর করেছে রাজ্যের ক্ষোভ।
কে-স্পোর্টস আর বাফুফের কর্তারা ভেবেছিলেন এমন একটা টুর্নামেন্টের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করতে হামলে পড়বে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। গত বছর নেপালে সাফ শিরোপা জয়ের পর মেয়েদের নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সেটাই আসলে স্বপ্নবাজ করে তোলে সালাউদ্দিন-মাহফুজা আক্তার-ফাহাদ করিমদের। তবে হয়েছে উল্টো। সেটাই যে হওয়ার কথা! কে-স্পোর্টস কিংবা বাফুফে, দুটি প্রতিষ্ঠানই যে এখন ভীষণভাবে ইমেজ সঙ্কটে ভুগছে। এর মাঝে অগোচরে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে, যেটা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না। কে-স্পোর্টস আর বাফুফের দেখানো স্বপ্নে বুদ হয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলাররা। এমন একটা টুর্নামেন্টে খেলতে মুখিয়ে ছিলেন তারা। এমনিতে ঘরোয়া ফুটবল খেলে সেভাবে পারিশ্রমিক জুটে না। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে হলে একটা আকর্ষণীয় পারিশ্রমিকের হাতছানি ছিল। তারচেয়েও বেশি ছিল নানা দেশের নামী-দামী ফুটবলারদের সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করার সুবর্ণ সুযোগ। দারুণ একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নে মুখ বুজে মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন দিনের পর দিন। এর মাঝেই তারা দেখেছেন বাবার মতো কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের বিদায়। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর ন্যায্য দাবী পুরোপুরি পূরণ না হওয়ার পরও তারা বাফুফের কঠোর অনুশাসন মেনে দুঃসহ গরমে সকাল-বিকাল ঘাম ঝড়িয়েছেন। এরপর যখন দেখলেন এই স্বপ্ন বারবার হোচট খাচ্ছে কে-স্পোর্টসের ব্যর্থতা আর বাফুফের অদূরদর্শীতায়, তখন আর মুখ বুজে থাকতে পারলেন না। হতাশার কথা জানাতে গিয়ে অগোচরে তাদের কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এসেছে ক্ষোভের আগুন।
অবস্থা বেগতিক দেখে তড়িঘড়ি বৃহস্পতিবার ক্যাম্প বন্ধ ঘোষণা করে বাফুফে। সিনিয়র খেলোয়াড়দের দেওয়া হয় পাঁচ দিনের ছুটি। বৃহস্পতিবার রাতে বাসে করে সাতক্ষীরাগামী সাফজয়ের অগ্রনায়ক সাবিনা খাতুন দেশ রূপান্তরকে মুঠোফোনে বলছিলেন, 'ওমেন্স সুপার লিগ স্রেফ আমাদের আবেগ নিয়ে খেললো।' একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, 'প্রথমত সাফের পর কোন খেলা নেই। তারপর এই লিগ মেয়েদের নিয়ে দুই দফা এত কিছু করলো, এত আশা দিলো, মেয়েরা খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল। আর সব থেকে বড় ব্যাপার বিদেশী খেলোয়াড় যারা দক্ষিণ এশিয়ার, তাদের নিয়ে আমি নিজেও কাজ করছিলাম। তাদের কাছে এখন আমার সম্মান কই থাকলো! বারবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। মেয়েরা অনেক আশায় ছিল। কিন্তু... । এটা নিয়ে অবশ্য মেয়েরা অনেক আগেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আমিও কোন আশা দেখছি না।'
সতীর্থদের সংগে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরে বাড়ির যেতে যেতে জাতীয় দলের রাইট উইঙ্গার সানজিদা বলছিলেন, 'আসলে কিছু বলার ভাষাই হারায় ফেলেছি। একটা টুর্নামেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমরা কঠোর অনুশীলণ করছিলাম। আশা ছিল খেলবো। এখন সেটা হচ্ছে না বলে খুব কষ্ট লাগছে। যখন শুনলাম লিগটা হবে না, তখন মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, বুঝতেই পারছেন।'
সাফের পর কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সিনিয়র ফুটবলাররা। এ নিয়ে ভীষণ হতাশ সানজিদা বলেন, 'নয়টা মাস ধরে অপেক্ষায় আছি খেলার। প্রীতি ম্যাচ বলেন কিংবা কোন টুর্নামেন্ট, একটা ম্যাচও আমরা খেলতে পারিনি সাফের পর। অথচ আমাদের সঙ্গে যারা সাফে খেলেছে, তারা প্রায় সবাই পাঁচটা-ছয়টা করে প্রীতি ম্যাচ খেলে ফেলেছে এর মধ্যে।' মেয়েদের সিঙ্গাপুরে গিয়ে প্রীতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল, মিয়ানমারে অলিম্পিক বাছাই খেলার কথা ছিল। অথচ বাফুফে অর্থ সঙ্কটসহ নানা অযুহাতে তাদের খেলতে পাঠায়নি। সানজিদা বললেন, 'আমরা আসলে হতাশ হতেও ভুলে গেছি। বারবার টুর্নামেন্টে খেলার কথা বলা হয়, আবার সেটা বাতিল হয়। এরকমটা হতে হতে আসলে আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে গেছি।'
হতাশা, বঞ্চনায় বাফুফের চাকুরি থেকে পদত্যাগ করেছেন নারী দলের প্রধান কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন। প্রিয় কোচের জন্য কষ্ট পান সানজিদা, 'ছোটন স্যারের হাত ধরেই আমার এখানে আসা। তার কাছেই আমার ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠা। তিনি চলে গেছেন। এতে খুব কষ্ট পাই। তিনি আমাদের অনেক আদর-যত্ন করতেন। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যেমন হয়, ঠিক তেমন সম্পর্ক ছিল।'
১৩ জুন সাবিনা-সানজিদাদের ক্যাম্পে ফেরার নির্দেশ দিয়েছে বাফুফে। বিকল্প নেই বলে তারা হয়তো ফিরবেন। তবে ফেরার সময় তাদের চোখে থাকবে না বড় কোন স্বপ্ন। সেটা দেখাই বারণ। কে-স্পোর্টস আর বাফুফে মিলে যে মেয়েদের সব স্বপ্ন গলা টিপে মেরে ফেলেছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর মেয়ের জামাতাকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার, কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশনসহ অন্যান্য প্রটোকল দেওয়ার একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
অনেকেই চিঠিটি শেয়ার করে সমালোচনা করছেন। কেউ বলছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই বলে কথা! কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, মন্ত্রীর মেয়ের জামাই প্রটোকল কোন হিসেবে পান? আবার কেউবা বলছেন, একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে!
জানা যায়, গত ৬ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। পরে ৭ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালককে চিঠিটি পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে চিঠিটির সত্যতাও পাওয়া যায়।
মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখার উপসচিব ড. অমিতাভ চক্রবর্ত্তী স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল হকের মেয়ের জামাতা মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান ৯ জুন শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট নম্বর ইকে ৫৮৬ যোগে দুবাই থেকে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন। তাকে বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহারের অনুমতিসহ মন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার মশিউর রহমানকে কাস্টমস ব্যাগেজ, ইমিগ্রেশন এবং বিমানবন্দরের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য বোর্ডিং ব্রিজ পাস দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিমানবন্দর পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গুরুত্বপূর্ণ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যবহারের জন্য পৃথক লাউঞ্জ রয়েছে। যেটাকে ভিআইপি লাউঞ্জ বলা হয়। ভিআইপি লাউঞ্জ কারা ব্যবহার করতে পারবেন এমন একটি স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের।
লাউঞ্জ রজনীগন্ধা, বকুল, দোলনচাঁপা ও চামেলি নামে বিমানবন্দরে ৪টি ভিআইপি লাউঞ্জ রয়েছে। রজনীগন্ধা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ভিআইপিরা ব্যবহার করেন। বকুল ব্যবহার করেন অতিরিক্ত সচিব বা তার পদমযার্দার ও সমমর্যাদার ব্যক্তিরা। দোলনচাঁপা ব্যবহার করেন সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আর চামেলি দিয়ে একুশে পদক পাওয়া ব্যক্তি, সংবাদপত্রের সম্পাদক ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা প্রবেশ ও বের হতে পারেন।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।